লিখেছেনঃ আশরাফুন নাহার

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র মিয়ানমার পরিচিত ছিল ‘বার্মা’ নামে। ১৯৮৯ সালে দেশটির সামরিক সরকার ‘বার্মার নতুন নামকরণ করে ‘মিয়ানমার’। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র মিয়ানমার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এত ঐশ্বর্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী। বর্তমানে দেশটিতে সামরিক শাসন চালু রয়েছে। মিয়ানমারে স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর চলছে কিন্তু দেশটির গণতন্ত্রের গন্তব্য কি? সেটা জানতে হলে এর পূর্বের ইতিহাস জানা জরুরি।

মিয়ানমারের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো হলেও কয়েকশত বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেশটির শাসনব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব। প্রথম দিকে মিয়ানমারের রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু থাকলেও ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশদের বার্মা দখলের মধ্য দিয়ে এই শাসনব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৮২৪-১৮২৬ সালের প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে আংশিক বার্মা, ১৮৫২ সালের দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ১৮৮৫ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বার্মা বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে চলে যায়। ব্রিটিশরা তাদের Divide and Rule নীতি চালু করে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশ দশকের দিকে বার্মার সুশীল সমাজ এবং বৌদ্ধভিক্ষুরা প্রথম আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩৫ সালের দিকে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে অং সান এই আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৩৮ সালের দিকে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে বার্মার অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতান্ত্রিক নীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরই মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর ২৯ জন সহচর নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে জাপানে যান। তাদের দলটি ‘থার্টি কমরেডস’ নামে পরিচিত ছিল। এরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু অং সান বুঝতে পেরেছিলেন যে, জাপানিরা কখনই বার্মার স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করতে পারবে না। তাই তিনি ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করেন বার্মার পূর্ণ স্বাধীনতা জন্য। কিন্তু ১৯৪৭ সালে অং সান আততায়ীর হাতে নিহত হন। সে বছরই অক্টোবর মাসে বার্মার স্বাধীনতার জন্য উ নু-এর সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যা ‘নু-অ্যাটলি চুক্তি’ নামে অভিহিত হয়। এরপর গণতান্ত্রিক চেতনার মূল্যবোধ নিয়ে ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মিয়ানমার। তারপরও ৭ দশকের বেশি সময় ধরে দেশটিতে একনায়কতন্ত্র এবং সামরিক শাসন অব্যাহত রয়েছে।

১৯৬২ সালে রেভুল্যুশনারি কাউন্সিলের (Revolutionary Council) ‘সমাজতন্ত্রের পথে বার্মা’ (Burmese way to Socialism) ঘোষণার মধ্য দিয়ে নে উইন ‘বার্মিজ সোসালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি)’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এর মূল নীতি ছিল ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত রাখা। ১৯৬৪ সালে রেভুল্যুশনারি কাউন্সিল একটি আইন জারি করে বিএসপিপি ছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং তাদের অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সালের সংবিধানের ধারা ১১-তে বলা হয় যে “রাষ্ট্র একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে এবং বার্মিজ সোসালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।” এরপর ১৯৮৮ সালে গণঅভ্যুত্থান হয় এবং হাজার হাজার গণতন্ত্র প্রিয় সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীর দ্বারা গণহত্যার শিকার হয়। তখন নে উইনকে হটিয়ে সামরিক জান্তা ‘স্টেট ল এ্যান্ড অর্ডার রেস্ট্রোরেশন (State Law and Order Restoration Council বা সংক্ষেপে SLORC) গঠন করে ক্ষমতা দখল করে এবং বিএসপিপিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ১৯৮৯ সালে প্রথম দিকে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনের ৪/৮৮ ধারা অনুসারে SLORC- এর পৃষ্ঠপোষকতায় তারা National Unity Party গঠন করে এবং অন্যদিকে ১৯৮৮ সালে অং সান সু চি-র National League For Democracy বা সংক্ষেপে NLD প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে SLORC নির্বাচনী দলগুলির প্রচারাভিযান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সভা সমাবেশের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তারপরও ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সু চি’র দল NLD জয়লাভ করে। তখন জান্তা সরকার নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে নতুন খেলা শুরু করে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত SLORC ক্ষমতায় ছিল। এরপর ১৯৯৩ সালে জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য। যেখানেÑ খোলামেলা আলোচনা হবে। কিন্তু সেই কনভেনশনে ৭০২ জন প্রতিনিধির মধ্যে এনএলডি’র মাত্র ৮৮ জন সংসদ সদস্য ছিল। অধিকাংশই ছিল জান্তা সরকারের বাছাই করা। এরপর ১৯৯৫ সালে এনএলডি কনভেনশন বর্জন করলে দীর্ঘদিন আর কনভেনশন আয়োজন করা হয়নি। ১৯৯৭ সালে SLORC বিলুপ্ত হয়ে নতুন নাম গ্রহণ করে The State Peace and Development Council। এরপর ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আবারও জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করা হয়। কিন্তু এর প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং জান্তা সরকারের পক্ষে।

