২০১০ সালের ১৬ জুন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভাতে চুল তাই স্ত্রীকে ন্যাড়া করে দিয়েছে স্বামী’ এরকম শিরোনামে একটি খবর পড়ে ছোটবেলায় নিজের আর সমবয়সীদের মাথা ন্যাড়া হওয়ার কথা মনে পড়ল। সাধারণত প্রায় বছরই গ্রীস্মের বা রমজানের ছুটিতে বোন ও ঠাকুমা আমাদের দুইবোনের মাথা ন্যাড়া করে দিতেন। গ্রীস্মেই বেশি করতেন। উছিলা ছিল গরম কম লাগবে এবং দীর্ঘ ছুটিতে ন্যাড়া মাথায় চুল একটু উঠবে যা স্কুলে গেলে আমাদের ঠুল্লা মাথার হাস্যকর পরিস্থিতিতে থেকে কিছুটা রক্ষা করবে। ন্যাড়া মাথা আঞ্চলিক ভাষায় বলতাম ঠুল্লা মাথা। খেপানোর জন্যে আরেকটা শব্দ ছিল বেল মাথা।

শৈশবে এ ঠুল্লা মাথা হাসির খোরাক ছিল। ন্যাড়া মাথাকে ছড়া বলে ভেঙানো হতো —-
‘ঠুল্লা মাথা
বেলের পাতা
আর কবিনি মিছা কথা?’

অর্থাৎ মিথ্যা কথা বলার অপরাধেই যেন ন্যাড়া মাথা করা হয়েছে।

আরেকটা ছিল —
‘ঠুল্লা মাথা
বেল বেল
পইড়া গেল মাথার তেল।’
অর্থাৎ ন্যাড়া মাথায় তেল দিলে গড়গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার চিত্রকল্প।

অনেকে ঠুল্লা মাথায় ঠাল্লা অর্থাৎ চাটি মেরে ছোটদের ব্যথা দেয়াকে উপভোগ করত।

ভাইদের মাথা ন্যাড়া করতেন না। ঠাকুমা ও বোনের তাদের ধারণা ছিল যতবার ন্যাড়া করবে চুল তত ঘন হয়ে উঠবে। আর মেয়েদের ঘন চুল বিয়ের বাজারে রূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কাজেই চুল দীর্ঘ করা ছিল আমাদের মাথা ন্যাড়া করার অলিখিত উদ্দেশ্য। তখন আমার বোধ এ সব অলিখিত উদ্দেশ্য বোঝার মত এতটা তীক্ষ্ণ ছিল না। তবে আমাদের ভাইবোন সবার মাথার চুলই কিন্তু ঘন। ঠাসা।

বিদ্যালয়ের উচ্চ শ্রেণীতে উঠার পর বোন চুল বিলিয়ে বিলিয়ে খাঁটি নারকেল তেল বা হিমকবরী তেল মাখিয়ে কাল ফিতা দিয়ে কষে চুল বেঁধে রঙিন ফিতায় ফুল তুলে দিতেন। এ কষে বাঁধায় চুল লম্বা হয় বলে ধারণা ছিল। আমার এখনকার চুলের ইচ্ছাকৃত আকার দেখলে ঠাকুমা ও বোন বেঁচে থাকলে তাঁদেরকে হতাশ হতে হতো বৈকি।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুরুষদের মা বাবা মারা গেলে শ্রাদ্ধের আগে মাথা ন্যাড়া করার রেওয়াজ রয়েছে। এ ধর্মের সদ্য বিধবারাও নিজের রূপ ঢাকতে শোকের উছিলায় মাথা ন্যাড়া করে থাকেন। অর্থাৎ ন্যাড়া মাথা শোকের আমেজ বহন করে এবং বিষয়টি তথাকথিত শাস্ত্রীয় প্রচ্ছদে ঢাকা হয়।
হিন্দু ধর্মে তীর্থযাত্রীরা মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে গয়া কাশি বৃন্দাবন ঘুরে আসলে এবং ইসলাম ধর্মে পুরুষরা হজ্ব করে আসলে দেখি ন্যাড়া মাথা। অর্থাৎ আপাত সংসারত্যাগী পূণ্যার্থীরা মাথা ন্যাড়া করেন।

আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি চুরি করে ধরা পড়লে শাস্তি হিসেবে মাথা ন্যাড়া করে বাজারে ও গ্রামে ঘুরানোর রেওয়াজ প্রচলিত। এখনও মাঝে মাঝে এ ধরণের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চোরের এ শাস্তির প্রভাবেই ছোটরাও ন্যাড়া মাথা নিয়ে বিব্রত হতো। ন্যাড়া মাথা দেখে অন্যরা দুষ্টুমি মাখা হাসি হাসত যার অর্থ দাঁড়াত, কি দোষে মাথা মুড়িয়ে দেয়া হল?

