বাড়ীর পাশে ছেলেদের স্কুল, আর সেই স্কুলের পাশে গীর্জা। গীর্জা আর বলেন না আজকাল অনেকে – চার্চ বলেন। আমি গীর্জাই বলি – যেহেতু খ্রীষ্টধর্ম বঙ্গদেশে আমদানীর কৃতিত্ব পর্তুগীজদের, আর ওদের ভাষাতে আব্রাহামিক খোদার ঘরের নাম গীর্জা, সেই ঘরের খেদমতগারের নাম পাদ্রী, আর খোদার পরে সেই ধর্মের প্রধান পুরুষের নাম যীশু। অনেকটা বঙ্গদেশে ইসলামের আবির্ভাবের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন – যারা ইসলাম এনেছিল এদেশে, তাদের ভাষা থেকেই আমরা ধর্মের মৌলিক শব্দসম্ভার পেয়েছি, ফলে আমাদের ধর্মের আলাপচারিতায় আরবীর চেয়ে ফার্সী/তুর্কিরই প্রাধান্য বেশী চোখে পড়ে। যাই হোক, সেই গীর্জায় একদিন এক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে দেখে আমার দুই ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে ঢুকে পড়লাম। বিনামূল্যে এলাকাবাসীর জন্য সসেজ-রুটির আয়োজন, বাচ্চাদের জন্য খেলাধুলা এবং আগ্রহী খোদাভক্তদের জন্য ধর্মীয় সঙ্গীত ও ধর্মালোচনা। বলাবাহুল্য, সময়টা বড়দিনের ঠিক আগের সপ্তাহে। আমার আগ্রহ খাবারে, তিন বছর বয়সী ছেলের আগ্রহ খেলাধুলায়, আর বারো বছর বয়সী ছেলের আগ্রহ গীর্জার মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের দিকে। গীর্জার প্রধান মঞ্চের উপরে একটা বয়োবৃদ্ধ হাড়-জিরজিরে গ্র্যান্ড পিয়ানো, পাশে কয়েকটা ডাবল ব্যাস ও বেহালা এবং আরেক পাশে একটা একুস্টিক ড্রাম সেট। আমার ছেলের যে বয়স, তাতে করে ড্রামের প্রতি তার আগ্রহটা স্বাভাবিক। সেদিন সে গীর্জার এক কর্তাব্যক্তির সদয় অনুমতিক্রমে ড্রামে হাত লাগানোর সুযোগ পায়। সেইখানে অন্য বাচ্চারা গাইছিল বিখ্যাত ক্রিসমাসের গান, জিঙ্গেল বেলস। আমার ছেলে ড্রামে তাল মেলানোর কোশিস করতে থাকে – খানিকটা গানের তালে তালে চালিত হয়ে আর খানিকটা সমবয়সী অপরিচিত ছেলেমেয়েদেরকে ইমপ্রেস করার খাতিরে।

যাই হোক, এই বাচ্চাদেরকে সমবেতভাবে ক্যারল গাইতে দেখে আমার কৈশোরের গজল গাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। মাদ্রাসায় বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে গজল গাওয়ার প্রথা ছিল। ছাত্র-ছাত্রীরা মূল মাহফিলের আগে কয়েক ঘন্টা মাইক ব্যস্ত রাখত। গজলের নানা রকমফের – কোথাও আল্লাহ/নবীর প্রশংসা বা হামদ/নাত, কোথাও মুনাজাত (শোন শোন ইয়া এলাহী) কোথাও ধর্মের নানা তত্বের ব্যাখ্যা (কবরের আজাব, বেহেশত/দোযখ, মৃত্যু, ঈমান এসব নিয়ে গজল আছে), কোথাও ইতিহাস বা কাসাসুল আম্বিয়া তথা প্রেরিত পুরুষদের জীবনকাহিনী (উদাহরণঃ ইয়াকুব নবী বাস করিতেন কেনানে, সবার চেয়ে ভালোবাসতেন ইউসুফকে)। আমিও গেয়েছি অনেকবার। অনেক গজলে আরবী ফারসী উর্দু শব্দ বা বাক্য থাকত, যেমন ‘বালাগাল উলাবে কামালিহী’ অথবা ‘কুম কুম ইয়া হাবিবী কামতানামু’। সেই একই জিনিস পেলাম এই দেশে এসে, ক্রিসমাস ক্যারোলে। স্রেফ গজলের ক্রিশ্চিয়ান ভার্শান, এবং সেখানেও ল্যাটিন মেশানো হামদ, কিম্বা যীশুর জন্মকাহিনী নিয়ে বর্ণনামূলক গাথা অথবা ক্রিশ্চিয়ানিটির মাহাত্ন্য বর্ণনা। আমরা গেয়েছি “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে”, আর এখানে এরা গাইছে “লং টাইম এগো ইন বেথেলহাম, সো দ্যা হলি বাইবেল সে, মেরি’স বয় চাইল্ড, জেসাস ক্রাইস্ট ওয়াজ বর্ন অন ক্রিসমাস ডে”। বাইবেলের মেরিই যে ইসলামের মরিয়ম, সে তো আমরা সকলেই জানি।

