২০১৩ সাল হতে ইসলামী জঙ্গিরা ধারাবাহিকভাবে নাস্তিক-সংখ্যালঘু-প্রগতিশীলদের কুপিয়ে হত্যা করলো, সরকার তখন এসব নৃশংস ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে আখ্যায়িত করে; সরকার স্বীকারই করলো না যে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ ভয়ংকরভাবে বিস্তার করেছে।

গতকাল গুলশানে ইসলামি জঙ্গিদের হামলায় ২০ জন বিদেশী ও ০২ জন পুলিশ নৃশংসভাবে মারা গেছে, আহত হয়েছে অসংখ্য।

এই মর্মান্তিক ঘটনাটি হয়তো ঘটতো না, যদি ২০১৩ সাল হতে ইসলামী জঙ্গিদের হাতে ধারাবাহিকভাবে নৃশংসতম উপায়ে নাস্তিক খুনের ঘটনাগুলোকে সরকার বিচ্ছিন্ন ঘটনা আখ্যা না দিয়ে বরং জঙ্গিবাদ দমনে জরুরি ব্যবস্থা নিতো।
সে সময় নাস্তিক ও প্রগতিশীলরা বারবার সরকারকে বলেছিল, ইসলামী জঙ্গিদের হাতে নাস্তিক হত্যাকান্ড একসময় মহীরূপ নেবে, দ্রুত জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হবে বাংলাদেশে বসবাসরত সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু সরকার সে সময় এগুলোকে শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের উপস্থিতি প্রকারান্তরে অস্বীকার করেছিল তা নয়, উপরন্তু সরকারের মন্ত্রী ও প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সহিংসতার জন্য নিরীহ ভিক্টিমদের তাদের লেখালেখি ও আচরণের জন্য দায়ী করেছিল।

ইসলামী জঙ্গিবাদ বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া।
এই ফোঁড়া যখন ছোট ছিল, তখন সরকার এর উৎপাটনের দায় এড়িয়ে গেছে বরং ভিক্টিমদের দোষারপ করেছে। বর্তমানে এই ফোঁড়া দেশের সবকিছুকে টার্গেট করছে; প্রতিদিনই ইসলামী জঙ্গিরা বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও তাদের নৃশংস অভিযান পরিচালনা করছে।
এখনও যদি সরকার ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে না যায়, তবে বাংলাদেশের পুরোপুরিভাবে পাকিস্তান-অাফগানিস্তান-নাইজেরিয়ায় পরিণত হওয়া অতিস্বল্প সময়ের ব্যাপার।

প্রথমে আলোকপাত করা যেতে পারে, বাংলাদেশের এই ইসলামী জঙ্গিগোষ্টী কারা?

বাংলাদেশের জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসার আল ইসলাম আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল কায়েদার সাথে যুক্ত।

গুলশানে হামলার ঘটনায় আনসার আল ইসলামের হামলারর পূর্বে ও হামলার সময় ঘটনার বর্ণনা দিয়ে টুইট, সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রদত্ত তথ্য প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক বলয়ে বাংলাদেশের এই ইসলামী জঙ্গিদের যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা আছে।

বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের হর্তা-কর্তা-জন্মদাতা-লালনকারী হলো জামাত-ই-ইসলামী।

বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনাকারী জঙ্গিসংগঠন জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হিজবুত তাহরির জামাত-ই-ইসলামীর স্পন্সর করা জঙ্গিসংগঠন।

জামাত-ই-ইসলামীর নিজস্ব সামরিক শাখা হলো ইসলামী ছাত্র শিবির।

জঙ্গি কার্যক্রমে জামাত-ই-ইসলামী তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ সহায়তা গ্রহণ করে।

আর রাজনৈতিকভাবে জামাত-ই-ইসলামীর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে বিএনপি ও এর জোটবদ্ধ দলগুলো।

যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান।
তাই, মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করার জন্য জামাত-ই-ইসলামী হেফাজত, খতমে নব্যুয়ত সহ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অসংখ্য ইসলামী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকে স্পন্সর করছে।

প্রশ্ন হলো, কেন জামাত-ই-ইসলামী এমনটি করছে?

