সাল ১৯৭১, পূর্ব পাকিস্থান যখন নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলো তখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা স্বাধীনতার এই প্রচেষ্টাকে দমন করতে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠানো ও গণহত্যা শুরু করে। সেই সাথে বাঙালিদের দুর্দশার কথা ও দেশের প্রকৃত অবস্থা বিশ্বের কাছে যেন না পৌছায় সে জন্য কোনো বিদেশি সাংবাদিককে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিলো না।

 

বিখ্যাত ফরাসি ফটো-সাংবাদিক মিস অ্যান ডি হেনিং তখন নেপালে অবস্থান করছিলেন। ২৬ বছর বয়সী মিস অ্যান ডি হেনিং বাঙালিদের দুর্দশার কথা বিশ্বের কাছে প্রকাশ করতে নেপাল থেকে ভারতীয় শহর কোলকাতা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি পরপর তিনবার ব্যর্থ হন।

অবশেষে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল গোপনে যশোর দিয়ে ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই সময়টাতে তিনি বর্তমান কুষ্টিয়া শহর, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী, রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও গোয়ালন্দে ক্যামেরা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে বেড়িয়েছেন।

এসময় তিনি উদ্বাস্তুদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, দখলদার বাহিনীর দ্বারা ভয়ঙ্করভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম এবং সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার অনেক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেন। অ্যানের তোলা ছবিগুলোর একটি বিশেষত্ব হলো যে সেগুলো অত্যন্ত বিরল। অ্যানের বেশিরভাগ ফটোগ্রাফই ছিলো যুদ্ধের প্রথম দিককার দিনগুলোর।

১৯৭১ সালের এপ্রিলে কুষ্টিয়া শহরে তোলা তার একটি ফটোগ্রাফে দেখা যায় লুঙ্গি পরিহিত উদাম গায়ে একজন যুবক একটি পুরানো ৩০৩ (থ্রি নট থ্রি) এনফিল্ড রাইফেল এক কাঁধে ঝুলিয়ে অন্য কাঁধে বিছানাপত্র ও হাতে একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অ্যানের তোলা অন্য আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পরে জানা যায় তিনি হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জহর সেন। সিলেটের জকিগঞ্জের এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে প্রথম অংশগ্রহণ করেন কুষ্টিয়া এলাকায়। কুষ্টিয়ায় পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন বিধায় ওই সময়ে পুলিশ সদস্য কর্তৃক অহরহ ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। পরে পাক বাহিনীকে মোকাবেলা করেছেন বৃহত্তর সিলেট জেলার হবিগঞ্জের বাহুবলে। আর একাই ১৭ জন পাকসেনা ও ২ জন আলবদরকে হত্যা করেছিলেন তিনি।

 

মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি বাড়ি ফিরে জানতে পারেন তাঁর কাকার মেয়েকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধ*র্ষ*ণ করেছে। রাজাকারদের প্ররোচনায় তার বাবা-মাকে পাক সেনারা গুলি করে মেরে ফেলেছে।

 

৭৫ এর ১৫ই আগষ্টে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর তৎকালিন ক্ষমতা লোভী পশ্চিম পাকিস্তানের দোসর, স্বদেশীয় রাজাকার-আলবদর কতৃক তার ওপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার, অনেক নির্যাতনে শেষে দেশে নিরাপদ বোধ না করায় ৯০ এ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে তিনি ভারতে চলে যান। জানা যায় এই সব কারনে রাগ, ক্ষোভ, অভিমানে তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টাটি পর্যন্ত করেননি।

 

বীর এই মুক্তিযোদ্ধা নীরবেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৪ জুন। ভারতের আসামের করিমগঞ্জে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

জহর সেনের দেশ ত্যাগের পর ২০ বছর ও গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি জহর সেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি। যে দেশের জন্য জহর সেন যুদ্ধ করলেন, তার মা-বাবাকে হত্যা করা হল, বোনকে দিতে হলো সম্ভ্রম, নির্যাতনের যাতনা মাথায় নিয়ে যাকে ত্যাগ করতে হল দেশ তাঁর সম্মান স্বাধীন দেশে জোটে না। বাংলাদেশ ফরাসি ফটো-সাংবাদিক মিস অ্যান ডি হেনিংকে বিভিন্ন সময় প্রদান করলেও জহর সেনর বিন্দুমাত্র সম্মান জোটেনি এই বাংলার মাটিতে।

 

এটা কি স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যর্থতা নয়?

 

তথ্যসূত্রঃ ১. মীর শাহনেওয়াজ: ফরাসি ফটো-সাংবাদিক মিস অ্যান ডি হেনিং : তাঁকে খুঁজে ফিরি (আমাদের সময়.কম)

 

২.মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর (পিএস) সালেকউদ্দিনের লেখা বই (সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ) এছাড়া দেব-দুলাল মুন্না নিজেও জহর সেন-এর সাথে (৮৮) সালে দেখা করেন, প্রিয় প্রজন্ম ম্যাগাজিনে একটা ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল।

 

৩. চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জহর সেন নাজনীন আক্তার লাকী (news now bangle . com)