:: পর্ব ১ :: পর্ব ২ ::

আমার জীবনের প্রথম পরীক্ষা ছিলো বাংলা, দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা। আমি শিশু শ্রেণী কিংবা প্রথম শ্রেণীতে পড়ার জন্য কখনো স্কুলে যাইনি। ঘরে বসে মায়ের কাছে পড়েছি। ভয় পাই বলে আমাকে স্কুলে পাঠানো হয়নি। আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা দুষ্টু প্রকৃতির, তারা বলে, ছোটোবেলায় আমি না-কি রাস্তায় মানুষ দেখলেও ভয় পেতাম; অবশ্য যারা দুষ্টু না, তারাও ওই একই কথাই বলে। কিন্তু, এতদিন ধরে তিনি আমাকে আসলেও কি পড়ালেন সেটা যাচাই করার জন্য, দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার সময় আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হলো। জীবনের প্রথম পরীক্ষাটা সাফল্যের সাথে শেষ করে বাড়ী ফিরে আসলাম। মা জিজ্ঞেস করে, “পরীক্ষা কেমন হয়েছে?” আমি বলি, “খুব ভালো।” মা বলে, “দেখি কি লিখে আসছিস?” আমি বললাম, “প্রশ্নে যা যা ছিলো পুরোটা বানান করে লিখে দিয়ে আসছি।” আমি আসলে পরীক্ষা কি জিনিস জানতাম না, যেটা প্রশ্ন দিয়েছিলো সেটা কপি করে পরীক্ষার খাতায় তুলে দিয়ে আসছি। মা’র প্রচণ্ড মন খারাপ হলো। বলেন, “তুই কি একটা ছড়াও লিখতে পারিস না।” আমি বলি, “পারিতো।” মা বলেন, “তাহলে লিখিস নাই কেন?” আমি বলি, “খালি খালি ছড়া লিখবো কেন। আমাকেতো কেউ ছড়া লিখতে বলেন নাই।”

ততক্ষণে, মা বুঝে গেছেন, ছেলেকে বাসায় বসে অনেক কিছু শিখালে-পড়ালেও পরীক্ষা কি জিনিস সেটাতো কখনো শিখানো হয়নি। অতএব, মন খারাপ হলেও, মা ব্যাপারটা মেনে নিলেন। তবে, মায়ের মন খারাপ দেখে, আমি বুঝতে পারলাম, আর কিছু করি না-করি অন্ততঃ কোনো একটা ছড়া আমার লিখে আসা উচিৎ ছিলো। যাই হোক, পরের দিন গণিত পরীক্ষা। গণিত পরীক্ষা দিয়ে আমার মন খুব ভালো। পরীক্ষা ভালো হয়েছে। গর্বিত ভাবে মায়ের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। মা আর আজ জিজ্ঞেস করে না, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। না পেরে শেষে আমিই নিজ থেকে বললাম, আজকে পরীক্ষা ভালো হয়েছে। মা বলে, “তাই না-কি! আজকেতো অঙ্ক পরীক্ষা ছিলো? কিভাবে ভালো হলো।” আমি বলি, “আজকে একটা ছড়া মুখস্থ লিখে দিয়ে আসছি।” তারপর, মা সেই যে হাসি শুরু করলো কোনোভাবেই আর হাসি থামাতে পারছিলেন না।

যথাসময়ে পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হলো। দুই বিষয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে আমি সর্বমোট ডাবল জিরো পেলাম। উপর্যুপরি দুই বিষয়ে ডাবল জিরো পাওয়ার পর আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা নিশ্চিত হয়ে গেলেন, এই ছেলে মারাত্মক মেধাবী, একে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে প্রমোশান দিয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হোক। সম্ভবত সেটাই আমার জীবনে কোথাও কাউকে ডাবল জিরো পেয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিতে দেখার একমাত্র উদাহরণ। তবে এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভালো যে, সে-সময় আমাদের প্রাইমারি স্কুলে, “কি দিয়ে ভাত খাইসো?”- এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে শিশু শ্রেণী পাস। আর, পরীক্ষায় কোনো রকমে একটা গোলাপ ফুল এঁকে দিয়ে আসতে পারলে এবং স্কুলে মধ্যাহ্ন বিরতির সময় কানামাছি ভোঁ ভোঁ করে এদিক সেদিক একটু দৌঁড়াতে পারলে প্রথম শ্রেণী পাস। মূলত, স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস করার জন্য এই দুটো শ্রেণী রাখা হয়েছে।

