মুক্তমনায় এই ধরনের লেখার পাঠক সংখ্যা খুবই সীমিত। এর আগে কালিদাসের মেঘদূত নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম কুমারসম্ভবের কবি নামে । সেই লেখাটি পাঠকদের পঠন আগ্রহের জায়গাতে খুব একটা নাড়া দিতে পারে নাই। অথচ কেউ যদি আমার নিজের লেখা থেকে আমার পছন্দের দুটো বা তিনটে লেখা বেছে নিতে বলে, তবে নিঃসন্দেহে আমি ওটাকেই বেছে নেবো সেই গোত্রে। পাঠক স্বল্পতার কথা মাথায় থাকার পরেও এই গাধার খাটুনিটা অবশ্য খেটে ফেলি মাঝে সাঝে বড় ধরনের গাধামি করেই।
এই লেখাটি ভ্রুণ আকারে জন্মেছিল বহুদিন আগে। আমার লেখা বানান নিয়ে আরো কিছু বকরবকর প্রবন্ধে মধুসূদনকে নিয়ে ক্যাথেরীনা একটা প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই এই ভ্রুণের জন্ম। তারপর যদিও চলে গিয়েছে অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো মাস, হয়তো বা দুটো চারটে বছরও। কিন্তু আমার আলস্যজনিত অবহেলার কারণে সেই ভ্রুণকে জঠরেই পড়ে থাকতে হয়েছে সুদীর্ঘকাল। তারপরেও আমি খুশি যে, এটাতো তবু আলোর মুখ দেখেছে। এই রকম কত ভ্রুণ অকালে মরে যাচ্ছে আমার আলস্যের বিলাসে। কে তার খবর রাখে।
এ লেখাটির জন্ম যেহেতু ক্যাথেরীনার কারণে, কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কার্পণ্য দেখাচ্ছি না কোনো। তাঁকেই উৎসর্গ করা হলো এই লেখাটি।
বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের যুগ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী সময়কে তিনি মুড়িয়ে দিয়েছেন মুঠো মুঠো মণিমুক্তো দিয়ে। মধুসূদনের আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিল মধ্যযুগে। তখন রাজত্ব চালাচ্ছিল সব প্রতিভাহীন এবং কল্পনারহিত পদ্যকারেরা। তিনিই একক প্রচেষ্টায় বিশাল এক ধাক্কা দিয়ে বাংলা কবিতাকে মধ্যযুগীয় পদ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এনে ফেলে দেন আধুনিকতার আঙ্গিনায়। এরকম দ্রোহী পুরুষ,উদ্ধত এবং আত্মম্ভর মানব, এরকম অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান কবি বাংলা সাহিত্যে আর জন্মায়নি। হয়তো আর জন্মাবেও না কোনদিন। প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথও তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। এই বিপুল পরাক্রম দেখানোর জন্য অবশ্য বাইরে থেকে তাকে ঋণ করতে হয়েছে প্রচুর। সারা বিশ্বের রত্নভাণ্ডার খুলে খুলে দেখেছেন তিনি, লুট করেছেন লাজলজ্জাহীন লুটেরার মত। যা কিছুকেই মনে হয়েছে মূল্যবান সেটাকেই তিনি নিয়ে এসে জমা করেছেন বাংলার ভাঁড়ার ঘরে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাকে অবিশ্বাস্য পরিমাণে, আবদ্ধ করেছেন অপরিমেয় ঋণে।
বাকি বিশ্বই শুধু নয়, বাংলার নিজস্ব ভাণ্ডারের দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত রত্নভাণ্ডারকেও আবিষ্কার করেছেন তিনি। চুপিসারে এগুলো পড়ে ছিল অনাদর এবং অবহেলায় ঘরের কোণে। গায়ে মেখে ছিল অযত্নের কাদামাটি। কারো চোখেই সেগুলো পড়েনি কখনো আগে। পরম যত্নে তিনি সেগুলোকে তুলে নিয়েছেন একটি একটি করে। পরিস্রুত করেছেন আপন প্রতিভার দাবানলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।
মেঘনাদবধকাব্য যখন তিনি লেখেন তখন বাংলা ছিল একটি অবিকশিত ও অশক্তিশালী ভাষা। এটি ছিল ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা। মহত্তম ভাবপ্রকাশের জন্য অপর্যাপ্ত এবং অপরিস্রুত এবং অনাদরণীয়। সমাজের চাষাভূষা মানুষের অবহেলিত ভাষা তখন সেটি। উঁচুমহলে এর কোন ঠাই ছিল না।
এরকম একটি অবিকশিত এবং হতদরিদ্র ভাষায় মেঘনাদবধকাব্য লেখা দুঃসাধ্যেরই নামান্তর। এর বাস্তবায়ন এক অসম্ভব কল্পনার নাম। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন তিনি করেছিলেন প্রবল জেদে, স্বভাবজাত একগুয়েমিতে। বাংলা সাহিত্যে সত্যিকারের মহাকাব্য রচনার অসম্ভব কল্পনাকে হাতের মুঠোর বাস্তবতায় পরিণত করেছিলেন অপরিমেয় প্রতিভার প্রখর ঝলকানিতে।
এর জন্য অবশ্য তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল নিজস্ব ভাষা ও ছন্দ। মন্থন করতে হয়েছিল সমুদ্র, মহাসমুদ্র। সাগরতলে লুকায়িত বাংলার রত্নভাণ্ডার থেকে রত্ন আহরণের জন্য দক্ষ ডুবুরির মত ডুব দিয়েছেন তিনি। ছেঁকে ছেঁকে তুলে এনেছেন সব মণি-মাণিক্য। ভয়ডরহীন ডাকুর মত হানা দিয়েছেন সমৃদ্ধশালী প্রতিবেশী সংস্কৃতের রত্নভাণ্ডারে। তারপর সেই লুণ্ঠিত রত্নরাজিকে মিশিয়েছেন চলিতের সাথে সুদক্ষ কারিগরের সুনিপুণ কৌশলে। তারপরও যখন প্রয়োজন মেটেনি,নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন নতুন নতুন সব প্রয়োজনীয় শব্দ।
বর্তমান সময়ে এসে চিন্তা করলে মধুসুদনের কাব্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহ অনেক দূরুহ, জটিল এবং অবোধ্য। অভিধানের পাতায় পাতায় শুয়ে থাকা বিপুল ওজনাকৃতির অব্যবহৃত শব্দ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এগুলোর সুদক্ষ এবং সুনিপুণ ব্যবহার করেই একদিন তিনি বাংলার মত অবহেলিত অনুজ্জ্বল ভাষাকে দীপ্তিময় করেছিলেন। হতচ্ছিন্ন মলিন গ্রাম্য পোশাক পালটিয়ে এর গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন আধুনিকতার উজ্জ্বল উত্তরীয়।
একজন মধুসুদন শুধু মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য এবং আধুনিক বাংলা সাহি্ত্যের সেতুবন্ধনই করেন নি, তিনি নিজেও ছিলেন আপাদমস্তক আধুনিক। বরং বলা চলে এখনকার অনেক আধুনিক কবির চেয়েও তিনি ছিলেন অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি প্রতিভাবান, অনেক বেশি ঝড়ো হাওয়া। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূচনা করেছেন তিনি। বিস্ময়কর হচ্ছে যে আজকে দেড়শো বছর পাড়ি দিয়েও তিনিই রয়ে গিয়েছেন আধুনিকতম। হুমায়ুন আজাদ তাঁর মাইকেল মধুসূদনঃ প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা প্রবন্ধে লিখেছেনঃ
কোনো স্বাদেশিক, বাঙলার কাদামাটির গন্ধমাখা কবির পক্ষে রচনা করা সম্ভব ছিলো না মেঘনাদবধকাব্য; পশ্চিমের সাথে যাঁর আন্তর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে নি, তাঁর পক্ষে কৃষ্ণকুমারী নাটক বা চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছ রচনা চরম দুঃস্বপ্ন। ঋণ করে মধুসূদন নিত্য অভিনব সামগ্রী সৃষ্টি করেন। বাঙলা ভাষার আকাশেবাতাসে যা কোনোদিন কল্পিত হয় নি, তা একদিন বাস্তব রূপ নেয় বাঙলা ভাষায়, মধুসূদনের আঙুলে। বিরামহীন অভিনবত্বের নামই মাইকেল মধুসূদন। যা ছিলো না, তিনি স্রষ্টা তাঁর; শুধু স্রষ্টা নন, তিনিই শ্রেষ্ঠ অনেক ক্ষেত্রে। বাঙলা ভাষায় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যদিও অনুকারী রয়েছে অনেক। এমনকি বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের চেয়েও তিনি বলিষ্ঠ প্রতিভা। তিনি পশ্চিম থেকে ঋণের যে রাস্তা খুলে দেন, সে পথেই চলেছেন বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁরা কেউ মধুসূদনের মতো তীব্র বিশালত্বমুখি ছিলেন না। বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম কল্পনা ও পরিকল্পনা মেঘনাদবধকাব্য; এক শতাব্দী পরেও বিস্ময়বোধ করতে হয় একথা ভেবে যে মধুসূদন ওই মহৎ কল্পনাকে কাব্যবাস্তবে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এমন এক সময়ে যখন বাঙলা ভাষা ছিলো একটি আঞ্চলিক, ক্ষুদ্র গোত্রের, অনেকটা কৃষিসম্প্রদায়ের ভাষা, যার মানরূপ তখনো অনির্ধারিত।
মধুসূদনের পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণা এবং আধুনিকতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ যেখানে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ এবং উদার, সেখানে আহমদ শরীফ ছিলেন কুণ্ঠাপ্রবন এবং কৃচ্ছ। মধুসূদনের ভাব, ভাষা, ছন্দ নিয়ে তাঁর কোনো আপত্তি ছিলো না। এগুলো যে মধুসূদনই বাংলা সাহিত্যে এনেছেন একথাকে স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু মধুসূদন সমসাময়িক চেতনাকে ধারণ করতে পারেন নি বলে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন তিনি। তাঁর মতে, মধুসূদন ছিলেন চেতনায় পিছিয়ে পড়া একজন মানুষ। আধুনিক যুগের বদলে তিনি ঘোরাফেরা করেছেন প্রাচীন এবং মধ্য যুগের প্রতীচ্যে। তাঁর ভাষাতেইঃ
মধুসূদন ভাবে, ভাষায়, ছন্দে ও আঙ্গিকে যা কিছু আনলেন তা এদেশে নতুন বটে, তবে তাতে সমকালীনতা বা স্বাদেশীকতা ছিল না। আঠারো শতক-পূর্ব য়ূরোপীয় সাহিত্য-চেতনাই ছিল তাঁর সম্বল, সারাজীবনে তিনি তা অতিক্রম করতে পারেন নি। প্রাচীন গ্রীক-ল্যাতিন সাহিত্য থেকে সতেরো শতকের জন মিল্টন-সাহিত্য অবধি ছিল তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, আঙ্গিকে কিংবা চেতনায় তিনি য়ূরোপীয় আঠারো শতক অতিক্রম করে তাঁর সমকালীন কিংবা ঈষৎ পূর্বকালীন য়ূরোপীয় অথবা সমকালীন স্বদেশকে ধারণ করতে সমর্থ হন নি।
