মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের বর্তমান স্তরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকার শাসনব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় এবং শাসনের প্রকৃতিভেদে নারীর অবস্থানেরও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। নারীর পীড়নকে যদি অপসংস্কৃতি হিসেবে মনেকরি, তবে বলা যায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা যেমন কোনো দেশের সংস্কৃতি, মানবিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সৃষ্টি হয় তেমনি সংস্কৃতির দ্বারাও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়। শাসন পদ্ধতির ভিন্নতা থাকলেও পৃথিবীর সকল স্থানের নারীই কম-বেশি অধিকারহীন। পৃথিবীর কোথাও নারী পূর্ণ স্বাধীন নয়, পৃথিবীর কোথাও নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা নেই, পৃথিবীর কোথাও নারী পূর্ণ মানুষের মর্যাদা পায়নি। তবে একটি কথা বলা যেতে পারে তুলনামূলক বিচারে যেখানেই নারী কিছুটা স্বাধীনতার আলো দেখছে সেখানেই সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে শাসনব্যবস্থার প্রকৃতির সাথে নারীর অধিকার প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত একথা সবাই একবাক্যে মেনে নিলেও কোন্ ব্যবস্থা নারীর জন্য কতটুকু উপযোগী তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য।
আলোচনাটা একটু পেছন থেকে শুরু করা উচিত। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই লিঙ্গ-বৈষম্য ছিল না। রুশোর মতে প্রকৃতির রাজ্যে ছিল অনাবিল সুখ, মানুষের সাথে মানুষের ছিল সোহার্দ্য। সেখানে ছিলনা কোনো শোষণ, ছিলনা কোনো বঞ্চনা। নারী এবং পুরুষ ছিল একে অপরের সহযোগী, তারা ছিল পরস্পরের পরিপূরক। মনিষীদের অধিকাংশের মতেই সম্পত্তিতে যখন ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি হয় তখন থেকেই মূলত শুরু হয় লিঙ্গ-বৈষম্য। মানুষ যখন বন্যযুগ থেকে কৃষিযুগে উত্তরণ করে তখন জমির উপর পুরুষের একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পদই নারীর জন্য হয়ে পড়ে মহাশত্র“। পুরুষেরা যেমন জমির মালিক হয়, তেমনি নারীর উপরও তার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। সামনে চলে আসে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। মাতৃপ্রধান প্রথা ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় পিতৃপ্রধান প্রথা। এটাকে বলা চলে পুরুষতান্ত্রিক বিপ্লব। এরপর থেকে আজ অবধি পুরুষ নারীকে করে রেখেছে নিজের দাসী, করেছে শৃঙ্খলিত। নারী হয়ে আছে পুরুষের ভোগের সামগ্রী এবং ব্যবহৃত হচ্ছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে। সুতরাং পুরুষতন্ত্র মানব ইতিহাসের একটি পর্ব মাত্র, যার ক্ষয় ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী পুরুষতন্ত্রের কবর রচনার কাজ চলছে। কোথাও দ্রুতগতিতে, কোথাও ধীরে। কোথাও নারী একটু বেশি এগিয়েছে, আবার কোথাও কম। দু-একটি রাষ্ট্রের নারীরা যদিও এখন পর্যন্ত ভোটাধিকার পায়নি তথাপি বলা যেতে পারে বিংশ শতাব্দি ছিল পৃথিবীব্যাপী নারীর ভোটাধিকার প্রাপ্তীর কাল। জন ষ্টুয়ার্ড মিল তাঁর ‘নারী-অধীনতা’ বইতে দেখিয়েছেন নারী জাতির অধীনতা দূর হবে প্রগতি ও নৈতিকতার ক্রম-অগ্রগতির মাধ্যমে। এরপর শুরু হবে নর-নারীর সুমধুর সম্পর্কের এক উন্নত পর্ব; বলা চলে ইহাই অভেদ্য, অকাট্য এবং অমোঘ তত্ত্ব। সে প্রেক্ষাপটেই বিশ্বের সকল দেশের নারীরা যেখানে যে অবস্থায় রয়েছে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাসত্ব-মুক্তির লড়াই করে চলেছে এবং ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি যাই হোক না কেন, হতে পারে ধনতন্ত্রী, হতে পারে গণতন্ত্রী অথবা হতে পারে সমাজতন্ত্রী, সকল স্থানেই নারী তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, মানুষ হিসেবে পুরুষের পাশে নিজেকে দাঁড় করানোর কাজে কঠিনভাবে ব্রত হচ্ছে।