যে স্বল্প সংখ্যক মানুষ আমার হৃদয়ে গাঁথা আছে এবং থাকবে মোঃ আবুল হোসেন, আমার আবুল ভাই তার মধ্যে একজন। আমার দুবছরের অগ্রজ। আবুল ভাই একজন সদা হাসিখুশি এবং “ভাল লাগা” বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একজন বিরল মানুষ। তারমত এত পরোপকারী মানুষ কম দেখেছি। কাউকে সাহায্য করতে হাটু জলে নামার দরকার হলে আবুল ভাই নামত গলাজল অবধি।

এম. এ. পাশ পাশ করার পরেই শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে একটি উচ্চ পদে চাকুরী হয় আবুল ভাইয়ের। অল্প দিনেই সেক্রেটারী মহোদয় আবুলের বিরাট হৃদয়টা অনুভব করতে পারেন। বলেন, তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। আবুল খুশী হয়। কিন্তু এই সুযোগই আবুলের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। বিপর্যয় শুরু হতে সময় লাগে মাত্র দশ বছর। মানুষ দেখতো হেসেখেলে দিব্যি আছে আবুল। বিপর্যস্ত জীবন চলে আরও প্রায় বিশটি বছর। কিন্তু শরীর এক সময় বিদ্রোহ করে। আবুল ভাই আর পারে না।

আবুল প্রেষণে ১৯৭৯ সালে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগদান করে। লন্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে নিজ চাচাতো বোন নাসিমার সাথে বিয়ে হয়। লন্ডনে একমাত্র ছেলে মোঃ মনজুর হোসেন সোহাগের জন্ম। ১০ বছর পরে ১৯৮৭ সনে সপরিবারে দেশে ফিরে। চুক্তিনামা অনুযায়ী আবুলকে অনতিবিলম্বে শিক্ষামন্ত্রনালয়ে যোগ দিতে হয়। প্রথমেই তারা উঠে ছোট একটা ভাড়া বাড়িতে। এই ছোট বাড়িতে উঠাটাই প্রথম ভুল। রাতারাতি ধানমন্ডির মত খোলামেলা একটা জায়গায় বাড়ি কিনতে সময় লাগে। বাড়ি বানাতে আরও বেশী সময় লাগে। কিন্তু ভাল একটা বাড়ি ভাড়া পাওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল না।

আমি ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। আবুল ভাই চলে এসেছে শুনেই দেখা করতে ঢাকায় আসি। বসার ঘরটা লন্ডন থেকে আনা জিনিষ পত্রে ঠাসা। ঘরে ৬০ কি ৭৫ ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বলছে। ঘরটা ভাল ভাবে আলোকিত নয়। মনে হলো দিনের বেলাতেও আলোটা জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এরকম পরিবেশে লন্ডনে জন্ম এবং বেড়ে উঠা ৭/৮ বছরের একটা বাচ্চার জন্য মাত্র এক বা দুটি ঘন্টা অবস্থানও কল্পনাতীত। খোলা পুকুরের একটা ব্যাংঙকে ১০০ ফুট কুয়োর মধ্যে ফেলে দিলে ব্যাঙের যেমন অবস্থা হয়, সোহাগেরও সেরকম অবস্থা। একদিন, দুদিন, সপ্তাহ যায়। কেনার মত বাড়ি মিলে না। সোহাগ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুরু হয় মানসিক যন্ত্রনা। কবে শেষ হবে এই দোজখ বাস? যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে সোহাগ। মানসিক যন্ত্রনার ট্রমা শুরু হয় সোহাগের। এমতাবস্থায় খোলামেলা ভাল একটা বাসা ভাড়া না নিয়ে নাসিমা সোহাগকে নিয়ে লন্ডনে ফিরে যায়। আবুল দেশে থেকে যায়। ধানমন্ডির মত ভাল এলাকায় একটা বাড়ি পেলে সোহাগ এবং নাসিমা বাংলাদেশে চলে আসবে।

