সিফিলিস নামে একটা প্রাণাঘাতী যৌনবাহিত অসুখ আছে, যেইটার উতপত্তিস্থল নিয়া নানান মত শোনা যায়। তবে অসুখটার নাম সিফিলিস হিসেবে প্রথম ব্যবহৃত হয় ইতালীয় এক কবির কবিতায়। ১৫৩০ সালে ল্যাটিন ভাষায় রচিত এক কবিতায় কবি জিরোলামো ফ্রাকাস্তেরো দেখাইতেছেন যে, ‘সিফিলাস’ নামে এক মেষপালক ভয়ানক এক অসুখে আক্রান্ত। অসুখটার নাম, কবির কলমে এবং ল্যাটিন ভাষায়, Syphilis sive morbus gallicus – যার অর্থ হলো ‘সিফিলিস বা ফরাসী অসুখ।’ কবিতার প্রধান চরিত্র সিফিলাসের যে অসুখ, তারই নাম সিফিলিস। সেই একই কবি পরবর্তীতে De Contagione et. Contagiosis Morbis বা “সংক্রমণ ও সংক্রামক ব্যধি সম্পর্কে” নামক একখানা মেডিক্যাল পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, এবং তাতে এই অসুখ প্রথমবারের মত অন্তর্ভুক্ত হয় ‘সিফিলিস’ নামে।
এই কবি যে একজন শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, তা তো আমরা দেখতেই পারতেছি। তিনি একাধারে কবি, ডাক্তার, জতির্বিদ এবং গনিতজ্ঞ হিসেবে সুখ্যাত ছিলেন। তো, এই রকম একজন মানুষ, ইতালীর মানুষ, এই অসুখের নামকরণ করলেন ‘ফরাসী অসুখ।’ ইউরোপে সিফিলিসের প্রথম বড় আকারের তথা মহামারী আকারের সংক্রমণ ঘটে ১৪৯৫ সালের দিকে ইতালীর নেপলস শহর থেকে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, নেপলস শহর অবরুদ্ধ করে রাখা ফরাসী সেনাদের ছাউনি থেকে। ফরাসী রাজা চার্লস তখন নেপলস দখলের উদ্দেশ্যে শহরটাকে ঘিরে রেখেছিলেন, অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। অসুখটা যেহেতু নতুন ছিল, তাই এর কোন মেডিকেল নাম ছিল না তখনও। পুর্বোক্ত কবি মহাশয়ই প্রথমবার তাকে লিখিত কাগজে ধারণ করলেন – কবিতায় এবং ডাক্তারী বইপত্রে। তিনি এই রোগের নামকরণ করলেন তেমনটা নাও হতে পারে – হয়তোবা এই অসুখকে কবির আশেপাশের মানুষেরা সবাই ‘ফরাসী অসুখ’ নামেই ডাকত। কবি শুধুমাত্র কবিতায় একটা চরিত্রের অবতারণা করে সেই চরিত্রের নামানুযায়ী এই রোগকে একটা আপাতঃ নিরপেক্ষ নাম দিলেন, যদিও তার কবিতাতে একে ফরাসী অসুখ বলা হয়েছে।
নেপলস শহরে যুদ্ধের কথা বলতেছিলাম। দখলদার ফরাসী রাজা চার্লসের হয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিল ভাড়ায় খাটা কিছু স্প্যানিশ সৈন্য (মার্সেনারিজ বলে যাঁদেরকে। এরা টাকার বিনিময়ে যে কোন রাজার হয়ে যুদ্ধ করে – এই জিনিসটা সেকালে খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসেও এইরকম পাইবেন প্রচুর)। সেই ভাড়াটে স্প্যানিশ সেনারাই এই অজানা অসুখ নিয়ে আসেন নেপলসে, এবং সেইখান থেকে তা বাকী সৈন্য ও স্থানীয়দের মধ্যে ছড়ায়। ঠিক এই কারণে সিফিলিসের উতপত্তি নিয়ে একটা তত্ব খুব বাজার পাইছে