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর অবস্থা সম্পর্কে রয়েছে যথেষ্ট ভিন্নমত। পুঁজিবাদ সম্পত্তির উপর ব্যক্তিমালিকানাকে প্রাধান্য দেয় অর্থাৎ সেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বন্টন, চাহিদা, যোগান, মূল্য-নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সমর্থন করা হয়। অনেকেই মনে করেন এই ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগীতার কারণে শ্রেণী-শোষণ বৃদ্ধি পায়। ওয়েব্সের মতে, “ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ হল এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে শিল্প এবং অন্যান্য আইনগত প্রতিষ্ঠানসমূহ এমন একটি স্তরে উপনীত হয় যে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিকানা হতে বঞ্চিত হয়ে দিনমজুরে পরিণত হয়।” ওয়েব্সের মতকে সমর্থন করলেও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হওয়ার সাথে লিঙ্গ-বৈষম্যের বিষয়টি সমার্থক নাও হতে পারে। হতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষ সমভাবে শোষিত। এখানেও রয়েছে ভিন্নমত, বলা হচ্ছে নারীর গৃহকাজ কোনো উৎপাদনশীল কর্ম নয়। কারণ পুঁজিবাদে শ্রমশক্তির সেই ধরনের ব্যবহার উৎপাদনশীল বলে বিবেচিত হয় যা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করতে পারে। কোনো কাজ তা সমাজের জন্য যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন যদি উহা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করতে না পারে তবে পুঁজিবাদী কাঠামোতে তা অনুৎপাদনশীল। তাই কলুর বলদের মতো খেটেও নারীর কর্মকে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিকারী কর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও লিঙ্গ-বৈষম্য যথারীতি টিকে থাকে। শুধু টিকেই থাকে না, এই ব্যবস্থায় সব শ্রেণীর পুরুষ শোষিত হয় না কিন্তু সকল শ্রেণীর নারীই নির্মমভাবে শোষিত এবং প্রচণ্ডভাবে শৃংখলিত হয়ে থাকে। ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, “নারীশোষণে বুর্জোয়া ও সর্বহারায় কোনো পার্থক্য নেই; বুর্জোয়া পুরুষ শুধু সর্বহারা শ্রেণীটিকে শোষণ করে না, শোষণ করে তার নিজের শ্রেণীর নারীকেও; আর সর্বহারা পুরুষ নিজে শোষিত হয়েও অন্যকে শোষণ করতে দ্বিধা করে না, সে শোষণ করে নিজের শ্রেণীর নারীকে। বিত্তবান শ্রেণীর নারী পরগাছার পরগাছা, বিত্তহীন শ্রেণীর নারী দাসের দাসী। শোষণে সব শ্রেণীর পুরুষ অভিন্ন; শোষণে মিল রয়েছে মার্কিন কোটিপতির সাথে বিকলাঙ্গ বাঙালী ভিখিরির, তারা উভয়েই পুরুষ, মানবজাতির রতœ।” তবে একথা নির্ভেজাল সত্যি যে, পুঁজিবাদের পূর্বে সামন্তযুগে নারীর দূরাবস্থা ছিল আরো ভয়ঙ্কর পর্যায়ে। সতীদাহের মতো বহু চরম-নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা ছিল সামন্তযুগের ফসল। কাজেই সামন্তযুগ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ নারীর জন্য সামান্য হলেও আশার আলোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আসলে পুঁজিবাদের কাঠামোসমূহ কিভাবে কাজ করে তার উপর নির্ভর করে নারীর দূরাবস্থার ধরণ। পশ্চিম ইউরোপীয় অবাধ পুঁজির দেশসমূহের নারীরা তুলনামূলক বিচারে বেশ কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী নারীকে এগিয়ে নেয়ার কাজে পুঁজিবাদীদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। জাতিসংঘ, বিভিন্ন প্রকার এনজিও এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের ‘উদারনৈতিক নারী আন্দোলন’ এর ধারা বিশ্বের সকল স্থানের নারীকেই স্পর্শ করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ধারার সকল কার্যক্রমের মর্মবস্তু হচ্ছে নারীকে পুঁজিবাদী উৎপাদনের সাথে ও বাজার ব্যবস্থার সাথে আরও বেশি একীভূত করা এবং সেক্ষেত্রে সব ধরনের বাধা ও বৈষম্যকে দূর করা। পুঁজি চায় শ্রম। নারীর শ্রম দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। সেই যুক্তিতে লিঙ্গ-বৈষম্য থাকার কথা নয়। কিন্তু পুঁজির মালিকরা পুরুষতন্ত্রকে ব্যবহার করে নারী শ্রমিকের মজুরি পুরুষের তুলনায় কম নির্ধারণ করে থাকে। নারী এখানে পুঁজির দ্বারা এবং পুরুষতন্ত্রের দ্বারা দ্বি-মুখী শোষণের শিকার। বাংলাদেশে তৈরি-পোষাক শিল্পে কর্মরত ত্রিশ লক্ষ নারী-শ্রমিক কি পরিমান পুঁজিবাদী শোষণের শিকার তা আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারি। ওভারটাইম