মুক্তমনায় এই ধরনের লেখার পাঠক সংখ্যা খুবই সীমিত। এর আগে কালিদাসের মেঘদূত নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম কুমারসম্ভবের কবি নামে । সেই লেখাটি পাঠকদের পঠন আগ্রহের জায়গাতে খুব একটা নাড়া দিতে পারে নাই। অথচ কেউ যদি আমার নিজের লেখা থেকে আমার পছন্দের দুটো বা তিনটে লেখা বেছে নিতে বলে, তবে নিঃসন্দেহে আমি ওটাকেই বেছে নেবো সেই গোত্রে। পাঠক স্বল্পতার কথা মাথায় থাকার পরেও এই গাধার খাটুনিটা অবশ্য খেটে ফেলি মাঝে সাঝে বড় ধরনের গাধামি করেই।


এই লেখাটি ভ্রুণ আকারে জন্মেছিল বহুদিন আগে। আমার লেখা বানান নিয়ে আরো কিছু বকরবকর প্রবন্ধে মধুসূদনকে নিয়ে ক্যাথেরীনা একটা প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই এই ভ্রুণের জন্ম। তারপর যদিও চলে গিয়েছে অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো মাস, হয়তো বা দুটো চারটে বছরও। কিন্তু আমার আলস্যজনিত অবহেলার কারণে সেই ভ্রুণকে জঠরেই পড়ে থাকতে হয়েছে সুদীর্ঘকাল। তারপরেও আমি খুশি যে, এটাতো তবু আলোর মুখ দেখেছে। এই রকম কত ভ্রুণ অকালে মরে যাচ্ছে আমার আলস্যের বিলাসে। কে তার খবর রাখে।


এ লেখাটির জন্ম যেহেতু ক্যাথেরীনার কারণে, কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কার্পণ্য দেখাচ্ছি না কোনো। তাঁকেই উৎসর্গ করা হলো এই লেখাটি।


বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের যুগ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী সময়কে তিনি মুড়িয়ে দিয়েছেন মুঠো মুঠো মণিমুক্তো দিয়ে। মধুসূদনের আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিল মধ্যযুগে। তখন রাজত্ব চালাচ্ছিল সব প্রতিভাহীন এবং কল্পনারহিত পদ্যকারেরা। তিনিই একক প্রচেষ্টায় বিশাল এক ধাক্কা দিয়ে বাংলা কবিতাকে মধ্যযুগীয় পদ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এনে ফেলে দেন আধুনিকতার আঙ্গিনায়। এরকম দ্রোহী পুরুষ,উদ্ধত এবং আত্মম্ভর মানব, এরকম অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান কবি বাংলা সাহিত্যে আর জন্মায়নি। হয়তো আর জন্মাবেও না কোনদিন। প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথও তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। এই বিপুল পরাক্রম দেখানোর জন্য অবশ্য বাইরে থেকে তাকে ঋণ করতে হয়েছে প্রচুর। সারা বিশ্বের রত্নভাণ্ডার খুলে খুলে দেখেছেন তিনি, লুট করেছেন লাজলজ্জাহীন লুটেরার মত। যা কিছুকেই মনে হয়েছে মূল্যবান সেটাকেই তিনি নিয়ে এসে জমা করেছেন বাংলার ভাঁড়ার ঘরে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাকে অবিশ্বাস্য পরিমাণে, আবদ্ধ করেছেন অপরিমেয় ঋণে।

বাকি বিশ্বই শুধু নয়, বাংলার নিজস্ব ভাণ্ডারের দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত রত্নভাণ্ডারকেও আবিষ্কার করেছেন তিনি। চুপিসারে এগুলো পড়ে ছিল অনাদর এবং অবহেলায় ঘরের কোণে। গায়ে মেখে ছিল অযত্নের কাদামাটি। কারো চোখেই সেগুলো পড়েনি কখনো আগে। পরম যত্নে তিনি সেগুলোকে তুলে নিয়েছেন একটি একটি করে। পরিস্রুত করেছেন আপন প্রতিভার দাবানলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।

মেঘনাদবধকাব্য যখন তিনি লেখেন তখন বাংলা ছিল একটি অবিকশিত ও অশক্তিশালী ভাষা। এটি ছিল ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা। মহত্তম ভাবপ্রকাশের জন্য অপর্যাপ্ত এবং  অপরিস্রুত এবং অনাদরণীয়। সমাজের চাষাভূষা মানুষের অবহেলিত ভাষা তখন সেটি। উঁচুমহলে এর কোন ঠাই ছিল না।

এরকম একটি অবিকশিত এবং হতদরিদ্র ভাষায় মেঘনাদবধকাব্য লেখা দুঃসাধ্যেরই নামান্তর। এর বাস্তবায়ন এক অসম্ভব কল্পনার নাম। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন তিনি করেছিলেন প্রবল জেদে, স্বভাবজাত একগুয়েমিতে। বাংলা সাহিত্যে সত্যিকারের মহাকাব্য রচনার অসম্ভব কল্পনাকে হাতের মুঠোর বাস্তবতায় পরিণত করেছিলেন অপরিমেয় প্রতিভার প্রখর ঝলকানিতে।