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত-ই-ইসলামীকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা করে দেয়; তাদের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা একাত্তরে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন, এদের অনেকের ফাঁসির শাস্তি আইনগতভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
জামাত আন্তর্জাতিক বলয় থেকে প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেও তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিচার-শাস্তি হতে বাঁচাতে পারেনি।
এদিকে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন সামাজিকভাবে জামাত-ই-ইসলামীকে চুড়ান্তভাবে বেকায়দায় ফেলে দেয়।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশে জামাত-ই-ইসলামীে টিকে থাকার জন্য দু’টি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তা হলো-

১. বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ তথা, মুসলমানদের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করা।

২. দেশকে জঙ্গি হামলার মাধ্যমে অস্থিতিশীল করে তোলা।

প্রথম পরিকল্পনায়, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ তথা, মুসলমানদের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে জামাত-ই-ইসলামী সফল হয়।
হেফাজতের মাধ্যমে নাস্তিক ফতোয়া দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনকে জনবিচ্ছিন্ন করা এবং আনসার আল ইসলামের (পূর্বনাম- আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) মাধ্যমে নাস্তিক, প্রগতিশীল, সমকামীদের হত্যার মাধ্যমে দেশের সচেতন এই যুব সমাজকে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের কাছে নেগেটিভলি উপস্থাপন করা ক্ষেত্রে জামাত-ই-ইসলামী তাদের উদ্দেশ্যে বেশ সফল।
এমনকি এসব হত্যার প্রতি স্বীকৃতি ও সমর্থন সাধারণ জনতা ও প্রকারান্তরে সরকার-প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে।
এরফলশ্রুতিতে আমরা সরকারের ধর্মাশ্রয়ী আচরণও দেখতে পাই।

দ্বিতীয় পরিকল্পনায়, দেশকে জঙ্গি হামলার মাধ্যমে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
কারন, রাজনৈতিকভাবে জামাত-ই-ইসলামীর নেমেসিস হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার।
আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে জামাত-ই-ইসলামী পাকিস্তান-আফগানিস্তান-মধ্যপ্রাচ্য-নাইজেরিয়ার জঙ্গিগোষ্টীগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিয়েছে।
জামাতের এই পরিকল্পনায় ব্যবহৃত হচ্ছে জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, হিজবুত তাহরীর, হামজা বিগ্রেড সহ আরো বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন।
তবে জামাতের এই সামরিক পরিকল্পনা হলো তাদের শেষঅস্ত্র; তাদের পিঠ দেয়ালে একদম ঠেকে গেলে তারা পুরোদমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে।
এর ফলে, পাকিস্তান-অাফগানিস্তান-মধ্যপ্রাচ্য-নাইজেরিয়ার মত বাংলাদেশেও জঙ্গিদের তথা জামাত-ই-ইসলামীর একটি উপসরকার ও ছায়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
বর্তমানে জামাত-ই-ইসলামী এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক স্তরে আছে; এর আওতায় তারা সংখ্যালঘু, ভিন্নমতালম্বী মুসলমান ও বিদেশীদের আক্রমন করছে, তাদের স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে, বড়ধরণের সাম্প্রদায়িক হামলার চেষ্টা করছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল (০১.০৭.২০১৬) রাতে সবচেয়ে বড় হামলাটি চালিয়েছে গুলশান-২ তে; এতে প্রায় ২০ জন বিদেশীকে হত্যা করা হয়।
এসব নৃশংস ঘটনাগুলো হলো আসন্ন ভয়াবহ হামলার ডেমো।