বাধ্যতামূলক করে সেখানে আইএলও ঘোষিত আন্তর্জাতিক শ্রম আইনকে(৮ ঘন্টা কাজ) নির্লজ্জভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখানো হচ্ছে। ওরা ভোর ৫টায় ওঠে আর রাত ১০টার পর ঘরে ফেরে এবং রাত ১২টায় ঘুমোতে যায়। ছুটি-ছাটার বালাই নেই, এমনকি জাতীয় দিবসেও না। ওরা শুধু জানে দিন গিয়ে রাত আসে, রাত গিয়ে দিন। তারপরেও আমি মনেকরি, স্বামীর দাসত্ব করার চাইতে গার্মেন্ট-এ গোলামী করা অনেক উত্তম। তার প্রমাণও রয়েছে। শতকরা কতজন গৃহিনী আত্মহত্যা করছে আর শতকরা কতজন বস্ত্র-বালিকা আত্মহত্যা করছে তার হিসাব করলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। ‘স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে যৌনপল্লীতে বিক্রী’ এইরকম একটি খবর প্রকাশিত হলো গত ১০ এপ্রিলের অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকায়। যেসব গৃহবধূ একটু কম কষ্টে আছে বলে মনে হচ্ছে অর্থাৎ আত্মহত্যা করছেনা বা খুন হচ্ছেনা বা বিক্রী/পাচার হচ্ছে না তাদের গার্হস্থ্য শ্রমকেও পুঁজিবাদ হিসাবের মধ্যে আনছে না। সাণ্ড্রা হার্ডিং মনে করেন, পুরুষতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ এর শেকড় শুধুমাত্র পরিবারের ভেতর লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজনের মধ্যেই প্রোথিত নেই, এটি একই সঙ্গে প্রোথিত আছে সামাজিক ব্যক্তির জৈবিক ও মনোজাগতিক জগতের মধ্যেও। পুরুষতন্ত্র ও পুঁজির ঐক্য বুঝতে পারলে এটাও বোঝা সম্ভব যে, পুরুষের পক্ষে কাউকে শ্রেণী ও লিঙ্গ নিপীড়ন থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয় সব রকম নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নারীকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। জেরেটস্কির কথা অনুযায়ী, “নারী আসলে পুঁজির জন্যই কাজ করছে পুরুষের জন্য নয়; দৃশ্যমান ঘটনা হল নারী পুরুষের জন্য কাজ করছে এবং বাস্তব হল নারী কাজ করছে পুঁজির জন্যÑ এই দুইয়ের তফাৎ না বোঝার জন্য নারী আন্দোলনের অনেক শক্তি দিক্ভ্রান্ত হচ্ছে।”
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে যেহেতু আমরা শোষণমুক্ত সমাজকেই বুঝি এবং নারীর পরাধীনতা যেহেতু অন্যতম একটি শোষণ-প্রক্রিয়া, সুতরাং সমাজতন্ত্রে লিঙ্গ-বৈষম্য সম্পূর্ণরূপে দুরীভূত হওয়ার কথা। সমাজতন্ত্রীদের বক্তব্য হল, পুঁজিবাদ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিকশিত রূপ। নিজের অমরত্বের জন্য পুরুষের যে আকাঙ্খা সেখান থেকেই নারীদেহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। যে বোধ থেকে পুরুষ উৎপাদনের উপায়ের উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় একই বোধ থেকে পুনরুৎপাদনের উপায়(নারী)-এর উপরও কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সকল প্রকার শোষণ, যেমন: শ্রেণী-শোষণ, বর্ণ-বৈষম্য, লিঙ্গ-নিপীড়ন সব একই সূত্রে গ্রোথিত এবং তা হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার। তাঁদের মতে, নারীর মুক্তির জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত করা এবং পরিবার নামক সংগঠনটির মৌলিক পরিবর্তন করা। এর জন্য পরিবারের আর্থিক দায়িত্বটি নিতে হবে রাষ্ট্রকে, পুঁজিবাদ সে ভার কখনও নেবে না। একমাত্র সাম্যবাদের মধ্যেই নারী পেতে পারে প্রকৃত মুক্তি; সেখানে পরিবার থাকবে, তবে তা গড়ে উঠবে নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণের ভিত্তিতে। তাই নারী-মুক্তি আন্দোলন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক সংগ্রামের একটি অংশ বলে বিশ্বাস করেন মার্কসবাদীরা। কাজেই তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা ধরে নিতে পারি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাবে। আমাদের মতো একইরূপ ধারণা পোষণ করতেন বিশ্ব নারীবাদের প্রবক্তা সিমোন দ্য বোভোয়ার। শুধু ধারণা পোষণ করেই বোভোয়ার ক্ষান্ত ছিলেন তা নয়, তিনি জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই ব্যয় করেছেন সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার লড়াইয়ে। ১৯৪৯ সালে তাঁর রচিত মহাগ্রন্থ ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বিশ্বব্যাপী পুরুষতন্ত্রের ভিত দুর্বল করে ফেলেছে সত্যি, কিন্তু বইটি যখন রচনা করেছেন তখনও তিনি নিজেকে নারীবাদী না বলে সমাজতন্ত্রী বলেই দাবী করেছেন। কিন্তু পরবর্তিতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর ভুল তিনি বুঝতে পারেন। তিনি পরিস্কার দেখতে পান যে, সমাজতন্ত্র নারীকে মুক্তি দিচ্ছে না। উহাও পুরুষতন্ত্র। সে প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে বোভোয়ার নিজেকে নারীবাদী হিসেবে ঘোষণা দেন এবং নিজেকে নারীবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত করেন। বোভোয়ারের মানসিকতার পরিবর্তন ‘নারীবাদ’-কে বিশ্বব্যাপী স্বতন্ত্র মাত্রা দান করেছে, গতিশীল করেছে র্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টদের। ১৯৭৩ সালে র্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টরা ঘোষণা করেন, “আমরা বিশ্বাস করি না যে পুঁজিবাদ অথবা অন্য কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নারী নিপীড়নের কারণ, এটাও আমরা বিশ্বাস করি না যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিপ্লবের লক্ষ্য দিয়েই নারী নিপীড়ন দূর হতে পারে।” এভাবেই শুরু হয়েছে সমাজতন্ত্রের প্রতি নারীবাদীদের অনাস্থা। সমাজতন্ত্রে নারী মুক্ত না হওয়ার কারণসমূহ নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রকার যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। অনেকে মনে করেন মার্কসবাদ নারীমুক্তি আন্দোলনের মতাদর্শিক কোনো কাঠামো যোগান দিতে পারে না। কেউ কেউ বলেছেন, মার্কসবাদ শ্রেণী-সংগ্রামের উপর অধিক গুরুত্ব দেয় যার কারণে নারীমুক্তি আন্দোলন উপেক্ষিত থাকে। আবার অনেকে মনে করেন, মার্কসবাদের মধ্যেই পুরুষ-পক্ষপাত রয়েছে এবং ক্ষমতাসীন পার্টি যে আমলাতন্ত্রের জন্ম দেয় তা পুরুষতন্ত্রকেই সহায়তা করে। অনেকে বলেন, যেহেতু মার্কসবাদ মনেকরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকেই সব শোষণ-পীড়নের উদ্ভব সেহেতু সম্পত্তি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করলেই নারী-নির্যাতনের সমাপ্তি ঘটবে কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া অনেকেই মনে করেন, যেহেতু মার্কসবাদ মানুষের মুক্তির মতবাদ সুতরাং এর সাথে নারী-মুক্তির মতবাদ সম্পর্কিত করা সম্ভব এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় তত্ত্ব সংযোজন করা দরকার। কৃষ্ণাঙ্গ নারীর দূরাবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে গ্লোরিয়া জোসেফ বলেছেন, মার্কসীয় প্রত্যয়গুলো শুধু লিঙ্গ-অন্ধ নয় বর্ণ-অন্ধও বটে। তিনি আরও বলেছেন, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীর মধ্যে যতটুকু সংহতি দেখা যায় তার চাইতে অনেক বেশি সংহতি দেখা যায় শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও নারীর মধ্যে। লিঙ্গ-বৈষম্যের চাইতে বর্ণ-বৈষম্যের প্রখরতা অনেক বেশি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। সেজন্যে তাঁর মতে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী তত্ত্বকে হিসাবের মধ্যে না আনলে কোনো কার্যকর নারীবাদী আন্দোলন সম্ভব নয়। আর একটি বিষয় চিন্তার উদ্রেক করে তা হল দেশে দেশে যেসমস্ত বাম সংগঠন মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে চলেছে সেই সকল সংগঠনে নারীর অবস্থান একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ে। কাজেই তাঁরা রাষ্ট্র-ক্ষমতায় গেলেই নারী মুক্ত হয়ে যাবে কি-না তা ষ্পষ্টতই প্রশ্নের দাবীদার। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেছেন, মার্কসবাদ ও নারী প্রশ্নের সম্পর্ক নিয়ে এত সব আলোচনা বা বিতর্কের কারণ হচ্ছে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এখন পর্যন্ত সব চাইতে শক্তিশালী বিশ্লেষণ পদ্ধতি মার্কসবাদ দিতে সক্ষম। এবং দেশে দেশে বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ মার্কসবাদীদেরই। বিদ্যমান সমাজ-অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন যাঁরাই অনুভব করেন তাঁদেরকেই মার্কসবাদকে হিসাবের মধ্যে আনতে হয়। সে কারণে নারী-মুক্তি আন্দোলন, তা যে আকারেই হোক, শেষ পর্যন্ত মার্কসবাদকে উপেক্ষা করতে পারে না। আনু মুহাম্মদের বক্তব্যকে যুক্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ঊনবিংশ শতাব্দিতে যখন নারী পূর্ণাঙ্গ মানুষ কিনা তা নিয়ে ছিল সংশয়-সন্দেহ, তখন মার্কস এবং এঙ্গেলস মানব মুক্তির অপরিহার্য অংশ হিসেবে নারী-মুক্তিকেও নির্দেশ করেছিলেন। যে ধর্মীয় কুসংস্কার নারীকে মানুষের পর্যায়ে আসতে প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, তার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য মার্কসবাদীদেরই। বোভোয়ার সমাজতন্ত্রের মধ্যে নারী-মুক্তি খুঁজে না পেলেও তিনি নিজেই কিন্তু মার্কসবাদের সৃষ্টি, একথাও সত্যি। তবে মার্কসবাদীরা একটি বিশেষ দোষে দুষ্ট যে, তাঁরা সকল ক্ষেত্রেই শ্রেণী-দন্দ্ব খোঁজেন। বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গীর তালিকায় ফেলে বাতিল করে দেন মার্কসবাদের প্রতি সকল প্রকার সমালোচনাকে। মার্কসের ‘উদ্বৃত্ত-মূল্য তত্ত্ব’ একটি অভ্রান্ত বিশ্লেষণ যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মাত্রা দান করেছে বটে তবে শ্রেণী-দন্দ্বের মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাকে চিন্তাশক্তির অসাঢ়তা বলেই অনেকে মনে করেন। সমাজ বিকাশের একটি স্তরে শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু নারীর সৃষ্টি-ইতিহাস মানব সৃষ্টির ইতিহাসের সমান। তবে শ্রেণী-শোষণ হয়তো লিঙ্গ-বৈষম্যকে উস্কে দিতে পারে, একথা মানা সম্ভব। কাজেই শ্রেণী-দন্দ্বের বাইরেও মানবজাতির আরো বহু সমস্যা রয়েছে। সেকারণে নারী-আন্দোলন থেকে যদি মার্কসবাদের প্রতি সমালোচনামূলক বক্তব্য উত্থাপিত হয়, সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে তাকে বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গী বলে বাতিল করা আমার মনেহয় মার্কসবাদীদের যথার্থ হবে না।
গণতন্ত্র হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা। তবে গণতন্ত্রে নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করা অত্যন্ত সহজ একটি কাজ হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তা খুবই দুরূহ; কারণ এসময়ের প্রায় সকল রাষ্ট্রের সকল শাসকগোষ্ঠীই নিজেদের ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক বলে চালানোর চেষ্টা অথবা অপচেষ্টা করছেন। একদিকে সমাজতন্ত্রীরা যেমন নিজেদের শাসনকে গণতান্ত্রিক বলে দাবী করছেন, অন্যদিকে যারা জণগনের সার্বভৌমত্বেই বিশ্বাস করেনা এইরূপ চরম-প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরাও নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলতে মোটেই ইতস্ততঃ করছে না। কাজেই ‘গণতন্ত্র’ বললেই কোন্টি প্রকৃত গণতন্ত্র আর কোন্টি প্রতারণা এবং কতটুকু প্রতারণা তা আগে ষ্পষ্ট করতে হবে। আমরা জানি, যে শাসনব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ নাগরিকদের সমানভাবে অংশগ্রহণ থাকে তাহাই গণতন্ত্র। লর্ড ব্রাইস লিখেছেন, “যেখানে শাসনক্ষমতা কোনো শ্রেণীর উপর ন্যস্ত না থেকে সমগ্র সমাজের সদস্যদের উপর ন্যস্ত থাকে তাহাই গণতন্ত্র।” অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও একইরূপ বলেছেন। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে যদি গণমানুষের শাসনকে বুঝানো হয়ে থাকে, নারী ও পুরুষ উভয়ই যদি সমানভাবে মনূষ্য প্রজাতির অংশ হয়ে থাকে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শাসনব্যবস্থা যদি গণতান্ত্রিক হয়ে থাকে এবং সরকারসমূহ যদি গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন হয়ে থাকে তবে নারীর কোনো দূরাবস্থা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। দেশে দেশে নারী আজ চরমভাবে নির্যাতিত, নিষ্পেশিত। মানবতা আজ লুন্ঠিত, নারীর অধিকার আজ ভূলুন্ঠিত। সংজ্ঞা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। কিন্তু নারী আজ এতই অবহেলিত যে, পরিবারে অথবা সমাজে অথবা রাষ্ট্রের কোথাও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর কোনো ভূমিকাই গ্রাহ্য নয়। অনেকে মনে করেন গণতন্ত্র আসলে পরিমানের ব্যাপার, কোনো রাষ্ট্র একটু বেশি গণতান্ত্রিক আবার কোনোটি কম। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে লিঙ্গ, ধর্ম এবং বর্ণভেদে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ প্রদান। এছাড়া গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার আরো কিছু শর্ত রয়েছে, যেমন: ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হওয়া, স্বায়ত্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, সরকারের জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা, প্রতিনিধি নির্বাচনে স্বচ্ছতার ব্যবস্থা ইত্যাদি। তবে সকল শর্তেরই মূললক্ষ্য কিন্তু তিনটি। তা হল: রাষ্ট্রের চরিত্রকে (১)ধর্ম-নিরপেক্ষ, (২) লিঙ্গ-নিরপেক্ষ এবং(৩) বর্ণ-নিরপেক্ষ করা। অর্থাৎ ধর্মের কারণে বা লিঙ্গের কারণে বা গায়ের রংয়ের কারণে রাষ্ট্র কারো প্রতি বৈরি আচরণ করবে না অথবা কাউকে অধিক সুযোগ প্রদান করবে না। কাজেই কোনো রাষ্ট্রের নারীর অবস্থা বা দূরাবস্থা বুঝতে আমাদের জন্য সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে দৃষ্টি দেওয়াই যথেষ্ট। এখন আমরা উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের শাসনপদ্ধতি কতটুকু গণতান্ত্রিক তা বিবেচনা করতে পারি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের চাইতে অধিক গণতান্ত্রিকতা চর্চার দেশ যেমন পৃথিবীতে অনেক রয়েছে, আবার সেদিক দিয়ে বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে থাকার দেশও কয়েকটি রয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামকে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। ‘মদিনার সনদ’-এ নবী অত্যন্ত সচেতনভাবে ‘বিস্মিল্লাহ্’ লেখেন নি। নবীর না লেখার কারণ মদিনার সনদ শুধু মুসলমানদের জন্য ছিল না বরং তা ছিল মদিনাবাসীর জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতে ‘বিস্মিল্লাহ্-র্হি-রাহ্মান-র্হিরাহিম’ লেখা হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্র নিজেই একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ায় উহার ধর্ম-নিরপেক্ষ চরিত্র সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে। সন্দেহ নেই সংবিধান অনুযায়ীই বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, অর্থাৎ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। এবং সেকারণে সংখ্যালঘু ধর্মীয়গোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। এপ্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, ধর্ম দিয়ে কখনও রাষ্ট্র হয়না। যদি করা হয় তাহবে এক‘শ ভাগ প্রতারণা। ধর্ম দিয়ে যদি রাষ্ট্র হতো তবে ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ইত্যাদি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র যেমন হতো না তেমনি বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া মিলেও একটি রাষ্ট্র করা যেত। অবশ্য ইতিহাসে এরকম একটি এবং একটিমাত্র রাষ্ট্রেরই নজির পাওয়া যায়, তা হল পাকিস্তান। যার খেসারত হিসেবে দিতে হয়েছিল নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ, যা ছিল বিশ্বে মানবহত্যার অন্যতম রেকর্ড। আমার কথাগুলো আমাদের রাজনীতির কর্তাদের কাছে পৌঁছবে কি-না জানিনা তবে তাঁদের কেহ বাংলাদেশকে মুসলমান বানাতে ব্যস্ত আবার কেহ বাংলাদেশের মুসলমানত্ব টিকে রাখতে ব্যস্ত। দ্বিতীয়ত: লিঙ্গ-নিরপেক্ষতার কথা। বাংলাদেশের সংবিধান এদিক দিয়ে ত্র“টিমূক্ত। সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। সংবিধানে উক্ত কথাগুলি কেন লেখা হয়েছে তা আমার জানা নেই। অনেকে বলেন সংবিধানের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য তা লেখা হয়েছিল, কারণ বাস্তবে রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে নারী এবং পুরুষকে মোটেই সমান দৃষ্টিতে দেখা হয় না। রাষ্ট্র নিজেই প্রবল পুরুষতান্ত্রিক। রাষ্ট্রের আইন দ্বারাই পরিবারের সম্পত্তি বন্টন, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে নারীকে করা হচ্ছে নিকৃষ্টভাবে বঞ্চিত। পরিণত করে রেখেছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। রাষ্ট্র কর্তৃক নারীর উপর বৈরী আচরণের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঘরে ঘরে অসন্তোষ, প্রেমহীনতা। চলছে নির্লজ্জ নিপীড়ন। সরকারের মন্ত্রীরা মাঝে মাঝে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলেন, কিন্তু রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলেন না। আমি বলি রাষ্ট্র ঠিক হলেই কেবল পুরুষরা ঠিক হয়ে যাবে, অন্যথায় নয়। রাষ্ট্র নারীর সাথে তামাশাও একেবারে কম করছে না। একদিকে লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন দ্বারা নারীকে অসহায় করে রাখছে, অন্যদিকে নারীকে রক্ষার জন্য আবার নতুন নতুন আইনও করছে। সকল নাগরিককে রক্ষার দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রের হয় এবং নারীরা যদি পূর্ণ-নাগরিক হয় তবে নারীকে রক্ষার জন্য কি আলাদা কোনো আইনের দরকার আছে? এসব হচ্ছে রাষ্ট্রীয় তামাশা। নারী নিয়ে তামাশা। ফসল-রক্ষা, বন্দর-রক্ষা, নদী-রক্ষার মতো নারীকে রক্ষার প্রয়োজন হচ্ছে কিন্তু পুরুষ রক্ষার কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ফসল, বন্দর, নদী, নারী সবই সম্পদ এবং তা পুরুষের সম্পদ। এসবের মূল কারণ রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চরিত্র। অগণতান্ত্রিকতা নারীকে বিপদে ফেলছে। এভাবে যেখানে অগণতন্ত্র, সেখানেই নারী বিপদগ্রস্ত। যেখানে নারী একটু স্বাধীন, গণতান্ত্রিকতা সেখানে এগিয়ে। সেই হিসেবে এক‘শ ভাগ গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্র পৃথিবীতে নেই। তবে উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহে নারীরা অনেকটাই স্বাধীনতা ভোগ করছে, বাস্তবিকেও উক্ত দেশসমূহ গণতন্ত্রের চর্চায় এগিয়ে।
॥ মিলন আহমেদ ॥
কলেজশিক্ষক এবং নারীবাদী কলামিস্ট, ঈশ্বরদী, বাঙলাদেশ।
সেলফোনঃ ০১৭১২-৪৩০৬৮১।
ই-মেইলঃ [email protected]
লেখকে বলছি। বাংলা বানান বাঙালা নয়। এব্যাপরে আপনার লেখা আশা করি। ৪০ বৎসর পার হয়ে গ্যাল। এই বানানটার ব্যাপরে আমরা বাঙ্গালীরা এক মত হতে পারলাম।
যুগান্তকারী মাত্রা দান করেছে বটেই, কিন্তু একে “অভ্রান্ত” ঘোষণা দেয়ার সাথে দ্বিমত করি। এর অনেক সমালোচনাই আছে। বহু আগে থেকে। একটা এখানে দেখতে পারেন।
মূল মালিক কে ছিলো যে ছেড়ে দিলো?
@রূপম (ধ্রুব),
মালিক কি কেউ ছিল? প্রশ্নে প্রশ্নের উদয়।
@স্বপন মাঝি,
“মালিক কি কেউ ছিল?” এর মাঝে যে লুকানো উত্তর, সেও উত্তম, এমন ইঙ্গিতের চেয়ে যে এর মূল মালিক কেউ একজন ছিলো, যে বা যারা সেটাকে পরে ব্যক্তি মালিকানায় “ছেড়ে দিলো।” আমার আপত্তি এই “ছেড়ে দিলোর” উহ্য কর্তাতে।
এখানে কিছু বোধয় ভুল তথ্য আছে। ধর্মের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে আরও রাষ্ট্র আছে যেমন ইসরাইল। তাছাড়া কতগুলো রাষ্ট্র সৃস্টির প্রছনে অন্যান্য অনেক কারনের সাথে ধর্মও অন্যতম ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করেছে, যেমন দক্ষিণ সুদান অথবা জিবুতি।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেশিরভাগ জনগণ নৃ-তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-ভাষার উপর তাদের ধর্ম বিশ্বাসের উপর বেশি জোর দিয়েছে। রাষ্ট্র গঠনে তারা আয়ারল্যান্ডের (ক্যাথলিক সংখ্যাগুরু) থেকে ইংল্যান্ডের (প্রোটেস্ট্যান্ট সংখ্যাগুরু) সাথে থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছে।
আর রাষ্ট্র গঠনে নৃ-তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-ভাষার কিংবা ধর্মের সাথে সাথে আর একটি মূল ব্যাপার হল ভৌগলিক অবস্থান এবং “নিকট রাজনৈতিক অবস্থা”।
সামাজিক বিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত কম্পার্টমেন্টালাইজিং করা মোটেও ঠিক না। নৃ-তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-ভাষার সাথে অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম অঙ্গাআঙ্গিক ভাবে জড়িত। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম, সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে থাকে। যেমন প্রাচীন ভারতে সনাতন (হিন্দু) অথবা জাপানে শিন্টো আবার অনেক ক্ষেত্রে অংশ হয়না, যেমন চীনে বৌদ্ধ ধর্ম কিংবা শ্রীলঙ্কাতে খৃস্ট ধর্ম। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিসত্তা যাদের মাঝে এখনো আধুনিক সভ্যতা পৌঁছেনি তাদের ধর্ম কিংবা সংস্কৃতি আলাদা করা যায়না ব্যাপারটি আমেরিকার কিংবা অস্ট্রেলিয়ার অনেক এবোরিজিন জাতি গোষ্ঠী কিংবা এই পূর্ব গোলার্ধের অনেক প্রাচীন অধিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য; তবে, অবশ্যই সবার জন্য না।
