প্রায় আট মাস আগে দেশের মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে এক ভয়াবহ স্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই স্বৈরাচার ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এখনো নানা কৌশলে দেশকে অস্থির করে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি মদদপুষ্ট এই চক্রের মূল লক্ষ্য একটাই—যেভাবেই হোক, আবার ক্ষমতায় ফেরা।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে দমন-পীড়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই জানা। তাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা থেকেও স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে—ক্ষমতায় ফিরলে তারা আগের সেই পুরোনো রূপেই ফিরে আসবে। দলে শেখ হাসিনাই থাকবেন শীর্ষে—এই ঘোষণা দিয়ে তারা আসলে বুঝিয়ে দিয়েছে, পরিবারতন্ত্র ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা নেই; বরং তারা আগের সব অন্যায়ের একরকম বৈধতা দিচ্ছে। জুলাইয়ের আন্দোলনে যে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, সে বিষয়ে আজও তাদের মধ্যে অনুশোচনার কোনো চিহ্ন নেই। অন্যদিকে, হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়—এমনটাই মনে হচ্ছিল। ওয়াকিবহাল মহলে ধারণা ছিল, এর পেছনে দেশের বাইরে কিছু প্রভাবশালী শক্তির সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতা কাজ করছে। তবে এই সমঝোতার প্রকৃতি বা ব্যাপ্তি সম্পর্কে এতদিন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
শেষ পর্যন্ত ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তার বহুল আলোচিত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে তুলে ধরেন যে এই গোপন সমঝোতার নেপথ্যে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ্জামানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি তার আর আরেক ছাত্রনেতা সারজিস আলমের সাথে সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক আলোচনার কথা জানান। যদিও সেনাসদর এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছিল, সারজিস আলমের একটি সম্পর্কিত পোস্ট আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আভাস দিয়েছে। সারজিস তার পোস্টে কিছু গৌণ বিষয়ে ভিন্নমত তুলে ধরলেও, সামগ্রিকভাবে আলোচনার প্রেক্ষাপট এবং সেনাপ্রধান যে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পক্ষে একটি সক্রিয় অবস্থানে ছিলেন, সেটি পরোক্ষভাবে নিশ্চিত করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ খুবই সীমিত।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো—হাসনাতের পোস্ট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া। তিনি এই পোস্ট দিয়ে নিজের দল থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সম্ভবত তিনি পোস্ট দেওয়ার আগে দলের সহযোগী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেননি। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তার এমন আচরণ অবশ্যই প্রশ্নের জন্ম দেয়—এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কি এককভাবে বলা উচিত ছিল? অন্যদিকে, যারা এখন তাকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন, তাদেরও ভাবা উচিত—সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়ায় বললেই কি সমস্যার সমাধান হয়? বরং নিজেদের মতপার্থক্যগুলো দলীয় ফোরামে তুলে ধরলে দল হিসেবে একসঙ্গে শেখার সুযোগ তৈরি হতো। তাদের নতুন দলের রাজনীতিতে কে কত বড় নেতা তা প্রমাণ করার চেয়ে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিভাবে বদলাবে সেটাই আসল প্রশ্ন হিসাবে বিবেচনা করার দরকার ছিল। বোঝা উচিত ছিল, ব্যক্তি নয়, দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণই এখন মূল লক্ষ্য।
পোস্টটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুফল
হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টটি নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও, এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুফলও পাওয়া গেছে:
প্রথমত, এই পোস্টের পর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। এখন কেউই সহজে বিতাড়িত দলটির পুনর্বাসনে মুখ খুলতে সাহস করছেন না।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলাটা সাধারণত এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এই পোস্ট সেই আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছে, যা এতদিন এক ধরনের ট্যাবু হিসেবে ছিল। বিশেষ করে যখন সন্দেহ রয়েছে যে সেনাপ্রধান বিতাড়িত একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন—তখন এমন আলোচনা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, সেনাপ্রধান তার এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় ছাড়িয়ে দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছেন বলে আগেই অভিযোগ উঠেছিল। হাসনাতের পোস্ট এই অভিযোগকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। তিনি যদি এই অভিযোগ থেকে নিজেকে পরিষ্কার করতে চান, তাহলে ভবিষ্যতে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকবেন—এই আশাই করা যায়। তবে পোস্টটির গুরুত্ব খাটো করার চেষ্টায় সেনাসদরের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতি একটি কাঁচা কাজ বলেই মনে হয়েছে।
চতুর্থত, একজন ছাত্রনেতা হিসেবে হাসনাত সাহস করে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন, যা তাকে একজন স্পষ্টবাদী এবং সাহসী নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে। তার এই ভূমিকা তরুণদের মধ্যে রাজনীতিতে সক্রিয় এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
পঞ্চমত, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও এই পোস্ট এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দেওয়া বিবৃতি থেকে বোঝা গেছে যে তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তনের চেষ্টা করছে না। তারা এখনো আগের একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বের হতে পারেনি, যা ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক আচরণ সম্পর্কেও একটি পরিষ্কার বার্তা দেয়।
এই পোস্ট জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা আরও বাড়িয়েছে। মানুষ আগ্রহ নিয়ে জানতে শুরু করেছে, কী ঘটছে, কে করছে, এবং কেন করছে। ফলে রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, যা একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।
সবশেষে, এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে—সোশ্যাল মিডিয়ার যথাযথ ব্যবহার কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। একটি সাহসী, তথ্যভিত্তিক পোস্ট কিভাবে পুরো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলোড়ন তুলতে পারে, সেটি এখন সবাই দেখেছে। এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের তরুণদেরও অনুপ্রাণিত করবে—তারা বুঝবে যে সত্য উচ্চারণ কখনোই নিষ্ফল যায় না।
তৃতীয় পয়েন্টে লিখছেন সেনাবাহিনীর কোনো অধিকার নেই সরকারের বিষয়ে কথা বলা। কিন্ত সেটা তখনই যখন গনতন্ত্রীক পদ্ধতিতে সরকার বদল হবে। হাসিনাকে রক্ষা করা ঐ সময়ে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল।
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য। আমি শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরের সময়ের কথা বলেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের বিনা অনুমতিতে দেশের রাজনীতিতে না জড়ালেই সবার জন্য ভালো হবে।
আঃ লীগের পূূনর্বাসন মানে কি? সংগঠনটি কারো করুণায় রাজনীতি করবে নাকি এটি এদেশের জনমানসে প্রতিষ্ঠিত একটি দল।জনরায়ে অংশগ্রহণ করতে বলপূর্বক বাধা দিতে অনাগ্রহের নাম পূনর্বাসন?
