“There is grandeur in this view of life, with its several powers, having been originally breathed by the Creator into a few forms or into one; and that, whilst this planet has gone cycling on according to the fixed law of gravity, from so simple a beginning endless forms most beautiful and most wonderful have been, and are being, evolved.”
— Charles Darwin, On the Origin of Species by Means of Natural Selection.
এই যে বিবর্তন তত্ত্ব দাবি করে অমুক জীব থেকে তমুক জীব এসেছে, কেন তা দাবি করে এ প্রশ্ন কোনোদিন আপনার মনে আসেনি? প্রকৃতিতে চলা অনবরত সংগ্রাম, যোগ্যতম প্রাণিদের টিকে যাওয়া, তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসতে আসতে অন্য প্রাণিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার পর্যবেক্ষণ কেবল ডারউইনই করেন নি। ডারউইনেরও এক হাজার বছর আগে সেই প্রাচীন ইরাকে বসে আল জাহিজ খুব সূক্ষ্মভাবে তা পর্যবেক্ষণ করেন। এ নিয়ে ‘কিতাব আল-হায়ওয়ান’ নামে সাত খন্ডের বই লিখে বসেন। এরপর ইউরোপে সভ্যতার হাওয়া লাগার পর ইংরেজ দার্শনিক, ন্যাচারালিস্ট চার্লস ল্যায়ল, জর্জ ক্যাভিয়ার, জন ব্যাপ্টিস্ট ল্যামার্ক প্রমুখদেরও নজরে আসে প্রকৃতিতে ঘটে চলা অনবরত এই টিকে থাকার সংগ্রাম, যোগ্যতমের টিকে যাওয়া। বিশ্বাস করুন, প্রকৃতির এ বাস্তবতা উন্মোচনের এই দৃশ্যপটে ডারউইনের প্রবেশ বেশ পরে হয়েছে। একই সাথে বলে রাখি, বিবর্তন তত্ত্ব মানেই ডারউইন নয়। বিবর্তন তত্ত্ব গত দেড়শো বছর ধরে শত শত জিনতত্ত্ববিদ, জীবাশ্মবিদ, ভূতত্ত্ববিদ এমনকী প্রকৌশলীদের হাতে গড়ে ওঠা জীববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান একটি খুঁটি। ডারউইন নিজেও বিবর্তনের অনেক মেকানিজম ভালো করে ব্যখ্যা করে যেতে পারেন নি। কোথাও বা গলদ পাকিয়েছেন নানান সীমাবদ্ধতার কারণে। এটুকুর জন্য আলাদা প্রবন্ধ লিখা যায়। এ প্রবন্ধ পড়তে পড়তে আরও টের পেয়ে যাবেন এ তত্ত্বের ব্যাপ্তি কত সুবিশাল।
মূল আলোচনায় ফেরা যাক, এ লেখাটি যারা যারাই পড়তে এসেছেন, আমি ধরেই নিয়েছি, আপনার বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে ইতিমধ্যে মোটামুটি অল্প কিছু পড়াশোনা করে ফেলেছেন। আমি ধরে নিয়েছি আপনি কোষ বিভাজন, মিউটেশন, সেন্ট্রাল ডগমা ইত্যাদি নিয়ে স্কুল-কলেজে কিছু না কিছু পড়েছেন। তাও ভয় পাবেন না। এখানে অল্প পরিসরে কিছু বেসিক ব্যাপার আলোচনা করা হয়েছে, মূল আলোচ্য টপিকের সাথে সাথে। তবে হ্যাঁ, পাঠকদের একটুখানি সতর্ক করিয়ে দিতে চাই যে, এ লেখাটি সময়ের সাথে সাথে একটু গভীর এবং গুরুগম্ভীর হতে যাচ্ছে। আপনার যদি মনে হয়, কীভাবে একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটে জানা জরুরী কিংবা কী কী ব্যাপার জানলে-বুঝলে আর কোনোদিন ‘প্রজাতির উদ্ভব’ ধারণাটিকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে ফেলার মতো অবস্থা হবে না আপনার, তাহলে এ লেখাটি আপনার জন্য। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এটা পড়ার পর বিবর্তন নিয়ে আপনার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থাকলে তা চলে যাবে। পুরো লেখাজুড়েই আমরা বিবর্তনের অসংখ্য উদাহরণ দেখবো, সেগুলিকে কাটাছেঁড়া করবো, জানার চেষ্টা করবো কী হয়েছিলো, কীভাবে হয়েছে, জিনের ঠিক কোথায় কী ঘটার ফলে ‘ক’ থেকে ‘খ’ হয়ে গেছে।
বিবর্তন ব্যাপারটা আসলে কী? বিবর্তন মানে হচ্ছে, descent with modification- অর্থাৎ এক জীবের পপুলেশানে পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্য জীবের(প্রজাতির) আবির্ভাব। আপনাকে যদি বলা হয়, কেন ভূমিকম্প হয়, সেটুকুর empirical আর সায়েন্টিফিক ব্যখ্যা আপনি জানতে চাইলে কোথা থেকে জানতে হবে? সেটা জানতে আপনাকে ‘প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব’ নামে বিজ্ঞানের এক প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দ্বারস্থ হতে হবে। বিকল্প, প্রমাণিত কোনো ব্যখ্যা নেই। একই ভাবে আমাদের মানুষ হিসেবে আবির্ভাবের ব্যখ্যা বিজ্ঞান দিয়ে জানতে কেবল এবং কেবল মাত্রই ‘থিওরি অব ইভোলিউশন’ এর দ্বারস্থ হতে হবে। সহজ করে বললে, বিবর্তন হলো জীববিজ্ঞানের অন্যতম মূল ভিত্তি, যা পৃথিবীতে জীবের বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে সময়ের সাথে সাথে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের মাধ্যমে। আজকে আমরা দেখবো, বিবর্তন তত্ত্ব কীভাবে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব ব্যখ্যা করে, কীভাবেই বা তা প্রমাণ করেছে।
১. প্রজাতি কী?
আরও গভীরে ঢোকার পূর্বে ‘প্রজাতি’ শব্দটিকে আপনাদের সাথে ভালো করে পরিচয় করাতে চাচ্ছি। ১৯৪২ সালে বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ার তাঁর Systematics and the Origin of Species শীর্ষক গবেষণাপত্রে ‘প্রজাতি’কে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে-
“প্রজাতি হলো এমন এক জনগোষ্ঠী, যারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারে বা এর সম্ভাবনা রাখে, তবে অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের প্রজনন সম্ভব নয়, কারণ তারা প্রজননগতভাবে আলাদা।” [১][২]
আমি যদি নিজ ভাষায় একটু সহজ করে বলি, তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে, প্রজাতি হল একটা স্বতন্ত্র এবং প্রজননগতভাবে আলাদা জনগোষ্ঠী, যারা নিজেদের জনগোষ্ঠীর বাইরে অন্য কারো সাথে প্রজনন করে না অথবা করতে পারে না। অর্থাৎ, কুকুর কেবল কুকুরের সাথেই প্রজনন করতে পারবে, বিড়াল কেবল বিড়াল সাথে। এদের যৌন মিলন হলেও কোনো প্রজনন ঘটবে না, কারণ এরা দুটি ভিন্ন প্রজাতির। আমাদের দেয়া প্রজাতির এ ধারণাটিকে বলা যায় ‘বায়োলজিকাল স্পিসিজ কন্সেপ্ট’। আমরা প্রজাতি সংজ্ঞাটা ব্যবহার করলাম এখানে, তা আমাদের আশেপাশের অধিকাংশ জীবের জন্য প্রযোজ্য, মানে যারা যৌন জননের মাধ্যমে প্রজনন করে থাকে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া বা অতি ক্ষুদ্র জীবগুলোর ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়। জীব জগতের অধিকাংশ প্রাণী যৌন প্রজননের মাধ্যমে নিজেদের বংশবিস্তার করে ও প্রজাতি গঠন করে—যেখানে প্রজননের মাধ্যমে নতুন জীব তৈরি হয় এবং একই প্রজাতির প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য আনুবিক্ষণিক জীব, এমনকি অনেক উদ্ভিদও যৌন প্রজননের মাধ্যমে জন্মায় না। ফলে তাদের প্রজাতি নির্ধারণের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যাকে পলিফেসিক পদ্ধতি বলা হয়। এখানে প্রাণীর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য (ফেনোটাইপ) এবং জেনেটিক গঠন (জেনোটাইপ) উভয়কেই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় “মরফোলজিকাল স্পিসিজ কনসেপ্ট”।
অন্যদিকে, লক্ষ-কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জীবগুলোর ক্ষেত্রে প্রজাতি নির্ধারণ করা আরও চ্যালেঞ্জিং। বিজ্ঞানীরা ফসিল আবিষ্কার করে সেই প্রাণীদের প্রজাতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফসিল থেকে তাদের প্রজনন পদ্ধতি সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, যার মাধ্যমে তাদের প্রজাতি সহজে নির্ধারণ করা যেত। তাই এই ধরনের বিলুপ্ত প্রাণীর প্রজাতি নির্ধারণ করার জন্য মরফোলজিকাল স্পিসিজ কনসেপ্ট ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, ফসিলের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে বর্তমানে জীবিত প্রাণীদের সাথে তুলনা করে তাদের প্রজাতি নির্ধারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার মডেলের সাহায্যে তুলনা করেন এবং সম্ভাব্য ভুলগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
তবে শুধুমাত্র মরফোলজিকাল স্পিসিজ কনসেপ্ট নয়, প্রজাতি নির্ধারণে আরও কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, Phylogenetic species concept-এ প্রাণীদের জেনেটিক গঠন এবং বিবর্তনীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রজাতি নির্ধারণ করা হয়। Nominalistic species concept অনুযায়ী, প্রকৃতিতে প্রজাতি বলতে কিছু নেই; এটি শুধু মানুষের দ্বারা তৈরি একটি শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি। Ecological species concept-এ প্রজাতি নির্ধারণ করা হয় তাদের বাস্তুসংস্থানিক নির্ভরতার ওপর ভিত্তি করে, অর্থাৎ, তারা কীভাবে পরিবেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং কীভাবে তাদের বাস্তুসংস্থানীয় ভূমিকা পালিত হয়। যদিও প্রজাতি নির্ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, আমাদের পরিচিত আশেপাশের জীবের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা প্রধানত ‘বায়োলজিকাল স্পিসিজ কনসেপ্ট’ ব্যবহার করেন। এই ধারণা অনুযায়ী, কোনো দুটি প্রাণী যদি প্রজননের মাধ্যমে উর্বর বংশধর উৎপাদন করতে পারে, তাহলে তারা একই প্রজাতির অন্তর্গত। নানাভাবেই একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রজাতি পাল্টে যেতে পারে বিবর্তনের লম্বা স্রোতে।
প্রজাতির সংজ্ঞা পরিস্কার করার পর এবার আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে নিই মাইক্রো বিবর্তন এবং ম্যাক্রো বিবর্তনকে। কারণ, সামনে অনেকবার আসবে এ টার্মদুটো। মাইক্রো বিবর্তন (Microevolution) হলো একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ভেতরে ক্ষুদ্র পরিসরে জেনেটিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এই মাইক্রো বিবর্তন একই প্রজাতির জনসংখ্যার ভেতরে প্রাকৃতিক নির্বাচন, জিন প্রবাহ, জিনগত ড্রিফট বা মিউটেশনের মাধ্যমে ঘটে। এর ফলে প্রজাতির বৈশিষ্ট্যগুলিতে ছোট ছোট পরিবর্তন দেখা দেয়, যেমন রঙ, আকার, বা আচরণগত পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ, কোনও পতঙ্গের জনসংখ্যা কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করলে, ব্যাক্টেরিয়ার এন্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স তৈরি করলে তা মাইক্রো বিবর্তনের আওতায় পড়ে।
অন্যদিকে, কোনো প্রজাতির অনেক অনেক দিনের, দীর্ঘ সময় ধরে ঘটা অনেক ধরণের মাইক্রো বিবর্তনের ফল হচ্ছে ম্যাক্রো বিবর্তন। আরেকভাবে বললে, ম্যাক্রো বিবর্তন (Macroevolution) ঘটে বৃহত্তর পরিসরে নতুন প্রজাতির উদ্ভব এবং বিলুপ্তির মাধ্যমে। এটা সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচন বা অন্যান্য বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার ফলে ঘটে এবং নতুন প্রজাতির উদ্ভব, পরিবর্তন বা বিবর্তনকে বোঝায়। কোনো প্রজাতিতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা মাইক্রো বিবর্তনের ফলে সেই নির্দিষ্ট প্রজাতি জেনেটিক্যালি এতোটাই পাল্টে যায় যে পবর্তীতে সে প্রজাতিটি তার পূর্বের প্রজাতির সাথে প্রজননে সক্ষম হয় না। হলেও তাদের থেকে জন্ম নেয়া বাচ্চাটি প্রজননক্ষম হয় না। এই ঘটনাটিকেই আমরা বলি প্রজাতির উদ্ভব, বা ইংরেজিতে স্পিসিয়েশন (Speciation)। রাশভারী বাংলায় একে আমরা বলতে পারি ‘প্রজাতিকরণ’। আর এই প্রজাতিকরণ হয় যে ধরণের বিবর্তনে, সেটিকে আমরা বলি ম্যাক্রো বিবর্তন। যেমন, ইওহিপ্পাস নামক কুকুর আকৃতির এক প্রাণী ৫ কোটি ৬০ লক্ষ যাবত নানান ধাপে বিবর্তিত হতে হতে আজকের ঘোড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইওহিপ্পাস থেকে ঘোড়া আসলেও তারা গঠনগত ও জেনেটিক্যালি অনেক ভিন্ন। ম্যাক্রো বিবর্তন সাধারণত দীর্ঘ সময় ব্যবধানে হয়ে থাকে। সেটা কয়েক হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ, এমনকী কয়েক কোটি বছর ধরে ঘটতে পারে। তবে, মাঝে মাঝে নানান প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কারণে কখনো কখনো ম্যাক্রো বিবর্তন খুব দ্রুত গতিতে ঘটতে পারে, বিশেষ করে যদি কোনো সংকটময় বা পরিবেশগত চাপ থাকে। সামনে এ ব্যাপারে আমরা বেশ কিছু উদাহরণ পেশ করবো। এ ব্যাপারে জীবাশ্মবিদ ড. রিচার্ড ডকিন্সের বক্তব্য,
“(ম্যাক্রো) বিবর্তন সাধারণত মানুষের জীবদ্দশায় কোনো বড় প্রভাব ফেলার মতো যথেষ্ট দ্রুত হয় না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, যখন সঠিক পরিস্থিতি থাকে, তখন বিবর্তন কখনো কখনো আশঙ্কাজনকভাবে দ্রুত ঘটতে পারে। আশা করা যায়, বার্ড ফ্লু (পাখির ফ্লু) এরকম একটি উদাহরণ হয়ে উঠবে না।”
সংক্ষেপে বলি, মাইক্রো বিবর্তন প্রজাতির ভেতরে ক্ষুদ্র পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, আর ম্যাক্রো বিবর্তন দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি বা বড় বিবর্তনীয় পরিবর্তনকে বোঝায়।
এবার দায়মুক্তির জায়গাটায় আসি, পুরো লেখার অধিকাংশ স্থানেই আমি ‘প্রজাতির উদ্ভব’ ব্যবহার না করে এই ‘স্পিসিয়েশন’ শব্দটি ব্যবহার করেছি কিংবা কোথাও ‘প্রজাতিকরণ’। প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি বছর পূর্বে আর্কিয়ন ইওনে মহাসাগরে উদ্ভব হওয়া সরল এককোষী জীব থেকে জটিল মেরুদণ্ডী প্রাণী পর্যন্ত, বিবর্তনের এই বিশাল যাত্রার অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হলো “প্রজাতি উদ্ভব” বা স্পিসিয়েশন। আমরা স্পিসিয়েশনের নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করেছি চারটি বিষয়কে, যেগুলি একত্রে বা ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে নতুন প্রজাতির উদ্ভবে। এ চারটি চালিকাশক্তি হচ্ছেঃ
১. প্রজনন বিচ্ছিন্নতা (Reproductive Isolation)
২. প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)
৩. যৌন নির্বাচন (Sexual Selection)
৪. জেনেটিক ড্রিফট (Genetic Drift)
৫. জিন প্রবাহ (Gene Flow)
সবার আগে জানা যাক, কীভাবেই বা মিউটেশন ঘটে; কীভাবেই বা জিনে যুক্ত হয় নতুন বৈশিষ্ট্য— এবং কীভাবেই বংশপরাম্পরায় এ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হতে সেটি সে জীবে্র পপুলেশনে স্থায়ী হয়, কীভাবেই বা বিবর্তনের ভিত্তি এই মিউটেশন। যদিও মিউটেশন নিয়ে এখানে আমাদের আলোচনাটা এতোটাও সুগভীর হতে যাচ্ছে না, তাও চেষ্টা করবো মিউটেশন নিয়ে একটা ভালো রকমের জ্ঞান নিয়ে বাকি লেখাটায় ঝাপিয়ে পড়ার। মূল আলোচনার শেষে আমরা আমাদের নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করা বা চোখের সামনে ঘটা কিছু ম্যাক্রো এবং মাইক্রো বিবর্তনের উদাহরণ দেখবো। কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো, যেমন— নতুন প্রজাতির জন্মের জন্য কি অবশ্যই পূর্ববর্তী প্রজাতির বিলীন হতে হবে? কিংবা, একই প্রজাতি থেকেই কি একাধিক নতুন প্রজাতির জন্ম হতে পারে? পরিস্কার করবো প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়ানো নানান ভুল ধারণা।
২. বিবর্তনের ভিত্তিঃ মিউটেশন
যারা মিউটেশন নিয়ে ভালোভাবে জানেন, তারা চাইলে এ অংশটা না পড়ে পরবর্তী আলোচনায় চলে যেতে পারেন। এখানে বিবর্তনের গল্প খুব একটা হবে না। এ অংশে পুরোটা লেখা বুঝার জন্য প্রয়োজনীয় জীববিজ্ঞান, জেনেটিক্স শেখা হবে। খুব বেশি না অবশ্য।
আধুনিক বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে মিউটেশন। একটা প্রজাতির উদ্ভব ন্যাচারাল সিলেকশানেই হোক, জেনেটিক ড্রিফটে হোক কিংবা জিন প্রবাহের মাধ্যমেই হোক—জেনেটিক ভ্যারিয়েশন ঘটার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে মিউটেশন। অর্থাৎ, বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে মিউটেশন। চার্লস ডারউইন যখন বিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, তখন পৃথিবীবাসীর এমনকী, তাঁর নিজেরও ক্রোমোজোম, ডিএনএ, জিন ইত্যাদি নিয়ে কোনো ধারণা ছিলো না। ডারউইন বিবর্তনকে দেখেছিলেন ব্যক্তিগত প্রাণী বা উদ্ভিদ এবং প্রজাতি লেভেলে। কিন্তু, আধুনিক জিনতত্ত্বের উন্নতির সাথে সাথে আমরা বুঝতে পেরেছি যে বিবর্তন ঘটছে জিন, বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য এবং পপুলেশনে।
২.১ মিউটেশনের পরিচয়, প্রকারভেদ ও আদ্যোপান্ত
একজন ছাপোষা লেখক হিসেবে আমি মোটেও আপনাদের ছোট করে দেখছি না। তাও, মিউটেশনের এই খটমটে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আপনাদের আবারও মনে করিয়ে দিই ক্রোমোজোম, ডিএনএ(DNA) এবং জিন(Gene) কী জিনিস। কারণ, এ লেখাটিতে আপনি এত্তোবার এ শব্দগুলো পাবেন, সংজ্ঞা ভুলে গেলে রেগেমেগে পড়া বাদ দিয়ে বেড়িয়ে যেতে পারেন। যারা একাডেমিক বা নার্ডি গোছের আলোচনা পছন্দ করেন, তাঁরা আমার এসব অতি সরলীকৃত, সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা পছন্দ না-ও করতে পারেন। তাঁদের কাছে অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
ক্রোমোজোম কী?
ক্রোমোজোমকে আমি বলবো একটা প্যাকেজ। তার কাজ হচ্ছে আমাদের বংশগতীয় যাবতীয় সব কাজ-টাজ সামলানো। কোষের কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। সেই নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকে সুতার মতো এই বস্তু। ক্রোমোজোম তার নিজের ভেতর আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর জেনেটিক রেকর্ড, আমাদের বৈশিষ্ট্য, আমাদের যাবতীয় তথ্য ধারণ করে রাখে ডিএনএ নামক এক বিশেষ অণুর মাধ্যমে। প্রতিটি কোষে কতোগুলো ক্রোমোজোম থাকবে, তা নির্ভর করে প্রজাতির ওপর। অর্থাৎ, একেক জীবে একেক সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে। যেমন আমাদের ৪৬ টি (২৩ জোড়া), আমাদের চাচাতো ভাই গরিলাদের ৪৮ টি (২৪ জোড়া)। ক্রোমোজোমের অর্ধেক আসে বাবা থেকে, বাকি অর্ধেক মায়ের থেকে।
ডিএনএ কী?
আপনাকে হতাশ করে দিয়ে শুরুতেই এর পূর্ণরূপ বলি, Deoxyribonucleic acid । আমাদের কোষের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটা অণু। প্রায় সব জীবকোষেই পাবেন। জীবের দেহের গঠন কেমন হবে, কোষগুলোর বিভিন্ন অঙ্গাণু কীভাবে তৈরি হবে, কতখানি করে তৈরি হবে, কোন কারণে ভেঙে গেলে মেরামত কী করে করতে হবে, ইত্যাদি হাজাররকম তথ্য এই ডিএনএর মধ্যে চারটা অক্ষর দিয়ে লেখা থাকে। সেই চারটা অক্ষর হচ্ছে, adenine (A), cytosine (C), guanine (G), এবং thymine (T) নামক চারটা নাইট্রোজেন ক্ষার। এই ডিএনএ-র ভেতর আবার থাকে জিন। সেটা পরে বুঝাচ্ছি। এই ডিএনএ-কে আমরা বলি জীবন রহস্য বা নীলনকশা।
জিন কী?
সহজ করে বললে, জিন হচ্ছে আমাদের শরীরের সবকিছু তৈরির নকশা। যেকোন জীবকোষের বেঁচে থাকার জন্য অসংখ্য রকম যন্ত্রের দরকার হয়- শক্তি উৎপাদনের যন্ত্র, অক্সিজেন পরিবহণের যন্ত্র, জিনিসপত্র চলাচলের যন্ত্র। আপনার দেহের কোটি কোটি কোষ তাদের অসংখ্য যন্ত্র দিয়ে সবসময় কাজ করছে বলেই আপনি এখন এত সুন্দর বেঁচেবর্তে আছেন। তো এরকম একেকটা যন্ত্র তৈরির নির্দেশনা একেক টুকরো ডিএনএতে লেখা থাকে চারটা অক্ষর দিয়ে। এই ডিএনএ টুকরোগুলোই জিন। এই জিনে নাইট্রোজেন ক্ষারগুলি একেকটা একেক সজ্জায় থেকে একেকটা তথ্য ধারণ করে। জিন থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে সৃষ্টি হয় আমাদের দেহে প্রোটিন। প্রোটিন তৈরি হয় তিন-বেসের কোডন অনুযায়ী। সে প্রোটিনগুলিই আমাদের দেহের নানান বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। যেমন ধরুন, আপনার চোখের রঙ। সেটার জন্যেও আপনার ডিএনএ তে কোথাও না কোথাও, কোনো লোকেশানে আলাদা নাইট্রোজেন বেইস এর কম্বিনেশন আছে। সেই ইউনিক কম্বিনেশনকে ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করে চোখের জন্য তৈরি হওয়া প্রোটিনটিই আপনার চোখের রঙ প্রকাশ করেছে। এভাবে আপনার প্রকাশিত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জিন। গায়ের রঙ কেমন হবে, বড় হয়ে চুরি বাটপারির প্রবণতা থাকবে কিনা, কতোটা লম্বা হবেন, দেখতে কেমন হবেন—সবকিছু কেবল চারটা অক্ষরে বিভিন্ন ভাবে সাজানো থাকে। জিনকে আপনি ব্লুপ্রিন্ট বা নীলনকশা ভাবতে পারেন। এ অংশের ছবিটিতে আমরা একই সাথে কোষ, তার কেন্দ্রের নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা ক্রোমোজোম দেখতে পাচ্ছি, তার ভেতরে ঢুকে দেখতে পাচ্ছি ডিএনএ, এবং এই ডিএনএ-র ভেতরে থাকা নাইট্রোজেন বেইসগুলি নির্দিষ্ট সজ্জা জিনকে দেখতে পাচ্ছি। ছবিটি নেয়া হয়েছে Wikimedia Commons থেকে।
জিনপুল কি?
কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতির নির্দিষ্ট পপুলেশনে বিদ্যমান সকল প্রকার জিনের সমষ্টিকে বলে জিন পুল। ধরা যাক ‘ক’ নামক একটি পপুলেশনে ৫ প্রকার জিন, A, B, C, D এবং E আছে। তাহলে সেই ‘ক’ পপুলেশনের জিনপুল হবে এই সবগুলো জিনের সমষ্টি(A+B+C+D+E)। একেকটা জিনের আবার ভিন্ন ভিন্ন রূপ, তথা এলিল থাকতে পারে। প্রতিটি এলিলেরই প্রায় একই কন্ট্রিবিউশন থাকে সে পপুলেশনের জিনপুলে। এবার প্রশ্ন আসে, অ্যালিল কী?
অ্যালিল কী?
একই জিনের বিভিন্ন রূপভেদকে অ্যালিল বলে। দাঁড়ান, একটা উদাহরণ দিয়ে আরও সহজ করে দিই, মোটর গাছের উদাহরণ দেয়া যাক। মোটর গাছের কান্ডের দৈর্ঘ্য অর্থাৎ উচ্চতা নিশ্চয়ই একটি জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন, এই উচ্চতা দুই রকমের হতে পারে, হয় লম্বা নাহয় খাটো। এই কান্ডের উচ্চতার জন্য দায়ী জিনটির তাই দুটি আলাদা রূপ থাকবে, ধরে নিই লম্বার জন্য জিনের সে রূপটি T এবং খাটোর জন্য t । এখানে T এবং t এরা বিপরীত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করছে—এবং এরাই একে ওপরের অ্যালিল। যদি কোনো মোটর গাছে T প্রকট হয়, তাহলে সে গাছের কান্ড লম্বা হবে। গাছটায় খাটো হওয়ার বৈশিষ্ট্য, t থাকার পরও কেবল সেটা প্রচ্ছন্ন হওয়ার কারণে গাছটা খাটো হবে না। আশা করি, অল্প হলেও বুঝেছেন অ্যালিল ব্যাপারটা আসলে কী।
মিউটেশন কী?