‘গ্লোরিয়া ইন এক্সেলসিস ডেও’ একটা অতি পুরাতন এবং বিখ্যাত ক্যারোল সং, যা খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে গাওয়া হয়ে আসছে। ঈশ্বরবন্দনা আর কি! Glória in excélsis Deo, et in terra pax homínibus bonae voluntátis. …… যার অর্থ মোটামুটি এরকমঃ Glory to God in the highest, and on earth peace to people of good will. We praise you, O God, almighty Father. এই গানের শেষে সবাই মিলে উচস্বরে আমিন (Amen) বলার রেওয়াজ। এর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিন আমাদের “হে খোদা দয়াময়, রাহমানুর রাহীম, হে বিরাট হে মহান হে অনন্ত অসীম”কে। সেই একই ঈশ্বরের প্রশংসাবাণী নানা দেশে নানা বুলিতে।

তবে একটা পার্থক্য আছে এই গায়কদলের মধ্যে। মাদ্রাসায় যারা গজল গাইত, তারা সাধারণতঃ প্রথাগতভাবে গান শেখা লোক নয়। সারেগামা’র কয়েকশো গজ দূরে অবস্থান, আর বাদ্যযন্ত্র বাজানো কিম্বা শিক্ষকের কাছে গানের তালিম, এসব ছিল আকাশ কুসুম কল্পনারও বাইরে। অন্যদিকে, ক্রিসমাস ক্যারোলে চার্চের মধ্যে পিয়ানো অথবা রেকর্ডেড মিউজিক দিয়ে গান গাওয়া হচ্ছে, গায়ক/গায়িকারা বহুদিন একত্রে রিহার্সেল করেছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় (গজল প্রায় সবসময়ই একক হত, দ্বৈত বা কোরাস শুনিনি খুব একটা), এবং সবার হাতে হাতে মিউজিকের নোটেশানের কাগজ, যেটাকে এরা বলে মিউজিক শিট। অর্থাত এরা সবাই সারেগামা শিখে আসা লোক, যারা স্বরলিপি দেখে সুর পড়তে পারে, গলা মেলাতে পারে এবং কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। মাদ্রাসার প্রাঙ্গনে এ সবের কিছুরই প্রবেশাধিকার নেই, যদিও ইসলামে গানের সাথে বাজনার সম্পর্ক আজতক বিতর্কিত এবং অমীমাংসিত বিষয়। ওদিকে পশ্চিমের ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীত এবং তার লিখিত রুপের উদ্ভাবন ও বিকাশে গীর্জা এবং খ্রীষ্টান ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম। চতুর্থ-পঞ্চম শতকে ইউরোপের গীর্জাগুলোতে দু’রকমের ধর্মীয় পবিত্র গান গাওয়া হত – রোমান চ্যান্ট এবং গ্যালিসিয়ান চ্যান্ট। এই দুইয়ের সমন্বয়ে অষ্টম শতকে উদ্ভব হয় গ্রেগরিয়ান চ্যান্টের, যা ১২টি স্কেল তথা মোডে বিন্যস্ত ছিল। এই মোড বা নোট-সমগ্রকে লিখে রাখার তাগিদ থেকেই সঙ্গীতের নোটেশনের লিখিত রুপের উদ্ভব হয়, যা আজকের দিনে স্টাফ নোটেশান বলে আমরা জানি। সেই গানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল কি-না, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, তবে আন্দাজ করা হয় যে পারকাশন বা তালযন্ত্রের ব্যবহার একেবারে শুরু থেকেই ছিল গীর্জার গানে, যা স্টাফ নোটেশনের বার-বিন্যাসেও লিখে রাখা হত। অন্যদিকে ইসলামের আদিকালে ধর্মীয় গান বা নাশিদের সাথে কেবল চামড়া দিয়ে বানানো এবং হাতে বাজানোর এক ধরনের ঢোল বাজানো হত।