ফলে, প্রাচীন ও মধ্য যুগের য়ূরোপীয় চেতনা এবং প্রাচীন ভারতীয় বিষয়ববস্তুই হয়েছে তাঁর সাহিত্যের অবলম্বন। অথচ তাঁর সমকালের অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনকি টুলো পণ্ডিত রামনারায়ন তর্কারত্নও সমকালীন য়ূরোপীয় জীবন-চেতনা ও জগৎ-ভাবনাকে একান্তভাবে জানায় ও গ্রহণে প্রয়াসী ছিলেন স্বাদেশিক কল্যান বাঞ্ছনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। এঁরা কেউ লন্ডন-প্যারিস দেখেননি, কিন্তু মধুসূদন সেখানে বাস করেছেন এবং তাঁর জ্ঞানের জগৎও ছিল বিস্তৃততর। মধুসূদনের চেতনায় য়ূরোপীয় আস্তিক্য, নাস্তিক্য, সংশয়বাদী কিংবা প্রত্যক্ষবাদী কোন দর্শনেরই প্রভাব নেই, নেই ফরাসী বিপ্লব বা আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের আভাস, এমনকি বিজ্ঞানে কিংবা ইতিহাসেও তাঁর আগ্রহের প্রমাণ মেলে না তাঁর রচনায়। (মধুসূদন ও আধুনিকতা)
তিনি মহাকাব্য লিখেছেন, সনেট লিখেছেন, বিয়োগান্ত নাটক লিখেছেন, লিখেছেন প্রহসন। এসবের কোনোটা তাঁর আগে আর কোনো বাঙালি লেখেন নি। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র ছয় বছর। অথচ এই স্বল্পকালকে বিশালত্ব এবং বৈচিত্র্যমুখিতায় ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি। অমিত্রক্ষর ছন্দের জনক তিনি। এর আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিলো ছন্দমিলের মিত্রাক্ষর ছন্দে। বাংলায় যে এরকম অভূতপূর্ব ছন্দ হতে পারে এবং সেই ছন্দে যে চিরস্থায়ী কাব্য রচনা করা যায় তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তাঁর অমিত প্রতিভা দিয়ে।
বাংলা কাব্যের আসরে মধুসূদনের যাত্রা মহাসমারোহে, ঢাকঢোল দামামা দুন্দুভি বাজিয়ে, আড়ম্বরে, সদম্ভ আস্ফালনে। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য দিয়ে এই উর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু। ১৮৬০ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এই কাব্য ছিল মহাযাত্রার গা গরম করা অনুশীলন। তিলোত্তমাসম্ভবের কাহিনি পৌরাণিক, কিন্তু রূপায়নে পাশ্চাত্য রীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। নিজের গা গরমের সাথে সাথে অপ্রস্তুত বাঙালি পাঠককে অজানা ভূবনে নিয়ে যাবার মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন ছিল তখন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য ছিল সেই মহারণের প্রস্তুতিপর্ব। কাব্য রচনার ক্ষেত্রে অসামান্যতা প্রদর্শন করলেও এই কাব্য বাঙালির হৃদয় সেভাবে জয় করতে পারে নি। এতে মধুসূদনের প্রতিভার সর্বোত্তম ব্যবহার নেই সত্যি, তবে বিশিষ্ট হবার জন্য, কালোত্তীর্ণ হবার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই ছিল এই কাব্যে। সুন্দ ও উপসুন্দ নামের দুই অমিত শৌর্যবীর্য দানব ভ্রাতার কাহিনি এটি। এদের দাপটে শংকিত দেবতারা। ব্রক্ষ্মার বুদ্ধিতে বিশ্বকর্মা সারাবিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য তিলে তিলে আহরণ করে গড়ে তোলেন অপূর্ব রূপসী এক নারী। নাম তিলোত্তমা। এই তিলোত্তমাকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে যায় সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাই।
তিলোত্তমাসম্ভবের প্রস্তুতিপর্ব শেষ হবার পরে মধুসূদন ঝোলা থেকে বের করেন তাঁর সেরা কাব্যটি। মেঘনাদবধ। শুধু মধুসূদনেরই নয়। এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের এটিই সেরা কাব্য। এই কাব্যের কাহিনি পরিকল্পনায়, ছন্দ-নৈপুণ্যে এবং চরিত্রচিত্রণে মধুসূদনের প্রতিভা অত্যুজ্জ্বল মহিমায় উদ্ভাসিত। রামায়নের মূল কাহিনি থেকে আখ্যানটি নেওয়া, কিন্তু এর পরিকল্পনা ও আঙ্গিক রূপায়নে ইউরোপিয় সাহিত্যের বিপুল প্রভাব রয়েছে। মধুসূদন সুস্পষ্ট সচেতনতায় পাশ্চাত্য কবিকূলের অনুসরণ করেছেন। হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিলটন, ট্যাসো দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি। তারপরেও বলা যায় যে, বিস্ময়কর এবং প্রতিভার মৌলিকতার কারণে এই রচনা অনুকৃতি দোষে দুষ্ট হয় নি এবং এর উৎকর্ষও ক্ষুণ্ণ হয় নি কোনো অংশ। প্রতিভার মৌলিকতা ছাড়া, শুধুমাত্র অনুকরণ, অনুসরণ করে কোনো কবিই চিরজীবী হতে পারেন না। মধুসূদনের অপার প্রতিভার স্পর্শেই প্রাচ্য থেকে কাহিনি এবং প্রতীচ্য থেকে আঙ্গিক গঠন এবং অলংকরণ নেবার পরেও মেঘনাদবধ বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী কাব্যগাথা।
মধুসূদন প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রতীচ্যে পড়ে আছেন একথা বলার পরেও তাঁর উপরে ইউরোপের রেঁনেসার প্রভাবকে অস্বীকার করেন নি আহমদ শরীফ। এই প্রভাব ততকালীন সমাজে সবচেয়ে আগে পড়েছিল মধুসূদনের উপরে। আর এর প্রভাবেই নতুন জানালা খুলে দিলেন তিনি বাকিদের জন্য। মধুসূদনের খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েই পাশ্চাত্যকে দেখেছে বাংলার সাহিত্যসেবীরা।
আমাদের সৃজনশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদনই প্রতীচ্যের প্রথম চিত্তদূত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের য়ূরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিই ছিল তাঁর অনুধ্যানের বিষয়। তিনি ছিলেন grand and sublime এর অনুরাগী। grandeur ও grandiose ঊনিশ শতকী য়ূরোপে ছিল বিরল, তাই তাঁর মানস-পরিক্রমের ক্ষেত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগেই রইল সীমিত। আধুনিক য়ূরোপ কিংবা ভারত তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।
তবু য়ূরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব তাঁর মধ্যেও দেখি- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতিপ্রেম, স্বদেশপ্রীতি, পুরুষকারে আস্থা, ঐহিক জীবনবাদ, বিদ্রোহানুরাগ, ব্যক্তিসত্তায় ও মানবপ্রীতিতে গুরুত্ব এবং হৃদয়াবেগে মর্যাদাদান প্রভৃতি তাঁরও রচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। ফলে আঙ্গিকে তিনি ক্লাসিক হলেও প্রেরণায় পুরোপুরি রোমান্টিক। আমরা জানি, মধুসূদন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংরেজিতে কাব্যরচনা করে অমর হবার বাসনায়। বাজি রেখে বাঙলা রচনায় হাত দিলেন, এজন্যে তাঁর প্রস্তুতি ছিল না। সে বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। বাঙালিকেও জিইয়ে ছিলেন নিস্পন্দ ধড়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে বাঙলার সমাজে ও সাহিত্যে, মননে ও মেজাজে মধুসূদনই প্রথম সার্থক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী, পথিকৃৎ ও যুগস্রষ্টা। ভাবে ও ভাষায়, ভঙ্গিতে ও ছন্দে এবং রুপে ও রসে অপরূপ করে তিনি নতুন জীবন ও জগতের পরিচয় করিয়ে দিলেন বাঙালির সঙ্গে। এ দক্ষতা সেদিন আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি, যদিও ইংরেজ শিক্ষিত গুণী-জ্ঞানীর সংখ্যা নেহাত নগণ্য ছিল না সেদিনকার কোলকাতায়। (মধুসূদনের অন্তর্লোক – আহমদ শরীফ)
মেঘনাদবধ কাব্যে তিনি একটি অচিন্তনীয় এবং অভাবনীয় ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। রাম এবং রাবণের চরিত্র আমরা যেরকম করে জানি, তিনি সেটিকে উলটে দিয়েছিলেন স্পন্দিত স্পর্ধায়। বাল্মিকীর রামায়নে রাম সৎ, সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং দয়াবান। রাবণ পাপীতাপী, অন্যায়কারী ও অত্যাচারী। কিন্তু মধুসূদনের মহাকাব্যে রাম ভীরু, শঠ, প্রতারক এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ। রাবণ সাহসী পুরুষ, স্নেহময় পিতা, প্রজাহৈতিষী। দেবতাদের চক্রান্ত ও কোপানলে পড়ে তিনি একজন বিরহী ও দুঃখী মানুষ। তিনি রামায়ন নির্দেশিত পথে না চলে রাক্ষস বংশের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছেন। তাঁর কাব্যে রাক্ষসেরা বীভৎস এবং ঘৃণ্য কোনো প্রাণী নয়, বরং আমাদের মতই আবেগ-অনুভূতিতে পূর্ণ মানুষ। রাবণ চরিত্রের জন্যই মেঘনাদবধ কাব্য করুণ রসের আধার হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধ অমিততেজী বিদ্রোহী রাবণের পরাজয়ের বেদনা কাহিনি। নিষ্ঠুর নিয়তি রাবণের সর্বনাশ করেছে, দেবতারা তাঁর বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্র করেছে। এর ফলে একের পর এক পরাজয়ের কলংকচিহ্ন যুক্ত হচ্ছে তার কপালে। তারপরও তার অনমনীয় এবং উদ্ধত পৌরুষ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মেঘনাদবধের রাবণ যেন মধুসূদন নিজেই। তার জীবনেও এই একই দুর্বিনীত সংগ্রাম এবং করুণ পরাজয়ের শোকগাথা লেখা রয়েছে। এই শোকগাথার জন্য অবশ্য অন্যেরা যতটুকু না দায়ী, তিনি নিজেও তার চেয়ে বেশি দায়ী।
