রশীদ তালুকদার আর নেই। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এই মুক্তিযোদ্ধার।

একাত্তরে, যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে শুধু ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েছিল কিছু মানুষ। ছুটে বেড়িয়েছেন রণাঙ্গনে, ক্যান্টনমেন্টে, লুকিয়ে লুকিয়ে অনুসরণ করেছেন হানাদার ও তার দোসরদের। ধরে রাখতে চেয়েছেন একখণ্ড ইতিহাস। জীবন বাজি রেখে তোলা তাদের সেইসব ছবি দিয়ে আজ আমরা ‘৭১-কে দেখি, স্মরণ করি। আজ যখন বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাসের পাতা তখন এই ছবিগুলোই একমাত্র অকাট্য প্রমাণ। যাদের ত্যাগে এসব দলিল আমরা হাতে পেয়েছি, যাদের ত্যাগে আজো ‘৭১ জীবন্ত, তাদের আমরা কতটুকু জানি। কতটুকু স্মরণ করি। কতটুকু মূল্যায়ন করতে পেরেছি সেই কৃতী সৈনিকদের।


রশীদ তালুকদার বহুল পরিচিত সংবাদচিত্র শিল্পী। যুদ্ধদিনের সেই কৃতী সৈনিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন। বাংলাদেশের সংবাদচিত্রে শৈল্পিক নৈপুণ্যের পরিচয় তার কাজেই সর্বপ্রথম দেখা যায়। ‘৬৯ থেকে শুরু করে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাঙালির মুক্তি ও আন্দোলন সংগ্রামের এমন অনেক ছবি তিনি তুলেছেন যা দেশ-বিদেশের অনেকের কাছে পরিচিত। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকার কারণে তার বিভিন্ন মুহূর্তের অনেক বিরল ছবি তিনি তুলতে পেরেছিলেন। রশীদ তালুকদারের বিচিত্র পেশাগত জীবন থেকে নেয়া ভিন্নধর্মী গল্পকথা তার চারপাশের মানুষকে আপ্লুত করে।

রশীদ তালুকদারের ঘরের দেয়াল
যে পুলিশকে একদিন তিনি প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন পরবর্তীতে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ে সেই পুলিশসহ অন্যান্য পুলিশের প্রহারে তিনি প্রায় মৃতবৎ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেও নিরাপত্তা না থাকায়, শঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতাল থেকে লুকিয়ে বের করে নিয়ে আসা হয়। তার সেই অসুস্থতা এখনো কাটেনি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গিয়ে বাথরুমে আছাড় খেয়ে পাওয়া ব্যথা। অসুস্থতাকে সঙ্গী করে বিমানে চেপেছিলেন দেশে ফেরার জন্য। এই বিমান ভ্রমণ তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা বেশ কয়েকদিন লড়াই করেন তিনি। অবশেষে আজ আমাদের সবাইকে ছেড়ে গেলেন তিনি।

রশীদ তালুকদার ও আনিস রায়হান
এই কিংবদন্তীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে। বেশ কয়েকবার তখন তার বাড্ডার বাসায় গিয়েছিলাম আমি। মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রীদের নিয়ে করা আমার জীবনের সেরা কাজটি করতে গিয়ে তার অনেক সাহায্য পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রীদের নিয়ে কাজ করাটা ছিল খুবই কঠিন।
আমি যখন প্রথম কাজে হাত দেই তখন মাত্র কয়েকজন মানুষের নাম পেয়েছিলাম। পরে এখানে ওখানে ছোটাছুটি, এর কাছে যাওয়া, ওর সঙ্গে কথা বলা, কারো কারো পেছনে দিনের পর দিন সময় কাটানো, এর মধ্য দিয়ে সমর্থ্য হয়েছি মুক্তিযুদ্ধে আলোকচিত্রীদের ভূমিকাকে জাতির সামনে তুলে ধরতে। এই কাজ করতে গিয়ে অনেকের অনেক অসহযোগিতায়, আমাকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা দেখে হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু রশীদ তালুকদার আমাকে অনেক অসুস্থতা সত্ত্বেও কাগজপত্র, ছবি, তথ্য দিয়ে অনেক সহযোগিতা করেছিলেন।

১৯৩৯ সালের ২৪ অক্টোবর চব্বিশ পরগনায় রশীদ তালুকদারের জন্ম। রাজশাহীর স্টার স্টুডিওতে মরহুম মোতাহার হোসেনের কাছে তার ফটোগ্রাফির প্রথম হাতেখড়ি। ১৯৫৯ সালে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দিলেন পিআইডিতে (প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট)। বেতন সর্বসাকুল্যে ৮০ টাকা। দুই বছর পর কর্মক্ষেত্র বদলান। ১৯৬১ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ-এ। ফটোসাংবাদিক হিসেবে তাকে জীবনের প্রথম এ্যাসাইনমেন্টটি দিয়েছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার।

