:: নিউইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: নিউইয়র্ক (দ্বিতীয়ার্ধ) :: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি ::

ডেট্রয়েট! ‘রোবোকপ’ এর শহর ডেট্রয়েট। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘রোবোকপ’ ড্রামা সিরিজের সুবাদে ডেট্রয়েট হয়ে উঠেছে আমাদের পরিচিত শহরগুলোর মধ্যে একটি। শহরের পা দেয়ার সাথে সাথে মনে মনে কল্পনা করছিলাম, একটু পরেই বুঝি রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে আস্তে করে বের হবে রোবোকপ। কিন্তু, ড্রামা আর ম্যুভির জীবনের সাথে বাস্তবের জীবন আলাদা। তাই রোবোকপের বদলে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যে বের হলো সে আমার বিশ্ববিদ্যালয়কালীন বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এক সাথে পড়েছি। সে এখন ডেট্রয়েটে অবস্থিত ওয়েইন স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে।

ভিডিওঃ এক ঝলক ‘রোবোকপ’

ডেট্রয়েট শহরের নামকরণ করা হয়েছে ‘ডেট্রয়েট রিভার’ এর নামানুসারে। তবে, ‘মোটর সিটি’ নামেও অনেকে ডেকে থাকে এই শহরকে। এই শহর আমেরিকার সবচেয়ে বড় তিন অটোমোবাইল কোম্পানি ‘জেনারেল মটরস্‌’, ‘ফোর্ড’ এবং ‘ক্রাইসলার’- এর হোম টাউন । মিশিগান স্টেইট এর সবচেয়ে বড় ও সুপরিচিত শহর হলেও ডেট্রয়েট মিশিগানের রাজধানী নয়, মিশিগানের রাজধানী ল্যান্‌সিং। তবে, মিশিগানের রাজধানী না হলে কি হবে, এটিকে বলা হয়ে থাকে সমস্ত বিশ্বের ‘পটেটো চিপস্‌’ এর রাজধানী। ডেট্রয়েটের মানুষ সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পটেটো চিপস্‌ খেয়ে থাকে। কারা কখন কিভাবে যে এই জরিপ চালালো কিংবা ডেট্রয়েটের মানুষেরই-বা এত পটেটো চিপস্‌ খাওয়ার কি কারণ, সেটা আর খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি। মাঝখান থেকে ‘পটেটো চিপস্‌’ যে একটা শহরের পরিচয় বহন করতে পারে, সেটা জেনে পটেটো চিপস্‌’র প্রতি সন্মান বেড়ে গেলো।

ছবিঃ ডেট্রয়েট শহরের স্কাইলাইন

ছবিঃ শহর সাঁকো

ঢাকা শহরকে বুঝানোর জন্য যেমনি শাপলা চত্বর, তেমনি ডেট্রয়েট শহরকে বুঝানোর জন্য দেখানো হয় ‘স্পিরিট অব ডেট্রয়েট’ ভাস্কর্যটি। আটান্ন হাজার ডলারে ব্রোঞ্জ নির্মিত ভাস্কর্যটি বসানো আছে শহরের মিউনিসিপ্যাল সেন্টারে। ভাস্কর্যটার দেখে মনে হলো, সেটার মধ্যে কেমন জানি একটা মাসল্‌ ম্যান জাতীয় ভাব। তবে, এই মাসল্‌ ম্যান প্রতীক ব্যবহার করেও শহরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যে প্রকারেরি র‍্যাংকিং করা হোক না কেন, যে প্রতিষ্ঠান-ই র‍্যাঙ্কিং করুক না কেন, ডেট্রয়েট অপরাধী শহরের তালিকা করলে এক, দুই, তিনের মধ্যেই থাকবে। শিকাগোতে রাতের বেলা দল বেঁধে চলার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। আর ডেট্রয়েটে দিনের বেলাতেও মানুষ গাড়ির দরজা খুলে বের হতে সতর্ক থাকে।

ছবিঃ ডেট্রয়েট শহরের পরিচয় বহন করে এই ভাস্কর্যটি

ছবিঃ আমেরিকার মানচিত্রে মিশিগান স্টেইটের অবস্থান (লাল অংশটুকু)

