লিখেছেন: মাহবুব মোর্শেদ
আমরা প্রায় সবাই একটা বাগধারা শুনেছি, -অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। কিন্তু মানুষ সত্যি সত্যি পাথরে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে তা এই প্রথম জানলাম। আর মৃত মানুষ নয়; জীবিত মানুষ পাথরে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে একটি রোগের কারণে -যার নাম ‘স্টোন ম্যান সিনড্রোম’ ( Stoneman Syndrome)। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর একটি গাল ভরা নাম আছে – Fibrodysplasia ossificans progressiva বাংলায় অনুবাদ করলে যার মানে দাঁড়ায় ক্রমশঃ দেহ তন্তুর হাড়ে রূপান্তরিত হওয়া।
হঠাৎ এই রোগ নিয়ে লিখতে বসার একটি কারণ আছে। কাল বাংলাদেশের একটি টিভি নিউজে বিশ্ব কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত সাফল্যের সংবাদের পরে একটি ভিডিও সহ সংবাদ দেখানো হলো । শুভ নামে বাংলাদেশের একটি ছেলে একটি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে যার নাম- ‘স্টোন ম্যান সিনড্রোম’। ছেলেটি প্রাইমারী স্কুলে পড়ে এবং ভাল ছাত্র।কিন্তু এই রোগের কারণে সে ক্রমশঃ অচল হয়ে পড়ছে। তার দরিদ্র বাবা তাকে ভারতে নিয়ে গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য; কিন্তু তাতে তেমন লাভ হয়নি। বাবা শুনেছে যে আমেরিকাতে না কী এ রোগের চিকিৎসা আছে। তাই তিনি প্রধাণ মন্ত্রীর সাহায্য চেয়েছেন।
‘স্টোন ম্যান সিনড্রোম’ একটি বিরল জেনেটিক রোগ। এটা এতো-ই বিরল যে ২০ লক্ষের মধ্যে মাত্র ১ জনের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। জীনগত পরিবর্তনের জন্য এই রোগ হয়ে থাকে। মানে ACVRI নামের একটি জীনের মিউটেশনের (Mutation) কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। আবার বাবা বা মা দুজনের একজনের এই রোগ থাকলে সন্তানের এই রোগ হবার ৫০% সম্ভাবনা থাকে। তবে দেখা গেছে সাধারণতঃ নিজের জীনের মিউটেশনের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে- যেখানে বাবা-মা সুস্থ। ACVRI জীন মাংশ পেশি, হাড়, লিগামেন্ট ( Ligament), টেন্ডন ( Tendon) ইত্যাদি কোষ কলায় অবস্থিত BMP(Bone Morphogenetic Protein) Receptor প্রোটিনদের নিয়ন্ত্রণ করে।
স্বাভাবিক মানুষের দেহে বয়স বাড়ার সাথে সাথে অস্থিঃ সন্ধি ( Joint )এবং টেন্ডন, লিগামেন্টগুলো শক্ত হতে থাকে অর্থাৎ দড়ি দড়ার মতো এই সব টিস্যু ক্রমশঃ হাড়ের মতো শক্ত হয়ে যায় -তার মূলে আছে এই জীন । কিন্তু স্টোন ম্যান সিনড্রোম হলে এই ACVRI জীন সারাক্ষণ সক্রিয় হয়ে থাকে -ফলে অল্প বয়সে-ই তা দেহ সন্ধি সংলগ্ন টেনডন, লিগামেন্ট ইত্যাদির মধ্যে বেশি পরিমাণে তন্তু এবং খনিজ যুক্ত করে এগুলোকে হাড়ে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু করে দেয় এবং যা চলতে-ই থাকে। এমন কী মাংস পেশিও আক্রান্ত হয় এবং সেখানে ও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে দেহের মাংস পেশিগুলো শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে রোগীর স্বাভাবিক কাজ-কর্ম, চলা ফেরা, এমন কী খাওয়া- দাওয়া করার প্রকট সমস্যা সৃষ্টি হয়। এখানে-ই শেষ নয়; বুকের খাঁচার মাংস পেশি এবং অন্যান্য টিস্যুগুলো আক্রান্ত হলে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোও কঠিন হয়ে পড়ে এবং রোগী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার Mutter Museum -এই রোগে আক্রান্ত একজন মানুষের কংকাল আছে ।