মধুসূদনকে আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষাপুষ্ট, আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসু, নবমানবতার উদগাতা আভিজাত্যগর্বী পরিশীলিত রুচির কবি এবং ধন-যশ-মান-লিপ্সু উচ্চাভিলাষী মানুষ বলেই জানি এবং মানি। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ছিল অসামান্য, প্রয়াস ও সাধনা ছিল নিখাদ, আর আকাঙ্খা ছিল ধ্রুব। আকাঙ্খা তো নয় যেন যোগ্যতালভ্য দাবী! তাঁর অটল আত্মবিশাসই তাঁর উদ্ধত উক্তি ও দাম্ভিক আচরণের উতস। কৈশোরে ও যৌবনে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর চাওয়া আর পাওয়া নিয়তির মতো অমোঘ। তাঁর এমনি আত্মপ্রত্যয় তাঁকে শিশুর মতো খেয়ালি, প্রানবন্ত, বেপরওয়া ও উদ্ধত করেছিল। আমাদের চোখে যা অবিমৃষ্যকারিতা ও অপরিণামদর্শিতা, তাঁর কাছে তা-ই ছিল লক্ষ্য-নির্দিষ্ট অকৃত্রিম জীবন-প্রয়াস। তাঁর সীমাহীন আত্মপ্রত্যয় তাঁকে নিশ্চিত সিদ্ধির যে প্রত্যক্ষ-মরীচিকায় নিশ্চিন্ত করে রেখেছিল, উত্তর-তিরিশে তা যখন নিয়তির ছলনারূপে প্রতিভাত হল, তখন হতাশায় ও হাহাকারে তাঁর মন-মরু কুঁকড়ে কেঁদে উঠল! তারই প্রতিচ্ছবি পাই আমরা তাঁর অমর কাব্যে ও রাবণ চরিত্রে। (নতুন দৃষ্টিতে মধুসূদন – আহমদ শরীফ)।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের অভিনব সৃষ্টি। বাঙালির কান এই অশ্রুতপূর্ব ছন্দে অভ্যস্ত ছিলো না। বাংলা ভাষায় যে এর প্রয়োগ হতে পারে, সে যুগে কেউ তা বিশ্বাস করতো না। এরকম একটি নতুন ছন্দকে ব্যবহার করে কাহিনিকে জিইয়ে রাখা সহজ কাজ ছিলো না। কিন্তু মধুসূদন সাফল্যের সাথে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল কাঠামোটি পয়ারের। অর্থাৎ প্রতি চরণে চৌদ্দ মাত্রা। অভ্যন্তর হলন্ত অক্ষর এক মাত্রা বলে যুক্তাক্ষর বহুল। অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল লক্ষণ তাই। পার্থক্য হচ্ছে পয়ারের প্রতি পঙতিতে ভাবসম্পূরণ, অষ্টম অক্ষরের পরে সুনির্দিষ্ট যতি ও উপচ্ছেদ এবং পদান্ত মিল অর্থাৎ অন্ত্যানুপ্রাস থাকে। কিন্তু অমিত্রাক্ষর ছন্দ এই বন্ধনের নির্দেশ অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে ভাবের আনুগত্য করে। এতে ভাবের প্রবাহ পঙতিসীমায় এসে থেমে যায় না। আবার পঙতির মধ্যে প্রয়োজনীয় ছেদ বিন্যাস করে বর্ণনাকে জীবন্ত এবং সৌন্দর্যময় করে তোলা যায়। তবে, পয়ার ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দের এই ব্যবহার অনভ্যস্ত বাঙালি শুরুতে মেনে নিতে পারে নি। সেই সময় অনেকেই কোমর বেধে নেমে পড়েছিলেন এর বিরোধিতায়।
পুরো কাব্য জুড়ে আলংকারিক ভাষার ছড়াছড়ি। নদী-গিরি, সন্ধ্যা-প্রভাত, উদ্যান-অট্টলিকার বর্ণনায় মধুসূদন ভাষার ঐশ্বর্যকে অকাতরে পাত্রে ঢেলেছেন। অলংকারের সৌন্দর্যে, ভাষার মাধুর্যে, অজস্র শব্দ ব্যবহারে এবং ছন্দের অভিনবত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে মেঘনাদবধ কাব্য খণ্ডকাব্যের খণ্ডিত পর্যায় অতিক্রম করে মহাকাব্যের বিশালতায় উঠে গিয়েছে।
মেঘনাদবধ কাব্য কি করুণ রসে সিক্ত? এর প্রধান রস কি করুণরস? এর উত্তর হ্যাঁ বোধক। এই কাব্যের প্রধান সমালোচকেরা একে করুণরসাত্মক হিসাবেই বর্ণনা করেছেন। বিদেশী কর্তৃক আক্রান্ত, পর্যুদস্ত, রাবণ বংশগৌরব এবং জাতীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ করে বসে আছেন এবং প্রতিকূল দৈবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রাবণের এই মর্মবিদারক ব্যথাই কাব্যখানির বিষয়বস্তু। রাবণের দুঃখের সাথে একাত্মবোধের জন্যই কাব্যখানি বিষাদগ্রস্ত হয়েছে এবং করুণ রসের প্রাধান্য ঘটেছে। তবে, পাশ্চাত্য মহাকাব্যের অনুকরণে রচিত বলে এতে পাশ্চাত্যের মহাকাব্যের মতই বীররসাশ্রিত। কিন্তু পরাজিত রাক্ষস বংশের প্রতি প্রবল সহানুভুতিতে বীররসকে প্রধান রস হিসাবে রাখতে পারেন নি পাশ্চাত্যের মত। একে ছাড়িয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে করুণরসই। আগাগোড়াই হাহাকারের কাব্য এটি। করুণরস এবং বীররসের বাইরেও এখানে শৃঙ্গার রস, ভয়ানক, বীভৎস এবং অদ্ভুত রসের সমাহার ঘটেছে প্রাচ্যীয় কায়দায়।
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, বঙ্গভাষায় ইহার তুল্য দ্বিতীয় কাব্য দেখা যায় না। নিবিষ্ট চিত্তে যিনি মেঘনাদবধ কাব্যের শঙ্খধ্বনি শুনিয়াছেন, তিনিই বুঝিয়াছেন যে বাংলা ভাষার কতদূর শক্তি এবং মধুসূদন কি ক্ষমতাসম্পন্ন কবি। শুধু হেমচন্দ্রই নয়, রবীন্দ্রনাথও ইতিবাচকভাবে দেখেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্য। তিনি বলেছিলেন, কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙিয়াছেন, এবং রাবণের সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে আমাদের মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহারও শাসন ভাঙ্গিয়াছেন।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে যে, এই রবীন্দ্রনাথই কিশোর বয়সে মেঘনাদবধ কাব্যের কঠোর ভাষায় তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত মেঘনাদবধ কাব্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেনঃ
“… যাঁহারা মহাকবি হইতে প্রতিজ্ঞা করিয়া মহাকাব্য লেখেন তাঁহারা যুদ্ধকেই মহাকাব্যের প্রাণ বলিয়া জানিয়াছেন; রাশি রাশি খটমট শব্দ সংগ্রহ করিয়া একটা যুদ্ধের আয়োজন করিতে পারিলেই মহাকাব্য লিখিতে প্রবৃত্ত হন। পাঠকেরাও সেই যুদ্ধবর্ণনামাত্রকে মহাকাব্য বলিয়া সমাদর করেন।… হেমবাবুর বৃত্রসংহারকে (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য, ১৮৭৫-৭৭) আমরা এইরূপ নাম-মাত্র-মহাকাব্য শ্রেণীতে গণ্য করি না, কিন্তু মাইকেলের মেঘনাদবধকে আমরা তাহার অধিক আর কিছু বলিতে পারি না।… মেঘনাদবধের অনেক স্থলেই হয়তো কবিত্ব আছে, কিন্তু কবিত্বগুলির মেরুদণ্ড কোথায়! কোন অটল অচলকে আশ্রয় করিয়া সেই কবিত্বগুলি দাঁড়াইয়া আছে!… সেই অভ্রভেদী বিরাট মূর্তি মেঘনাদবধ কাব্যে কোথায়? কতকগুলি ঘটনাকে সুসজ্জিত করিয়া ছন্দোবন্ধে উপন্যাস লেখাকে মহাকাব্য কে বলিবে? মহাকাব্যে মহৎ চরিত্র দেখিতে চাই ও সেই মহৎ চরিত্রের একটি মহৎ কার্য মহৎ অনুষ্ঠান দেখিতে চাই। হীন ুদ্র তস্করের ন্যায় নিরস্ত্র ইন্দ্রজিৎকে বধ করা, অথবা পুত্রশোকে অধীর হইয়া লক্ষ্মণের প্রতি শক্তিশেল নিপে করাই কি একটি মহাকাব্যের বর্ণনীয় হইতে পারে? এইটুকু যৎসামান্য ক্ষুদ্র ঘটনাই কি একজন কবির কল্পনাকে এত দূর উদ্দীপ্ত করিয়া দিতে পারে যাহাতে তিনি উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে একটি মহাকাব্য লিখিতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইতে পারেন? রামায়ণ মহাভারতের সহিত তুলনা করাই অন্যায়, বৃত্রসংহারের সহিত তুলনা করিলেই আমাদের কথার প্রমাণ হইবে। স্বর্গ-উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ যথার্থ মহাকাব্যের উপযোগী বিষয়। আর, একটা যুদ্ধ, একটা জয় পরাজয় মাত্র, কখনও মহাকাব্যের উপযোগী বিষয় হইতে পারে না।… মেঘনাদবধ কাব্যে ঘটনার মহত্ত্ব নাই, একটা মহৎ অনুষ্ঠানের বর্ণনা নাই। তেমন মহৎ চরিত্রও নাই।… মহৎ চরিত্র যদি-বা নূতন সৃষ্টি করিতে না পারিলেন, তবে কোন মহৎকল্পনার বশবর্তী হইয়া অন্যের সৃষ্ট মহৎ চরিত্র বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন?… তিনি কোন প্রাণে রামকে স্ত্রীলোকের অপেক্ষা ভীরু ও লক্ষ্মণকে চোরের অপেক্ষা হীন করিতে পারিলেন! দেবতাদিগকে কাপুরুষের অধম ও রাসদিগকেই দেবতা হইতে উচ্চ করিলেন! এমনতর প্রকৃতিবহির্ভূত আচরণ অবলম্বন করিয়া কোনও কাব্য কি অধিক দিন বাঁচিতে পারে? মাইকেল ভাবিলেন, মহাকাব্য লিখিতে হইলে গোড়ায় সরস্বতীর বর্ণনা করা আবশ্যক, কারণ হোমর তাহাই করিয়াছেন; অমনি সরস্বতীর বন্দনা শুরু করিলেন। মাইকেল জানেন অনেক মহাকাব্যে স্বর্গ-নরক-বর্ণনা আছে; অমনি জোর-জবর্দস্তি করিয়া কোনও প্রকারে কায়কেশে অতি সংকীর্ণ, অতি পার্থিব, অতি বীভৎস এক স্বর্গ-নরক-বর্ণনার অবতারণ করিলেন। মাইকেল জানেন কোনও কোনও বিখ্যাত মহাকাব্যে পদে পদে স্তুপাকার উপমার ছড়াছড়ি দেখা যায়; অমনি তিনি তাঁহার কাতর পীড়িত কল্পনার কাছ হইতে টানাহেঁচড়া করিয়া গোটা কতক দীনদরিদ্র উপমা ছিঁড়িয়া আনিয়া একত্র জোড়াতাড়া লাগাইয়াছেন। তাহা ছাড়া, ভাষাকে কৃত্রিম ও দুরূহ করিবার জন্য যত প্রকার পরিশ্রম করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত তাহা তিনি করিয়াছেন। কাব্যে কৃত্রিমতা অসহ্য এবং সে কৃত্রিমতা কখনও হৃদয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিতে পারে না। আমি মেঘনাদবধের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লইয়া সমালোচনা করিলাম না আমি তাহার মূল লইয়া তাহার প্রাণের আধার লইয়া সমালোচনা করিলাম, দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই। দেখিলাম তাহা মহাকাব্যই নয়।…”
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর কাঁচা বয়সের এই কাঁচা সমালোচনাকে পরিণত বয়সে আর ধরে রাখেন নি। ওই বয়সে যেখানে তাঁর সন্দেহ ছিলো যে, মেঘনাদবধ কাব্য হবে স্বল্পজীবী, সেখানে পরিণত বয়সে এসে তিনি এঁকে অমর কাব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই অমর কাব্যে নখরাঘাত করে নিজেও অমরত্ব পাবার ইচ্ছা থেকেই ওই রকম কঠোর সমালোচনা করেছিলেন বলে আত্মস্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ইতিপূর্বেই আমি অল্প বয়সের স্পর্দ্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস কাঁচা সমালোচনাও গালি-গালাজ। অন্য মতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার মতাটা খুব তীব্র হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপো সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম।
রবীন্দ্রনাথের অমর কাব্যের আখ্যার অপেক্ষায় অবশ্য মধুসূদন বা মেঘনাদবধকে থাকতে হয় নি। ওই সৃষ্টির দেড়শো বছর পরে এসে আমরা দেখছি যে সৃষ্টি এবং স্রষ্টা দুজনে অমরত্বের পথে অবিচল অগ্রসরমান। বাংলা কাব্য রচনায় মধুসূদনের কীর্তি অতুলনীয়। তাঁর অতুলস্পর্শী প্রতিভায় এবং বৈদগ্ধে বিমুগ্ধ হই আমরা। কাব্যদেবীর কৃপা যেন কলস্বরে এসে ভাসিয়েছিল তাঁকে। তিনি যে সময়ের কবি সেই সময় বাংলার নবজাগরণের কাল। সাহিত্যের গতানুগতিক অনুজ্জ্বল এবং একঘেয়ে ধারায় পিয়াস মিটছে না আর শিক্ষিত বাঙালির। কিন্তু নতুন কিছুও সৃষ্টি হচ্ছে না এই নবরুচির সাথে সঙ্গত করার জন্য। বাঙালির এই নবজাগ্রত সাহিত্য রুচির রসনা মেটাতে নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব তুলে নেন মধুসূদন। শুধু দায়িত্ব তুলে নিয়েই ক্ষান্ত হন নি তিনি। যুগসন্ধিক্ষণে সমস্ত সংস্কারকে ভেঙেচুরে জাঁহাবাজ জাহাজির মতো সাগরে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর সাম্পান প্রবহমান সমীরণকে উপেক্ষা করে।