যে, সিফিলিস নতুন দুনিয়া থেইকা আসছে। নতুন দুনিয়া মানে আমেরিকা – উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, যেইটা তখন কেবলি আবিস্কার তথা অনাবৃত হইছে (ডিসকভারী অর্থে) বছর দুই-তিনেক আগে, আর কলম্বাসের আমেরিকাফেরত নাবিকরাই প্রথমবারের মত সিফিলিসে আক্রান্ত হইছে বইলা প্রমাণ পাওয়া যায়। এই ভাড়াটে স্প্যানিশ সৈন্যরাও কলম্বাসের সেই আদি সংক্রমণ থেইকা সংক্রমিত হইছিলেন বা তাদের সংস্পর্শে আসছিলেন বইলা নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়ায়, সিফিলিসের “আমেরিকা হইতে আমদানী” তত্বটি মোটামুটি প্রামাণ্য বইলাই স্বীকৃত হইছে এই পুরাতন দুনিয়ায় (ইউরেশিয়া ও আফ্রিকায়)। তবে এই বিষয়ে শেষ কথা এইটাই নয় – এই বিষয়ে একটু পরে আবার আলোকপাত করতেছি।
১৪৯৫ সালের নেপলস। সিফিলিসের মহামারী আকারে সংক্রমণ, যেইটার সূত্রপাত আমেরিকা-ফেরত কলম্বাসের সঙ্গীসাথী, ফলে সকলেই জানে যে অসুখটার সোর্স আমেরিকার আদিবাসীরা। অথচ ইতালীতে তার নাম হয়ে গেল ‘ফরাসী অসুখ’। ইতালীয়ান ভাষায় mal francese কিম্বা ল্যাটিনে morbus gallicus। সেই একই নামে একে ডাকত জার্মানরা, পোলিশরা ও মাল্টিজরা। ওদিকে ফ্রান্সের লোকেরা সেই একই সময়ে এই একই অসুখকে ডাকতেন ‘ইতালীয়ান ব্যারাম’ নামে। ডাচরা তখন দুনিয়া আবিস্কারের ধান্দায় স্প্যানিয়ার্ডদের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে দুনিয়ার সাগর চষে বেড়াত, ফলে তারা এই অসুখের আমেরিকান উৎসের কথা জানত। তাছাড়া তাদের সাথে ফ্রান্স বা ইতালীর কোন যুদ্ধবিগ্রহও চলতেছিল না, বরং দুনিয়া দখিলের প্রতিযোগীতায় তাদের প্রতিপক্ষ ছিল স্পেন। ডাচরা এই অসুখকে বলত ‘স্প্যানীশ অসুখ।’ আমেরিকান অসুখও বলতে পারত, কিন্তু তারা এইটারে নাম দিল স্প্যানীশ অসুখ। রাশিয়ানরা এইটারে বলতেছে পোলিশ অসুখ, আর মুসলমান তুর্কীরা একে বলতেছে খ্রীষ্টান অসুখ বা ফিরিঙ্গী অসুখ। ফিরিঙ্গী মানে পশ্চিম ইউরোপীয়ান – আদি শব্দ Frank এর তুর্কী/আরবী চেহারা। যেহেতু পর্তুগীজ/ডাচরা বঙ্গোপসাগরে বা আরব সাগরে বাণিজ্য করতে আসার আগে থেকেই এই এলাকায় আরব বণিকেরা ব্যবসাবাণিজ্য করত, ফলে ওদের কাছ থেইকাই আমরা ইউরোপের মানূষকে ফিরিঙ্গী ডাকতে শিখছিলাম, অনেকটা ‘বিদেশী’ অর্থে। একই জিনিসের অনেক নাম, এবং সেই নামকরণগুলার পেছনের কারণ বুঝতে খুব একটা বুদ্ধির দরকার হয় না। পানির মতন পরিস্কার।