বিবর্তনের সাক্ষ্যপ্রমাণ

(তৃতীয় পর্ব)

ইরতিশাদ আহ

 

জেরি কোয়েন-এর বিবর্তন কেন বাস্তব অবলম্বনে

 

(প্রথম পর্ব), (দ্বিতীয় পর্ব)

[লেখাটা শুরু করেছিলাম ২০১০-এর মার্চে।  দুই পর্ব লিখে আর লেখা হয় নি।  আমার সীমাহীন আলসেমি ঘুচিয়ে তৃতীয় পর্ব লিখতে শুরু করেছিলাম বছর খানেক আগে।  পাঠকদের সাথে সাথে আমিও ভুলেই  গেছিলাম যে আমার একটা লেখা মুক্তমনায় ঝুলে আছে।  ভুলেন নি শুধু দু’জন।  অভিজিৎ রায় আর অনন্ত বিজয় দাস।  সুযোগ পেলেই এবং কখনো কখনো সুযোগের অপেক্ষা না করেই আমার এই দায়টার কথা তাঁরা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন।
 
আমার নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে লেখাটা তাঁরা প্রয়োজনীয় মনে করেছেন বলে।  আর প্রথম পর্বের সূচনাতেই উল্লেখ করেছিলাম, এই লেখাটার প্রেরণা পেয়েছিলাম বন্যা আহমেদের কাছে।  তাই এই সিরিজটা আমি বন্যা আহমেদ, অভিজিৎ রায় আর অনন্ত বিজয় দাসকে উৎসর্গ করলাম।
 
দায় মনে না করলেও Why Evolution is True  অনুবাদের এই কাজটাকে আমি একধরনের দায়িত্ব  ভেবেছি।  বাংলায় বিবর্তন বোঝার মতো বই-এর প্রচন্ড অভাব।  বন্যা আহমেদ তাঁর অসাধারণ বই ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ লিখে সে অভাব অনেকটাই পূরন করেছেন।  তবুও বিবর্তনের ওপরে বাংলায় প্রকাশিত বই-এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।  তাই আমি ঠিক করেছি, আমার সময়াভাব আর আলসেমির বিরুদ্ধে লড়াই করে এই প্রয়াস অক্ষুন্ন রাখবো।  অন্ততপক্ষে জেরি কোয়েনের বইয়ের প্রথম দুই অধ্যায়ের ভাবানুবাদ করবো, মুক্তমনার জন্য।  এই পর্বে বইটার দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম ভাগ এসেছে -– আরো অনেকটাই বাকী।]

লেখার যে অংশগুলো কোয়েনের বইতে নেই, সেগুলোকে ইটালিকস ফন্টে পৃথক করা  হয়েছে।

 Why Evolution is True  – প্রচ্ছদ

পাথরে লেখা ইতিহাস

আগের দুই পর্বের আলোচনা থেকে যে কোন যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে খুব স্বাভাবিকভাবে একটা উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব; আর তা হলো পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তন একটা নিছক বস্তুবাদী প্রক্রিয়া।  এই উপসংহার বা সিদ্ধান্ত একটা দীর্ঘ ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষনের ফল।  এখন পর্যন্ত এমন কিছু জানা যায় নি, যা এই মৌলিক সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করতে পারে, বা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।  বরং পর্যায়ক্রমে আরো এমন অনেক কিছুই জানা গেছে, এবং এখনো গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারা যাচ্ছে, যা এই সিদ্ধান্তকে দৃঢ়তর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 
এই অধ্যায় (কয়েক পর্বে) সীমাবদ্ধ থাকবে ফসিলে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণের আলোচনায়।
 
চার্লস ডারউইন লিখেছিলেন তাঁর অরিজিন অফ স্পিশিজে, “এই পৃথিবীর উপরিভাগ যেন একটা বিশাল সংগ্রহশালা, জাদুঘরের মতো; তবে প্রকৃতির সংগ্রহগুলোর মাঝে রয়েছে সময়ের বিরাট ব্যবধান”।