আমাদের সাহিত্যদ্রোহীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি; মধ্যযুগ থেকে তিনি কয়েক বছরে বাঙলা সাহিত্যকে নিয়ে আসেন আধুনিক কালে। এমন এক সময়ে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন, এবং জন্ম দিচ্ছিলেন তাঁর স্পর্ধিত রচনাবলি, যখন বিনয়-বিকাশ-ক্রমমুক্তি কাজে আসতো না কোনো। তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের মতো ক্রমবিকশিত হওয়ার সাধনার অর্থ ছিলো ব্যর্থতা। তাঁর সার্থকতা আকস্মিক বিস্ফোরণে, চারপাশে হঠাৎ তীব্র আলোকে ভরে দেয়ায়। তাঁর সংস্কারমুক্তি, বিশ্বপরিব্রাজকতা, অতৃপ্তি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিলো হঠাৎ সফল হয়ে বিনাশের অভিমুখে ধাবিত হবার। মধুসূদনের মধ্যে যে বিক্ষোভ, বিনাশ ও মহান অশুভকে পাই, তা বর্তমান সময়ের বান্ধব। তাঁর সংস্কারমুক্তি ঈর্ষা জাগায় আমাদের; এখন আমরা প্রতিদিন বাঁধা পড়ছি এক একটি সংস্কারের শেকলে, খুলে বেরোতে না বেরোতেই নতুন কোনো শেকলে জড়িয়ে পড়ে আমাদের শিল্প ও জীবনভাবনা। কিন্তু মধুসূদন সমস্ত সংস্কার পরিহার করতে পেরেছিলেন বলে তিনি যেমন প্রথাগত বিশ্বাসের বিরোধী কল্পনাকে মূল্যবান করে তুলতে পেরেছিলেন একের পর এক নতুন সাহিত্য আঙ্গিক সৃষ্টি করতে। তাঁর রাম-রাবণ পরিকল্পনা মহত্তম দুঃসাহসের উদাহরণ, এমন সংস্কারমুক্তির পরিচয় বাঙলা ভাষায় আর পাওয়া যায় না। মধুসূদন এমন কাজ করে গেছেন মেঘনাদবধকাব্যে, যা সাম্প্রতিক হিন্দু মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। তিনি যখন একের পর এক নতুন সাহিত্য-আঙ্গিক সৃষ্টি করছিলেন, পয়ার ভেঙে ফেলে বইয়ে দিচ্ছিলেন প্রবহমাণ অক্ষরবৃত্ত, রচনা করছিলেন নিষিদ্ধ ট্রাজেডি, বা সৃষ্টি করছিলেন অভিনব চতুর্দশপদী, তখন সংস্কারমুক্তির কাজ করেছে প্রধান প্রেরণারূপে। (মাইকেল মধুসূদনঃ প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা – হুমায়ুন আজাদ)
মান্যবর ফরিদ আহমেদ,
আজ আপনার লেখাটা পড়লাম। আমি মুক্তমনার অল্পদিনের পাঠক। সাহিত্য সম্বন্ধে আমার ত্ত জ্ঞান নেই। তবে স্কুলে মধুসূদন দত্তের কবিতা পড়েছি এবং পরে তার কিছু কাব্য পড়েছি। তাতে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়, আপনি আমার মনের কথা বলে দিয়েছেন। আমি অতি সাধারণ, আমি কোনদিন আমার মনের ভাব প্রকাশ ক্রতে পারতাম না। আপনার আরও অনেক লেখা পড়েছি। আজ যেন হংসের মত জল থেকে দুধ তুলেনিলাম। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আশাকরি ভবিষতে আরও লেখা পাবো। শেষে একটা কথা বলবো যে, বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন যে বিপ্লব আনয়ন করেছেন, তার ফলে বাংলা সাহিত্যের গাছ ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ হয়েছে।
ফরিদ, আমি জানি আপনি সোশাল স্টাডিস -এর একজন খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন – কিন্তু আমি এখন এটাও বলতে পারি আপনি বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হলে আরো আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেতেন ! বাংলা সাহিত্য নিয়ে আপনার লিখা অব্যাহতভাবে চলবে এই রইলো আমার আশা ! ভালো থাকবেন !
মেঘনাদ যেমন দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত ও বন্দী করে অসাধ্য কে সাধ্য করেছিলেন, সম-বিক্রমে মধুসূদন বাংলা সাহিত্যকে পৌঢ়তা থেকে করেছেন মুক্ত, দিয়েছেন যৌবনের স্বাদ। আর এই নব যুবাপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে তিনি কোন রকম কার্পণ্য করেননি।
মহাকাব্য, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, বিয়োগান্ত নাটক, প্রহসন অথবা চতুর্দশপদী কবিতাই নয় আবৃত্তিযোগ্য কবিতা ও তাঁর আধুনিক রীতির আদি রূপটির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মধুসূদন দত্তই।
কবি মধুসূদনের জীবন ও সৃষ্টির মধ্যে নিত্য যেন ছিকল ভাঙার গান শুনতে পাই। যদিও তাঁর এই বারংবার বিদ্রোহ-বিবর্তন সৃষ্টির লক্ষেই। যেমন এই মেঘনাদবধ মহা কাব্য। দেবতারে ফেলে রাবণ রাক্ষসের স্তুতি! মুগ্ধ করে তাঁর এই অনুভূতির গভীরতা।
[img]http://www.parabaas.com/translation/database/authors/images/michael2.jpg[/img]
মধু কবি ও তাঁর মহা কাব্য কে নিয়ে লেখক ফরিদ আহমেদের এই শ্রমসাধ্য সুন্দর লিখনি মনকে নাড়া দিল। আসলে অনেক বিষয় ভাববার জানবার আছে। লিখে যান (F)
@অরণ্য,
সুন্দর একটা মন্তব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
@ফরিদ আহমেদ,
কবিতা নাটক নিয়ে আলাপ চলুক, এরই মাঝে তাঁর একটা গান হয়ে যাক- তারপর যদি প্রাসঙ্গিক মনে করেন, বলবেন এখানে এঁরা কিসের কানাকানি করছেন?
হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন; –
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –
“ ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মনিজালে।।
httpv://www.youtube.com/watch?v=mnlbQmh176Q
দেশে আসার জন্যে আপনার মন ব্যাকুল হলেও -ঢাকাঢাকা কিংবা ময়মনসিং কোনটাই নিরাপদ নয় আপনার জন্যে। ফেইজবুকার একটি লিখা পড়েই বললাম। এদেশে রাজনীতি চলে ধর্মের উপর।
সত্যি, অধার্মিক হলে শুধুই ধর্মবিরোধী লিখতে হবে, বিজ্ঞানমনা হলে শুধুই বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে হবে এমন একটি ধারণা অনেকদিন যাবৎ ছিল বিধায় মুক্ত মনাকে একটু এড়িয়ে চলতাম।
সিন্ধান্ত পাল্টালাম, আর এ ধরনের লিখাকে সিন্ধান্ত পাল্টানোর পুরুস্কার হিসেবে বুঝে নিলাম। 🙂
****মানুষ যখন শুধুমাত্র একটি ভাষায় নয়, অন্যান্য ভাষায়ও পারঙ্গম হয়ে ওঠে, তখন তিনি যেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করতে চান এবং যান সে প্রকাশে থাকে নুতনত্বের ছড়াছড়ি। মধু কবির মধুত্ব এ কারনেই ভীষণ মধুর।****
@ছিন্ন পাতা,
সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জন্য সাধুবাদ এবং ধন্যবাদ। আমি নিজেও বহুবার মুক্তমনার সংস্রব ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু কার্যকর করা হয় নি কখনোই। এটা ভিন্ন এক টান। শক্তিশালী এবং সর্বগ্রাসী।
বৈচিত্র্যই এর সৌন্দর্য। বহুমুখি মন মানসিকতা আছে বলেই হয়তো এখনও এটি আকর্ষণীয়। একমুখিতার একঘেয়েমি থেকে মুক্ত রেখেছে।
পড়েছিলাম আগেই, কিন্তু সময়াভাবে মন্তব্য করা হয়ে উঠেনি। এমন লেখা আরো বেশি বেশি করে চাই। অসাধারণ (Y)
@স্বাধীন,
ধন্যবাদ। আপনার লেখাও আমরা পড়তে চাই। দাবি জানিয়ে গেলাম।
বেড়ালের ল্যাজ ধরে মাথাটিকে উল্টে দেওয়ার মতো দুঃসাহস মধু কবি ছাড়া আর কে করতে পারেন?
মুক্তমনায় একটি ভিন্ন স্বাদের লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ফরিদ ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। অনলাইনে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পড়া যাবে এখানে। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
প্রবল পৌরুষ নিয়ে ঘাড় অবধি অহংকারী কেশর ফুলানো সিংহপুরুষ যে ওই একজনই ছিলেন।
@ফরিদ আহমেদ,
(Y) (Y)
ফরিদ ভাই, এই এই লেখাটার ব্যাপরে আপনার সাথে কথা ছিল। ([email protected]) ।
@প্রণব,
আপনাকে মেইল করেছি আমি।
খুউব ভালো লাগলো। এই ধরনের লেখা আরো চাই।
@মোজাফফর হোসেন,
আপনারা সাহিত্যিক মানুষ। আপনাদের কাছ থেকেইতো এগুলো চাই আমরা আমজনতা।
@ফরিদ আহমেদ, এভাবে বলে লজ্জা দেবেন না প্লিজ। আপনারা আমজনতা হলে যে আমার মতো মানুষদের অস্তিত্বই থাকে না ! ভালো থাকবেন। পরবর্তী লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ফরিদ ভাই , যদি একটু কষ্ট করতেন এই অধম বান্দার জন্য । আমি ঠিক এই রকম করেই জীবনানন্দ দাস সম্পর্কে একটা লেখা চাই । দয়া করে শীত নিদ্রা না গিয়ে ঝটপট লিখে ফেলুন আপনার লেখার অপেক্ষাই তীর্থের কাকের মত পথ চেয়ে রইলুম
@মাসুদ রানা,
জীবনানন্দ আমার অনেক পছন্দের একজন। নিশ্চয়ই লিখবো তাঁকে নিয়ে কোনো একদিন।
ফরিদ ভাইয়ের এই লেখাগুলোর মর্মই আমার কাছে আলাদা। লেখাটা পড়তে পড়তেই মনে হচ্ছিলো রবীন্দ্রনাথ যে তার তরুণ বয়সে মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা করেছিলো সেটা নিয়ে ছোট একটা মন্তব্য করব। পরে দেখি ফরিদ ভাই সেটাও কভার করে দিয়েছে। তাই মন্তব্য করার মত কোন পয়েন্ট আপাততঃ আমার খালি নাই।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আবারো।
আমি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে মেঘনাধ বধ ও মধুসূদন পড়েছিলাম, কিন্তু ফরিদ আহমদের এ লেখাটি মধুসূদনের পাঠক তৈরিতে ও মেঘনাদ বধ কাব্য পাঠে অনেককেই উদ্ধুদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
দারুন হয়েছে। (Y)
@গীতা দাস,
সাহিত্যের ছাত্রী যেহেতু ছিলেন সে কারণে সাহিত্যের আলোচনার দাবি রইলো আপনার কাছে।
মধু কবির কাছ থেকে শিখছিতো তাই। 🙂
কত দীর্ঘ কাল অপেক্ষায় ছিনু
এমন দারুণ লেখা দেখিবার তরে
দেখিলেন ফরিদ ভাই
মোর হাতেও আজ কাব্য ভর করে!