এর জন্য অবশ্য তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল নিজস্ব ভাষা ও ছন্দ। মন্থন করতে হয়েছিল সমুদ্র, মহাসমুদ্র। সাগরতলে লুকায়িত বাংলার রত্নভাণ্ডার থেকে রত্ন আহরণের জন্য দক্ষ ডুবুরির মত ডুব দিয়েছেন তিনি। ছেঁকে ছেঁকে তুলে এনেছেন সব মণি-মাণিক্য। ভয়ডরহীন ডাকুর মত হানা দিয়েছেন সমৃদ্ধশালী প্রতিবেশী সংস্কৃতের রত্নভাণ্ডারে। তারপর সেই লুণ্ঠিত রত্নরাজিকে মিশিয়েছেন চলিতের সাথে সুদক্ষ কারিগরের সুনিপুণ কৌশলে। তারপরও যখন প্রয়োজন মেটেনি,নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন নতুন নতুন সব প্রয়োজনীয় শব্দ।

বর্তমান সময়ে এসে চিন্তা করলে মধুসুদনের কাব্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহ অনেক দূরুহ, জটিল এবং অবোধ্য। অভিধানের পাতায় পাতায় শুয়ে থাকা বিপুল ওজনাকৃতির অব্যবহৃত শব্দ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এগুলোর সুদক্ষ এবং সুনিপুণ ব্যবহার করেই একদিন তিনি বাংলার মত অবহেলিত অনুজ্জ্বল ভাষাকে দীপ্তিময় করেছিলেন। হতচ্ছিন্ন মলিন গ্রাম্য পোশাক পালটিয়ে এর গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন আধুনিকতার উজ্জ্বল উত্তরীয়।

একজন মধুসুদন শুধু মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য এবং আধুনিক বাংলা সাহি্ত্যের সেতুবন্ধনই করেন নি, তিনি নিজেও ছিলেন আপাদমস্তক আধুনিক। বরং বলা চলে এখনকার অনেক আধুনিক কবির চেয়েও তিনি ছিলেন অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি প্রতিভাবান, অনেক বেশি ঝড়ো হাওয়া। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূচনা করেছেন তিনি। বিস্ময়কর হচ্ছে যে আজকে দেড়শো বছর পাড়ি দিয়েও তিনিই রয়ে গিয়েছেন আধুনিকতম। হুমায়ুন আজাদ তাঁর মাইকেল মধুসূদনঃ প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা প্রবন্ধে লিখেছেনঃ


কোনো স্বাদেশিক, বাঙলার কাদামাটির গন্ধমাখা কবির পক্ষে রচনা করা সম্ভব ছিলো না মেঘনাদবধকাব্য; পশ্চিমের সাথে যাঁর আন্তর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে নি, তাঁর পক্ষে কৃষ্ণকুমারী নাটক বা চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছ রচনা চরম দুঃস্বপ্ন। ঋণ করে মধুসূদন নিত্য অভিনব সামগ্রী সৃষ্টি করেন। বাঙলা ভাষার আকাশেবাতাসে যা কোনোদিন কল্পিত হয় নি, তা একদিন বাস্তব রূপ নেয় বাঙলা ভাষায়, মধুসূদনের আঙুলে। বিরামহীন অভিনবত্বের নামই মাইকেল মধুসূদন। যা ছিলো না, তিনি স্রষ্টা তাঁর; শুধু স্রষ্টা নন, তিনিই শ্রেষ্ঠ অনেক ক্ষেত্রে। বাঙলা ভাষায় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যদিও অনুকারী রয়েছে অনেক। এমনকি বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের চেয়েও তিনি বলিষ্ঠ প্রতিভা। তিনি পশ্চিম থেকে ঋণের যে রাস্তা খুলে দেন, সে পথেই চলেছেন বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁরা কেউ মধুসূদনের মতো তীব্র বিশালত্বমুখি ছিলেন না। বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম কল্পনা ও পরিকল্পনা মেঘনাদবধকাব্য; এক শতাব্দী পরেও বিস্ময়বোধ করতে হয় একথা ভেবে যে মধুসূদন ওই মহৎ কল্পনাকে কাব্যবাস্তবে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এমন এক সময়ে যখন বাঙলা ভাষা ছিলো একটি আঞ্চলিক, ক্ষুদ্র গোত্রের, অনেকটা কৃষিসম্প্রদায়ের ভাষা, যার মানরূপ তখনো অনির্ধারিত।