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ডানপন্থী এক পত্রিকায় আর্টিকেল বের হইছে, দুনিয়ার বড় বড় সব মহামারী এবং সেইগুলা থেইকা আমরা কি কি শিখতে পারি এই বিষয়ে। তো, সেইখানে লেখক মহাশয় যত মহামারীর নাম উল্লেখ করছেন, তার সবগুলারই সোর্স উল্লেখ করছেন একটা ছাড়া। যে একটার সোর্স তিনি বলেন নাই, সেইটা ইউরোপ বা আমেরিকায় উতপত্তি হইছে বলে ধারণা করা হয়, আর বাকী প্রায় সবগুলোই উতপত্তি হইছিল এশিয়াতে। তো, এই যে একটা মহামারীর সোর্স না বলা, ইচ্ছাকৃত হোক বা অজান্তে হোক, এইখানে শেখার একটা জিনিস আছে। একটা রাজনীতি আছে। যেহেতু জিনিসটা ফেসবুকে আমি দেখলাম, ফলে ঘরে বইসা একটা উত্তপ্ত কমেন্টবিনিময়সভা কইরা ফেললাম, এবং সেইখানেও দেখা গেল এই রাজনীতি সাধারণ মানুষকে প্রবলভাবে বায়াসড কইরা রাখছে, এমনকি এই যুগেও। মহামারী থেইকা এইটা আমার শিক্ষা – যে, মহামারী শুধু মারেই না, সাধারণ মানুষকে রাজনীতিকে তাতিয়েও দেয়। এর বাইরে তো মহামারীর নানা শর্ট ও লং টার্ম সামাজিক/অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়া জ্ঞানীগুণীরা নানা প্লাটফর্মে কথা বলতেছেন, আলোচনা করতেছেন। সেইগুলা শুনিতেছি, শিখতেছি।
১৯১৮-১৯২০ সালে যে ব্যাপক মহামারী দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তার নামকরণের পেছনে আছে আরেকটা রাজনীতি – এইটারে বলা যাইতে পারে ভাবমুর্তির রাজনীতি। যে কারণে অনেক দেশের সরকার অনেকসময় করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সঠিকভাবে প্রকাশ করতেছে না বইলা আমরা ভাবতেছি। বাংলাদেশকে এই তালিকায় আমি রাখছিলাম শুরু থেকেই, যেহেতু এই দেশে সর্দি-জ্বরে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা এত বেশী আমরা আগে দেখি নাই কোনদিন। অবশেষে তাদের মনে হয় ভাবমুর্তির প্রয়োজন ফুরাইছে, গত তিন-চার দিন যে রিপোর্টিং হইতেছে তারে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নিতেছি। আমার এক বন্ধুর ফেসবুকে অর্জিত জ্ঞান মোতাবেক চীন সেই তালিকার এক নম্বরে – সেইখানে নাকি লাখে লাখে মানুষ মারা গেছে। ষড়যন্ত্র তত্বের আমি খুব একটা ভক্ত না, তবে আমার বক্তব্য হইতেছে যে ১৯১৮-১৯২০ সালের মহামারীতে একমাত্র স্পেন ছাড়া বাকী প্রায় সব দেশ এই আকামটাই করছিল ব্যাপকভাবে। যেইটারে আমরা বলি স্প্যানিশ ফ্লু, সেই ফ্লুর আক্রমণের সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলতেছিল, এবং তাতে উভয়পক্ষের নানা দেশ খুব ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছিল, যেহেতু এই ফ্লু তরুনদেরকে বেশী আক্রমণ করছিল। সৈন্যরা দলে দলে মারা যাচ্ছিল এবং নতুন করে সেনাদলে নাম লেখানোর মতন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না জার্মানীতে, ইতালীতে, আমেরিকায় কিম্বা যুক্তরাজ্যে। সম্ভবত আমেরিকার কেন্টাকি বা ফ্রান্সের কোন একটা জায়গাতে এর উতপত্তি, এবং যুদ্ধরত সকল দেশ নিজেদের দেশের ও সেনাদের মনোবল চাঙা রাখার তাগিদে আক্রান্তের ও মৃতের হার প্রকাশ করতেছিল রেখেঢেকে। অথচ স্পেন তার সব খবর প্রকাশ করতেছিল নির্দ্বিধায়, যেহেতু তারা যুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই স্পেনের মৃত্যুর উচ্চ সংখ্যা বাকী বিশ্বকে অবাক করল – সেই সময়ের পত্রপত্রিকা দেখলে আপনার মনে হবে যে, এই ঘটনা শুধুমাত্র স্পেনেই ঘটতেছে। তো এইকারণে আমরা এইটারে আজতক বলতেছি স্প্যানিশ ফ্লু।