পরবর্তী ১৩ বছর দৈনিক সংবাদ-এ কাজ করেন। ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটানা ৩২ বছর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সিনিয়র প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে সাংবাদিকতা করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে স্বর্ণপদকসহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার রশীদ তালুকদার দেশের জন্য বয়ে এনেছেন। তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ৭৭। এ বছর মে মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির পক্ষ থেকে এই আলোকচিত্রী পেয়েছেন ‘পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার এ্যাওয়ার্ড’। সারা বিশ্বের মধ্যে তিনিই এই প্রথম পুরস্কারটি পেলেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন তিন বার। পরে সোসাইটির সর্বোচ্চ পদক অনারারি ফেলোশিপ পান। বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়কও ছিলেন তিনি।

আলোচিত এই আলোকচিত্রীর ছবি নামে অথবা বেনামে সরকারি, বেসরকারি নানা প্রকাশনা, পোস্টার, ক্যালেন্ডার এবং অসংখ্য বইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো আলোকচিত্রী, লেখক, প্রকাশক তার ছবি ফটোকপি করে নিজেদের নামে ছেপেছেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ধার ধারেননি তারা। অবস্থা এমনই যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত এই আলোকচিত্রী আজ পর্যন্ত নিজস্ব কোনো একক অ্যালবাম প্রকাশ করতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্রী হিসেবে রশীদ তালুকদারের কাছে আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রীদের কতটা মূল্যায়ন হয়েছে? প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। হাত নেড়ে বলে ওঠেন, ‘কিছুই হয়নি। বাদ দাও ওসব। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিতর্কিত দুজনকে একুশে পদক দেয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৭ সালে এবং এই ২০১০ সালে এসে দুজন আলোকচিত্রী তার কাজের মূল্যায়ন পেলেন। এরা হচ্ছেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী এম এ বেগ এবং মোহাম্মদ আলম। এই দুই ব্যক্তিই সত্যিকারের আলোকচিত্রী হিসেবে সর্বপ্রথম একুশে পদক পেলেন। এটা আরো আগে হওয়ার দরকার ছিল। আমার কথা বাদ দিন। জনগণ আমাকে অনেক পুরস্কার দিয়েছে। ছারছিনা পীরের বাড়ির কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণীর বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তার বিরোধী অবস্থানও কারো অজানা নয়। এই রাষ্ট্র তাকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। তাই এই রাষ্ট্রের পুরস্কার আমার চাই না, আমাকে কোনো পদক দেয়া হলেও আমি তা গ্রহণ করব না।’

রশীদ তালুকদার মহাভাগ্যবান এক আলোকচিত্র শিল্পীর নাম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং ফলাফল, অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী হাহাকার, আহাজারি, কান্না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিক অনুভূতি, নারী আন্দোলন, বিভিন্ন সংগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তার ক্যামেরার মাধ্যমে মানুষের সামনে আবেদনময় করে উপস্থাপন করেছেন। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে জাগ্রত করে তুলেছেন। বিখ্যাত, বহুল প্রচারিত ও মুদ্রিত এসব ছবি ইতিহাসের সত্যতাকে ধারণ করছে যুগ যুগ ধরে। নিজের এসব ছবি সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি শুধু একটি কথাই বলেছিলেন- ‘আই এ্যাম এ লাকি ফটোগ্রাফার।’ তার কিছু ছবি পরিচয়সহ তুলে ধরলাম।

৬৯
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান
গণঅভ্যুত্থানের সময় মিছিলে স্লোগানরত নিহত টোকাইয়ের ছবি। কালজয়ী এই আলোকচিত্রটির আবেদন কখনো ফুরোবার নয়। গণঅভ্যুত্থানের শেষ মিছিল ছিল এটি। আইয়ুব খানের ছবিতে জুতার মালা পরিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের এই মিছিলটি যখন শিক্ষা ভবনের মোড়ে এসে পৌঁছায় তখন রশীদ তালুকদারের চোখ আটকে যায় এই শীর্ণ টোকাইয়ের ওপর। টোকাইটির চোখের ও মুখের প্রতিবাদী ভাষা সারাদেশের নিপীড়নের কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্যকে প্রতিবাদ করতে আহ্বান জানায়। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ডাক দেয়। এ ধরনের আহ্বান শাসকগোষ্ঠীর কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে তিনি পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াতেই ইপিআর কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ছেলেটি নিহত হয়। কিন্তু রশীদ তালুকদার তাকে হারিয়ে যেতে দেননি। তার ক্যামেরার ফ্রেমে সেই সময়ের নির্ভীক সাহসী প্রতিবাদ জীবন্ত হয়ে আছে, থাকবে।

আসাদের শার্ট
আসাদের শার্ট
”গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।”
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পুলিশ বাহিনীর গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হন। আসাদের মৃতুর খবর সারা শহরে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শহীদ আসাদ হত্যা প্রতিবাদে তার রক্তরঞ্জিত শার্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশাল মিছিল বের হয়। দুই মাইল লম্বা সেই মিছিল ছিল ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ মিছিল। রশীদ তালুকদার তার ফ্রেমে বন্দি করেন আসাদের শার্ট। ছবিটি দেখে শামসুর রাহমান ‘আসাদের শার্ট’ অমর কবিতাটি লেখেন।

