তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত মুক্তমনাতেই অনুবাদ করেছেন আন্দালিব। আমি হঠাৎ করেই নবম অধ্যায়টা করে ফেললাম। নামটা দেখে (ব্যাটল অব দ্য সেক্সেজ) ভালো লাগলো কি না :))। পাঠকদের অবগতির জন্যে, কয়েকজন মিলে বইটা শেষ করে বাঙালি পাঠকদের কাছে প্রথম ডকিন্সকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাকিরা আওয়াজ দিন, কোথায় আপনারা? এটা অনেকটা খসড়া, পাঠকদের উপদেশ এবং পরামর্শ কাম্য। আমি অতোটা জ্ঞানী নই, সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছ থেকে আশা করা তাই ভুল হবে। তবে, প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা সবসময়ই স্বাগতম।

নবম অধ্যায় (ব্যাটল অব দ্য সেক্সেজ)

যদি মা-বাবা আর সন্তানেরা, যারা একে অন্যের শতকরা ৫০ ভাগ জিন ভাগাভাগি করে, সেই তারাই স্বার্থের সংঘাতে লিপ্ত হয়, তবে যাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কই নেই, সেই জীবনসঙ্গীদের আন্তর্সংঘাত তীব্রতর কোন পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে? তাদের মাঝখানে একমাত্র মিল বলতে তাদের সন্তানদের শতকরা ৫০ ভাগ জিনের মালিকানা। যেহেতু মা-বাবা দুজনেই একই সন্তানের ভিন্নার্ধের মঙ্গলসাধনে নিয়োজিত, তাই ওই সন্তানদের বেড়ে-ওঠার ব্যাপারে দু’জনে একে অন্যকে সহযোগিতা করলে দু’জনেরই কিছুটা ফায়দা হওয়ার কথা। যদি মা-বাবার একজন প্রতি সন্তানের জন্যে তার মূল্যবান সম্পদের যথাযথ অংশের কিছুটা কম ব্যয় করে, তাহলে তার জন্যে ঘটনা সুখকর, কারণ সেক্ষেত্রে সে তার অন্য যৌনসঙ্গীর মাধ্যমে উৎপাদিত অন্য সন্তানের পেছনে আরো বেশি ব্যয় করতে পারে, এবং এভাবে তার জিন ছড়িয়ে দিতে পারে আরো বেশি পরিমাণে। বলা যেতে পারে সঙ্গী দু’জনই এভাবে একে অন্যকে বেশি করে দুইয়ে নিতে চাইছে, চেষ্টা করছে অন্যের বিনিয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে। একজনের আদর্শ ‘পছন্দ’ হবে (শারীরিকভাবে উপভোগের কথা বলছি না, যদিও সে ওটা চাইতেই পারে) ভিন্ন লিঙ্গের যত বেশিজন সদস্যের সাথে মিলিত হওয়া, পাশাপাশি সে বাচ্চা বড় করার ভার ছেড়ে দিতে চাইবে তার সঙ্গীর ওপর। আমরা এরপরে দেখবো, কিছু প্রজাতির পুরুষ সদস্যেরা এই সুবিধে হাতিয়ে নিয়েছে, কিন্তু, অন্য প্রজাতিগুলোয় সন্তান বড় করে তোলার ভার পুরুষ সদস্যের বইতে হয় উপযুক্ত পরিমাণে। যৌনসম্পর্কের এই দিকটা, যেটা কিনা পারস্পরিক অবিশ্বাস আর পারস্পরিক শোষণের সম্পর্ক, বেশ গভীরভাবে তুলে ধরেছেন বিশেষত ট্রিভার্স। ইথোলজিস্টদের কাছে এটা একটা নতুন ব্যাপার বটে। আমরা সাধারণত যৌন আচরণ, মিলন আর এর পূর্ববর্তী পূর্বরাগের ব্যাপারগুলো কি-না আবশ্যকীয়ভাবে পারস্পরিক সুবিধের জন্যে নেওয়া সম্মিলিত উদ্যোগ হিসেবেই দেখেছি, কিংবা প্রজাতির মঙ্গলের জন্যে!

আসুন প্রথম নীতিটায় ফিরে যাই, আর উঁকি দেই নরত্ব আর নারীত্বের মৌল স্বভাবগুলোয়। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা মৌলিক বিষমতার ওপর জোর না দিয়েই যৌনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। শব্দগুলোর অর্থ অনুসন্ধান না করেই আমরা সাদামাটাভাবে কিছু প্রাণীকে বলেছি পুরুষ, আর কিছু প্রাণীকে বলেছি নারী। কিন্তু, পুরুষত্বের মূলভাবটা কী? নারীকে সংজ্ঞায়িত করার ভিত্তিটাই বা কী? স্তন্যপায়ী হিসেবে আমরা লিঙ্গ সংজ্ঞায়িত করি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের সামগ্রিক লক্ষণের ভিত্তিতে-পুরুষাঙ্গ থাকা, যুবাদের স্বভাবচরিত্র, বিশেষ দুগ্ধগ্রন্থির মাধ্যমে দুগ্ধপান করানো, কিছু ক্রোমোজমসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য এবং এমনি আরো কিছু। ব্যক্তিভেদে লিঙ্গপরিচয় আলাদা করার জন্যে স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এটা বেশ কাজের বটে, কিন্তু, সাধারণভাবে প্রাণী এবং উদ্ভিদের জন্যে এটা মানুষদের ভেতর প্যান্ট পরার অভ্যাস দেখে লিঙ্গপরিচয় চেনার মতো, তেমন কাজে আসে না। ধরা যাক ব্যাঙেদের কথাই। তাদের কোন লিঙ্গেরই কোনো পুরুষাঙ্গ (penis) নেই। তাহলে হয়তো নর এবং নারী শব্দ দুটোরই সাধারণ কোন অর্থ নেই। শেষাশেষি তারা স্রেফ শব্দই, এবং ব্যাঙের বেলায় যেহেতু তারা তেমন কাজে আসে না, ওগুলো বাদ দেওয়ার স্বাধীনতাও আমাদের আছে। চাইলে ব্যাঙেদের লিঙ্গ ১ এবং লিঙ্গ ২-এভাবে ভাগ করতে আমরা পারতাম। তবে, সব প্রাণী আর উদ্ভিদের মধ্যে লিঙ্গসংক্রান্ত একটা মূল বৈশিষ্ট্য আছে যাতে করে পুরুষদের পুরুষ আর নারীদের নারী হিসেবে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। সেটা হলো পুরুষের যৌনকোষ বা ‘গ্যামেট’ আকারে নারীর যৌনকোষ থেকে আকারে অনেক ছোট আর সংখ্যায়ও অনেক বেশি। প্রাণী হোক বা উদ্ভিদ, সবার ক্ষেত্রেই এটা খাটে। একটা দলের সদস্যদের যৌনকোষ আকারে বড়, তাই তাদের নারী বলা সুবিধেজনক। অন্য যে দলটার নাম পুরুষ রাখা সুবিধেজনক, তাদের যৌনকোষ আকারে ছোটমাপের। পার্থক্যটা বিশেষত সরীসৃপ আর পাখির মধ্যে উচ্চকিত যেখানে একটা ডিম্বকোষই এতোটা বড় এবং পুষ্টিকর যে সেটা একটা বর্ধিষ্ণু বাচ্চাকে কয়েক সপ্তাহের মতো খাবার যোগাতে পারে। এমনকি মানব প্রজাতিতেও, যেখানে ডিম্বকোষ রীতিমত আণুবীক্ষণিক, ওটা শুক্রাণু থেকে বহুগুণ বড়। পরে আমরা দেখবো যে, এই একটি মাত্র মূল পার্থক্য থেকে উদ্ভূত অন্য লৈঙ্গিক পার্থক্যগুলোও ব্যাখ্যা করা যায় চমৎকার।

কিছু আদিম প্রাণের ক্ষেত্রে, উদাহরণস্বরূপ কিছু ছত্রাকে, পুরুষত্ব বা নারিত্বের দেখা মেলে না, যদিও একরকমের যৌনপ্রজনন ঘটে। আইসোগ্যামি নামে পরিচিত এই পদ্ধতিতে একক প্রাণীদের নারী বা পুরুষ হিসেবে ভাগ করা যায় না। যেকেউই মিলিত হতে পারে যেকারোর সাথে। এখানে শুক্র আর ডিম্বক নামে দুরকমের ভিন্ন যৌনকোষ নেই, যা আছে সব একইরকমের, এদের নাম আইসোগ্যামেট। দুটো আইসোগ্যামেট, যারা প্রত্যেকে মিয়োটিক বিভাজনে তৈরি, মিলিত হয়ে তৈরি করে নতুন প্রাণ। যদি থাকে তিনটে আইসোগ্যামেট, ক, খ আর গ, তাহলে