ডেট্রয়েট শহরের বাংলাদেশী কমিউনিটি তুলনামূলকভাবে বেশ বড়ই বলতে হবে। বাংলাদেশীরা দল বেঁধে একজায়গায় বসবাস করতে পছন্দ করে। বাংলাদেশী শুধু কেন, যে কোনো দেশীরাই সেটা পছন্দ করে। ইউএসএ’র শহরগুলোতে খুঁজলেই পাওয়া যায় গ্রিক টাউন, চায়না টাউন, ইটালিয়ান ভিলেজ, জার্মান ভিলেজ। বাংলাদেশীদের এলাকায় গিয়ে বাংলাদেশী বেশ কিছু ঘর-দোকান দেখতে পেলাম। সুন্দর করে বাংলায় সাইন বোর্ড লাগানো। তবে বাংলাদেশী নয়, ডেট্রয়েট বিখ্যাত আরবীয়দের জন্য। প্রায় চারলক্ষ আরবীয়ের বসবয়াস এই শহরে। ডেট্রয়েটের ‘ডিয়ারবর্ন’ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি আরব অধ্যুষিত এলাকা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মোটর সিটি ডেট্রয়েটের মোটর কারাখানায় কাজের জন্য সর্বপ্রথম আরবীয়রা বিশেষ করে লেবানীজরা পাড়ি জমায় এ-শহরে। এখানে অবস্থিত ‘ইসলামিক সেন্টার অব আমেরিকা’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় বারোশটি মসজিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে প্রাচীণ শিয়া মসজিদ।

ছবিঃ আমেরিকায় বিভিন ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশকে সন্মান জানাতে এভাবে রাস্তার নামকরণ করা হয়, তবে সেটা রাস্তার মূল নাম নয়, রাস্তার মূল নাম অন্য একটি থাকে

ছবিঃ চটপটি, মিষ্টি, কি নেই এখানে

আরবরা থাকলে থাকলো, তাই বলে বাংলাদেশিরাও কম যায় না-কি! সৌদি আরবে না-হয় মানুষ হজ্জ্ব করতে যায়, কিন্তু বাংলাদেশেওতো মানুষ ইজতেমায় যায়। হজ্জ্বের পর মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সন্মেলন বিশ্ব ইজতেমা। অতএব, বাংলাদেশিদের নিজেদের করা একটা মসজিদ না থাকলে এই বিদেশের মাটিতে সেটা হবে অত্যন্ত লজ্জার একটা ব্যাপার। ফলে অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে এখানেও বাংলাদেশীদের করা একটি মসজিদ আছে। সেটার নাম ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ’। সারা জীবন বাংলাদেশের মাটিতে দেখে এসেছি, প্রায় সমস্ত মসজিদের পাশে বাক্স নিয়ে পাঞ্জাবী পরা একজন মানুষ বসে আছে। মসজিদের জন্য সাহায্য চায়। একতলা মসজিদ হয়ে গেলে দুই তলা করার জন্য সাহায্য চায়, দুই তিন। আর উপরে বাড়ানোর ক্ষমতা না থাকলে, পুরাতন ভেঙ্গে নতুন মসজিদের করার জন্য সাহায্য চায়। বিদ্যুৎ না থাকলে তেল কেনার জন্য, বিদ্যুৎ থাকলে ফ্যান কেনার জন্য সাহায্য চায়। ডেট্রয়টের বায়তুল মোকাররম মসজিদের ওয়েবসাইটে-এ গিয়ে দেখতে পেলাম সংস্কৃতি মানুষকে সহজে ছাড়ে না।