এই কংকালটি Harry Eastlack নামে একজন মানুষের যিনি স্টোন ম্যান সিনড্রোম-এ আক্রান্ত হয়ে ছিলেন। তিনি ৪০ বছর বয়সে এই রোগের কারণে-ই মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তার মুখের মাংস পেশি এমন শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে তিনি খেতে পারতেন না; শুধু তার ঠোঁট জোড়া নাড়াতে পারতেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার দেহকে মিউজিয়ামে দান করে যান যাতে ভবিষ্যতে এই রোগের উপরে গবেষণা করে এর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে ১৬৯২ সালে এই রোগটি প্রথম আবিষ্কৃত হলেও এবং ১৭৪০ সালে একজন ব্রিটিশ সার্জন এই রোগটির নামকরণ এবং চিহ্নিত করলেও এই রোগের কোন কার্যকরি চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আর রোগটি এতো-ই বিরল যে সারা পৃথিবীতে মাত্র ৭০০ জন রোগীর অস্তিত্বের কথা জানা গেছে। এদের মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৪৫ জন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২৮৫ জন রোগী রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দুজন স্টোনম্যান সিনড্রোম রোগী পাওয়া গেছে।
এ রোগ সমন্ধে আগে জানতাম না। তথ্যবহুল লেখা।
@স্বয়ম, ধন্যবাদ।
তথ্যবহুল নোট। মুক্তমনায় স্বাগতম। :good:
@বিপ্লব রহমান, ধন্যবাদ।
FOP নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যবহুল লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। এধরনের আরো লেখা আশা করছি।
আসলে জীন নয় মিউটেশনের কারনে ACVRI প্রোটিনটিই (BMP Receptor) সবসময়ের জন্য সক্রিয় হয়ে যায়। সাধারণ অবস্থায় এই প্রোটিনটি কেবল BMP-র সংস্পর্শে এলেই সক্রিয় হয়, কিন্তু মিউটেশন হলে আর BMP-র দরকার পড়ে না, তাতেই এই ভয়াবহ সমস্যা।
শুভ-র কথা জেনে দুঃখ পেলাম। এই রোগের আসলে কোন চিকিৎসা নেই। কেবল রোগের বিস্তার কিছুটা ধীর করা যেতে পারে। BMP Receptor-র কাজ ব্লক করার জন্য কিছু ইনহিবিটর আছে, সেগুলো ব্যবহার করা যায়। বেশ কয়েক বছর আগে দেখিয়েছিলাম যে লিথিয়াম BMP সিগনালিং এ বাঁধা দেয়। FOP মিউটেশনে কাজ করবে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হয় নি।
@মনজুর মুরশেদ, আমার সংক্ষিপ্ত ( ইচ্ছাকৃত) লেখাটি Appreciate করার জন্য ধন্যবাদ। তবে FOP বা Stone Man Syndrome রোগের মেকানিজম বিষয়ে আমি যতোদূর জেনেছি যে এটা জেনেটিক রোগ; প্রকৃতির দিক দিয়ে অটোজোমাল ডমিন্যান্ট( Autosomal Dominat Type)। তবে বাবা-মার কাছ হতে এভাবে রোগটি পাওয়ার চেয়ে বাস্তবে জীন মিউটেশনের কারণে-ই এটা বেশি হয়ে থাকে। এখানে Journal of Orthopaedics, traumatology and rehabilitation ( Year 2014,vol7, issue 1, page 84-87) হতে উদ্ধৃত করে দিলাম।Most cases of fibrodysplasia ossificans progressiva result from new mutations in the gene. FOP usually occurs in the people with no history of the disorder in their family, as in our case also. In a small number of cases, an affected person has inherited the mutation from one affected parent. [1] Researchers believe that a mutation in the ACVR1 gene may change the shape of the receptor under certain conditions and disrupt mechanisms that control the receptor’s activity. [1] The bone morphogenetic protein (BMP) receptors are a family of transmembrane serine/threonine kinases that include the type I receptors