আপনারা আগে থেকেই এটুকুও হয়ত জানেন যে, আমাদের ডিএনএর মধ্যে নানা কারণে পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন কথাটার একটু রাশভারী অনুবাদ হল মিউটেশন। বাংলায় আবার এটাকে কেউ কেউ বলেন পরিব্যক্তি বা পরিবর্তন। আবার বইয়ের ভাষায় বলতে গেলে বলবো মিউটেশন মানে হচ্ছে ‘sudden and abrupt changes to the genetic materials of organisms’, অর্থাৎ জীবের বংশগতীয় বস্তুতে আকস্মিক পরিবর্তন। আরও ঘুরিয়ে বললে, মিউটেশন হচ্ছে জিন সিকোয়েন্সে পরিবর্তন। যেহেতু আমাদের জিনেই নাইট্রোজেন ক্ষারগুলো নানান সজ্জায় সজ্জিত থেকে আমাদের নানান রকম তথ্য ধরে রাখে, সে তথ্যের পরিবর্তন ঘটালে জীব দেহেও এর বড়সড় পরিবর্তন চলে আসে।
কথার কথা, ধরুন THE CAT RAN FAR টাইপের জিন সিকোয়েন্সের জন্য কোনো প্রাণীর ২ টা ডানা হয়। এবার ধরুন সে জিনোম সিকোয়েন্সে কোনোভাবে এই অক্ষরগুলির সিকোয়েন্স উলটাপালটা হয়ে লিখা হয়ে গেলো THE TAC RAN FAR । সেক্ষেত্রে আর অর্থ কি একই থাকলো? THE CAT RAN FAR এর জন্য সে প্রাণিতে যে ধরণের প্রোটিন সৃষ্টি হতো, THE TAC RAN FAR এর জন্য অন্য ধরণের পরিবর্তন আসবে। হয়তো আকার পালটে যাবে কিংবা হয়তো আরও একটা বাড়তি ডানা যোগ হবে। মিউটেশন ব্যাপারটাও আসলে এভাবেই ঘটে। তবে কিছু নিয়মের ভেতরেই, কিছু কারণেই মিউটেশন ঘটে। কীভাবে ঘটে, কেন ঘটে তা জানতে ক্রোমোজোম আর তার ভেতরের ডিএনএ-তে প্রবেশ করবো আমরা। এবার আমরা ঢুকবো গম্ভীর আর গভীর আলোচনায়। চলুন দেখি কীভাবে এই মিউটেশন ব্যাপারটা বিবর্তনের কারণ হয়; কীভাবেই বা এটা মাংশাসী ডায়নোসোরকে মুরগীতে রূপান্তরিত করে, শেয়ালের মতো দেখতে প্রাণী হয়ে যায় তিমি—সৃষ্টি হয় বিচিত্র্য সব প্রাণের স্পন্দন।
এর আগে সংক্ষেপে মিউটেশনের ইতিহাসটা জেনে নেয়া যাক। চার্লস ডারউইন বিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাব করার সময় তিনি সঠিক কোনো ব্যখ্যা দিতে পারেন নি, কীভাবে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো জীবে আসে। এ নিয়ে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যখ্যা হাজির করেন অগাস্ট ভাইজম্যান, ম্যান্ডেলিফের জিনতত্ত্ব নিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর। ১৮৮০ সালে অগাস্ট ভাইজম্যান তাঁর জার্মপ্লাজম-সোমাটোপ্লাজম তত্ত্বে (Germplasm-Somatoplasm) উল্লেখ করেন যে, জীবের জননাঙ্গে অবস্থিত জননকোষে থাকে জার্মপ্লাজম, আর দেহের অবশিষ্ট কোষে থাকে সোমাটোপ্লাজম। তিনি বলেন, সোমাটিক সেল বা দেহকোষ প্রজননে কোনো ভূমিকা রাখে না। শুধুমাত্র জার্ম সেল বা গ্যামেট ভূমিকা রাখে। তিনি এই জার্মপ্লাজমের এ ধারণাকে কে সংযুক্ত করেন চার্লস ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তনের সাথে। তিনি বললেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে মূলত জীবের জার্মপ্লাজম স্তরে। তার এই নতুন অনুকল্প দ্বারা মেন্ডেলিয়ান ইনহেরিটেন্সের নতুন নতুন দ্বার খুলে গেল। এর মাধ্যমে মেন্ডেল আর ডারউইন—উভয়ের গবেষণাকে অনেকটা এক সূত্রে গেঁথে দেয়া হলো। জীবের প্রজননের সময় জনন কোষে ঘটা মিউটেশনের কারণেই প্রকরণের(variation) উদ্ভব ঘটে। কোনো প্রজাতিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নানাবিদ প্রকরণের ফলে উদ্ভব ঘটে নতুন প্রজাতির। এর ফলে সৃষ্টি হয় নতুন প্রজাতির।
কথা হচ্ছে, সব মিউটেশন জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করে না। নতুন বৈশিষ্ট্য তখনই জীবের মধ্যে যুক্ত হয় যখন মিউটেশন জার্মলাইন কোষে (যেমন ডিম্বাণু বা শুক্রাণু) ঘটে এবং প্রজননের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে সেই পরিবর্তন চলে যায়। অন্যদিকে, যদি মিউটেশন সোম্যাটিক কোষে (যেমন ত্বক বা যেকোনো শরীরের কোষ) ঘটে, তবে সেটি সেই জীবের শরীরে পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু তা উত্তরাধিকার সূত্রে যায় না। একই সাথে বলে রাখা ভালো যে, সব মিউটেশন উপকারী না। ধরুন, মিউটেশনের ফলে কোনো জীবে একটি বৈশিষ্ট্য যোগ হলো, যার ফলে সে সেই পরিবেশে টিকে থাকার মতো সুবিধা পাচ্ছে, তাহলে সে মিউটেশনকে আমরা উপকারী মিউটেশন বলতে পারি। এই আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে মেরু অঞ্চলের ভাল্লুকদের উদাহরণ দিয়েছি। এবার প্রশ্ন আসছে যে মিউটেশন কীভাবেই বা ঘটে? কতো প্রকার?
মোটাদাগে মিউটেশন ২ প্রকারঃ
(১) ক্রোমোজোমাল মিউটেশন ও
(২) জিন মিউটেশন।
এই দুই প্রকার মিউটেশনেই জিন সিকোয়েন্সে পরবর্তন ঘটে। একটু করে জেনে নিই এ দুটো আসলে মিউটেশন কী, কীভাবে ঘটে আর কেন ঘটতে পারে।
১. ক্রোমোজোমাল মিউটেশনঃ আমারা আগেই জেনেছি ক্রোমোজম হচ্ছে আমাদের কোষে থাকা এমন এক ফিতা যা আমাদের সকল তথ্য ধরে রাখে। কারণ, ক্রোমোজোম ধারণ করে ডিএনএ, আর ডিএন-তে থাকে জিন। এই জিন যেভাবে যে সিকোয়েন্সে আছে, তা পাল্টে গেলেই তো মিউটেশন, তাই না? এখন একবার ভেবে দেখুন তো, যদি আমাদের এই ডিএনএ, জিন যেই ফিতেটায় আছে, সেই ফিতেটার আকার আকৃতি যদি পরিবর্তন করে দিই, তাহলে ফিতের ভেতর থাকা তথ্য পালটে যাবে কীনা? নীচের উদাহরণটা দেখুন। ধরুন, একটা কল্পিত ক্রোমোজোমে লিখা আছে “তোমার বাড়িতে থামা যাবে”। এখন, ক্রোমোজোমের যে অংশে “থামা” কথাটা আছে, সে অংশে ধরুন কেউ ক্রোমোজোম কেটে “মা” কে আগে রাখলো, “থা” কে পরে রাখলো। পুরো কথার অর্থ পালটে হয়ে যাবে “তোমার বাড়িতে মাথা যাবে”। মনে হচ্ছে না কোনো সাইকোপ্যাথের পাঠানো চিঠি?
অনেকটা এভাবেই ঘটে ক্রোমোজোমাল মিউটেশন। ক্রোমোজোমের গঠন বা সংখ্যা পরিবর্তনকেই আমরা ক্রোমোজোমাল মিউটেশন বলি। এই মিউটেশন জিন মিউটেশনের মতো কেবল অল্প কিছু জিনকে প্রভাবিত করে না, একসাথে অনেক জিনকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ক্রোমোজোমাল মিউটেশনের মাধ্যমে জিন সিকোয়েন্স পরিবর্তিত হয়ে প্রাণি, উদ্ভিদ সহ জীব জগতের প্রায় সব ডোমেইনেই বিবর্তন ঘটে। একটু পরেই আমরা পলিপ্লয়ডি সংকরায়ণের মাধ্যমে উদ্ভিদের নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটার উদাহরণ দেখবো, মানুষের বিবর্তনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা-ক্রোমোজোম-২ জোড়া লেগে যাওয়া, ডাউন সিনড্রোম হওয়া—এমন অনেক কিছু ঘটেছে, ঘটে ক্রোমোজোমাল মিউটেশনের কারণেই।
ক্রোমোজমাল মিউটেশন নানা ধরণের হতে পারে। একেকভাবে ক্রোমোজোমের গঠন পরিবর্তন হওয়ার ক্ষেত্রে নির্ভর করছে ক্রোমোজোমাল মিউটেশনের ধরণ। যেমন, কোনো একটি ক্রোমোজমের অনেকখানি অংশ আলাদা হয়ে যেতে পারে (deletion) । আবার, সেই আলাদা হয়ে যাওয়া অংশ আরেকটা ক্রোমোজমে যেয়ে জোড়া লাগতে পারে। এখন এই ব্যাপারটা একই টাইপের ক্রোমোজমে হলে সেটা duplication, আলাদা টাইপের ক্রোমোজমে যেয়ে জোড়া লাগলে translocation. বা ক্রোমোজমের কোনো অংশ উল্টে যেতে পারে (inversion) । আবার কখনো কখনো ক্রোমোজমের দুই প্রান্ত জোড়া লেগে যায়, সেটাকে তখন ring chromosome বলে। ক্রোমোজমের টেলোমিয়ার অংশ সাধারণত এমনটা হতে বাধা দেয়, তবে টেলোমিয়ার না থাকলে তারা জোড়া লেগে যায়।
২. জিন মিউটেশনঃ জিন মিউটেশন হলো জিনের ডিএনএ সিকোয়েন্সে স্থায়ী পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ছোট বা বড় পরিসরে হতে পারে—কখনও একটি মাত্র ডিএনএ বেস পেয়ারকে প্রভাবিত করে, আবার কখনও একাধিক জিনসহ পুরো ক্রোমোজোমের অংশকে পরিবর্তন করতে পারে। খুলেই বলি আপনাকে। জীব কোষ মাত্রই তার কোষ বিভাজন ঘটে, তাই না? সে বিভাজন জার্মালাইন এবং সোমাটিক—উভয় কোষেই ঘটবে। এবং কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ-রও বিভাজন হয়। অর্থাৎ ডিএনএ-র বিশাল লম্বা কোডগুলোর কপি তৈরী করতে হয় নতুন কোষ সৃষ্টির সময়। যাতে নতুন কোষে হুবুহু আগের কোষের মতই ডিএনএ কোডগুলো থাকে। এই কোড অনুযায়ী এমিনো এসিড পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরী করা হয়, যা প্রকাশ করে জীবদেহের নানান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু, রেপ্লিকেশনের সময় ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম সবসময় হুবুহু কপি করতে পারে না মাতৃ ডিএনএ থেকে। নানা কারণে কোডগুলো কপি করার সময় কিছু পরিবর্তন এসে যায়। জিনের কোথায় কতটুকু পরিবর্তন হচ্ছে সেটার ওপর নির্ভর করে এটা কোন ধরণের মিউটেশন। এই বেস পেয়ার কপিতে ছোটো একটা ওলটপাল্টের জন্য জীবের পুরো দেহেই কোনো না কোনো পরিবর্তন চলে আসে। এই পরিবর্তনটাকেই বলছি জিন মিউটেশন [৩]।
এখন এইটুকু নার্ডি আলোচনা আপনার না পড়লেও চলবে। আপনি জিন মিউটেশনের প্রকারভেদ না পড়েও এই পুরো লেখাটা পড়ে বুঝতে পারবেন। তাও আমি নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে সংক্ষেপে একটু আলোচনা করে রাখছি। মন চাইলে পড়তে পারেন। উপরে বলেছি, মাতৃ ডিএনএ থেকে অপত্য নতুন ডিএনএ সৃষ্টির সময় নতুন ডিএনএ সূত্রকে মাতৃ ডিএনএ-র অক্ষরগুলি হুবহু কপি হয় না বলেই পরিবর্তিত এই ডিএনএ সিকোয়েন্স মিউটেশন ঘটায় জীবদেহে। এখন, জিনের কোথায় কতটুকু পরিবর্তন হচ্ছে সেটার ওপর নির্ভর করে এটা কোন ধরণের মিউটেশন। খুব সংক্ষেপে বলি। যেমনঃ
- পয়েন্ট মিউটেশন (Point Mutation) – ডিএনএ সিকোয়েন্সের শুধু একটা নির্দিষ্ট বেস পেয়ার (Adenine, Guanine, Cytosine, Thymine) একটি মাত্র বেস পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ, মাত্র একটা বেস ভুল কপি হচ্ছে। যার ফলে প্রোটিনের একটি অ্যামিনো অ্যাসিড বদলে যেতে পারে। আবার যদি এমন জায়গায় মিউটেশন হয় যেটা কোনো কিছু প্রকাশ করল না, বা পরিবর্তন আনল না, অর্থাৎ, মিউটেশনের ফলে আসা নতুন কোড আদতে আগের কোডেরই আরেকটা ভার্সন, মানে এটাও একই এমিনো এসিডের জন্যেই কোড হয় তবে সেটাকে আমরা বলব সাইলেন্ট মিউটেশন।
- ইনসারশন (Insertion) – যখন ডিএনএ সিকোয়েন্সে এক বা একাধিক অতিরিক্ত বেস যুক্ত হয়, তখন ইনসারশন মিউটেশন ঘটে।
- ডিলিশন (Deletion) –ডিলিশন মিউটেশন তখন ঘটে যখন ডিএনএ সিকোয়েন্স থেকে এক বা একাধিক বেস বাদ পড়ে যায়। এই মিউটেশন প্রোটিন তৈরির গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা মুছে ফেলতে পারে।
- ফ্রেমশিফট মিউটেশন (Frameshift Mutation) – একটু জটিল, তবে সহজ করে দিবো। ফ্রেমশিফট মিউটেশন ঘটে যখন ইনসারশন বা ডিলিশন তিনের গুণিতকে না হয়, ফলে ডিএনএ পড়ার প্যাটার্ন (reading frame) বদলে যায়। যেহেতু প্রোটিন তৈরি হয় তিন-বেসের কোডন অনুযায়ী, ফ্রেমশিফট হলে প্রতিটি পরবর্তী অ্যামিনো অ্যাসিড পাল্টে যায়, যা সাধারণত অকেজো প্রোটিন বা পূর্ববর্তী স্টপ কোডনের জন্ম দেয়। উদাহরণ দিই। ধরি, THE CAT RAN FAR টাইপের জিন সিকোয়েন্সের জন্য কোনো প্রাণীর ডানার গঠন নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে প্রতিটাই তিনটা করে বেস আছে। একদম ডিএনএর মতই প্রতিটা শব্দ তিনটা অক্ষর দিয়ে বানানো। প্রতি তিনটা অক্ষর মিলে একটা অর্থবহ শব্দ হয়। যার ফলে আরামসেই প্রোটিন তৈরি হতে পারবে এই কোডনগুলি থেকে। কিন্তু কোনোভাবে যদি এখানের THE থেকে E এর ডিলিশন ঘটে, অর্থাৎ বাদ পড়ে, তাহলে কি দাঁড়ায়?
THC ATR ANF AR
কিছু অংশ আগের মতোই তিনটা অক্ষর মিলে একটা করে শব্দ তৈরী করেছে। কিন্তু এই শব্দগুলো আমাকে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। অর্থাৎ, এরা যদি কোনো এমিনো এসিডের জন্য কোড হত তাহলে আমি উক্ত এমিনো এসিডের কোনোটাই তৈরী করতে পারতাম না।
২.২ মিউটেশন ঘটার কারণ
মিউটেশন অনেকভাবে ঘটতে পারে। অনেক কিছু মিউটেশনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তবে এখানে তিনটা কারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলি মিউটেশনকে নানানভাবে প্রভাবিত করে। পরোক্ষভাবে বিবর্তনকেই প্রভাবিত করে। কারণ তিনটি হলোঃ
১. স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশন
২. ইনডিউসড মিউটেশন
৩. জীব প্রক্রিয়া ও কোষীয় চাপ
১. স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশনঃ স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশন প্রাকৃতিকভাবে, এলোমেলোভাবে ঘটে। যেমন ডিএনএ রেপ্লিকেশনে ত্রুটি। যখন কোষ বিভাজন হয়, তখন ডিএনএ সিকোয়েন্স কপি করা হয়। মাঝে মাঝে নতুন ডিএনএ তে ভুল বেস ঢুকে পড়ে।ঘটে যায় মিউটেশন। আমাদের ডিএনএ-র মেরামত প্রক্রিয়া বেশিরভাগ ত্রুটি সংশোধন করে, তবে কিছু ভুল ঠিক থেকেই যায়। আবার ডিএনএ বেসের (যেমন, অ্যাডেনিন, থাইমিন, সাইটোসিন, গুয়ানিন) রাসায়নিক গঠনে সাময়িক পরিবর্তন ভুল বেস-পেয়ারিং তৈরি করে মিউটেশন ডেকে আনে। এটাকে বলি আমরা টটোমারিক শিফট। মাঝে মাঝে ডিএনএ তে থাকা নাইট্রোজেন ক্ষার সাইটোসিন থেকে একটি অ্যামিন গ্রুপ হারিয়ে ইউরাসিল-এ রূপান্তরিত হয়, যা পয়েন্ট মিউটেশন ঘটাতে পারে।
২. ইনডিউসড মিউটেশনঃ বাংলায় এটাকে বলা যায় প্ররোচিত মিউটেশন। এই ইনডিউসড মিউটেশন স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশনের উলটো এবং বেশ দ্রুত সময়েই ঘটতে পারে। অর্থাৎ, বাহ্যিক কোনো প্রভাবক দ্বারা ডিএনএ-র জিন সিকোয়েন্সে পরিবর্তন ঘটে এখানে। বিজ্ঞানীরা এই প্রভাবকগুলিকে বলেছেন মিউটাজেন। এই মিউটাজেন আবার বায়োলজিকাল হতে পারে, রাসায়নিক, ভৌত বা ফিজিকালও হতে পারে। আলাদা করে এই ৩ প্রকার মিউটাজেন নিয়ে জেনে রাখলেও ক্ষতি নেই। আবার জানতে না চাইলে আপনি এড়িয়ে যেতে পারেন। অনেক মজার কিছু তথ্য মিস করবেন যদিও।
- রাসায়নিক মিউটাজেন – 5-bromouracil নামক এক প্রকার রাসায়নিক কম্পাউন্ড নকল নাইট্রোজেন বেইস সেজে ডিএনএ তে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে। ডিএনএ অনুলিপনের সময় ভুল-ভাল বেইস পেয়ারিং ঘটিয়ে মিউটেশন ঘটায়। মাস্টার্ড গ্যাস, EMS এর মতো কিছু অ্যালকাইলেটিং এজেন্ট ডিএনএ বেসে অ্যালকাইল গ্রুপ যোগ করে বেস-পেয়ারিংয়ে ত্রুটি ঘটিয়েও মিউটেশন ঘটাতে পারে। অন্যদিকে কিছু ইন্টারক্যালেটিং এজেন্ট ডিএনএ বেসের মধ্যে প্রবেশ করে ডিএনএ-র বেস এর ইনসারশন বা ডিলিশন ঘটায়। যেমন, অ্যাক্রিডিন ডাইস। সিগারেটের সাথে থাকা নিকোটিনও একটা শক্তিশালী রাসায়নিক মিউটাজেন। যেটা মিউটেশন সৃষ্টির মাধ্যমে ক্যান্সার ঘটাতে পারে।
- জীববৈজ্ঞানিক মিউটাজেন – কিছু ভাইরাস তাদের জেনেটিক উপাদান হোস্টের ডিএনএতে ঢুকিয়ে দিয়ে মিউটেশন ঘটাতে পারে। বিস্তারিত বলা যাক কেমন? সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা জানাচ্ছে, ভাইরাস সংক্রমণ পরোক্ষভাবে মানব বিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে ইতিহাসে অনেকবার। বিশেষ করে স্নায়বিক এবং কগনিটিভ কার্যক্রমের সাথে জড়িত জিনগুলির উপর সিলেক্টিভ প্রেশার প্রয়োগ করে [৪]। কিছু ভাইরাস নিজেদের জিনোম কপি তৈরি করে এবং সেই কপিকে তার হোস্টের জিনোমের অন্য কোথাও ঢুকিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে ট্রান্সপোজিশন বলা হয়। এবং ভাইরাসের ডিএনএ থেকে প্রাপ্ত এই এলিমেন্টগুলিকে বলে ট্রান্সপোজেবল এলিমেন্ট। এদের জাম্পিং জিনও বলা হয়। এই ট্রান্সপোজিশনের জন্যও মিউটেশন ঘটতে পারে। উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়, আমাদের ভাষা রপ্ত করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য দায়ী FOXP2 gene কে। FOXP2 জিনের উদ্ভব সহ নানান কগনিটিভ ডেভেলপমেন্টের পেছনে দায়ী মিউটেশন গুলো ঘটেছে এনডোজেনাস রেট্রোভাইরাল ইন্টিগ্রেশন এর কারণে। বলে রাখা ভালো যে, এনডোজেনাস রেট্রোভাইরাল ইন্টিগ্রেশন হচ্ছে এমন একটি ট্রান্সপজিশন প্রক্রিয়া যেখানে একটি রেট্রোভাইরাসের রিভার্স-ট্রান্সক্রাইবড ডিএনএ এর কপি কোনো জীবের ক্রোমোজোমে সংযুক্ত হয়, যার ফলে সে জীবে ঘটে মিউটেশন [৫] । শুধু এ ব্যাপারটা নিয়েই গোটা এক আর্টিকেল লিখা যাবে, সেটা নাহয় অন্যদিনের জন্য তোলা রইলো।
- ভৌত মিউটাজেন – সূর্যের আলোতে থাকা অতিবেগুনী রশ্মি থাইমিন ডাইমার তৈরি করে, যা ডিএনএ অনুলিপিতে বাধা দেয়। পারমাণবিক দুর্ঘটনা বা অতিরিক্ত মেডিকেল ইমেজিং(এক্স রে, গামা রশ্মি) থেকে আসা আয়নায়িত রশ্মি ডিএনএ স্ট্র্যান্ড ভেঙে মিউটেশন ঘটিয়ে দেয়। যেমন, Drosophila melanogaster (ফলমাছি)-এর ওপর এক্স রে ব্যবহার করে দেখা গেছে, তাদের ডিএনএতে এমন মিউটেশন হয় যা চোখের রং বা ডানার আকৃতিতে পর্যন্ত পরিবর্তন এনে ফেলে। চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর, আশেপাশের প্রাণী ও উদ্ভিদ উচ্চ রেডিয়েশনের পরিবেশে থাকতে থাকতে এদের ডিএনএ তে অনেকপ্রকার মিউটেশন ঘটে জেনেটিক ডাইভার্সিটি তৈরি হয়। কিছু প্রজাতি এমন বৈশিষ্ট্য তৈরি করে, যা তাদের ওই রেডিয়েশনপূর্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এইতো, এ বছরেরই(২০২৪) মার্চ মাসে ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের অধ্যাপকেরা চেরনোবিল দূর্ঘটনাগ্রস্থ এলাকায় পাওয়া নেমাটোডা পর্বের এক কীটের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, এরা রেডিয়েশনের বিরুদ্ধেও রেজিস্ট্যান্স গড়ে তুলেছে [৪৮] ।
৩. জীব প্রক্রিয়া ও কোষীয় চাপঃ এটা যদিও এতো বেশি ঘটে না, তবে ঘটে। কোষের স্বাভাবিক বিপাকীয় ক্রিয়ায় Reactive oxygen species (ROS) নামক এক প্রকার উপজাত তৈরি হয়। এই ROS ডিএনএ, প্রোটিন এবং লিপিডের ক্ষতি করতে পারে। কখনো কখনো ROS-এর কারণে বেস পরিবর্তন, স্ট্র্যান্ড ভাঙন বা ক্রস-লিংকিং হতে পারে যা জিন সিকোয়েন্সে প্রভাব রাখে। ঘটে যেতে পারে মিউটেশন। ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় ভুল-ভাল কপি হওয়া বেইস-পেয়ারগুলোকে মেরামত করার কাজটা ব্যর্থ হলে রেপ্লিকেশন স্ট্রেস সৃষ্টি হতে পারে। এটাও মিউটেশন ঘটাতে পারে।
এতোক্ষণ জানলাম যে, কীভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে জীবে নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ হয় এবং সে পরিবর্তন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যায় এবং কালের বিবর্তনে সেসব নতুন বৈশিষ্ট্যের ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে ন্যাচারাল সিলেকশানের মাধ্যমে। এবার দেখানো যাক যে কীভাবে এই নতুন প্রজাতির উদ্ভব বা স্পিসিয়েশন প্রভাবিত হয়।
৩. প্রজনন বিচ্ছিন্নতা (Reproductive Isolation)
রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশান অর্থাৎ প্রজনন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আলোচনার পূর্বে আমরা জেনে নিই বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে পপুলেশন (Population) বলতে কী বোঝায়— পপুলেশন বলতে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসরত একই প্রজাতির সদস্যদের এমন একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা প্রজনন করে একে অপরের সঙ্গে জিন আদান-প্রদান করতে পারে। বাংলায় কখনো কখনো এ লেখায় আমরা পপুলেশনকে ‘জনগোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করেছি। বিবর্তন সাধারণত পপুলেশন স্তরে ঘটে। একক ব্যক্তির পরিবর্তন বিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং গোষ্ঠীগত পরিবর্তনে বিবর্তন ঘটে। প্রাকৃতিক নির্বাচন, মিউটেশন (mutation), জিন প্রবাহ, এবং জেনেটিক ড্রিফট (genetic drift) এর মতো প্রক্রিয়াগুলো কোনো পপুলেশনের জিন পুলে স্থায়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন আনে—ফলস্বরূপ ঘটে বিবর্তন। এ নিয়ে আমরা শীঘ্রই বিস্তারিত জানতে যাচ্ছি।
দেখা গেছে যে, নতুন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশানের প্রয়োজন হয়। যখন কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতির এক জনগোষ্ঠী তাদেরই অন্য এক জনগোষ্ঠী থেকে প্রজননগতভাবে পৃথক হয়ে যায়, তখন জিনপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় দুটো জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এবং এই আইসোলেশন সেই আলাদা হয়ে যাওয়া দুটি জনগোষ্ঠীকে জেনেটিক্যালিও আলাদা হতে সাহায্য করে। আরও সহজ করে বলি। ধরুন, “ক” নামক একটি প্রজাতির দুটি জনগোষ্ঠী “ক-১” এবং “ক-২” আলাদা হয়ে গেলো। এতে করে হবেটা কি বলি, “ক-১” এ আসা জেনেটিক পরিবর্তন/পরিবর্তন সমূহ যদি সে পরিবেশে সারভাইভ করার জন্য সুবিধাজনক হয়, তাহলে সেসব পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যগুলি সে জনগোষ্ঠির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতে হতে লম্বা সময়ের ব্যবধানে একসময় সে প্রজাতিটিই পাল্টে যাবে। কারণ, “ক-১” এ আসা পরিবর্তন গুলি “ক-২” তে স্থানান্তর করার সুযোগ হয়নি দুইদল প্রজননগত ভাবে আলাদা থাকার ফলে। যার ফলে, তারা আলাদাভাবে পরিবর্তিত(বিবর্তিত) হতে থাকবে। ফলস্বরূপ হবে কী, দীর্ঘ সময় পর “ক-১” এর ডিসেন্ডেন্টসরা যদি কখনো “ক-২” এর ডিসেন্ডেন্টস দের সাথে মিলিত হয়, তাহলে তাদের থেকে প্রজনক্ষম কোনো সন্তান দান সম্ভব হবে না। অর্থাৎ তাদের প্রজাতিই আলাদা হয়ে যাবে। সামনে আমরা অনেক উদাহরণ দেখবো। এ স্পিসিয়েশন ঘটতে পারে জিওলজিকাল আইসোলেশান ছাড়াও বিভিন্নরকম ভাবে। সামনে উদাহরণ দিয়ে আমরা দেখাবো যে, কীভাবে এমন প্রজননগত বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমেই আমাদের জীবজগতে সবকিছুর, এমনকি মানব বিবর্তনেও ঘটেছে বিভিন্ন নতুন প্রজাতির উদ্ভব। শুধু ঐতিহাসিক উদাহরণই না, আমাদের চোখের সামনে বিবর্তিত হয়েছে বা হচ্ছে, এমন কিছু ঘটনা আমরা এখানে দেখাবো। বলে রাখা ভালো যে, এই প্রজননগত বিচ্ছিন্নতার পর স্পিসিয়েশনের ঘটাতে আবার কাজ করে ন্যাচারাল সিলেকশন, জেনেটিক ড্রিফট, সিমবায়োসিস, সেক্সুয়াল সিলেকশান ইত্যাদি। এই রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশন বা প্রজননগত বিচ্ছিন্নতা বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে। কীভাবে রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশনটা ঘটবে, সেগুলিকে মোটাদাগে আমরা ৪ ভাগে ভাগ করতে পারি :
১. অ্যালোপেট্রিক স্পিসিয়েশন