বিষয়বস্তুতে মিল ছাড়াও আরেকটা ব্যাপারে বেশ মিল আছে তিন আব্রাহামিক ধর্মের ধর্মীয় সঙ্গীতে, আর তা হলো নিজ নিজ ধর্মের তীর্থস্থানে বা উৎসভূমিতে যাওয়ার আকাঙ্খা। কখনো সরাসরি, কখনো মেটাফোর বা প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় এই দুর্বার আকাঙ্খা। একটা বেশ জনপ্রিয় গজল আছে, যেটি বাংলাদেশের প্রায় সকলেই শুনে থাকবেনঃ

মনে বড় আশা ছিল যাব মদীনায়
আশা আছে সম্বলে নাই, করি কি উপায়?

অথবা এই গজলটির কথা ভাবুনঃ আমার হৃদয় মাঝে কাবা, নয়নে মদীনা। ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাব মদীনায়। দে দে পাল তুলে দে, ও মাঝি হেলা করিস না। নৌকায় করে ভারত মহাসাগর আর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে তারপর মরুর দেশে যাওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে এখানে গীতিকার ভাবেন নি। তার মক্কা-মদীনায় যাওয়া চাইই চাই। খাঁটি প্রেমিকেরা তো বাস্তবতাবোধ দিয়ে পরিচালিত হয় না সবসময়।

জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনে তার একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতায় একটি পাম গাছের জন্য এক পাইন গাছের তীব্র আকূলতাকে চিত্রিত করেছেন। সেইখানেও এইসব গজলের আছর পড়েছে এমনটা দেখা যায়। কবিতাটা আমেরিকান কবি এমা লাজারাস এর অনুবাদে পড়া যাকঃ

There stands a lonely pine-tree
In the north, on a barren height;
He sleeps while the ice and snow flakes
Swathe him in folds of white.
He dreameth of a palm-tree
Far in the sunrise-land,
Lonely and silent longing
On her burning bank of sand.

ইহুদীদের প্রেমের কবিতায় একটা ধারা আছে, যেখানে যেরুজালেমকে প্রেমিকারুপে কল্পনা করা হয় (গাছের জন্য ব্যবহৃত সর্বনাম, He ও She দেখে বুঝে নিতে হবে) – যে প্রেমিকা চোখের আড়ালে বহুদুরে অবস্থান করে এবং যাকে পাওয়ার কোন উপায়ই সম্ভবত নেই। গজলে যেমন প্রশ্ন করা হচ্ছে, আশা আছে সম্বলে নাই, করি কি উপায়?

হাইনে হয়তোবা বাইবেলের সেই পংক্তিগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন- By the rivers of babylon, there we sat down and wept when we remembered Zion. …..If I forget thee, O Jerusalem, may my right hand wither, may my tongue cling to the roof of my mouth। এই পংক্তিগুলো সারা দুনিয়ার ইহুদী ডায়াস্পোরার যেরুজালেমের প্রতি ভালবাসা কিম্বা সেখানে ফিরতে না পারার মর্মবেদনা প্রকাশ করে। হাইনে ইহুদী ছিলেন, এবং তার পাম গাছের অবস্থানও পূর্বদিকে – far in the east। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে পারেন। এ আসলে প্রকারান্তরে সেই ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদীনায়’ এর জার্মান কিম্বা ইহুদী প্রকাশ।