দৈনিক পত্রিকার পাতায় খবরটি ছিল —–
‘‘ভাতে চুল পাওয়ার স্ত্রীর মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে রহিদুল ইসলাম (৩৭) নামের এক ব্যক্তি। গতকাল দুপুরে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার চরকানাই ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। প্রতিবেশি আলাউদ্দিন ও রাজ্জাক জানিয়েছেন, রহিদুল দুপুরে খেতে বসে ভাতের মধ্যে একটি চুল পান। এ নিয়ে তার স্ত্রী শাহিদা আক্তারকে (৩০) গালিগালাজ করেন তিনি। এক পর্যায়ে ব্লেড এনে স্ত্রীর মাথা ন্যাড়া করে দেন রহিদুল। খবর পেয়ে শ্বশুর- শাশুড়ি আসলে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মিমাংসা করা হয়।’’

খবরে প্রকাশ রহিদুল ইসলাম ও শাহিদা আক্তারের দশ বছরের দাম্পত্য সম্পর্ক। এক দশক ঘর করেও স্ত্রী তার স্বামীর কাছে এতটুকু মর্যাদা পেল না। এ ন্যাড়া মাথা তো অপমানের এক দগদগে ঘায়ের উদাহরণ। এরপরও স্ত্রীটি সংসার করছে ঐ স্বামীটিরই সাথে। শাহিদারা আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ঘটিত নাটকের উপায়হীন ও সহায়হীন বাস্তব চরিত্র। বাংলাদেশের কোন স্ত্রী তার স্বামীর সাথে এ ধরণের ঘটনা করেছে বলে আমার জানা নেই। করার মত অবস্থা ও অবস্থানও এদেশের কেন সারা বিশ্বের নারীদেরই নেই। আর কোন স্বামী এর চেয়ে কম দোষ করলেও এমন স্ত্রী নিয়ে ঘর – সংসার করত না।
স্বামীটি মার-ধর করেনি, নারীটি ধর্ষণের শিকার হয়নি তবুও শাহিদা আক্তারের এ অপমানকর, অবমাননাকর ও অধঃস্তনতার উদাহরণ নারী মাত্রই গায়ে লাগার কথা। এ কাজটি করার জন্যে আইনের চোখে রহিদুলকে কেউ অভিযুক্ত করায়নি, সামাজিকভাবেও অভিযুক্ত হয়নি, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এ খবরটি পড়ে অপমানবোধ করছি এবং লোকটির মাথা মুড়িয়ে দেয়ার মত প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি না জাগলেও সামাজিকভাবে রহিদুললে অভিযুক্ত করার উদ্যোগ নেবার মত মনোভাব পোষণ করছি।

আমি এবং আমার ভাইবোনেরা,আমাদের পাড়ার সব পড়ুয়ারাই শব্দ করে পড়তাম। শব্দ করে না পড়লে অভিভাবকদের কাছ থেকে তাড়া পেতাম, পড়া বন্ধ কেন? কাজেই কেউ মাছির মত ভন ভন করে কেউ চিল্লিয়ে পড়া চালিয়ে যেতাম।

শব্দ করে পড়ার ফলে সোনাকাকা অন্যত্র বসেই উচ্চারণ শুদ্ধ করে দিতেন। আমার এক জেষ্ঠ্যতুত ভাইয়ের বাংলা পড়া নিয়ে হাসাহাসি হতো। ধ্বংস শব্দটি পড়তেন ধ বংস উচ্চারণে। এমনি বিস্ময়কে বিসময়, গ্রীস্মকে গীস ম বলা ছিল তার উচ্চারণ রীতি। তা শুধরাতে সোনাকাকার বেশ সময় লেগেছিল।
ইউনিভার্সিটির হলে থাকতে আমার এ অভ্যাস আমার রুমমেটদের অনেক বিরক্তি উৎপাদন করলেও আমি ছিলাম অসহায়। কারণ, জোরে শব্দ করে না পড়লে আমার মুখস্থ হতো না।

কিন্তু আমার ছেলেমেয়ের পড়া শব্দহীন। তারা টিভি দেখতে দেখতে অংক করতে পারে। গান চালিয়ে পড়তে পারে। আমি অফিসে নিচু স্বরে গান শুনার চেষ্টা করে দেখেছি কাজ করতে পারি না। গানে মন চলে যায়। ছোটবেলা পড়া মুখস্থ করতাম জোরে,কারণ অন্য শব্দ কানে আসলে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়ে যেত। এখন অফিসেও একই অবস্থা। কাজ করতে করতে ভাল না লাগলে একটু সময় গান শুনি। গান শুনতে শুনতে কাজ করতে পারি না। গান আমার কাছে সুরের সাথে কথা এবং কণ্ঠও গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্র সংগীতের সুর ও কথার সাথে কন্ঠও অনুভব করি। সবার কণ্ঠে তো সব গান ভাল লাগে না। অন্যের ফোনের কথোপকথনও আমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। আমি এও বুঝি আমার টেলিফোনের কথোপকথন অন্যকে বিরক্ত করে। আর দিন দিন মনোযোগ অনেক বেশি মনোযোগ চায়।