মহামারী বা নানান অসুখের সাথে রাজনীতি ও রেসিজম জড়িত হওয়ার ব্যাপারটা অনেক পুরাতন বিষয়। সেইখানে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হইতেছে, আমার হিসাবে, ১৯০০ সালের দিকে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একটা শহরের বুবোনিক প্লেগ সামলানোর ততপরতা ও তার থেইকা পুরা দুনিয়া যে লেসনটা পায়, সেইটা। সেই লেসন অজ্ঞতা ও রেসিজমের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, মাইক্রোব নিয়া নানান গবেষণা ও সামাজিক দূরত্ব / লক ডাউন এইসব নিয়া রাজনীতির একটা চমৎকার কেইস স্টাডি। এই নিয়া একটা বই পড়তেছিলাম সম্প্রতি, যার নাম ‘ব্ল্যাক ডেথ এট দ্যা গোল্ডেন গেইট।’ সেই বইতে দেখা যায়, সান ফ্রান্সিস্কো শহরের চায়না টাউনে একজন প্লেগ রোগে মারা যায়। ঘটনাটা ১৯০০ সালের। এই প্লেগ সেই প্লেগ, যা মধ্যযুগে ইউরোপ তথা সারা দুনিয়াকে এক শবাগারে পরিণত করেছিল। বুবোনিক প্লেগ বা কালো মৃত্যু। তখন সান ফ্রান্সিস্কো শহরে শুরু হয় চাইনিজ খেদাও আন্দোলন, এবং সেই আন্দোলনের মুখে মেয়র চায়না টাউনের চারদিকের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। শহরে ছিলেন একজন ব্যাকটেরিওলোজিস্ট, যিনি কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলেন, কোন জাহাজ কোন শহর থেকে সান ফ্রান্সিস্কোতে এসেছে গত ২০/২৫ দিনে, এবং তাদের কোনগুলো প্লেগ আক্রান্ত দেশ বা বন্দর থেকে এসেছে। তার হিসাব মতে যে জাহাজে করে এই জীবানু আমেরিকায় এসেছে, তার অনেক যাত্রীই এখন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে কিছু এশিয়ানও ছিল, তবে যে লোকটি মারা গেছে সে ট্রাভেল করে নি অনেকদিন ধরে। অর্থাত কমিউনিটি সংক্রমণ বলে যে ব্যাপারটা আছে, সেইটা এখন ঘটতেছে পুরাদমে। তিনি মেয়রের সাথে মিটিং করে বললেন, শহরকে এক্ষুণি লকডাউন করতে হবে। মেয়র সাহেব কন, তুমি কে হে বাছা? লকডাউন তো অনেক পরের কথা, ওই চাইনীজ যে প্লেগে মারা গেছে এইটা স্বীকার করা মানেই ক্যালিফোর্নিয়ার ইকোনোমিক সুইসাইড।
