১৯৮৫ সালে, রয়্যাল সোসাইটি বিজ্ঞান সম্পর্কে জনসাধারণের বোধগম্যতা বৃদ্ধির জন্য তাদের নীতিমালা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। নীতিমালার ৬.১ ধারায় উল্লেখ করা হয়:
বিজ্ঞানীদের অবশ্যই সমাজের সকল স্তরের মানুষের, বিশেষত গণমাধ্যমের সঙ্গে, আরও ভালোভাবে যোগাযোগ করতে শিখতে হবে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুটি বিষয় বারবার উঠে এসেছে—একদিকে, সাংবাদিকদের প্রতি বিজ্ঞানীদের অবিশ্বাস, তাদের অজ্ঞতা এবং প্রায়শই যথাযথভাবে যোগাযোগ করতে অনিচ্ছা ও অক্ষমতা; অন্যদিকে, গণমাধ্যমে বিজ্ঞানের যথাযথ উপস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকদের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একই ধরনের সম্পর্ক প্রয়োজন সংসদ, প্রশাসন এবং শিল্পক্ষেত্রের সাথেও। আমাদের দলটি যদিও সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক ছিল না, তবুও এটি বৈজ্ঞানিক সমাজ থেকেই উৎপন্ন। তাই আমাদের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ এবং জরুরি বার্তাটি বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে—জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শিখুন, তা করতে আগ্রহী হোন, এবং সত্যি বলতে, এটি আপনার দায়িত্ব বলে বিবেচনা করুন।
(p.24)
স্টিভেন পিঙ্কার (২০০২) লিখেছেন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ইহুদি-খ্রিস্টান ধারার মানব স্বভাব সম্পর্কিত ধারণাটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব…মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব পৃথিবীতে মানব জীবনের উৎপত্তির সেরা ব্যাখ্যা। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদরা স্পষ্টভাবে ধর্মীয় তত্ত্বকে গ্রহণ করেন, এবং কোনো মূলধারার রাজনীতিকই জনসমক্ষে তা অস্বীকার করার সাহস দেখান না। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান—মহাজাগতিক বিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান এবং প্রত্নতত্ত্ব—এমন জ্ঞান সরবরাহ করেছে যা কোনো বৈজ্ঞানিকভাবে সচেতন ব্যক্তির পক্ষে বাইবেলের সৃষ্টি কাহিনীকে সত্যি বলে বিশ্বাস করা অসম্ভব করে তুলেছে। ফলে, ইহুদি-খ্রিস্টান মানব স্বভাব তত্ত্বটি এখন আর অধিকাংশ একাডেমিক, সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক বা অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রকাশ্যে সমর্থন পায় না।
(p.2)
রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞান সম্পর্কিত জনসচেতনতা বৃদ্ধির নীতিমালার বাস্তবায়নের ফলে ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে তারা বিজ্ঞান বিষয়ে জনমানুষের বোধগম্যতা বাড়াতে সেমিনার, সম্মেলন ও অন্যান্য কার্যক্রম চালু করতে সক্ষম হয়েছে।
রিচার্ড ডকিন্স আন্তর্জাতিকভাবে বহুল বিক্রিত বইয়ের একজন বিখ্যাত লেখক, যিনি বিজ্ঞানের জনপ্রিয় ব্যাখ্যায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে “পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সায়েন্স”-এর চার্লস সিমোনি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লেখা “The God Delusion” (২০০৬) বইটিতে তিনি ধর্মকে বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের মাধ্যমে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন।
আমাদের দেশেও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা অনেক পড়াশোনা করেছেন এবং যাঁদের জ্ঞানের গভীরতা প্রশংসনীয়। কিন্তু তারাও অনেক সময় চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে—কিছু খ্রিস্টান মিশনারি বা মুসলিম ধর্মীয় দল তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারে সচেষ্ট, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের ধর্ম কোনো চূড়ান্ত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
