বিবর্তনবাদঃ একটি বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গী

বন্যা আহমেদ

 

 

কোপার্নিকাস পৃথিবীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সেই ষোলশ শতব্দীতে, সেই ধাক্কার জের  সামলাতে আমাদের কিন্তু কম সময় লাগেনি। আজ, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বসে হয়তো আমাদের মনে হতে পারে এ আর এমন কি তত্ত্ব, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে এটাই তো স্বভাবিক, অথচ সে সময়ে এটাই ছিল এক ভয়ঙ্কর ত্তত্ব। কয়েকশ’ বছর লেগে গিয়েছিল আমাদের ব্যাপারটা মেনে নিতে । চারপাশের ধর্মান্ধ মানুষগুলোর ভয়েই হয়তো কোপার্নিকাস নিজের এই যুগান্তকারী মতবাদটিকে প্রকাশ করারই সাহস পাননি তার জীবদ্দশায়। মধ্যযুগীয় চার্চের আদেশে ব্রুনোকে পুড়ে মরতে হল, গ্যালিলিওকে সইতে হল অসহ্য নির্যাতন। অসীম ক্ষমতাধারী মধ্যযুগীয় চার্চ্চের সামনে এর চেয়ে অপরাধ আর কি হতে পারে? বাইবেলের স্বর্গীয় বানী কি মিথ্যা হতে পারে – পৃথিবীই সকল ‘সৃষ্টি’র কেন্দ্রবিন্দু, তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরে চলেছে চাঁদ, সূর্য গ্রহ, তারা! পৃথিবী নামের এই গ্রহটির এক বিশেষ মর্যাদা ছিলো সে সময়কার ধর্মবেত্তা, বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের মাঝে। তারা ভাবতেন, আমাদের এ নিটোল বাসভূমি -পৃথিবী বোধ হয় ঈশ্বরের অনুগ্রহপ্রাপ্ত এক ‘বিশেষ গ্রহ’ আর মহাবিশ্বের সবকিছুই বুঝি এই পৃথিবীকে ঘিরেই অনবরত পাক খেয়ে চলছে। কোপার্নিকাস এই মনগড়া কল্পকাহিনীর অবসান ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করলেন পৃথিবী সে অর্থে মোটেই কোন ‘বিশিষ্ট’ গ্রহ নয়, বরং বুধ-শুক্র-মঙ্গল-বৃহষ্পতিদের মতই সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণরত আরেকটি সামান্য গ্রহমাত্র। ভয় ভীতি অত্যাচারকে অবজ্ঞা করে অতীতের মত সেবারও আস্তে আস্তে মানব সভ্যতা এগিয়ে গেছে, ধর্মীয় কুসংস্কার আর অজ্ঞতাকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে গবেষণালব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান। কুপমুন্ডুকতার জগৎ সৌরজগতের থেকে বেরিয়ে এসে এই যে বুঝতে পারা পৃথিবী কোন কিছুর কেন্দ্র নয়, না, না মহাবিশ্বের, বরং এক অতি সাধারণ নক্ষত্র সূর্য যার নাম – তার চারিদিকে প্রদক্ষিণরত এক তুচ্ছ গ্রহমাত্র – মানব সমাজে চিন্তা চেতনার এই ক্রমশ উত্তোরণকে এখন ‘কোপার্নিকাসীয় বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়। বারবার এভাবেই এগিয়েছে আমাদের সভ্যতা, কখনও ধীরে, কখনও বা শত আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে, কখনও বা অদম্য এক দ্রুতগতিতে সময়কে হারিয়ে দিয়ে।

 

