লিখেছেনঃ কাজল কুমার দাস

খুব বেশী সময় নেই আর আসছে বাঙ্গালীর খুব প্রিয় পুতুল ভাঙ্গা-গড়ার উৎসব। যদিও হিন্দু সংখ্যালঘুরা এটাকে বলে শারদীয় দুর্গাপুজা। তা সে শরৎ হোক বা গ্রীষ্ম এমন উৎসব এ অঞ্চলে চলে বছরভর। জাতিগত-ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন এখন এ অঞ্চলের প্রতিদিনের ঘটনা। শুধু হিন্দুদের উপরই নয় বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরাও এমন সব উৎসবের বাইরে নয়। রামুর বৌদ্ধ বিহারের কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চই! ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামু ও এরপর উখিয়া, মহেষখালী ও পটিয়ায় কুরআন অবমাননার মিথ্যে অভিযোগ এনে বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা মনে করুন। সেই তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে কুরআন অবমাননা করার ভুয়া খবরে ধর্মভীরু তৌহিদী জনতা ৬টি বৌদ্ধ মন্দিরসহ ২০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে আর ভাংচুর করে শতাধিক বসতিতে। (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম- ১ অক্টোবর ২০১২)

২০১৬ সালেও ঘটে সেই একই ঘটনা। এবারও সেই তথাকথিত ধর্মাবমাননা। হেফাজত এবং আহলে হাদিসের ব্যানারে সেই ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতা ফেসইবুকে রসরাজ দাস নামের এক নিরক্ষর জেলের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার মিথ্যে অভিযোগে নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়ি-ঘর, মন্দির ভেঙে লুটপাট করে। যদিও তখন ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ও ফেসবুকে এই হালাল ‘তাকিয়া’ বা মিথ্যাচারটি করেছিলো এমন কয়েকজনকে আটক করা হয়েছিলো কিন্তু, মৌলবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের সংখ্যাগুরু ভাইদের বাঁচাতে মামলায় গ্রেফতার হওয়া প্রায় সব আসামিকেই জামিন দিয়ে দেয়। শুধু নাসিরনগরই নয় পুরো দেশজুড়েই এরকম অসংখ্য হামলার উপাখ্যান রচিত হয়েছে। ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়া গ্রামের টিটু রায় নামে একজন হিন্দু যুবক ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননামূলক পোস্ট দিয়েছেন বলে মিথ্যা অভিযোগ তুলে কয়েকশো ইসলামপ্রিয় জনতা ঐ গ্রামে হামলা চালায়। তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে সেই একই গোষ্ঠির তৌহিদি জনতা ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে অর্ধশত হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। যশোরের অভয়নগর, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে সবখানেই সাম্প্রদায়িক হামলার একই চিত্র। আর কত শুনবেন! এসব এখন এদেশের সংখ্যাগুরুদের কালচারের সাথে মিশে গেছে। সংখ্যালঘুদের সম্পদ-জমি দখল, নির্যাতন-নিপিড়ন, নারী-ধর্ষণের প্রধান হাতিয়ার এখন ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগ। একজন সংখ্যালঘুকে ফাঁসানোর এটাই এখন সবথেকে সহজ পদ্ধতি, তা সে শ্যামল কান্তি হোক আর নিরক্ষর রসরাজ দাস কারো জন্যই এ মাটি আর নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের রোল মডেল হিসেবে পুরো বিশ্বেই কুখ্যাত কারণ, মিথ্যে অজুহাতে কিভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন করা যায় সারা বিশ্বের মৌলবাদীরা সেটা বাংলাদেশের কাছে শিখতে পারে। (সূত্র: বিবিসি বাংলা- ১৩ নভেম্বর ২০১৭)