২. সিমপেট্রিক স্পিসিয়েশন
৩. প্যারিপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন
৪. প্যারাপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন।
আরও বিস্তারিত জানা যাক।
৩.১ অ্যালোপেট্রিক স্পিসিয়েশন
অ্যালোপেট্রিক স্পিসিয়েশন হলো প্রজা্তির উদ্ভবের সবচেয়ে প্রচলিত ধরন। এটি ঘটে যখন কোনো জনগোষ্ঠী ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতার কারণে দুই বা ততোধিক পৃথক দল হিসেবে আলাদা হয়ে যায়, যেমন— পাহাড়, নদী বা সমুদ্রের মাধ্যমে। একবার আলাদা হলে, তাদের মধ্যে জিন প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তারা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশগত চাপে পড়ে এবং আলাদা বিবর্তনীয় পথ অনুসরণ করে। ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্নভাবে ন্যাচারালি সিলেক্টেড হয়ে, নয়তো জেনেটিক ড্রিফটের পাল্লায় পড়ে দুই দলের মধ্যকার জিন পুলের মিউটেশনগুলো আদান-প্রদান হতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে জেনেটিক পার্থক্য এতটাই বেড়ে যায় যে, তারা আবার মিলিত হলেও আর প্রজনন করতে সক্ষম হয় না [৬]।
এই অ্যালোপেট্রিক স্পিসিয়েশনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে ডোয়ার্ফিজম ও জাইগান্টিজম নামে দুটি বিশেষ ঘটনাও ঘটে। ঘটনাগুলো আলোচনার পাশাপাশি কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণও দেয়া যাক। কোনো একটি প্রজাতি যখন ছোট ও বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে বসবাস শুরু করে, তখন বংশপরম্পরায় এদের আকার ছোট হতে থাকে। তাদের শরীর, মগজ, সবই ধীরে ধীরে খর্বাকায় হয়। কারণ বড় শরীর ধারণের জন্য যে-পরিমাণ খাবার দরকার, তা ছোট দ্বীপ বা এলাকায় পাওয়া যায় না। ফলে টিকে থাকার তাগিদে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, প্রাণীগুলোর আকার খর্ব হয়ে আসে, যেন কম খাবারে বেশিদিন বেঁচে থাকা যায়। বড় অতিকায় প্রাণী পরিণত হয় বেঁটে জন্তুতে। যেমন কয়েক লাখ বছর আগে হোমো ইরেক্টাসের একটি দল ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরস নামক দ্বীপে এসে অবস্থান নেয়। এক সময় দ্বীপের চারপাশে পানি বেড়ে যাওয়ায় আটকে পড়ে হোমো ইরেক্টাসের সে দলটি। হাজার হাজার বছর ধরে অত্যন্ত ছোট এ দ্বীপটিতে আটকে পড়ায় খাদ্যাভাবে সে দ্বীপের হোমো ইরেক্টাস সহ বাকি সব প্রাণিও খর্বাকৃতির হয়ে যায়। এবং একসময় সে হোমো ইরেক্টাস বিবর্তিত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রজাতিতে, ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী যাদের গড় উচ্চতা হয়ে যায় মাত্র ৩ ফিট ৬ ইঞ্চি। তাদের ফসিলের পাশে পাওয়া কমোডো ড্রাগন এবং হাতির ফসিলও ছিলো বামন আকৃতির।[৭]
অন্যদিকে, এই ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে ঘটে জাইগান্টিজমও। ছোট আকৃতির কোনো জীবের কোনো জনগোষ্ঠী আইসোলেটেড পরিবেশে বংশ পরম্পরায় বড় হতে থাকে যদি সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং শিকারি প্রাণির অনুপস্থিতি থাকে। যেমন মাদাগাস্কার, সার্ডিনিয়া, ও মৌরিশাসে ইঁদুর, টিকটিকি, কোমোডোর প্রজাতিগুলো তাদের অন্য প্রজাতিগুলো থেকে দানবাকৃতির।
ডারউইনের ফিঞ্চ পাখিঃ ডারউইনের ফিঞ্চ পাখির উদাহরণ অ্যালোপেট্রিক স্পিসিয়েশনের একটা প্রসিদ্ধ ঘটনা। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে প্রজাতিগুলো যখন ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপে বসবাস শুরু করে, তখন তারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। আলাদা খাবারের উৎসের উপর ভিত্তি করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির ফিঞ্চ পাখির উদ্ভব ঘটে, যেখানে প্রতিটি প্রজাতি তাদের নির্দিষ্ট পরিবেশের সাথে বিবর্তিত [৮]। উদাহরণস্বরূপ, মিডিয়াম গ্রাউন্ড ফিঞ্চ (Geospiza fortis) এবং লার্জ গ্রাউন্ড ফিঞ্চ (Geospiza magnirostris) বিভিন্ন দ্বীপে বসবাস করে এবং তাদের খাবার সংগ্রহের ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অনুসারে বিবর্তিত হয়েছে।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কাইবাব কাঠবিড়ালিরাঃ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কাইবাব কাঠবিড়ালি (Sciurus aberti kaibabensis) এবং অ্যাবার্ট’স কাঠবিড়ালি (Sciurus aberti), অ্যালোপ্যাট্রিক প্রজাতিকরণের আরেকটা আদর্শ উদাহরণ। এরা দেখতে প্রায় একই রকম হলেও দুটি ভিন্ন প্রজাতির, অর্থাৎ একে অপরের সাথে প্রজননে অক্ষম। কয়েক লাখ বছর আগে গ্রান্ড ক্যানিওনের দুই গিরিখাতের মাঝে গাছগাছালি থাকার সময় এরা সবাই অ্যাবার্ট’স কাঠবিড়ালি প্রজাতির ছিল। তবে আইস এইজ শুরু হওয়ার পর মাঝের পাইন গাছের বন ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে উত্তর এবং দক্ষিণের রিমে অ্যাবার্ট’স কাঠবিড়ালির দুইটি বিচ্ছিন্ন পপুলেশনের সৃষ্টি হয়। সময়ের সাথে সাথে এই বিচ্ছিন্নতা উত্তর-দক্ষিণে আটকা পড়া দুই কাঠবিড়ালীর দলের মধ্যে জিন প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। একই সাথে, দুই গিরিখাতের পরিবেশও সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঘন ছায়াযুক্ত পন্ডেরোসা পাইন বনের সাথে মানিয়ে নিতে উত্তর দিকের কাঠবিড়ালিগুলোর ধূসর শরীর এবং সাদা লোমের পেট একসময় কালো লোম এবং সাদা লেজে বিবর্তিত হয়েছে। এর বিপরীতে, দক্ষিণ দিকে থাকা কাইবাব কাঠবিড়ালিদের পূর্বপুরুষ অ্যাবার্ট’স কাঠবিড়ালি তুলনামূলকভাবে হালকা ধূসর রঙের লোমযুক্ত, যা শুষ্ক এবং কম ছায়াযুক্ত পরিবেশের জন্য আরও উপযুক্ত।
সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচন, জেনেটিক ড্রিফট সহ প্রজাতিকরণের অন্যান্য নিয়ামক বিভিন্নভাবে কাজ করার মাধ্যমে উত্তরে থাকা Kaibab Plateau এর অ্যাবার্ট’স কাঠবিড়ালিরা কাইবাব কাঠবিড়ালিতে বিবর্তিত হয়।
৩.২ সিমপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন (Sympatric Speciation)
গ্রীক Sym শব্দের অর্থ একই, আর Patri মানে পিতৃভূমি, পিতার আর আদিপুরুষের বসবাসের স্থান। যখন একটা নির্দিষ্ট প্রজাতির একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে আরেকটা নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়, কোনোরকম ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই, তখন সে প্রজাতিকরণকে আমরা বলতে পারি সিমপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন। সেই জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যদি দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন ভিন্ন নিচেস(niches) ব্যবহার করে, তখন এই টাইপের স্পিসিয়েশনটা ঘটতে পারে। ধরুন, কোনো প্রজাতির কোনো একটা জনগোষ্ঠীর অংশ ভিন্ন ধরনের খাবার খেতে শুরু করলো বা ভিন্ন মেটিং প্রিফারেন্স গড়ে তুললো—এই ব্যাপারটাকে বলে নিচেস(niches)। একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী সময়ের সাথে সাথে এসব পার্থক্যের ফলে, অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন নিচেস ব্যবহার করায় নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়, একই ভৌগোলিক এলাকায় থাকা সত্ত্বেও। আরেকটু সহজ করে বুঝাই চলুন।
মনে করা যাক, ‘ক’ নামক একটা প্রজাতি একটা অবিচ্ছিন্ন ভূমিতে বসবাস করে। কোনো নদী বা পর্বত দিয়ে পৃথক করা নেই তাদের কোনো জনগোষ্ঠী। একসময় দেখা গেলো, সে প্রজাতির একটা জনগোষ্ঠী ভিন্ন এক ধরণের খাবার খাওয়া শুরু করেছে—যেটা তাদের প্রজাতির অন্যরা খাচ্ছে না। এই ভিন্ন খাবার খাওয়া জনগোষ্ঠীর নাম দিতে পারি ‘ক-১’, আর বাকিরা যারা সে খাবারটা খায় না, তারা ধরুন ‘ক-২’। কালের পরিক্রমায় দেখা গেলো ন্যাচারাল সিলেকশানের মাধ্যমে ‘ক-১’ দের দাঁত বিবর্তিত হয়ে এক বিশেষ পরিবর্তন ঘটলো, যার ফলে এই নতুন খাবার খেতে তাদের আরও বেশি সুবিধা হয়। যেখানে ‘ক-২’ তাদের গতানুগতিক খাবারই খেয়ে যেতে থাকলো।
একসময় দেখা যাবে ‘ক-১’ জনগোষ্ঠীরা সেক্সুয়াল সিলেকশানের মাধ্যমে সিংহভাগই একই দৈহিক অ্যাপেয়ারেন্স থাকায় তাদের নিজেদের মধ্যেই প্রজনন করতে থাকলো। তাদের এই পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য সমূহ জেনারেশন থেকে জেনারেশন ছড়িয়ে যেতে থাকলো। একইভাবে ‘ক-২’ জনগোষ্ঠীও তাদের নিজেদের মধ্যে প্রজননে অধিক প্রিফার করতে থাকলো। হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে এই প্রজনন বিচ্ছিন্নতার ফলে ‘ক-২’ থেকে ‘ক-১’ এতোটাই পৃথক হয়ে যায় যে, একসময় এই ‘ক-১’ পুরোপুরি আলাদা এক প্রজাতি হিসেবে বিবর্তিত হয়ে যায়। তখন দেখা যায় যে, ‘ক-১’ এবং ‘ক-২’ এর মধ্যে ব্রিডিংয়ে কোনো প্রজননক্ষম বাচ্চা জন্ম দেয়া সম্ভব হয় না।
ভিক্টোরিয়া লেকের সিক্লিড মাছঃ এই সিম্প্যাট্রিক স্পিসিয়েশনের একটা চমৎকার উদাহরণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়ার সিক্লিড মাছদের মধ্যে। এখানে, এই হ্রদের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির সিক্লিড মাছ বিবর্তিত হয়েছে। কিছু মাছ শৈবাল খাওয়ার জন্য বিবর্তিত হয়েছে, আবার কিছু মাছ অন্যান্য ছোট মাছের শিকার করে খায়। উদাহরণস্বরূপ,সে হ্রদের Haplochromis chilotes মাছের শিকার ধরে খাওয়ার জন্য শক্ত চোয়াল বিবর্তিত হয়েছে, অন্যদিকে Neochromis greenwoodi প্রজাতির মাছের শৈবালের উপর নির্ভর করে বাঁচার মতো উপযুক্ত গঠনের চোয়াল বিবর্তিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তাদের খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য এবং বিভিন্ন রঙের ভিত্তিতে সঙ্গী বেছে নেওয়ার প্রবণতা তাদের আলাদা প্রজাতিতে রূপান্তরিত করেছে, একই হ্রদে বাস করা সত্ত্বেও [৯]।
৩.৩ পেরিপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন
পেরিপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন আসলে খুব ভিন্ন কিছু না। খুব ক্ষুদ্র স্কেলে ঘটা অ্যালোপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশনকে বলা যেতে পারে। যখন কোনো প্রজাতির মূল জনগোষ্ঠী থেকে জিওলজিক্যালি একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন সে ছোট দলটির ওপর বিভিন্ন সময়ে নানান পরিবেশগত চাপ পড়তে পারে। ছোট দল হওয়ায় বিভিন্ন জেনেটিক পরিবর্তন পরবর্তী কয়েক প্রজন্মে নিজেদের মধ্যে খুব তাড়াতাড়িই ছড়িয়ে দিতে পারে। যা পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ব্যবধানে নতুন এক প্রজাতির জন্ম দেয়। এই ঘটনাটিকেই বলা যেতে পারে পেরিপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন।
চলুন, আবারও ‘ক’ নামক একটা প্রজাতির উদাহরণ টানা যাক। এবার ধরা যাক, এই ‘ক’ নামক প্রজাতিটির একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের মূল ভূমি ছেড়ে, তাদের প্রজাতির সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপে পৌঁছে যায়। এই ছোট দলটির নাম দেয়া যাক ‘ক-১’। এই ‘ক-১’ দলটি দেখা গেলো এমন এক পরিবেশে গিয়ে হাজির হয়েছে যেখানে গড় তাপমাত্রা অনেক বেশি এবং খাদ্যও অপ্রতুল। যেহেতু দলটি খুবই ছোট, তাই ক্ষুদ্র পরিবর্তন বা যেকোনো মিউটেশনের প্রভাব বেশি হয়। বিশেষত, যদি হয় সেটা সে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য সহায়ক কোনো মিউটেশন। এবং তাই-ই হয়, সময়ের সাথে সাথে আমাদের এই ছোট দলটি তাদের নতুন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য দ্রুত নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ করতে পারে, যেমন: আকারে ছোট হয়ে যাওয়া বা আরও শক্তিশালী পরিপাকতন্ত্রের বিকাশ। হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে একসময় তারা মূল দলের থেকে এতটাই আলাদা হয়ে যায় যে, তারা আর তাদের সাথে প্রজনন করতে সক্ষম হয় না। এই পর্যায়ে জন্ম হয় নতুন একটি প্রজাতির [১০]।
মেরু এলাকার ভাল্লুকঃ পেরিপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশনের উদাহরণ হিসেবে টানা যায় মেরু এলাকার ভাল্লুকদের। বাদামী ভাল্লুকদের ক্ষুদ্র একটা পপুলেশন মেরু এলাকায় আটকে যায়, এবং সে অঞ্চলে সেই বাদামী ভাল্লুকদের মধ্যে ঘটা জিনগত পরিবর্তনগুলো মূল ভূমিতে থেকে যাওয়া মূল পপুলেশনে প্রবাহ হয়নি। এই প্রজনন বিচ্ছিন্নতার ফলে তারা পরবর্তীতে প্রাকৃতিক নির্বাচনে সাদা ভাল্লুকে বিবর্তিত হয়। সামনে এ নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের লপালা ঝিঁঝিঁঁপোকারাঃ আমাদের পর্যবেক্ষণ করা, বিবর্তনীয় টাইম স্কেলে কম সময়ে ঘটা ম্যাক্রো বিবর্তনের একটা চমৎকার ঘটনা ঘটে গেছে হাওয়াইয়ের Laupala paranigra এবং Laupala kohalensis নামক দুই ঝিঁঝিঁঁ পোকা প্রজাতির মধ্যে। একই সাথে এটা পেরিপ্যাট্রিক প্রজাতিকরণেরও উৎকৃষ্ট একটা উদাহরণ। বাংলায় আমরা এদের আদর করে ডাকবো লপালা ঝিঁঝিঁপোকা। এই দুটি প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হলেও ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতে গিয়ে আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
বিস্তারিত বলি, মূল পার্থক্য তাদের প্রজননের জন্য ব্যবহৃত ডাকের গতিতে। ইংরেজি প্রতিশব্দটা সুন্দর, মেটিং কল। অর্থা মেটিং বা প্রজননের জন্য মিলিত হওয়ার ডাক। এদের পূর্বপুরুষদের যে দলটা হাওয়াই দ্বীপে বাস করতো এরা ধীরগতির ডাক দিতো, আর মাউই দ্বীপে বাস করা দলটা তুলনামূলক দ্রুতগতির ডাক দেয়। এই মেটিং কলের পার্থক্য তাদের একে ওপরের মাঝে প্রজননে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে তারা নিজেদের মেটিং কল অনুযায়ী সঙ্গী বাছাই করে। হাওয়াই দ্বীপে বাস করা লপালার ঝিঁঝিঁ পোকার দলটা ধীরে ডাক দেয়া সঙ্গীদেরই মধ্যেই প্রজনন করা শুরু করে। এবং মাউই দ্বীপে বাস করা দলটা দ্রুত ডাক দেয়া ঝিঁঝিঁঁপোকাদের ডাকেই সারা দিয়ে প্রজনন করে। দীর্ঘ সময় কেবল প্রজনন ডাক বা মেটিং কলের ভিত্তিতে হাওয়াই এবং মাউই দ্বীপের দুটি ঝিঁঝিঁঁপোকার দলের ভেতর হওয়া প্রজনন বিচ্ছিন্নতার ফলে একসময় তারা Laupala paranigra এবং Laupala kohalensis নামক দুই আলাদা প্রজাতি হিসেবে বিবর্তিত হয় [১১]।
৩.৪ প্যারাপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন
পর্বত, অরণ্য বা পানি অর্থাৎ শারীরিক বাধা দ্বারা একই দুটি জনগোষ্ঠী আলাদা না থাকলেও তারা ভিন্ন পরিবেশ বা অঞ্চলে বসবাস করে এবং সেই পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়ে দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে পারে— মোটাদাগে এটাকেই আমরা বলি প্যারাপেট্রিক স্পিসিয়েশন [১২]।
এবার আরেকটু সহজ করে বুঝাই আপনাকে। ধরা যাক, একটি উদ্ভিদ প্রজাতি আছে যার নাম “পি”। এই “পি” প্রজাতির উদ্ভিদগুলি একটি বিশাল তৃণভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কাছেই পাহাড় এবং ঝর্ণা থাকায় এই প্রজাতির কিছু উদ্ভিদ ছায়াযুক্ত ও আর্দ্র জায়গায় থাকে। এদের নাম দেয়া যাক “পি-১”। এই প্রজাতির বাকি উদ্ভিদেরা বেশি রোদযুক্ত ও শুকনো জায়গায় থাকে, এদের নাম দেয়া যায় “পি-২”। এখন, ন্যাচারাল সিলেকশানের মাধ্যমে “পি-১” উদ্ভিদের পাতা বড় আকার ধারণ করেছে, যা ছায়াময় জায়গায় আরও আলো সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। একই ভাবে, “পি-২” উদ্ভিদে মোটা কান্ড বিবর্তিত হয়েছে, যা বেশি পানি সংরক্ষণ করতে পারে। যেহেতু আমাদের “পি-২” উদ্ভিদেরা রোদযুক্ত ও শুকনো জায়গায় থাকে।
যদিও তারা এই বিশাল তৃণভূমিতে একই সাথে রয়েছে, তাও অবস্থানগত ভিন্নতা এবং সে বাসস্থানের এনভায়রনমেন্টাল কন্ডিশানের(তাপ, আর্দ্রতা, সূর্যালোকের পরিমাণ ইত্যাদি) ওপর ভিত্তি করে, লম্বা সময়ের ব্যবধানে “পি-১” এবং “পি-২” এতোটাই ভিন্ন হয়ে যায় যে তারা আর পরস্পরের সঙ্গে পরাগায়ন করতে পারে না। এভাবেই দুটি ভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি হয় প্যারাপেট্রিক স্পিসিয়েশনের মাধ্যমে।
সুইট ভার্নাল ঘাসের বিবর্তনঃ আমাদের বাস্তব দুনিয়ায় আমাদের পর্যবেক্ষণে থাকা একটা উদাহরণ হচ্ছে, সুইট ভার্নাল ঘাস (Anthoxanthum odoratum)। এই ঘাসগুলো ইউরোপের দূষিত খনি এলাকার কাছে বেড়ে ওঠে। দেখা গেছে, খনি এলাকার কাছাকাছি থাকা ঘাসগুলো ভারী ধাতু যেমন জিঙ্ক সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করেছে, যেখানে খনি থেকে দূরে থাকা ঘাসগুলো এসব বিষাক্ত পদার্থের প্রতি সংবেদনশীল। এমনকি, জেনেটিক্যালিও এদের মধ্যে বিরাট বড় আইসোলেশন তৈরি হয়ে গেছে [১৩]।
৪. প্রজাতিকরণের চালিকাশক্তি: প্রাকৃতিক নির্বাচন, জেনেটিক ড্রিফট এবং জিন প্রবাহ
মিউটেশনের মাধ্যমে ভ্যারিয়েশন ঘটে সত্যি, কিন্তু অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো প্রজাতিতে সে ভ্যারিয়েশন ছড়িয়ে দিতে কাজ করে ৩ টি নিয়ামক — প্রাকৃতিক নির্বাচন, জেনেটিক ড্রিফট এবং জিন প্রবাহ। সহজ করে বলি, কোনো মিউটেশনের ফলাফল সে পপুলেশনে ছড়িয়ে পড়বে কিনা তা অনেকটা নির্ধারণ করে প্রাকৃতিক নির্বাচন, জেনেটিক ড্রিফট কিংবা জিন প্রবাহের মতো ফ্যাক্টরগুলি। কোনো প্রজাতির উদ্ভব যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে হতে পারে, তেমনিভাবে ছোটো কোনো পপুলেশনে জেনেটিক ড্রিফট-এর মাধ্যমেও নতুন প্রজাতির উদ্ভব হতে পারে এমনকী মাইগ্রেশনের মাধ্যমে জিন প্রবাহেও স্পেসিয়েশন হতে পারে। যদিও প্রতিটি প্রক্রিয়া ভিন্নভাবে কাজ করে, কিন্তু তারা সম্মিলিতভাবে সময়ের সাথে সাথে কোনো জনগোষ্ঠীর বিবর্তনের ধারা অব্যাহত রাখে। চলুন, শেখা যাক কীভাবে এই প্রক্রিয়াগুলো স্পেসিয়েশান বা প্রজাতির উদ্ভবের পেছনে কাজ করে।
৪.১ প্রাকৃতিক নির্বাচনঃ যোগ্যতমের জয়
এই বিবর্তনীয় শক্তিগুলোর আলোচনায় আসলে শুরুতেই আসবে প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশান’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন। ন্যাচারাল সিলেকশান সেসব প্রজাতি বা প্রাণির পক্ষেই, যাদের মিউটেশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ সে পরিবেশের অনুকূলে আছে এবং প্রজননে সহায়ক। চলুন, বুঝানোর চেষ্টা করি যে কীভাবে কাজ করে এই ন্যাচারাল সিলেকশান ব্যাপারটা।
ধরুন ‘ক’ নামক একটি প্রজাতির একটি দল কোনোভাবে একটি দ্বীপে আটকা পড়লো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দ্বীপটি বেশ ছোট এবং খাবার ও মিঠা পানিও অপ্রতুল। এমন পরিবেশে, যেখানে খাদ্য কম— সেখানে ধরুন সেই প্রজাতির কোনো এক নবজাতক মাতৃগর্ভে এমন এক মিউটেশন হয়ে জন্মেছে, যার ফলে সে আকার আকৃতিতে ছোট হবে বড় হলে। মিউটেশন কি, ব্যাপারটা কীভাবে কাজ করে, এটা যদি এতোক্ষণে ভুলে গিয়ে থাকেন, তাহলে এ অধ্যায়ের প্রথম সেকশানটা পড়ে আসতে পারেন। আচ্ছা, গল্পে ফিরি। এখন, এই নতুন বাচ্চাটা এমন বৈশিষ্ট্যের জন্য সে পরিবেশে একটা সুবিধা পাবে, তা হচ্ছে সে অঞ্চলের অপ্রতুল খাবারে সে যেটুকু খেয়ে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারবে, তার প্রজাতির অন্যরা পারবে না। তার এ বৈশিষ্ট্য বংশপরাম্পরায় ছড়িয়ে যাবে। তার বেঁটে আকৃতির জন্য সে এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য পাওয়া বংশধরেরা সে অঞ্চলে অন্যদের চেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারবে কম খাবার খেয়েও। এই সুস্থদের প্রজননের হারও রোগা-পাতলা, অসুস্থদের চেয়ে বেশি হবে। যার ফলে সে জনগোষ্ঠীতে বেঁটে জনগোষ্ঠীই বেড়ে যাবে এবং এই জিন ডোমিনেন্ট জিন হয়ে যাবে। এবার আপনিই বলুন, এই বেঁটে জনগোষ্ঠীরা কি নিজেরা ইচ্ছা করে বেঁটে হয়েছে? কিংবা প্রকৃতি তাদের বাছাই করে নিয়েছে? উত্তর হচ্ছে, না। তাদের মধ্যে ঘটা মিউটেশনের ফলাফল সে পরিবেশে টিকে থাকার অনুকূলে ছিলো বলেই তারা টিকে থাকতে পেরেছে। আজ যদি তাদের মধ্যে কেউ অধিক লম্বা হয়ে জন্ম নিতো? এ পরিবেশে খাদ্যের অভাবে সুস্থ সবলভাবে না থাকতে পারায় তার জিন সেখানে ডোমিনেন্ট হতো না। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে সে জনগোষ্ঠীতে পরিবেশের অনুকূলে পাওয়া অনেক অনেক মিউটেশনের ফলাফল যেমন মেটাবোলিকাল রেট কমে যাওয়া কিংবা শক্তিশালী পরিপাকতন্ত্রের বিকাশ— তাদেরকে সে পরিবেশের জন্য করেছে আরও বেশি উপযুক্ত। একটা সময় পর দেখা যাবে, এই বেঁটে জনগোষ্ঠী পূর্বের ‘ক’ প্রজাতি থেকে জেনেটিক্যালি আলাদা হয়ে ভিন্ন প্রজাতি বা উপপ্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। আগেই আমরা হোমো ফ্লোরোয়েন্সিসের উদাহরণ দেখেছি। এবার আমরা মেরু এলাকার ধবধবে সাদা ভাল্লুকদের উদাহরণ দেখি চলুন।
সে অনেক অনেক কাল আগে। কিছু বাদামী বর্ণের ভাল্লুক উত্তর মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে দেখা গেলো কোনো এক ভাল্লুক শাবকের জন্মের সময় সে একটা ব্যতিক্রম রূপ নিয়ে জন্ম নিলো। তার জন্মের সময় ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় ছোট্ট কোনো ভুল অনুলিপির জন্য এ পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ মিউটেশন ঘটে। যার গায়ের রঙ তার বাবা মায়ের তুলনায় তুলনামূলক সাদা। এতে করে সে একটা বাড়তি সুবিধা পেলো। তার পশমের রঙ সাদা থাকায় সাদা বরফাচ্ছাদিত এলাকায় তাকে শিকার-রা দূর থেকে শনাক্ত করতে পারতো না। ফলে, শিকার পালাবার আগেই শিকারকে ধরে ফেলা যেতো। মিউটেশন থেকে পাওয়া এ সাদা লোম ঐ এলাকার জন্য সুবিধাজনক। এই বৈশিষ্ট্যই ওদের জেনারেশন থেকে জেনারেশন ছড়াতে থাকলো। এর ফলে দেখা গেলো, সাদা ভাল্লুকেরা সে অঞ্চলে বেশি শিকার করতে পারছে।
আর বাদামি ভাল্লুকরা সাদা বরফাচ্ছাদিত এলাকায় শিকারের চোখে ধরা পড়ে শিকার হারাচ্ছে। হাজার হাজার বছর যায়, সাথে বিলুপ্ত হতে থাকে বাদামিরা৷ সেই অঞ্চলে টিকে যায় সাদা ভাল্লুকেরা। আজ থেকে ৭০,০০০ কি ১৫০,০০০ বছর আগে এই সাদা ভাল্লুকেরা ভিন্ন পরিবেশে ভিন্নভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। এর ফলাফল কি জানেন?