জামাত-ই-ইসলামী তাদের এই ভয়ংকর পরিকল্পনায় একটি কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছে।
তা হলো- এই পুরো দৃশ্যপটে জামাত নিজেকে আড়ালে রেখেছে এবং জনগণ ও বৈশ্বিকভাবে সিভিলাইজড ইমেজ বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
এর কারন, চুড়ান্তভাবে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে দৃশ্যপটে সিভিলাইজড ইসলামিক দল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ তথা মুসলিম জনতার পছন্দ হিসেবে সামনের সারিতে আসবে জামাত-ই-ইসলামী।
এমনকি ভবিষ্যতের অস্থির সময়ে জামাতের পরিকল্পিত যে উপসরকার ও ছায়ারাষ্ট্র অন্যান্য জঙ্গিআক্রান্ত রাষ্ট্রের মত এদেশে গঠন হতে পারে, তার মধ্যমণিও হবে এই জামাত-ই-ইসলামী।

এক্ষেত্রে জামাত-ই-ইসলামী এই ভয়ংকর পরিকল্পনা রুখে দিতে করণীয় কি হতে পারে?

সরকার-প্রশাসন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
সরকারের উচিত এখনই আইনের মাধ্যমে বলপ্রয়োগ করে ইসলামী জঙ্গিদের নির্মূল করা।
এক্ষেত্রে সরকার বেশকিছু কাজ করতে পারেন-

১. জঙ্গিবিরোধী বিশেষ আইন প্রণয়ন।
২. জঙ্গি স্থাপনায় অভিযান পরিচালনা করা, তাদের অর্থ ও লজিস্টিক সাপোর্টের উৎস চিহ্নিত করা এবং তা দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. জঙ্গিদের বিশেষ আইনে দ্রুতবিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
৪. মোল্লাদের ফতোয়া নিষিদ্ধকরণ ও ক্ষমতা হ্রাসকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. মাদ্রাসা ও ধর্মীয় সংগঠনের উপর মনিটরিং সেল গঠন করা যেন, এখান থেকে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ন্ত্রন করা যায়।
৬. ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ।

৭. শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ণ করা, তথা- মানবিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠের অধিক প্রচলন করা।
৮. ইমাম ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের জঙ্গিবিরোধীতায় তাত্ত্বিক শিক্ষা প্রদানের জন্য সেমিনার ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা।
৯. প্রতিটি এলাকা, প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী সচেতনতামূলক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা।
১০. প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা করা।

১১. জামাত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণ করা, এর সদস্যদের কার্যক্রম মনিটর করা এবং আর্দশিক ও বাস্তবিক দিক হতে জামাতের চুড়ান্ত দমনে ব্যবস্থা গ্রহণ।
১২. এটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা আজ হোক, কাল হোক, এর বাস্তবায়ন জরুরি এবং আবশ্যকীয়- রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ ও শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ধারণ করা।

সরকার যদি অতিদ্রুত ইসলামী জঙ্গিবাদ সমূলে নির্মূলের বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অতিশীঘ্রই আরো খারাপ হবে, জঙ্গিরা তাদের হামলার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত করবে, জামাত-ই-ইসলামী তাদের ভয়ংকর উদ্দেশ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে।

এখন সময় এসেছে ডিনায়াল থেকে বেরিয়ে সরকারের স্বীকার করা যে- বাংলাদেশে অান্তর্জাতিক মদদপুষ্ট ইসলামী জঙ্গিদের অস্তিত্ব আছে এবং বাংলাদেশ ইসলামী জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত ও ইসলামী জঙ্গিরা সুসংগঠিত।

এবং দেখার বিষয়, আসন্ন ভয়ংকর ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে সরকার কতটুকু কি পদক্ষেপ নেয়। গতকালকের গুলশান-হামলার ঘটনার পরেও যদি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জঙ্গিদমনে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী। কারন, জামাত-ই-ইসলামীর ভয়ংকর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফলতা অর্জন মানে হলো বাংলাদেশের মৃত্যু।