মধুসূদনের পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণা এবং আধুনিকতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ যেখানে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ এবং উদার, সেখানে আহমদ শরীফ ছিলেন কুণ্ঠাপ্রবন এবং কৃচ্ছ। মধুসূদনের ভাব, ভাষা, ছন্দ নিয়ে তাঁর কোনো আপত্তি ছিলো না। এগুলো যে মধুসূদনই বাংলা সাহিত্যে এনেছেন একথাকে স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু মধুসূদন সমসাময়িক চেতনাকে ধারণ করতে পারেন নি বলে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন তিনি। তাঁর মতে, মধুসূদন ছিলেন  চেতনায় পিছিয়ে পড়া একজন মানুষ। আধুনিক যুগের বদলে তিনি ঘোরাফেরা করেছেন প্রাচীন এবং মধ্য যুগের প্রতীচ্যে। তাঁর ভাষাতেইঃ

মধুসূদন ভাবে, ভাষায়, ছন্দে ও আঙ্গিকে যা কিছু আনলেন তা এদেশে নতুন বটে, তবে তাতে সমকালীনতা বা স্বাদেশীকতা ছিল না। আঠারো শতক-পূর্ব য়ূরোপীয় সাহিত্য-চেতনাই ছিল তাঁর সম্বল, সারাজীবনে তিনি তা অতিক্রম করতে পারেন নি। প্রাচীন গ্রীক-ল্যাতিন সাহিত্য থেকে সতেরো শতকের জন মিল্টন-সাহিত্য অবধি ছিল তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, আঙ্গিকে কিংবা চেতনায় তিনি য়ূরোপীয় আঠারো শতক অতিক্রম করে তাঁর সমকালীন কিংবা ঈষৎ পূর্বকালীন য়ূরোপীয় অথবা সমকালীন স্বদেশকে ধারণ করতে সমর্থ হন নি।


ফলে, প্রাচীন ও মধ্য যুগের য়ূরোপীয় চেতনা এবং প্রাচীন ভারতীয় বিষয়ববস্তুই হয়েছে তাঁর সাহিত্যের অবলম্বন। অথচ তাঁর সমকালের অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনকি টুলো পণ্ডিত রামনারায়ন তর্কারত্নও সমকালীন য়ূরোপীয় জীবন-চেতনা ও জগৎ-ভাবনাকে একান্তভাবে জানায় ও গ্রহণে প্রয়াসী ছিলেন স্বাদেশিক কল্যান বাঞ্ছনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। এঁরা কেউ লন্ডন-প্যারিস দেখেননি, কিন্তু মধুসূদন সেখানে বাস করেছেন এবং তাঁর জ্ঞানের জগৎও ছিল বিস্তৃততর। মধুসূদনের চেতনায় য়ূরোপীয় আস্তিক্য, নাস্তিক্য, সংশয়বাদী কিংবা প্রত্যক্ষবাদী কোন দর্শনেরই প্রভাব নেই, নেই ফরাসী বিপ্লব বা আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের আভাস, এমনকি বিজ্ঞানে কিংবা ইতিহাসেও তাঁর আগ্রহের প্রমাণ মেলে না তাঁর রচনায়। (মধুসূদন ও আধুনিকতা)

তিনি মহাকাব্য লিখেছেন, সনেট লিখেছেন, বিয়োগান্ত নাটক লিখেছেন, লিখেছেন প্রহসন। এসবের কোনোটা তাঁর আগে আর কোনো বাঙালি লেখেন নি। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র ছয় বছর। অথচ এই স্বল্পকালকে বিশালত্ব এবং বৈচিত্র্যমুখিতায় ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি। অমিত্রক্ষর ছন্দের জনক তিনি। এর আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিলো ছন্দমিলের মিত্রাক্ষর ছন্দে। বাংলায় যে এরকম অভূতপূর্ব ছন্দ হতে পারে এবং সেই ছন্দে যে চিরস্থায়ী কাব্য রচনা করা যায় তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তাঁর অমিত প্রতিভা দিয়ে।

বাংলা কাব্যের আসরে মধুসূদনের যাত্রা মহাসমারোহে, ঢাকঢোল দামামা দুন্দুভি বাজিয়ে, আড়ম্বরে, সদম্ভ আস্ফালনে। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য দিয়ে এই উর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু। ১৮৬০ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এই কাব্য ছিল মহাযাত্রার গা গরম করা অনুশীলন। তিলোত্তমাসম্ভবের কাহিনি পৌরাণিক, কিন্তু রূপায়নে পাশ্চাত্য রীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। নিজের গা গরমের সাথে সাথে অপ্রস্তুত বাঙালি পাঠককে অজানা ভূবনে নিয়ে যাবার মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন ছিল তখন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য ছিল সেই মহারণের প্রস্তুতিপর্ব। কাব্য রচনার ক্ষেত্রে অসামান্যতা প্রদর্শন করলেও এই কাব্য বাঙালির হৃদয় সেভাবে জয় করতে পারে নি। এতে মধুসূদনের প্রতিভার সর্বোত্তম ব্যবহার নেই সত্যি, তবে বিশিষ্ট হবার জন্য, কালোত্তীর্ণ হবার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই ছিল এই কাব্যে। সুন্দ ও উপসুন্দ নামের দুই অমিত শৌর্যবীর্য দানব ভ্রাতার কাহিনি এটি। এদের দাপটে শংকিত দেবতারা। ব্রক্ষ্মার বুদ্ধিতে বিশ্বকর্মা সারাবিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য তিলে তিলে আহরণ করে গড়ে তোলেন অপূর্ব রূপসী এক নারী। নাম তিলোত্তমা। এই তিলোত্তমাকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে যায় সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাই।