এই দুই রঙের পশমের ভাল্লুকেরা আর পুরোপুরি একই প্রজাতিতে নেই। আজকের দিনে সাদা ভাল্লুকেরা বাদামি ভাল্লুকের উপপ্রজাতি [১৪]। এই পৃথিবীতে সাদা ভাল্লুকেরাও আছে, তাদের পূর্বপুরুষ, বাদামি ভাল্লুকেরাও টিকে আছে। কোনো এক র্যান্ডম মিউটেশন, এন্টার্টিকার পুরো ভাল্লুক প্রজাতিকে প্রভাবিত করল এবং ব্রাউন ভাল্লুকরা ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে সাদা ভাল্লুকে বিবর্তিত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আরও অনেক মিউটেশন হল, ঐসব সাদা ভাল্লুকদের মধ্যে আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের জন্ম নিল। ন্যাচারাল সিলেকশন, জেনেটিক ড্রিফট বা র্যান্ডমলি সিলেকশনের কারণে অনেক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেল এবং তারা বিবর্তিত হলো আজকের পোলার বিয়ারে। এব্যাপারে মজুদ আছে অসংখ্য গবেষণা, প্রমাণাদি [১৫]।
এভাবেই মিউটেশনের মাধ্যমে প্রকরণ তৈরি হতে হতে একসময় উৎপত্তি ঘটে নতুন প্রজাতির। এই মিউটেশনের কারণেই পরিবেশ থেকে বাদ পড়ে, বিলুপ্ত হয়। কিংবা কখনও মিউটেশনের সুবিধাজনক ফলাফল সেই পরিবেশে আরও ভালো করে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, কোনো প্রাণিতে একটা মিউটেশনের ফলাফল সেই পরিবেশে টিকে থাকার মতো হলে ঐ পরিবেশের জন্য সেই মিউটেটেড প্রাণিটা টিকে থাকার যোগ্য। আর ফলাফল যদি সে পরিবেশে টিকে থাকার মতো না হয়, তাহলে সে টিকে থাকার মতো যোগ্য হতে পারবে না। বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটাকেই এক শব্দে বলে “ন্যাচারাল সিলেকশান”। পোলার ভাল্লুকদের ব্যাপারটাই দেখা যাক না—এদের মধ্যেই হয়তোবা মিউটেটেড হয়ে কারোর জন্ম হয়েছে খুব কম পশম নিয়ে। ঠান্ডায় মারাও গেছে। কেউ জন্মেছে একটু সাদা রঙের বেশি পশম নিয়ে। তারা সুবিধা পেয়েছে। শেষ কথা হচ্ছে, কোনো প্রাণিতে মিউটেশনের ফলাফল সেই অঞ্চলের আবহাওয়া জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো হলেই সে প্রাকৃতিক ভাবে নির্বাচিত। মিউটেশন থেকে প্রাপ্ত এই সুবিধাজনক গুনাবলি স্থানান্তরিত হয় বংশপরম্পরায়। সামনেই আমরা বর্তমানে, চোখের সামনে চলা কিছু ন্যাচারল সিলেকশানের জলজ্যান্ত উদাহরণ দেখবো।
৪.২ সেক্সুয়াল সিলেকশান: অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যও বাঁচাতে পারে জীবন
আমরা এতোক্ষণ দেখেছি যে, যেসব জীব কোনো পরিবেশে মিউটেশনের মাধ্যমে টিকে থাকার মতো বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। তারাই প্রাকৃতিক ভাবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু, কিছু জীবের বেলায় আমরা দেখি যে, তাদের শরীরে এমনসব বৈশিষ্ট্য আছে, যা তাদেরকে সারভাইভালে কোনো সুবিধা দেয় না। দেখা যায় যে, কিছু পাখির মাথায় ইয়া বড় এন্টেনা থাকে বা অস্বাভাবিক আকৃতি রঙবেরঙের লেজ থাকে। যা কিছুক্ষেত্রে উড়তেও বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করে। তাও এসব অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহাল তবিয়তেই টিকে আছে। কেন সেটা?
এখানেই আসে সেক্সুয়াল সিলেকশন। এখানে কোনো জীব কেবল টিকে থাকার মতো বৈশিষ্ট্য পাওয়ায় টিকে যায় নি, বরং এলোপাতাড়িভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে এমন বৈশিষ্ট্য পেয়ে বসে আছে, যা তাকে তার প্রজাতির অন্য সদস্যদের থেকে বেশি সঙ্গী পেতে সাহায্য করে। বেশি পরিমাণ জিন ছড়িয়ে যেতে পেরেছে। ফলে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সে পপুলেশনে এই “আকর্ষণ” করতে পারার জিনটা ছড়িয়ে যায়। এখান থেকে আমরা বিবর্তনের একটা চমৎকার ইন্টারপ্রেটেনশন পাই। কী সেটা? কোনো প্রজাতির উদ্ভব কেবলই টিকে থাকার বৈশিষ্ট্য অর্জনের ওপর নির্ভর করে না। তারচেয়েও বেশি নির্ভর করে কোন জীব কতো বেশি প্রজনন করতে পেরেছে—কতো বেশি তার বৈশিষ্ট্য সমূহ পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। মানুষের চাইতেও প্রাণি জগতে এর উদাহরণ অধিক। সেক্সুয়াল সিলেকশন দু রকমের হতে পারে।
১. ইন্ট্রা সেক্সুয়াল সিলেকশন: এই সিলেকশনের ক্ষেত্রে একাধিক পুরুষ একই স্ত্রীয়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। মিলিত হবার সে প্রতিযোগিতায় যোগ্যতম হিসেবে বিবেচিত হতে পুরুষ সদস্যদের মধ্যে নানান বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে (লম্বা ঠোঁট, দৈহিক শক্তি, বলিষ্ঠতা)।
২. ইন্টার সেক্সুয়াল সিলেকশন: কোনো পপুলেশনের সাধারণত স্ত্রী লিঙ্গের সদস্যরা বিপরীত লিঙ্গের অর্থাৎ পুরুষ সদস্যদের নানান বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নির্বাচন করে। এ কারণেই প্রকৃতিতে নারী সদস্যের প্রাণিদের চেয়ে পুরুষ সদস্যের প্রাণিদের বেশি রঙবেরঙের দেখবেন। এতে তাদের অনেক অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যও বিবর্তিত হয়, যেটা তাদের টিকে থাকার লড়াইয়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও নারী সদস্যকে মিলিত হওয়ার জন্য আকর্ষিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যেমন অনেক পাখিদের উজ্জ্বল, রঙিন পালক, মেটিং ডান্স, লম্বা লেজ ইত্যাদি।
৪.৩ জেনেটিক ড্রিফটঃ অযোগ্যরাও বিবর্তিত হয় (Driven by chance, not selection)
কোনো ছোট জনগোষ্ঠীতে সময়ের সাথে সাথে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতে রেন্ডম পরিবর্তনই হচ্ছে জেনেটিক ড্রিফট। আমি জানি, এই খটমটে সংজ্ঞায় আপনার মন ভরবে না। চলুন দেখা যাক, পূর্বের সব ধারণা আপনাদের অল্প অল্প মনে করিয়ে এই জেনেটিক ড্রিফটের সংজ্ঞাটা পরিস্কার করতে পারি কিনা। জেনেটিক ড্রিফট বুঝতে আমরা ৩ টা ব্যাপার একটু শিখে নেবো— ১) জিন, ২) অ্যালিল, এবং ৩) অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি। আপনার আগে থেকেই এগুলি সম্পর্কে ভালো করে জানাশোনা থাকলে আপনি সরাসরি জেনেটিক ড্রিফটের আলোচনায় চলে যেতে পারেন।
আবারও মনে করিয়ে দিই, জিন হচ্ছে ডিএনএ-র অংশবিশেষ। আমাদের ডিএনএ তে থাকা নাইট্রোজেন বেইস ( adenine (A), thymine (T), guanine (G), এবং cytosine (C)) গুলো নানান কম্বিনেশনে থেকে একেক প্রকার প্রোটিন সৃষ্টির ইনফরমেশন বহন করে। এই একেকটা কার্যকর কম্বিনেশনকেই আমরা জিন বলতে পারি। জিন থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে সৃষ্টি হয় আমাদের দেহে প্রোটিন। এবং সে প্রোটিনগুলিই আমাদের দেহের নানান বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। যেমন ধরুন, আপনার চোখের রঙ। সেটার জন্যেও আপনার ডিএনএ তে কোথাও না কোথাও, কোনো লোকেশানে আলাদা নাইট্রোজেন বেইস এর কম্বিনেশন আছে। সেই ইউনিক কম্বিনেশনকে ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করে চোখের জন্য তৈরি হওয়া প্রোটিনটিই আপনার চোখের রঙ প্রকাশ করেছে। এভাবে আপনার প্রকাশিত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জিন। জিন এর ধারণা আরও পরিস্কার করতে হলে আমাদের এ লেখাটাকে আরও বেশি বড় করতে হবে।
এবার জেনে নেয়া যাক, অ্যালিল কী? একই জিনের বিভিন্ন রূপভেদকে অ্যালিল বলে। দাঁড়ান, একটা উদাহরণ দিয়ে আরও সহজ করে দিই, মোটর গাছের উদাহরণ দেয়া যাক। মোটর গাছের কান্ডের দৈর্ঘ্য অর্থাৎ উচ্চতা নিশ্চয়ই একটি জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন, এই উচ্চতা দুই রকমের হতে পারে, হয় লম্বা নাহয় খাটো। এই কান্ডের উচ্চতার জন্য দায়ী জিনটির তাই দুটি আলাদা রূপ থাকবে, ধরে নিই লম্বার জন্য জিনের সে রূপটি T এবং খাটোর জন্য t । এখানে T এবং t এরা বিপরীত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করছে—এবং এরাই একে ওপরের অ্যালিল। যদি কোনো মোটর গাছে T প্রকট হয়, তাহলে সে গাছের কান্ড লম্বা হবে। গাছটায় খাটো হওয়ার বৈশিষ্ট্য, t থাকার পরও কেবল সেটা প্রচ্ছন্ন হওয়ার কারণে গাছটা খাটো হবে না। আশা করি, অল্প হলেও বুঝেছেন অ্যালিল ব্যাপারটা আসলে কী। তাহলে কেতাবি ভাষায় অ্যালিলের সংজ্ঞা কী দাঁড়াচ্ছে?
ক্রোমোজোমের নির্দিষ্টি লোকেশানে অবস্থান করা একই বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দায়ী জিনের দুটি ভিন্ন রূপকে একটি আরেকটির অ্যালিল বলা হয়। এখন তবে জানা যাক অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি কী।
“Allele frequency refers to the measurement of how often a specific allele (variant) of a gene occurs in a given population”
অর্থাৎ, কোনো নির্দিষ্ট পপুলেশনে একটি নির্দিষ্ট অ্যালিল কি পরিমাণে আছে, তার পরিমাপকে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি বলে। আরও ভালো করে বললে, অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি হল একটি জনসংখ্যায় নির্দিষ্ট অ্যালিলের আপেক্ষিক প্রাচুর্যতা। এই পরিমাপটা মূলত আমাদের জানায় যে একটি অ্যালিল একটি নির্দিষ্ট পপুলেশনে কতটা সাধারণ বা বিরল [১৬]। সাধারণত এ পরিমাপটিকে আমরা শতকরা হার বা অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করি।
উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা আরও সহজ করা যাক। ধরি, একটা ফুলের পপুলেশনে ১০০ টি ফুল আছে। এর মধ্যে ৭০ টি ফুলের পাপড়ির রঙ লাল (Allele R) এবং বাকি ৩০ টি ফুলের পাপড়ির রঙ বাদামী (Allele r)। তাহলে এখানে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সির হিসেব কষে পাচ্ছি-
- অ্যালিল R এর ফ্রিকোয়েন্সি = 100-এর 70 = 70%
- অ্যালিল r এর ফ্রিকোয়েন্সি = 100-এর 30 = 30%
একটা পপুলেশনে কোনো অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সি বেশি থাকার অর্থ হচ্ছে, সে পপুলেশনে সেই অ্যালিল থেকে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যটি বেশি কমন। এবার দেখা যাক, কেনই বা এতোক্ষণ অ্যালিল, অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে এতোকিছু জানলাম।
ধরি, ১৪ টি খরগোশের একটি ছোট পপুলেশন বাস করে একটি ছোট্টো দ্বীপে। যেখানে ৭টির লোম বাদামী (B অ্যালিল) এবং ৭টির লোম সাদা (b অ্যালিল)। তাহলে সে দ্বীপের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে উভয় অ্যালিলের ক্ষেত্রেই ৫০%। একদিন এক দাবানলে দূর্ভাগ্যবসত সে দ্বীপের সাদা লোমের ৪ টি খরগোশ অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যায়। এক্ষেত্রে বর্তমানে B অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সি ৭০%। অর্থাৎ, খরগোশের এই বর্তমান পপুলেশনে বাদামী লোম বেশ সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং সাদা লোম তুলনামূলক বিরল বৈশিষ্ট্য। ক্রমান্বয়ে দেখা যাবে বাদামী রঙের খরগোশরা বেশি পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করতে পারছে এবং নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে সে পপুলেশনে বাদামী লোমের (B) অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাবে এবং সাদা লোমের (b) অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাবে। যদি এটি কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে, তাহলে একসময় পুরো জনসংখ্যা বাদামী লোমের হয়ে যেতে পারে, এবং সাদা লোমের অ্যালিল সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে পারে।
খেয়াল করুন, এখানে কিন্তু র্যান্ডমলি সাদা লোমের খরগোশ মারা পড়েছে। এই দাবানল কিন্তু বাদামী খরগোশের জন্যও সমান বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু কোনোভাবে বাদামী খরগোশরা বেঁচে গেল আর সাদা খরগোশেরা ফেসে গেল। যেহেতু এই সিলেকশনে ভালো/খারাপ মিউটেশন এর কোনো প্রভাব ছিল না (অর্থাৎ এখানে যোগ্যতমের টিকে থাকার ব্যাপারটি আসছে না), একদম র্যান্ডমলি কয়েন টসের মতো কারা টিকে থাকবে সেটা সিলেক্ট হলো তাই এই সিলেকশনের আমরা নাম দিলাম র্যান্ডম সিলেকশন। আর এই র্যান্ডম সিলেকশনের কারণে একটি বিশাল জীবসংখ্যায় যেহেতু হঠাৎ বড়ধরনের ধ্বস নামে (৭ টা সাদা খরগোশের মধ্যে ৪ টাই মারা পড়ল), তাই এধরনের সিলেকশনকে বলা হয় জেনেটিক ড্রিফট (Genetic drift)। বড় পপুলেশনে এই প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে ধীর হয়, কারণ এইযে দৈবভাবে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতে বড় পরিবর্তন আসা কঠিন। কিন্তু ছোট জনসংখ্যায়, জেনেটিক ড্রিফট অনেক দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এভাবে উৎপত্তি ঘটতে পারে নতুন প্রজাতির।
জেনেটিক ড্রিফট সাধারণত দুই ভাবে ঘটতে পারেঃ
১) বটলনেক ইফেক্ট (Bottleneck Effect)
২) ফাউন্ডার ইফেক্ট (Founder Effect)
৪.৩.১ বটলনেক ইফেক্ট
একটি বড় জনগোষ্ঠিতে বিধ্বংসী কোনো দূর্যোগে(প্রাকৃতিক দূর্যোগ, মহামারী বা মানব সৃষ্ট কর্মকান্ড) জনসংখ্যা ধ্বস নামলে পপুলেশন বটলনেক ঘটতে পারে। এর ফলে একটি ছোট জনগোষ্ঠী বেঁচে থাকায় এবং সে জনগোষ্ঠীটি পূর্বের জনগোষ্ঠীর চেয়ে কম জেনেটিক বৈচিত্র্য বহন করে। অনেক অ্যালিল হারিয়ে যায় এবং জনসংখ্যার জেনেটিক গঠন পরিবর্তিত হয় উল্লেখযোগ্যভাবে। সময়ের সাথে সাথে এই ছোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়—ফলশ্রুতিতে উদ্ভব ঘটে নতুন প্রজাতির।
ব্যাপারটাকে আরও সহজভাবে বলি। ধরুন, কোনো জঙ্গলে ৪ টি সাদা, ৪ টি বাদামী, ৪ টি লাল আর ৪ টি কালো খরগোশ বাস করে। এক্ষেত্রে এই পপুলেশনে সবগুলি অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সি ২৫%। সে জঙ্গলে দাবানল লেগেছে। দেখা গেলো যে, জঙ্গলে আগুন পৌঁছায়নি এমন জায়গায় আগে থেকে অবস্থান করা ৩ টি সাদা খরগোশ আর ২ টি। এদের টিকে যাওয়াটা তুলনামূলক ভালো এডাপ্টিভ ক্ষমতার জন্য হয়নি, বরং কাকতালীয়ভাবে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করার জন্য সম্ভব হয়েছে। এখন এই পরিবর্তিত ছোট্টো পপুলেশনের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি পূর্বের অরিজিনাল পপুলেশনের চেয়ে ভিন্ন। এখন ৭৫% অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে এই পপুলেশন সামনে সাদা খরগোশের একটি পপুলেশনে রূপান্তরিত হবে কয়েক প্রজন্ম পর। এটাই বটলনেক ইফেক্ট। এই বটলনেক ইফেক্টের ফলে কোনো প্রজাতির জেনেটিক ডাইভার্সিটি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়, যা স্পিসিয়েশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বটলনেক ইফেক্টের ফলে কোনো প্রজাতির জেনেটিক ডাইভার্সিটি প্রভাবিত হওয়ার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
নর্দার্ন এলিফ্যান্ট সিলঃ নর্দার্ন এলিফ্যান্ট সিলেরা এক মারাত্মক বটলনেক ইফেক্টের সম্মুখীন হয়েছিলো। ১৯ শতকে অতিরিক্ত শিকারের ফলে এদের সংখ্যা মাত্র ২০-টিতে নেমে এসেছিলো। পরবর্তীতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে এদের সংখ্যা ১ লক্ষতে পৌঁছাতে পারলেও একটা বড়সড় ক্ষতি হয়ে যায়। তা হচ্ছে, জেনেটিক ডাইভার্সিটি একদম কমে যায়। এতে করে এদের অভিযোজন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, যেটা পূর্বের নর্দার্ন এলিফ্যান্ট সিলদের মধ্যে দেখা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে জেনেটিক ড্রিফট। ২০ টি অবশিষ্ট পপুলেশনের অ্যালিল ফ্রিকুয়েন্সি ছিলো এদের পূর্বের বৃহৎ পপুলেশনের চেয়ে ভিন্ন। যার ফলে, এদের জিন পুল ছিলো খুবই সীমিত, হারিয়ে গেছে অনেক অ্যালিল চিরতরে। একটা ডাইভার্স জিনপুলের পপুলেশনে কারোর না কারোর কোনো নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে পারে। এতে করে সে পপুলেশনের পুরোটা কোনো প্যাথোজেনের আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু এই বটলনেক ইফেক্টের ফলে নর্দার্ন এলিফ্যান্ট সীল সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে [১৭]।
চিতাবাঘেদের বটলনেক ইফেক্টঃ একই রকম বটলনেকের স্বীকার হয়েছিলো চিতা বাঘেরা। প্রথম একবার আইস এইজে বাসস্থান হারিয়ে এবং পরবর্তীতে ১৮/১৯ শতকের দিকে মানুষের শিকারের তোপে দুটি বিশাল বড় বটলনেকের সম্মুখীন হয়। এতে করে এই সীমিত জিন পুল নিয়ে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হারানো থেকে শুরু করে নানান প্রজননগত সমস্যায় ভুগছে চিতা বাঘেরা [১৮]।
পিঙ্গেলাপীয়(Pingelapese) উপজাতিঃ বটলনেক ইফেক্টের আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায় মাইক্রোনেশিয়ানদের পিঙ্গেলাপীয় উপজাতির মধ্যে। ১৮ শতকে এক বিধ্বংসী টাইফুন এবং ফলশ্রুতিতে হওয়া দুর্ভিক্ষে তাদের জনগোষ্ঠীর মাত্র ২০ জন বেঁচে থাকে। বাকিরা মারা যায়। এই বেঁচে যাওয়া মানুষদের মধ্যে কেবল একজনের achromatopsia নামক খুব বিরল এক বর্ণান্ধতা ছিলো। যেটা প্রতি ৩ লাখে ১ জনের হয় সাধারণত। কিন্তু আজকের দিনে পিঙ্গেলাপীয়দের জনসংখ্যার ১০%-ই এই রোগে আক্রান্ত [১৯]।
আইল্যান্ড ফক্সের দ্রুত বিবর্তনঃ চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জের আইল্যান্ড ফক্স(Urocyon littoralis) এর বিবর্তন সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা চমৎকার একটি উদাহরণ। ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জে পাওয়া শিয়াল গুলো মূল ভূখণ্ডের ধূসর শিয়ালের(Urocyon cinereoargenteus) তুলনায় অনেক ছোট। ধারণা করা হয় যে, প্লাইস্টোসিন যুগে সমুদ্র পৃষ্ঠের স্তর পরিবর্তনের ফলে খুব সম্ভবত শেয়ালগুলো সাঁতার কেটে, ভাসমান কোনো জিনিসের সাহায্যে, অথবা মানুষের মাধ্যমে চ্যানেল দ্বীপে পৌঁছেছিল। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপপুঞ্জে এই শিয়ালগুলো ফাউন্ডার এফেক্টের সম্মুখীন হয়। অর্থাৎ ছোট জনসংখ্যার জিনগত বৈচিত্র্য কমে যায় এবং দ্রুত বিবর্তনমূলক পরিবর্তন ঘটে। পিয়ার রিভিউড জার্নাল PLOS ONE-এ একটি গবেষণায় এই শিয়ালগুলোর মাইকোটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে পপুলেশন বটলনেক এবং রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশন এই Urocyon littoralis দের উদ্ভবের পেছনে দায়ী ছিলো। অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এ শিয়ালগুলির বিবর্তন বেশ কম সময়ের মধ্যেই ঘটেছে [২৪ ]।
মানব বিবর্তনে বটলনেক ইফেক্টঃ ক্রোমোজোম-২ এর সৃষ্টি
মানব বিবর্তনের ইতিহাসে অনেকবার এই বটলনেক ইফেক্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাদের এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের। তবে, এর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী যে পপুলেশন বটলনেক ঘটেছিলো তা নিয়ে এ অংশে লিখবো। আপনি চাইলে এ অংশটা না পড়ে ফাউন্ডার ইফেক্ট-এ চলে যেতে পারেন। না জানলেও ক্ষতি নেই।
গল্পে ফেরা যাক। ২০২৩ সালে চীনের কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট ওয়াংজিয়ে হু এর নেতৃত্বে চীন, ইটালি ও আমেরিকার মোট ৯ জন কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট Fast infinitesimal time coalescent process (FitCoal) নামক এক স্ট্যাটিসটিক্যাল মেথড অনুসরণ করে মানব জিনোমে অনুসন্ধান চালান। সে অনুসন্ধান থেকে উঠে আসে, প্লাইস্টোসিন epoch-এ আজ থেকে প্রায় ৯,৩০,০০০ থেকে ৮,১৩,০০০ বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের সে সময়ের পূর্বপুরুষের ওপর নেমে আসে এক বরফ যুগ। এবং সে সময়েই আমাদের পূর্বপুরুষেরা সম্মুখীন হয় এক ভয়াবহ পপুলেশন বটলনেকের। যেটা তাদের জনসংখ্যা কমিয়ে মাত্র ১২৮০ জনে নামিয়ে আনে। খুব সম্ভবত সে সময় পৃথিবীতে অবস্থান করছিলো আমাদের পূর্বপুরুষ হোমো হাইডেলবারগেন্সিস। ১ লাখ ১৭ হাজার বছর ধরে চলা সেই পপুলেশন বটলনেকে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। জনসংখ্যার এই চরম ধ্বস কেবল জেনেটিক বৈচিত্র্যকেই সীমিত করেনি, বরং কিছু ইউনিক জেনেটিক পরিবর্তনেরও সুযোগ করে দিয়েছিলো—যেমন ক্রোমোজম-২ এর সংযোগ, যা পরবর্তীতে আধুনিক মানবের অনন্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। বলে রাখা ভালো যে, মানুষের ক্রোমোজম সংখ্যা ২৩ জোড়া। গ্রেট এইপ পরিবারের অন্য প্রজাতির সদস্যদের ২৪ জোড়া থাকলেও আমাদের ২৩ জোড়া। এর কারণ হচ্ছে ক্রোমোজম-২ হচ্ছে দুটি আদি ক্রোমোজমের মিলিত(fused) রূপ। শিম্পাঞ্জি আর আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক হওয়ার পর এই প্লাইস্টোসিন epoch এ চলা বটলনেকে রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশানের ফলে দুটো ক্রোমোজমের ফিউশান ঘটে আজকের Chromosome-2 এ পরিণত হয়েছে। সেই ঘটনার প্রায় দেড় লক্ষ বছর পর, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৭ লাখ বছর আগে আমাদের এ পূর্বপুরুষদের থেকে উদ্ভব ঘটতে থাকে নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভান সহ বেশ কয়েকটি মানব প্রজাতির পূর্বপুরুষদের। এই পূর্বপুরুষদের থেকে আসা সকল হোমিনিনদের Chromosome-2 ছিলো ফিউজড বা সংযোজিত। গবেষকদের ধারণা, এই সংযোজিত ক্রোমোজমটি আমাদেরকে মস্তিষ্কের বিকাশে কিংবা প্রজনন ক্ষমতায় সুবিধা প্রধান করা সহ প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছিলো [২০]।
৪.৩.২ ফাউন্ডার ইফেক্ট
বটলনেক ইফেক্টে আমরা দেখলাম যে, কোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কারণে কোনো প্রজাতির জনগোষ্ঠিতে পপুলেশনের হ্রাস ঘটলে জেনেটিক ড্রিফট ঘটতে পারে। কিন্তু ফাউন্ডার ইফেক্ট ঘটে যখন কোনো প্রজাতির একটা ছোটো জনগোষ্ঠী তাদের মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করে। এতে করে দীর্ঘ সময় প্রজনন বিচ্ছিন্নতা বা রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশানের কারণে জিন পুলের অ্যালিলে রেন্ডম পরিবর্তন আসতে পারে, জেনেটিক বৈচিত্র্য কমে যেতে পারে এবং দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে পারে।
ফাউন্ডার ইফেক্টের কারণে জেনেটিক বৈচিত্র্যতা কমার একটা চাক্ষুষ উদাহরণ আমরা দেখতে পাই আমেরিকার আমিশ জনগোষ্ঠিতে। ১৬৯৩-১৬৯৭ সাল থেকেই আমিশ জনগোষ্ঠী ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমেরিকায় এসে বসতি গড়তে শুরু করে। এই বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী বাইরের সাথে প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন গত তিনশো বছর যাবত, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যেই প্রজনন অব্যাহত রেখেছে। এতে করে এদের জিন পুলে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়নি। এই লিমিটেড জিন পুল নিয়ে তাদের জেনেটিক ডাইভার্সিটিও কমে গেছে। ফলশ্রুতিতে Ellis-van Creveld syndrome এর মতো অত্যন্ত বিরল একটা রোগও তাদের জনগোষ্ঠীতে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে হচ্ছে। এ রোগ সাধারণত জেনেটিক্যালি ছড়ায়, যার ফলে এ রোগ নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষ বামনাকৃতির হয় এবং হাত-পায়ের আঙ্গুল ৫ টার বেশি হয়।
এইযে ফাউন্ডার ইফেক্টের মাধ্যমে একটা জনগোষ্ঠীর অ্যালিলে এভাবে রেন্ডম পরিবর্তন আসতে থাকে, সেজন্যে কিন্তু বিশাল সময় ব্যবধানে একসময় নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণ দেখা যাক।
লেমুরের মাদাগাস্কার ভ্রমণঃ লেমুররা প্রায় ৬৩ মিলিয়ন বছর আগে, ইওসিন যুগে Strepsirrhini উপগোত্রের এক প্রাইমেট প্রজাতির একটা ক্ষুদ্র অংশ কোনোভাবে আফ্রিকার মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাদাগাস্কারে চলে আসে। পরবর্তীতে এদের থেকে উৎপত্তি ঘটে লেমুরের সব প্রজাতির। এবং মূল ভূখন্ডে থেকে যাওয়া জনগোষ্ঠী থেকে উদ্ভব ঘটে lorises, pottos এবং galagos (lorisoids) দের [২১], যারা লেমুরদের থেকে প্রজাতিগত ভাবে সম্পূর্ণরূপে আলাদা।
ফলের মাছিঃ ফ্রুট ফ্লাই বা যেটাকে বাংলায় বলে ফলের মাছি (গণ: ড্রসোফিলা), হচ্ছে ফাউন্ডার ইফেক্টের আরেকটা প্রসিদ্ধ উদাহরণ। এদের অনেক প্রজাতির এক বৈচিত্র্যময় আবাস্থল হচ্ছে হাওয়াই দ্বীপ পুঞ্জ। গবেষণা করে দেখা গেছে, এদের পূর্বপুরুষেরা খুব ক্ষুদ্র পপুলেশন নিয়ে এ দ্বীপগুলোতে এসেছিলো এশিয়ার মূল ভূমি থেকে। সময়ের পরিক্রমায় এ দ্বীপপুঞ্জে জেনেটিক ড্রিফট এবং সিলেকশান প্রেশারে প্রায় ৮০০ প্রজাতির ফ্রুট ফ্লাই বিবর্তিত হয়েছে [২২]।
ডারউইনের ফিঞ্চ পাখিঃ ডারউইনের ফিঞ্চ পাখির বিবর্তনের গল্প লক্ষ্য করলেও আমরা ফাউন্ডার ইফেক্টের উদাহরণ দেখতে পাই। লক্ষ লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে ফিঞ্চ পাখি্র পূর্বপুরুষের একটা ছোট পপুলেশন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছায়। এই পাখিরা বিভিন্ন দ্বীপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বিভিন্ন পরিবেশগত অবস্থার মুখোমুখি হয়। সময়ের সাথে সাথে, তারা লোকাল রিসোর্সের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, যার ফলে খাবারের ধরণ অনুযায়ী তাদের ঠোঁটের আকার ও গঠনে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা দেয়। এই প্রক্রিয়াটি জিনগত পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। গবেষকরা নির্দিষ্ট জিন, যেমন HMGA2 শনাক্ত করেছেন, যা ঠোঁটের আকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জিনের ফলে উদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ফিঞ্চদের বিভিন্ন খাদ্য উৎসের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং প্রতিযোগিতা এড়াতে সাহায্য করে। যার ফলে এরা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত হয় [২৩]।
৪.৪ জিন প্রবাহ (Gene Flow)
বিবর্তন হলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের ধীর নৃত্য। স্পিসিয়েশন বা প্রজাতির উদ্ভবে এই জিন প্রবাহ হচ্ছে আরেকটি উল্লেখযোগ্য নিয়ামক। জিন প্রবাহ একটি জনসংখ্যায় এমন সব নতুন জেনেটিক বৈচিত্র্য নিয়ে আসে, যা টিকে থাকা এবং প্রজননের মতো বৈশিষ্ট্যগুলিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
তাহলে, জিন প্রবাহ ব্যাপারটা কী? জিন প্রবাহ হচ্ছে এক জনগোষ্ঠী থেকে অন্য জনগোষ্ঠীতে জেনেটিক উপাদান আদান-প্রদান। এটি সাধারণত ঘটে যখন একই প্রজাতির আলাদা দুটি জনগোষ্ঠীর প্রাণীরা অন্য জায়গা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এক জায়গায়, একসঙ্গে বংশবৃদ্ধি করে এবং তাদের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল মিশে যায়। জিন প্রবাহ কাছাকাছি রিলেটেড দুটি প্রজাতি মধ্যেও ঘটতে পারে। এই জিন প্রবাহ জেনেটিক বৈচিত্র্য বজায় রাখে এমনকী, কোনো জনগোষ্ঠীর জিনপুলে পরিবর্তন ঘটায়। যা লম্বা সময়ের ব্যবধানে নতুন প্রজাতির উদ্ভব পর্যন্ত ঘটায় সংকরায়ণের মাধ্যমে। সামনে আমরা আরও কিছু উদাহরণ দেখলেই স্পষ্ট হবে ব্যাপারটা।
৪.৩.১ কীভাবে কাজ করে জিন প্রবাহ?
