“গত ১২/১/৮৯ ইং তারিখে মাননীয়া ফার্ষ্টলেডীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় নারী নির্যাতন বিরোধী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সরকার নিম্নবর্ণিতভাবে জেলা নারী নির্যাতন নিরোধ কমিটি গঠন করিলেন।”
২১মার্চ ১৯৮৯ সালে সকমবিম/মবি-৩ (কমিটি) ৭৫/৮৯-১২৪/(৬৪) স্মারক নম্বরে সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জেলা প্রশাসকদের একটি চিঠি দিয়েছিলেন জেলা নারী নির্যাতন নিরোধ কমিটি গঠনের জন্য। উপরের লাইনটি দিয়েই চিঠিটি শুরু হয়েছিল।

কি প্রহসনমূলক দৃষ্টান্ত!

তখনকার ফার্ষ্টলেডী যে রওশন এরশাদ ছিলেন তা ১৯৮৯ সাল দেখে সহজেই বুঝা যায়। আর যারা পত্রিকা পড়েন, ইতিহাস জানেন তারা তখনকার সময়েই এরশাদের মরিয়মকে বিয়ে করাসহ একাধিক নারী সঙ্গ পিয়াসী চরিত্রের অনেক কাহিনীর খবর জানেন। কাজেই জাতীয় নারী নির্যাতন বিরোধী উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ফার্ষ্টলেডীই স্বামীর একাধিক বিয়েসহ অনেক অপকর্মের শিকার। বাবুলের আর ফোরকানের স্ত্রী তো কোন ছাড়! (বাবুলের আর ফোরকানের স্ত্রী র ঘটনা একটু পরেই বলা হয়েছে) আর এখানেই বুঝা যায় বাবুলের বা ফোরকানের স্ত্রী আর এরশাদের স্ত্রীর আর্থিক অবস্থায় পার্থক্য থাকলেও তাদের সামাজিক ও আইনগত অবস্থান অভিন্ন। আর নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ এমনই চোখ ধোয়ানো — মাথা গুলানো বিষয়। স্বামী স্বামীর মতই ভোগে আর উপভোগে মত্ত।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে, নারীর প্রতি সুবিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট এবং ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খান পারবারিক আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদকে পারিবারিক আইনে সালিশি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ে ও তালাক প্রক্রিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একজন বিচারক। এ পদের মাধ্যমেই নারীরা আদালতে না গিয়ে নিজ এলাকায় বসে সুবিচার পাবার আশা রাখে। ভরসা রাখে। অনেক উন্নয়নকর্মী, গবেষক, নারীনেত্রী, সুশীল সমাজ টক শোতে, সেমিনারে, ঘরোয়া কথোপকথনে, প্রতিবেদনে, পত্রিকার কলামে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইউনিয়ন পরিষদকে ব্যবহারের সুপারিশ করেন। তাদেরকে অনুরোধ করেন তার এলাকায় জন সচেতনতা সৃষ্টি করতে। ১৯৮৩ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ)অধ্যাদেশ- এর ৩৮ ধারা অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদে ১৩টি স্ট্যান্ডিং কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল নারী ও শিশু কল্যাণ বিষয়ক এবং এর অন্যান্য কাজের মধ্যে একটি কাজ হল ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের ব্যাপারে জনগণকে নিয়ে কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন করা।

যারা গ্রাম পর্যন্ত খবর রাখি, দৈনিক পত্রিকার পাতায় গ্রামের খবর পড়ি তারা জানি কি হচ্ছে।

সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে শতকরা কতজন চেয়ারম্যান মেম্বার পাওয়া যাবে যারা নিজেরা এ বিষয়ে সচেতন? কয়জন নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে প্রচলিত আইনকে মেনে বিচার করে? নারীর প্রতি নির্যাতন জেনে, শুনে বুঝে কমাতে চায়? তাছাড়া নিজেরাও ব্যক্তি জীবনে অনেক ঘটনার জন্য দায়ী থাকে। কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলেও তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

গত ২৩ আগষ্ট, ২০১০ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর হল— ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোহাম্মদ ব বেগমকে রাজাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রানী মারা যায়। এলাকাবাসী জানায়, ফোরকানের পরকীয়া প্রেম ছিল এবং রাণী এর প্রতিবাদ করার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণটি কি শুধুই ব্যতিক্রমী ঘটনা? নাকি অহরহই ঘটে? ঘটে । ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা সব সময় প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে প্রায়শঃই জড়িত থাকে। দায়ীও কি!

গত ১৫ আগষ্ট, ২০১০ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত আরেকটি খবর হল— রাজশাহীর পুঠিয়ায় থানায় বসে বিয়ে হল ইউনিয়ন পরিষদের এক নারী সদস্যের। দুই সন্তানের জননী বিধবা ওই মহিলা ইউপি সদস্যের নাম সাজেদা। তিনি ভালুকগাছী ইউপির ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের সদস্য। বর বাবুল হোসেন তিন সন্তানের জনক। শনিবার থানার ওসি ও ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ওই বিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও বিয়ের আগে অনুমতি মেলেনি বাবুলের প্রথম স্ত্রীর।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভালুকগাছী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল করিম জানান, সাজেদার সঙ্গে শুকদেবপুর গ্রামের আলহাজ আবুল কাশেমের ছেলে বাবুল হোসেনের দীর্ঘদিন ধরে প্রেম ছিল। ৪ মাস আগে সাজেদার অসুস্থ স্বামী মনছুর মারা যান। এ সময় সাজেদা ব্যবসার জন্য ১ লাখ টাকাও দেন বাবুলকে। কিন্তু বাবুল তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলে বৃহস্পতিবার সাজেদা বাবুলের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। খবর পেয়ে সাজেদার ছেলে লাল্টু মোটরসাইকেল নিয়ে বাবুলের বাড়িতে গেলে বাবুলের লোকজন লাল্টুর মোটরসাইকেল আটকে দেয়। লাল্টু থানায় গিয়ে অভিযোগ করলে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ সাজেদা ও বাবুলকে থানায় নিয়ে আসে। শনিবার সকালে সাজেদা ও বাবুলের বিষয়টি সমঝোতার জন্য পুলিশ দু’পক্ষকে থানায় ডাকে। পরে দু’পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে থানার গোলঘরে সাজেদা ও বাবুলের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়। ভালুকগাছী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল করিম বলেন, ‘বিয়েতে বাবুলের প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া হয়নি। ওসি বাবুলের প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।’
এ ব্যাপারে পুঠিয়া থানার ওসি বলেন, ‘এলাকায় অশান্তি হচ্ছিল। তাই দু’পক্ষের উপস্থিতিতে তাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া না হলে বাবুল জেলে যাবে।’
তবে তিনি বাবুলের প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার জন্য ভালুকগাছী ইউপি চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