তবুও জীবনের ইতিহাস জানতে চাইলে  পাথরের লেখাই পড়তে হবে আমাদের।  প্রাচীন শিলার স্তরে স্তরে রয়েছে জীবনের পথ চলার কাহিনি।  প্রকৃতির লেখা  ইতিহাসের এই বই যত্ন করে কেউ বাঁধিয়ে রাখে নি।  বইটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন, পাতাগুলো ছড়ানো-ছিটানো।  কিন্তু তবুও কোনরকমে পড়া যায়, গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর পাঠোদ্ধার কঠিণ হলেও অসম্ভব নয়।
 
যেমন ধরা যাক, হোমো স্যাপিয়েনদের কথা।  প্রথমবারের মতো কখন তাদের ইউরোপে  পদার্পণ ঘটে?  ফসিলই দিচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর।  রুমানিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে পাওয়া ফসিল থেকে জানা যাচ্ছে এখন থেকে কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে এই ঘটনাটি ঘটে।
 
কাজটা আসলেই সহজ নয়।   জাদুঘরে ডাইনোসরের সযত্নে সাজানো কঙ্কাল দেখে আমাদের চট করে হয়তো মনে হবে না, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে একেকটা কঙ্কালের পেছনে।  ফসিল আবিষ্কার, আহরণ, আর সংরক্ষনের প্রক্রিয়া যে কতটা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল আর বিপজ্জনক হতে পারে, না দেখলে বোঝা মুস্কিল।

কিন্তু তারপরেও জীবন বাজি রেখে ফসিল খুঁজে চলেছেন প্যালেন্টোলজিস্ট (paleontologist) নামের বিজ্ঞানীরা।  তাদের এবং জীববিজ্ঞানীদের কাছে ফসিল সোনার চেয়েও দামী।  ফসিলের মাঝে রয়েছে জৈব-বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।  ফসিল না থাকলে বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হতো ভাসাভাসা, অসম্পূর্ণ।  আমাদের নির্ভর করতে হতো শুধু জীবন্ত প্রাণীর ওপর।  এদের মধ্যে মিল-অমিল, বিকাশের ধরণ, আর ডিএনএ সিকোয়েন্স দেখেই বিবর্তনের ধারা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানতে হতো।
 
ফসিল ছাড়াই আমরা হয়তো জানতে পারতাম, স্তন্যপায়ীরা সরীসৃপ আর উভচরদের কাছাকাছি।  কিন্তু জানতে পারতাম না তাদের পূর্বসুরীরা দেখতে কেমন ছিল।  কিছুই জানতে পারতাম না অতিকায় ডাইনোসরদের কথা, বা  খাড়া হয়ে হাঁটতে শেখা আমাদের নিজেদের পূর্বসুরীদের কথা।  বিবর্তনতত্ত্বের অনেককিছুই থেকে যেতো রহস্যঘেরা।
 
ফসিলের মতো ফসিলের ইতিহাসও পুরোনো।  এরিস্টেটল ফসিলের কথা আলোচনা করেছেন।  প্রাচীন গ্রিক মিথোলজির গ্রিফিন পাখী বা চীনদেশের রূপকথায় কল্পিত ড্রাগনের গল্পের পেছনে ডাইনোসর ফসিলের প্রভাব থাকটা অস্বাভাবিক নয় মোটেও।
 
কিন্তু পাথরের স্তরে পাওয়া ফসিল থেকে জীবনের ইতিহাস বের করে আনা চাট্টিখানি কথা নয়।  প্রথম কথা হলো অনেক অনেক ফসিল পেতে হবে, তারপরে সেগুলোকে বয়স অনুযায়ী সাজাতে হবে, পুরোনো থেকে নতুনতর, এই ধারায়।  শেষে জানতে হবে এদের সঠিক বয়স।  এর কোনটাই খুব সোজা কাজ নয়।
 