@প্রদীপ দেব,
যেমতি দূর করতে নিকষ আঁধার
গগণ মাঝে জাগে নক্ষত্রের প্লাবন
তেমতি প্রদীপ হাতে দেবগণ হাঁটে
ঝরায় আলোক বৃষ্টি, বসুধার বুকে
চমৎকার একটি প্রবন্ধ পাট করলাম। এই প্রবন্ধে সুচারুরূপে সত্য উদঘাটিত হয়েছে। সত্যি ভীষণ ভালো লাগা…
@মাহমুদ মিটুল,
আপনাকেও ধন্যবাদ মিটুল। আশা করছি মুক্তমনায় নিয়মিত পাবো আপনাকে।
@ফরিদ আহমেদ, আমিও আশা করছি মুক্তমনায় নিয়মিত পড়ে ও লিখে যেতে পারবো…ধন্যবাদ।
ফরিদ দা, আপনার লেখা পড়ে আমি এত বেশি অভিভূত হয়ে যাই যে মন্তব্য করার ভাষা হারিয়ে ফেলি। মধুকবিকে নিয়ে আপনার এই লেখা ও মেঘনাদবধ কাব্যের উপর বোধগম্য আলোচনার মাধ্যমে এই দুর্মূল্য মহাকাব্যের দুর্বোধ্যতা কিছুটা হলেও কমবে আমার মত কম বুদ্ধির পাঠকদের কাছে।
ফরিদ ভাইয়ের লেখা দেখি! অনেক দিন পর লিখলেন। আমি তো আরো ভাবছিলাম শীতকাল আসছে দেখে শীতনিদ্রায় গেলেন কিনা! 😛
যাই হোক, লেখা ভালো লাগল। মধুকবি হৃদয়ঙ্গম করা আমার জন্য বেশ কঠিন,তাই প্রায় সময় হাল ছেড়ে দেই।লেখাটা পড়ে আবার আগ্রহ পেলাম।
@নিটোল,
ভুলে গিয়েছিলাম যে শীতকাল এসে গিয়েছে। আপনার কথায় মনে পড়লো। এইবার একটা দীর্ঘ শীতনিদ্রায় গেলে খারাপ হয় না। 🙂
লেখাটা মুক্তমনার পাতায় ভেসে ওঠবার পরপরই চোখে পড়েছিল। ঘুম ঘুম চোখ। মন ছুঁয়ে গেল,ঘুম ঘুম চোখ, মন্তব্যের পথে যেতে না করে দিল। আমিও পা বাড়াইনি। আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নিয়ে আপনি পাঠক সমাবেশে উপস্থিত, এইটুকুতেই। ভাল লাগার জন্য কি অনেককিছু লাগে?
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামটাই আমাকে মনে করিয়ে দেয়, কালো মানে রাক্ষস নয়, কালো মানে শিল্প-রস-বোধহীন কোন প্রাণী নয়।
কে কতটা সৃজনশীল, হাওয়া আমাদের জানান দিয়ে যায়।
ঠিক তাই। আর সেজন্যই
সে সময়ে ঐ রকম উপলব্ধিতে দাঁড়িয়ে কথা বলা অর্থাৎ প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে যাত্রা, সে-ও কম নয়।
আর এই উজান স্রোতের যাত্রীরাই আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যায় আর আমরা পরমানন্দে ভুলে যাই।
ভুলে না-যাবার মিছিলে, আপনাকে অভিনন্দন।
@স্বপন মাঝি,
না, লাগে না। পা ডুবোনোর জন্য আদিগন্ত নীল জল আর জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতার বই হলেই চলে।
এই কালো রাক্ষস খোক্কসেরা আমরাই। সে কারণেই মেঘনাদবধের সাথে আমাদের এতো একাত্মতা। গৌরবর্ণ অভিজাতরা এখানে পরিত্যাজ্য।
মধুসূদন মধুসূদনই। গর্বিত, অহংকারী এবং আত্মম্ভরি। স্রোত অনুকুল নাকি প্রতিকুল তা নিয়ে মাথা ঘামান নি কখনো। মাথা ঘামান নি বলেই বরং উলটো বিরুদ্ধ স্রোতকেই অনুসরণ করতে হয়েছে মধুসূদনকে।
কে বলেছে এই ধরনের লেখার পাঠক সংখ্যা কম? আমার মত একজন সামান্য পাঠকও কাব্য সমালোচনা মুলক এই লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ুন আজাদ এবং আহমেদ শরীফের দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি যেভাবে মুল্যায়ন করেছেন তা নিয়ে কোন আপত্তি না থাকলেও আহমেদ শরীফের মুল্যায়ন প্রসংগে আমার সামান্য দ্বিমত রয়েছে। মধুসুদন যদি সমকালিন চেতনা ধারন না করে থাকতেন তাহলে তিনি রাম-রাবন সংস্কার ভেঙ্গে কিভাবে বারিয়ে আসতে পারলেন। এটাইতো খুব বড় প্রগতিশিল চেতনা। মাইকেলইতো সব থেকে বড় প্রথা বিরোধি লেখক। খুব ভাল হতো যদি মেঘনাদ বদ কাব্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে তার উপর কিছু আলোচনা করতে পারতেন কষ্ট করে আমাদের জন্য। সময় ও শ্রমসাপেক্ষ এই ভাল লাগা লেখাটা পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
@শাখা নির্ভানা,
আহমদ শরীফের মূল্যায়নের সাথে আমি নিজেও একমত নই। মধুসূদনের কাব্যে সমকালীন চিন্তা-চেতনা ঠাই পায় নি বলেই তিনি সমসাময়িক নন, এ বিষয়টাকে মানতে আমি অনাগ্রহী। একটা জিনিস আমরা ভুলে যাই যে, মধুসূদনের সাহিত্যিক জীবন অত্যন্ত স্বল্প। মাত্র ছয় বছরে সৃষ্ট হয়েছে তাঁর সকল সৃষ্টি। এর মধ্যেই তিনি একটি ভাষার সাহিত্যকে একক প্রচেষ্টায় টেনে নিয়ে গিয়েছেন মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে। এত বড় কীর্তির পরে আর কী প্রয়োজন থাকে আধুনিকতা প্রমাণের।
আপনার এবং বিপ্লবের বক্তব্যের পরে আমারও মনে হচ্ছে যে এই কাজটা করা প্রয়োজন ছিলো। কাব্যের কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে এতে শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কারের প্রয়োগ ও সৌন্দর্য নিয়ে কিছুটা আলোচনা করলে খুব একটা মন্দ হতো না।
আহমেদ শরীফ ঠিকই বলেছিলেন যে মধুসূদন সমসাময়িক যুগের চেতনাকে ধারন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রগ্রেসিজম কিংবা বাংলার রেনেসার চিন্হ তার লেখায় নেই। তিনি বরং চেতনার আধার করেছিলেন সুপ্রাচীন ইলিয়াড-ওডিসি এবং প্রিভিক্টোরিয়ান জার্মান-ইংলিশ রোমান্টিসিজমকে। এই ধারাটির মূল উপাদান হলো আকাংখা, হিরোইজম, অনার, একতরফা সর্বগ্রাসী ভালোবাসা, প্রকৃতির রহস্যময়তা, ভাগ্য ও ট্র্যাজেডী, মোটকথা দিনন্দিন জীবন ছাপিয়ে আরো বড়ো কিছুকে ছোয়ার চেষ্টা। বলা হয় ইলিয়াড-ওডিসি পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনা এবং সাহিত্যের উৎসমূল। মধুসূদন সমসাময়িক উপাদান ফেলে উৎসে গিয়ে সেই বৃহৎ ভাবগুলোকেই ধারন করতে চেয়েছেন যেখান থেকে মানুষের কাব্যবোধ জন্ম নিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের একটা বড়ো দুর্ভাগ্য যে মধুসূদনের পরে খুব কম সংখ্যক সাহিত্যিকই ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে এই বড়োকিছুকে স্পর্শ করার স্পর্ধা করেছেন।
@সফিক,
মধুসূদন যুগের চেতনাকে ধারণ করেন নি ঠিকই, কিন্তু যুগটাকে ঠেলে সামনে নিয়ে গিয়েছেন। সমসাময়িক চেতনাকে ধারণ করার চেয়েও বিশুদ্ধ শিল্প সৃষ্টিই খুব সম্ভবত তাঁর প্রধানতম ইচ্ছা ছিলো। মধুসূদনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব আমার চোখে আপনি যেটা বলেছেন সেটাই, বড় কিছুকে স্পর্শ করার স্পর্ধা। মধুসূদনের মত এরকম আকাশ ছোঁয়ার দুঃসাহস, শিখরে উঠার দুর্দমনীয় আস্পর্ধা এবং সীমাহীন স্পৃহা আর কোনো বাঙালি কবি দেখানোর সাহস পান নি। না তাঁর আগে, না তাঁর সময়ে, না আজকের যুগে।
ধন্যবাদ দারুণ একটা নিবন্ধের জন্য।
একটি ছোট আপত্তি। ধ্রুপদী রামায়ণকে আপনি যতটা বাইনারি ভাবছেন তা নয় কিন্তু। মধ্যযুগের “কল্পনারহিত” কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ুন, দেখবেন সেখানেও রাবণ ট্রাজিক চরিত্র। মহাকাব্য — হোক ভারতীয় বা গ্রীক — moral ambiguity সেখানে থাকবেই। রামায়ণও তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে হ্যাঁ, মধুসূদন এটাকে তঁার কাব্যে কেন্দ্রীয় স্থান দিয়েছিলেন, যেটা নতুন।
@রৌরব,
কত অজানারে!! 🙂
এই লেখাটা পড়ে মনে তৃপ্তি হল না -যদিও আমিও মনে করি ধ্রুপদী সাহিত্যে মধূসুদন রবীন্দ্রনাথের থেকে বেশী পারদর্শীই ছিলেন।
আমার অতৃপ্তির কারণ অন্য। প্রথমত আমার বাড়িতে টিকা টিপ্পনী সহ একটা মেঘনাদ বধ কাব্য ছিল। তাতে প্রতিটা ভার্সের সাথে নুন্যতম ২০-৩০টা করে টিকা থাকত। মেঘনাদ বধের প্রতিটা লাইনের ফাঁকে লুকিয়ে আছে পৌরানিক উপমা এবং সেই উপাখ্যানগুলি না জানলে এর সম্পূর্ণ রস নেওয়া সম্ভব না। এই লেখা টাই বেশ কিছু এই ধরনের উদাহরণ দিলে সমৃদ্ধি আসত।
দ্বিতীয়টা ভাষার ব্যবহারে। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ এই ভাবে আর কেও করে নি। কিন্ত ফরিদ ভাই লিখেই খালাস। উদাহরন দিলেন কই?