ক মিলিত হতে পারে খ আর গ-এর সাথে

খ মিলিত হতে পারে ক আর গ-এর সাথে।

সাধারণ যৌনপদ্ধতিতে এই ঘটনা কখনোই ঘটবে না। যদি ক হয় শুক্র এবং খ বা গ-এর সাথে এটা মিলিত হতে পারে, তাহলে খ আর গ অবশ্যই ডিম্বক হবে এবং খ কখনোই গ-এর সাথে মিলিত হতে পারবে না।

দুটো আইসোগ্যামেট যখন মিলিত হয়, নতুন প্রাণের ক্ষেত্রে তখন দুটোই সমান সংখ্যক জিন সরবরাহ করে, এবং সরবরাহ করে একই পরিমাণের খাদ্যও। শুক্র আর ডিম্বকও একই সংখ্যক জিনের যোগান দেয় বটে, কিন্তু খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে ডিম্বকের কার্যকারিতা শুক্রের কয়েকগুণ বেশি। বলতে কি, শুক্রাণুগুলো প্রায়শই খাবার যোগান দেয় না এবং এদের আসল কাজ হচ্ছে যতদ্রুতগতিতে সম্ভব ডিম্বকের কাছে জিন পৌঁছে দেওয়া। প্রারম্ভমুহূর্তে তাই সন্তানে পিতার বিনিয়োগ তার যথাযথ অংশের চাইতে (অর্থাৎ, শতকরা ৫০ ভাগ) কমই হয়। যেহেতু, প্রতিটি শুক্রাণুই অত্যন্ত ক্ষুদ্র, তাই একজন পুরুষ এগুলো দিনে কয়েক লক্ষ করে উৎপাদন করতে পারে। এর মানে হচ্ছে বিভিন্ন নারীর সাথে মিলিত হয়ে খুব কম সময়ে প্রচুর পরিমাণ সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা তার আছে। এটা সম্ভব হওয়ার একমাত্র কারণ হলো প্রতিটা ক্ষেত্রেই নতুন ভ্রূণটা তার মায়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত খাবার পায়। এতে করে হয় কি নারীর সন্তানধারণের ওপর সীমাবদ্ধতা থাকে, কিন্তু পুরুষের সন্তানপ্রজনন ক্ষমতা হয় বাস্তবিকভাবে অসীম। এখানেই শুরু নারীদের শোষণের।