- অভিবাসন: যখন এক জনগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক জীব অন্য জনগোষ্ঠীতে আসে এবং প্রজনন করে, তারা সেই নতুন জনগোষ্ঠীর জিন পুলে নতুন জেনেটিক বৈচিত্র্য (অ্যালিল) যুক্ত করে। ধরুন, দুটি হরিণের দল- এক দল একটি ঠান্ডা উপত্যকায় উঁচুতে বাস করে, অন্য দল পাহাড়ের অন্য পাশে। তারা জেনেটিকভাবে কাছাকাছি হলেও শারীরিক বৈশিষ্ট্যে কিছু ভিন্নতা আছে দুটি ভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে বাস করায়। হতে পারে উপত্যকায় বাস করা হরিণের দলটি বিবর্তনের মাধ্যমে ঘন লোম পেয়েছে ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে বাঁচতে। যদি কোনোভাবে সেই উপাত্যকা আর পাহাড়ের ওপর পাশ সংযুক্ত হয়, (মানুষ একটি সেতু তৈরি করল ধরে নিন) এবং এই দুটি দল একে অপরের সঙ্গে প্রজনন শুরু করে, তাহলে এক দলের জেনেটিক বৈচিত্র্য অন্য দলের সাথে মিশে যাবে, ফলে তাদের সন্তানেরা নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করবে। এভাবে তাদের জিন পুলে যুক্ত হবে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য।
- প্রবসন (অভিবাসন প্রস্থান): বিপরীতে, যখন কিছু সংখ্যক জীব তাদের জনগোষ্ঠী ছেড়ে যায়, তারা তাদের জেনেটিক উপাদানও সঙ্গে নিয়ে চলে যায়, যার ফলে তারা যে জনগোষ্ঠী থেকে গেছে তার জেনেটিক বৈচিত্র্য কমে যেতে পারে। ধরা যাক, ১০০ টি খড়গোশের একটা জনগোষ্ঠীতে ২০ টি সাদা রঙের খড়গোশ আছে। সেখান থেকে ১৭ টি সাদা খড়গোশ ধরুন কেউ নিয়ে গেলো। তাহলে খড়গোশের সে অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীতে সাদা রঙের জন্য দায়ী জিনটির পরিমাণ কমে যাবে, অর্থাৎ সামগ্রীকভাবে এই খড়গোশ পপুলেশনে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তন ঘটে যাবে। এভাবে প্রবসনের ফলে অনেক অনেক বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিনের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবর্তন ঘটতে পারে।
- জিন মিশ্রণ: যদি দুটি জনগোষ্ঠী ভৌগোলিক বা আচরণগত কারণে আলাদা থাকে এবং পরে পুনরায় যুক্ত হয়, তখন জিন প্রবাহ পূর্বে বিচ্ছিন্ন জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের এক্সচেঞ্জ ঘটাতে পারে, যা সমগ্র জনসংখ্যার বিবর্তনে প্রভাব ফেলতে পারে।
৪.৪.২ জিন প্রবাহের মাধ্যমে জিন পুলের পরিবর্তনের ও প্রজাতির উদ্ভবের বাস্তব ও ঐতিহাসিক উদাহরণ
এ অংশে আমরা দেখবো জিন প্রবাহের ফলে জীব বিবর্তনের কিছু ঐতিহাসিক এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা কিছু বিবর্তনের উদাহরণ। এ অংশে আমরা জিন প্রবাহের ফলে ঘটা মাইক্রো এবং ম্যাক্রো বিবর্তনের উদাহরণ খতিয়ে দেখবো। এতে করে এ ব্যাপারটায় আমাদের ধারণা আরও পরিস্কার হয়ে যাবে।
ক. প্রাচীন মানুষের বিবর্তনে জিন প্রবাহ (প্রাচীন মানুষ এবং নিয়ান্ডারথাল)
জিন প্রবাহের একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল প্রাচীন মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স) এবং নিয়ান্ডারথালদের (হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস) মধ্যে আন্তঃপ্রজনন। নিয়ান্ডারথালরা এবং আধুনিক মানুষ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সহাবস্থান করেছিল হাজার হাজার বছর আগে।
- জিন প্রবাহের প্রভাব: জেনেটিক প্রমাণ থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, আজকের দিনে মধ্য-প্রাচ্য ও ইউরোপের নন-আফ্রিকান মানুষদের ১-৪% নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ আছে, যা প্রাচীন প্রজননের ফলশ্রুতি। এই নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ নতুন বৈশিষ্ট্য এনেছিল, যেমন স্থানীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।
- বিবর্তনীয় প্রভাব: নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হলেও তাদের জিন এখনও আধুনিক মানুষের জিন পুলে আছে এবং ত্বকের রং, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং নির্দিষ্ট রোগের জন্য সংবেদনশীলতার মতো বৈশিষ্ট্যগুলিতে প্রভাব ফেলেছে। এই জিন প্রবাহ নতুন প্রজাতি তৈরি করেনি, তবে এ অধ্যায়টি মানুষের জিন পুলকে আরও ডাইভার্স করার মাধ্যমে মানব বিবর্তনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
খ. গাছের সংকর প্রজাতির উদ্ভব: সূর্যমুখী (হেলিয়ান্থাস প্রজাতি)
উদ্ভিদের জগতে, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জিন প্রবাহ ঘটে। দুইটি প্যারেন্ট প্রজাতির জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালের সমন্বয়ে অনেক সময় নতুন প্রজাতির জন্ম হয়, যাকে বলা হয় হাইব্রিড স্পিসিয়েশন। এই হাইব্রিড স্পিসিয়েশন বা সংকর প্রজাতিকরণ ঘটে জিন প্রবাহের ফলে[২৫]। এক্ষেত্রে আমরা সূর্যমুখী (Helianthus) উদ্ভিদের একটি বিশেষ প্রজাতির উদ্ভবের গল্প বলবো এখানে।
আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এরিজোনা, নিউ মেক্সিকো এবং নেভাডা রাজ্যের শুষ্ক, বালুময় মরুভূমিতে গবেষকরা এক অদ্ভুত ধরণের সূর্যমুখী ফুলের প্রজাতি খুঁজে পান, নাম দেয়া হয় Helianthus anomalus । এই Helianthus anomalus প্রজাতি এমন এক পরিবেশে আকাশের উত্তপ্ত অগ্নীগোলকের দিকে তাকিয়ে আছে, যেখানে পানি এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণ অত্যন্ত কম। এমন কর্কশ পরিবেশে সূর্যমুখীর আর কোনো পরিচিত প্রজাতি টিকে থাকার কথা না। এই নতুন প্রজাতি কোথা থেকে এলো? কীভাবে এটি এমন নারকীয় পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারছে?
সূর্যমূখীর এ নতুন প্রজাতিটির জিনে অনুসন্ধান চালিয়ে চমকপ্রদ এক ফলাফল পাওয়া গেলো, এই Helianthus anomalus আসলে প্রচলিত কোনো প্রজাতি নয়। এটা ভিন্ন দুটি প্রজাতির সংকরায়নের ফল। Helianthus annuus (সাধারণ সূর্যমুখী) এবং Helianthus petiolaris (প্রেইরি সূর্যমুখী) নামক দুই সূর্যমুখীর প্রজাতির সংকরায়নের ফলে উদ্ভব ঘটে আমাদের এ নতুন সূর্যমুখী প্রজাতির। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সংকর প্রজাতিটি দুই প্যারেন্ট প্রজাতির সেরা বৈশিষ্ট্যগুলিকে ধারণ করেছে। এক প্যারেন্টের কাছ থেকে এটা খরা সহনশীলতা পেয়েছে, আর অন্যটির কাছ থেকে পুষ্টিহীন বালুময় মাটিতে টিকে থাকার ক্ষমতা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যেসব পরিবেশে এর প্যারেন্ট প্রজাতি দুটি (H. annus এবং H.petiolaris) কোনোটিই বেঁচে থাকতে পারতো না, সেখানে আমাদের এই নতুন প্রজাতিটি শুধু বেঁচে থাকেনি, বরং খুব আয়েশ করেই টিকে যাচ্ছে [২৬]। আরও গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেলো, এই দ্রুত বিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে ‘অ্যালোপলিপ্লয়ডি‘ (allopolyploidy) নামক একটি প্রক্রিয়া, যেখানে সংকরটি দুই প্যারেন্ট প্রজাতির পূর্ণ ক্রোমোজোম সেট উত্তরাধিকারসূত্রে পায়। এর ফলে দ্রুত নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে । এই অ্যালোপলিপ্লয়ডি কর্তৃক গমের বিবর্তন ত্বরান্বিত হওয়ার একটি নজির তথ্যসূত্র অংশে দিয়ে দিচ্ছি [২৭]।
ম্যাক্রো বিবর্তনে ‘লম্বা সময়ের প্রয়োজনের’ যে চিরাচারিত ধারণা, সেটাকে ভেঙে H. anomalus-এর আবির্ভাব দেখিয়ে দেয়, জিন প্রবাহ এবং সংকরায়ন কীভাবে জীবজগতে দ্রুত অভিযোজন ঘটিয়ে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাতে পারে। সামনে সংকর প্রজাতিকরণের আরও একটি উদাহরণ থেকে দেখবো।
৫. চোখের সামনে ঘটা বিবর্তন
এ অংশটা শুরু করার আগে কিছু ব্যাপার পরিষ্কার করে রাখা যাক। আমাদের এ প্রকৃতির কিছু বস্তুতা আছে, আমরা সরাসরি উপস্থিত হয়ে চাক্ষুষ অবলোকন করতে পারি না বা সম্ভবও না। যেমন পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলির যেমন সূর্যেকে কেন্দ্র করে সৌরজগতে ঘূর্ণায়মান রয়েছে; যা সরাসরি উপস্থিতি থেকে চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয় একটি নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হচ্ছে, আর সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা হাতে নিয়ে দেখা। কিংবা একজন ভূতত্ত্ববিদের পক্ষে সম্ভব না পৃথিবীর কেন্দ্রের গঠন দেখা আসা। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হওয়া সিসমিক ওয়েভ থেকে আমরা জানতে পারি ভূঅভ্যন্তরের গঠন সম্পর্কে। নিজ চোখে আমরা কেউ কোনোদিন দেখতে পারিনি, এমনকী, কোনো যন্ত্রও পাঠানো সম্ভব হয়নি। টেলিস্কোপে ব্ল্যাক হোল স্বচক্ষে দেখার প্রায় ১০০ বছর আগেই মানুষ কেবল অংক কষেই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে। অর্থাৎ, পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের সব বাস্তবতা এক রকম নয়; কোনোটা চাক্ষুষ দেখা যায়, কোনোটা চাক্ষুষ দেখা যায় না। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিভিন্ন মেথোডোলজি বা পদ্ধতি রয়েছে। বিজ্ঞানের তত্ত্ব গঠনের জন্য গবেষণা পদ্বতি কেবলমাত্র সরাসরি উপস্থিত উপস্থিত হয়ে বাস্তবতা পর্যবেক্ষণের’ ওপর নির্ভরশীল নয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিভিন্ন পদ্বতি রয়েছে। কোথাও ডিডাক্টিভ পদ্বতি অনুসরণ করা হয়, কোথায় ইনডাক্টিভ পদ্বতি। বিজ্ঞানে কোনো অপ্রমাণিত অনুমান বা অনুকল্পকে পরীক্ষণ-বিশ্লেষণ ছাড়া মেনে নেওয়া হয় না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবেও গ্রহন করা হয় না [২৮]। লক্ষ-কোটি বছর আগের বিবর্তন সামনে থেকে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করা যায়না বলেই বিবর্তন তত্ত্বের গবেষণায় মূলত ইন্ডাক্টিভ রিজনিং ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, পূর্বের অসংখ্য প্রমাণ সংগ্র করে সবকিছু যেদিকে নির্দেশ করে, তার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড় করানো হয় সিদ্ধান্ত।
তবুও, আমাদের নাকের ডগায়-ই এমন সব বিবর্তন ঘটে গেছে বা যাচ্ছে, যেগুলি প্রকৃতির এই অনিবার্য বাস্তবতাকে আমাদের সামনে আরও পরিস্কার করে দেয়। যেমন আছে মাইক্রো বিবর্তনের নজির, তেমনি আছে ম্যাক্রো বিবর্তনের নজির। ম্যাক্রো বিবর্তন সাধারণত দীর্ঘ সময় ব্যবধানে হয়ে থাকে। সেটা কয়েক হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ, এমনকী কয়েক কোটি বছর ধরে ঘটতে পারে। তাই মাইক্রো বিবর্তনকে জানতে, চিনতে এবং প্রমাণ জন্যে আমরা ফসিল রেকর্ড, জিনতত্ত্ব, এবং হোমোলোগাস প্রমাণের দ্বারস্থ হই। তবে, মাঝে মাঝে নানান প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কারণে কখনো কখনো ম্যাক্রো বিবর্তন খুব দ্রুত গতিতে ঘটতে পারে, বিশেষ করে যদি কোনো সংকটময় বা পরিবেশগত চাপ থাকে। স্পিসিয়েশন তথা প্রজাতির বিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রমাণ অসংখ্য। আজ অবধি ফসিল রেকর্ড, জেনেটিক্স, হোমোলজির ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে জানা গেছে। এ নিয়ে লিখতে শুরু করলে কয়েকশো ভলিউমের এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে যাবে। বিখ্যাত ফসিল টিকটালিকের সহ-আবিস্কারক জীবাশ্মবিদ ড. নিল শুবিন তাঁর ২০০৮ সালে প্রকাশিত Your Inner Fish: A Journey into the 3.5-Billion-Year History of the Human Body বইয়ে লিখেছেন,
“The evidence for evolution is so strong that one could spend a lifetime studying it without exhausting the supply. Fossils, genes, embryos, and anatomy all reveal evolutionary change in painstaking detail.”
তাই আমরা বিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া না লিখে নজর দিয়েছি স্পিসিয়েশনের প্রক্রিয়া এবং আনুসঙ্গিক মেকানিজমগুলোর সহজ ব্যখ্যায়। প্রবন্ধের একদম শেষে আমরা মানুষের স্পিসিয়েশনের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। কিন্তু, এ অংশে আমরা চারপাশে ঘটে চলা মাইক্রো এবং ম্যাক্রো বিবর্তনের নানান নজির; দিনদুপুরে আমাদের মধ্যেই ঘটে চলা ন্যাচারাল সিলেকশানের বেশ কিছু উদাহরণ পেশ করেছি। দেখাবো ল্যাবেও কীভাবে ঘটানো গেছে বিবর্তন। যদিও প্রজনন বিচ্ছিন্নতা ও জেনেটিক ড্রিফটের আলোচনায় আমরা সাম্প্রতিক কিছু বিবর্তনের আলোচনা করেছি, তাও এখানে এ আলোচনা আরও বিস্তারিত পরিসরে করা যাক। ম্যাক্রো তথা বৃহৎ বিবর্তনের উদাহরণে টানা হয়েছে কম সময়ে ঘটা বিবর্তনের উদাহরণগুলি।
৫.১ দ্যা ব্যাটেল অব ম্যালেরিয়াঃ ডিক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন বনাম মশা
এনোফিলিস নামক এক ধরণের মশার দেহে এক ধরণের প্রটোজোয়া পরজীবী বাস করে। সমস্যা হচ্ছে, এরা যখন আমাদের কামড় দেয়, আমরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। আবার আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে কামড়ানো মশারা যখন সুস্থ মানুষের দেহে কামড় দেয়, তখন সে সুস্থ মানুষটাও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় ৩০ থেকে ৫০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৭ থেকে ২৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাহলে এই ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তি পেতে সহজ উপায় কী হতে পারে? মশা নিধন, তাই তো?
কয়েক দশক আগে আমাদের উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে তাই-ই করা হয়েছিলো। ডিক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন বা সংক্ষেপে ডিডিটি (DDT) নামক কীটনাশকের মাধ্যমে ব্যাপক হারে মশা নিধন করা হয়েছিলো। মোটামুটি ৬০/৭০ এর দশকেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমিয়ে গড় আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটিতে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিলো। তাহলে এখন সে সংখ্যা ৩০-৫০ কোটি কেন? কীভাবে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আবারও এতো বাজেভাবে বেড়ে গেলো?
এখানে এই ডিডিটি আর মশার যুদ্ধে মশা ন্যাচারাল সিলেকশনের লটারী জিতে গিয়েছিলো। এ গল্পটা আরও ভালো করে বুঝতে চলুন আমরা ভারতের উদাহরণ দেখি। গত শতকের ৪০ এর দশকে মশাদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ভারতে ডিডিটির প্রয়োগে প্রায় এক যুগ ধরে ম্যালেরিয়া রোগের আক্রান্তের সংখ্যা নেমে আসে তলানীতে। বিপত্তিটা ঘটে সেই এক যুগ পর। হঠাৎ করেই দেখা যায় ডিডিটিকে আর পাত্তা দিচ্ছেনা মশারা। চোখের পলকে আকাশ-বাতাস ছেয়ে যাচ্ছে মশা। ১৯৫৯ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এই মশাদের থেকে একদল মশার আবির্ভাব ঘটেছে, যারা এই ডিডিটির প্রতি রেজিস্ট্যান্স। ব্যাপারটাকে একদম জিন পর্যায়ে কাটাকুটি করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা।
দেখা গেছে, বেশ কিছু মিউটেশনের ফলে এদের দেহে বিষমুক্তকরণ এনজাইমের (Detoxification Enzyme) পরিমাণ বাড়ার সাথে মোটামুটিভাবে দুই জায়গায় জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে।
- ডিডিটির কারণে এদের VGSC জিন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই জিনেই ঘটে যায় মিউটেশন। এই মিউটেশনের ফলে এদের লিউসিন নামক এমিনো এসিড, যেটি VGSC জিনের ১০১৪ তম পজিশনে(L1014F) থাকতো, সেটিকে phenylalanine নামক এমিনো এসিড প্রতিস্থাপন করে। এতে করে ডিডিটি-এর কার্যকারিতা কমে যায় একেবারেই [২৯]।
- Acetylcholinesterase-1 নামক জিনে আরেকটি মিউটেশন ঘটায় ACE-1 নামক এনজাইমের উৎপাদন বেড়ে যায় মশার দেহে। এই এনজাইমটি ডিডিটির প্রভাবকে ডিটক্সিফাই অর্থাৎ বিষমুক্ত করতে পারে [৩০]।
দেখা গেছে যে, রেন্ডমলি মিউটেশনের ফলে যেসব মশার দেহে এই পরিবর্তন গুলি এসেছে, তারাই ডিডিটি যুক্ত পরিবেশে বেঁচে গেছে। একই সাথে মরতে থাকে স্বাভাবিক, অপরিবর্তিত মশাগুলি। মিউটেটেড মশাগুলি সে পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করতে করতে একসময় তারাই হয়ে ওঠে মেজারোরিটি। এভাবে লম্বা সময় বাদে এমন মশা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটার ডিডিটি রেজিস্ট্যান্স নেই। এখানে মশারা মিউটেশনের ফলে প্রাপ্ত পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য নিয়ে সে পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং টিকে যায়। জিন তত্ত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা ডারউইন কেবল পর্যবেক্ষণ থেকে এই ন্যাচারাল সিলেকশানের ধারণা দিয়েছিলেন। যা আজ আমরা চোখের সামনে, হাতে কলমে, ল্যাবে ফেলে কাটা-ছেঁড়া করে প্রমাণ পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সামনে এগুতে এগুতে আমরা আরও উদাহরণ দেখবো চলুন।
৫.২ দ্যা ব্যাটেল অব ম্যালেরিয়া-২ঃ এনিমিয়া বনাম ম্যালেরিয়া
Sickle Cell Anemia নামক একটি জেনেটিক রোগ আছে। এই রোগটি মূলত হয় রক্তে একপ্রকার বিকৃত হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির কারণে। সুস্থ হিমোগ্লোবিন আর সিকেল সেল হিমোগ্লোবিনে তফাত হচ্ছে এদের বেটা চেইনে কেবল মাত্র একটা এমিনো এসিডের অমিল থাকার কারণে। সুস্থ হিমোগ্লোবিন চাকতির মতো দেখতে হলেও এই সিকেল সেল হিমোগ্লোবিনগুলো দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এই বিকৃত হিমোগ্লোবিনগুলো অক্সিজেন বহন করতে পারে না এবং রক্তস্বল্পতারও কারণ হয়।
আমরা জানি যে আমাদের প্রতিটি জিনের দুটি কপি আছে। একটা আসে বাবার থেকে, আরেকটা আসে মায়ের থেকে। যারা বাবা ও মা দুজনের থেকেই সিকেল সেল হিমোগ্লোবিনের জিন পায়, সে পূর্ণাঙ্গ রোগী। তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে খুবই ক্ষীণ। কিন্তু, যে বাবা মায়ের কেবল একজনের থেকে এই জিন পায়, সে এই এনিমিয়ার বাহক। যদিওবা এদের ভারী কাজ করা কষ্টকর হয়, তাও এরা ভালোভাবেই বেঁচে থাকতে পারে। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, আফ্রিকায় প্রতি ১০০ জনে ৩০ জনই এই বিকৃত হিমোগ্লোবিন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এবং প্রতিনিয়তই এ সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। কথা হচ্ছে, কোনো পপুলেশনে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বেড়ে চললে বুঝতে হবে হবে সে জিনটি কোনো সুবিধা দিচ্ছে।
কী সেই সুবিধা?