ছবিঃ বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ডেট্রয়েট, মিশিগান

ডেট্রয়েট শহরের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে ডেট্রয়েট রিভার। রিভারের একপাশে ডেট্রয়েট অন্যপাশে ‘কানাডা’। নদীই এখানে সীমানা নির্ধারণ করেছে। সীমান্ত আছে, তবে তাই বলে সীমান্ত্ররক্ষীরা সবসময় গুলিভর্তি রাইফেল নিয়ে বসে থাকছে না; একদেশে বসে অন্যদেশের দিকে চোখ তুলে তাকালো কেন, সেই অপরাধে শার্টের কলার চেপে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না। সীমান্ত ব্যাপারটা খুব অদ্ভূত। এটা প্রকৃতি তৈরী করে না, আমরা মানুষরা তৈরী করি। সারা পৃথিবীতে সীমান্ত নির্ধারণ করার জন্য দুইটা ভূখণ্ডকে কাল্পনিক একটা রেখা দিয়ে বিভক্ত করা হয়। তারপরও যখনই কোনো দেশের সীমান্তে যাই, কেমন জানি একটা অনুভূতি হয়। কাল্পনিক একটা রেখার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি দেখে অবাক হই।
ডেট্রয়েট রিভারের অপর পাশে কানাডা, যদিও সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। আসলে অনুমতি নেই বললে ভুল হবে। আমার যে বন্ধু ড্রাইভ করছে সে কানাডার রেসিডেন্ট, আমরা যে গাড়ীতে আছি তার নাম্বার প্লেট পর্যন্ত কানাডার। গাড়ীর মালিক, তার ফ্যামিলি, এমন কি গাড়ীরও কানাডা যাবার অনুমতি আছে; নেই শুধু গাড়ীর যাত্রীদের।

ছবিঃ কেঁপে যাওয়া হাতে, গাড়ীর ভিতর থেকে তোলা মেঘলা শহর ডেট্রয়েট

ওপারে চকচকে আলোয় উদ্ভাসিত কানাডা, এপারে আলো ঝলমলে ডেট্রয়েট শহর। এ-শহরে ক্যাসিনোর আলোই মনে হয় সবচেয়ে উজ্জ্বল। আমার নিজ শহর শিকাগো-তে ক্যাসিনো নিষিদ্ধ। শহর থেকে একটু দূরে যদিও আছে, শহরের মাঝখানটাতে নেই। শহরে কিংবা স্টেইট অনুযায়ী নিয়মগুলো ভিন্ন। যেমন, লাস ভেগাসে এয়ারপোর্ট এর ভিতরেই স্লট মেশিন বসানো। বিমানের উঠার আগে, কিছু টাকা খরচ করে উঠার ব্যবস্থা করে রেখেছে। নিউইয়র্কেও শহর থেকে কিছুটা দূরে ক্যাসিনো আছে। একেবারে শহরের মাঝখানটাতে আছে কি-না জানা হয়নি। সেখানকার ‘এম্পায়ার সিটি’ ক্যাসিনোতে গিয়ে দেখেছিলাম বেশ কিছু বাঙ্গালি মহিলা বোরখা পরে ডলারের পর ডলার দিয়ে খেলেই যাচ্ছে, টাকা হারছে আর একজনের গায়ে আরেকজন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। দেখে মনে হলো টাকা হারানো বড়ই আনন্দের ব্যাপার। অথচ, ক্যাসিনোতে খরচ করার জন্য আমার সর্বোচ্চ বাজেট বিশ ডলার। স্টুডেন্ট বলে কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কম পারিশ্রমিকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করা শ্রমিক।