লন্ডনে চলে যাওয়াটা দ্বিতীয় এবং শেষ ভুল। ছোট্ট ভাড়া বাড়ির পরিবেশ ভুলতে পারেনা সোহাগ। সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় বাংলাদেশে আর ফিরবে না। সোহাগ না ফিরলে নাসিমারও ফেরা হয় না। এভাবেই একে একে তেইশটি বছর চলে গেল। কিন্তু এই তিনটি প্রাণীর আর দেখা হলো না। ছোট বাচ্চাদের সাইকোলোজিক্যাল সমস্যার প্রেক্ষিতে সঠিক পদক্ষেপ সঠিক সময়ে না নিলে জীবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, এটি তার একটা দুঃখজনক উদাহরণ।

আবুল নিজ গ্রামে “বৈন্যা নব জাগরণী সংঘ” নামে একটা ক্লাব গঠন করে। আমাকে চিঠি লিখে সাহায্যের জন্য। আমি তখন আমেরিকাতে ছাত্র। আবুল ভাইয়ের ডাকে আমার শরীরে রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। যথাসাধ্য সাহায্য করি। পরে যখন জানতে পারে আমি একজন ছাত্রে, তখন আবুল ভাইএর অনুশোচনার সীমা থাকে না। ঢাকা শহর ভিত্তিক সিটি ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটির উপদেষ্টা ও থিয়েটার মিডিয়া নাট্যদলের সভাপতি দায়িত্বে কাজ করে। রজনীগন্ধা সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৯ সালে সফল নাট্য সংগঠক হিসেবে ‘রজনীগন্ধা পুরষ্কার’ দেওয়া হয় আবুল ভাইকে।

২০০১ সালে সাড় চৌদ্দ বছর পরে বাংলাদেশে গিয়েই শিক্ষামন্ত্রনালয়ে আবুল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাই। সেক্রেটারিয়েটের ভিতরেই আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। আমি বললাম, খেতে পারব না। আমার সমস্যা আছে। আবুল ভাই বলল, সমস্যা? সমস্যার আর কী দেখছো? বলেই ড্রয়ার খুলে লম্বা এবং বেশ মোটা একটা বাঁধানো খাতা বের করল। খাতার সর্ব পেছনের পাতা বের করে বলল, “দ্যাখো।“ প্রায় পনের দিনের রক্তচাপের রেকর্ড। সর্ব নিম্নেরটা ২১০/১৪০। আমি আতকে উঠি। একি অবস্থা? ডাক্তার কী বলে? উত্তর – কী আর বলবে? মরতে তো হবেই একদিন।

তারপর অন্য ড্রয়ার খুলে একটা বই বের করল। তার লেখা কবিতার বই, “নিমেষ অশেষ হয়”। আবুল ভাইয়ের কবিতার বই! আবুল ভাই কবে সাহিত্যিক হলো? সাহিত্যের একটা অক্ষরও কোন দিন লিখেছে শুনিনি। প্রথম পাতায় লিখল, “আমার স্নেহধন্য ও প্রাণপ্রিয় নৃপেন সরকারকে বইটি দিতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। স্বাক্ষরঃ ৪ জুন ২০০১।” বইটি আমার বন্ধু, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মহাব্যাবস্থাপক, নিতাই চাঁদ দাসের বাসায় নিয়ে এলাম। কিন্তু আমেরিকা ফেরার সময় বইটি নিয়ে আসার কথা ভুলে যাই।

তারপর ২০০২ সালে দ্বিতীয়বার দেশে যাই। আমি তখন আমার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছি। একদিন রাত সাড়ে নয়টায় আবুল ভাই উপস্থিত। এটা ওটা কথা হলো। তারপর বলল, আজ উঠি। সাড়ে দশটায় শেষ বাস।
বললাম – মানে কী?
আবুল ভাই পথে নিজের বাড়িতেও ঢুকেনি। রাতটাও থাকবে না। বলল – তোমার সাথে দেখা করতেই এসেছি। ঢাকাতে এলেও তুমি নানা জনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তাই যখন শুনেছি তুমি এখন গ্রামের বাড়িতে, এখানেই এসেছি তোমার সাথে দেখা করতে।

এরপর ২০০৩, ২০০৮, এবং ২০১০ সালে বাংলাদেশে তার সাথে দেখা হয়েছে। ২০১০ সালে দেখলাম গ্রামের বাড়িটা সাজিয়েছে। বাইরের ঘরের সামনে বারান্দা। পায়ের নীচে মাছেরা আনাগোনা করবে তার ব্যবস্থা করেছে। অবসরে এখানেই থাকবে। আমি চলে আসার পরেই শুনলাম এক প্রচন্ড হার্ট এটাকে আবুল ভাইএর জীবন শেষ হয়ে গেছে। ঘটনাটা ঘটেছে রাতে। ঘরে একা থাকত। ধারণা করা হয়, বুকে প্রচন্ড ব্যথায় দরজা খুলে বাইরে আসার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌছুতে পারেনি।