এই এক কপি সিকেল সেল হিমোগ্লোবিন জিন তাদের ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বিকৃত হিমোগ্লোবিনের জন্য ম্যালেরিয়ার পরজীবি টিকতে পারে না। আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া এক আতংকের নাম। প্রতিবছর পৃথিবীতে ম্যালেরিয়ায় যতোজন মানুষ মারা যায়, তার ৭৫%-ই আফ্রিকান বাসিন্দা। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেসব অঞ্চলেই আশ্চর্যজনকভাবে এই এনিমিয়ার রোগী দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একটা বিকৃত সিকেল সেল হিমোগ্লোবিন জিন নিয়ে সেখানকার মানুষ টিকে থাকে ঠিকই, কিন্তু রক্ষা পেয়ে যায় মরণব্যাধি ম্যালেরিয়া থেকে। এখানেই তারা পেয়ে গেছে ন্যাচারাল সিলেকশানের লটারি। ধীরে ধীরে এনিমিয়ার রোগী সেসব অঞ্চলে বাড়ার কারণ হচ্ছে, সেসব অঞ্চলে স্বাভাবিক মানুষেরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু, এক জিন বিশিষ্ট এনিমিয়ার রোগীরা বেঁচে যাচ্ছে। সেই পরিবেশে এনিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরাই প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত এবং সে অঞ্চলের যোগ্যতম সদস্য। স্বাভাবিক মানুষেরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই দিনকে দিন সেসব অঞ্চলে এনিমিয়ার রোগী বাড়ছে। এভাবে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অব্যাহত থাকলে হাজার হাজার বছর পর হয়তো আফ্রিকার সেসব অঞ্চলে স্বাভাবিক আর কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। সবাই এনিমিয়া রোগ বহন করে বেড়াবে [৩১]।
৫.৩ শিল্প বিপ্লব ও পেপারড মথ(Biston betularia)
পেপারড মথের গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। উনিশ শতক। আবিষ্কার হলো স্টিম ইঞ্জিন, শুরু হলো শিল্প বিপ্লপব। ইংরেজরা এই মানবজাতিকে এক লাফে কয়েকশো বছর এগিয়ে দিলো। বলা হতো, “ইংরেজ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না”। ১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে ১৮৪০ পর্যন্ত এক বিশাল সময়ে সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিলো ইংরেজরা। কিন্তু, এর ফলে শুধু সভ্যতারই মোড়ই ঘোরেনি, বিবর্তনের ছোট একটা গলিও ঘুরে গিয়েছিলো।
১৮১১ সালের আগে পৃথিবীর মানুষ পেপারড মথ নামক যে বিশেষ প্রকার মথ কে চিনতো, তারা দেখতে ছিল সাদা রঙের। মথ হচ্ছে প্রজাপতির মতোই দেখতে একপ্রকার পতঙ্গ। কেবল মাথায় ছোট এন্টেনা। প্রজাপতির বড় এন্টেনা থাকে। তো হলো কী, কখনো মানুষ কালো বা অন্যান্য রঙের পেপারড মথ দেখেনি। থাকলেও মাঝে মাঝে রেন্ডম মিউটেশনে টুকটাক কিছু হয়তো জন্মাতো, সেটাও খুবই রেয়ার। অস্বাভাবিকভাবে কালো রঙ নিয়ে জন্মানো মথরা নিজের মিউটেশনকে পরবর্তী প্রজন্মে তেমন আকারে পাস করতে পারতোনা। কারণ, সাধারণত শিল্প বিপ্লবের আগে সে অঞ্চলে অধিকাংশ গাছ গাছালির বাকলই ছিলো উজ্জ্বল বর্ণের। উদ্ভিদের কাণ্ড বা মূলের বাহিরের অংশকে বাকল বা গাছের ছাল বলা হয়। ফলে শিকারী পাখি বা প্রকৃতির অন্যান্য প্রিডেটরদের চোখে পড়ে যেতো উজ্জ্বল গাছে, পাতায় হেঁটে বেড়ানো কালো মথদের।
১৮৪৮ সালে পোকামাকড় নিয়ে গবেষণা করা RS Edleston নামক এক প্রকৃতিবিদ তাঁর জার্নালে লিখেন, “আজকে পুরোপুরি কালো বর্ণের একটা মথ ধরতে পারলাম মেনচেস্টারের কেন্দ্রে” [৩২]।
হঠাৎ এই কালো মথ দেখা অবধিও সমস্যা নেই। প্রায়ই আমরা পরিচিত প্রাণিদের বিরল রঙ নিয়ে জন্মাতে দেখি। তাই, টুকটাক কোনো মিউটেশনে কিছু কালো বর্ণের মথ দেখা অসম্ভব কিছু না। গল্পটা অন্যদিকে মোড় নিলো সে শতকের শেষদিকে। ১৮৮৫ সালের দিকে মানুষ দেখলো সামনে যতো মথ আসে, সব কালো বর্ণের। সাদা মথ আর কারোর চোখে পড়ে না। ব্যাপারটা নিয়ে গবেষকরা উঠে পড়ে লাগলো। এ ব্যাপারে ডারউইনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ কীটতত্ত্ববিদ জেমস উইলিয়াম টাট জানান যে, এ ব্যাপারটা ঘটেছে ন্যাচারাল সিলেকশান বা প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা আসে আরও পরে। এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ প্রথম গবেষণা করেন জেনেটিসিস্ট বারনার্ড ক্যাটেলওয়েল। পরবর্তীতে এরচেয়েও বিস্তারিত গবেষণা করেন ক্যাম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট মাইকেল ম্যাজেরাস। এই দীর্ঘ ৭ বছরের পূর্ণ গবেষণার ফলাফল নিয়ে ২০১২ সালে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল সোসাইটির পিয়ার রিভিউড জারররনাল, বায়লোজি লেটার্সে প্রকাশিত হয় Selective bird predation on the peppered moth: the last experiment of Michael Majerus শিরোনামে গবেষণা প্রবন্ধ [৩৩]।
আমরা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করবো যে কেন ১৮৮৫ সালের পর সব পেপারড মথ পুরোপুরি কালো বর্ণের হওয়া শুরু করেছিল এবং কেনই বা সে যাত্রায় বিবর্তন তাদের বিলুপ্তি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। ম্যানচেস্টার ছিলো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শিল্পোন্নত শহরগুলোর একটা। শিল্পবিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বে কয়লার ব্যাবহার বেড়ে যায়।এই কয়লার ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃস্বরণ ঘটতে শুরু করে। এই কয়লা থেকে আসা কার্বনের ফলে গাছ-পালা আর বিভিন্ন স্থাপনার গায়ে ধোঁয়া, কার্বন লেগে তাদের রঙ অনুজ্জ্বল হয়ে গেলো। অনেক গাছের বাকলও কালচে বর্ণ ধারণ করতে থাকে। এতে সমস্যা হয়ে গেলো সে সময়ের সাদা বর্ণের পেপার্ড মথদের। এই কালচে বর্ণের উদ্ভিদে হেঁটে বেড়ানো পেপারড মথেরা সহজেই নজর কাড়তো শিকারী পাখিদের। তাই সে পরিবেশে রেন্ডম মিউটেশনের ফলে কালো পিগমেন্ট নিয়ে জন্মানো একটা-দুটো বিরল পেপারড মথই টিকে থাকার জন্য সুযোগ সুবিধা পেয়ে গেলো, যেটা আগে পেতো না। এভাবে এরা বাঁচতে পারছে, বংশবৃদ্ধি করতে পারছে, কিন্তু সাদারা শিকারীদের খপ্পড়ে পড়ছে। এভাবে সাদাদের সংখ্যা কমতে কমতে একসময় তলানীতে যায় এবং কালো বর্ণের পেপারড মথে চারপাশ ছেয়ে যায়। তারপর সে অঞ্চলে, সে শতকে সাদা মথদের আর দেখতে পাওয়া যায়নি। শিল্পোন্নয়নের কারণে কোনো প্রজাতিতে গাঢ় পিগমেন্টের আধিক্য হওয়ার এই ঘটনাকে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যালানিজম। এটা হয় ডারউইনের বাতলে যাওয়া সেই ন্যাচারাল সিলেকশনের কারণে।
পপুলেশন জেনেটিক্সের অন্যতম প্রবক্তা সিওয়াল রাইট ১৯৭৮ সালে বলেন, “এটা (মিরাকল অফ মথ) প্রথম ঘটনা, যেখানে বিবর্তন সুস্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে” [৩৪]। আচ্ছা, এই ঘটনায় কোন ধরনের ফিনোটাইপটা সিলেক্টেড হয়েছে? শুধু গাঢ় ধরনের। মানে, একটা নির্দিষ্ট ফিনোটাইপ এর সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছে। এই ধরনের ন্যাচারাল সিলেকশনকে আমরা বলি “ডায়রেকশনাল”।
বিজ্ঞানীরা এদের জিনোমে চিরুনী অভিযান চালিয়েছেন, দেখার জন্য যে, কেন তাদের এই ম্যালানাইজেশন ঘটে। এ গবেষণা ২০১৬ সালে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল, ন্যাচারে The industrial melanism mutation in British peppered moths is a transposable element শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তাদের গবেষণায় উঠে আসে, মথদের এই কালো হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী “carb-TE” নামক একটি ট্রান্সপোজেবল এলিমেন্ট। এটি তাঁরা খুঁজে পান কর্টেক্স জিনের কাছেই। এটি একটি ২১,৯২৫ বেস পেয়ার বিশিষ্ট অংশ। এটা এক প্রকারের ট্রান্সপোজেবল এলিমেন্ট কারণ এই “carb-TE” সেকশানটি জিনোমের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে পারে। দেখা গেছে, যখনই জিনোমের এ অংশটি সক্রিয় হয়, তখনই পেপারড মাথের কালো রঙের এক্সপ্রেশন ঘটে [৩৫]।
সাম্প্রতিক সময়ে দূষণ কমায় আবারও অল্প হলেও সাদা পেপারড মথ চোখে পড়তে শুরু করেছে। এই ঘটনাটা আমাদের দেখায় যে কীভাবে পরিবেশগত পরিবর্তন দ্রুত একটি পপুলেশনে অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সিকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রপরিবেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুযায়ী একেকটা মিউটেশনের ফলাফল একেকভাবে কাজে লাগে। সে অনুযায়ী পাল্টে যায় সে প্রজাতির অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি। ন্যাচারাল সিলেকশান হচ্ছে বিবর্তনের একেকটা বিল্ডিং ব্লক। এভাবে অনবরত কোনো প্রজাতি নানানভাবে ন্যাচারাল সিলেকশানের মাধ্যমে নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলে একসময় পাল্টে যায় তাদের প্রজাতি। পৃথিবীর জীবনের এই বিরাট যাত্রার গল্পে স্পিসিয়েশনের অসংখ্য গল্প থাকলেও সামনে আমরা আরও সেরকম কিছু গল্প দেখাবো, যেগুলি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে হাতে-নাতে বিবর্তনকে দেখিয়েছে। এর আগে ন্যাচারাল সিলেকশানের আরও এক দুটো চাক্ষুষ উদাহরণ দেখে নিই। আশা রাখি, বিরক্ত হচ্ছেন না।
৫.৪ মাছের আকার কমে যাওয়া
বিশ্বজুড়ে মাছের পপুলেশনের আকার ছোট হয়ে আসা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমবর্ধমান। সমস্যাটা বেশ জটিল, যেহেতু অনেক দেশের মৎস্য আইন মাছের জনসংখ্যা রক্ষার জন্য জেলেদেরকে ছোট মাছ জালে উঠলে সেটাকে জলাশয়ে ফিরিয়ে দিতে এক প্রকার বাধ্য করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছ ধরা নিষেধ বাংলাদেশেও। এই আইনের পেছনে যুক্তি হলো, কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতির স্বাভাবিক আকারের চেয়ে ছোট আকৃতির মাছ সাধারণত অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছ, যাদের প্রজনন করার সুযোগ হয়নি। যদি তাদের পানিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তারা প্রজননক্ষম হয়ে তাদের প্রজাতির পরবর্তী প্রজন্মের অবদান রাখতে পারে।
সমস্যা হচ্ছে, এই পদ্ধতি প্রথম বেশ ভালো কাজ করলেও, একসময় এটা আমাদের অজান্তেই মাছের দীর্ঘমেয়াদী এক বিবর্তনীয় পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। একসময় বিশ্বজুড়েই রিপোর্ট আসতে থাকে যে অনেক প্রজাতির মাছ প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও ছোট রয়ে গেছে! মানে মাছ প্রাপ্ত বয়স্ক হচ্ছে, হয়েছে—কিন্তু আকৃতিতে ছোটই রয়ে গেছে। আগে এমনটা হতো না। সমস্যা হচ্ছে, দিনকে দিন ছোট হয়েই যাচ্ছে।
সাধারণত অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছেরাই আকার আকৃতিতে ছোট হয়। কিন্তু, বেশ বিরল হলেও প্রাপ্তবয়স্ক মাছও খর্বাকৃতির হতে পারে। এবং এই আকৃতি খর্ব হওয়ার জিন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে প্রায়ই টুকটাক খর্বাকৃতির এডাল্ট মাছ দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না। যেমন আমাদের মানুষদের মধ্যেও অস্বাভাবিকভাবে ছোট মানুষ প্রায়ই দেখা মেলে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এভাবে এডাল্ট মাছদের আকৃতি ছোট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
ড. ডেভিড ও’কোনোভারের গবেষণা:
যাদের এ ব্যাপারে গবেষণাখানি পড়ার ইচ্ছে বা শক্তি আছে, কেবল তাঁরাই এ অংশটা পড়তে পারেন। নাহয় পরবর্তী অংশে সহজ ব্যখ্যায় চলে যেতে পারেন।
কীভাবে মাছেরা নিজেদের আকৃতি কমিয়ে ফেলেছে, এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে বিখ্যাত ম্যারিন বায়োলজিস্ট David O. Conover এবং তাঁর সহযোগী Stephane B. Munch গবেষণায় নেমে পড়লেন। ড. ডেভিড ও’কোনোভারের প্রাথমিক ধারণা ছিলো, বড় মাছগুলোকে যখন ধরা হয় এবং ছোট মাছগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন ভবিষ্যতের প্রজন্মে ছোট মাছের বৈশিষ্ট্য বেশি পরিমাণে ট্রান্সফার হয়। কারণ, বড় মাছেরা প্রজনন করার আগেই অতিরিক্ত মৎসচাষের বলি হয়ে জালে ধরা পড়ে। প্রজননের হারের চেয়ে মাছ ধরার পরিমাণ বেশি হওয়ায় বড় আকৃতির এডাল্ট মাছেরা কমে যাচ্ছিলো। তাই মাছদের টিকে থাকার স্বার্থে, এই মাছ ধরার পদ্ধতিটা সময়ের সাথে সাথে, মাছদের আকার ছোট হয়ে যাওয়ার দিকে পরিচালিত করেছে।
এই অনুকল্প যাচাই করার জন্য, ডঃ ডেভিড ও’কোনোভার এবং তার দল আটলান্টিক সিলভারসাইডস নামক এক প্রজাতির মাছ নিয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত গবেষণা পরিচালনা করেন। এ প্রজাতিটি উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক উপকূলে সাধারণত পাওয়া যায়। এ পরীক্ষায় তারা তিনটি একুরিয়াম নেন। তিনটা একুরিয়ামেই সমান সংখ্যক মাছ(১ হাজার) নেন একই প্রজাতির। তারপর এই তিনটা একুরিয়ামকে ৩ গ্রুপে বিভক্ত করেন তাঁরা। প্রতিটাতেই একই রকম খাবার, একই রকম পরিবেশ নিশ্চিত করেন। এবং এদেরকে পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মতোও পর্যাপ্ত সময় দেন। কিন্তু, এদের প্রজনন শুরুর পূর্বে এই ৩ টা গ্রুপে ৩ টা ভিন্ন ভিন্ন কাজ করা হয়ঃ
১. প্রথম গ্রুপে বড় মাছগুলো প্রজননের আগে সরিয়ে নেওয়া হয় একুরিয়াম থেকে।
২. দ্বিতীয় গ্রুপে (নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ) মাছগুলো এলোমেলোভাবে সরানো হয়। মানে বড়-ছোট মিলিয়েই এলোপাতাড়িভাবে মাছ সরানো হয় একুরিয়াম থেকে।
৩. তৃতীয় গ্রুপে কেবল ছোট মাছগুলো সরিয়ে নেওয়া হয় প্রজননের পূর্বে।
মাছগুলো প্রতিবার প্রজনন করার পর সে একুরিয়ামগুলোতে একই কাজ করা হতে থাকে। এভাবে চার প্রজন্ম পর ড. ডেভিড ও’কোনোভার এবং তাঁর দল এক অদ্ভুতুড়ে ফলাফল প্রত্যক্ষ করেন। তাঁরা দেখতে পান যে এই আটলান্টিক সিলভারসাইডস মাছের প্রজাতিটা প্রথম গ্রুপে(যেখানে ধারাবাহিকভাবে প্রজননের পূর্বেই বড় মাছগুলো সরানো হচ্ছিলো) এডাল্ট অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও আকৃতিতে অনেক ছোট রয়ে যায়। কতোটুকু ছোট?
মনে আছে, তৃতীয় গ্রুপটায় তাঁরা কেবল ছোট মাছ গুলি সরিয়ে নিচ্ছিলো? হ্যাঁ, সেই তৃতীয় গ্রুপের চেয়ে প্রথম গ্রুপের এডাল্ট মাছগুলি আকৃতিতে গড়ে অর্ধেক হয়ে যায়!
প্রাপ্তবয়স্ক মাছদের ছোট হয়ে যাওয়ার কারণঃ
এ অংশটা তাদের জন্যেই, যারা উপরে এতোক্ষণ ডেভিড ও’কোনোভারের একাডেমিক, কাঠখোট্টা এক্সপেরিমেন্ট টা কোনদিকে আমাদের নির্দেশ করেছে তা বুঝেন নি। আমাদের এই প্রথম একুরিয়ামটা হচ্ছে পৃথিবীর জলাশয় সমূহ। যেখানে জেলেরা কেবল বড় মাছগুলিকেই ধরতো। ছোট মাছ ছেড়ে দিতো। এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে কয়েক জেনারেশন পর মাছেরা নিজেদের সারভাইভালের স্বার্থে আকৃতিতে ছোট হয়ে যায় স্থায়ীভাবে। এতে তাদের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতেও এটা এস্টাব্লিশড হয়ে যায়। কীভাবে ছোট হয়? বলেছিলাম না? এডাল্ট মাছও আকারে ছোট হতে পারে। তবে রেয়ার। একুরিয়ামের মাছগুলিকে সরানো হয়েছিলো এডাল্ট হওয়ার পর। এর মানে সেখানে বড় এডাল্ট মাছের পাশাপাশি টুকটাক ছোট এডাল্ট মাছও ছিলো। বড় মাছগুলিকে তাই সরিয়ে ফেলার পর ছোট আকৃতির এডাল্ট মাছগুলিই তাদের বেঁটে হওয়ার জিন ট্রান্সপার করেছে নেক্সট জেনারেশনে। এভাবে একসময় সে ট্যাংকের পুরো পপুলেশনেই সব বেঁটে এডাল্ট মাছ পাওয়া যায়।
বাস্তবেও অনেকটাই তাই-ই ঘটে। জেলেরা বড় মাছ ধরলো। ছোট মাছ ছেড়ে দিলো। ছোটমাছগুলির কেউ কেউ “বাচ্চা” মাছ ছিলো না। এরা এডাল্ট বেঁটে মাছ ছিলো। আকার ছোট থাকায় এডাল্ট মাছ হওয়া সত্ত্বেও জেলেরা বাচ্চা মাছের সাথে সাথে এই বেঁটে দেরও ফেলে দিয়েছে পানিতে। এরা আরামসে পানিতে ঘুরে বেড়ালো আর প্রজনন করলো, তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলিও তাদের মতই বেঁটে হলো, এবং জেলেদের রাডার থেকে দূরে রইলো। আর বড় আকৃতির মাছগুলি প্রতিবারই জালে আটকা পড়লো। বাজারে চড়াদামে বিক্রিও হলো।
একসময় আকারে বড় হওয়া মাছের চেয়ে এডাল্ট হওয়ার পরও বেঁটে মাছের পরিমাণ বেড়ে গেলো। এভাবে কোনো কোনো মাছের পুরো প্রজাতির অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিও পাল্টে যেতে পারে। যা পরবর্তীতে সে প্রজাতির আকার আকৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আনতে পারে। যারা অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি কী তা এতক্ষণে ভুলে গেছেন, তারা উপরে আরেকটু পড়ে আসুন। এবার আশা করি পরিস্কার হয়েছে।
চোখের সামনেই দেখে ফেললাম কীভাবে মাছেরা নিজেদের আকৃতি কমিয়ে নিয়েছে নিজেদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। ডঃ ডেভিড ও’কোনোভারের এ গবেষণাটা Sustaining Fisheries Yields Over Evolutionary Time Scales শিরোনামে প্রকাশিত হয় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জার্নাল, সায়েন্স জার্নালে। তথ্যসূত্র অংশে দিয়ে দিচ্ছি। পড়ে দেখতে পারেন [৩৬]।
৫.৫ প্রারম্ভিক প্রজাতিকরণঃ আপেল ম্যাগট মাছি
ম্যাক্রো বিবর্তনের উদাহরণে ঢোকার পূর্বে প্রারম্ভিক প্রজাতিকরণ (incipient speciation)-এর একটি উদাহরণ দেখে নিই আমরা। এক্ষেত্রে, আপেল ম্যাগট মাছি(Rhagoletis pomonella) চমৎকার, নীবিরভাবে পর্যবেক্ষণকৃত একটি উদাহরণ। একই সাথে এটা সিম্প্যাট্রিক স্পিসিয়েশনেরও একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। সহজভাবে বললে, প্রারম্ভিক প্রজাতিকরণ বলতে আমরা বুঝি, যে দশায় একটি প্রজাতির দুটি জনগোষ্ঠী আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। পোষক পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বাস্তুসংস্থানিক চাপ এবং আচরণগত ও জেনেটিক পরিবর্তনগুলো স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, তারা একসময় সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে [৩৭]।
এই আপেল ম্যাগট মাছি মূলত উত্তর আমেরিকায় উদ্ভুত একটি প্রজাতি। এটা সাধারণত হথর্ন গাছের (Crataegus species) ফলকে আক্রান্ত করতো। কিন্তু উনিশ শতকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা যখন আপেল গাছের (Malus domestica) চাষ শুরু করে, তখন একটা বিস্ময়কর বিবর্তনমূলক পরিবর্তন ঘটে এদের মধ্যে। এ বিবর্তনীয় পরিবর্তনসমূহ দেখে নেয়া যাক চলুনঃ
১. পোষক পরিবর্তন এবং বাস্তুসংস্থানিক প্রজাতিকরণঃ আগেই বলেছি আমরা, ইউরোপীয় কলোনাইজাররা আপেল গাছ চাষের পূর্বে এই মাছিরা কেবলমাত্র হথর্ন ফলেই ডিম পাড়ত। কিন্তু আপেল গাছ আসার পরে এদের পপুলেশনের একাংশ তাদের ডিম হথর্নের পরিবর্তে আপেলের উপর পাড়া শুরু করে। একে আমরা বলতে পারি ‘হোস্ট শিফট’ বা বাংলায় পোষক পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে, আপেলের উপর ডিম পাড়া মাছিগুলি হথর্নের উপর ডিম পাড়া মাছি থেকে আলাদা হতে শুরু করে, কারণ আপেল হথর্নের আগে পেকে যায়। এই পেকে যাওয়ার সময়ের পার্থক্য এদের দুটি পপুলেশনকে আলাদা সময়ে প্রজনন করতে বাধ্য করে বলা যায়। যার ফলে তাদের মধ্যে এক বিশেষ প্রকার প্রজনন বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়। এটাকে বলা হয় সময়ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতা (temporal isolation)।
২. জেনেটিক পার্থক্যঃ আপেল ম্যাগট মাছিদের আলাদা হয়ে যাওয়া এ দুটি পপুলেশনের ডিএনএ সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এদের ঘ্রাণ সংবেদী (olfactory) সিস্টেমে প্রভাব ফেলা জিন ও বিকাশকালীন সময়ের (developmental timing) সাথে সম্পর্কিত জিনগুলি আলাদাভাবে বিবর্তিত হচ্ছে। ঘ্রাণ সংবেদী সিস্টেমের জন্য দায়ী জিন গুলি আলাদাভাবে বিবর্তিত হচ্ছে কারণ, দুটি পপুলেশন দুটি আলাদা ফলের গন্ধের প্রতি সাড়া দিয়ে সঠিক হোস্ট বা পোষক খুঁজে বের করে। অন্যদিকে আপেল খাওয়া মাছিরা দ্রুত বড় হয়, কারণ আপেল তুলনামূলকভাবে আগেই পাকে। অন্যদিকে হথর্ন খাওয়া মাছিরা ধীরে বিকশিত হয়, হথর্ন ফলের ধীর পাকানোর সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে। এই জীবনচক্রের ভিন্নতা তৈরি হওয়ার কারণে এদের ডেভেলপমেন্টাল টাইমিং বা বিকাশকালীন সময়ের সাথে সম্পর্কিত জিনগুলি আলাদাভাবে বিবর্তিত হওয়ার কারণ হচ্ছে। যা পরবর্তীতে এক বড়সড় বিবর্তনীয় পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করতে পারে এদের [৩৮]।
৩. প্রজনন সঙ্গী নির্বাচনঃ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, আপেল-ভিত্তিক এবং হথর্ন-ভিত্তিক মাছিগুলি তাদের নিজ নিজ পোষক প্রজাতির মাছিদের সাথেই মিলিত হতে পছন্দ করে। এর ফলে দুটি পপুলেশনের মধ্যে জিন প্রবাহ (gene flow) কমে যায়, যেটা প্রজাতিকরণের প্রক্রিয়াকে আরো দ্রুত করে দেয়। বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, এই প্রক্রিয়াটি আসোর্টেটিভ মেটিং (assortative mating) নামে পরিচিত, যেখানে কোনো পপুলেশনের সদস্যরা নিজেদের ধরণের সঙ্গীর সাথে মিলন করতে পছন্দ করে।
৫.৬ পলিপ্লয়েডের মাধ্যমে চোখের সামনে প্রজাতির পরিবর্তন
আমরা জানি যে, সাধারণত ম্যাক্রো বিবর্তন বেশ লম্বা সময় নেয়। কারণ, আমাদের চোখের সামনে প্রাকৃতিকভাবে এলোপাতাড়িভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হতে লম্বা সময়ের প্রয়োজন হয়। সেজন্যে আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় ডিএনএ-র অভ্যন্তরে থাকা জিনের কাছে, দেখতে হয় কীসব ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে যা বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে। কিংবা কখনো ফসিল দেখে আমরা বিবর্তনের বাস্তবতা উদ্ধার করি। কিন্তু, গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা উদ্ভিদের বেশ কিছু বিবর্তন চোখের সামনেই পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি। চোখের সামনেই বিবর্তনের জাদুতে পুরোপুরি আলাদা প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়ে যেতে দেখেছি বিভিন্ন উদ্ভিদকে।
এর মধ্যে ট্র্যাগাপোগন নামক একটি মুলার মতো উদ্ভিদের গল্প বলবো আজকে। গত শতকের ১৯১০ এর পূর্বে কখনো উত্তর আমেরিকায় এ উদ্ভিদের কোনো প্রজাতি ছিলো না। ১৯১০ থেকে ১৯৩০ এর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন আর আইডাহো রাজ্যে এই ট্র্যাগাপোগনের তিনটি প্রজাতি—Tragopogon dubius, Tragopogon pratensis এবং Tragopogon porrifolius এর চাষ করা হয়। তারপর মাত্র ২০/৩০ বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেলো এক বিস্ময়কর ঘটনা!