তিলোত্তমাসম্ভবের প্রস্তুতিপর্ব শেষ হবার পরে মধুসূদন ঝোলা থেকে বের করেন তাঁর সেরা কাব্যটি। মেঘনাদবধ। শুধু মধুসূদনেরই নয়। এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের এটিই সেরা কাব্য। এই কাব্যের কাহিনি পরিকল্পনায়, ছন্দ-নৈপুণ্যে এবং চরিত্রচিত্রণে মধুসূদনের প্রতিভা অত্যুজ্জ্বল মহিমায় উদ্ভাসিত। রামায়নের মূল কাহিনি থেকে আখ্যানটি নেওয়া, কিন্তু এর পরিকল্পনা ও আঙ্গিক রূপায়নে ইউরোপিয় সাহিত্যের বিপুল প্রভাব রয়েছে। মধুসূদন সুস্পষ্ট সচেতনতায় পাশ্চাত্য কবিকূলের অনুসরণ করেছেন। হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিলটন, ট্যাসো দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি। তারপরেও বলা যায় যে, বিস্ময়কর এবং প্রতিভার মৌলিকতার কারণে এই রচনা অনুকৃতি দোষে দুষ্ট হয় নি এবং এর উৎকর্ষও ক্ষুণ্ণ হয় নি কোনো অংশ। প্রতিভার মৌলিকতা ছাড়া, শুধুমাত্র অনুকরণ, অনুসরণ করে কোনো কবিই চিরজীবী হতে পারেন না। মধুসূদনের অপার প্রতিভার স্পর্শেই প্রাচ্য থেকে কাহিনি এবং প্রতীচ্য থেকে আঙ্গিক গঠন এবং অলংকরণ নেবার পরেও মেঘনাদবধ বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী কাব্যগাথা।

মধুসূদন প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রতীচ্যে পড়ে আছেন একথা বলার পরেও তাঁর উপরে ইউরোপের রেঁনেসার প্রভাবকে অস্বীকার করেন নি আহমদ শরীফ। এই প্রভাব ততকালীন সমাজে সবচেয়ে আগে পড়েছিল মধুসূদনের উপরে। আর এর প্রভাবেই নতুন জানালা খুলে দিলেন তিনি বাকিদের জন্য। মধুসূদনের খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েই পাশ্চাত্যকে দেখেছে বাংলার সাহিত্যসেবীরা।

আমাদের সৃজনশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদনই প্রতীচ্যের প্রথম চিত্তদূত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের য়ূরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিই ছিল তাঁর অনুধ্যানের বিষয়। তিনি ছিলেন grand and sublime এর অনুরাগী। grandeur ও grandiose ঊনিশ শতকী য়ূরোপে ছিল বিরল, তাই তাঁর মানস-পরিক্রমের ক্ষেত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগেই রইল সীমিত। আধুনিক য়ূরোপ কিংবা ভারত তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।


তবু য়ূরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব তাঁর মধ্যেও দেখি- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতিপ্রেম, স্বদেশপ্রীতি, পুরুষকারে আস্থা, ঐহিক জীবনবাদ, বিদ্রোহানুরাগ, ব্যক্তিসত্তায় ও মানবপ্রীতিতে গুরুত্ব এবং হৃদয়াবেগে মর্যাদাদান প্রভৃতি তাঁরও রচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। ফলে আঙ্গিকে তিনি ক্লাসিক হলেও প্রেরণায় পুরোপুরি রোমান্টিক। আমরা জানি, মধুসূদন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংরেজিতে কাব্যরচনা করে অমর হবার বাসনায়। বাজি রেখে বাঙলা রচনায় হাত দিলেন, এজন্যে তাঁর প্রস্তুতি ছিল না। সে বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। বাঙালিকেও জিইয়ে ছিলেন নিস্পন্দ ধড়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে বাঙলার সমাজে ও সাহিত্যে, মননে ও মেজাজে মধুসূদনই প্রথম সার্থক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী, পথিকৃৎ ও যুগস্রষ্টা। ভাবে ও ভাষায়, ভঙ্গিতে ও ছন্দে এবং রুপে ও রসে অপরূপ করে তিনি নতুন জীবন ও জগতের পরিচয় করিয়ে দিলেন বাঙালির সঙ্গে। এ দক্ষতা সেদিন আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি, যদিও ইংরেজ শিক্ষিত গুণী-জ্ঞানীর সংখ্যা নেহাত নগণ্য ছিল না সেদিনকার কোলকাতায়। (মধুসূদনের অন্তর্লোক – আহমদ শরীফ)



