বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র,দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম, মানবতা, প্রগতি এইসব নিয়ে মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। অভিজিৎ রায় ছিলো যেন এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। কি হতে যাচ্ছে তা যেন সে অনায়াসেই আঁচ করতে পারত। প্রায় ২৫ বছর আগে সে বলেছিল যে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামের এক কালো ছায়ায় দ্রুত আবদ্ধ হয়ে পড়ছে বিশ্ব। মানবজাতি সেই ভাইরাসে আক্রান্ত। তাঁর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি সেই ভাবনা থেকেই লেখা।

অনেক বছর আগেই অভিজিৎ লিখেছিল যে ভবিষ্যতের অনগ্রসর মানুষের জীবনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে সেক্সসুয়ালিজম। তখনই সমকামিতা নামের একটি বই লিখবার কথা ভাবে সে। আশঙ্কা করেছিলো সমকামিতা বাংলাদেশের মত ধর্মবিশ্বাসের দেশে সমস্যার একটা বড় বিষয় হয়ে উঠবে। সমকামিতা নিয়ে যখন উন্নতবিশ্বে জাগরণের ঢেউ, বাংলাদেশে তখন এ নিয়ে কোন আলোচনাই নেই। অভিজিৎ রায় সময়ের আনেক আগে তা বুঝতে পেরে এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বই লিখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কাম বিষয়ে বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ দেশের মানুষের জ্ঞান বাড়াতে অভিজিৎ ’সমকামিতা’ , একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান বইটি লিখে ফেলে। সহজ করে বাংলা ভাষায় লেখা বইটি তখন বাংলাদেশের তথা বাঙালির মনোযোগ আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল বেশ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। অনগ্রসর দেশে এমন প্রগতিশীল লেখা ও বিজ্ঞান, যুক্তি, মুক্তচিন্তা চর্চার অন্যতম একজন সংগঠক হয়ে উঠবার কারণে অভিজিৎ খুন হয়ে যায়।

বাংলাদেশে আজ প্রায় ২৫ বছর পর ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা রূপান্তরকামী বিষয়টি আগুনে ইস্যু হয়ে উঠেছে। ওদিকে মাদ্রাসা পড়ুয়া দরিদ্র ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষকদের দ্বারা ধর্ষিত এবং খুন হয়ে গেলেও মানুষ পরোয়া করছে না। সামাজিক প্রতিবাদ প্রতিরোধ নেই। দেশের আনাচে কানাচে মসজিদ, মাদ্রাসায় কি হচ্ছে তা নিয়ে যেন আমাদের দেশের আঁতেল বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্র কারোই সত্যিকার অর্থে কোন মাথাব্যথা নেই। মুখ বন্ধ হয়ে থাকে সবার। রাষ্ট্র তৈরি করে দেশে শত শত মসজিদ। মাদ্রাসাশিক্ষার মাঝেও আছে হরেক রকমের শিক্ষার ধারা। যে যেভাবেই পারে, যেনতেন ভাবে দু চারটা বাড়ি মিলিয়েই একটা মসজিদ বানিয়ে ফেলছে। এতিমখানা বানিয়ে ফেলছে। আর সেসবের সুযোগ নিচ্ছে আমাদের দেশের গ্রামীন রাজনীতির মোড়ল, ধর্মীয় মোড়লরা। শীতকাল আসলেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে শুধু ওয়াজ আর মাহফিলে কেঁপে উঠে সারাদেশ। সেখানে ধর্মের নামে ওয়াজ মাহফিলে শুধু দেশের সরকার প্রধান থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, নারীনেত্রী হারাম থেকে আমেরিকা, ইজরাইল, ইহুদি, নাসারা, হিন্দুধর্ম থেকে অন্য সব ধর্মের বিরুদ্ধে হেন কোন বিদ্বেষ-বিষ নেই যা ছড়ানো হয় না। এসব নির্বিঘ্নে করে চলে ঐসব আলেম মোল্লারা। সেই সব মাহফিলে দেশের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা থেকে শুরু করে জোয়ান-বুড়া সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেগুলো শুনে শুনে আমজনতার ব্রেইনওয়াশ হয়ে যায়। কবিগান, যাত্রা পালা, বাউল গানের আসরের বদলে আজ হয় ওয়াজ মহফিল যা বিনোদনের নামে ঐ বিদ্বেষ বিষ ছড়াচ্ছে। ধর্মের নামে পুরো সুযোগ নিচ্ছে মোড়ল শ্রেনীর সব গোষ্টী। ২০-৩০ বছর আগেও মানুষ গ্রামে পালাগান, যাত্রা, লালনগীতি, সার্কাস ইত্যাদি নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতে পারত সাধারণ মানুষ। এখন সেসবের বালাই নেই। এখন পরিচয় হয় ধর্মে। মানুষ মানুষের পরিচয় দেয় কে মুসলমান আর কে হিন্দু। হবে না কেন? এমন চললে তাই তো হবে। অথচ এই দেশ সে-ই কবে মানুষ হয়ে বেঁচেছিলো শুধুই মানুষ পরিচয়ে। মানুষের মাঝে মানবিকতার বোধ ছিল প্রবল। সেই প্রবলবোধ আরো বেশি হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে। বাঙালি জাতি দূর্ভাগা জাতি। ৭১’এর ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে পারি নি।