৫০ এর দশকে বোটানিস্টরা লক্ষ্য করলেন, সে মাঠে ইউরোপ থেকে আনা তিনটি প্রজাতি ছাড়াও আরও দুটি পুরোপুরি নতুন প্রজাতির ট্র্যাগাপোগন উদ্ভিদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে [৩৯]। যেখানে ঐ গোটা মহাদেশেই এই উদ্ভিদ ছিলো না, সেখানে কেবল এক মোটামুটি এক/দেড় দশকেই ভোজবাজির মতো এ দুটো নতুন প্রজাতির কীভাবে উদয় হলো, এমনকী এরা বাকি ৩ টি প্রজাতির কারোর সাথেই প্রজননক্ষম না— তা জানতে গবেষকরা নেমে পড়লেন।
বিজ্ঞানীরা খুব বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, এখানে মাত্র এক দশকের একটু বেশি সময়ের মাঝেই একটা ম্যাক্রো বিবর্তন ঘটে গেলো। জিনে খোঁজ চালিয়ে দেখা গেলো আমাদের নতুন সে দুটি প্রজাতি, Tragopogon mirus এবং Tragopogon miscellus আসলে পূর্বের ৩ টি প্রজাতি থেকে এসেছে পলিপ্লয়ড সংকরায়ণের মাধ্যমে। নতুন তৈরি হওয়া দুটি প্রজাতি:
- Tragopogon mirus – T. dubius ও T. porrifolius এর পলিপ্লয়ড সংকরায়নে তৈরি
- Tragopogon miscellus – T. dubius ও T. pratensis এর পলিপ্লয়ড সংকরায়নে তৈরি
পলিপ্লয়ড সংকরায়নে আসলে হয়টা কী বলি, সাধারণত সন্তানেরা তাদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের মা-বাবার প্রত্যেকের থেকে একটা করে ক্রমোজোম পায়। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার দুই বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. ডগলাস সল্টিস এবং ড. পামেলা সল্টিস বিস্তারিত গবেষণা করে দেখেন যে মিউটেশনে ফলে নতুন প্রজাতি দুটোর মধ্যে তাদের দুজিনের প্যারেন্ট স্পিসিজ থেকে এক সেটের বলে দুই সেট করে ক্রোমোজম এসেছে। এর ফলে এরা নিজেদের মধ্যে প্রজননক্ষম হলেও তাদের বাবা মা প্রজাতি অর্থাৎ T. dubius, T. porrifolius এবং T. paretensis তিনটি প্রজাতির সাথে প্রজনন করতে পাছে না।
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের চোখের সামনেই এখানে মিউটেশনের ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ নতুন দুটি প্রজাতির উদ্ভব হলো [৪০]। একই ভাবে আজকের দিনে আমরা ল্যাবে বসেই কৃত্রিমভাবে পলিপ্লয়েড সংকরায়ন সহ অন্যান্য সংকরায়নের সাহায্যে বিভিন্ন নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাতে পারছি।
৫.৭ হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির বিবর্তনের গল্প: সংকরায়ন জন্ম দেয় নতুন প্রজাতির
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার কোস্টারিকার সবুজ সজীব বনাঞ্চল। এসব ট্রপিকাল বনাঞ্চলে জীবনের রঙ ছড়িয়ে পড়ে নানান রূপে। আমাদের অলক্ষেই সেখানে এক বিস্ময়কর বিবর্তনীয় ঘটনা ঘটে গেলো। সংকরায়ণ দ্বারা একটা নতুন হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটলো। আমাদের এ হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির গল্পটা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় যে বিবর্তন সবসময় ধীরে ধীরে ঘটে না—এটা অনেক সময় সৃজনীর বিস্ফোরণে সংকরায়নের মাধ্যমে তৈরি করে ফেলে নতুন ধরণের জীবন। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিস্ট নিল রসারের ভাষ্যে, “হাইব্রিডাইজেশনকে একসময় বিরল বা গুরুত্বহীন বলে মনে করা হতো, তবে সাম্প্রতিক জিনোমিক গবেষণাগুলি দেখায় যে এটি প্রজাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।” [৪১]
তো যেখানে ছিলাম, এই বিবর্তনীয় পাঁচালীর মূল চরিত্র দুটি প্রজাতির প্রজাপতি—হেলিকোনিয়াস মেলপোমেনি(Heliconius melpomene) এবং হেলিকোনিয়াস সিডনো(Heliconius cydno)। হেলিকোনিয়াস মেলপোমেনির ডানা কালো, উজ্জ্বল লাল রেখায় সজ্জিত। আর হেলিকোনিয়াস সিডনোর ডানা হালকা রঙের, উজ্জ্বল সাদা চিহ্নযুক্ত। যদিও এরা আলাদা প্রজাতির, তাদের বসবাসের এলাকা একই জায়গায় হওয়ায় এদের মধ্যে প্রায়ই আন্তঃপ্রজনন করে হাইব্রিড সন্তান জন্ম দেয়। সধারণত ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সংকরায়ণ বন্ধ্যা বা বেঁচে থাকার অযোগ্য সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেলো—এই হাইব্রিড প্রজাপতিরা শুধু উর্বরই হয়নি, বরং তারা তাদের পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে মিশ্র ডানার নকশা পেয়ে গেলো।
এই সংকরায়িত নতুন প্রজাপতির ডানায় কালো-লাল এবং সাদা চিহ্ন দেখা যায়, যা তাদের একটি নতুন বিবর্তনীয় সুবিধা দেয়। দেখা গেলো এরা এই রঙ নিয়ে সেসব ট্রপিকাল জঙ্গলে তাদের প্যারেন্টদের থেকে আরও ভালোভাবে টিকে থাকতে পারছে। প্রথম নজরে এই রঙিন ডানাগুলির নকশা কেবল সজ্জা মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের এই নতুন, মিশ্র ডানার নকশা সেই পরিবেশে শিকারীরা চিনতে পারে না। এতে করে ন্যাচারাল সিলেকশানের লটারি জিতে যায়। সময়ের সাথে সাথে এরা নিজেরা নিজেরা প্রজনন করা, প্যারেন্ট প্রজাতির সাথে প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া, নিজেদের ভিন্ন নিচেস তৈরি—ইত্যাদি করার মাধ্যমে তাদের প্যারেন্টস প্রজাতি থেকে জেনেটিক্যালিও খুব কম সময়েই আলাদা হয়ে যায়। আবির্ভাব ঘটে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রজাতির, হেলিকোনিয়াস হিউরিপা (Heliconius heurippa) [৪২]।
হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির এই গল্পটা আপনাদের বললাম, কারণ এটা আমাদের বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কী সেটা বলি, ম্যাক্রোইভলিউশন—যার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে—অনেক সময় ভাবা হয় ধীরে ধীরে ঘটে, কিন্তু হেলিকোনিয়াস প্রজাপতিরা আমাদের অবাক করিয়ে দিয়ে দেখালো যে সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি খুব দ্রুতও হতে পারে। বিবর্তনীয় টাইম ফ্রেমে, খুব ক্ষুদ্র সময়ে এই হাইব্রিডরা প্রজননগত ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, তাদের নিজস্ব ইউনিক ডানার নকশা ডেভেলপ করে ফেললো এবং তাদের নিজস্ব বাস্তুতান্ত্রিক নিচেস-য়েও বসবাস করা শুরু করে দিলো। ক্ষুদ্র সময়েই বিবর্তিত হয়ে গেলো নতুন প্রজাতিতে।
৫.৮ আমাদেরই বানানো প্রজাতি
বিবর্তন যে আদতেই ঘটে, এবং সেটা প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছেতেও যে ঘটে, সেটা অনেকেরই জানা নেই। বিভিন্ন জাতের ধান, গম, ভুট্টা আজকে যে রূপে আমরা দেখতে পাই তা মোটেও এমন ছিলো না। কয়েক হাজার বছর আগেও এগুলো সাধারণ ঘাস ছিল (যেমন ভুট্টা এসেছে teosinte নামক এক প্রকার বুনো ঘাস থেকে)। হাজার হাজার বছর আগে আমরাই নিজেদের সুবিধার্থে নানান ভাবে সংকরায়ন ও সিলেক্টিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে উন্নত সব ধান, ঘম, ভুট্টা সহ অনেক ফসল সবজি গাছের প্রজাতির উদ্ভব ঘটিয়েছি। বড় পাতা, মোটা ডাটা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে মানুষেরই করা কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে হাজার বছর আগের Brassica oleracea নামক একপ্রকার বুনো বাঁধাকপি থেকে আজকের দিনে আমরা পেয়েছি ব্রকুলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পাতাকপি(Kale) ইত্যাদি। আমাদের বাগানে যেসব ডালিয়া, আইরিস, টিউলিপ ইত্যাদি ফুল দেখি—সেসবের অনেক কিছুই আজকের বর্তমান রূপে ছিলোই না। বুনো ফুলদেরই নানান রকমের সিলেক্টিভ ব্রিডিং, আর্টিফিশিয়াল সিলেকশান, সংকরায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা অনেক অনেক ফুল আনতে পেরেছি। সিলেক্টিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমেই প্রাচীন কাল ধরে গৃহপালিত নেকড়েদের থেকে আমরা একটি উপ-প্রজাতির উদ্ভব ঘটিয়েছি, যারা আজকের দিনে আমাদেরই পরম বন্ধু, Canis lupus familiaris, অর্থাৎ কুকুর। চোখের সামনেই মানুষ নিজের অজান্তেই বিবর্তন দেখেছে অনেকবার।
বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এখন আমরা ল্যাবেই কতো কতো উন্নত প্রজাতির ফসল উদ্ভাবন করতে পারছি। শুধু কি ফসল? গোটা বহুকোষী পোকামাকড়ও বানানো সম্ভব হয়েছে। তারওপর এখন এসেছে CRISPR জিন প্রযুক্তি। আমরা নিজেরাই এখন জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবদেহে আকাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে পারবো এমনকী, নতুন প্রজাতিও আনতে পারবো। এইতো ২০২১ সালেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু রোগ বহন করা এডিস মশার (Aedes aegypti) ডিএনএ এডিট করে এদের কে ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় ছেড়ে দিলেন। সেসব মশা পরবর্তীতে যতো মশার সাথে মিলে প্রজনন করবে, তাদের সন্তান বন্ধ্যা হয়ে জন্মাবে। এতে করে কোথাও মশা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে [৪৩]। এমনকী, ল্যাবরেটরিতে সেই কবেই নতুন প্রজাতির প্রাণ সৃষ্টি সফলভাবে করা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে ডবজনস্কি এবং পাভলভস্কি তাঁদের ড্রোসোফিলা (ফলের মাছি) নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে একটি নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটাতে পেরেছিলেন [৪৪]।
ল্যাবে ঘটানো প্রজাতিকরণের আলোচনা যখন আসলো, তখন উইলিয়াম র্যাটক্লিফ ও তাঁর দল জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে MuLTEE এর ওপর করা এক প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করা স্টাডিটারটার ব্যাপারে বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এই আলোচনাটা একটুখানি বিস্তারিত হবে। আপনি চাইলে না পড়ে পরবর্তী প্যারায় চলে যেতে পারেন। তো হলোটা কী, উইলিয়াম র্যাটফ্লিক আর তাঁর দল বুঝতে চেয়েছেন, কীভাবে প্রাচীন পৃথিবীতে অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে একেবারে সাধারণ এককোষী জীব ধীরে ধীরে আরও জটিল বহুকোষী জীব হয়ে ওঠে এবং “ডারউইনিয়ান” প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত বিবর্তিত হতে থাকে। তাঁরা Saccharomyces cerevisiae নামক একপ্রকার এককোষী ইস্ট নেন। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এটাকে বহুকোষী জীবে বিবর্তিত করা। তিনটি ভিন্ন পরিবেশে এই পরীক্ষা চালানো হয়—একটি অক্সিজেন ছাড়া (অ্যানেরোবিক), একটি শুধুমাত্র অক্সিজেনযুক্ত (অব্লিগেটলি অ্যারোবিক), এবং আরেকটি মিশ্র (মিক্সোট্রফিক) পরিবেশ।
৩,০০০ প্রজন্ম ধরে তারা লক্ষ্য করেন, কীভাবে অ্যানেরোবিক (অক্সিজেনবিহীন) পরিবেশে আমাদের এই এককোষী “স্নোফ্লেক ইস্ট” বিশাল আকারের বহু কোষী জীবে বিবর্তিত হয়। আকারে তাদের এককোষী পূর্বপুরুষদের তুলনায় ২০,০০০ গুণ বড় এবং প্রায় ১০,০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী হয়। এমনকি নতুন শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যও লাভ করে। এই বিবর্তনের পেছনে কারণ হচ্ছে বেশ কিছু নতুন এডাপ্টিভ মেকানিজম, যেগুলি আগে দেখা যায়নি। এই অভিযোজনগুলো এতটাই ইম্পেক্টফুল ছিল যে, এর ফলে এদের পূর্বপুরুষদের থেকে এদের প্রজনন বিচ্ছিন্নতা ঘটে এবং সম্পূর্ণ একটি নতুন প্রজাতির বহু কোষী জীবের জন্ম দেয়। গবেষণাটি বিশ্ববিখ্যাত ন্যাচার জার্নালে De novo evolution of macroscopic multicellularity শিরোনামে প্রকাশিত হয় [৪৫]। র্যাটফ্লিকের ভাষ্যে,
“একক-কোষযুক্ত জীবের বিবর্তনে একটুখানি হস্তক্ষেপ করেই আমরা জানতে পেরে গেলাম কীভাবে তারা ক্রমান্বয়ে আরও জটিল এবং সমন্বিত বহু কোষযুক্ত জীব হিসাবে বিকশিত হলো। একই সাথে, সেই প্রক্রিয়াটি পর্যায়ক্রমে অধ্যয়নও করতে পারি। আমরা আশা করি এটা বহু কোষযুক্ত আবিষ্কারের দীর্ঘ গল্পের প্রথম অধ্যায় মাত্র, কারণ আমরা মিউল্টিতে (MuLTEE) স্নোফ্লেক ইয়েস্টের বিবর্তন অব্যাহত রাখছি।” [৪৬]
ল্যাবে নতুন প্রজাতি উদ্ভাবনের এমন অসংখ্য গল্প আমি আপনাদের শোনাতে পারবো। এইতো সেই ২০২০ সালে ল্যাবে ঘটা খুব দ্রুত স্পিসিয়েশন ঘটার একটা চমৎকার নজির দেখান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান ডিয়েগো এবং মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানীরা। মাত্র এক মাসের মধ্যেই গবেষকরা ব্যাকটেরিওফেজ ল্যাম্বডা নামক একটি ভাইরাসকে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাইরাস প্রজাতিতে বিবর্তিত করেছেন, যেগুলো প্রতিটি আলাদাভাবে E. coli ব্যাকটেরিয়ার ভিন্ন রিসেপ্টর সংক্রমণ করতে বিশেষায়িত [৪৭]। প্রজাতিকরণের ওপর গোটা একটা বই লিখা হলে এমন অসংখ্য উদাহরণ নিয়ে আপনাদের সাথে গল্প করতাম। বিবর্তন ঘটে। ঘটে বলেই আমরা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ঘটাতে পারি। তেমনিভাবে প্রকৃতিতেও ঘটে। বিবর্তন মানেই কেবল বানর থেকে মানুষ আসার মিথ্যা দাবি না। বিবর্তন তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটা আমাদের গল্প। আমরা, যারা শ্বাস নিই, প্রেমে পড়ি, বেড়ে ওঠি, পৃথিবীর পথ ধরে হাঁটি, সমুদ্রতলে প্রবাল হয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকি, কিংবা আকাশে উড়ে বেড়াই, সেরেঙ্ঘাটিতে শিকার খুঁজি, শিকারি থেকে দৌড়ে পালাই—আমাদের সবার গল্প। আমাদের প্রবন্ধের এ অংশটা শেষ হলো।
৬. প্রজাতিকরণ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা ও ভুল ধারণার খণ্ডন
এ অংশে আমরা প্রজাতিকরণ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেবো এবং একই সাথে, স্পিসিয়েশন নিয়ে বাজারে চলা নানান ভুল ধারণা খন্ডন করবো সংক্ষিপ্ত আকারে। এতে করে এ ব্যাপারে আমাদের ধারণা আরও পরিস্কার হবে।
১. নতুন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য তার পূর্ববর্তী প্রজাতির বিলুপ্তি কি প্রয়োজনীয়?
না, নতুন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য তার পূর্ববর্তী প্রজাতির বিলুপ্তি প্রয়োজনীয় নয়। প্রজাতির উদ্ভব বা স্পিসিয়েশন প্রক্রিয়ায় প্রায়ই পূর্ববর্তী প্রজাতির পাশাপাশি নতুন প্রজাতি সহাবস্থান করতে পারে। আপনি যদি স্পিসিয়েশনের মেকানিজমগুলি, রিপ্রোডাক্টিভ আইসোলেশনের আলোচনাটুকু ভালো করে পড়ে থাকেন, তাহলে আপনার পরিস্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে, উদ্ভুত নতুন কোনো প্রজাতির জীবেরা একই সময়ে তার পূর্ববর্তী প্রজাতির সাথেই পৃথিবীতে সহাবস্থান করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সিমপ্যাট্রিক স্পেসিয়েশন-এ ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়েও নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস বা যৌন নির্বাচনজনিত পার্থক্যের মাধ্যমে উদ্ভুত নতুন প্রজাতি একই ভৌগোলিক অঞ্চলে মূল প্রজাতির সাথে থেকেই উদ্ভূত হয়। এখানে উভয় প্রজাতি সহাবস্থান করতে পারে একই সময়ে তাদের বানানো আলাদা আলাদা নীচেস-এ।
একইভাবে, অ্যালোপ্যাট্রিক স্পেসিয়েশন (ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা) বা পেরিপ্যাট্রিক স্পেসিয়েশন (ক্ষুদ্র পরিসরে ঘটা ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা)-এর ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যা সময়ের সাথে সাথে জিনগতভাবে ভিন্ন হয়ে নতুন প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। এতেও আলাদা আলাদা ভাবে দুটি প্রজাতি একই সময়ে টিকে থাকতে পারে। হোমো ফ্লোরোয়েন্সিসের উদাহরণটাই দেখুন না। হোমো ইরেক্টাসের একটা পপুলেশন ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে আলাদা হয়ে যাওয়ায় লম্বা সময়ের ব্যবধানে খাদ্য স্বল্পতা এবং অন্যান্য প্রতিকুলতা থেকে বাঁচতে এদের আকারে ছোট হয়ে বিবর্তন ঘটে। উদ্ভব হয় সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজাতির। কিন্তু, মূল ভুখন্ডে থেকে যাওয়া হোমো ইরেক্টাসেরা হোমো ফ্লোরোয়েন্সিসদের সাথে একই সময়ে অবস্থান করেছে। ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়, আজ থেকে ১ লাখ ৪৩ হাজার বছর আগেও হোমো ইরেক্টাস আর ফ্লোরোয়েন্সিসরা একই সময়ে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বেঁচে ছিল [৪৯]। আরও পরিস্কার উদাহরণ পাই নেকড়ে(Canis lupus) থেকে কুকুরদের(Canis lupus familiaris) বিবর্তন থেকে। কুকুড়দের বিবর্তন ঘটে মানুষের হাত ধরেই। আজ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগেই মানুষের হাত ধরে আমাদের লোকালয়ে চলে আসে নেকড়েদেরই কিছু দল। তারপর লম্বা সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস, আমাদের হাতে ঘটানো সেক্সুয়াল সিলেকশান ও নেকড়েদের মূল পপুলেশনের সাথে প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জিন প্রবাহ না ঘটায় কুকুরদের আবির্ভাব ঘটে। আজকের দিনে এরা নেকড়েদের সাথে আর একই প্রজাতিতে নেই। উপ-প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে উভয়-ই পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াচ্ছে একই সময়ে।
বাদামী ভাল্লুক থেকে মেরু অঞ্চলের সাদা ভাল্লুকের বিবর্তনের গল্প তো আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের আলোচনায় জেনেছি। আজকের দিনে বাদামী ভাল্লুক এবং মেরু অঞ্চলের ভাল্লুকদের একই সময়ে পৃথিবীতে অবস্থান করতে দেখছি আমরা। এমন উদাহরণ অহরহ দেখতে পাওয়া যাবে। ইতিহাসে তাকালেও পাবো অনেক উদাহরণ। একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো আধুনিক ঘোড়ার (Equus ferus caballus) বিবর্তন, যা প্রায় ৪-৫ মিলিয়ন বছর আগে প্রাচীন ঘোড়ার পূর্বপুরুষ Equus ferus থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ফসিল রেকর্ড থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, এই প্রাথমিক ঘোড়াদের পূর্বপুরুষ, যেমন ইওহিপ্পাস এবং মেসোহিপ্পাস ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে নতুন প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়েছিল। তবে, এই পূর্বপুরুষ প্রজাতিগুলোর অনেকেই তাদের থেকে উদ্ভুত নতুন প্রজাতির সাথে দীর্ঘ সময় ধরে সহাবস্থান করেছে। পরবর্তীতে পরিবেশগত পরিবর্তন বা প্রতিযোগিতার কারণে কিছু পুরনো প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছিলো ঠিক, কিন্তু নতুন প্রজাতির উদ্ভব-ই যে তাদের পূর্বপুরুষদের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনটা বলার অবকাশ নেই। সবশেষে বলা যায় যে, বিবর্তন একক জীবের ক্ষেত্রে ঘটে না, বরং কোনো একটা এলাকার পুরো পপুলেশনের ঘটে। অন্য এলাকার একই প্রজাতির অন্য পপুলেশনের ওপর যদি বিবর্তনীয় চাপ না আসে, তাহলে ঐ পপুলেশনের মধ্যে কোনো মিউটেশন আসলেও তা প্রজন্মান্তরে পুরো প্রজাতির সব পপুলেশনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে না। এ কারণেই একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির উদ্ভব হলেও আগের প্রজাতিটাও টিকে থাকে, অন্য পরিবেশে। সবারই একসাথে বিবর্তন হয় না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বিলুপ্তিও ঘটে না পূর্ববর্তী প্রজাতির।
২. একক প্রজাতি থেকে একাধিক প্রজাতির উদ্ভব: কীভাবে সম্ভব?
একক প্রজাতি থেকে একাধিক প্রজাতির উদ্ভব সম্ভব। এর স্বপক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ সহ চোখের সামনে ঘটা-ই বেশ কিছু উদাহরণ আছে। উদাহরণে একটু পরে ঢুকি। আগে দেখে নেয়া যাক কীভাবে একক প্রজাতি থেকে একাধিক প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে ‘অ্যাডাপ্টিভ রেডিয়েশন’ নামে একটি শব্দ আছে। একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকায় কোনো একক প্রজাতি থেকে ভিন্ন ভিন্ন নিচেস(niches)-এ অভিযোজিত হওয়ার মাধ্যমে সময়ের ব্যবধানে নতুন প্রজাতির উদ্ভবকে আমরা অ্যাডাপ্টিভ রেডিয়েশন হিসেবে জানি। একটা সূচনা বিন্দু(সাধারণ পূর্বপুরুষ) থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে রেডিয়েট করায় অর্থাৎ ছড়িয়ে পড়ায় এটাকে আমরা আমরা অ্যাডাপ্টিভ রেডিয়েশন বলছি। একটি প্রজাতির পপুলেশন ধরুন ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন এনভায়রনমেন্টাল নিচেস-এ বিভক্ত হয়ে গেলো। এতে করে হবেটা কী, লম্বা সময় ব্যবধানে একেকটা গ্রুপ একেকভাবে বিবর্তিত হবে—তাদের খাদ্যাভ্যাস, সেক্সুয়াল সিলেকশন এবং সে গ্রুপ যে পরিবেশে অবস্থান করছে, তাতে উদ্ভুত টিকে থাকার জন্য সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। পৃথিবীর জীব-বিবর্তনের ইতিহাসে অসংখ্যবার একই প্রজাতি থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভবের ঘটনা ঘটেছে।
সেই উনিশ শতকেই প্রকৃতিবিদ চার্লস ডারউইন গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে ফিঞ্চ পাখিদের ভিন্ন ভিন্ন নিচেস ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে বিবর্তিত ভিন্ন আকারের ঠোঁট দেখে সিদ্ধান্তে আসেন যে, এরা একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে। পরবর্তীতে আধুনিক জেনেটিক্সের উন্নতি ঘটায় আমরা এদের জিন পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছি যে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে ফিঞ্চ পাখিদের অ্যাডাপ্টিভ রেডিয়েশন ঘটেছিলো [৫০]। অ্যাডাপ্টিভ রেডিয়েশনের আরেকটা প্রসিদ্ধ উধারণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান মারসুপিয়ালদের বিবর্তন। এরা সবাই একই পূর্ব পুরুষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন নিচেস, এনভায়রনমেন্টাল প্রেসার, সেক্সুয়াল সিলেকশন অনুযায়ী আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। হাওয়াইয়ান হানিক্রিপার পাখিরা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়েছে। সাধারণ এক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত এই পাখিরা প্রতিটি দ্বীপের ভিন্ন ভিন্ন আবাসস্থল ও খাদ্য উৎসের সাথে মানিয়ে নিয়ে আলাদা প্রজাতিতে বিভক্ত হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে এ আলোচনা চালালে কেবল এ নিয়েই গোটা একটা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা লিখা যাবে। মোদ্দাকথা হলো, একটি একক প্রজাতি একাধিক নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে পারে যখন সে নির্দিষ্ট প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন পপুলেশন জিনগতভাবে স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন বা ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে অভিযোজিত হয় এবং সময়ের সাথে স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হয়।
৩. নতুন প্রজাতি কখন হয়? হওয়া দেখি না কেন? এখন কেন নতুন প্রজাতি হচ্ছে না?
এ প্রশ্নটার উত্তরটুকু বেশ সুন্দরভাবে দিয়েছেন জীবাশ্মবিদ রিচার্ড ডকিন্স তাঁর ম্যাজিক অব রিয়্যালিটি বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। উত্তরটা সে বই থেকেই নিচ্ছি। ধরুন আমাদের কাছে একটা হাইপথেটিকাল ছবির অ্যালবাম আছে। এই অ্যালবামে ছবি একটার ওপর আরেকটা গাদা করে রাখা থাকে। সবচেয়ে উপরে আপনার ছবি, তার উপরে আপনার বাবার ছবি, তার উপরে তার বাবা কিংবা মায়ের, এভাবে আপনার আরও পূর্বপুরুষেরও পূর্বপুরুষের ছবি রাখা। এই অ্যালবামে যেকোনো একটা ছবি তুলে নিন। যেটা তুলে নিলেন তার উপরের, নিচের, আগের পরের ছবিগুলো মোটামুটি একই রকমের হবে। মানুষের বাচ্চা মানুষই পাবেন, বনমানুষ না। তাহলে বিবর্তন হচ্ছে কোথায়?
আপনার সাথে আপনার বাবার চেহারার মিল অনেক, দু’জন-ই মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আরও আগে যাই, আপনার দাদা, তার দাদা এভাবে যেতে যেতে আপনার ৪০০০ তম পরদাদার ছবিটা বের করুন। প্রতিটা প্রজন্ম যদি ২৫ বছরে হয়। এক তাহলে আপনার চার হাজারতম পরদাদা বাস করতেন এক লক্ষ বছর আগে। এই ভদ্রলোকও কি মানুষ?