আর ভুলে গেলে চলবেনা তৎকালীন বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে বসবাসরত এই অঞ্চলের মানুষ ভারত হতে পাকিস্তানের সাথে থাকার পক্ষেই মত দিয়েছিল। এর পেছনে শুধু ধর্ম কাজ করেনি “নিকট রাজনৈতিক অবস্থা” অনেকটা দায়ী। পশ্চিম বঙ্গ হতে পূর্ব বঙ্গ দুঃখ জনক ভাবে অনুন্নত ছিল যদিও সিংহভাগ কাঁচামাল আসত এ অঞ্চল হতে। এ অঞ্চল শিল্পোন্নত ছিলনা।
আর আপনার যা মত; তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্য কাশ্মীর, গোয়া, হায়দারাবাদ কিংবা সিকিমের মত হতে পারত ৭১ এর পর। এক্ষেত্রে “নিকট রাজনৈতিক অবস্থা” কাজ করেছে।
প্রাগৈতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থা আলোচনায় অস্টদশ শতাব্দীর ক্লাসিক্যাল দার্শনিক হতে বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর এনথ্রপলজিস্টদের উদ্ধৃতি দেওয়া বিজ্ঞান সম্মত। আর এভাবে “ছিলনা” বলাটাও যুক্তি না।
সর্বশেষে,
লেখার বিষয়বস্তু এবং শিরোনাম আগ্রহ উদ্দীপক কিন্তু লেখাটি মোটেও সুখপাঠ্য নয়। এত বড় প্রবন্ধ কিন্তু প্যারা মাত্র পাঁচটি। উদ্ধৃতি গুলো আলাদা ভাবে দেওয়া যেত এবং যখন নাম্বারিং করা হয় তখন পাশাপাশি না লিখে ক্রমানুসারে উল্লেখ করা শ্রেয়। আশাকরি লেখক এটা পজেটিভ ভাবেই নিবেন।
ধন্যবাদ।
@সংবাদিকা,
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় কোন রাষ্ট্রে অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদেরকে বঞ্চিত ও শোষিত মনে করলেই সেখানে ধর্ম ভিত্তিক একটা রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন শুরু হয় ও এক পর্যায়ে ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। যার উদাহরন পাকিস্তান, পূর্ব তিমুর, দক্ষিন সুদান , অবশ্যই ইসরাইল। গণতন্ত্র হোক আর সমাজতন্ত্র হোক আর ধর্ম তন্ত্র হোক রাষ্ট্রের ভিত্তি যাই হোক না কেন, পুরুষরা নারী দেরকে দুর্বল হিসাবে দেখতে অভ্যস্থ , যে কারনে প্রতিটি তন্ত্রেই নারীদেরকে তাত্ত্বিকভাবে যতই অধিকার দেয়া হোক না কেন তা তারা ভোগ করতে পারে না আর তাই নারীদেরকে এগিয়ে আসা উচিত তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার জন্য। এর মধ্যে অবশ্য ধর্মগুলো নারীদের অবস্থান চিরতরে নিম্ন গামী করেছে, যে কারনে যে কোন রাষ্ট্রেই তাত্ত্বিকভাবে তাদেরকে যতই অধিকার দেয়া হোক না কেন, তা অধিকাংশ নারী্ই ভোগ করতে পারে না, তারা মনে করে নিগৃত হওয়া হলো নারীর ভবিতব্য।
বেশ ঘনীভূত লেখা, বহু উপাদান। বস্তুত উপাদান এতই বেশি যে প্রতিক্রিয়া জানানো শক্ত।
নারী নিয়ে যখন লিখছেনই ! হেলেন কেলারের (Helen Keller) ‘দৃষ্টিতে’ নারী নিয়ে একটা লেখা ছাড়ুন । পারলে এমি লী ( Amy lee)। দারুন হবে । আমি এ দুজনের ভীষণ ভক্ত !
শুধু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়াতেই এই খেসারত দিতে হয়েছিল? ধরুন, পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি অনেক গণতন্ত্রমনা, তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কোন বৈষম্য করে না, পূর্ব পাকিস্তান তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না, তাহলে ?
ধর্মের ভিত্তিতে তো খালি পাকিস্তানই হয়নি, একই সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রেরও জন্ম হয়েছিল। আলাদা আলাদা জাতি থাকা স্বত্বেও খালি ধর্মের মিলের কারণেই কতগুলো রাজ্য নিয়ে আজকের ভারত জন্ম লাভ করে। কই ভারতে তো এমন হয়নি?
তাই বলে এটা কিন্তু নয় যে, পাকিস্তানের জন্ম স্বাভাবিক ছিল! প্রায় ১০০০ হাজার মাইলের দূরত্ব এবং মাঝে বিশাল অন্য দেশ রেখে পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল বলে আমার জানা নেই।
আপনার আরও লেখা পড়ার প্রত্যাশা করছি। ভাল থাকুন।