 সেই ষোলশ’ শতাব্দীতে কোপার্নিকাস যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন তারই হাত ধরে কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটনের মত বিজ্ঞানীদের কয়েক শতাব্দীর কাজ আমাদের পৃথিবীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল অতিপ্রাকৃত শক্তির হাত থেকে প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার পরিমন্ডলে। মানব সভ্যতার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা প্রথমবারের মত ভাবতে শিখেছিলাম যে, পৃথিবীসহ এই বিশাল মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য বাইরের কোন কল্পিত শক্তির প্রয়োজন নেই – প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর সাহায্যেই আজকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বিস্তৃতি, ভুত ভবিষ্যতের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব, আর সেই ব্যাখ্যাগুলো মানুষের জ্ঞানের পরিধির বাইরে নয়। কিন্তু মানব সভ্যতার এই চেতনামুক্তি জড়জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল প্রথম কয়েক শতাব্দী, জীবজগৎ তখনও রয়ে গিয়েছিল প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার পৃথিবীকে সৌরজগতের কেন্দ্র থেকে ঠেলে বের করে দিলেও মানুষ কিন্তু তখনও দিব্যি নিজেকে বসিয়ে রেখেছিল সমগ্র প্রাণ জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে – উর্দ্ধে।মানুষই একঅমাত্র সৃষ্টির সেরা জীব তাকে ঘিরেই সৃষ্টির এই মহা আয়োজন! ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন এবং অ্যালফ্রেড রাসেলই প্রথম বললেন, এই পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তি এবং প্রাণের বিকাশ ও বিস্তৃতিও প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে নয়, সব জীবই এই প্রকৃতির অংশ। পৃথিবীর এই অফুরন্ত প্রাণের মেলায় আমরা যে হাজার হাজার প্রজাতির আনাগোনা দেখি তারা সবাই সেই আদি সরল প্রাণ থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। কোন ‘মহাসৃষ্টি’র ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী এই লক্ষ-কোটি প্রজাতিগুলো আলাদা আলাদাভাবে তৈরি হয়নি। অসংখ্য প্রজাতির উৎপত্তি ঘটেছে, টিকে থাকতে না পেরে তাদের অনেকেই আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এরকম – মানুষও এ সমীকরণ থেকে বাদ পড়ছে না, আমরা যতই নিজেদেরকে তথাকথিত ‘সৃষ্টি’র কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে স্বান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করি না কেন, মানুষ আসলে অন্যান্য জীবের মতই বিবর্তনের অমসৃন আর বন্ধুর পথেরই সহযাত্রী!

 

আমরা দেখেছি, আমাদের আবাসভূমি এই জড় পৃথিবীটাকে কেন্দ্র থেকে হটাতে কি পরিমান বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে মানব সভ্যতাকে, তাহলে সহস্র বছর ধরে বহু যত্ন করে তৈরি করা স্বর্গ-মর্ত্যের কেন্দ্রস্থলএ নিজেকে বসিয়ে মানুষ যে সভ্যতা সংস্কৃতি তৈরি করেছে সেখান থেকে তাকে নামিয়ে আনতে কি প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হবে তা তো বোঝা দুঃসাধ্য নয়। মধুযুগীয় চার্চ বা অন্যান্য ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতাপ ইতমধ্যেই কমে এসেছিল বলে ডারউনের পরিণতি ব্রুনো বা গ্যালিলিওর মত হয়নি কিন্তু আজও দেখা যায় পৃথিবীর আনাচে কানাচে এই বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মিথ্যা রটনার কোন সীমা পরিসীমা নেই। ইউরোপে বেশীরভাগ মানুষই বিবর্তনবাদকে সঠিক বলে স্বীকার করে নিলেও আমেরিকায় এখনও ৬০% মানুষ একে মিথ্যা এবং ক্ষতিকর রটনা বলেই মনে করে, বিভিন্ন শক্তিশালী অংশ স্কুলের পাঠ্যবই থেকে একে উঠিয়ে দেওয়ার দাবী জানায়। অথচ, ডারউইন তার তত্ত্বটি দেওয়ার পর প্রায় দেড়শ বছর পার হয়ে গেছে, বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অভুতপূর্ব গতিতে। আর যতই নতুন নতুন আবিষ্কার হয়েছে ততই নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে বিবর্তনবাদের যথার্থতা।  ফসিলবিদ্যা থেকে শুরু করে আণবিক জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, এবং জেনেটিক্স, জিনোমিক্সের মত বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক শাখাগুলো থেকে পাওয়া সাক্ষ্যগুলো বিবর্তনবাদকে আজ অত্যন্ত শক্ত খুঁটির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর তাই, গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই বিজ্ঞানীরা এই সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বিবর্তনবাদকে জীববিদ্যার সব শাখার ভিত্তিমুল হিসেবে গন্য করে আসছেন। কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের মতই এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। বিজ্ঞানীরা আজকাল প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন যে, বিবর্তনবাদ ছাড়া জীববিজ্ঞানের কোন অর্থই হয় না। এজন্যই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস আয়ালা বলেন, ‘ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কোপার্নিকাসঈয় বিপ্লবকে পূর্ণতা দিয়েছিলো’। কথাটা কিন্তু একেবারেই মিথ্যে নয়। রিচার্ড ডকিন্স মনে করেন শুধু আমাদের পৃথিবীতে নয়, মহাবিশ্বের আর কোথাও প্রাণের বিকাশ ঘটলেও তা ডারউইনীয় বিবর্তনকে অনুসরণ করেই ঘটবে। সে হিসেবে, ডারউইনের তুত্ব শুধু আমাদের পৃথিবী নয়, মহাজগতের জন্যও প্রাসঙ্গিক।  

 

 

 

 

কিন্তু তারপরও  আশচর্যের বিষয় হচ্ছে যে, আপনি বিবর্তনবাদকে সঠিক বলে মনে করেন শুনলেই পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ আপনার দিকে একরাশ অবিশ্বাস এমনকি ঘৃণা নিয়ে তাকাবে। আমার এক ডাক্তার বন্ধু তো সেদিন বেশ সাহস করে জিজ্ঞেস করেই বসলো, ‘তুমি কি আসলেই যেসব কথা লেখো সেগুলো সব বিশ্বাসও কর?’ তার গলায় একধরণের কাকুতি ছিল, যা শুনে সত্যি বলতে কি তার জন্য একটু হলেও মায়া হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এইরকম অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা নিয়ে এরা যদি ডাক্তারী পাশ করে দিব্যি চেম্বার খুলে বসতে পারে তাহলে আমাদের মত রুগীদের কপালে কি আছে কে জানে!