ফসিল গঠন হওয়ার প্রক্রিয়াটা কিন্তু খুবই সোজাসাপ্টা।  যদিও নির্দিষ্ট বিশেষ পরিস্থিতি না থাকলে  ফসিল গঠিত হয় না।  প্রথমত, মৃত জীবজন্তু আর গাছপালার দেহাবশেষকে কোন না কোন ভাবে জলের নীচে তলিয়ে যেতে হবে, তারপরে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলোকে পলির আস্তরণে ঢাকা পড়ে যেতে হবে পচন শুরু হওয়ার আগেই।  মৃত উদ্ভিদের বা স্থলচর প্রাণির মৃতদেহের খুব অল্প সংখ্যকেরই  হ্রদ বা সাগরের নীচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  তাই দেখা যায় বেশির ভাগ ফসিলই জলচর জাতীয় প্রানীর বা সামুদ্রিক উদ্ভিদের – যেগুলো সমুদ্রের তলদেশে থাকে বা মরলে যেগুলো সহজেই তলিয়ে যায় সমুদ্রের নিচে।
 
কিছু ফসিলের ছবি দেয়া হলো (চিত্র ১,২, ৩) –


 
আরো সমস্যা আছে।  সাধারণত, জীবজন্তুর শরীরের শক্ত-কঠিন অংশগুলোর ছাপই পড়ে থাকে শিলার গায়ে।  শরীরের মাংসল নরম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে যায় কালের গর্ভে।   এ জন্যে প্রচুর হাঁড় আর দাঁত পাওয়া যায় প্রাচীন জীবজগতের নিদর্শনরূপে।  পোকামাকড় আর কাঁকড়াজাতীয় প্রাণীর শক্ত বহিরাবরণ (শেল) ও শক্ত হাঁড়ের কঙ্কালও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়।  কিন্তু কীট, জেলিফিশ, ব্যাক্টেরিয়া, আর নরম শরীরের পাখিদের ফসিল দূষ্প্রাপ্য।  প্রাণীজগতের ইতিহাসে প্রথম আশি ভাগই (শতকরা হিসাবে) নরম শরীরের।  তাই জৈববিবর্তন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কৌতুহলদ্দীপক অংশটা ধোঁয়াশাচ্ছন্নই রয়ে গেছে আমাদের কাছে।  আর এই কারণেই প্রাণের উৎস সম্পর্কে আমরা এখনো তেমন কিছু জানি না।
 
ফসিল গঠন হওয়ার পরে তাকে টিকেও থাকতে হবে ভূস্তরের নিরন্তর উথাল-পাথাল সহ্য করে।  বেশির ভাগ ফসিলই এই উথাল-পাথালের ধাক্কায় টিকে থাকতে পারে না, ধংশ হয়ে যায়।  যেগুলো টিকে থাকে, সেগুলোকেও আবার আবিষ্কৃত হ’তে হবে।  বেশির ভাগই পৃথিবীর উপরিভাগের অনেক নিচে থাকে – এগুলোর নাগাল পাওয়া প্রায় অসম্ভব।  প্রাকৃতিক কারণে এই উপরিভাগ ক্ষয়ে গিয়ে সমুদ্রের তলদেশটা ওপরে উঠে এসে বৃষ্টি-বাতাসের কারণে উন্মোচিত হলেই কেবল জীবাশ্মবিদদের হাতুড়ি কার্যকর হ’তে পারে – নইলে নয়।  আবার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদেরকে কাজটা সারতে হয় – এই আধা-উন্মোচিত ফসিলগুলো জলবায়ুর উপুর্যুপরি আঘাতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই।
 
নিচে (চিত্র -৪) একটি ফসিলায়িত মাছের ছবি বর্ণনাসহ দেয়া হলো –
 

 