৭১’ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ কিন্তু এসব নীতি নিয়ে জন্ম নেয়নি। সদ্য স্বাধীন সেই দেশের সংবিধান চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে প্রথম হাঁটতে শিখেছিলো- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এখন সেসব অলীক আর স্বপ্ন। রাজনীতির বেশ্যারা মৌলবাদীদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে আমাদের সংবিধানকে তাদের প্রয়োজন মত পাল্টেছে বহুবার। দেশটাকে লুটপাট করতে ক্যাপিটালিস্ট আর ফান্ডামেন্টালিস্টরা ক্ষমতায় গিয়ে দেশকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিনত করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অবস্থান প্রতিদিনই একটু একটু করে অনিরাপদ হয়েছে- আজ তাদের অস্তিত্ব সংকট এই জনপদে। তাইতো এদেশে সংখ্যালঘু আজ আর কেবল একটি শব্দই নয় এইটি একটি বিলুপ্ত প্রজাতীর নাম। যারা ভাবছেন দেশটাকে এভাবে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক অরাজকতা, দূর্বৃত্তায়ন, মৌলবাদী আগ্রাসন, সহিংসতা, ইতিহাস বিকৃতিকরণে মোশতাক, এরশাদ, জিয়া, খালেদা জিয়া, জামাত… এরাই দায়ী, সন্দেহ নেই যে তারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আর দলান্ধ দালাল। ক্ষমতাসীনদের আজন্ম মসনদে থাকার মোহে তাঁরা এইসব সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে তাদের মাথা নত করছে। উদাহরণ, মৌলবাদী গোষ্ঠীদের সরকারি খাস জমি বরাদ্দ, অকল্পনীয় অর্থ অনুদান, তাদের মতানুসারে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামিকরণ। মৌলবাদীদের সাথে নিয়ে সংস্কৃতি- অর্থনীতি- রাজনীতি- জাতীয়তা সবক্ষেত্রেই খুব কৌশল করে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছে। ধর্মের নামে দেশের মানুষ অতি আহ্লাদে আর ধর্মোন্মাদনায় ঢক-ঢক করে এইসব গিয়ে খেয়েছে। এদেশের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর সন্তানদের একটা বিরাট অংশই এখন মাদ্রাসায় আর ইসলামিক স্কুল-কলেজে পড়ে। যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার মূলনীতিতে অমুসলিম আর বিধর্মীদের প্রতি কেবলই তাদের দ্বেষ আর হিংসা। এটা এখন আর শুধু স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রতিটি সাম্প্রদায়িক পরিবারগুলোর ভেতরের চিত্রও একই যা আজ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই সকল কারণে আজ অকোপটে বলা যায় যে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচ্ছন্ন মদদেই এই মৌলবাদের উত্থান।

সব থেকে ভয়ংকর যে বিষয়টির মুখোমুখি আমরা এখন দাঁড়িয়েছি তা হলো, এখানে বাইরে থেকে মৌলবাদকে চেনা খুবই কষ্টকর। এমন একটা সময় ছিলো এ দেশে যখন আপনি চিনতেন, কে জামাতপন্থী-উগ্রবাদী-ডানপন্থী আর কেই বা বামপন্থী! এখন তো সেটা চেনাও কষ্টকর। সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে মাথা তুলে দাড়িয়েছে মৌলবাদ। অদ্ভুত বিষয় হলো, আপনি হয়ত জানেন কে জামাতী বা মৌলবাদী, আবার সেও হয়ত জানে তার সাথে আপনার আদর্শিক দ্বন্দের জায়গাটা। তারপরেও হয়ত তার সাথে চা খাচ্ছেন, গল্প করছেন সামাজিকতার খাতিরে। কিন্তু যাকে প্রগতিশীল বা সংস্কৃতির মানুষ বলে জানেন, যাকে সাথে নিয়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তাকে কি চেনেন আপনি? যদি না চেনেন তবে, সম্প্রতি প্রিয়া সাহার ঘটনাটি আপনি লক্ষ্য করুন। এদেশের সুশীল-কুশীল-বাম-গতিশীল সবার লুঙ্গি প্রিয়া সাহা খুলে দিয়েছেন। শফি হুজুর থেকে শুরু করে ব্যাক্তি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের চেতনাজীবীদের চেহারা কিন্তু অভিন্ন নয়।

একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি- রহিঙ্গা শরনার্থীরা যখন মিয়ানমারের সেনাবহিনীর কাছে নির্যাতিত হয়ে দেশ ছেড়ে ছুটছে তখনকার ঘটনা এটা। বরিশালের কয়েকটা ছেলে আর সংবাদকর্মীরা একটা মানবন্ধনের আয়োজন করেছে রহিঙ্গা শরনার্থীদের সাহায্যের জন্য- বিষয়টা ততক্ষনও ছিলো কেবল মানবিক। আয়োজকরা আমার কাছে জানতে চাইলো, এটার শ্লোগান কি হতে পারে? আমি একবারে লিখে দিলাম “মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ- সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও”। ব্যাস্, তারাও যথারীতি একটি ব্যানারে এটা লিখে সেটা নিয়ে রাস্তায় দাড়ালো। ততক্ষনে এ আয়োজনটি আর সেই কয়েকটি ছেলের হাতে নেই; ওটাতে তখন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কত্তারা যোগ দিয়েছেন। তারাও এসে যথারীতি রাস্তায় দাঁড়ালো। কিন্তু মানবন্ধন শেষে তো তাদের চক্ষুস্থির- “এখানে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ” কেন হে বাপু! ছেলেগুলোকে প্রচন্ড কটাক্ষ করে চেতনাজীবীরা বলেই ফেল্ল- “তোমরা তো ভারি সাম্প্রদায়িক হে। এই বাংলাদেশ কথাটা এখানে লিখলে কেন? সবাই এর সমালোচনা করছে জানো!” এ ধরনের বাকবিতন্ডায় সদর রোড ততক্ষণে উত্তপ্ত। যাইহোক শেষব্দি আয়োজকরা আমার নামটিই নিলো; ব্যাস্ আর কোথায় যায়। আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তেনারা। এই হলেন আমাদের প্রগতিশীল যোদ্ধা আর বোদ্ধারা! নিজের দেশের সংখ্যালঘু-আদিবাসী-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের উপর নির্যাতনে এরা চুপ থাকে; মুচকি হাসে। খুব বেশি ঠেকলে একবার বলে “সত্যিই এটা অমানবিক” সাথে জুড়ে দেয় আরেকটি লাইন “তবে সত্যি বলতে কি জানো- সহি ইসলামের সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই…”। আসলে এরা মিয়ানমারে মানবিকতা নয় “ইসলামিজম” দেখেছে। তাইতো মিয়ানমার থেকে রহিঙ্গা শরনার্থীরা যখন এদেশে আসতে শুরু করেছিলো- এদেশের মাহফিলে হুংকার দিয়ে আলেমরা বলেছিলেন “রহিঙ্গা মুসলিম নারীদের বিয়ে করা ফরজ। কারো একটা বিবি থাকলে তিনি আরেকটা বিয়ে করতে পারেন…..” আসলে এসব শুধু মাহফিলের বয়ানই নয় সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও মনের কথা। এই মানবতা শুধু মিয়ানমারের রহিঙ্গাদের বেলায়ই নয়- সিরিয়ানদের বেলায়ও সেই একই দেখা যায়। কিন্তু কখনো জানতে চেয়েছেন সৌদি আগ্রাসনের শিকার ইয়েমেনের বিষয়ে এরা মৌনব্রত কেন?

সাগরপাড়ের শিশু আয়ানের দেহ প্রগতিশীল বোদ্ধাদের যতটা নাড়া দেয়, তাদের দেশে তাদেরই ভাইদের হাতে ধর্ষিত ভোলার পূর্নিমার ক্ষেত্রে ততটা কেন নয়?

তথ্যসূত্র:

১। www.dailysangram.com/post/97703

২। https://www.bbc.com/bengali/41969826

৩। https://www.bbc.com/bengali/news-46126648

 

ছবি:

১। রামু বৌদ্ধ বিহারে হামলা- ঢাকা ট্রিবিউন

২। নাসিরনগরে হামলা- ঢাকা ট্রিবিউন