তাই গণতন্ত্রের সুবাতাস কখনো মিয়ানমারে পৌঁছাতে পারেনি। ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের রোডম্যাপ নামে একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এবং খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সামরিক সরকারের অনুমোদিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। সামরিক সমর্থিত ‘সামরিক সংহতি ও উন্নয়ন’ দলটি বিজয়ী হয়। যদিও সে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। সেসময় অং সান সু চি’র গৃহবন্দিত্বের অবসান ঘটে এবং ২০১১ সালে অপ্রত্যাশিত সংস্কারের ফলে তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’র জ্যেষ্ঠ নেতারা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনকরণ এবং উপনির্বাচনে প্রার্থী দেবার সক্ষমতা অর্জন করে। পরিশেষে ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এনএলডি’র নেত্রী অং সান সু চি নির্বাচিত হন। কিন্তু সেখানেও সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন নি। ক্ষমতা মূলত সেনাপ্রধানের হাতেই থাকে। তবুও প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রের স্বাদ পায় দেশটির জনগণ। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মিয়ানমারে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। তখন অং সান সু চি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতেই এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি’কে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। জারি করে জরুরি অবস্থা। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেই জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জান্তা সরকার আবারও তাদের পুরনো কৌশল অবলম্বন করছে। যদিও দেশটির সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজন এবং নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার কথা। কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং এবং জান্তা প্রশাসন, নির্বাচনে যাতে কোন দল অংশগ্রহণই করতে না পারে সেজন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ সালে দেশটির সামরিক জান্তা প্রশাসন নতুন নির্বাচনী আইন জারি করেছে। এ আইন অনুযায়ী, দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোকে ৬০ দিনের মধ্যে জান্তা সমর্থিত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন করতে হবে। আর নিবন্ধনের ৯০ দিনের মধ্যে দলগুলোকে অবশ্যই অন্তত ১ লাখ সদস্য সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। একইসাথে ১৮০ দিনের মধ্যে মিয়ানমারের অন্তত অর্ধেক শহরে দলীয় কার্যালয় খুলতে হবে। কোনো দল এতে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও মিয়ানমারে নির্বাচন নির্বাচন খেলা চলছে কিন্তু গণতন্ত্রের দেখা মিলছে না।

কারণ ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সাথে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলছে। একইসাথে ভিন্নমতের মানুষের ওপর সামরিক জান্তা ব্যাপক দমন-পীড়ন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাই সামরিক জান্তার অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা হলে, তা হবে আবারও একটি ‘ধোঁকাবাজি’ নির্বাচন। যদিও মিয়ানমারের বড় মিত্র ও অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত রাশিয়া এ নির্বাচনকে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছে। রাশিয়া এবং চীন সব-সময়ই জান্তা সরকারের পক্ষে এবং তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। এমনকি বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলিও নিজেদের স্বার্থে কৌশলগত কারণেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পক্ষে। তাদের কেউ কেউ পরোক্ষভাবে, কেউ আবার প্রত্যক্ষভাবে জান্তা সরকারকে সাহায্য করে যাচ্ছে।

পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশ কোন পদ্ধতিতে শাসিত হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে অন্তত দুটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়, ক. শুরু থেকেই দেশটিতে সামরিক শক্তির বিরাট প্রভাব রয়েছে। খ. দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ বা সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠীর সংঘাত। যেখানে প্রায় ৫০টির বেশি বিদ্রোহীগোষ্ঠী নিয়মিত লড়াই করে চলেছে। দেশটিতে সামরিক শক্তির প্রভাবের অন্যতম কারণ হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই স্বাধীনতা নিয়ে আসে। কাজেই সাধারণ জনগণের চোখে তাদের জন্য আলাদা সম্মান ছিল স্বাধীনতার শুরু থেকেই। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক জান্তারা বিভিন্ন সময়ে অভিযানের নামে যে দমন-পীড়ন চালায় তাতে সাধারণ জনগণের চোখে সামরিক বাহিনীর অবস্থানটা নির্যাতিত স্বৈরশাসনের পর্যায়ে চলে আসে। আর সামরিক জান্তার সাথে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠীর পাল্টাপাল্টি অবস্থান মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণরূপে নাজুক করে তুলেছে। দেশটিতে সামরিক শাসন এবং গৃহযুদ্ধ একে-অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।

যদিও মিয়ানমারের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু দেশটি এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের সন্ধান পায়নি। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের স্বপ্ন কবে বাস্তবায়িত হবে তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারে। বর্তমানে মিয়ানমারের জনগণ নির্বাচনের দাবিতে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করেছে। জনগণ যেহেতু একবার মাঠে নেমেছে তাদের প্রতিহত করতে পারে এমন শক্তি নেই বা অতীতের ইতিহাসেও দেখা যায়নি। তাই প্রত্যাশা, মিয়ানমারের এই ধোঁকাবাজি নির্বাচন নির্বাচন নাটক বন্ধ হবে এবং গণতন্ত্রের সোনার হরিণ মিয়ানমারের জনগণের কাছে অচিরেই ধরা দেবে।

* লেখক-আশরাফুন নাহার- পিএইচডি ফেলো, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।