যদি বাংগালীরা ৭১’র মূলনীতির ধারাবাহিকা ধরে রাখতে পারত তাহলে আজ হয়ত আমরা জীবনের আর কত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। ট্রান্সজেন্ডারসহ সমকামিতা, বিষমকামিতা, বাই-সেক্সসুয়াল ইত্যাদি সব ধরনের সেক্স নিয়ে উম্মুক্ত আলোচনা করতে পারতাম। কিন্তু বিধি বাম। সেই আলোচনা করতে যেয়ে আমাদের দেশের আজকের যারা খুবই উচ্চশিক্ষিত ডিগ্রীধারী, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা তাদের কথা আর আলোচনা শুনলে মনে হয় যেন তাঁরা অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। সবচাইতে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে সেসব উচ্চশিক্ষিত মানুষজনের অনেকেই ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত পৃথিবীর অনেক দেশে বসবাস করে এসেছে।

আজকের ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে দেশের স্বনামধন্য লেখক, বুদ্ধিজীবিরা যেন মুরগীর খোঁয়াড় থেকে বের হয়ে আবোল-তাবোল আর মরিয়া হয়ে আগডুম-বাগডুম বকে যাচ্ছে। এরা মিডিয়া, পত্র-পত্রিকা থেকে অনলাইন এবং টিভি টক-শো-তে যেন গলা ফাঁটিয়ে জোর করে দেশের মানুষকে ব্রেইনওয়াশ করছে। এসব দেখলে লজ্জায় মাথা নুঁয়ে পড়ে। কারণ, কাম বিষয়ক জ্ঞান নেই তাঁদের।এই বিষয়ে এরা অভিজিৎ রায়ের বা অন্য কারো বই পড়তে চায় না। জ্ঞান এদের আটকে আছে গোঁয়ার্তুমিতে।

অভিজিৎ রায় এবং তাঁর মত মানুষের আজ বড়ই প্রয়োজন। বাংলাদেশের এমন কুৎসিত আদিম মনোভাবাপন্ন শিক্ষিত আঁতেলদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য অভিজিৎ’এর লেখার মত তীব্র, ঝাঁঝালো ও ক্ষুরধার লেখা খুব দরকার ছিলো। আশার কথা, কেউ কেউ লিখছেন বা বলছেন। তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা বলছেন এবং লিখছেন। সেইসব মহৎপ্রাণের জয় হোক।

ফেব্রুয়ারীর বই মেলাতেই অভিজিৎ রায়কে ঠান্ডামাথায় পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হত্যা করেছিল। এইতো, কিছু পরেই শুরু হবে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রানের বই মেলা। এই মেলাতে অংশ নিতেই অভিজিৎ দেশে গিয়েছিলো, ইচ্ছে ছিলো তাঁর বই নিজ হাতে মেলায় প্রিয় বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। সে কি জানতো যে সেইটাই ছিলো তাঁর শেষ যাত্রা? অভিজিৎ রায় তাঁর সমকামী বই লিখেছিল প্রায় ২৫ বছর আগে। সেই বইয়ের প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতির ও বাঙালির সংস্কৃতির অঙ্গনে জোর প্রভাব ফেলেছিল।

অভিজিৎদের খুন করে, থামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আজ পেয়েছে কুৎসিত মনোভাবের শিক্ষিত ডক্টরেট-ধারীদের, অন্ধকারের শিক্ষক, আঁতেল এবং স্বার্থপর মৌলবাদী শাসক-শোষক সুবিধাবাদিরের। এদের সুমতি হোক।

আজ এত বছর পরে হলেও নানাবিধ ধরণের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা উঠেছে। এই আলোচনা জরুরি। মানবাধিকারের পক্ষে যাবার জন্য বিবিধ লৈঙ্গিক মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করা ও এই বিষয়ে জ্ঞানার্জন একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

বিভিন্ন লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে এবং সেগুলো জানতে হবে এমন ভাবনায় কথা বলা একটি লিংক দিচ্ছি এখানে।

চিররঞ্জন সরকার লিখেছেনঃ হিজড়াদের নিয়ে গল্প, প্রতিক্রিয়া ও আমাদের কূপমণ্ডুকতা

 

অভিজিৎ রায় লিখিত বই পড়তেঃ

সমকামিতা বইটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

বিশ্বাসের ভাইরাস বইটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ভাবুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন, কৌতূহলী হন, জানুন। জ্ঞানচর্চাই মুক্তি। মুক্ত চিন্তা, মুক্ত বুদ্ধির জয় হোক। যুক্তি আনুক মুক্তি।