প্রথম উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায়, অন্যান্য দেশেও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে শেখা মানুষদের অনেকেই একাডেমিয়ার ভেতরে কী ঘটছে, তা নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে চান না। শ্রেণিকক্ষের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও অনেক সময় কেবল শুনে যান, বোঝেন, কিন্তু কোনো কিছু পরিষ্কার করে বলেন না—যদিও তারা জানেন ও বুঝেন। এই ‘নীরবতা’ই বিজ্ঞান সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে “Public Understanding of Science” প্রকল্পের সূচনা ঘটায়।
বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় তাঁর মুক্তমনা প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু করেন ঠিক এই প্রয়োজনে—যেখানে মানুষ যেন যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, কথা বলতে পারে এবং ভাবতে পারে মুক্তভাবে।
সমস্যাটা শুরু হয় তখনই, যখন আপনি চুপ থাকেন—কারণ নীরবতার সুযোগে অজ্ঞতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, গ্রামাঞ্চলে বহু আগে থেকেই দেখা গেছে—যে মানুষটি সবচেয়ে বাচাল, যার টাকাপয়সা আছে, কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই—সেই মানুষটিই মেম্বার বা চেয়ারম্যান হয়ে নির্বাচনে জিতে যায় এবং ইউনিয়ন পরিষদ চালায়। দুর্নীতির পথটা সেখান থেকেই শুরু হয়, কারণ যাঁরা শিক্ষিত, সচেতন—তাঁরাই সামনে এগিয়ে আসেন না।
বিজ্ঞানের বিষয়টা আরও অনেক গভীর। কারণ বিজ্ঞান কেবল তথ্য দেয় না, এটি প্রমাণসহ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে। অবশ্যই কিছু কিছু বিজ্ঞান শিক্ষক বা ছাত্র আছেন, যাঁরা ‘Black Swan’ সমস্যার মতো বিরল ও অপ্রত্যাশিত বিপদের ভয়ে বিজ্ঞানমনস্ক কথা বলতে সাহস পান না। কিন্তু একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতে হবে—যে জ্ঞান বিজ্ঞানীরা প্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি করেন, তা ধর্মীয় গ্রন্থের তুলনায় জ্ঞানের সন্ধানে অনেক বেশি অগ্রসর এবং গতিশীল।
ধর্মীয় গ্রন্থগুলো ব্যাখ্যার বাইরে যেতে পারে না। আর যদি ব্যাখ্যা না দেওয়া যায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রশ্ন বা চিন্তাকে ‘ভ্রান্ত’ বলে চিহ্নিত করে উস্কানিমূলক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়—যেমনটা আল-গাজালি (মৃত্যু: ১১১১ খ্রিস্টাব্দ) করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত বই “The Incoherence of the Philosophers”-এ তিনি দার্শনিকদের যুক্তিকে খণ্ডন করেছিলেন। তিনি একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দমন চালিয়েছিলেন, যেটা আজও দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মীয় চিন্তাধারায়।
Freedom of thought বা চিন্তার স্বাধীনতা সব ধর্মের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, যখনই কোনো নতুন জ্ঞান ধর্মীয় বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।
বেশি দূরে যেতে হবে না আমাদের—মুক্তমনা ব্লগারদের গত কয়েক বছরের আন্দোলনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ২১ শতকের শুরুতে অভিজিৎ রায় যে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছিলেন, মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে তার মূল্য কতটা রক্তে দিতে হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এদের অনেকেই এসেছে মুসলিম পরিবার থেকে। কিন্তু তারা বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোয় সত্যকে অনাবৃত করার সাহস দেখিয়েছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ধর্মীয় উন্মাদনায় ভরা মানুষদের হাতে তারা হয়ে ওঠে লক্ষ্যবস্তু।
সেদিন আসিফ মহিউদ্দিনের একটি লাইভ আলোচনায় অভিজিৎ রায়ের এক হত্যাকারী এসে বলেছিলেন—সে বুঝতেই পারেনি কেন সে এমন কাজ করেছিল। এখন সে নাকি দোষবোধে ভুগছে। আসিফ ভাই তাকে ইমেইল করতে বলেছিলেন, এবং এই বিষয়টি আসাদ নূরের সঙ্গে এক আলোচনায় আবার সামনে উঠে এসেছিল।