আমার বন্ধু নিতাই বহুবার বাসা বদল করেছে। কিন্তু বইটি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে। নিউ ইয়র্কের সহপাঠী ইমদাদুল ইসলাম মারফত আমাকে পাঠিয়েছে।
উৎসর্গে লেখা – আমার প্রথম কবিতার বই, “নিমেষ অশেষ হয়” মিসেস নাসিমা আক্তার মুক্তাকে দিলাম।

কবিতাগুলোর কিছু বিশেষত্ব সহজেই ধরা পড়ে আছে যা পৃথিবীর তাবৎ কবিতাগ্রন্থ থেকে সুস্পষ্ট আলাদা। গোটা দশেক পাঁচ-ছয় লাইনের কবিতা বাদে সবগুলো মাত্র এক বা দুই লাইনের। একটা লাইন আবার কবিতার নাম। প্রতিটি পাতায় তিনটি কবিতা। মাত্র তিনটি পাতায় আছে চারটে কবিতা। ফলে আশি পাতার কবিতার বইয়ে স্থান পেয়েছে মোট ২৪৩টি কবিতা। ধারণা করি, আবুল ভাই কবিতাগুলো লিখেছে দশ বছর সময়ে। ফলে গড়ে প্রতিদিন দুটো করে। দীর্ঘ রাত, দীর্ঘ দিনের ফসল প্রতিটি কবিতা। মাত্র একটি বা দুটি লাইনে আবুল ভাইএর বিরহী চিত্তের সুদীর্ঘ প্রেম পত্র নাসিমার প্রতি। সহজেই মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন মহাকবি কালিদাসের “মেঘদুতের” কথা। বিরহী যক্ষ থাকে উজ্জয়িনি নগরে, আর প্রেমিকা থাকে হাজার মাইল দূরে নীলগিরি পর্বতে। যক্ষের পক্ষে সম্ভব নয় নীলগিরি পর্বতে গিয়ে মিলিত হওয়া। যক্ষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রতিদিন, সপ্তাহ, মাস, প্রতিটি বছর। যক্ষ দেখ মেঘ দক্ষিন থেকে উত্তরে ভেসে যায়। মেঘই পৌছে দিতে পারে তার হৃদয়ের আকুতি তার প্রিয়তমার কাছে। যক্ষ সারা দিনমান মেঘের সাথেই কথা বলে।

“নিমেষ অশেষ হয়” থেকে কয়েকটি কবিতাঃ

তুমি আমার মনের মানুষ, তুমি পরশ পাথর
ইচ্ছে করে তোমায় নিয়ে আবার নতুন করে বাঁধি ঘর।

দিয়ে তোমার উষ্ণ পরশ, নীরস জীবন করো সরস।

যতদিন নাহি পাই তব ভালবাসা
শেষ হবে সব, শেষ হবে না আশা।

মরণের ক্ষণে যদি তোমায় দেখে মরতে পারি
তবে অন্য কিছুর আশা নাহি করি।

আমার সাধ জাগে তোমাকে বুকে ধরে
নতুন করে আরেকবার বাঁচি ভাল করে।

তুমি হীন একটি দিন হাজার দিনের সমান
তুমি কাছে এলে মরা দেহে ফিরে পাই প্রাণ।

তোমার বিরহ করে মোরে নিঃশেষ
পলে পলে ধ্বংস করে করে দেয় শেষ।

তোমার হাসিমুখ ভুলায়ে সকল দুঃখ
দেয় অনাবিল প্রশান্তি বেহেস্তী সুখ।

আমার আরাম হারাম হয়ে যায়
দেখা না পেলে তোমার—
বেঁচে থাকি মরার মত
বুক ভরা নিয়ে হাহাকার।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বাচ্চারা বিদেশের মাটিতে পড়াশুনা শুরু করলে সেই দেশে তার শিকড় গড়ে উঠে। মা-বাবাদের এটা বুঝা দরকার এবং গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।