 

ডারউইন দিবস পালনের কথা শুনলেই অনেকেই নেড়েচেড়ে বসেন, তারপর খুব গম্ভীরভাবে বলেন, ডারউইনকে ‘গড’ বানিয়ে ফেলার কিছু নেই, ডারউইন যা বলেছিল তার সবই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে হবে এমন কোন কথা নেই, কিংবা এভাবে ডারউইনে বিশ্বাস করাটা আরেক ধরনের মৌলবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। খুব কমন একটা প্রতিক্রিয়া শোনা যায় অনেকের মুখ থেকেই, তোমরা ডারউইনের পুজা কর, ইশ্বর পুজা এবং ডারুইনের পুজার মধ্যে পার্থক্য কি? কি আর বলবো এদেরকে, কিভাবে বোঝাবো বিজ্ঞান কাউকে পূজা করে না, কেউ যদি সেটা করে থাকে তবে সে বিজ্ঞান বোঝে না। কিন্তু যারা বিবর্তনবাদের ইতিহাস জানেন তারা খুব ভালভাবেই জানেন যে, ডারউইনের প্রবর্তিত বিবর্তনবাদ এক দিনে বা এক বছরে বা এক দশকেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিজ্ঞান অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কাজ করে না। বিজ্ঞানকে নির্ভর করতে হয় যুক্তির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণের উপর। কোন অনুকল্পকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জায়গায় উঠে আসতে হলে তাকে বিভিন্ন স্তর পার হয়ে আসতে হয় – প্রথমে গভীর পর্যবেক্ষণ, যুক্তি, সমস্যার বিবরণ, সম্ভাব্য কারণ, ফলাফল ইত্যাদির উপর নির্ভর করে প্রকল্পটা প্রস্তাব করা হয়, তারপর তাকে প্রমাণ করার জন্য চলতে থাকে ক্রমাগত পরীক্ষা নিরীক্ষা। বিভিন্ন পরীক্ষার থেকে পাওয়া ফলাফল এবং তথ্যের মাধ্যমে যদি প্রকল্পটাকে প্রমাণ করা না যায় তাহলে তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি দীর্ঘ দিন ধরে বারবার করে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষার মাধ্যমে তাকে প্রমাণ করা যায় এবং অন্য কোন বিজ্ঞানী এই প্রমাণের বিরুদ্ধে কোন তথ্য হাজির না করেন তবেই তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখানেই কিন্তু শেষ নয়, তার সাক্ষ্য প্রমানের দায় কখনই শেষ হয় না, বিজ্ঞানে বিমূর্ত বা অনাদি সত্য বলে কোন কথা নেই।এই প্রক্রিয়ায় একটা প্রচলিত এবং প্রমাণিত তত্ত্বকেও যে কোন সময় আংশিক বা সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণ করা যেতে পারে, আজকে একটা তত্ত্বকে সঠিক বলে ধরে নিলে কালকেই তাকে ভুল প্রমাণ করা যাবে না এমন কোন কথা নেই। তাই আমরা দেখি, নিউটনের তত্ত্ব পদার্থবিদ্যার জগতে কয়েকশো বছর ধরে রাজত্ব করার পরও আইনস্টাইন এসে বিশেষ কোন কোন ক্ষেত্রে তার অসারতা প্রমাণ করে দিতে পারেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম উদাহরণের কোন শেষ নেই, কারণ বিজ্ঞান কোন তত্ত্বকে পবিত্র বা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করে না, কোন ভাল বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞান মনস্ক ব্যাক্তি কোন তত্ত্বকে চোখ বন্ধ করে স্বীকার করে নিতে পারেন না। সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্যতার কথা না হয় বাদই দিলাম, গত দেড়শ’ বছরে বিবর্তনতত্ত্বকে যে কত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-মহাপরীক্ষা-প্রত্যাখ্যানের চড়াই উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থায় পৌঁছাতে হয়েছে তার হিসাব দিতে গেলে একটা আস্ত বইই লিখে ফেলতে হবে। কতবার যে বিবর্তনবাদকে আরও হাজারও বিফল তত্ত্বের সাথে পোটলা করে ‘ভুল-তত্ত্বের’ আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। চলুন খুব অল্প কথায় দেখা যাক ১৮৫৯ সালে প্রথমবারের মত তত্ত্বটি প্রকাশের পরে তআকে কি পরিমান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে!