কিন্তু, দৌঁড়াদৌঁড়ি করা হোক আর যাই করা হোক, দুই/তিন বছর টপকে সামনে চলে আসার কারণে যে সমস্যাটা হয়েছে সেটা টের পেতে শুরু করলাম হাই-স্কুলে এসে। যে-ক্লাসেই উঠি না কেন, যত বড়ই হই না কেন, ক্লাসে সহপাঠীদের সবার থেকে বয়স কম। ছেলেদের থেকে বয়স কম সেটা না-হয় মেনে নেয়া গেলো, কিন্তু সমস্যা হলো সাথে সাথে মেয়েদের থেকে বয়সও যে কম। সহপাঠী ছেলেবন্ধুরা যখন কৈশোরের নতুন রঙিন অনুভূতিগুলো সাথে নিয়ে ক্লাসের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকছে, কিংবা অযথা অজুহাতে গিয়ে কথা বলার অপচেষ্টা করছে, তখনতো আমার পাত্তাই নেই। ক্ষেত্রবিশেষে বড়দের আলাপ বলে, অনেক সময় আড্ডার মাঝখান থেকে জোর করে তাড়িয়েও দিচ্ছে। স্কুলের সেই দিনগুলো না হয় রয়ে-সয়ে পার করা গেলো। কিন্তু, আসল সমস্যাতো হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। ভালো কথা, আমি স্কুল ছেড়ে এক লাফে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসিনি, মাঝখানে কলেজও ছিলো। কিন্তু, কলেজের কথা কিছু বললাম না। নটর ডেম কলেজে পড়েছি, সেখানে রঙিন কোনো গল্প নেই। রঙিন বলতে সেখানে আছে শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাবএ এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য কিছু ‘রাসায়নিক লবণ’।

বাংলা সিনেমায় কত দেখেছি, কত শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেম এর কথা। প্রথমেতো মনে হয়েছিলো, বিশ্ববিদ্যালয় মানেই খালি প্রেম করো। ঘটনা যে একেবারে একশতভাগ মিথ্যা, তাও না। আমার নিজের আশ-পাশেইতো কত কাপল্‌। ওরা একে অপরের দিকে কেমন করে জানি তাকায়। কিন্তু, শুধু আমার সাথে কথা বলতে আসলে সহপাঠি বান্ধবীরা বলছে, ওরা আমাকে অত্যন্ত ‘স্নেহ’ করে। আরে আজব! ক্লাসমেটকে কেউ স্নেহ করে না-কি। তবে, আজব-গজব কোনো কিছু বলেই কোনো লাভ হয় না। তারা আমাকে অবিরাম স্নেহ করেই গেলো। তখন মনে হতো, এক লাফে দ্বিতীয় শ্রেণীতে না উঠলেই পারতাম, তাহলে এমন করে আর স্নেহের যাতনায় দগ্ধ হতে হতো না। অবশেষে প্রতিজ্ঞা করলাম, এমন কিছু করতে হবে যাতে কেউ আর স্নেহ না করে। এমন সহজ-সরল-সুন্দর ‘স্নেহ’ শব্দটার সাথে তৈরী হলো আমার শত্রুতা।

এবার আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা বলি। বনানীর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। অফিসে বসে আছি। এর মধ্যেই একজন অতি উৎসাহী টাইপের স্টুডেন্ট অফিসে এলো। আমাকে বলে, খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিসো। এই বিশ্ববিদ্যালয়টা খুব ভালো। কোন কোন ক্লাস নিতে হবে, সে ব্যাপারে আমি হেল্প করবো তোমাকে। আমি বিশেষ বিব্রত হলাম। সেটা সে খেয়াল করেছে, এবার দ্বিগুণ উৎসাহে আমাকে অভয় দিয়ে বলছে, আরে নার্ভাস হবার কিছু নেই। এখানে এনভায়রোনমেন্ট খুব ভালো। সিনিয়র-জুনিয়র রিলেশানশিপও খুব ভালো। কয়েকদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি নিজেই বুঝবা। তারপর, আমাকে জিজ্ঞেস করে, পাস করসো কোথা থেকে। অবশেষে, আর না-পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোন সাবজেক্টে পড়ছেন এখানে”? উনি বলেন, “কম্পিউওটার সায়েন্স।” আমি বললাম, আমি “কম্পিউটার সায়েন্স” এ লেকচারার পোস্ট-এ অ্যাপ্লিকেশান জমা দিতে এসেছি, ডীন স্যারের জন্য অপেক্ষা করছি। তারপর, যা হবার কথা, সেগুলো সব হয়ে গেলো। কিন্তু, কিছুক্ষণ পর দেখলাম, একজন একজন করে স্টুডেন্ট আসছে, আর অফিস রুমে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখে যাচ্ছে। গ্রামের দিকে বাড়ীগুলোতে কোনো পুরুষ অতিথি এলে, বাড়ীর পর্দানশীল নারীরা টিন, বেড়া কিংবা পর্দার ফাঁক দিয়ে নিজেদেরকে আড়ালে রেখে অতিথিকে দেখার চেষ্টা করে; ক্ষণে ক্ষণে আবার অযথাই খিল খিল করে একযোগে হেসে উঠে। এখানেও সে একই ব্যাপার ঘটে চলছে! বিরক্ত হবো, না হাসবো বুঝতে পারছি না। শুধু মনে হলো, কেন যে এক লাফে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠতে গেলাম।