দেখতে কিছুটা মানুষের মতোই মনে হচ্ছে বৈকি। খুলিটা তার একটু মোটা, চোখের ভ্রুগুলো বেশ ভিন্ন। কিন্তু এই ভদ্রলোককে এনে এখনকার মানুষের সাথে বিয়ে দিন, যে বাচ্চা হবে সেই বাচ্চারও বাচ্চা হওয়ার ভাল সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ, ইনিও মানুষ। এবার আরও আগে যাই। আপনার ৫০০০০ তম পরদাদার ছবিটা এই স্তুপ থেকে বের করা যাক। অবাক হয়ে দেখলেন যে, এই লোক ইয়েতি হতে পারে, বিগফুট হতে পারে কিন্তু আর যাই হোক মানুষ না। এর সাথে আধুনিক মানুষের মিলন ঘটলে কোনো সন্তান হবে না। হলেও যে বাচ্চা হবে, সে প্রজননক্ষম হবে না। এই লোকের প্রজাতি ভিন্ন। আমাদের সে পরদাদার নাম হোমো ইরেক্টাস।
তাহলে এ উদাহরণটা থেকে কি বুঝলেন? আপনি কি বুঝলেন তা জানি না, তবে আমরা যেটা আপনাকে জানাতে চাচ্ছি, তা হচ্ছে বিবর্তন সাধারণত হুট করেই ঘটে না। অর্থাৎ আপনার বনমানুষ বাবার সন্তান আপনি মানুষ হয়ে জন্মালেন, এমনটা না। বিবর্তনের বক্তব্যও না এটা। বিবর্তন কোনো ব্যক্তি পর্যায়ে ঘটে না। কোনো প্রজাতির কোনো জীবে আসা বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন বিভিন্ন বিবর্তনীয় চালিকাশক্তির(ন্যাচারাল সিলেকশন, সেক্সুয়াল সিলেকশন, জেনেটিক ড্রিফট ইত্যাদি) মাধ্যমে সে প্রজাতির কোনো পপুলেশনে ছড়িয়ে পড়তে হবে আগে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দীর্ঘ সময় ধরে ঘটতে থাকা এমন নানান পরিবর্তনের ফলে উদ্ভব হয় সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের। তবে হ্যাঁ, সব প্রজাতিই যে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিবর্তিত হয়েছে এমনটাও না। কিছু কিছু জীব ‘তুলনামূলক’ কম সময়েও সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়েছে। এটাকে আমরা বলি ‘র্যাপিড ইভোলিউশন’ বা দ্রুত বিবর্তন। উপরেই আমরা নানান উদাহরণ, গবেষণা হাজির করেছি। সামনে আরও উদাহরণ থাকবে।
এবার আমরা জনমানুষে প্রচলিত স্পিসিয়েশন নিয়ে কিছু ভুল ধারণা সংক্ষিপ্তাকারে খণ্ডন করবো।
দাবি-১ঃ “কোনো পপুলেশনে ক্ষুদ্র পরিবর্তন (মাইক্রোইভোলিউশন) জমা হতে হতে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি (ম্যাক্রোইভোলিউশন) উদ্ভব ঘটতে পারে না”
আপনি যদি এতোক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে পড়ে এসে থাকেন, তাহলে লক্ষ্য করে দেখবেন, আমরা অনেকবারই পরোক্ষভাবে এ দাবিটি খন্ডন করে বসে আছি অনেক অনেক উদাহরণের মাধ্যমে। বিবর্তন হচ্ছে যতোটা না দৃশ্যমান পরিবর্তন, তারচেয়েও বেশি জেনেটিক পরিবর্তন একই প্রজাতির দুটি আলাদা পপুলেশনে জিন প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে দুটি আলাদা প্রজাতির জিনপুলে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিবর্তন ঘটতে থাকে অর্থাৎ, মাইক্রোবিবর্তন ঘটতে থাকে। এভাবে পপুলেশন দুটির জিন পুলের পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এক সময় দেখা যায় দুটি দল একটা আরেকটা থেকে জেনেটিক্যালি এতোটাই আলাদা হয়ে যায় যে, এরা আর একজন আরেকজনের সাথে প্রজনন করতে সক্ষম হয় না, অর্থাৎ আলাদা প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে যায়। এমনটাই দেখিয়েছেন হার্ভার্ডের জীববিজ্ঞানী আরনেস্ট মায়ার তাঁর allopatry মডেলে।
ম্যাক্রো বিবর্তন বুঝতে শুধু যে আমরা ফসিল বা হোমোলোগাস প্রমাণের দ্বারস্থ হই, এমনটা না। বরং আজকের দিনে আমাদের জিন ঘাটাঘাটি করেই পেয়ে যাই ম্যাক্রো বিবর্তনের অসংখ্য আলামত। এমনকি, বিজ্ঞানীরা জিনোমের কোথায় কোন ধরণের পরিবর্তনের ফলে কোনো জীব তার পূর্ববর্তী প্রজাতি থেকে জেনেটিক্যালি এবং ফিজিক্যালি আলাদা হয়েছে, তাও খুঁজে খুঁজে বের করতে পারেন। তাই ম্যাক্রো বিবর্তন হাওয়া থেকে উড়ে আসা কোনো টার্ম না। প্রোটিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যেসব জিন অন্যান্য জিনদের এক্সপ্রেশন নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরকে আমরা রেগুলেটরি জিন বা নিয়ন্ত্রক জিন বলি। বিজ্ঞানীরা মলিকিউলার লেভেলে গবেষণা করে দেখেছেন, এই রেগুলেটরি জিনগুলিতে ধারাবাহিক ক্ষুদ্র মিউটেশনের ফলে জীবদেহে বড় স্কেলে পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। যেমন, আমাদের জলজ পূর্বপুরুষদের থেকে পা-যুক্ত স্থলচর প্রাণী প্রাণীতে বিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পাখনার পরিবর্তে পা গঠনের জন্য ছোট ছোট পরিবর্তন ঘটেছিল Hox জিন নামক রেগুলেটরি জিনে। এই Hox জিন শারীরিক গঠন তথা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নিয়ন্ত্রক জিনগুলোর মিউটেশন ধীরে ধীরে পাখনাকে পা সদৃশ কাঠামোতে বিবর্তিত করার মাধ্যমে আমাদের জলজ পূর্বপুরুষদের চলাফেরা, শিকার ধরা ইত্যাদির মাধ্যমে স্থলে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। বহু প্রজন্ম ধরে রেগুলেটরি জিনগুলিতে আসা অসংখ্য পরিবর্তনের ফলে বিবর্তিত হয় স্থলচর প্রাণীরা। তিমির কথাই ধরুন না, এদের স্থলচর পূর্বপুরুষদের মাত্র দুটি রেগুলেটরি জিন, Hoxd9 এবং Hoxd10 জিনে মিউটেশনের ফলে পিছনের পা পরিণত হয়েছে পাখনায়। এভাবে রেগুলেটরি জিন গুলিতে ধারাবাহিকভাবে মিউটেশন ঘটতে থাকলে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভবের(মাইক্রো বিবর্তন) সাথে সাথে ঘটে যায় ম্যাক্রো বিবর্তনও। এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য কোনোদিন।
দাবি-২ঃ “মিউটেশনের ফলে কেবল ভ্যারিয়েশন-ই ঘটে, বিবর্তিত হয়ে নতুন কোনো প্রজাতি চলে আসে না”
এ দাবির ক্ষেত্রেও বলছি, আপনি যদি এতোক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে পড়ে এসে থাকেন, তাহলে লক্ষ্য করে দেখবেন, আমরা অনেকবারই পরোক্ষভাবে, কোনো না কোনোভাবে এ দাবিটি খন্ডন করে বসে আছি। তাও, এখানে আরেকটু খোলামেলা করে আলোচনা করা যাক যে, কীভাবে এমন দাবী অযৌক্তিক এবং বিবর্তনের মূল ধারণার সাথেই সাংঘর্ষিক।
মিউটেশন কেবল ভ্যারিয়েশনই ঘটায় না, বিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। কিন্তু কেবল মিউটেশন ঘটা অবধিই যথেষ্ট না, অর্থাৎ কোনো জীবে মিউটেশন ঘটে ভ্যারিয়েশন সৃষ্টি হলো আর বিবর্তন ঘটে গেলো এমনটা না। কেন?
আমরা আগেই জেনে এসেছি যে, মিউটেশন হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো জীবের ডিএনএতে ক্ষুদ্র পরিবর্তন ঘটে এবং এর মাধ্যমে নতুন জেনেটিক বৈচিত্র্য বা নতুন অ্যালিল সৃষ্টি হয়। মনে করিয়ে দিই যে, অ্যালিল হচ্ছে একই জিনের দুটি ভিন্ন রূপ। যখন কোনো মিউটেশন প্রজনন কোষে (যেমন শুক্রাণু বা ডিম্বাণু) কিংবা জাইগোটে ঘটে, তখন এটি পরবর্তী প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে যেতে পারে এবং এ পরিবর্তন পুরো পপুলেশনে ছড়িয়ে পড়লে এর জিনপুলে নতুন বৈচিত্র্য যোগ করে। এবার জানা যাক বিবর্তনকে আসলে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পপুলেশন জেনেটিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিবর্তন হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে কোনো পপুলেশনের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কোনো একক জীবের ক্ষেত্রে নয়, বরং পুরো পপুলেশনে ঘটে।
মিউটেশনের ফলে ভ্যারিয়েশন ঘটে ঠিক, কিন্তু সে ভ্যারিয়েশনের ফলাফল সে পপুলেশনে ছড়িয়ে যাবে কি যাবে না তা নির্ভর করে নানান বিবর্তনীয় চালিকা শক্তি যেমন ন্যাচারাল সিলেকশন, জেনেটিক ড্রিফট, জিন প্রবাহ ইত্যাদি। দীর্ঘ সময় ধরে মিউটেশনের ফলে কোনো পপুলেশনের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবর্তন চলতে থাকলে এক সময় তা জেনেটিক্যালি খুব আলাদা হয় সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়।
দাবি-৩ঃ “মানুষ বানর থেকে এসে থাকলে এখনও বানর রয়ে গেলো কেন? বানর থেকে আর মানুষ হচ্ছে না কেন?”
আমার এ লেখাটুকু এ অবধি যারা পড়ে এসেছেন, তাদের এ ননসেন্স প্রশ্নটা করার কথা না। পরবর্তীতে কখনো হোমো স্যাপিয়েন্স নামক প্রজাতির, মানে আমাদের উদ্ভবের গল্প করবো। তাও যদি ভুলেও এমন প্রশ্ন মাথায় এসে থাকে, তাহলে এ অংশটা আপনার জন্যে।
প্রথমত, মানুষ বানর থেকে আসেনি। বিবর্তন তত্ত্ব বলছে মানুষ আর পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়ানো মানুষ এবং প্রাইমেট বর্গের অন্যান্য বনমানুষগুলো অনেক অনেককাল আগে একই পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভুত হয়ে বিবর্তিত হয়ে আলাদা আলাদা প্রজাতির ধারা (lineage) তৈরি করেছে। এর মানে কিন্তু এই নয় পৃথিবীতে বিদ্যমান সব শিম্পাঞ্জীগুলো মানুষ হয়ে যাবে বা সব মানুষগুলো শিম্পাঞ্জী হয়ে যাবে। প্রাণের বিকাশ এবং বিবর্তনকে একটা বিশাল গাছের সাথে তুলনা করা যায়। একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভুত হয়ে বিবর্তনের ওই গাছটির (জাতিজনি বৃক্ষ) বিভিন্ন ডাল পালা তৈরি হয়েছে। এর কোন ডালে হয়তো শিম্পাঞ্জীর অবস্থান, কোন ডালে হয়ত গরিলা আবার কোন ডালে হয়ত মানুষ। অর্থাৎ, একসময় তাদের সবার এক সাধারণ পূর্বপুরুষ মোটামুটি ৯-১৩ মিলিয়ন বছর আগে সে প্রজাতি থেকে ভিন্ন প্রজাতি-উপপ্রজাতিতে বিভক্ত হতে হতে আজকের এই প্রাইমেট বর্গের প্রাণিদের উৎপত্তি। এ নিয়ে আছে অসংখ্য প্রমাণাদি। সামনের কোনো লেখায় আমাদের এইপ কাজিনদের সাথে আমাদের সম্পর্কের দলিল রীতিমতো জিন লেভেলে গিয়ে দেখানো হবে।
এ পর্যন্ত এসে আমরা পরিস্কার হলাম যে, আমরা বানর থেকে আসিনি। এবং এখনও বানর বা অন্যান্য এইপরা রয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা যেভাবে অন্য বনমানুষদের থেকে বিবর্তিত হয়েছি, একইভাবে তারাও হয়েছে। বর্তমানে বেঁচে থাকা কোনো এইপ-ই আমাদের পূর্বপুরুষ না। এবার আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, বর্তমানে ঘুরে বেড়ানো এইপদের থেকে মানুষ কেন আসে না?
এর উত্তরে প্রথম কথা হচ্ছে, বর্তমানের এইপদের থেকে বিবর্তিত হয়ে যাই আসুক না কেন, তা আপনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবেন না। কারণ, এ ধরণের বিবর্তন ঘটবে লক্ষ লক্ষ বছর সময় নিয়ে। তারচেয়েও বড় কথা, তাদের থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষই বা কেন আসবে? কারণ, বিবর্তন হচ্ছে একটি অন্ধ প্রক্রিয়া। ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার। আমাদের পক্ষে সম্ভব না জানা যে আজকের শিম্পাঞ্জিদের থেকে কয়েক লাখ বছর পর কেমন প্রাণী বিবর্তিত হতে যাচ্ছে। ধরুন মানুষের জিনোমে কয়েক কোটি লেটারের বিশাল লম্বা কোড আছে। ধরে নিই সব মানুষ খুব কাছাকাছি, ৪১০০০০০০০ পারমিউটেশনের খুব অল্প কিছু পারমিউটেশনে মানুষ হয়। যে এইপ বা বনমানুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে, সে এইপের বিলুপ্তি ঘটেছে কোটি বছর আগেই। তাই আজকের দিনের এইপদের থেকে বিবর্তিত হয়ে একই জিনোম নিয়ে একই রকম প্রজাতির উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনা শূন্য। আশা করি এমন ননসেন্স প্রশ্ন আর মাথায় জাগবে না।
দাবি-৫ঃ “মাছ থেকে আজকের স্থলচর সব প্রাণি আসলেও এখনও জলে মাছ রয়ে গেলো কীভাবে?”
জীববিবর্তনের বিস্তারিত ইতিহাস আমরা পরে কখনও জানবো। তাহলেই আপনার মাথায় এমন প্রশ্ন আর ঘোরপাক খাবে না। তবে স্পিসিয়েশনের আলোচনায় এমন প্রশ্ন প্রায়ই উঠে আসে। বিবর্তন তত্ত্ব কখনও কোথাও দাবি করেনি যে আজকের স্থলচর সব প্রাণির পূর্বপুরুষ আজকের দিনের কোনো মাছ। ফসিল রেকর্ড থেকে জানতে পারি, Acanthostega এবং Ichthyostega রা ছিলো জল থেকে স্থলে উঠে আসা প্রথম দিকের ভার্টিব্রেট। তাহলে এবার আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন যে, জলজ প্রাণী থেকে স্থলচর প্রাণিদের বিবর্তন ঘটে থাকলে এখনও জলে কীভাবে প্রাণিরা রয়ে গেলো?
প্রথম কথা হচ্ছে, এমন প্রশ্নই হাস্যকর। কারণ বলছি। আপনার প্রথম পূর্বপুরুষ আপনার পিতা ধরে নিয়ে, ধাপে ধাপে সময়ে পিছতে পিছতে আপনার ১০০০ তম পর্ব পুরুষে পৌঁছে যাই। ধরা যাক আপনার এই ১০০০ তম পূর্বপুরুষের ৩ সন্তান ছিল। আর এই ৩ সন্তানের প্রত্যেকের ৪ টি করে সন্তান আছে। তাদেরও চারটি করে সন্তান আছে। এইভাবে আপনার বর্তমান প্রজন্ম এসেছে। আর আপনি সেই ১০০০ তম পূর্বপুরুষের প্রথম সন্তানের বংশধর। এখন আপনার সাথে আপনার ১০০০ তম পূর্বপুরুষের তৃতীয় সন্তানের যে লিনিয়েজ তার সাথে আপনার সম্পর্ক এখন এতই দূরের যে আপনার সাথে তার কোন সাদৃশ্য নেই। কিন্তু এর মনে কি এটা যে আপনি আছেন বলে আপনার ১০০০ তম পূর্বপুরুষের তৃতীয় সন্তানের লিনিয়েজ আর নেই? অবশ্যই আছে। অর্থাৎ ‘ক’ নামক কোনো প্রজাতি থেকে অনেক অনেক জলজ প্রাণি আসলেও কিছু জলজ প্রাণি জলেই রয়ে গেলো। এবং সে অনুযায়ীই বিবর্তিত হলো। আর তার কিছু চাচাতো ভাই ডাঙায় উঠে এলো। এরপর ডাঙা আর জলে দুই কাজিনের আলাদাভাবে বিবর্তন ঘটেছে।
এবার আসি বিবর্তনের কথায়। বিবর্তন কাকে বলে সেটা আবারও মনে করিয়ে দিই। বিবর্তন হলো কোন একটি নির্দিষ্ট জিনপুলে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তন। এই জিনপুলে অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তন না হয়ে স্ট্যাবল থাকতে পারে, যদি এই জিনপুলের আকার খুবই বড় হয়, কোন প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ না করে আর যদি প্রতি সদস্য একই সম্ভাবনা নিয়ে এই জিন পুলে কাজ কন্ট্রিবিউট করে। তাই আমরা আজকের দিনেও লিভিং ফসিলদের দেখতে পাই। এবং অন্যান্য জলজ প্রাণিদের ভেতর এতো বেশি বিবর্তনীয় পরিবর্তন দেখি না, যতোটা আমরা আমাদের জলজ পূর্বপুরুষ টিকটালিক, অ্যাকান্থস্টেগা বা ইচথিওস্টেগাদের থেকে হয়েছি।
কিন্তু এই জিন পুল থেকে যদি একটি ক্ষুদ্র অংশ আলাদা হয়ে যায়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন, জেনেটিক ড্রিফট অথবা জিন প্রবাহের কারণে এই নতুন আলাদা জিনপুলের অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একটি মোটামুটি লম্বা সময়(considerable time period) এর পরে এই দুটি জিন এতটাই আলাদা হয়ে যায়, যে তারা আর জিন আদান প্রদান করতে পারে না। তাই আজকের মাছেরা আর আমরা জলজ পূর্বপুরুষ থেকে আসা সত্ত্বেও এখনো জলে জলজ প্রাণিরা রয়ে গেছে এবং তারা আমাদের চেয়ে দেখতে এতোটা ভিন্ন।
তথ্যসূত্রঃ
[১] De Queiroz, K. (2005). Ernst Mayr and the modern concept of species. Proceedings of the National Academy of Sciences, 102(suppl_1), 6600–6607. https://doi.org/10.1073/pnas.0502030102
[২] Mallet J. Group selection and the development of the biological species concept. Philos Trans R Soc Lond B Biol Sci. 2010 Jun 12;365(1547):1853-63. doi: 10.1098/rstb.2010.0040. PMID: 20439286; PMCID: PMC2871894.
[৩] Semi-Conservative DNA replication | Learn Science at Scitable. (n.d.). https://www.nature.com/scitable/topicpage/semi-conservative-dna-replication-meselson-and-stahl-421/
[৪] Desfarges S, Ciuffi A. Viral Integration and Consequences on Host Gene Expression. Viruses: Essential Agents of Life. 2012 Sep 25:147–75. doi: 10.1007/978-94-007-4899-6_7. PMCID: PMC7120651.
[৫] Hasselbalch, H. C. (2013). Chronic inflammation as a promotor of mutagenesis in essential thrombocythemia, polycythemia vera and myelofibrosis. A human inflammation model for cancer development? Leukemia Research, 37(2), 214–220. https://doi.org/10.1016/j.leukres.2012.10.020
[৬] Mayr, E. (1963). Animal Species and Evolution. Belknap Press of Harvard University Press.
[৭] https://www.nature.com/collections/sbdmbbrnbr
[৮] Grant, P.R. & Grant, B.R. (2014). 40 Years of Evolution: Darwin’s Finches on Daphne Major Island. Princeton University Press.
[৯] Seehausen, O. (2006). “African cichlid fish: a model system in adaptive radiation research.” Proceedings of the Royal Society B, 273(1597), 1987-1998.
[১০] “Peripatric speciation”. Understanding Evolution. University of California, Berkeley. https://evolution.berkeley.edu/modes-of-speciation/peripatric-speciation/
[১১] Mingzi Xu, Kerry L Shaw, The Genetics of Mating Song Evolution Underlying Rapid Speciation: Linking Quantitative Variation to Candidate Genes for Behavioral Isolation, Genetics, Volume 211, Issue 3, 1 March 2019, Pages 1089–1104, https://doi.org/10.1534/genetics.118.301706
[১২] Feder, J. L., Hood, G. R., Doellman, M. M., Schuler, H., Miller, A., Tait, C., Glover, M. M., & Meyers, P. (2017). Speciation, Process of . In Reference Module in Life Sciences (pp. 1-12). Elsevier. https://doi.org/10.1016/B978-0-12-809633-8.02366-9
[১৩] Antonovics, J. Evolution in closely adjacent plant populations X: long-term persistence of prereproductive isolation at a mine boundary. Heredity 97, 33–37 (2006). https://doi.org/10.1038/sj.hdy.6800835
[১৪] Lindqvist, C., Schuster, S. C., Sun, Y., Talbot, S. L., Qi, J., Ratan, A., Tomsho, L. P., Kasson, L., Zeyl, E., Aars, J., Miller, W., Ingólfsson, Ó., Bachmann, L., & Wiig, Ø. (2010). Complete mitochondrial genome of a Pleistocene jawbone unveils the origin of polar bear. Proceedings of the National Academy of Sciences, 107(11), 5053–5057. https://doi.org/10.1073/pnas.0914266107
[১৫] Kumar, V., Lammers, F., Bidon, T. et al. The evolutionary history of bears is characterized by gene flow across species. Sci Rep 7, 46487 (2017). https://doi.org/10.1038/srep46487
[১৬] Allele Frequency. Science Direct. https://www.sciencedirect.com/topics/neuroscience/allele-frequency
[১৭] Amos W, Harwood J. Factors affecting levels of genetic diversity in natural populations. Philos Trans R Soc Lond B Biol Sci. 1998 Feb 28;353(1366):177-86. doi: 10.1098/rstb.1998.0200. PMID: 9533122; PMCID: PMC1692205.
[১৮] Stephen J O’Brien, Warren E Johnson, Carlos A Driscoll, Pavel Dobrynin, Laurie Marker, Conservation Genetics of the Cheetah: Lessons Learned and New Opportunities, Journal of Heredity, Volume 108, Issue 6, September 2017, Pages 671–677, https://doi.org/10.1093/jhered/esx047
[১৯] Stone, D., & De Wilde, S. (2018, January 26). On Island of the Colorblind, Paradise Has a Different Hue. https://www.nationalgeographic.com/photography/article/pingelap-island-colorblindness-micronesia
[২০] Wangjie Hu et al., Genomic inference of a severe human bottleneck during the Early to Middle Pleistocene transition.Science381,979-984(2023).DOI:10.1126/science.abq7487
[২১] Kay, R. F.; Ross, C.; Williams, B. A. (1997). “Anthropoid Origins”. Science. 275 (5301): 797–804. doi:10.1126/science.275.5301.797. PMID 9012340. S2CID 220087294.
[২২] Coyne, J. A., & Barton, N. H. (1988). What do we know about speciation? Nature, 331(6155), 485-486. https://www.nature.com/articles/331485a0.pdf
[২৩] Rogers, N. Evolution of Darwin’s finches tracked at genetic level. Nature (2016). https://doi.org/10.1038/nature.2016.19795
[২৪] Hofman CA, Rick TC, Hawkins MTR, Funk WC, Ralls K, et al. (2015) Mitochondrial Genomes Suggest Rapid Evolution of Dwarf California Channel Islands Foxes (Urocyon littoralis). PLOS ONE 10(2): e0118240. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0118240
[২৫] Mallet, J. (2007). Hybrid speciation. In Nature (Vol. 446, p. 279). https://doi.org/10.1038/nature05706
[২৬] Loren H. Rieseberg et al., Major Ecological Transitions in Wild Sunflowers Facilitated by Hybridization.Science301,1211-1216(2003). DOI:10.1126/science.1086949
[২৭] Hakan Ozkan, Avraham A. Levy, Moshe Feldman, Allopolyploidy-Induced Rapid Genome Evolution in the Wheat (Aegilops–Triticum) Group, The Plant Cell, Volume 13, Issue 8, August 2001, Pages 1735–1747, https://doi.org/10.1105/TPC.010082
[২৮] জীববিববতর্ন তত্ত্বঃ নানা জিজ্ঞাসা, অনন্ত বিজয় দাস, পৃষ্ঠাঃ ৪।
[২৯] Silva, A.P.B., Santos, J.M.M. & Martins, A.J. Mutations in the voltage-gated sodium channel gene of anophelines and their association with resistance to pyrethroids – a review. Parasites Vectors 7, 450 (2014). https://doi.org/10.1186/1756-3305-7-450
[৩০] Abbasi E, Daliri S (2024) Knockdown resistance (kdr) associated organochlorine resistance in mosquito-borne diseases (Culex quinquefasciatus): Systematic study of reviews and meta-analysis. PLOS Neglected Tropical Diseases 18(8): e0011991. https://doi.org/10.1371/journal.pntd.0011991
[৩১] Luzzatto, L. (2012) “SICKLE CELL ANAEMIA AND MALARIA”, Mediterranean Journal of Hematology and Infectious Diseases, 4(1), p. e2012065. doi: 10.4084/mjhid.2012.065.
[৩২] Peppered Moths: natural selection. (n.d.). https://askabiologist.asu.edu/peppered-moths-game/natural-selection.html
[৩৩] Cook, L. M., Grant, B. S., Saccheri, I. J., & Mallet, J. (2012). Selective bird predation on the peppered moth: the last experiment of Michael Majerus. Biology Letters, 8(4), 609–612. https://doi.org/10.1098/rsbl.2011.1136
[৩৪] Rice, Stanley A. (2007). Encyclopedia of Evolution. New York: Facts on File. p. 308. ISBN 978-1-4381-1005-9
[৩৫] Hof, A., Campagne, P., Rigden, D. et al. The industrial melanism mutation in British peppered moths is a transposable element. Nature 534, 102–105 (2016). https://doi.org/10.1038/nature17951
[৩৬] David O. Conover, Stephan B. Munch, Sustaining Fisheries Yields Over Evolutionary Time Scales .Science297,94-96(2002).DOI:10.1126/science.1074085
[৩৭] Jiggins, C. D., & Bridle, J. R. (2003). Speciation in the apple maggot fly: a blend of vintages? Trends in Ecology & Evolution, 19(3), 111–114. https://doi.org/10.1016/j.tree.2003.12.008
[৩৮] Feder, J. L., Berlocher, S. H., Roethele, J. B., Dambroski, H., Smith, J. J., Perry, W. L., Gavrilovic, V., Filchak, K. E., Rull, J., & Aluja, M. (2003). Allopatric genetic origins for sympatric host-plant shifts and race formation in Rhagoletis. Proceedings of the National Academy of Sciences, 100(18), 10314–10319. https://doi.org/10.1073/pnas.1730757100
[৩৯] Ownbey, M. (1950). Natural Hybridization and Amphiploidy in the Genus Tragopogon. American Journal of Botany, 37(7), 487–499. https://doi.org/10.2307/2438023
[৪০] Soltis, P. S., & Soltis, D. E. (2009). The role of hybridization in plant speciation. Annual Review of Plant Biology, 60(1), 561–588. https://doi.org/10.1146/annurev.arplant.043008.092039
[৪১] Gazettebeckycoleman, & Gazettebeckycoleman. (2024, June 12). Amazon butterfly evolved from hybrids. Harvard Gazette. https://news.harvard.edu/gazette/story/2024/04/amazon-butterfly-evolved-from-hybrids-heliconius-species-evolution/
[৪২] C. A. Salazar, C. D. Jiggins, C. F. Arias, A. Tobler, E. Bermingham, M. Linares, Hybrid incompatibility is consistent with a hybrid origin of Heliconius heurippa Hewitson from its close relatives, Heliconius cydno Doubleday and Heliconius melpomene Linnaeus, Journal of Evolutionary Biology, Volume 18, Issue 2, 1 March 2005, Pages 247–256, https://doi.org/10.1111/j.1420-9101.2004.00839.x
[৪৩] https://www.sciencedaily.com/releases/2021/06/210602091401.htm
[৪৪] DOBZHANSKY, T., PAVLOVSKY, O. Experimentally Created Incipient Species of Drosophila. Nature 230, 289–292 (1971). https://doi.org/10.1038/230289a0
[৪৫] Bozdag, G.O., Zamani-Dahaj, S.A., Day, T.C. et al. De novo evolution of macroscopic multicellularity. Nature 617, 747–754 (2023). https://doi.org/10.1038/s41586-023-06052-1
[৪৭] https://today.ucsd.edu/story/biologists_watch_speciation_in_a_laboratory_flask
[৪৮] Tintori, S. C., Çağlar, D., Ortiz, P., Chyzhevskyi, I., Mousseau, T. A., & Rockman, M. V. (2024). Environmental radiation exposure at Chornobyl has not systematically affected the genomes or chemical mutagen tolerance phenotypes of local worms. Proceedings of the National Academy of Sciences, 121(11). https://doi.org/10.1073/pnas.2314793121
[৪৯] Homo erectus. (2024, January 3). The Smithsonian Institution’s Human Origins Program. https://humanorigins.si.edu/evidence/human-fossils/species/homo-erectus#:~:text=Sometimes%20they%20were%20even%20found,possibly%20Homo%20floresiensis%20in%20Indonesia.
[৫০] Peter R Grant, B Rosemary Grant, From microcosm to macrocosm: adaptive radiation of Darwin’s finches, Evolutionary Journal of the Linnean Society, Volume 3, Issue 1, 2024, kzae006, https://doi.org/10.1093/evolinnean/kzae006
লেখককে ধন্যবাদ অসাধারণ লেখা, তথ্য-উপাত্তসহ ও বিশ্লেষণের জন্য। তরুণদের এই লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে অধিকা যাওয়া উচিত।