শিক্ষকদের যখন হত্যা করা হয়, তখন ছাত্রদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাঁদের কথা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের আলোকে যত প্রমাণ হাতে আছে, তা স্পষ্ট করে বলে—এই মহাবিশ্ব নিজেই নিজের ব্যাখ্যা। কোনো বাইরের অলৌকিক শক্তি এখানে কাজ করেনি। এই মহাবিশ্ব প্রায় ১৪০০ কোটি বছরের ধাপে ধাপে বিকাশমান ইতিহাস বহন করে। সেই ইতিহাসের একটি নিদর্শন হলো কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB)। তারপরে নক্ষত্রের সৃষ্টি আমাদের শিখিয়েছে—কীভাবে সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর তৈরি হওয়া নেবুলা থেকে সূর্য এবং আমাদের গ্রহগুলো গঠিত হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার ফলেই আজ আমি, একজন নগণ্য ছাত্র, ল্যাপটপে বসে মহাবিশ্ব নিয়ে লিখতে পারছি।
আমরা আসলে সবাই মহাজাগতিক ইতিহাসের বাহক। কারণ আমরা সবাই তারাগুলোর ধূলিকণার সন্তান। এই উপলব্ধি গভীরভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক। সুতরাং, কোনো অলৌকিক সত্তার প্রতি নয়, কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য সেই তারাগুলোর, যাদের বিলিয়ন বছরের বিবর্তন, ধ্বংস আর পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে আজকের আমরা গঠিত হয়েছি। সত্যটা হয়তো তিক্ত, কিন্তু একইসঙ্গে অভাবনীয়ভাবে সুন্দর—যদি কেউ বুঝে উঠতে পারে।
লরেন্স ক্রাউস একবার এক সম্মেলনে বলেছিলেন—”সপ্তাহান্তে চার্চে গিয়ে ধর্মীয় শ্লোক পড়ার চেয়ে, বিজ্ঞানীদের লেখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বই পড়লে আরও বেশি ‘মিস্টিক্যাল’ অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়।” আমাদের মহাবিশ্বই আমাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উপলব্ধির উৎস।
ব্রাইসন তাঁর বইতে এমন একধরনের ‘মিস্টিক্যাল’ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন, যেখানে মহাবিশ্বের বিশালতা ও মানব অস্তিত্বের ক্ষণস্থায়ীতার একটি দার্শনিক ধাক্কা আছে। তিনি লেখেন:
ষাট মিলিয়ন বছর ধরে নিরব নিঃশব্দে, একটি তারা বিস্ফোরণের পর যে আলো ছড়িয়েছিল, তা মহাকাশ পেরিয়ে একটানা ভ্রমণ করতে করতে অবশেষে ২০০১ সালের আগস্টের এক রাতে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়—একটি ক্ষীণ আলোছায়ার আকারে, রাতের আকাশে একটুখানি উজ্জ্বলতা। এবং এই দৃশ্যটি চোখে পড়েছিল রবার্ট ইভান্সের, যিনি ছিলেন ইউক্যালিপটাসের ঘ্রাণমাখা পাহাড়ে অবস্থানরত। ইভান্স বলেছিলেন, ‘একটা তৃপ্তিকর ব্যাপার আছে, আমার মনে হয়, এই ধারণাটিতে—যে আলো লক্ষ লক্ষ বছর মহাকাশ পেরিয়ে এসেছে এবং ঠিক সেই সময়, যখন এটি পৃথিবীতে পৌঁছায়, তখন কেউ একজন ঠিক সেই আকাশের অংশটিতে তাকায় এবং সেটা দেখে ফেলে। এমন বিশাল কিছুর ঘটনাকে কাউকে প্রত্যক্ষ করতেই হবে—এটা যেন ঠিক এমনটাই হওয়ার কথা।’
এই প্রবন্ধের সমাপ্তি টানতে চাই একটি বিদেশি গানের প্রথম পঙ্ক্তির অনুবাদ দিয়ে—যেটা অনেক দিন আগে কোথাও শুনেছিলাম। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারি সেটা ছিল অত্যন্ত দার্শনিক ও গভীর বার্তা।—
“I thank the stars for you.”
আমাদের চারপাশের যে মহত্ব ও সৌন্দর্য আমরা দেখি, তা সম্ভব হতো না যদি না এই মহাবিশ্ব বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠত। কোনো আল্লাহ, ভগবান, যীশু বা ঈশ্বর ছিলেন না—আর আমাদের কোনো স্বর্গীয় হুকের জন্য অপেক্ষাও করতে হবে না, যেমনটি ড্যানিয়েল ডেনেট তাঁর বই “Breaking the Spell”-এ বলেছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ
The Royal Society. “The Public Understanding of Science (Policy).” London: The Royal Society, 1985, পৃ. ২৪.
উপলভ্য: এখানে ক্লিক করুন।
Pinker, Steven. The Blank Slate: The Denial of Human Nature in Modern Intellectual Life. New York: Viking, 2002, পৃ. ২.
Bryson, Bill. A Short History of Nearly Everything. 1st ed., New York: Broadway Books, 2003, পৃ. ৩৫.
Leave A Comment