ঘটনা ঘটতেছিল সান ফ্রান্সিস্কোতে – যেইখানে শহরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলতেছেন যে, পুরা শহর লকডাউন করতে হবে এখনই, আর মেয়র জণগনের দাবীর মুখে চায়নাটাউন কোয়ারেন্টাইন করে ভাবতেছেন, কাজ শেষ। ইতিমধ্যে চায়নাটাউনে মারা গেছে কয়েকজন প্লেগে আক্রান্ত হয়ে। চায়নাটাউনের কেউ বাইরে যেতে পারে না, বা শহরের কেউ চায়নাটাউনে। ফলে তখন সেখানে সেইটাই হইল আজকে ঢাকায় যা যা ঘটতেছে – কাজের লোকের অভাব, দর্জি মুচী বা শ্রমিকের অভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করল। চায়না টাউনে তো লোকেরা না খেয়েই মরা আরম্ভ করল। চাইনিজদের কাউকে চায়নাটাউনের বাইরে দেখা গেলেই মব-লিঞ্চিং ঘটতেছিল, ফলে সরকার বা মেয়রের নির্দেশে নয়, মানুষের মনের অজ্ঞতাপ্রসূত ঘৃণাই যথেষ্ঠ ছিল চাইনীজদেরকে একঘরে করতে। মনে রাইখেন, সেই দুনিয়া আজকের মত এত পলিটিকালি কারেক্ট ছিল না, ফলে পুরো চাইনা টাউন পুড়িয়ে দেওয়ারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ওদিকে যে ব্যাকটেরিয়োলজিস্ট মেয়রের বকা খেয়ে ঘরে ফিরে গেলেন, তার কাজ ছিল শুধু অপেক্ষা করা, কখন এই প্লেগ শহরের অন্য মানুষকেও মারতে শুরু করে। তার জানা ছিল যে এই অসুখ চেহারা দেখে আক্রমণ করে না, ফলে সে জানতো যে মেয়রের একসময় তার কাছে আসতেই হবে। তখন অন্ততঃ তিনি তার কাজটা করার সুযোগ পাবেন। ওদিকে সরকারী পত্রিকায় পুরো ঘটনাকে চেপে যাওয়া হল, যাতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নানা প্রকারের রপ্তানী ও যান চলাচল বন্ধ না হয়। ঠিক দেড় মাস পরে চায়নাটাউনের বাইরে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পরে জানা যায়, প্লেগে লোক মারা যাচ্ছিল আরো আগে থেকেই, কিন্তু শহরে যেহেতু প্রচণ্ড এন্টি-চাইনিজ সেন্টিমেন্ট, এবং ধরেই নেওয়া হয়েছে যে চাইনীজরাই এই রোগের উতস, ফলে চায়না টাউনের বাইরের ডাক্তারেরাও প্লেগে মারা যাওয়া রোগীকে সর্দি-কাশিতে মারা গেছে বলে রিপোর্ট করছিল এতদিন। ভাবমুর্তি, জাতিগত হিংসা/ঘৃণা এবং সরকারী প্রোপাগাণ্ডা। যাই হোক, এক শুভক্ষণে শহরের কর্তাদের বোধোদয় হল, তারা গণস্বাস্থ্যের লোকজনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলেন। তখন তারা যা করেছিলেন, সেইটা আজও সংক্রামক ব্যাধি সামলানোতে বাকী দুনিয়ার জন্য একটা অনুকরণীয় মডেল। এই জীবানু যে মানুষ থেকে ইঁদুর বা বাদুর বা কাঠবিড়ালী হয়ে অন্য মানুষে সংক্রমিত হতে পারে, সেটাও সান ফ্রান্সিস্কোতেই আবিস্কার হয়। ফলে সান-ফ্রান্সিস্কোতে ইঁদুর মারার একটা অভিযান হয়েছিল সেই সময়ে। কেউ মরা ইঁদুর নিয়ে কাউন্সিলের অফিসে গেলেই অর্থ পুরস্কার পাইত। একসময় চায়না টাউনে যেহেতু অপরিচ্ছন্নতাহেতু প্রচুর ইঁদুর ছিল, যা ছিল প্লেগের জীবানুর বাহন, সেই চায়না টাউন পরিস্কার করে ফেলাতে ইঁদুরেরা শহরের অন্য অংশে পালিয়ে গেল, এবং তার ফলে শহরের দূরবর্তী বিভিন্ন পাড়াতে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ল। সেইটাকে থামাতে এই রকম নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। সানফ্রান্সিস্কো থেকে কেউ বাইরে যেতে চাইলে তাকে ডাক্তারের সার্টিফিকেট সাথে নিয়ে রাখতে হতো, এবং আরো নানা প্রকারে তারা শুধু সান-ফ্রান্সিস্কোকে নয়, পুরো আমেরিকাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আরেকটা ব্ল্যাক ডেথ এর হাত থেকে। সবচেয়ে বড় যে কাজটা তারা করেছিল তা হইল, মানুষকে সচেতন করা। বারবার হাত ধোয়া, নিজেদের বাড়ীর আশপাশ পরিস্কার রাখা, নিজে আক্রান্ত হইলে সেলফ-আইসোলেশনে থাকা, শহরের বাইরে থেকে কেউ আসলে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকা, এইসব। আরেকটা হইল, চাইনীজরা এই রোগের উতস নয়, এইটা প্রমাণ করা।
এর ফলে, ঠিক ১৮/২০ বছর পরে আমেরিকায় যখন প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ মারা গেল স্প্যানিশ ফ্লু-তে, তখন আমেরিকার বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে যে শহর সবচেয়ে কম আক্রান্ত হইছিল তার নাম সান-ফ্রান্সিস্কো। এবং মজার বিষয়, সান-ফ্রান্সিস্কোতে কিছু মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গেলেও চায়নাটাউনে একজনও মারা যায় নি।
যাই হোক, সময় থাকলে বইটা পইড়া দেখতে পারেন। তো আমার বক্তব্য হইতেছে যে প্লেগ বলেন আর করোনা বলেন, এইগুলা থামানোর জন্য সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন এইসবই সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি, এবং পরীক্ষিতও বটে। আবার সিফিলিসের গল্পে ফিরে আসি। এই যে, কে রোগের উতস আর কে তার ভিকটিম, এর মধ্যে একটা মর্যাদা বা প্রেস্টিজের ব্যাপার আছে, যদিও আসলে জীবানুগুলো নিজেরাই তাদের জন্য উপযুক্ত বাহন খোঁজার চেষ্টায় থাকে অবিরত, এবং নিজেকে অধিকতর প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে রাখার মতন করে অভিযোজন করে নেয়। অথচ মানুষ সবসময় তার চেয়ে ইনফেরিয়র কারো দিকে আঙ্গুল তুলে একটা সহজ সমাধান পায়। সিফিলিসের গল্পে এইটা প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, যেহেতু পুরাতন দুনিয়ায় (বর্তমান দুনিয়া, মাইনাস দুই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া) সিফিলিসের কোন অস্তিত্ব ছিল না কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের আগে (অন্ততঃ আমাদের তাই ধারণা), এবং কলম্বাসের লোকেরাই প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল এই অসুখে, ফলে বলা হয় যে, এই রোগটা তারা আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের কাছ থেইকা নিয়া আসছে ইউরোপে। এই সিফিলিসে সে সময় ইউরোপের অনেক মানুষ মারা যায়, এবং একই সাথে দুই আমেরিকাতেও অসংখ্য আদিবাসী মানুষ মারা