অষ্টাদশী, লাজুক, সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকা আমি হঠাৎ করে প্রেমে পড়ে গেলাম। ছেলেটি মেধাবী, সুদর্শন, মাত্র ২৪ বছর বয়েসেই বিসিএস দিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে জয়েন করছে। পাশাপাশি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ছেলেটি তার কর্মস্থলের বিশাল বাংলোতে আত্মীয়-বন্ধুহীন একাকী সময় কাটায়। অবস্থা বিবেচনায় মোটামুটি পারিবারিক ভাবেই দ্রুত আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আর বিয়ের  সাথে সাথেই শুরু হলো আমার মানসিক টানা-পোড়েন,যেখান থেকে গল্পের শুরু আর কিভাবে অভিজিত রায় আমাকে এই টানা-পোড়েন এর সমাধান দিলেন তা এই গল্পের মূল বিষয়।

আমার শ্বশুরবাড়িতে বিয়েটা ওই সময় আকাঙ্ক্ষিত ছিল না। আমার ভাসুর তখনো বিয়ে করেনি। ছেলের একাকীত্ব আর কিছুটা ছেলের জোরেই বিয়েটা হয়। এই বিষয়টা নিয়ে আমার বর অপরাধবোধে ভুগতো। আর এটাই হলো আমার শ্বশুরবাড়ির বড় অস্ত্র। বিয়ের প্রথমদিক থেকেই আমাকে মুখোমুখি হতে হলো অতি কমন বাংলা সিনেমার। ধীরে ধীরে জটিলতা বাড়তে লাগলো। আমার এবং আমার ফ্যামিলির সবকিছুতেই দোষ ধরা পড়ল। প্রথম কয়দিন আমার প্রতিভাবান বর, যার কিনা  ষোল পাতা প্রেমপত্র জুড়ে থাকতো কিভাবে বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর মানুষগুলোকে পরিবেশ রক্ষায় আরো শিক্ষিত করে তোলা যায় তার হাজারো পরিকল্পনা – সে আমাকে বোঝাতে লাগলো যে, “ওরা অভিমান করে আছে, চলো আমরা একটু খুশী করার চেষ্টা করি। সব ঠিক হয়ে যাবে।“ তাই আমাদের কাউকেই কোনোকিছুর প্রতিবাদ করা চলবে না। কিন্তু পরিস্থিতি তাতে আরো খারাপ হলো। পাঠককে এতকিছু বলছি কারণ এই ভূমিকাটুকু না দিলে বিষয়টা হয়ত পুরো বোঝাতে পারব না। খুশী করার চেষ্টার একটা উদাহরণ দেই, তাহলে হয়ত বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে অভিযোগ আসলো যে, আমি কথা বলি বাচ্চাদের মত আহ্লাদী স্বরে। আর তাই নিয়ে তাদের ছোট হতে হয় প্রতিবেশীদের কাছে।তখনই আমার বর গানের ওস্তাদ ডেকে আনলো। আমি যদি চেষ্টা করে গলার স্কেলটা চেইঞ্জ করতে পারি তাহলে ওদের খুশি করা যায়। কিন্তু এটা হলো ওর চরিত্রের একদিক, অপরদিক হলো, সে আমাকে প্রচুর পড়তে বলে, self dignity অর্জন করতে বলে। বলে, পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়েও যদি আমি তাকে ভালোবাসি সেটাই হবে প্রকৃত ভালোবাসা। বাংলাদেশের সামাজিকতায় মেয়েদের অবস্থান আর তার থেকে কিভাবে বের হয়ে আসতে হবে তা নিয়ে অনেক জ্ঞান দেয়। আবার খুশি করার প্রক্রিয়া দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। পুরো বিষয়টায় আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাই। আমার হাসিমুখ সারাক্ষণ কালো হয়ে থাকে। ওদিকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হই। এক পর্যায়ে ও বলে, ওর বিয়ে করাটা ভুল ছিল। আমার শরীরের একপাশ প্রায় অবশ হয়ে যায়, হাঁটতে পারি না। ডাক্তারি পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়ে না। “মড়ার উপর খাড়ার ঘা”র মত যোগ হয় আমার নিজের দিকের কিছু লোকজন। বিচারটা এরকম যে, পাত্র হিসেবে যে এত ভালো অবস্থানে আছে সেখানে অন্য অনেক কিছুই সহ্য করাটা কোনো বিষয়ই না। আমি নাকি বেশি বেশি করছি। আবার আমরা একে অপরকে ভালো তো বাসি। এক পর্যায়ে আমরা দেশ ছেড়ে আসি।