পার্কার এবং অন্যেরা দেখিয়েছেন কিভাবে এই বিষমতা আদি আইসোগ্যামেট অবস্থা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। যখন সব যৌনকোষই ছিলো আন্তঃপরিবর্তনশীল এবং প্রায় একই মাপের, সেসব দিনেও হয়তো এমন কিছু কোষের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, যারা অন্যদের চাইতে কিছুটা বড় মাপের। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গড়পড়তা কোষের চাইতে বড়সড় আইসোগ্যামেট সুবিধে পাবে, কারণ তার থেকে উদ্ভূত ভ্রূণটা প্রাথমিকভাবে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ পাওয়ার কারণে যাত্রা হবে শুভ। এমনি করেই হয়তো বিবর্তনের ধারায় আবির্ভাব ঘটেছে বড় যৌনকোষের। কিন্তু এখানে ঘটনা একটু প্যাঁচ খায়। নিতান্তই না-হলে-নয় এমন আকারের চাইতে বড় আকারের আইসোগ্যামেটের উদ্ভব স্বার্থপর শোষণের দরজা খুলে দেয়। যারা গড়ের চাইতে ছোট মাপের গ্যামেট উৎপাদন করবে তারা লাভবান হবে, তবে শর্ত হচ্ছে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের খুদে গ্যামেটগুলো অতিরিক্ত বড়গুলোর সাথে জুড়ে যেতে পারছে। এটা তখনই সম্ভব যখন ছোটগুলো বেশি গতিশীলতা অর্জন করবে, আর চটপট খুঁজে নিতে পারবে বড়গুলোকে। কেউ যদি খুদে, চটপটে গ্যামেট উৎপাদন করতে পারে তাহলে তার সুবিধে হচ্ছে সে অনেক গ্যামেট তৈরি করতে পারবে, আর তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাও বেড়ে যাবে বহুগুণ। প্রাকৃতিক নির্বাচন সেসব যৌনকোষের উৎপাদনে সমর্থন যোগাবে যারা আকারে ছোট এবং যারা দ্রুতগতিতে বড়গুলোর সাথে মিলিত হতে পারে। তাই ভাবা যায় যে, এভাবে দুটো ভিন্নধারার লৈঙ্গিক ‘কৌশল’ তৈরি হলো। একটা হলো বৃহৎ-বিনিয়োগ বা ‘সৎ’ কৌশল। এটা সাথেসাথেই একটা স্বল্প বিনিয়োগ শোষণমূলক কৌশলের জন্ম দিলো। দুটোর ভেতর একবার ভিন্নতা দেখা দিলে দুটো হয়তো দুদিকে ছুট দিতে পারতো। মাঝামাঝি মাপের যৌনকোষগুলো হয়তো শাস্তির মুখোমুখি হতে পারতো, কারণ দুটো চরমপন্থার কোনোটার সুবিধেই তারা উপভোগ করতে পারতো না। সুবিধেভোগীগুলো হয়তো মাপে ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে পড়লো, এবং আরো গতিশীল। সৎগুলো হয়তো হয়ে পড়লো আরো বড়, যাতে করে শোষকদলের ক্রমশ কমে-আসা বিনিয়োগের ক্ষতিপূরণ ঘটে, পাশাপাশি তারা নিশ্চল হয়ে পড়ে কারণ শোষকগোষ্ঠী যেনতেনপ্রকারেণ তাদের খুঁজে বের করেই ছাড়বে। প্রতিটা সৎ যৌনকোষই অন্য আরেকটা সৎ যৌনকোষের সাথে মিলিত হতে ‌‌’চাইবে’। কিন্তু শোষকদল আটকানোর নির্বাচনী চাপের চাইতে হয়তো শোষকদলের বাধা ডিঙানোর ক্ষমতা বেশি ছিলো: সুবিধেভোগীদের তাই হারানোর ছিলো বেশি, এবং তাই তারা জিতে নিলো বিবর্তনীয় লড়াই। সৎগুলো হয়ে গেলো ডিম্বক আর সুবিধেভোগী শোষকেরা হয়ে গেলো শুক্র।

তা দেখা যাচ্ছে যে, পুরুষেরা নিতান্তই অকর্মণ্য বটে, আর স্রেফ ‘প্রজাতির মঙ্গল’ যুক্তিতে এলে আশা করা যায় যে, পুরুষেরা নারীদের চাইতে সংখ্যায় কম হবে। যেহেতু একজন পুরুষ তাত্ত্বিকভাবে ১০০ জন নারীর একটা হেরেমের জন্যে শুক্রাণু সরবরাহ করতে পারে তাই ধরে নেওয়া যায় যে প্রাণীদের জনসংখ্যায় নারী ও পুরুষের অনুপাত হতে পারে ১০০-য় ১। ব্যাপারটা এভাবেও বলা যায় যে, প্রজাতির জন্যে পুরুষেরা বেশি ‘মূল্যহীন’ আর নারীরা বেশি ‘মূল্যবান’। সামগ্রিকভাবে কোন প্রজাতির দিকে তাকালে ব্যাপারটার শতভাগ সঠিকতা বোঝা যায়। হাতি সিলদের ওপর চালানো একটা পরীক্ষা থেকে একটা চরম উদাহরণ নেওয়া যায়। শতকরা ৮৮ ভাগ মিলনে জড়িত ছিলো মাত্র শতকরা ৪ ভাগ পুরুষ। এই ক্ষেত্রে, এবং অন্য অনেকগুলোতেই, অনেক পুরুষ হয়তো জীবনে চিরকৌমার্য বরণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই বাড়তি পুরুষেরা অন্যদিকে স্বাভাবিক জীবনই যাপন করে, এবং প্রজাতির অন্য প্রাপ্তবয়স্কদের চাইতে কম খাবার তারা সাবাড় করে না। ‘প্রজাতির মঙ্গল’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ভয়ংকররকমের খরুচে বটে; বাড়তি পুরুষগুলোকে সামাজিক পরজীবী হিসেবেই ধরা যেতে পারে। দলগত নির্বাচন তত্ত্বের একটা বড় সমস্যার উদাহরণ এটা। অন্যদিকে প্রকৃতার্থে উৎপাদনকারী পুরুষের সংখ্যা কম হওয়ার পরও নারীপুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে স্বার্থপর জিন তত্ত্বের কোন সমস্যাই হয় না। ব্যাখ্যাটা প্রথমে দেন আর. এ. ফিশার।