যায়। যেহেতু এই রোগের সাথে যৌনতার সম্পর্ক ছিল, ফলে আক্রান্তরা সামাজিকভাবে অপমানিত হতেন সকলের চোখে। ধর্মজাজকেরা একে যৌন অবিশ্বস্ততার শাস্তি হিসেবে আখ্যা দিতেন। এত খারাপ একটা অসুখ নিশ্চয়ই খারাপ মানুষদের কাছ থেইকাই আসবে, ফলে আমরা ধরেই নিছি যে, ইউরোপ থেইকা এটা আমেরিকায় যায় নি, বরং আমেরিকার আদিবাসীরা এইটা আমাদেরকে দিসে। তাতে আমাদের ইজ্জত বাড়ে আর কি।
অতি সম্প্রতি সিফিলিসের এই ‘আমেরিকা হইতে আমদানী’ থিওরীর গোড়ায় কড়াল মারার মতন কিছু কাজ হইতেছে দুনিয়ায়। ব্রিটেনের হাল শহরে এক প্রত্নতাত্নিক সাইটে মানুষের হাড় পাওয়া গেছে যেইগুলা দেইখা বুঝা যায় যে তারা সিফিলিসে আক্রান্ত ছিল। সিফিলিস মানুষের মাথার খুলি এবং হাড়কে বিশেষভাবে আক্রান্ত করে এবং সেইখানে একটা ছাপ রেখে যায়, যা দিয়ে তাদের মধ্যে সিফিলিসের উপস্থিতি বুঝা যায়। তো, সেই হাড়গুলার বয়স এমন যে, মানুষগুলি মারা গেসিল দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকে। অর্থাৎ আমেরিকা আবিস্কারের আগে। ফলে আমরা সিফিলিস নিয়া যে আমেরিকানদেরকে ব্লেইম করতেছিলাম, সেইটা সম্ভবতঃ জায়েজ না – এমনও হতে পারে যে, এই রোগ ইউরোপ থেকে কলম্বাসের জাহাজে চইড়া আমেরিকায় গেসিল। যেহেতু ততদিনে ইউরোপে এই রোগের প্রকোপ কমে এসেছিল, ফলে ইউরোপীয়ানরা খানিকটা হার্ড ইমিউনিটি পাইয়া গেসিল, ফলে সিফিলিসের জীবানু খুব একটা সুবিধা করতে পারতেছিল না। তারা আমেরিকানদের সংস্পর্শে এলে এই জীবানু একটা সহজ হোস্ট পায়, ফলে তারা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ইতিহাস পইড়া দেখেন, ইউরোপীয়ানরা যেখানেই গেছে, সেইখানকার আদিবাসীরা ইউরোপীয়ানদের বয়ে আনা সাধারণ অসুখেও লাখে লাখে মরেছে, যেহেতু তাদের কোন ইমিউনিটি ছিল না এই নতুন অসুখের বিরুদ্ধে। ফলে সিফিলিসের জীবানু এক নতুন জীবন লাভ করে আমেরিকা মহাদেশে, এবং সম্ভবতঃ সেইখানেই মিউটেশান করে আরো নতুন রুপে চাঙ্গা হয়ে নাবিকদের মাধ্যমে আবার ইউরোপে ফিরে আসে। এর খানিকটা এখনও তত্বমাত্র, এবং অনলাইনে খুঁজলে নানা রকম তত্ত্ব পাইবেন সিফিলিসের উতপত্তি নিয়ে। কিন্তু কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের আগেই যে ইউরোপে সিফিলিস ছিল, এই তথ্যটা খুব দরকারী। কারণ এইটা ইউরোপের ইজ্জত রক্ষা কমিটির পায়ের তলার মাটি সরাইয়া দিসে এক লাফে। ফলে সিফিলিস মহামারীর সোর্স হিসেবে আমাদের চাইতে অধম কারো দিকে (আমাদের মাপকাঠিতে অধম) আঙ্গুল যে আমরা তুলে আসতেছিলাম, সেইটা একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এইটা একটা দরকারী জিনিস। একটা লেসন
অনেক অজানা বিষয় জানা হলো। ধন্যবাদ পোস্টের জন্যে।
Gratitude for this writing. I loved it.
ধন্যবাদ