মোদ্দা কথা ফরিদ ভাই এই লেখাটি লিখতে ফাঁকি মেরেছেন-উনার কাছে অনুরোধ, মেঘনাদ বধ কাব্য থেকে পংতি তুলে কিছু কাব্যিক , ভাষা শৈলীর বিশ্লেষণ চলুক।
@বিপ্লব পাল,
আলোচনায়তো আপত্তি নেই। কিন্তু টাইপটা করবে কে শুনি? তুমি? খুঁজে টুজে দেখোতো ইউনিকোডে কোথাও মেঘনাদবধ কাব্য পাওয়া যায় কি না। তাহলে আলোচনা জমানো যাবে কাব্যের সর্গ ধরে ধরে।
যন্ত্রণা!!
এই যে দেখো সর্প শব্দটা। এর সমার্থক হিসাবে তিনি ভুজগ, ভুজঙ্গ, আশীবিষ, চক্রী, কাকোদর, ফণী, উরগ, পন্নগ, ভোগী এই রকম অপ্রচলিত শব্দকে অবলীলায় ব্যবহার করেছেন। শুধু সমার্থক শব্দই নয় যুগ্মপদ সৃষ্টি করেছেন তিনি, তৈরি করেছেন সমস্তপদ। গ্রাম্য বা ব্যাকরণদুষ্ট পদ প্রয়োগেও কুণ্ঠিত ছিলেন না তিনি। নির্বিচারে ধ্বন্যাত্মক শব্দও ব্যবহার করেছে। বরুণ এর স্ত্রীলিঙ্গ বরুণানী না করে তিনি করেছেন বরুণী। এতে পণ্ডিতেরা আপত্তি করলে তিনি উদ্ধত শিরে বলেছিলেন, The name is বরুণানী, but I have turned out one syllable. To my ears this word is not half so musical as বরুণী, I don’t know why I should bother myself about Sanskrit rules.
এই না হলে কী আর তিনি মধুসূদন!!!
চলুক, আপত্তি কিসে। শুধু টাইপ করার দায়িত্ব নিতে রাজি নই আমি। 🙂
@বিপ্লব পাল,
তাফসির আর হাদিস ছাড়া যেমন কোরানের আগা-মাথা কিছু বুঝা যায়না, রামায়ন, মহাভারত না পড়ে তেমনি কেউ বুঝি মেঘনাদবধ বুঝবেনা। অন্তত আমি তো ঘটনার কিছুই বুঝিনা।
কী আশ্চর্য, মানুষ কোরানের ভাষা, বাক্যে, অক্ষরে, শব্দে মিরাক্যল খোঁজে, মেঘনাদবধ দেখেনা। এই চতুর্দশপদী কবিতা, অক্ষরবৃত্ত, এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ যদি মিরাকল না হয়, তাহলে মিরাকল আছে দুনিয়ার কোন কিতাবে? ১৪ অক্ষরের কেরামতিটা বুঝা বড় দায়। William Radice নামের এক পীর সাহেব দেখলাম তার কুদরতি দেখিয়েছেন মেঘনাদবধ কাব্যের অনুবাদ করে। সেই অনুবাদ আরো দূর্বোধ্য।
নিন্দুকেরা বলেন, কবি মাইকেল তার মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণ ও লক্ষীকে সঠিকরূপে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন এখানে-
এ হেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,/
বাক্যহীন পুত্রশোকে ঝর ঝর ঝরে/
অবিরল অশ্রুধারা-তিতিয়া বসনে/
তারা বলেন পুত্রশোকে বাক্যহীন,অবিরল অশ্রুধারা এটা রাবণের চরিত্র নয়। রাবণ নাকি বাহুবলে স্বর্গপুরী কাঁপাইয়া দিতে পারেন, দশটা মাথার অধিকারী রাবণের, অসহায় বালিকার মতো ক্রন্দন সাজেনা।
এ নিয়ে না হয় পরে আলাপ করা যাবে। ফরিদ ভাই উপমা উদাহরণ না দেয়া পর্যন্ত আলাপ বোধ হয় জমবেনা।
@আকাশ মালিক,
কীযে পাপ করেছিনু ভালোচনা লিখে
এমতি এখন সবে ঠেলিছে পঙ্কিলে 🙁
মহাকাব্যে ঘটনা বর্ণনার জন্য যে উপমাগুলো কবিরা ব্যবহার করে থাকেন সেগুলোকে সাধারণ উপমা অলঙ্কারের সাথে পার্থক্য করার জন্য বাংলায় মহোপমা বলা হয়। হোমার এই ধরনের উপমা ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। পাশ্চাত্যে এই অলঙ্কারশাস্ত্রকে বলা হয় Homeric simile. মধুসূদনও মেঘনাদবধ কাব্যের বিপুল পরিমাণে এর ব্যবহার করেছেন। মহোপমার স্বরূপ সাধারণ উপমার মতই। দুটি অসদৃশ বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য তৈরি করা। সাধারণ উপমায় একটি মাত্র ভাবকে সাধারণ ধর্মরূপে রাখা হয়। যেমন ধরুন বলা হচ্ছে চন্দ্রের মত মুখ তার। এখানে চন্দ্র হচ্ছে উপমান আর মুখ হচ্ছে উপমেয়। ভাব ওই একটিই। মেয়েটির সৌন্দর্যকে অনিন্দ্যতর করা হচ্ছে চন্দ্রের সাথে তুলনা করে। অন্যদিকে মহোপমায় উপমান এবং উপমেয় দুটি পৃথকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র বা একটি সুবলয়িত ঘটনা প্রকাশ করে। ফলে সাধারণ উপমায় যেখানে উপমেয়ের সাথে সংযোগসূত্র ছাড়া উপমানের কোনো মূল্য নেই, সেখানে মহোপমায় উপমানও একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র। এর নিজস্ব সৌন্দর্য, নয়ন মনোহর রূপ রয়েছে।
মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন উপমা প্রয়োগের আশ্চর্য কৌশল দেখিয়েছেন। এই কাব্যে পদে পদে উপমার ছড়াছড়ি। কিছু কিছু জায়গায় পূর্ণাঙ্গ চিত্রের মহিমা প্রকাশের জন্য যে উপমানের বর্ণনা দিয়েছেন তা মহোপমার পুরো লক্ষণ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। রাবণ তার শোকের মুহ্যমানতা বোঝাতে গিয়ে মন্ত্রী সারণের সান্ত্বনা বাক্যের উত্তরে বলেন,
হৃদয় বৃন্তে ফুটে যে কুসুম
তাহারে ছিড়িলে কাল, বিকল হৃদয়,
ডোবে শোকসাগরে, মৃণাল যেথা জলে
যবে কুবলয় ধন লয় কেহ হরি।
এখানে পদ্ম ছিড়লে মৃণাল ডুবে যায়, এই দৃশ্যকে উপমান হিসাবে রেখে পুত্রের মৃত্যুতে হৃদয় শোকাচ্ছন্ন হয় এই উপমেয়কে ব্যঞ্জনা দেওয়া হয়েছে।
এরকম আরেকটি উদাহরণ দেই। শিবের ধ্যানভঙ্গের জন্য মদন সম্মোহন শর নিক্ষেপ করায় মহাদেবের জটাজুট কম্পিত হলো, ললাটক্ষেত্রে অগ্নি জ্বলে উঠলো। ভস্ম হবার ভয়ে মদন দ্রুতগতিতে পার্বতীর বক্ষস্থলে লুকোলো। মদুসূদন এই পলায়নপর আচরণকে একটি উপমানের সাহায্যে প্রকাশ করলেন। সেটি হচ্ছে, মেঘগর্জন এবং বিদ্যুতচমকে ভীত সিংহশাবক মায়ের নিরাপদ কোলে আশ্রয় নিলো।
ভয়াকুল ফুলধনুঃ পশিলা অমনি
ভবানীর বক্ষঃস্থলে, পশয়ে যেমতি
কেশরি-কিশোর ত্রাসে, কেশরিণী কোলে,
গম্ভীর নির্ঘোষে ঘোষে ঘনদল যবে
বিজলী ঝলসে আঁখি কালানল তেজে।
এই যে দেখুন দুর্যোগের দিনে ভয়াতুর সিংহ শাবকের মায়ের কোলে আশ্রয় নেবার চিত্রটি উপমান হলেও এটি একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র। উপমেয় ছাড়াও এর স্বতন্ত্র সৌন্দর্য মূল্য রয়েছে।
@ফরিদ আহমেদ,
বাহ বাহ বাহ, চমৎকার চমৎকার :clap :clap :clap
এটাই তো হওয়া উচিৎ ছিল। একদিন হয়তো আপনার এই লেখাটা আপডেইট করার প্রয়োজন বোধ করতে পারেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ একে তো মনে হয় দূর্বোধ্য অজানা কোন্ এক স্বর্গপুরীর শব্দ ভান্ডার, যা শুধু অবতার, পয়গাম্বররাই বুঝেন, তার ওপর মিত্রাক্ষর, অমিত্রাক্ষর, আটমাত্রা, চৌদ্দমাত্রার কেরামতি। এসব কঠিন বিষয়কে সহজ সরল ভাষায়, উদাহরণ উপমা সহকারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে না দেখালে আমার মতো ব্যাকরণ ও রামায়ণ না জানা মূর্খ পাঠক সাহিত্যের আসরে বসবে কোন সাহসে? এমনিতেই রাবণকে দেখলে আমার ভয় লাগে!!
[img]http://i1088.photobucket.com/albums/i332/malik1956/Ravan.jpg[/img]
@ফরিদ আহমেদ,
ভাই জান, এরাম ফলবতী কমেন্ট আরও কয়েকটা দিন না (টাইপের কষ্ট হজম করে)। লেখাটা পড়ে তৃষ্ণা বাড়ছিল, জল খুজে পাচ্ছিলামনা। কমেন্টটা পড়ে তৃষ্ণা কিছুটা মিটলো কিন্তু আরও চাই। বোঝেনিতো চাইতেতো আর কষ্ট করতে হয়না… এমন ব্যতিক্রমী লেখা আপনি ছারা আর কে লিখতে পারবে শুনি?
@সুমন,
ভাইজান, আমার কমেন্টরে ফলবান না কইয়া ফলবতী কইলেন ক্যান? আমার পুরুষবাদী অহংকারের আঁতে ঘা লাগছে এইটাতে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মধুসূদন একথা জানি আমরা। মিত্রাক্ষরের বন্ধন থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করেছেন তিনি। কিন্তু বাংলা কবিতার গতানুগতিক মিত্রছন্দে কাব্য রচনার দক্ষতাও তাঁর অসাধারণ ছিল। মেঘনাদবধ কাব্য রচনার সময়েই মধুসূদন ব্রজাঙ্গনা নামের একটি গীতিকাব্য প্রকাশ করেন। শুরুর দিকে এই লিরিক কাব্যটির নাম ছিল রাধা-বিরহ। তবে প্রচলিত পয়ার ত্রিপদী ব্যবহার না করে ইতালিয় Ottava Rima নামের ছন্দের অনুসরণে একটি মিশ্রছন্দ তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
নাচিছে কদম্বমূলে,
বাজায়ে মুরলী, রে
রাধিকারমণ!