সন্তানপালন কৌশলের একটা বিশেষ সমস্যা হচ্ছে কী পরিমাণ পুরুষ আর কী পরিমাণ নারী জন্ম নেবে তার সমস্যা। যেকোন একজন জিনরক্ষাকামী অভিভাবক কিভাবে তার সবচাইতে সেরা পরিবারের আকার পেতে পারে তা এখন আমরা যেভাবে আলোচনা করলাম, তেমনিভাবে আমরা লিঙ্গের সেরা অনুপাত নিয়েও আলাপ করতে পারি। আপনার মূল্যবান জিনের সুরক্ষার জন্যে কার ওপর ভরসা করবেন-আপনার ছেলে না মেয়ে? ধরা যাক, একজন মা তাঁর সব সম্পদ ছেলেতেই বিনিয়োগ করলেন, আর তাই মেয়েদের জন্যে বিনিয়োগ করার মতো তাঁর কিছু নেই: এক্ষেত্রে কি মেয়েতে সম্পূর্ণ বিনিয়োগ করেছে এমন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী মায়ের চাইতে তিনি ভবিষ্যৎ জিনপুলে বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবেন? ছেলেসন্তাননির্বাচক জিনের চাইতে কি মেয়েসন্তানপসন্দ জিনের সংখ্যা কমবে বা বাড়বে? ফিশার দেখিয়েছিলেন যে, সাধারণ পরিস্থিতিতে স্থায়ী লিঙ্গানুপাত হচ্ছে ৫০: ৫০। কারণ জানতে চাইলে প্রথমে লিঙ্গনির্ধারণের কৌশলটা কিছুটা জানা চাই।

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে নিম্নোক্ত কৌশলে জিনগতভাবে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। প্রতিটি ডিম্বকই পুরুষ বা নারীতে পরিণত হতে সক্ষম। লিঙ্গনির্ধারণী ক্রোমোজোমের বাহক হচ্ছে শুক্র। একজন পুরুষ যেসব শুক্রাণু উৎপাদন করে তার আদ্ধেকটা নারী-উৎপাদী, অর্থাৎ এক্স-শুক্রাণু, আর বাকি আদ্ধেক পুং-প্রজননী, তথা ওয়াই-শুক্রাণু। দুজাতের শুক্রাণুই দেখতে হুবহু একই। তফাৎ হয় স্রেফ একটি ক্রোমোজমের সাপেক্ষে। পিতা তৈরির একটা জিনে তেমন কিছুই নেই কিন্তু কন্যারা ওকে দিয়ে শুধু এক্স-শুক্রাণু তৈরি করিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধন করে নিতে পারে। মাতা প্রজননের একটা জিনেও তেমন কিছুই থাকে না, কিন্তু কন্যারা তাকে দিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট শুক্রাণুঘাতক তৈরি করিয়ে নিতে পারে, বা তাকে দিয়ে পুরুষ ভ্রূণের গর্ভপাত ঘটিয়ে নিতে পারে। আমরা আসলে যেটা চাই, সেটা একটা বিবর্তনানুগ স্থায়ী কৌশলজাতীয় [evolutionarily stable strategy (ESS)] কিছু, যদিও এখানে, আগ্রাসনের অধ্যায়ের চাইতেও বেশি করে, কৌশল কথাটা স্রেফ একটা বাগভঙ্গি মাত্র। আক্ষরিকভাবে কেউ একজন তার সন্তানের লিঙ্গনির্ধারণ করতে পারে না। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন একটি লিঙ্গের বা অন্য লিঙ্গের সম্ভাব্য শিশুজন্মপ্রদায়ক জিন উৎপাদন অসম্ভব নয়। যদি ধরে নেই যে অসম লিঙ্গানুপাত পক্ষপাতী এজাতীয় জিন আছে, তাহলে কি তারা জিন পুলে তাদের বিপক্ষ এলিল, যারা সম লিঙ্গানুপাতের দিকে ঝোঁকে, তাদের চাইতে সংখ্যায় বেশি হতে পারে?

