সম্প্রতি একজন জনপ্রিয় লেখক প্রশ্ন তুলেছেন বংলাদেশের মানুষ কেন ভারত বিরোধী এর জবাবে অনেকেই বলে ভারত আমাদিগকে হেয় করে। লেখকের পাল্টা প্রশ্ন সৌদিরা মিসকিন বললে তা কেন হেয় করা হয়না। আমি এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এই লেখাটি দাঁড় করিয়েছি। এর মাধ্যমে সেই প্রশ্ন দুটির জবাব দিতে চেষ্টা করলাম।
আমি বাঙালি মুসলমানের সন্তান। পৃ্থিবীতে আমি যখন ভূমিষ্ট হই তখন আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রথম যে বাক্যটি আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করানো হয়েছিল তা আমার মাতৃভাষায় নয়, ভিন্ন এক ভাষায়। আমার নাম রাখার সময় বাংলা নয় ভিনদেশী ভাষার অভিধান ঘেঁটে আরবি এবং ফার্সিভাষার মিশেলে আমার নামকরণ করা হয়েছিল। বাংলা বর্ণমালা শিক্ষার আগে আমাকে শিখতে হয়েছে আরবি আলিফ বে তে ছে ইত্যাদি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঈশ্বর নামের যে স্বত্বাটির বন্দনা করে আমার দিন শুরু করতে হয় সেই ঈশ্বর এই জল হাওয়া মৃত্তিকাজাত নয়। হাজার হাজার বছর সে পাথরের প্রতিমা হয়ে পূজিত হয়েছে মরু প্যাগানদের দ্বারা। তার প্রভাব সেইসব মূর্তিপূজকদের কাছে এতটাই প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে তারা তাদের সন্তানদের নামের সাথেও সেই দেবতার নাম জুড়ে দিত। এর প্রমাণ কাবা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আব্দুল মোতালিব তার এক পুত্রের নামকরণ করেন আব্দুল্লাহ। তারপর ইতিহাসের কোনো এক সন্ধিক্ষণে সেই পাথরের দেবতা নিজের সহ সঙ্গীয় তিনশত ষাট মূর্তিকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে হয়ে যান নিরাকার ঈশ্বর। মরুর বুকে তা ছিল অভাবনীয় এক দেবতা বিদ্রোহ। কালক্রমে পাথুরে ঈশ্বরের চেয়ে নিরাকার ঈশ্বরের শক্তি এতটাই প্রবল হয়ে উঠে যে তা বানের পানির মত বিস্তৃত হয়ে যায় চারদিকে। সেই ছড়িয়ে পড়া পানিতে স্নাত হন আমার পূর্বপুরুষও। শিব কৃষ্ণ দূর্গা মনসা ছেড়ে তারা অনুগত হন এককালের মরু দেবতার কাছে যিনি তখন আর দেবতা নন স্বয়ং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। আমি সেই পূর্বপুরুষের প্রশ্নহীন উত্তরাধিকারী। আমার শরীরে আমার জীবনাচারে আমার নিজের কোনো অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার চুল দাঁড়ি আমার নিজের নয়। আমার পোষাক আমার শিষ্টাচার সামাজিকতা কিছুই আমার নয়। এমনকি আমার নিম্নাঙ্গের পুংস্বত্বাটির দিকে তাকিয়ে দেখি সেটাও নিরংকুশ আমার নয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইহুদির সেই আদি বর্বর প্রথা নতুন ধর্মে দীক্ষিত মরু পৌত্তলিকদের মাধ্যমে আমদানী হয়ে আমার এই নিখুঁত এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর অঙ্গটিকেও ব্যবচ্ছেদ করে গেছে।