কানাডায় এসেই প্রথম আমার ‘মুক্তমনা’র সাথে পরিচয়। পড়ার অভ্যাসটা যেহেতু ছিলই আর অভিজিৎদা’র এত সহজ সুন্দর লেখা যে গোগ্রাসে গিলতে থাকি। এর মধ্যে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো, আমার বরের চাকরীর প্রভাব-প্রতিপত্তি হারানো, পর পর ছোট দুটি বাচ্চা – সব মিলিয়ে আমার মানসিক টানা-পোড়েনের যে সমাধান আমি এখানে উন্নত দেশে সব শিক্ষিত বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে পেয়ে যাবো ভেবেছিলাম, তা আর হয় না। উলটো খেয়াল করি, বাংলাদেশেরই আরেক সংস্করণ এখানে। আর আমার বরের ব্যবহারও একই রকম দ্বিমুখী। ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে একাকী বাসায় আমার মনে সারাক্ষণই সিনেমার মত ভেসে বেড়ায় সব ঘটনা। আরো অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি। আমার বর আমাকে স্যরি বলে, ডাক্তারও দেখায়। সবাই আমাকে মানসিক কাউন্সেলিং করতে বলে। এ অবস্থায় জাদুর স্পর্শ বোলায় অভিজিৎদা’র একটা লেখা। লেখার বিষয়টা আমার পুরো মনে নেই। ২০০৬ এর দিকের লেখা। সেখানে উনি কিছু জিনিস বোঝাতে মানুষের চরিত্রে জিন আর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এই লেখাই আমাকে প্রথম উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করে আমার ভালোবাসার মানুষের দ্বিমুখী চরিত্রের। পরে এই ‘বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান’ নিয়ে উনার আরো অনেক লেখা পড়েছি। এই অল্প লেখাপড়া জানা আমি বিজ্ঞানের এমন একটা বিষয় বুঝতে পেরেছি, ধারণ করতে পেরেছি শুধুমাত্র অভিজিৎদা’র সহজ ভাষা ও ব্যাখ্যার কারণে। আমার ক্রমবর্ধমান মানসিক টানা-পোড়েনের সমাধান আমি নিতে পেরেছি উনার লেখা থেকে। যা আমার জীবনে এনেছে স্বস্তি। এখানে একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করবো, চাইল্ড কেয়ার কনসালটেন্ট রা একটা বাচ্চাকে ভালোভাবে বোঝার জন্য একটা বই সব সময় রেফার করে, বইটি আলব্রাটা হেলথ এর ৩৫ বছরের গবেষণার ফসল। বইটির নাম ‘Growing Miracle’ যা আমার অনেক ভালো লেগেছে এবং আমি অনেক উপকৃত হয়েছি নিজের বাচ্চাদেরকে বুঝতে।অবুঝ শিশুদের নানা আচরণের বিবরণ ওখানে আছে।বিভিন্ন সময় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে অভিজিৎদা যেভাবে লিখেছেন সেটা আমার জীবনে আরেকটা গ্রোয়িং মিরাকল।
যখন থেকে অভিজিৎদা’র লেখাগুলি পড়ে পড়ে আমার জীবনের এই জটিল সমস্যার সমাধানগুলো আমি খুঁজে পেতে শুরু করেছি তখন থেকেই ভাবতাম, একদিন উনাকে বিষয়টা লিখে জানাবো। কখনো সাহস হয়ে ওঠেনি।আজ লিখছি মনে অনেক কষ্ট নিয়ে। বন্যা-অভিজিৎদা’র বয়স আমার আর আমার বরের বয়স প্রায় কাছাকাছি। আমি যখন অভিজিৎদা’র কঠোর পরিশ্রম আর গবেষণার ফসল তার সহজ ভাষার লেখাগুলি থেকে নিজের সংসারের সংশয় দূর করে স্থিরতা এনেছি, তখনই মানুষ নামের কিছু অমানুষ বিশ্ব সংসার থেকে তাকে কেড়ে নিল। আমার মত এরকম কত সাধারণ হয়তো আরো কত কিছুর সমাধান পেতে পারতো উনার কাছ থেকে। আমি যতটুকু বুঝেছি- বন্যা আহমেদ তার যোগ্য সহচর। তাই বন্যার কষ্টটুকু শক্তিতে পরিণত হোক। বন্যা আহমেদকে বলবো, আমি তোমার কষ্টের পুরোটা নিলাম, তুমি তোমাদের চলার সেই পথটুকুকে টেনে সামনে নিয়ে যাও, আমরা আছি অভিজিতের ভালোবাসা হয়ে তোমার সাথে।