সে যাত্রা সেখান থেকে রক্ষা পাওয়া গেলো। আরো কিছু দিন পর ধানমন্ডির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গেলাম। ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে স্টুডেন্টরা সব হই-হই কর উঠলো। সবার একই কথা, “স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। ল্যাব দখল নিতে হবে।” দখল নিতে হবে মানে কি? আমি কি লাঠিয়াল সর্দার না-কি। সমস্ত ঘটনা শুনে দেখি, ব্যাপার আরো গভীর। কম্পিউটার ল্যাব এখানে খুব বেশি না, তাই মাঝে মধ্যেই দেখা যায় অন্য কোনো শিক্ষক ল্যাব দখল করে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার স্টুডেন্টরা গিয়ে ল্যাব-এ বসতে চাইলে যে শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন তিনি না-কি বলেছেন, “তোমাদের স্যারকে আসতে বলো” তারপর ওদেরকে ল্যাব থেকে বের করে দিয়েছেন। আর, এখন যেহেতু তাদের স্যার এসে গেছেন, তারা এখন তার প্রত্যুত্তর দেবে। ঘটনা বিশাল সাংঘাতিক, অন্য একজন শিক্ষককে তার সমস্ত স্টুডেন্ট সহকারে ল্যাব থেকে বের করে দেয়া হবে এবং সেটার নেতৃত্ব দিবে আরেকজন শিক্ষক। আনন্দে আর উত্তেজনায়, আমার স্টুডেন্টরা শুধু বলছে, “চলেন, স্যার চলেন।” সবাই একযোগে চিৎকার করে বলে, “হ্যাঁ, স্যার চলেন।”

জনগণের জোরালো দাবীর কারণে পিছু হটা সম্ভব হলো না। দরজা নক্‌ করে ভিতরে ঢুকি। পিছনে এক বিশাল দল দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, হায়! ওই শিক্ষকের চোখ থেকে আগুন বের হচ্ছে, আগে এরকম টের পেলে আমি ভুলেও আসতাম না। উনি তার সমস্ত চোখের আগুন মুখ দিয়ে বের করে বলছে, “বেয়াদঅঅঅঅঅঅঅঅব! আমি এখানেই ক্লাস নেব। তোমার স্যার আসলে তারপর উনার সাথে আমি কথা বলবো। তোমাদের সাথে কোনো কথা নয়।” আমি উনার হুঙ্কার শুনে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পিছন থেকে হো হো করে সমস্বরে হেসে উঠলো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্টুডেন্টরা। মনে হলো, গোটা সিমেস্টারজুড়ে তাদের জন্য এত বড় আনন্দের ঘটনা আর ঘটেনি। তারপর আমি উনাকে আস্তে করে বললাম, “সারা জীবন আমি দেখে এসেছি, শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন না, তাদেরকে কাকুতি-মিনতি করেও ক্লাসে আনা যায় না। নিয়ম মেনে হোক আর নিয়ম ভেঙ্গেই হোক, কারণে হোক আর অকারণেই হোক, আজকে জীবনে প্রথম দেখলাম, একজন শিক্ষককে ক্লাস থেকে বের করা যাচ্ছে না। আপনি নিশ্চিন্তে আপনার ক্লাস নেন স্যার। নো প্রোবলেম।” ততক্ষণে, তিনি যা বুঝার বুঝে গেছেন। সরি বলতে বলতে, আমার সাথে সাথেই এগিয়ে আসলেন। আমি উনাকে বললাম, “আমি খুব সন্তুষ্ট মনেই বলছি, আপনি ক্লাস নেন। আমি এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে নেব।” ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে মনে শুধু বললাম, কেন যে এক লাফে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠতে গেলাম।