এতসব শর্ত পূরণ করে যে ফসিল রেকর্ড গড়ে ওঠে আর বিজ্ঞানীরা তা সংগ্রহ করেন, তা তো অসম্পূর্ণ  হবেই।  কিন্তু কতটা অসম্পূর্ণ?  ধারণা করা হয় যে, পৃথিবীতে বসবাসকারী স্পিশিজ-এর সঙ্খ্যা ১.৭ কোটি (১৭ মিলিয়ন – আন্দাজটা মনে হয় খুবই কমের দিকে, কারণ এখনকার পৃথিবীতেই প্রায় এক কোটি স্পিশিজ-এর বসবাস) থেকে চারশো কোটি (৪বিলিয়ন) ।  আমরা এই পর্যন্ত মাত্র ২৫০,০০০ ভিন্ন প্রজাতির (স্পিশিজ)-র ফসিল আবিষ্কার করতে পেরেছি।  তা’হলে ধরে নেয়া যায়, পৃথিবীতে বসবাসকারী সমস্ত স্পিশিজের শতকরা মাত্র ০.১ ভাগ থেকে ১ ভাগের ফসিল-সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি।  এটাকে কোন হিসাবেই ‘প্রাণের ইতিহাসে’র মতো বিজ্ঞানের একটা বিরাট শাখার জন্য পর্যাপ্ত নমুনা বলা যায় না।  অনেক বিচিত্র প্রাণীর হয়তো অস্তিত্ব ছিল এই পৃথিবীতে, যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, এবং জানবোও না কোন দিন।  তা সও্বেও, বিবর্তনের প্রক্রিয়াটাকে ভালোভাবে বোঝার জন্য এবং কিভাবে প্রধান প্রধান প্রজাতিগুলো একটা আরেকটা থেকে পৃথক হয়ে গেল তা জানার জন্য যথেষ্ট পরিমানে ফসিল পাওয়া গেছে।
 
মজার ব্যাপার হলো, ফসিল রেকর্ডগুলোকে সাজানোর কাজটা শুরু করেছিলেন বিবর্তনবিজ্ঞানীরা নয়, সৃষ্টিবাদী (ক্রিয়েশনিস্ট) ভুতত্ত্ববিদেরা।  এঁরা জেনেসিস-এর বই থেকে পাওয়া প্রাণের বৃত্তান্তে বিশ্বাস করতেন।  কিন্তু শিলার বিভিন্ন স্তরগুলোকে সাজাতে গিয়ে তাঁরা প্রয়োগ করেন আর কিছু নয়, সাদামাটা সাধারণ জ্ঞান। (এই শিলাগুলোর বেশির ভাগই পাওয়া গিয়েছিল ইংল্যান্ডের শিল্পায়নের (ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন) সমসাময়িক কালে, যখন অনেকগুলো খাল খনন করার দরকার পড়েছিল।)

ফসিল পাওয়া যায় শুধুমাত্র পাললিক শিলায়।  আর পাললিক শিলা গঠিত হয় সমুদ্র, হ্রদ বা নদীর তলদেশে জমতে থাকা মাটি দিয়ে।  স্বাভাবিকভাবেই গভীরতর স্তরগুলোর গঠনের সময়কাল হবে অপেক্ষাকৃত অগভীর স্তরগুলোর গঠনের আগে।  নতুনতর শিলাগুলোর অবস্থান হবে পুরোনোগুলোর ওপরে। কিন্তু মুস্কিল হলো, একটা বিশেষ জায়গায় সব স্তরগুলোকে পাওয়া নাও যেতে পারে – অনেক জায়গায় পলি গঠনের জন্য জলের প্রবাহ নাও থাকতে পারে।
 
