ফেসবুকে একটা লিঙ্ক বেশ কবার শেয়ার হয়েছে দেখলাম। খবর24 নামের একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম- “কাকে বিয়ে করবেন? জেনে নিন পাত্রী খোজের গাণিতিক সূত্র”।

‘খোঁজ’ শব্দটির বানান তারা ভুল করেছে, তবে সেটা নিয়ে আসলে কথা বলার কিছু নেই; আছে তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচার নিয়ে।

পাত্রী বা সহধর্মিনী কিংবা প্রেমিকা খোঁজার জন্য গাণিতিক গবেষণা হতেই পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাকে সবারই স্বাগত জানানো উচিত। এবং সেটা হয়েছেও। যদি গুগল করেন, “Mathematical formula for the perfect wife”, তাহলে শ’য়ে শ’য়ে সার্চ রেজাল্ট পাবেন, এবং উপরদিকেই পাবেন দ্যা টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এই খবর। এই খবরের ওপর ভিত্তি করে টপিকটি অনেক জায়গাতে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকগুলো লেখা পড়ে দেখলাম, প্রায় সবই লেখা হয়েছে টেলিগ্রাফের রিপোর্টটির ওপর ভিত্তি করে। তারপর আরেকটি লেখা পাওয়া গেলো, ক্রিস মাতিস্ক এর নিবন্ধ। এই লেখা থেকে সূত্র নিয়ে মূল গবেষণাটির অ্যাবস্ট্রাক্ট পড়ার সুযোগ ঘটল।

এই অ্যাবস্ট্রাক্টে কী রয়েছে? বয়সের ব্যবধান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং লেখাপড়ার পরিমাণ এবং বুদ্ধিমত্তার মাপের সাথে পারিবারিক অবস্থার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে, এমনটাই আমরা অ্যাবস্ট্রাক্ট থেকে দেখতে পাই। টেলিগ্রাফের খবর এবং ক্রিস মাতিস্কের লেখাতেও এই জিনিসগুলোই মূল ফোকাস পেয়েছে। নেটে পাওয়া অন্যান্য লেখাগুলোর অধিকাংশই টেলিগ্রাফের লেখাটির অংশত বা পূর্ণাঙ্গ কপিপেস্ট। অ্যাবস্ট্রাক্টে যে লেখাটি দেখেছেন, তার সাথে এই খবরগুলোর কোনোই ব্যত্যয় নেই। আছে কেবল এক জায়গায়, এবং হতাশা, সেটি বাংলা ভাষায় লেখা।

খবর24 এ প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে কিছু বলার আগে, ফেসবুক বন্ধু রথীর কিছু লেখা উদ্ধৃত করি। তাঁর প্রোফাইলে লিঙ্কটি দেখার পরই আমার খোঁজাখুঁজির শুরু।

সমমর্যাদার মোড়কের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে “গনিত” কেও ব্যবহার করা হচ্ছে “নারী”দের ক্লাসিফাই করতে!”

গবেষণায় দেখা গেছে ফর্সা মেয়েদের তুলনায় শ্যামলা, উজ্জ্বল শ্যামলা কিম্বা কালো রং এর মেয়েরা স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের বেশী ভক্তি করে।”–এইটা বলে আসলে মেয়েদের মনের ভেতরেই একটা বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, একটা মানুষ কালো না সাদা- এইটার জন্য যদি তার মেন্টালিটি ভিন্নতা পায় তার জন্যেও কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দায়ি, একটা কালো মেয়ে “স্বামী”র বাধ্য হবে, কারন তার একটা দোষ আছে-সে কালো,দোষওয়ালা মেয়ে বিয়ে করছে আর “স্বামী”র বাধ্য হবে না-এইটা তো মানা যায় না,আচ্ছা, গবেষণা মতে তাইলে আফ্রিকান মেয়েরা খুব পতিভক্ত, তাই না?

”গবেষণায় আরো দেখা গেছে স্বাস্থ্যবতী মেয়েরা শান্ত শিষ্ট ও ধর্য্যশীল হয় আর ক্ষীন স্বাস্থ্যের মেয়েরা খিটখিটে মেজাজের হয়।”-ওহ তাইলে তো এখন হইতে চিকন স্বাস্থ্য মোটা ও সুন্দর করিবার আশায় গরুর ট্যাবলেট সেবন শুরু করিতে হইবে, না কি?

এবার আসি সবচেয়ে হাইলাইটেড কোথায়-“জানা গেছে, যে পাত্রীরা তুলনামূলক আলজেবরায় ভালো, তারা সাংসারিক দুঃখ সুখ শেয়ারিং এ ভালো, আর যারা পাটীগণিতে ভালো তারা কিছুটা স্বার্থান্বেষী ধরণের হয়। আর জিওমেট্রিতে ভালো যারা, তাদের লোভ বেশী থাকে। “এই তো তোমাদের গবেষণার আসল পর্যবেক্ষণ পরিলক্ষিত হইল…মেয়েদের পড়ালেখার গন্ডি তাইলে এস, এস, সি পর্যন্তই যথেষ্ট! এর পরের শিক্ষা আসলে মেয়েদের বুদ্ধি, চিন্তা বিকাশে নিতান্তই অর্থহীন, এখানে ইনিয়ে-বিনিয়ে বুঝানো হয়েছে, “ইয়ে মানে, শেষমেশ সংসারই তো করবা, আর ওই মেট্রিকের লেখাপড়া দিয়াই কিন্তু তোমাদের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, এরপর যত পড়ালেখা কর, তোমাদের মানসিক বিকাশ এখানেই স্থগিত থাকতেছে কিন্তু”