চল, সখি, ত্বরা করি,
দেখিগে প্রাণের হরি,
ব্রজের মতন!
চাতকি আমি স্বজনি,
শুনি জলধর-ধ্বণি,
কেমনে ধৈরজ ধরি থাকি লো এখন?
যাক মান, যাক কুল,
মন-তরী পাবে কূল;
চল ভাসি প্রেমনীরে, ভেবে ও চরণ।
কিংবা এরকম,
মৃদু কলরবে তুমি, ওহে শৈবলিনি
কি কহিছ ভাল করে কহ না আমারে।
সাগর বিরহে যদি, প্রাণ তব কাঁদে, নদী
তোমার মনের কথা কহ রাধিকারে –
তুমি কি জান না, ধনি, সেও বিরহিণী?
তবে মিত্রাক্ষর কবিতা রচনায় নিজের দক্ষতার বিষয়ে মধুসূদনের নিজেরই সংশয় ছিল। তাই রচনার পরে প্রায় একবছর এটিকে অপ্রকাশিত রেখেছিলেন তিনি।
তাঁর গীতি কবিতার প্রতি এই আগ্রহের চরম প্রকাশ ঘটে বীরাঙ্গনা কাব্যে।
একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে
রঘুরাজ? কিন্তু দাসী নীচকুলোদ্ভবা,
সত্য মিথ্যা জ্ঞান তার কভু না সম্ভবে!
কহ তুমি;- কেন আজি পুরবাসী যত
আনন্দ সলিলে মগ্ন? ছড়াইছে কেহ
ফুলরাশি রাজপথে; কেহ বা গাঁথিছে
মুকুল কুসুম ফল পল্লবের মালা
সাজাইতে গৃহদ্বার;- মহোৎসবে যেন?
গীতিকবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহকে তিনি তাঁর বন্ধু রাজনারায়ন বসুকেও জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,
I suppose I must bid adieu to Heroic Poetry after Meghnad…. there is the wide field of Romantic and Lyric poetry before me and I think I have a tendency in the Lyrical way.
কবির এই রোমান্টিক লিরিক-প্রবণতার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে ব্রজাঙ্গনাতে, রয়েছে মেঘনাদবধে। কিন্তু এর সফলতম প্রকাশ ঘটেছে বীরাঙ্গনায়।
এ ছাড়া চতুর্দশপদী কবিতার কথাতো আমরা সবাই কমবেশি জানি।
এবার আর কবিতা নয়। আসুন একটু ভিন্ন দিকে নজর দেই। বাংলা কাব্যের মত বাংলা নাটকেরও বন্ধন মুক্তি ঘটেছিল মধুসূদনের হাতে। সূচিত হয়েছিল অনুন্নত স্তর থেকে উন্নততর স্তরে পদার্পন। কোলকাতার অভিজাত সমাজে মেলামেশার সুযোগে মধুসূদ সৌখিন নাট্যাভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। পাইকপাড়ার রাজাদের উদ্যোগে বেলগাছা থিয়েটার স্থাপিত হয় এবং সেখানে রামনারায়নের রতনাবলো নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। ইংরেজ সাহেবদের বোঝার সুবিধার্থে নাটকটির চুম্বক অংশগুলির ইংরেজি অনুবাদের প্রয়োজন হয়। মূল নাটকের চেয়ে মধুসূদনের এই অনুবাদই বেশি প্রশংসিত হয়েছিল। এই নাটকের অনুবাদ করতে গিয়েই বাংলা নাট্যসাহিত্য সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে উঠেন তিনি। নাটকটি ছিল দুর্বল একটি নাটক, যা ওই সময়ের সামর্থকে ধারণ করেছিল। এই দুর্বল নাটক দেখে তৃপ্তি মেটে নি মধুসূদনের। বরং বাংলা নাটকের দুর্বলতা দূর করার জন্য নিজেই নাটক লেখার সিদ্ধান্ত নেন। আর এরই ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় বাংলার প্রথম সার্থক নাটক শর্মিষ্ঠার। এরপর লেখেন পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী।
তবে নাটকের চেয়েও বেশি বিস্ময়কর মধুসূদনের প্রহসন দুটি, একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। এদুটো মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ শিল্পসৃষ্টি। এতে মধুসূদনের নাট্য প্রতিভার বিস্ময়কর দীপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমটির বিষয়বস্তু সেকালের তরুণ ইঙ্গবঙ্গ সমাজের নৈতিক ব্যভিচার, আধুনিকতার নামে তাদের উৎকট উচ্ছৃঙ্খলতার কদর্য কাহিনি। অন্যটিতে আছে কপট ধার্মিক নারীমাংসলোলুপ বৃদ্ধ জমিদারদের ইন্দ্রিয়লালসার কাহিনি। এই প্রহসন দুটির লঘু কৌতুক এবং সূক্ষ্ণ ব্যঙ্গ এমনই উচ্চস্তরের যে বাংলা পরবর্তী আর যত প্রহসন রচিত হয়েছে তার কোনোটাই এদুটো্র শিল্পস্তরকে অতিক্রম করে যেতে পারে নি।
@ফরিদ ভাই,
আসলে আমি হইলাম ছদ্ম পুরুষবাদী, নারীবাদী ভেক ধইরা থাকি (নারীকে খুশি রাখার জন্যে);-) তাই এমন নারীবাদী কমেন্ট। যদি এতে আপনি আহত হন সেজন্যে আমার কিছু করার নাই, কারন আপনার মন রক্ষার চেয়ে নারীর মন রক্ষায় কি বেশী ফায়দা মিলিবে না?
আর কমেন্টে চমৎকার আলোচনার জন্যে আপনাকে (F) (F) (F) ।
@সুমন,
হা হা হা। পুরোনো পাপী আপনি। ছদ্ম নারীবাদী যে তাতেও কোনো সন্দেহ নাই। 🙂
একটা বিষয় অনেকদিন ধরেই মাথার মধ্যে ঘুরছে আমার। এই সুযোগে আপনার সাথে আলোচনা করি। এই মুক্তমনায় পুরুষবাদী লোক আমি একা, একজনা। বিভিন্ন, পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনেও দেখি নারীবাদী পুরুষদের ছড়াছড়ি আর গড়াগড়ি। এগুলোকে যদি প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা হিসাবে নেওয়া যায়, তবে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন হবারই কথা নয়। তাই না? অথচ পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি শুধু নারী নির্যাতনের কাহিনি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব সমাজেই। অথচ আমার মতো দুই চারটা অপাঙতেয় ফরিদ আহমেদ ছাড়াতো নারী নির্যাতনকারী খুঁজে পাবার কথা নয়। বাকি নারী নির্যাতনকারীরা তাহলে আসে কোথা থেকে? নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। এটা যদি বিড়ালের ওজন হয়, তবে মাংস গেলো কোথায়? আর যদি মাংসের ওজন হয়, তবে বিড়ালটা কই? :))
@ ফরিদ ভাই,
ঠিকি ধরেছেন বস্, আমি পুরনো পাপী। কিন্তু পুরদস্তুর কিংবা ছদ্ম নারীবাদী কোনটাই নই। আমি আসলে সমতায় বিশ্বাসী। আর দেশে নারীবাদী পুরুষদের সম্বন্ধে আপনি যা বললেন তা ১০০% সঠিক অর্থাৎ নারীবাদীদের ছড়াছড়ি গড়াগড়ি কিন্তু খাটি নারীবাদী পেতে আপনার খুজতে হবে আতশি কাচ দিয়ে। টকশোগুলোতে চলে বাগাড়ম্বর ব্যক্তিদের আস্ফালন, মিঠা কথার ফুলঝুরি, কাজের বেলায় নাই। আমাদের মিডিয়াগুলোও তাদের শৈশব অতিক্রম করতে পারেনি। কোনও একটা টপিক পেলো খুব লাফা ঝাপা চললো কয়েকদিন তারপর আর কোন খবর নেই। তবে আশার কথা হল দেশের মেয়েরা বসে নেই, তারা এগিয়ে যাচ্ছে যদিও গতিতে শ্লথ। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা হল পুরুষেরা সেভাবে আগায়নি, ফলাফল ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধিতে। আমার ডিভোর্সে সমস্যা নেই বরং খুব কাছের কয়েকজন আত্মীয়কে দেখেছি ডিভোর্সের পরে তারা ভালো আছে। আরেকটি কথা না বললেই নয় যারা ডিভোর্স দিয়েছেন তারা সবাই স্বাবলম্বী। তাই নারী স্বাধীনতার পুর্বশর্ত হোল মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে হবে সেটা যেকোন মুল্যে। পুরুষ বাবাজি বাপ বাপ করে অধিকার দেবে তাহলে। রবি বাবুর থেকে ধার করে বলি অধিকার কেউ কাউকে দেয়না অধিকার আদায় করে নিতে হয়। তাই বলছি বংগ ললনারা যতদিন তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন না হবেন, যতদিন না তারা সাবলম্বী হবার চেষ্টা করবেন ততদিন তাদের উন্নতি হবেনা সেটা হাজারটা কোটা চালু করেওনা। পৃথীবির সকল নারী মানুষ হিসেবে বাচুক এটাই কামনা।
ধন্যবাদ অসাধারণ প্রবন্ধের জন্য।
(Y)
মধূসুদন সত্যিই অসামান্য প্রতিভাধর!তিনি ১৩-১৪টি ভাষা জানতেন,তাঁর ভাষা চর্চার পদ্ধতিটা ছিল এমন যে,সকাল ৮-১০ ল্যাটিন,১০-১২ টা হিব্রু,২-৪ টা ফারসি …
তিনি একইসাথে তিন চারটি কাব্যরচনা করতেন,নিজে হাতে নয় মুন্সিদের দিয়ে,চারজনকে একসাথে বসিয়ে একলাইন একলাইন করে বলতেন।এই অবস্থা 🙁
@অথৈ সমুদ্র,
মেঘনাদবধ কাব্য পড়লে শুধু বিস্ময়ই জাগে মনে। কেমনে পারলো এই রকম করে লিখতে?
লেখাটি নিয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে ঠিক হবে না… তবে মধূকবিকে নিয়ে একটা কথা না বললেই না! বেশ অনেকদিন তা হবে প্রায় ঊনিশ কি কুড়ি বছর আগে বিটিভিতে একটা যাত্রা পালা দেখেছিলাম। অমলেন্দু বিশ্বাস অভিনীত ‘মধুসুধন’।মধু কবি আমাকে যতোটা মুগ্ধ করেছে, ঠিক ততোটাই মুগ্ধ করেছে অমলেন্দু বিশ্বাসের মধুসুধন চরিত্রে অভিনয়!
আর প্রথমবার মেঘনাধ বধ কাব্য পড়ার অনূভুতি ভাষার প্রকাশ করা যাবে না, যদিও সেটা অনেক পরিনত বয়সে।
লিখাটার জন্য ধন্যবাদ!