তাই শিলার স্তরগুলোকে সময়ের ক্রমানুসারে পুরোপুরি সাজাতে চাইলে দরকার হবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া শিলার মধ্যে বয়স অনুযায়ী একধরনের সম্পর্ক স্থাপন।  যদি একই ধরনের শিলার স্তরে একই ধরনের ফসিল পাওযা যায় দু’টি ভিন্ন  জায়গায়, তা’হলে এটা ধরে নেয়া অসঙ্গত হবে না যে, শিলাস্তর দু’টি একই বয়সের।  ধরা যাক, এক জায়গায় শিলার চারটা স্তর পাওয়া গেল।  এদের নাম দেয়া যাক ABDE,অগভীর থেকে গভীর এই ক্রমানুসারে।  আরো ধরে নেয়া যাক, অন্য আরেকটা জায়গায় এদের মধ্যে দু’টো স্তর A আর E পাওয়া গেলো।  আরো দেখা গেলো, এই দুটোর মধ্যে আর একটা স্তরে BCD রয়েছে।  এ’থেকে কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না, এই পাঁচটা স্তরের বিন্যাস হবে ABCDE – সময়ের বিচারে নবীনতম থেকে প্রাচীনতম এই ধারায়। এর নাম দেয়া হয়েছে উপরিস্থাপনের নীতি (principle of superposition)। সপ্তদশ শতকেরএক ড্যানিশ পন্ডিত নিকোলাস স্টেনো (Nicolaus Steno) এই নীতি উদ্ভাবন করেন।  স্টেনো পরে আর্চবিশপ হয়েছিলেন এবং ঊনিশশো অষ্টাশিতে পোপ তাঁকে সেইন্ট-র সম্মান দেন।  ইতিহাসে ইনিই মনে হয় একমাত্র সেইন্ট যাঁর দ্বারা কোন গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক নীতি আবিষ্কৃত হয়েছে।
 
স্টেনোর নীতি ব্যবহার করে অষ্টাদশ আর নবম শতাব্দীতে ভূতাত্ত্বিক তথ্যসমূহ বা রেকর্ড – সেই ক্যাম্ব্রিয়ান (Cambrian)থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত – সাজানো হয়।  কাজটা ছিল সময়সাপেক্ষ এবং কঠিণ।  তা তো হলো।  কিন্তু এই সাজানোর ফলে শিলাস্তরের শুধু আপেক্ষিক বয়স সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল।  এই স্তরগুলোর আসল  বয়স তো জানা গেলো না।
 
১৯৪৫ থেকে বিজ্ঞনীরা কিছু শিলার আসল বয়স নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন – তেজস্ক্রিয়তা বা radioactivity (রেডিওএক্টিভিটি) -র সাহায্যে।  গলিত লাভার শক্ত হওয়ার সময় কিছু রেডিওএক্টিভ মৌলিক পদার্থ বা radioisotopes (রেডিওআইসোটোপ) আগ্নেয় শিলার মধ্যে র’য়ে যায়।  রেডিওআইসোটোপ ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অন্য মৌলিক পদার্থে পরিণত হয়।  ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটা ঘটে একটা নির্দিষ্ট (constant) হারে আর এই হারটাকে মাপা হয় “অর্ধ-জীবন” বা “হাফ-লাইফ” দিয়ে।  হাফ-লাইফ হচ্ছে সেই সময়টুকু যেটুকুতে আইসোটোপের অর্ধেকটা ‘নাই’ হয়ে যায়।  হাফ-লাইফ কতটা, আর শিলা গঠিত হওয়ার সময়ে কতটুকু রেডিওআইসোটোপ ছিল (ভূতত্ত্ববিদরা এই তথ্যটা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করতে পারেন), আর এখন কতটুকু অবশিষ্ট আছে, এ’তথ্যগুলো জানা গেলে শিলার বয়স বের করাটা তুলনামূলক বিচারে একটা সহজ-সরল কাজ।  অনেকটা ঘড়ি দেখে সময় বলে দেবার মতো ব্যাপার!
 
একেক রকমের আইসোটোপ-এর ক্ষয়প্রাপ্তির হারও একেক রকম।  খুব পুরোনো শিলার বয়স সাধারনত নির্ধারণ করা হয় ইউরেনিয়াম-২৩৮ (ইউ-২৩৮) দিয়ে (সাধারণ খনিজ জিরকন-এ থাকে)।  ইউ-২৩৮-এর হাফ-লাইফ প্রায় সত্তর কোটি (৭০০ মিলিয়ন) বছর।  তুলনায় কার্বন-১৪-এর হাফ-লাইফ হচ্ছে মাত্র ৫,৭৩০ বছর, আর তাই কার্বন-১৪ ব্যবহৃত হয় নতুনতর শিলার ক্ষেত্রে।  কম হাফ-লাইফের জন্য কার্বন-১৪ মানুষ-নির্মিত ঐতিহাসিক হাতিয়ারের বয়স নির্ধারণের কাজেও ব্যবহৃত হয়।
 