ধরে নেওয়া যাক, ওপরে যে হাতি সিলের কথা বলা হয়েছে, তাদের ভেতর একটা মিউট্যান্ট জিন জন্ম নিলো যেটা মা-বাবাদের বেশি করে মেয়ে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। যেহেতু জনগোষ্ঠীতে পুরুষের অভাব নেই, মেয়েদের সঙ্গী পেতে বিশেষ সমস্যা হবে না, আর কন্যাজন্মদায়ী জিনটিও বেশ ছড়িয়ে পড়তে পারবে। জনগোষ্ঠীতে লিঙ্গানুপাত তখন হয়তো বাড়তি নারীর দিকে ঝুঁকে পড়বে। প্রজাতির কল্যাণের দিক থেকে ব্যাপারটা ঠিকই আছে, কারণ এর আগেই আমরা দেখেছি স্রেফ অল্প ক’টা পুরুষের পক্ষে বিশাল বাড়তি নারীদের জন্যে দরকারি শুক্রাণুর যোগান দিয়ে যাওয়া সম্ভব। মোটাদাগে তাই আমরা আশা করতে পারি কন্যা-উৎপাদী জিন ততক্ষণ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে যাবে যতক্ষণ না বাকি সেবাপ্রদানকারী পুরুষেরা কাজ চালানোর শেষ সীমায় পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু এখন খেয়াল করুন যাদের পুত্রসন্তান আছে এমন অল্প ক’জন মা-বাবা কী দারুণ সুবিধে পাচ্ছে। পুত্রসন্তানে বিনিয়োগ করেছে এমন যেকারোরই শতশত সিলের পূর্বসূরী হওয়ার সুযোগ হচ্ছে। যারা স্রেফ কন্যার জন্মদান করেছে তারা নিশ্চিতভাবে কিছু উত্তরসূরী পাচ্ছে, কিন্তু পুত্রসন্তানে বিনিয়োগকারীদের সামনে যেসব গৌরবময় জিনগত সম্ভাবনা আছে, তার তুলনায় সেতো কিছুই না। তাতে করে পুত্রসন্তান-প্রজননী জিনের সংখ্যা বাড়বে প্রভূত পরিমাণে, আর দোলক আবার দুলবে অন্যদিকে।

সরলতার জন্যে আমি দোলকের দোলনের কথা বললাম। বাস্তবে দোলক নারীপ্রাধান্যের দিকে অত দূরে যাবেই না, কারণ লিঙ্গানুপাত অসম হওয়ার সাথে সাথেই পুত্রকামনার চাপ দোলকটা অন্যদিকে ঠেলে দেবে। সমসংখ্যক পুত্র এবং কন্যাসন্তান উৎপাদনের কৌশল একটা বিবর্তনানুগ স্থায়ী কৌশল, এ-অর্থে যে এথেকে যে-জিন অন্যদিকে হেলবে, তার নিটফল হবে ক্ষতি।

গল্পটা বলেছি ছেলেসন্তান বনাম মেয়েসন্তানের সংখ্যার ভাষায়। ব্যাপারটা সরল করতে চেয়েছি। কিন্তু এটা আসলে সরাসরিভাবে বোঝাতে হবে অভিভাবকীয় বিনিয়োগের (parental investment) ভাষায়, মানে একজন অভিভাবক খাবার আর অন্য সব সম্পদ কতটুকু খরচ করতে পারে। হিসেবটা করে দেখানো হয়েছে আগের অধ্যায়েই। অভিভাবকদের পুত্র এবং কন্যাসন্তানে সমানভাবে বিনিয়োগ করা উচিত। সাধারণত এর মানে হচ্ছে যে যতটা তাদের ছেলে থাকবে, ততটাই থাকবে মেয়ে। হাতি সিলের বেলায় এমন একটা নীতি যদি নেওয়া হয় যার আওতায় ছেলেদের তিনগুণ মেয়ে জন্ম দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু প্রতিটা ছেলের পেছনে তিনগুণ করে খাবার আর অন্য বিনিয়োগের কারণে সেগুলো হয়ে উঠছে একটা অতিপুরুষ, তাহলে ওটা খাটে। পুত্রসন্তানের পেছনে খাবার আর অন্যান্য বিনিয়োগ করে আর তাদের বিশাল আর শক্তিশালী করে গড়ে তুলে একজন অভিভাবক সে-পুত্ররত্নটির নিজস্ব একটা হেরেমখানা জেতার মহান পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এটা একটা বিশেষ ঘটনা। সাধারণত প্রতিটা পুত্রসন্তানের পেছনে বিনিয়োগের পরিমাণ মোটামুটি একটা কন্যাসন্তানের পেছনে-করা বিনিয়োগের সমান, আর সংখ্যার দিক থেকে লিঙ্গানুপাত হয় এক অনুপাত এক।