আগরতলা মামলা
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
১৯৬৮ সালের ১১ এপ্রিল এক সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার একটি মামলা দায়ের করে। এতে এক নম্বর আসামি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এর নাম দেয়া হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। সাধারণ জনতা এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করতে থাকে। যা ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভীতসন্ত্রস্ত সামরিক শাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের এই মামলা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এই গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিলাভ স্বাধীনতার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। জেলে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকে শুনানির জন্য আদালতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি ধারণ করেন রশীদ তালুকদার। দুর্লভ এই ছবিটিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত অবিচল এক নেতার আত্মপ্রত্যয় প্রকাশ পাচ্ছে।

৭ মার্চ
৭ মার্চের ভাষণ
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর আঙ্গুল উঁচিয়ে ভাষণদানের মুহূর্তটি রশীদ তালুকদার অসাধারণ দক্ষতায় ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবিটি তার তেজোদীপ্ত আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় অবস্থান, কঠিন সংগ্রামের শপথকে যেন প্রকাশ করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি এ ছবির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে আসছে। ৭ মার্চের আরো অনেক ছবি আছে রশীদ তালুকদারের তোলা। তার তোলা অনেক ছবি অনেকে চুরি করেছে। ছেপেছে নিজের নাম দিয়ে। এই প্রতারকদের ক্ষমা করা উচিত হবে না।

রশীদ তালুকদার
জনসমুদ্র
‘৭১-এর মতো অস্থির সময় এদেশে আর কখনো আসেনি। পাকিস্তানিদের শোষণ ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ বাঙালি জাতি তখন চরম বিক্ষুব্ধ। পাকিস্তানের মোহ কেটে গেছে অনেক আগেই। মানুষের তখন একটাই আকাক্সক্ষা স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু ততদিনে হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক। তার মুখ থেকে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা শুনতে ‘৭১-এর ৭ মার্চে রমনার রেসকোর্স ময়দানে নেমেছিল লাখ লাখ মানুষের ঢল। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধী সব শ্রেণীর মানুষই হাজির। প্রত্যেকের চোখেমুখে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর সমুচিত জবাব দেয়ার দৃঢ় কঠিন শপথ। রশীদ তালুকদার তার ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন সেদিনের প্রতিবাদী জনতার এক শৈল্পিক রূপ। অসাধারণ এ ছবিটি আলোকচিত্র শিল্পী হিসেবে রশীদ তালুকদারের অসামান্য দক্ষতার পরিচয় বহন করে। এ ধরনের ছবি সারা বিশ্বে আর কোথাও দেখা যায়নি।

রায়েরবাজার
রায়েরবাজার বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস৷ চারদিক থেকেই খবর আসছিল মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় খুব বেশি দূরে নয়৷ গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের অলি-গলিতে প্রতিটি মানুষই চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকে মুক্তির প্রতীক্ষা করছিল৷ এ সময় পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার প্রকল্প হাতে নেয়। হিটলিস্টে যাদের নাম ছিল তাদের ১৫ নভেম্বর থেকেই ঘরবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস। ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর এমনকি ১৬ ডিসেম্বরও ঘাতকরা বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে। ওরা মেরেছে কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, ইঞ্জিনিয়ারসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো সেই বীভৎসতার ইতিহাস প্রতিনিয়ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

রশীদ তালুকদার
ভাগ্যবান এই আলোকচিত্রী আজ হাসপাতালে মৃতবৎ। হে জীবন্ত কিংবদন্তী, আমাদের প্রজন্মের অনেকেই আপনাকে দেখেনি। তবে তারা আপনার চোখ দিয়েই দেখে নিজেদের ইতিহাস। আপনার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আমাদের সামনে উন্মোচিত করে বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় একাত্তর, শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ্‌ আর শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতাকে। এমন সুসময় এ জাতির জীবনে আসেনি কখনো, আসেনি এমন দুঃসময়ও।
এ সময়টা অনেককে শ্রেষ্ঠ করেছে। অনেককে করেছে নিকৃষ্ট। কেউ সব কিছু সহ্য করে, অনেক ক্ষতি মেনে নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানুষ হিসেবে। আর কেউ কেউ বুঝতেই পারেননি কিভাবে হয়ে গেলেন অমানুষ। মানুষ এ সময় বদলেছে ক্ষণে ক্ষণে। ঘাত-প্রতিঘাতের একেকটা মুহূর্ত এসে নিজের সঙ্গে নিজের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নতুন করে। আপনি বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরই একজন। জেগে উঠুন আপনি, ফিরে আসুন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে- এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম আমরা। কিন্তু আপনি জাগতিক নিয়ম অনুসরণ করে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। তবে এই বিদায় আসলে পাহাড়ের মতো ভারী। এই ভার বইবার সাধ্য আমাদের নেই…