মেঘনাদবধ কাব্যে তিনি একটি অচিন্তনীয় এবং অভাবনীয় ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। রাম এবং রাবণের চরিত্র আমরা যেরকম করে জানি, তিনি সেটিকে উলটে দিয়েছিলেন স্পন্দিত স্পর্ধায়। বাল্মিকীর রামায়নে রাম সৎ, সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং দয়াবান। রাবণ পাপীতাপী, অন্যায়কারী ও অত্যাচারী। কিন্তু মধুসূদনের মহাকাব্যে রাম ভীরু, শঠ, প্রতারক এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ। রাবণ সাহসী পুরুষ, স্নেহময় পিতা, প্রজাহৈতিষী। দেবতাদের চক্রান্ত ও কোপানলে পড়ে তিনি একজন বিরহী ও দুঃখী মানুষ। তিনি রামায়ন নির্দেশিত পথে না চলে রাক্ষস বংশের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছেন। তাঁর কাব্যে রাক্ষসেরা বীভৎস এবং ঘৃণ্য কোনো প্রাণী নয়, বরং আমাদের মতই আবেগ-অনুভূতিতে পূর্ণ মানুষ। রাবণ চরিত্রের জন্যই মেঘনাদবধ কাব্য করুণ রসের আধার হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধ অমিততেজী বিদ্রোহী রাবণের পরাজয়ের বেদনা কাহিনি। নিষ্ঠুর নিয়তি রাবণের সর্বনাশ করেছে, দেবতারা তাঁর বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্র করেছে। এর ফলে একের পর এক পরাজয়ের কলংকচিহ্ন যুক্ত হচ্ছে তার কপালে। তারপরও তার অনমনীয় এবং উদ্ধত পৌরুষ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মেঘনাদবধের রাবণ যেন মধুসূদন নিজেই। তার জীবনেও এই একই দুর্বিনীত সংগ্রাম এবং করুণ পরাজয়ের শোকগাথা লেখা রয়েছে। এই শোকগাথার জন্য অবশ্য অন্যেরা যতটুকু না দায়ী, তিনি নিজেও তার চেয়ে বেশি দায়ী।

মধুসূদনকে আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষাপুষ্ট, আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসু, নবমানবতার উদগাতা আভিজাত্যগর্বী পরিশীলিত রুচির কবি এবং ধন-যশ-মান-লিপ্সু উচ্চাভিলাষী মানুষ বলেই জানি এবং মানি। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ছিল অসামান্য, প্রয়াস ও সাধনা ছিল নিখাদ, আর আকাঙ্খা ছিল ধ্রুব। আকাঙ্খা তো নয় যেন যোগ্যতালভ্য দাবী! তাঁর অটল আত্মবিশাসই তাঁর উদ্ধত উক্তি ও দাম্ভিক আচরণের উতস। কৈশোরে ও যৌবনে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর চাওয়া আর পাওয়া নিয়তির মতো অমোঘ। তাঁর এমনি আত্মপ্রত্যয় তাঁকে শিশুর মতো খেয়ালি, প্রানবন্ত, বেপরওয়া ও উদ্ধত করেছিল। আমাদের চোখে যা অবিমৃষ্যকারিতা ও অপরিণামদর্শিতা, তাঁর কাছে তা-ই ছিল লক্ষ্য-নির্দিষ্ট অকৃত্রিম জীবন-প্রয়াস। তাঁর সীমাহীন আত্মপ্রত্যয় তাঁকে নিশ্চিত সিদ্ধির যে প্রত্যক্ষ-মরীচিকায় নিশ্চিন্ত করে রেখেছিল, উত্তর-তিরিশে তা যখন নিয়তির ছলনারূপে প্রতিভাত হল, তখন হতাশায় ও হাহাকারে তাঁর মন-মরু কুঁকড়ে কেঁদে উঠল! তারই প্রতিচ্ছবি পাই আমরা তাঁর অমর কাব্যে ও রাবণ চরিত্রে। (নতুন দৃষ্টিতে মধুসূদন – আহমদ শরীফ)।


অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের অভিনব সৃষ্টি। বাঙালির কান এই অশ্রুতপূর্ব ছন্দে অভ্যস্ত ছিলো না। বাংলা ভাষায় যে এর প্রয়োগ হতে পারে, সে যুগে কেউ তা বিশ্বাস করতো না। এরকম একটি নতুন ছন্দকে ব্যবহার করে কাহিনিকে জিইয়ে রাখা সহজ কাজ ছিলো না। কিন্তু মধুসূদন সাফল্যের সাথে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।

অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল কাঠামোটি পয়ারের। অর্থাৎ প্রতি চরণে চৌদ্দ মাত্রা। অভ্যন্তর হলন্ত অক্ষর এক মাত্রা বলে যুক্তাক্ষর বহুল। অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল লক্ষণ তাই। পার্থক্য হচ্ছে পয়ারের প্রতি পঙতিতে ভাবসম্পূরণ, অষ্টম অক্ষরের পরে সুনির্দিষ্ট যতি ও উপচ্ছেদ এবং পদান্ত মিল অর্থাৎ অন্ত্যানুপ্রাস থাকে। কিন্তু অমিত্রাক্ষর ছন্দ এই বন্ধনের নির্দেশ অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে ভাবের আনুগত্য করে। এতে ভাবের প্রবাহ পঙতিসীমায় এসে থেমে যায় না। আবার পঙতির মধ্যে প্রয়োজনীয় ছেদ বিন্যাস করে বর্ণনাকে জীবন্ত এবং সৌন্দর্যময় করে তোলা যায়। তবে, পয়ার ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দের এই ব্যবহার অনভ্যস্ত বাঙালি শুরুতে মেনে নিতে পারে নি। সেই সময় অনেকেই কোমর বেধে নেমে পড়েছিলেন এর বিরোধিতায়।

পুরো কাব্য জুড়ে আলংকারিক ভাষার ছড়াছড়ি। নদী-গিরি, সন্ধ্যা-প্রভাত, উদ্যান-অট্টলিকার বর্ণনায় মধুসূদন ভাষার ঐশ্বর্যকে অকাতরে পাত্রে ঢেলেছেন। অলংকারের সৌন্দর্যে, ভাষার মাধুর্যে, অজস্র শব্দ ব্যবহারে এবং ছন্দের অভিনবত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে মেঘনাদবধ কাব্য খণ্ডকাব্যের খণ্ডিত পর্যায় অতিক্রম করে মহাকাব্যের বিশালতায় উঠে গিয়েছে।

মেঘনাদবধ কাব্য কি করুণ রসে সিক্ত? এর প্রধান রস কি করুণরস? এর উত্তর হ্যাঁ বোধক। এই কাব্যের প্রধান সমালোচকেরা একে করুণরসাত্মক হিসাবেই বর্ণনা করেছেন। বিদেশী কর্তৃক আক্রান্ত, পর্যুদস্ত, রাবণ বংশগৌরব এবং জাতীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ করে বসে আছেন এবং প্রতিকূল দৈবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রাবণের এই মর্মবিদারক ব্যথাই কাব্যখানির বিষয়বস্তু। রাবণের দুঃখের সাথে একাত্মবোধের জন্যই কাব্যখানি বিষাদগ্রস্ত হয়েছে এবং করুণ রসের প্রাধান্য ঘটেছে। তবে, পাশ্চাত্য মহাকাব্যের অনুকরণে রচিত বলে এতে পাশ্চাত্যের মহাকাব্যের মতই বীররসাশ্রিত। কিন্তু পরাজিত রাক্ষস বংশের প্রতি প্রবল সহানুভুতিতে বীররসকে প্রধান রস হিসাবে রাখতে পারেন নি পাশ্চাত্যের মত। একে ছাড়িয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে করুণরসই। আগাগোড়াই হাহাকারের কাব্য এটি। করুণরস এবং বীররসের বাইরেও এখানে শৃঙ্গার রস, ভয়ানক, বীভৎস এবং অদ্ভুত রসের সমাহার ঘটেছে প্রাচ্যীয় কায়দায়।

হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, বঙ্গভাষায় ইহার তুল্য দ্বিতীয় কাব্য দেখা যায় না। নিবিষ্ট চিত্তে যিনি মেঘনাদবধ কাব্যের শঙ্খধ্বনি শুনিয়াছেন, তিনিই বুঝিয়াছেন যে বাংলা ভাষার কতদূর শক্তি এবং মধুসূদন কি ক্ষমতাসম্পন্ন কবি। শুধু হেমচন্দ্রই নয়, রবীন্দ্রনাথও ইতিবাচকভাবে দেখেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্য। তিনি বলেছিলেন, কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙিয়াছেন, এবং রাবণের সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে আমাদের মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহারও শাসন ভাঙ্গিয়াছেন।

তবে মজার বিষয় হচ্ছে যে, এই রবীন্দ্রনাথই কিশোর বয়সে মেঘনাদবধ কাব্যের কঠোর ভাষায় তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত মেঘনাদবধ কাব্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেনঃ

“… যাঁহারা মহাকবি হইতে প্রতিজ্ঞা করিয়া মহাকাব্য লেখেন তাঁহারা যুদ্ধকেই মহাকাব্যের প্রাণ বলিয়া জানিয়াছেন; রাশি রাশি খটমট শব্দ সংগ্রহ করিয়া একটা যুদ্ধের আয়োজন করিতে পারিলেই মহাকাব্য লিখিতে প্রবৃত্ত হন। পাঠকেরাও সেই যুদ্ধবর্ণনামাত্রকে মহাকাব্য বলিয়া সমাদর করেন।… হেমবাবুর বৃত্রসংহারকে (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য, ১৮৭৫-৭৭) আমরা এইরূপ নাম-মাত্র-মহাকাব্য শ্রেণীতে গণ্য করি না, কিন্তু মাইকেলের মেঘনাদবধকে আমরা তাহার অধিক আর কিছু বলিতে পারি না।… মেঘনাদবধের অনেক স্থলেই হয়তো কবিত্ব আছে, কিন্তু কবিত্বগুলির মেরুদণ্ড কোথায়! কোন অটল অচলকে আশ্রয় করিয়া সেই কবিত্বগুলি দাঁড়াইয়া আছে!… সেই অভ্রভেদী বিরাট মূর্তি মেঘনাদবধ কাব্যে কোথায়? কতকগুলি ঘটনাকে সুসজ্জিত করিয়া ছন্দোবন্ধে উপন্যাস লেখাকে মহাকাব্য কে বলিবে? মহাকাব্যে মহৎ চরিত্র দেখিতে চাই ও সেই মহৎ চরিত্রের একটি মহৎ কার্য মহৎ অনুষ্ঠান দেখিতে চাই। হীন ুদ্র তস্করের ন্যায় নিরস্ত্র ইন্দ্রজিৎকে বধ করা, অথবা পুত্রশোকে অধীর হইয়া লক্ষ্মণের প্রতি শক্তিশেল নিপে করাই কি একটি মহাকাব্যের বর্ণনীয় হইতে পারে? এইটুকু যৎসামান্য ক্ষুদ্র ঘটনাই কি একজন কবির কল্পনাকে এত দূর উদ্দীপ্ত করিয়া দিতে পারে যাহাতে তিনি উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে একটি মহাকাব্য লিখিতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইতে পারেন? রামায়ণ মহাভারতের সহিত তুলনা করাই অন্যায়, বৃত্রসংহারের সহিত তুলনা করিলেই আমাদের কথার প্রমাণ হইবে। স্বর্গ-উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ  যথার্থ মহাকাব্যের উপযোগী বিষয়। আর, একটা যুদ্ধ, একটা জয় পরাজয় মাত্র, কখনও মহাকাব্যের উপযোগী বিষয় হইতে পারে না।… মেঘনাদবধ কাব্যে ঘটনার মহত্ত্ব নাই, একটা মহৎ অনুষ্ঠানের বর্ণনা নাই। তেমন মহৎ চরিত্রও নাই।… মহৎ চরিত্র যদি-বা নূতন সৃষ্টি করিতে না পারিলেন, তবে কোন মহৎকল্পনার বশবর্তী হইয়া অন্যের সৃষ্ট মহৎ চরিত্র বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন?… তিনি কোন প্রাণে রামকে স্ত্রীলোকের অপেক্ষা ভীরু ও লক্ষ্মণকে চোরের অপেক্ষা হীন করিতে পারিলেন! দেবতাদিগকে কাপুরুষের অধম ও রাসদিগকেই দেবতা হইতে উচ্চ করিলেন! এমনতর প্রকৃতিবহির্ভূত আচরণ অবলম্বন করিয়া কোনও কাব্য কি অধিক দিন বাঁচিতে পারে? মাইকেল ভাবিলেন, মহাকাব্য লিখিতে হইলে গোড়ায় সরস্বতীর বর্ণনা করা আবশ্যক, কারণ হোমর তাহাই করিয়াছেন; অমনি সরস্বতীর বন্দনা শুরু করিলেন। মাইকেল জানেন অনেক মহাকাব্যে স্বর্গ-নরক-বর্ণনা আছে; অমনি জোর-জবর্দস্তি করিয়া কোনও প্রকারে কায়কেশে অতি সংকীর্ণ, অতি পার্থিব, অতি বীভৎস এক স্বর্গ-নরক-বর্ণনার অবতারণ করিলেন। মাইকেল জানেন কোনও কোনও বিখ্যাত মহাকাব্যে পদে পদে স্তুপাকার উপমার ছড়াছড়ি দেখা যায়; অমনি তিনি তাঁহার কাতর পীড়িত কল্পনার কাছ হইতে টানাহেঁচড়া করিয়া গোটা কতক দীনদরিদ্র উপমা ছিঁড়িয়া আনিয়া একত্র জোড়াতাড়া লাগাইয়াছেন। তাহা ছাড়া, ভাষাকে কৃত্রিম ও দুরূহ করিবার জন্য যত প্রকার পরিশ্রম করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত তাহা তিনি করিয়াছেন। কাব্যে কৃত্রিমতা অসহ্য এবং সে কৃত্রিমতা কখনও হৃদয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিতে পারে না। আমি মেঘনাদবধের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লইয়া সমালোচনা করিলাম না  আমি তাহার মূল লইয়া তাহার প্রাণের আধার লইয়া সমালোচনা করিলাম, দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই। দেখিলাম তাহা মহাকাব্যই নয়।…”


রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর কাঁচা বয়সের এই কাঁচা সমালোচনাকে পরিণত বয়সে আর ধরে রাখেন নি। ওই বয়সে যেখানে তাঁর সন্দেহ ছিলো যে, মেঘনাদবধ কাব্য হবে স্বল্পজীবী, সেখানে পরিণত বয়সে এসে তিনি এঁকে অমর কাব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই অমর কাব্যে নখরাঘাত করে নিজেও অমরত্ব পাবার ইচ্ছা থেকেই ওই রকম কঠোর সমালোচনা করেছিলেন বলে আত্মস্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ইতিপূর্বেই আমি অল্প বয়সের স্পর্দ্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস  কাঁচা সমালোচনাও গালি-গালাজ। অন্য মতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার মতাটা খুব তীব্র হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপো সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম।

রবীন্দ্রনাথের অমর কাব্যের আখ্যার অপেক্ষায় অবশ্য মধুসূদন বা মেঘনাদবধকে থাকতে হয় নি। ওই সৃষ্টির দেড়শো বছর পরে এসে আমরা দেখছি যে সৃষ্টি এবং স্রষ্টা দুজনে অমরত্বের পথে অবিচল অগ্রসরমান। বাংলা কাব্য রচনায় মধুসূদনের কীর্তি অতুলনীয়। তাঁর অতুলস্পর্শী প্রতিভায় এবং বৈদগ্ধে বিমুগ্ধ হই আমরা। কাব্যদেবীর কৃপা যেন কলস্বরে এসে ভাসিয়েছিল তাঁকে। তিনি যে সময়ের কবি সেই সময় বাংলার নবজাগরণের কাল। সাহিত্যের গতানুগতিক অনুজ্জ্বল এবং একঘেয়ে ধারায় পিয়াস মিটছে না আর শিক্ষিত বাঙালির। কিন্তু নতুন কিছুও সৃষ্টি হচ্ছে না এই নবরুচির সাথে সঙ্গত করার জন্য। বাঙালির এই নবজাগ্রত সাহিত্য রুচির রসনা মেটাতে নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব তুলে নেন মধুসূদন। শুধু দায়িত্ব তুলে নিয়েই ক্ষান্ত হন নি তিনি। যুগসন্ধিক্ষণে সমস্ত সংস্কারকে ভেঙেচুরে জাঁহাবাজ জাহাজির মতো সাগরে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর সাম্পান প্রবহমান সমীরণকে উপেক্ষা করে।

আমাদের সাহিত্যদ্রোহীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি; মধ্যযুগ থেকে তিনি কয়েক বছরে বাঙলা সাহিত্যকে নিয়ে আসেন আধুনিক কালে। এমন এক সময়ে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন, এবং জন্ম দিচ্ছিলেন তাঁর স্পর্ধিত রচনাবলি, যখন বিনয়-বিকাশ-ক্রমমুক্তি কাজে আসতো না কোনো। তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের মতো ক্রমবিকশিত হওয়ার সাধনার অর্থ ছিলো ব্যর্থতা। তাঁর সার্থকতা আকস্মিক বিস্ফোরণে, চারপাশে হঠাৎ তীব্র আলোকে ভরে দেয়ায়। তাঁর সংস্কারমুক্তি, বিশ্বপরিব্রাজকতা, অতৃপ্তি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিলো হঠাৎ সফল হয়ে বিনাশের অভিমুখে ধাবিত হবার। মধুসূদনের মধ্যে যে বিক্ষোভ, বিনাশ ও মহান অশুভকে পাই, তা বর্তমান সময়ের বান্ধব। তাঁর সংস্কারমুক্তি ঈর্ষা জাগায় আমাদের; এখন আমরা প্রতিদিন বাঁধা পড়ছি এক একটি সংস্কারের শেকলে, খুলে বেরোতে না বেরোতেই নতুন কোনো শেকলে জড়িয়ে পড়ে আমাদের শিল্প ও জীবনভাবনা। কিন্তু মধুসূদন সমস্ত সংস্কার পরিহার করতে পেরেছিলেন বলে তিনি যেমন প্রথাগত বিশ্বাসের বিরোধী কল্পনাকে মূল্যবান করে তুলতে পেরেছিলেন একের পর এক নতুন সাহিত্য আঙ্গিক সৃষ্টি করতে। তাঁর রাম-রাবণ পরিকল্পনা মহত্তম দুঃসাহসের উদাহরণ, এমন সংস্কারমুক্তির পরিচয় বাঙলা ভাষায় আর পাওয়া যায় না। মধুসূদন এমন কাজ করে গেছেন মেঘনাদবধকাব্যে, যা সাম্প্রতিক হিন্দু মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। তিনি যখন একের পর এক নতুন সাহিত্য-আঙ্গিক সৃষ্টি করছিলেন, পয়ার ভেঙে ফেলে বইয়ে দিচ্ছিলেন প্রবহমাণ অক্ষরবৃত্ত, রচনা করছিলেন নিষিদ্ধ ট্রাজেডি, বা সৃষ্টি করছিলেন অভিনব চতুর্দশপদী, তখন সংস্কারমুক্তির কাজ করেছে প্রধান প্রেরণারূপে। (মাইকেল মধুসূদনঃ প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা – হুমায়ুন আজাদ)