এই লেখাটা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি, তখনই (গত সপ্তাহে) আমার সুযোগ হলো নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যচারাল হিস্ট্রি দেখতে যাওয়ার।  দূর্লভ সু্যোগ ছিল এটি আমার জন্য। বেশ কিছু ছবি আমি তুলেছি যার কিছু এই লেখায় সংযোজন করা হলো।  নিচের ছবিতে (চিত্র -৫ আর চিত্র -৬) রেডিওএক্টিভ ডেটিং-এর পদ্ধতি সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।   
 

 
শিলায় সাধারণত, কয়েক ধরনের রেডিওআইসোটোপ একসাথে পাওয়া যায়।  এ’তে সুবিধা হয় কারণ, একটার বয়সের হিসাবের সাথে আরেকটার হিসাব সহজেই মিলিয়ে নেয়া যায়, এবং প্রায় কখনোই গরমিল হ’তে দেখা যায় না।
 
কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই গেল।  যে শিলাগুলোতে ফসিল পাওয়া যায় সেগুলো আগ্নেয় নয়, বরং পাললিক শিলা।  পাললিক শিলার বয়স সরাসরি নির্ধারণ করা যায় না। এজন্যে আমাদের খুঁজে পেতে হয় পাললিক শিলাস্তরের সংলগ্ন আগ্নেয় শিলার স্তর।
 
বিবর্তনবিরোধীরা শিলাস্তরের বয়স নির্ধারণের এই পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করে – এই বলে যে, রেডিওআইসোটোপ-এর ক্ষয়প্রাপ্তির হার বছরের পর বছর একই থাকতে পারে না বা চাপ ও তাপের প্রভাবে, শিলাস্তরের বৈশিষ্ট্যও সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।  এই প্রশ্নগুলো তোলেন সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসীরা, যারা বিশ্বাস করেন এই পৃথিবীর বয়স ছয় থেকে দশ হাজার বছর মাত্র।  কিন্তু তাদের ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক।
 
তাদের ধারণা সত্যি হলে ভিন্ন ভিন্ন রেডিওআইসোটোপ ভিন্ন ভিন্ন হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও শিলার বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে বার বার একই ফল দিতো না।  বিজ্ঞানীরা  ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখেছেন চরম তাপ আর চাপের মধ্যেও আইসোটোপগুলোর হাফ-লাইফে কোন তারতম্য হয় না।  আবার  তেজষ্ক্রিয়তার সাহায্যে নির্ধারিত (যেমন, কার্বন-১৪) বয়সের সাথে ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া বয়সের তুলনা করলে দেখা যায় তারা একই।  পতিত উল্কার তেজস্ক্রিয়তা নির্ধারণ করেই আমরা জানতে পেরেছি এই পৃথিবী আর সৌরমন্ডলের বয়স প্রায় চারশো ষাট কোটি বছর (৪.৬ বিলিয়ন)।  (আসলে, কানাডার উত্তরাংশ থেকে পাওয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলার বয়স আরেকটু কম, প্রায় চারশো তিরিশ কোটি বা ৪.৩ বিলিয়ন বছর।)
 
তেজষ্ক্রিয়তার সাহায্যে বয়স নির্ধারণের প্রক্রিয়া (রেডিওমেট্রিক ডেটিং) যে সঠিক, তা প্রমাণিত হয় অন্যভাবেও।  কর্নেল ইউনিভার্সিটির জন ওয়েলস জীববিজ্ঞানের গবেষণায় ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তাঁর কাজ হচ্ছে প্রবালের ( coral) ফসিল নিয়ে।  রেডিওআইসোটোপের পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই প্রবালগুলো বেঁচে ছিল ডেভোনিয়ান যুগে (Devonian Period) প্রায় আটত্রিশ কোটি বছর আগে। কিন্তু ওয়েলস এই প্রবালগুলোকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেই বলে দিতে পেরেছিলেন কখন এরা জীবিত ছিল।
 