@থাবা,
ওই যাত্রাপালাটি আমিও দেখেছি। অমলেন্দু বিশ্বাসের সেরা কাজ ছিলো ওটি।
ফরিদ ভাই, অনেক ধন্যবাদ একটি শ্রমসাধ্য লেখা উপহার দেয়ার জন্য। আপনার লেখাটি পড়ে অনেক কিছুই জেনেছি; তবে কিছু জানা আগের জানাগুলোর সাথে সংঘর্ষ তৈরি করেছে। যেমনঃ
আমরা জানতাম, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যও কম সমৃদ্ধ নয়। আলাওল, বিদ্যাপতি, চণ্ডিদাসেরা তো এই সময়েই রাজত্ব করেছেন। হয়ত এদের বিষয়বস্তু বা ভাষা আধুনিক ছিল না এবং নিশ্চিতভাবেই মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের স্রস্টা ছিলেন। কিন্তু তাই বলে কি আগের যুগের কবিদের অর্জন মূল্যহীন, কল্পনা-রহিত বা প্রতিভাহীন হয়ে যায়?
আপনি হুমায়ুন আজাদ স্যারের রেফারেন্স দিয়েছেন। কিন্তু তবু এরকম একটা সিদ্ধান্তে আসার পেছনের কারণগুলি ব্যাখ্যা করলে পাঠকদের সুবিধা হত!
যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেই মধুসূদন মূল্যায়নে তার ভুল স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কিন্তু তবু একটা সত্য বেরিয়ে আসে যে, শত বৎসর পূর্বে কলকাতার সবচেয়ে বিদগ্ধ একটি পরিবারে জন্ম নিয়েও রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনকে দুরূহ মনে করেছিলেন। আমার এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবি ফররুখ আহমেদের কথা; আরবি-ফারসির কি দুরূহ ভার চাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি পাঠকদের উপর, যেটা নজরুল করেননি।
এই অংশটুকু পড়ে আধুনিক যুগের সাদ্দাম-গাদ্দাফির কথা মনে পড়ল। অনেকেই তাদের রাবণ হিসাবেই জানে; তবু তারাও কিন্তু ষড়যন্ত্রের শিকার এবং মাতৃভূমির অধিকার রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে।
আপনার লেখায় এই বাক্যটির পুনরুক্তি হয়েছে।
পরিশেষে, দুরূহ ও তরুণ পাঠকদের প্রায় অপঠিত ‘মধুসূদনকে’ নিয়ে আপনি যে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন, তার জন্য আপনাকে (F) । আমি নিশ্চিত অনেকেই আপনার এই লেখা পড়ে মধুসূদন পাঠে আগ্রহী হবে।
@কাজি মামুন,
আগের যুগের কবিদের অর্জন মূল্যহীন হয়ে যাবে বা তাঁরা সবাই ছিলেন প্রতিভাহীন এরকম কথা বলার ইচ্ছা আমার আদৌ নেই। তাঁরা তাঁদের সময়ের চাহিদা মিটিয়েছেন তাঁদের প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে। একটা যুগের সাহিত্যতো আর আকাশ থেকে পড়ে না। এর জন্য ধারাবাহিকতা থাকতে হয়। তাঁরা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ ছিলেন।
আমি প্রতিভাহীন বলতে মধুসূদনের সমকালীন কবিদের বুজিয়েছি। ওই সময় বাংলায় রেঁনেসা তৈরি হয়েছে। শিক্ষিত বাঙালিদের পাশচাত্য শিক্ষার ফলে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ধরনের ক্ষুধা, ভিন্ন ধরনের রুচি। এই নব্যসৃষ্ট চাহিদা এবং ক্ষুধার খাদ্য মেটানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তখনকার কবিকূল। তাঁরা তখনও বয়ে চলেছেন মধ্যযুগের উত্তরাধিকার। সেই সময়ের সবচেয়ে বড় কবি ছিলেন ঈশ্বরগুপ্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রথা মানা প্রচলিত ধরনের সীমিত সামর্থের কবি। তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না যুগের দাবী মেটানোর। সম্ভব ছিলো না যুগসন্ধিক্ষণের পরিবর্তনকে ধারণ করা, মধ্যযুগের সীমারেখা অতিক্রম করে আধুনিক যুগে সাহসী পা রাখার।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক সিদ্ধান্তে আসাটা আসলে একটু মুশকিলই। একজনকে কেউ হয়তো বলবে, শ্রেষ্ঠ আরেকজন এসে বলবে আরে ও কোথায় শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠতো অমক জন। এর মানে হচ্ছে যে, এই শ্রেষ্ঠত্ব মাপার, প্রতিভা বিচারের কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। পাঠকের আগ্রহ, রুচি, শিক্ষা এগুলোই সিদ্ধান্তের পিছনে নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। এই প্রবন্ধেও দেখা গেছে যে হুমায়ুন আজাদ যেখানে মধুসূদনকে আধুনিক্তম হিসাবে চিহ্নিত করছেন, সেখানে আহমদ শরীফ তাঁকে সমকালীন মানতেই নারাজ। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ঘুরাঘুরি করা আঠারো শতকের আগের সময়ে পড়ে থাকা কবি হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
মধুসূদনের প্রতি আমার পক্ষপাতটা আমি ব্যাখ্যা করছি। সৃষ্টির পরিমাণের দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ বাংলা সাহিত্যে কেউ নেই। একথা অনস্বীকার্য। প্রতিভাতেও তিনি অনেকের চেয়েই এগিয়ে। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে ক্রমবিকশিত এক প্রতিভা। এর তুলনায় মধুসূদনের আগমন এবং নির্গমন ঝড়ের মত। বাংলায় সাহিত্য সাধনা করার ইচ্ছা তাঁর ছিলো না। তিনি সমস্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংরেজিতে সাহিত্য রচনার জন্য। যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের ইয়ার্কিসূলভ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাংলায় সাহিত্য চর্চা তিনি শুরু করেন পরিণত বয়সে। কিতু এই চর্চাও মাত্র কয়েক বছরের। অথচ এই কয়েক বছরে তিনি বাংলা সাহিত্যকে যে ধাক্কাটা দিয়েছেন, যে গতিটা দিয়েছেন, যে নিত্যনতুন সৃষ্টি করেছেন, যে আত্মবিশ্বাস প্রবাহিত করেছেন এর ধমনীতে, সেটা আর কেউ পারে নি কোনো যুগেই। এখানেই মধুসূদন সবার চেয়ে এগিয়ে আমার কাছে।
এটা সত্যি। রবীন্দ্রনাথের মত সহজ সরল ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন নি মধুসূদন। তাঁর ভাষা উচ্চ এবং অবোধ্য। অভিধান পাশে নিয়ে না বসলে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর কাব্যের অর্থ বোঝাটা কঠিন।
ধন্যবাদ ধরিয়ে দেবার জন্য। মুছে দিয়েছি। শুধু পুনরুক্তিই হয় নি। লেখায় একটা অংশ বাদও পড়ে গিয়েছিল। সেটিকেও সংযোজন করে দিলাম।
@ফরিদ আহমেদ,
বাংলা সাহিত্যের ওপর এই ধরনের লেখা দেখলেই আগ্রহ নিয়ে পড়ি। অন্য কোথাও খুব আগ্রহ করে পড়তাম না আগে। দুর্বোধ্য মনে হত। এখানে যারা খাটুনি করে আমাদের মত আলসেদের জন্য লেখে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়, তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই। ফরিদ আহমদ, আপনাকে ধন্যবাদ সেজন্য।
তবু ঈশ্বরগুপ্তের প্রতি ঋণ স্বীকারে তার দু একটি লেখার দু একটি চরণঃ
চিত্রকরে চিত্র করে করে তুলি তুলি।
কবি সহ তাহার তুলনা কিসে তুলি?
চিত্রকরে দেখে যত বাহ্য অবয়ব।
তুলিতে তুলিতে রঙ্গ লেখে সেই সব।।
অথবা ( গুনে দেখলে সবটাতে ১৪ পাওয়া যাবে ),
হায় হায় পরিতাপে পরিপূর্ণ দেশ।
দেশের ভাষার প্রতি সকলের দ্বেষ।।
অগাধ দুঃখের জলে সদা ভাসে ভাষা।
কোনমতে নাহি তার জীবনের আশা।।
নিশাযোগে নলিনী যেরূপ হয় ক্ষীনা।
বঙ্গভাষা সেইরূপ দিন দিন দীণা।।
অথবা
কাতর কিঙ্কর আমি তোমার সন্তান।
আমার জনক তুমি, সবার প্রধান।।
বার বার ডাকিতেছি কোথা ভগবান।
একবার তাহে তুমি, নাহি দাও কান।।
@কাজী রহমান,
মিত্রাক্ষর পয়ার ছন্দে লেখা হয়েছে এগুলো। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আট মাত্রার পরে যতি ও উপচ্ছেদ। পদের শেষে মিল বা অন্ত্যানুপ্রাস। অমিত্রাক্ষর ছন্দও চৌদ্দ মাত্রার। কিন্তু এখানে আট মাত্রার পরের বাধ্যবাধকতামূলক যতিচ্ছেদ দেওয়া হয় না। সেই সাথে পদের শেষের মিলও ছেটে দেওয়া হয়েছে। এ এক ধরনের বন্ধনমুক্তি। এতে করে ভাবের প্রবাহ পঙতিসীমায় এসে থেমে যায় না। আবার পঙতির মধ্যে যেখানে খুশি সেখানে প্রয়োজনীয় যতিচিহ্ন বসিয়ে ছেদ বিন্যাস করে বর্ণনাকে জীবন্ত এবং সংলাপগুলোকে সৌন্দর্য দান করা সম্ভব হয়। যেমন মধুসূদন করেছেনঃ
এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে
পা দুখানি। আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া
সিন্দুর। করিলে আজ্ঞা, সুন্দর ললাটে
দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে
এ বেশ? নিষ্ঠুর হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি!
একে যদি মিত্রাক্ষর পয়ারের ঢঙে আট অক্ষরের পরে যতি আর চরণ শেষে পূর্ণচ্ছেদ দিয়ে পড়া হয়, তাহলে এর কী দশা হবে বলেনতো দেখি? 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
কি হবে?
এতক্ষনে অরিন্দম কহিলা বিষাদে?
,
ওই যে ওইটা হবে,
এখনে …করিবেন
না করিলে আইনত দন্ডনীয় হইবেন 😀
@কাজী রহমান,
পুরাপুরি ১০০% একমত।
(Y)
চমৎকার লেখেছেন ফরিদ ভাই। হৃদয়ঙ্গমের জন্য সময় নিয়ে কয়েকবার পড়া আবশ্যক।
আপনি ঐ লেখাটি নিশ্চয় সীমিত সময়ের জন্য তৈরী করেন নি, মহাকাল ধরেই সে লেখা থাকবে, মানুষ পড়বে এবং কাউকে না কাউকে তা নাড়া দিবেই।
@সৈকত চৌধুরী,
বলো কী? আমিও অমর হবো? 🙂
মুক্তমনার পাঠকদের পছন্দের বিষয়গুলো আসলে একটু ভিন্ন ধরনের। ধর্ম, বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদের প্রতি তাঁরা যে পরিমাণে আগ্রহী, ঠিক সেই পরিমাণ আগ্রহটা সাহিত্যের প্রতি দেখায় না এখানে। এর মানে অবশ্য এই না যে তাঁরা সাহিত্যপ্রেমী নয়। মুক্তমনা হয়তো নির্দিষ্ট একটা নিশ তাঁদের জন্য। ধর্ম, বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদের আলোচনা খুঁজে নেবার একটা নিবিড় ক্ষেত্র। সাহিত্যের জন্য আলাদা কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁদের।
@ফরিদ আহমেদ, না আমি তাই মনে করিনা মুক্তমনা শুধু বিজ্ঞান বা ধর্মের চর্চার জন্য নয় এখানে সাহিত্যর স্থানও রয়েছে সমভাবে