তাহলে বংশধারার নিম্নাভিমুখী দীর্ঘ যাত্রায় একটা গড়পড়তা জিন প্রায় অর্ধেকটা সময় বসে কাটাবে কোন পুরুষদেহে, আর বাকি অর্ধেক বসে কাটাবে কোন নারীশরীরে। কিছু জিন-ইফেক্ট শুধু একটা দেহেই চোখে পড়ে। এদের বলা হয় লিঙ্গ-সীমায়িত জিন-ইফেক্ট। পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্য নির্ধারক জিন শুধু পুরুষশরীরেই কাজ করবে, কিন্তু ওটা নারীদেহেও থাকবে এবং ওখানে দেখাবে হয়তো একেবারে অন্যকোন বৈশিষ্ট্য। মায়ের কাছ থেকে ছেলের দীর্ঘপুরুষাঙ্গের বৈশিষ্ট্য না পাওয়ার পক্ষে কোন যুক্তিই নেই।

দুধরনের শরীরে যেখানেই পাওয়া যাক না কেন, আমরা ধরে নিতে পারি যে সেখানেই জিনটা পাওয়া সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করবে। শরীরটা নারীর না পুরুষের তার ওপর ভিত্তি করে এই সুযোগগুলো পুরোই আলাদা হতে পারে। হিসেবের সুবিধের জন্যে আমরা আবারো ধরে নিতে পারি যে প্রতিটা ভিন্ন শরীরই একটা স্বার্থপর যন্ত্র, যেটা এতে অন্তর্গত সব জিনের জন্যে সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এধরনের স্বার্থপর যন্ত্র পুরুষ হলে এর সেরা নীতিটা হবে একরকম, আর নারী হলে হবে বেশ অন্যরকমের। ব্যাপারটা সংক্ষেপ করতে আমরা আবারো ধরে নেবো যেন এরকম একজনের একটা সচেতন উদ্দেশ্য আছে। আগের মতোই মনের গহিনে ধরে নেবো যে এটা স্রেফ কথার কথা। শরীর আসলেই এর স্বার্থপর জিনেদের অন্ধভাবে প্রোগ্রাম-করা একটা যন্ত্র।