আমার স্বাধীন একটি দেশ আছে কিন্তু সেই স্বাধীনতাও এসেছে অন্য একটি দেশের প্রত্যক্ষ্য সহায়তায়। আমার যে পতাকার ডিজাইন তাও এসেছে এক হিন্দুর হাত দিয়ে। আমার যে জাতীয় সঙ্গীত তাও ভিনদেশী আরেক হিন্দু কবি থেকে নেয়া। আমার যে জাতীয় কবি তিনি মুসলমান হলেও আপাদমস্তক তিনি হিন্দুস্থানী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হলেও আমাকে চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় ভারত। আমার পবিত্র ঈদের প্রধান উপকরণ গরু আসে ভারত থেকে, ভারতের পিঁয়াজ না আসলে মাংস সিদ্ধ হয়না এমনকি ডিম আর কাঁচা মরিচটির জন্যও নির্ভর করতে হয় ভারতের উপর। আমার দেশে কে ক্ষমতায় থাকবে তাও নির্ধারণ করে ভারত। আমার দেশের শাসকেরা যখন ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে হাড্ডি নিয়ে কামড়া কামড়ি করা কুকুরের মত সহিংস হয়ে যান তখন এদেরকে শান্ত করতে হয় বিদেশের মিশন কর্তাদের।
আমরা আমাদের প্রধান আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের নামকরণ করেছি মধ্যপ্রাচ্যের অজ্ঞাতকূলশীল এক পীরের নামে (শাহজালাল), দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের নামকরণ করেছি এক অবাঙ্গালি বিহারীর নামে(শাহ আমানত), উত্তরবঙ্গ এয়ারপোর্টের নামকরণ করেছি পশ্চিমা আরেক পীরের নামে (শাহ মখদুম)। আমরা ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে বাপ পুতে লাঠালাঠি মাথা ফাটাফাটি করে অকাতরে প্রাণ দিই। এবার বলুনতো সৌদিরা যখন আমাদেরকে মিসকিন বলে গালি দেয় তা কি মিথ্যা কিছু বলে? বাঙ্গালি মুসলমানের সমতুল্য এমন আদর্শ আরেকটি মিসকিনের জাত এই গ্রহে আর কটি আছে বলুনতো? হাঁ, আরেকটা আছে, আর সেটি হল বর্তমানে বিশ্ব-মিসকিন বলে পরিচিত আমাদের বড়ভাই পাকিস্তান (আর্থিক দিক দিয়ে তারা মিসকিন হলেও ঐতিহ্য আর স্বকীয়তায় তারাও আমাদের মত এত নিম্নমানের মিসকিন নয়) চোরকে চোর বললে ডাকাতকে ডাকাত বললে তার যেমন মানহানী হয়না তেমনি আমাদিগকে মিসকিন বললে আমাদের শরীরে ফোস্কা পড়ার কোনো কারণ থাকতে পারেনা বরং গর্বিত হওয়ারই কথা।
এবার আসুন ভারত বিরোধিতা প্রসঙ্গে। ভারতকে আমরা ঘৃণা করি এর অন্যতম প্রধান কারণ ভারত আমাদের সহোদর দুই ভাইয়ের মাঝে বিভাজন এনেছে। ভ্রাতৃবিরহের সেই জ্বালা এতটাই তীব্র যে তা একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজনের লাশের উপর দাঁড়িয়েই অনেক মুক্তিযোদ্ধা তীব্রভাবে অনুভব করেন। আর তার প্রথম প্রকাশ ঘটে মেজর জলিলের মাঝে যিনি পরবর্তিতে জলিল পীর হয়ে তসবি জপতে জপতে পাকিস্তানের পবিত্র মাটিতে দেহত্যাগ করে ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার গ্লানি এবং দায় থেকে মোক্ষ লাভ করেন। জলিল থেকে সেই জ্বালা খেতাবপ্রাপ্ত বেশিরভাগ টপ রেংকড মুক্তিযোদ্ধার মাঝেই সংক্রমিত হয়। এদের তীব্র আওয়ামী বিরুধী অবস্থান মুলত সেই ভারত বিরুধিতারই প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পেছনেও সেই ভারত বিরু্ধিতা, ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের অপরাধবোধ থেকে মোক্ষ লাভ ছিল প্রধান অনুঘটক। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও কি ভ্রাতৃবিরিহের সেই দংশন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন? স্বাধীন একটি দেশের একচ্ছত্র নেতা হয়েও কি তিনি বুকের ভেতর বড় ভাইয়ের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করেননি? নইলে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্টিত ও আই সি সম্মেলনে যেতে কেন তিনি একাত্তরের গণ-হত্যার নেপথ্য কুশীলব ভুট্টুকে এদেশ সফরের শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন? ভুট্টুর বর্বর সেনাদের রেখে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ দেখাতে? না, তিনিতো তাকে নিয়ে কোনো বধ্যভূমি পরিদর্শনে যাননি। বরং দেখা গেছে উল্টো চিত্র। মফস্বলের অজপাড়াগাঁ থেকে ঢাকার একটি কলেজে পড়তে যাওয়া এক তরুনের চোখে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছি সেদিনের সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর দুইপাশ লোকে লোকারণ্য। ভুট্টুকে দেখার জন্য বাঙালির কী অসীম ব্যাকুলতা। রক্ষীবাহিনী সমানে চড় থাপ্পড় দিয়েও ভুট্টুকে বহনকারী ছাদখোলা গাড়িকে আলিঙ্গন করতে যাওয়া ভক্তদের নিবৃত্ত করতে পারছেনা।
সময়ের হিসাবে মাত্র ৭৬৫দিনের ব্যবধানে বাঙালিকে তার ত্রিশলাখ স্বজনের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়ে এমন আবেগ আর ভালবাসায় বরণ করতে দেখে সেদিনই আমার উপলব্ধি হয়েছিল আমরা আসলে বাঙালি নই, মুসলমান। আমাদের সেই উৎকট মুসলমানীত্বের প্রমাণ অবশ্য সেই যুদ্ধকালীন সময়েই দেখা গেছে। পাকিস্তানী বর্বর সেনারা যখন এদেশে পাখির মত মানুষ মারছে, পুরো দেশকে গনিমতের মাল হিসেবে লুন্টন করছে, ধর্ষণ করছে সেই ভয়াল কৃষ্ণপক্ষেও ২৭০১ জন মুসলমান ব্যক্তিগত পূণ্য লাভের আশায় হজ করতে মক্কা গিয়েছিলেন, চিন্তা করা যায়? ভুট্টু আসলেন, বাঙ্গালি মুসলমানের হৃদয় প্রাণ জয় করে, লাল গালিচা সম্বর্ধনা নিয়ে বঙ্গভবনে রাজকীয় খানা খেয়ে ছোটভাই মুজিবকে নিয়ে পাকিস্তান উড়ে গেলেন। তারপর যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা মুসলিম বিশ্বে আমাদের মুসলমানিত্ব হারিয়েছিলাম সেই পাকিস্তানে গিয়েই ও আই সির মাধ্যমে আমরা আবার তা ফিরে পেলাম।
এমন প্রবল ভাতৃপ্রেম যে জাতির মাঝে বিদ্যমান সেই জাতি কীভাবে সেই ভ্রাতৃত্ব ছেদনকারী দেশ ভারতকে বন্ধু দেশ বলে মেনে নেবে? অবশ্য বাঙালি মুসলমানের ভেতরের পুঞ্জিভূত সেই ঘৃণা দিনে দিনে সমুদ্রপ্রমাণ হয়ে যাবার পেছনে ভারতেরও কিছু দায় আছে, দায় আছে ভারতের একপেশে নীতির একমাত্র বেনিফিশিয়ারী দলের নেতা নেত্রীদের বালখিল্যসুলভ বিভিন্ন আচরণেরও। “মেরেছ কলসের কানা তাই বলে কি প্রেম দেবনা’ “ভারতকে এত দিয়েছি যা সে কোনোদিনও ভুলতে পারবেনা, বাংলাদেশ-ভারতের স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক, ভারতকে বলে এসেছি আওয়ামিলীগকে ক্ষমতায় রাখতে” ইত্যাদি বচনামৃত বাঙালি মুসলমানের ঘৃণানলে ঘৃতাহুতি দেয়ার মত যথেষ্ট শক্তিশালী উপকরণ তা বলাই বাহুল্য।