এবার বলা যাক সাতাশ নাম্বারের একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্যাররা সব আরামদায়ক বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে, এক্সটার্নাল শিক্ষকদের জন্য রাখে সব মহাবিরক্তিকর সাবজেক্টগুলো। সেই ধারাবাহিকতায় আমিও পেলাম একটা মহাবিরক্তিকর সাবজেক্ট। কত রকমের আরব্য-রজনী, পারস্য-নগরীর গল্প-সল্প বলে যে বিষয়টাকে একটু ইন্টারেস্টিং করার চেষ্টা করতে হয়। হঠাৎ করে একদিন শুনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে না-কি আবার ফাইনাল পরীক্ষা হয়। সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার পরীক্ষার দিন আমাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকতে হবে। অন্য সবাজেক্ট এর স্টুডেন্টদের সাথে আমার স্টুডেন্টরাও একসাথে পরীক্ষা দিবে। পরীক্ষার দিন যথা সময়ে উপস্থিত হলাম। যথা সময়ে প্রশ্ন দেয়া হলো। প্রশ্ন দিয়ে সামনে থেকে পিছনে যাওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেলো ফিস্‌ফিস্‌ কথা বলা। আমি বললাম, কথা বলা যাবে না। সাথে সাথে সবাই আকাশ থেকে পড়লো। মনে হয়, এধরণের আজগুবি কথা তারা এ-জীবনে আর কখনো শুনেনি। কিন্তু কোথায় কি! কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো ম্যারাথন কথা বলা। একটু আগেত ফিস্‌ফিস্‌ করছিলো, এবার সবচেয়ে সামনের টেবিলে বসে, একেবারে পিছনের টেবিলে কথা শুরু হয়ে গেলো। আমি পিছনে যাইতো সামনে থেকে কথা বলে, সামনে যাইতো পাশে থেকে কথা বলে। একজন দুইজন বললে সামলানো যেতো, সবাই একসাথে কথা বলছে। আমি এই পরিস্থিতির সাথে পরিচিত না। আমার মূল কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিরিশ জনের পরীক্ষাকক্ষে আমি একজন খুব ভালোভাবেই পরীক্ষা নিয়ে ফেলতে পারি। কথা বলাতো দূরে থাক, কোনো স্টুডেন্ট এ-দিক সে-দিক সন্দেহজনকভাবে একবার ফিরলেই দুইবার কৈফিয়ত দিতে হয়। আর এখানে একজন কি, আমার সাথে আরো অতিরিক্ত একজন শিক্ষক থাকার পরও কিছুই করা যাচ্ছে না।

কোনোভাবে পরীক্ষা শেষ হবার পর, শিক্ষক লাউঞ্জে এসে দেখতে পাই আরো একজন শিক্ষক আছেন। উনার বিষয়ের পরীক্ষাও ছিলো। তিনি কিছু দিন আগে বুয়েটে থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। উনারও আমার মত একই অবস্থা। আসলে আমরা যে সিস্টেমে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, সে হিসেবে আমাদের জন্য এ-ধরণের পরীক্ষা পরিচালনা করা অসম্ভব। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, ঘটনা এখনো শেষ হয়নি, ঘটনা মাত্র শুরু। একদল ছাত্র এসে বলছে, চেয়ারম্যান কোথায়। এরা উগ্রভাবে চেয়ারম্যানকে খুঁজছে। কিন্তু চেয়ারম্যানকে পাওয়া গেলো না। বুয়েটের উনি যে হলের পরিদর্শক ছিলেন, সে হলের স্টুডেন্ট। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কি সমস্যা আপনাদের বলেন।” তারা কটকট করে বললো, “প্রশ্নও কঠিন করবেন, আবার কথাও বলতে দেবেন না, আবার পাশে দাঁড়িয়ে গার্ডও দেবেন, এটা কোন ধরণের কথা।” অর্থাৎ, স্টুডেন্টদের দাবি হলো প্রশ্ন যেহেতু কঠিন হলো, পরীক্ষার হল থাকবে ফ্রি, ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে লিখবে। সাথে সাথে তিনি উত্তর দিলেন, “প্রশ্ন কঠিন কোথায় হলো, প্রশ্নতো সহজই হয়েছে।” সাথে সাথে শুরু হলো চিৎকার। “আরে মিয়া, এই প্রশ্ন যদি আমাদের কাছে সহজ মনে হতো, তাহলেতো আর আমরা এখানে পড়তাম না, আপনার মত বুয়েটেই পড়তাম।” এ-পর্যায়ে, ‘স্যার’ যখন ‘মিয়া’তে নেমে আসলো, আমার মনে পড়ে গেলো, আমাদের বাড়ির পাশের রহমান মিয়ার কথা। রহমান মিয়া, যেখানে যে ট্যাবলেটই দেখুক না কেন, খেয়ে ফেলবে। সবাই তাজ্জব হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, “রহমান মিয়া, এই ট্যাবলেট কেন খেলে তুমি?” রহমান মিয়া হাসতে হাসতে জবাব দেয়, “কোনো না কোনো রোগতো এ ট্যাবলেট সারাবে। খেয়ে রাখলে দোষ কি!” রহমান মিয়ার উত্তর শুনে যে-রকম নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, স্টুডেন্টদের কথা শুনেও সেভাবেই কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে থাকতে হলো। তারপর কোনোভাবে আমরা দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হতভাগা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চেয়ারম্যানের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে বিদ্রোহ দমন করলাম।

গুলশানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প দিয়ে শেষ করছি। এখানে যাদেরকে পড়াতে হবে তারা বেশিরভাগই আমার বাবা-চাচার বয়সী। বাবা চাচার বয়সী লোকদেরকে পড়ানোটা কোনো সমস্যা না। সে অভিজ্ঞতা আমার আগেই ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাঝে মাঝে কিছু কম্পিউটার বিষয়ক কোর্স করাতে হতো, তারা আমার বাবা-চাচার বয়সীই ছিলেন। এখানে যারা আছেন তারা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বা সেরকম কিছু একটা। বিশ্ববিদ্যালয় উনাদেরকে বললো, আপনারা সবাই মিলে যদি একসাথে এসে ব্যাচ-এ ভর্তি হোন, তাহলে আমরা একটা সাবজেক্ট চালু করবো এবং আপনাদেরকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে ছেড়ে দেবো। যে কথা, সেই কাজ। বহু বছরের অভিজ্ঞ সব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, এসেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হতে। উনাদের ক্লাশে একদিন নাম্বার সিস্টেম পড়াচ্ছিলাম। আমি বললাম, “‘ডেসি’ শব্দটা দশ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। সে-হিসেবে ডেসিমাল নাম্বার সিস্টেমে শূণ্য থেকে নয় পর্যন্ত সর্বমোট দশটি ডিজিট আছে। আর একইভাবে ডেসিমাল মানেও হচ্ছে দশমিক, দশ থেকে দশমিক। এখন প্রশ্ন হলো, “বাই” শব্দের অর্থ যদি হয় “দুই”, তাহলে বাইনারি নাম্বার সিস্টেমে কতটা নাম্বার থাকা উচিৎ অথবা বাইনারি শব্দের এর অর্থই-বা কি হতে পারে?” একজন হাত তুলে বলেন, “স্যার বড় অশ্লীল কথা বললেন।” আমি বলি, “মানে কি?” তিনি বলেন, “বাই” মানে “দুই”, “নারি” মানে- নারী। তাহলে বাইনারি মানে-দুই নারী। সমস্ত ক্লাস কাঁপিয়ে আমার বাপ-চাচারা আদিরসাত্মক কৌতুক নিয়ে হাসিতে মেতে উঠেছে, স্বল্পমাত্রায় হলেও আমিও যোগ দিলাম তাদের সাথে। হাসির রেশ থামতে না থামতেই, আমার এতদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা মিথ্যা প্রমাণ করে একজন বলে উঠলেন, “কিছু মনে করবেন না স্যার। আমরা আসলে আপনাকে খুব স্নেহ করি!” তারপর আবার সবার সমস্বরে হাসি। বাবা-চাচার বয়সী বলা হয়তো খানিকটা বেশি হয়ে যায়, সেটা না-হোক, অন্তত পক্ষে বড় কোনো ভাইয়ের বয়সী এই লোকগুলোর হাসি দেখে সেদিন মনে হলো, এভাবে ভাবছি কেন, চাইলেইতো অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়। নাহ! সেদিন আর ভাবিনি, “কেন যে এক লাফে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠতে গেলাম।” সেইদিন থেকে অন্যভাবে চিন্তা করার শুরু, সেইদিন থেকে আর শত্রুতা নয় ‘স্নেহ’ শব্দটির সাথে, সেইদিন থেকে ‘স্নেহের সাথে ভালোবাসা’।

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]