BMPR1A and BMPR1B and the type II receptor BMPR2. These receptors are also closely related to the activin receptors, ACVR1 and ACVR2. The ligands of these receptors are members of the TGF beta superfamily. Bone morphogenetic proteins (BMPs) exhibits broad spectra of biological activities in various tissues, including bone, cartilage, blood vessels, heart, kidney, neurons, liver and lung. BMPs are members of the transforming growth factor-β (TGF-β) family that bind to type II and type I serine-threonine kinase receptors, and transduce signals through Smad and non-Smad signaling pathways. Recent findings have revealed that BMP signaling is finely tuned by various mechanisms in both the positive and the negative fashion. Perturbations of BMP signaling pathways are linked to a wide variety of clinical disorders, including vascular diseases, skeletal diseases and cancer. FOP is caused by a recurrent heterozygous activating mutation of Activin receptor type IA/Activin-like kinase-2 (ACVR1/ALK2), a bone morphogenetic protein (BMP) type I receptor that occurs in all the classically affected individuals. [3] The ACVR1 gene provides instructions for producing a member of a protein family called bone morphogenetic protein type I receptors. It helps to control the growth and development of the bones and muscles, including the gradual replacement of cartilage by bone (ossification) that occurs in the normal skeletal maturation from birth to young adulthood. The FOP mutation dysregulates BMP signaling and initiates the formation of a disabling second skeleton of heterotopic bone. This results in overgrowth of the bone and cartilage and fusion of joints, resulting in the signs and symptoms of FOP. This is known as progressive heterotopic ossification (HO) and it usually begins in the first decade of life. [1]
@মাহবুব মোর্শেদ,
সাধারণতঃ জিন সক্রিয় (প্রকাশ) হওয়া বলতে আমরা বুঝি DNA থেকে RNA, তারপর প্রোটিন তৈরী হওয়া। যদি বলা হয় যে ইনসুলিন জিন অগ্নাশয়ে সক্রিয় অন্য কোথাও নয়, তাহলে আমরা বুঝি যে উপরের প্রক্রিয়া অনুসরন করে কেবল অগ্নাশয়ে ইনসুলিন তৈরী হয়, অন্য কোথাও নয়।
যতদূর জানি, FOP মিউটেশনে প্রোটিন তৈরী হওয়ার সাধারণ প্রক্রিয়াটি পরিবর্তিত হয় না, কেবল এর কারনে তৈরী হওয়া ACVR1 প্রোটিনটি BMP-র সাহায্য ছাড়াই সক্রিয় হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। আপনার তুলে ধরা তথ্যেও এ্রর ইঙ্গিত আছে, ‘a mutation in the ACVR1 gene may change the shape of the receptor (প্রোটিন) under certain conditions and disrupt mechanisms that control the receptor’s activity.’ এক্ষেত্রে যেহেতু জিনের প্রকাশে পরিবর্তন হচ্ছে না, হচ্ছে প্রোটিনের কাজে তাই প্রোটিন সক্রিয় হওয়ার কথা বলাই যুক্তিযুক্ত।
দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা জরুরী এজন্য যে FOP-র মতো প্রোটিনের গুনাবলীর পরিবর্তন না হয়ে কেবল জীনের সক্রিয়তা বা প্রকাশে কম-বেশী হলেও তা জেনেটিক রোগের কারণ হতে পারে।
প্রাসংগিক ছবিটি সংযুক্ত করে দেয়ার জন্য মডারেটরকে ধন্যবাদ।