১৯৮৯ সালের একটি পরিপত্র অনুযায়ী প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে নারী নির্যাতন নিরোধ কমিটি রয়েছে যার সভাপতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ডের নারী সদস্যগণ। আর উপরোক্ত ঘটনাটি ঘটালো নারী নির্যাতন নিরোধ কমিটির সেই লোকজনই। প্রবাদ বাক্যের মত শিয়ালের কাছে মুরগী ভাগী।

এখানে আমি সাজেদার ভালবাসা ও বিয়েকে সমালোচনার জন্য খবরটিকে উদ্ধৃত করিনি। সাজেদাকে শুধু একজন নারী হিসেবেও দেখছি না। সে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত একজন নারী সদস্য। তার অন্যান্য দায়িত্বের সাথে রয়েছে নারীর স্বার্থ দেখা। নারী আন্দোলন এ পদটি নিয়ে এ রকম আশাই করে থাকে। এখানে সে রক্ষক হয়েও ভক্ষক এর ভূমিকাটি নিলেন। আর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও বাবুলের দ্বিতীয় বিয়ের পর তার প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার দায়িত্ব নিলেন।
নাটকের মঞ্চের বাইরে রাখা চরিত্রটির জীবনে ঘটে গেল এক অনাঙ্ক্ষিত অধ্যায়।

এখানে থানার ওসি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত একজন নারী সদস্য তিনজনের মধ্যে একজন সুবিধাভোগী আর দুইজন সুবিধা দাতা। এ তিনজনের বিরুদ্ধে বাবুলের স্ত্রীর মাথা তুলে কথা বলার ক্ষমতা থাকলে বাবুল হোসেন তিন সন্তান রেখে এ দ্বিতীয় বিয়ের করার মত সাহস পেত না। আর দ্বিতীয় বিয়ের করার আগে প্রথম স্ত্রী যে যে কারণে অনুমতি দিবে তা ও এখানে প্রযোজ্য নয়।
কারণ খবরটিতেবাবুলের প্রথম স্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে অপারগতার কোন তথ্য নেই।
এখানে সাজেদা নারী হয়েও আরেক নারীর ঘরে ঢুকেছে বলে আমার কি বলব যে নারীরাই নারীর শত্রু? না। সাজেদা এখানে জৈবিকভাবে নারী হলেও সে পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। সে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি। সামাজিক পরিচয়ে সে ক্ষমতাধর। নিজের চাহিদাপূরণে সক্রিয়। তার অর্থ আছে যা সে ধার দিয়েছিল ভালবাসার পাত্রকে। তার ব্যক্তি জীবন থেকে তার জনজীবন যে এখানে গুরুত্বপূর্ণ এ সম্বন্ধে সে সচেতন নয়। সচেতন হলেও পুরুষতান্ত্রিক দম্ভে তা সে মাড়িয়ে গিয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

যারা আইন প্রণেতা, যারা আইন বাস্তবায়নকারী, যারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাই নারী হিসেবে কেউ ভোগে আবার কেউ ভোগায়।

তবে সাজেদা ইউ এস এ এর প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের চেয়ে সাহসী। ক্লিনটন জনচরিত্র হয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অবৈধ কাজ করলেও সাজেদা আইনী স্বীকৃতি নিয়ে নিয়েছে।

উপরোক্ত ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য সাজেদার ভূমিকা আর শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটা একই রেখার দীর্ঘরূপ মাত্র। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতনে হাসিনা খালেদা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান না হলেও দলীয়ভাবে হোন। তা না হলে পুলিশ দিয়ে আর রাস্তায় রাজনৈতিক নারী কর্মী পেটান কেন? এখানে সাজেদা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান। পার্থক্য এটুকুই।

রাজনৈতিক নারী কর্মীরা সরব আর বাবুল হোসেনের প্রথম বউ নীরব। রাজনৈতিক নারী কর্মীরা পথে প্রতিবাদ করতে জানে। বাবুলের প্রথম বউ তা পারে না। এখানে রাজনৈতিক নারী কর্মীদের চেয়ে বাবুলের প্রথম বউ বেশি অসহায় এবং অধিকতর দুঃস্থ। আর সাজেদা এ দুঃস্থতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।
ফোরকানের স্ত্রীকে তো মরেই প্রমান করতে হল যে স্বামীর অপকর্মের প্রতিবাদ করার অপর নাম মরণ, পাপ। নিষিদ্ধ কাজ।

সাজেদার অথবা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া কারও নারীর প্রতি কোন মর্যাদাকর দৃষ্টিভঙ্গি নেই। তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার, ক্ষমতার কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে নারী স্বার্থ বিঘ্নিত হলে তাদের স্বার্থ হানি ঘটে না।