সমুদ্রের জোয়ার-সৃষ্ট ঘর্ষণের (tidal friction) ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি সময়ের সাথে ক্রমশ কমে যাচ্ছে এই সত্যটাকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। আসলে হয় কি, প্রতিদিন পৃথিবী একবার পুরো ঘুরে আসতে যে সময়টা নেয় তা আগের দিনের চেয়ে একটু বেশি।  এটা এত কম যে কারোরই বোঝার কথা নয়।  সময়ের এই বৃদ্ধিটা প্রতি একলক্ষ (১০০,০০০) বছরে মাত্র দুই সেকেন্ডের মতো।  কিন্তু যেহেতু পৃথিবীর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করার সময় – মানে এক বছরের সময়কাল – অপরিবর্তিত থাকছে,প্রতি বছরে দিনের সংখ্যা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে।  ওই দৈনিক ঘূর্ণনের সময় একটু বেশি নেয়ার জন্য।  বছরে দিনের সংখ্যা কমে যাওয়ার হারটা হিসেবে নিয়ে ওয়েলস নির্ধারণ করলেন, তাঁর প্রবালেরা যখন জীবিত ছিল তখন – আটত্রিশ কোটি বছর আগে (রেডিওমেট্রিক পদ্ধতি যদি সঠিক হয়) – বছরে দিনের সংখ্যা ছিল তিনশত ছিয়ানব্বই, আর দিনগুলো ছিল বাইশ ঘণ্টার।  ল্যাঠা চুকে যেত যদি ফসিলেরা নিজেরাই বলে দিতে পারতো যখন তারা বেঁচে ছিল তখন দিনের দৈর্ঘ্য কত ছিল।
 

ওপরের ছবিতে (চিত্র-৭), বয়স নির্ধারণের আরো একটু জটিল পদ্ধতি (ফিশন ট্র্যাক-এর সাহায্যে) বর্ণনা করা হয়েছে। 
 
কিন্তু কথা না বলেও প্রবালেরা ঠিক এই কাজটাই করতে পারে।  প্রতি বছরে কতদিন গেল তার চিহ্ন থেকে যায় তাদের শরীরে।  অনেকটা গাছের ‘এনুয়াল গ্রোথ রিং’-এর মতো। জীবিত প্রবালের শরীরে দৈনিক আর বাৎসরিক ‘গ্রোথ রিং’-এর চিহ্ন পড়ে।  প্রবাল-ফসিলের শরীর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কতগুলো দৈনিক রিং একেকটা বাৎসরিক রিং-এর জন্ম দিচ্ছে।  অর্থাৎ, যখন তারা বেঁচে ছিল তখন বছরে কতদিন ছিল তা জানা যাচ্ছে।  জোয়ারের কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সময় কমে যাওয়ার হারটা যদি জানা থাকে,  খুব সহজেই ‘টাইডাল’ বয়সের সাথে ‘রেডিওমেট্রিক’ বয়স মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।  ওয়েলস তাঁর ডেভোনিয়ান প্রবালের রিংগুলো গুনে বের করলেন, তখন বছরে চারশো দিন ছিল।  তার মানে প্রতিটা দিন ছিল ২১.৯ ঘণ্টা দীর্ঘ।  এই সময়টা রেডিওমেট্রিক পদ্ধতিতে নির্ধারিত অনুমান ২২ ঘণ্টার খুবই কাছাকাছি।  রেডিওমেট্রিক ডেটিং যে সঠিকভাবেই ফসিলের বয়স নির্ধারণ করতে পারে জীববিজ্ঞানের এই পরীক্ষাটা তারই অকাট্য প্রমাণ।

তথ্যসূত্র –

Coyne, J. Why Evolution is True, Viking, 2009.

কোয়েনের বই-এর ওয়বসাইট – http://jerrycoyne.uchicago.edu/index.html

লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো লেখকের ক্যামেরায় ধারণকৃত (বলাবাহুল্য আনাড়ি হাতে) – নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির সংগ্রহ।

(চলছে…)