পুনশ্চ-১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নৃসংশভাবে হত্যার পর পরই সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পূর্বে ১৯৭২ থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের হজ গমনের সুবিধার্থে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেইসব পূণ্যার্থীর জন্য বিশেষ ভারতীয় পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে হজ করে আসা সেইসব হাজী সাহেবদের সন্তানদের এখন এক নম্বরের ঘৃণার তালিকায় ভারত। আমরা আসলেই মুসলমান। আমাদের শরীরে হিন্দুর রক্ত প্রবাহিত হলেও আমাদের চিন্তা মননজুড়ে সেই মরু ডাকাতদের ক্রুড়তা, হিংস্রতা অকৃতজ্ঞতা প্রবলভাবে বহমান।
আমরা আসলেই মুসলমান। আমাদের শরীরে হিন্দুর রক্ত প্রবাহিত হলেও আমাদের চিন্তা মননজুড়ে সেই মরু ডাকাতদের ক্রুড়তা, হিংস্রতা অকৃতজ্ঞতা প্রবলভাবে বহমান।
আসলেই একদম ঠিক বলেছেন।
আর বাংলাদেশের মানুষের মনোজগৎ যে এখনও আদিমতায় ভরা সেটা বারবার সর্বত্র চোখে পড়ে।
বাংগালীরা এখনও নিজেদের আইডেন্টিটি ঠিক করতে পারে নি।আমরা কি পরিচয়ে পরিচিত হব? মুসলমান নাকি বাংলাদেশী বাংগালী। এই মুল ক্রাইসিস ঠিক না করা পর্যন্ত আমাদের জাতির কারোই মনে হয় মুক্তি নেই।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এলিটদের ভূমিকা ও অবস্থান দেখলে সবচেয়ে বেশী মাথা ঝিমঝিম করে।
আর সব রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা তো শুধু ক্ষমতার পালাবদল। সব দলগুলোর মানুষ কিন্তু সেসব দলের লেজুড়বৃত্তি করা ছাড়া কিছুই করার নেই।
রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মনোজগৎ থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার জন্য যেসব বেসিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আছে তা নিজেদের হাতে কব্জা করে রেখেছে।
সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যবস্থা, আমলা,সেনা,মাফিয়া, মাফিয়া ব্যবসায়ীরা দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিচালিত।
এতো বেশী অনৈতিক,নির্লজ্জ এমন হেন কিছু নেই যা এই রাজনৈতিক দলের লোকেরা করে না। তারাই আইন কানুন বলুন আর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বলুন সেগুলোর পেয়ারদার।
বাংলাদেশ তাই সব সম্ভবের দেশ।এখানে টাকা থাকলে সবকিছু করাই সম্ভব।টাকাই সব। টাকা দিয়ে সবকিছু কেন সম্ভব।সেটাই আম জনতা দেখে আসছে।
তাই জ্ঞানের এখানে কোনো কদর নেই।
যদি জ্ঞানের কোনো কদর না থাকে তখন সেখানে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা সৃষ্টি হতে থাকবে।
সেটাই আমাদের রাজনীতিবিদ-রা খেলে যাচ্ছে।
সেই বিশৃঙ্খলার মূল বিষয় হলো শিক্ষা ব্যবস্থা আর ধর্মের আফিম আম জনতাকে সারাক্ষণ গিলানো।
তার পিছনে বসে আছে, মধ্যপ্রাচ্য, আরব শক্তি, ইউরোপিয়ান শক্তি।ভারত, রাশিয়া। আরও গভীর পিছনে বসে দাবার খেলে যাচ্ছে আমেরিকা আর চীনের প্রভাব ও শক্তি।
ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
apnar lekha osadoron ….
অসাধারণ লেখনী। কী বলবো? কিছু বলার ভাষা নেই 😭 জন্মই আমার আজন্মের পাপ!
আমি একজন নাস্তিক কিন্তু আমি হিন্দুত্ববাদী ভারত পছন্দ করি না
স্বাধীনতার এত বছর পর ভারতের (পড়ুন হিন্দুদের) মানসিকতা এমন পরিবর্তন কেন হল বলে মনে করেন? এটা ক্রিয়া না কি প্রতিক্রিয়া?