হাসনাত আব্দুল্লাহর দাবি অনুযায়ী, সেনাপ্রধান এমন কিছু চাইছিলেন যাতে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকার পতনের পর এই প্রথম শীর্ষ নেতাসহ এত বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। পালিয়েছে, কারণ তারা কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। এসব অপরাধের মধ্যে ছিল ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, এমনকি গুম-খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধও।
আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এসব অপরাধের দায় স্বীকার করেনি; বরং তারা দলীয় নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন না এনে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা রকম ক্ষতিকর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া মানে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আবার পথ তৈরি করে দেওয়া, এবং অপরাধীদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া।
আপনার বক্তব্য অনুযায়ী যদি দলটি সত্যিই “জনমানসে প্রতিষ্ঠিত” হতো, তাহলে তাদের এভাবে পালাতে হতো না। শেখ হাসিনা এবং তার অপরাধী সহযোগীরা তো মানুষকে উসকে দেওয়ার কম চেষ্টা করেনি — কিন্তু এতদিনে আওয়ামী লীগের পক্ষে চোরাগোপ্তা অপরাধ ছাড়া কোনো বাস্তব জনসমর্থনের চিহ্ন দেখা যায়নি! দুঃখ হয়, একসময় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখা একটি দলের নাম কীভাবে তাদের খুনি, সন্ত্রাসী আর দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের জন্য নর্দমায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ যদি দেশের রাজনীতিতে ফিরতে চায়, তাহলে তাদের অতীতের অন্যায়ের জন্য দায় স্বীকার করে, নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন এনে ফিরতে হবে। জনগণ যদি তখন তাদের নির্বাচিত করে, সেটা হবে গ্রহণযোগ্য। তবে মূল কথা হলো — দেশকে নিজের বাপ-দাদার জমিদারি ভাবার দিন শেষ। মাফিয়া বসদের দিয়ে আর দেশ চলবে না; শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে দেশের প্রকৃত মালিক জনগণের হাতে।
এই ব্লগ খুবই ধীরে চলে। খুলতেই চায় না। দেখুন ।
ঠিকই বলেছেন, বহুদিন পর মুক্তির আনন্দে আবার এখানে লিখতে এসেছি! কিন্তু কোন কারণে দেখছি ব্লগ খুলতে, সম্পাদনা করতে আগের চেয়ে বেশী সময় লাগছে।
তৃতীয় পয়েন্টে আপনি লিখেছেন সেনাবাহিনীর রাজনিতীতে মাথা গলানো ঠিক না। তাদের ব্যারাকেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। কিন্ত তা হলে তো বলা যায় সরকার পরিবর্তন সংসদীয় পথেই হওয়া উচিত। হাসিনার বিরুদ্ধে গন আন্দোলন সেনাবাহিনীর সহায়তা দেওয়া ঠিক হয়নি।
ভেবে দেখুন, শেখ হাসিনা যে শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তাতে কি সত্যিই কাউকে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল? গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোকে সমান সুযোগে অংশগ্রহণের পরিবেশ দেওয়া হয়নি; সাধারণ মানুষকেও স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। এমন কি এখন এতকিছুর পরও আওয়ামী লীগ কি শেখ হাসিনাকে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারবে? হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, সেনাবাহিনীর পক্ষে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল— সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার ওপর জাতিসংঘেরও ছিল কঠোর বিরোধিতা, যা উপেক্ষা করা শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশ নিতে আগ্রহী সেনাবাহিনীর জন্য সহজ ছিল না। এজন্যই আমার মনে হয়, দেশ অচিরেই সেনাশাসনের পথে যাবে না।
সহমত।