খবর24-এ প্রকাশিত এই যে কথাগুলো, এগুলো কি আসলেই গবেষণায় ছিল? একটা অংশ দেখে দ্বিধার সূত্রপাত, সেটা হল ফর্সা-শ্যামলা-কালো। ইউরোপিয়ান একটি গবেষকদল ফর্সা-শ্যামলা পাবে কোথায়? ককেশিয়ান আর নিগ্রোদের নিয়ে কথা বলা এক কথা, ফর্সা-শ্যামলা নিয়ে কথা বলা একেবারেই অন্য কথা। ফর্সা-শ্যামলার এই বিষয়টি উপমহাদেশের একচেটিয়া। ইউরোপের গবেষণায় এটা ফিচার্ড অংশ হবার কথা নয়। এই দ্বিধা নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম, এবং স্তব্ধ হয়ে লক্ষ্য করলাম, খবর24 ছাড়া অন্য কোনো খবরেই এরকম কোনো কথা লেখা নেই! একইভাবে লেখা নেই স্বাস্থ্যবতী-ক্ষীণস্বাস্থ্য, পাটিগণিত-অ্যালজেব্রা এবং চিকনকন্ঠ-সুরেলাকন্ঠ-মোটাকন্ঠের কোনো কথা।

এই মিথ্যাচারের অর্থ কী?

মিলিয়ে দেখুন, যেসব তথ্য তারা ইউরোপিয়ান গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে পেয়েছে, সেই তথ্যগুলো শেষ হয়েছে ‘হতে হবে’ শব্দবন্ধটি দিয়ে- ‘হতে হবে’ নিশ্চিত একটি সুর প্রকাশ করে। এর পরে তারা মিশিয়েছে তাদের গোবরে ভর্তি মস্তিষ্কের অবদান, যেগুলো শেষ হয়েছে ‘হয়’ দিয়ে। অনিশ্চিত সুর, বিশ্বাসের সুর। কোনো একটি গর্দভ পুরুষ এই লেখাটি প্রসব করেছে, এবং নিজের পুরুষবাদী ভ্রান্ত ধারণা এখানে ঢোকানোর সময়ে দুর্গন্ধটা লুকোতে পারেনি। খবর24-এর লেখাটা আরেকবার পড়ে নিন, এবারে স্পষ্ট বুঝবেন।

আমার দুটো পয়েন্ট।

পয়েন্ট ১. একটি গবেষণা সম্পর্কে প্রকাশিত খবরের সাথে নিজের দুর্গন্ধযুক্ত মস্তিষ্কের প্রসব করা কথা মিশিয়ে দেবার সাহস এই লোকের কী করে হয়? গবেষণা জিনিসটা কি ফাজলামি জাতীয় কিছু? একটা পরিসংখ্যানিক গবেষণাকে অপমান করার সাহস এদের কী করে হয়? কেউ যদি এই ফিচারকারীকে চিনে থাকেন, তাহলে আমার পক্ষ থেকে তার দুগালে সজোরে দুটো চপেটাঘাত করে দিলে, আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ হব।

পয়েন্ট ২. নারীদের সম্পর্কে এই দেশের পুরুষের কী ধারণাগুলো পোষণ করে, সেটা যতবার প্রকাশিত হয়ে পড়ে, শিউরে উঠতে হয়। নারীদের শিক্ষাগত অবস্থান, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে এড়িয়ে সমাজের অধিকাংশ পুরুষ, এবং অনেক নারীও, মজে আছে নারীর শারিরীক বৈশিষ্ট্য, এবং তার গায়ের রঙ নিয়ে। আমাদের এই বর্ণবাদীতার শেষ হবে কখন?

খবর24 এর মিথ্যাচার নিয়ে পড়লেন। এখন মূল রিপোর্টের প্রধান ফিচার্ড ধারণাগুলো আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নিন।১. বর-কনের বয়সের পার্থক্য পাঁচ বছরের কাছাকাছি হওয়া উচিত।২. তাদের একইরকম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা উচিত।৩. নারীর পুরুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হওয়া উচিত।৪. পুরুষের চেয়ে নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি থাকা উচিত।৫. এবং বিয়ে বিষয়টি মূলত পারস্পরিক সহযোগিতার ওপরে সবচাইতে বেশি নির্ভরশীল।

এর বাইরে কালো-ফর্সা, চিকন-মোটা, পাটিগণিত-বীজগণিত বিষয়ক বেহায়া মতবাদগুলো আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে দিন। আর একটা গবেষণার ফলাফল নিয়ে যারা ফাজলামি করতে পারে, তাদের মুখে আমার পক্ষ থেকে কয়েকদলা থুতু নিক্ষেপ করলাম।

সব কথার শেষ কথা, আপনার আশপাশে যেসব পুরুষবাদী পশু আছে, তাদের জন্য কী বিধান?

পরিমল ঘটনার কথা মনে আছে? সেসময় কিছু মানুষরূপী পরিমলসমর্থককে বলতে দেখেছিলাম, “এক হাতে তালি বাজে না।”
আমার দেখা শ্রেষ্ঠ উত্তর, “এক হাতে কষে থাপ্পড় মারা যায়।