এই অধ্যায়ের শুরুতে যে-যৌনমিলনক্ষম জোড়ার কথা বলেছি আবারো তাদের কাছে ফিরে আসা যাক। দুজন সঙ্গীই, স্বার্থপর যন্ত্র হিসেবে, চাইবে সমসংখ্যক ছেলে আর মেয়ে। এটুকু পর্যন্তই তাদের মিল। গরমিলটা সেখানেই যেখানে দুজনেই সন্তান লালনের ব্যয়ভার একে অন্যের ঘাড়ে চাইছে চাপিয়ে দিতে। প্রতিটা একক প্রাণীই চায় যথাসম্ভব বেশি জীবিত সন্তান। কোনো সন্তানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ যতই কম হবে, ততই তার সন্তানসম্ভাবনা যাবে বেড়ে। এই কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় পৌঁছানোর সুস্পষ্ট রাস্তা হচ্ছে আপনার যৌনসঙ্গীকে প্রতিটি সন্তানে তার উপযুক্ত ভাগের চাইতে বেশি বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করা, যাতে করে আপনি অন্য সঙ্গীর সাথে মিলিত হয়ে সন্তান জন্ম দিতে পারেন। উভয় লিঙ্গের জন্যেই এটা একটা কাঙ্ক্ষিত কৌশল বটে, কিন্তু নারীদের জন্যে এটা অর্জন করা বেশি কষ্টকর। যেহেতু শুরুতেই সে তার বিশাল, খাদ্যসমৃদ্ধ ডিম্বকের আকারে পুরুষের চাইতে বেশি বিনিয়োগ করে ফেলে, তাই জন্মমূহূর্ত থেকেই মা সন্তানের প্রতি বাবার চাইতে অনেক বেশি ‘দায়বদ্ধ’। সন্তান মারা গেলে বাবার চাইতে মায়ের ক্ষতি সইতে হয় বেশি। আরো ঘটনা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিকল্প একটা সন্তান বৃদ্ধির একই পর্যায়ে নিয়ে আসতে গেলে তাকে বাবার চাইতে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। যদি সে বাবার কাছে সন্তানটা ফেলে দিয়ে অন্য পুরুষ সঙ্গীর সাথে চলে যায়, বাবাটাও হয়তো তখন নিজের অল্প ক্ষতি করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে ঐ বাচ্চাকে ফেলে চলে গেলো। তাই অন্তত শিশুবৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে, সন্তান পরিত্যাগের ব্যাপারটা হয় প্রধানত পিতার হাতেই, অন্য ঘটনাটা ঘটে খুবই কম। তেমনিভাবে শুধু শুরুতে নয়, বৃদ্ধির সামগ্রিক পর্যায়েই নারীরা পুরুষদের চাইতে বেশি বিনিয়োগ করবে বলে ধরে নেওয়া স্বাভাবিক। স্তন্যপায়ীদের উদাহরণ নিয়ে দেখা যাক, নারীরাই শরীরে ধারণ করে ভ্রূণ, নারীরাই নবজাতককে পান করায় স্তন, নারীরাই তাকে লালনের ও প্রতিরক্ষার বোঝা বহন করে। শোষিত হয় নারীলিঙ্গটি, আর এই শোষণের মূলগত বিবর্তনীয় কারণ হচ্ছে এই তথ্য যে ডিম্বকের আকার শুক্রাণুর চাইতে বড় হয়।

অনেক প্রজাতির ক্ষেত্রেই বাবা নিঃসন্দেহে প্রচুর কষ্ট করে বিশ্বস্তভাবে সন্তান লালন-পালনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু তারপরও আমরা অবশ্যই ধরে নেবো যে পুরুষদের ওপর সাধারণত সন্তানপ্রতি বিনিয়োগের বিবর্তনীয় চাপ কম এবং তারা নানান স্ত্রীর মাধ্যমে একাধিক সন্তান লাভ করতে চায়। আমি এটা বলে সাদামাটাভাবে এটাই বোঝাচ্ছি যে জিনপুলে সফল হওয়ার জন্যে জিনগুলোর এই কথাটা বলার প্রবণতা আছে, “হে শরীর, যদি তুমি পুরুষ হও, তাহলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এলিল যখন তোমায় তোমার সঙ্গীকে ত্যাগ করতে বলবে, তার আগেই তাকে ত্যাগ করো এবং আরেকজন নারী খুঁজে নাও।”এই বিবর্তনীয় চাপ বাস্তবে কতদূর কাজ করবে সেটার পরিমাণ প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে অনেকটাই পৃথক হয়। অনেকগুলোতেই, যেমন বার্ড অব প্যারাডাইসের ক্ষেত্রে, নারীটি পুরুষের কাছ থেকে অণুমাত্র সাহায্য পায় না, এবং সন্তানপালন করে একাই। কিটিওয়েকের মতো অন্য কিছু প্রজাতি অনুকরণীয় বিশ্বস্ততার সাথে একগামী বন্ধন তৈরি করে, এবং সন্তানলালনের ক্ষেত্রে দুটো সঙ্গীই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। এখানে ধরে নিতে পারি কোন বিবর্তনীয় বিপ্রতীপ চাপ কাজ করছে: স্বার্থপর সঙ্গীশোষণের কৌশলে নির্ঘাৎ একটা ক্ষতি এবং একটা লাভ আছে, আর কিটিওয়েকের ক্ষেত্রে ক্ষতিটা লাভের চাইতে বেশি। যদি স্ত্রীটির নিজে নিজে বাচ্চা বড় করার সমূহ সম্ভাবনা থাকে তাহলে যেকোন সময়ই এটা বৌ-বাচ্চা পরিত্যাগের ক্ষেত্রে স্রেফ বাবার লাভ ঘটাবে।

[অসমাপ্ত]