ছবিঃ গ্রিকটাউন ক্যাসিনো

ডেট্রয়েটের যে ক্যাসিনোটাতে গেলাম সেটা আবার বহুতল। একটা ফ্লোর ঘুরে দেখতেই টায়ার্ড হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। আবার প্রথম ফ্লোরেরই পেছনের দিকে গিয়ে দেখি স্টেজে চলছে মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম। সুর উপেক্ষা করা আমার পক্ষে অসম্ভব, তা-সে যেই সুরেরই হোক না কেন। অবশেষে ক্যাসিনো বাদ দিয়ে গান শুনতে লেগে গেলাম। গায়িকা হেলে-দুলে নানা অঙ্গভঙ্গি করে চমৎকার গেয়ে যাচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ীতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমি গান শুনতাম। সাধারণ গলার সাধারণ বাজনার গানও ভালো লাগতো। বাংলাদেশে একটা অদ্ভূত দেশ। সত্যিকারের দামী সব জিনিসই সেখানে ফ্রি। আমাদের দেশে শিল্পীরা টিএসসি’তে যেভাবে ফ্রি মিউজিক শোনায়, সে-জিনিসটা এখানকার শিল্পীরা করে না। এখানে বড় বড় শিল্পীর কনসার্টগুলোতে যাওয়া অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। টিকিটের মূল্য গড়ে একশো ডলার বা তারও বেশি। ছোটো শিল্পীদের গানও ফ্রি নয়। ফ্রি’তো নয়ই, বরং এখানকার চলতি কথাগুলোর মধ্যে একটি হলো, ‘দেয়ার অ্যাইন্ট নো সাচ্‌ থিং অ্যাজ অ্যা ফ্রি লাঞ্চ’, সুযোগ পেলেই তারা সেটা শুনিয়ে দেবে।

ছবিঃ ক্যাসিনো সঙ্গীত

রাতের ডেট্রয়েট দেখে পরদিন যেতে শুরু করলাম ইউনিভার্সিটি অব মেশিগান। সুন্দর ক্যাম্পাসের জন্য এই ইউনিভার্সিটির সুখ্যাতি আছে। আমরা ড্রাইভ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, কিছুক্ষণ পর এত বেশি তুষারপাত শুরু হলো যে রাস্তায় গাড়ী নিয়ে এগোনোই মুশকিল হয়ে গেলো। ওদিকে, ইউনিভার্সিটি না দেখেও আমরা ফিরে যাওয়ার মানুষ না। অবশেষে, সিদ্ধান্ত হলো, রাস্তায় যেতে যেতে যে-কোনো একটা ইউনিভার্সিটির সাইনবোর্ড হলেও দেখে, তবেই বাসায় ফিরবো, ইউনিভার্সিটি না দেখে বাসায় যাবো না। তুষারপাতের কাছে পরাজয় স্বীকার করার মানে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে তিন হাজারের মত ইউনিভার্সিটি। রাস্তায় তাদের সাইনবোর্ড থাকে, তাদের ক্যাম্পাসে যাওয়ার নির্দেশনা থাকে। মনে মনে আশা ছিলো, একটা না একটা ঠিকই পেয়ে যাবো। অবশেষে, এমন এক ইউনিভার্সিটির সাইন বোর্ড খুঁজে পেলাম, বাসায় শুধু ফিরেই আসলাম না, বরং নাচতে নাচতে ফিরে আসলাম। রাস্তায় খুঁজে পাওয়া আমাদের সেই ইউনিভার্সিটির নাম ‘ম্যাডোনা ইউনিভার্সিটি’।

ছবিঃ রাস্তায় কুঁড়িয়ে পাওয়া ম্যাডোনা বিশ্ববিদ্যালয়

শহরে অবস্থানের শেষ দিন চলে গেলাম বেল্‌ আইল্যান্ড-এ। এ আইল্যান্ডের একটি বিশেষত্ব আছে। এটি আমেরিকার সবচাইতে বড় আইল্যান্ড, যেটি কি-না শহরের মধ্যে অবস্থিত একটি সিটি পার্ক।

ছবিঃ বেল আইল্যান্ড-১ (বামে কানাডা, ডানে ইউএসএ'র ডেট্রয়েট শহর)

ছবিঃ বেল আইল্যান্ড-২

ছবিঃ বেল আইল্যান্ড-৩

ছবিঃ বেল আইল্যান্ড-৪

ছবিঃ বেল আইল্যান্ড-৫

একপাশে আমেরিকা এবং অন্যপাশে কানাডাকে রেখে ডেট্রয়েট নদীর মাঝখানে চুপটি করে বসে আছে দ্বীপটি। গাড়ি চালিয়েই ব্রিজ পার হয়ে চলে যাওয়া যায় ছোট্ট দ্বীপটিতে, আর সেখানে বসে চোখ জুড়ে তাকিয়ে দেখা যায় নজরকাড়া ডেট্রয়েট শহর।

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]