 

জীবের বিবর্তন যে ঘটছে এমন কথা ডারউইনের আগেও অনেক বিজ্ঞানীই বলেছিলেন যে, কিন্তু ডারউইন শুধু এই কথাটি বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনিই প্রথম তার অরিজিন অফ স্পেশিজ বইতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দেখান যে, জীবজগৎ স্থিতিশীল নয়, কোটি কোটি বছর ধরে অত্যন্ত ধীর গতিতে ক্রমান্বয়ে বিবর্তন ঘটছে এবং এর মাধ্যমেই জীবের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। কোন প্রজাতিই চিরন্তন বা স্থির নয়, বরং এক প্রজাতি থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আরেক প্রজাতির জন্ম হয়, পৃথিবীর সব প্রাণই কোটি কোটি বছর ধরে তাদের পুর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। তিনি তার বইতে প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন ধরণের উদাহরণ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, অ্যলফ্রেড ওয়ালেসের সাথে একসাথে প্রথমবারের মত কিভাবে বিবর্তন ঘটতে পারে সেই প্রক্রিয়াটারও ব্যাখ্যা দিলেন – বললেন, প্রকৃতিতে সবসময় খাদ্য, বেঁচে থাকা, জায়গা, সঙ্গী নির্ধারণ, আশ্রয়, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে থাকে একই ধরনের প্রজাতির ভিতরের প্রতিটি জীবের মধ্যে এবং এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির মধ্যে। আবার প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বা প্রকারণের কারণে এই অনন্ত প্রাকৃতিক সংগ্রামে কেউ বা সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়ে বেশীদিন টিকে থাকতে সক্ষম হয়, আর অন্যরা আগেই শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিটি জীবের মধ্যে প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে সংগ্রাম করে যারা টিকে থাকতে সক্ষম হয়, তারাই শুধু পরবর্তী প্রজন্মে বংশধর রেখে যেতে পারে, এবং তার ফলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনেক বেশী প্রকটভাবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ, যে প্রকারণগুলো তাদের পরিবেশের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযোজনের ক্ষমতা রাখে, তাদের বাহক জীবরাই বেশীদিন টিকে থাকে এবং বেশী পরিমানে বংশবৃদ্ধি  করতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রকৃতি প্রতিটা জীবের মধ্যে পরিবেশগতভাবে অনুকুল বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের নির্বাচন করতে থাকে এবং ডারউইন প্রকৃতির এই বিশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)।

 

ডারউইন প্রস্তাবিত বিবর্তনের তত্ত্বটা বেশ সহজ, কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক এবং দর্শনগত অভিব্যক্তি কিন্তু বিশাল।  দু’দশকেরও বেশী সময় ধরে তিনি নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন এই যুগান্তকারী তত্ত্বটি, বীগেল যাত্রা থেকে ফিরে আসার পর থেকেই তো রাত নেই দিন নেই তিনি এর উপরে কাজ করে চলেছেন। ওয়ালেস ১৮৫৮ সালে নিজে নিজে এই একই সিদ্ধান্তে না পৌঁছালে ডারউইন কবে এই তত্ত্বটি জনসমক্ষে হাজির করতেন, আদৌ করতেন কিনা, তাও হলফ করে বলা যায় না। তিনি খুব ভাল করেই জানেন এর ব্যাপকতা, তিনি জানেন তার হাতে প্রচুর উদাহরণ থাকলেও, একে প্রমাণ করার জন্য যে বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যাগুলোর প্রয়োজন তার সবগুলো তখনও তার হাতে নেই। তিনি জানেন শুধু তো বৈজ্ঞানিক মহলেই তাকে প্রমাণ হাজির করতে হবে না, মানব সভ্যতার সমগ্র বৌদ্ধিক এবং দার্শনিক স্বত্ত্বাকে ধরে নাড়া দিতে চলেছেন তিনি। তার এই তত্ত্বের নির্মম বস্তুবাদী দিকটিকে গ্রহণ করার জন্য মানব সভ্যতা যে তখনও তৈরি নয় সেটা তার চেয়ে ভাল করে আর কে জানে?  

 

১৮৫৯ সালে অরিজিন অফ স্পেসিজ বইটা বের হওয়ার পর পৃথিবীব্যাপি হইচই পড়ে যায়, ইউরোপের ধর্মীয় রক্ষণশীল অংশটি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ডারউইনের বিরুদ্ধে। ডারউইন নিজে এসবের তেমন কোন জবাব না দিলেও তার বন্ধুরা, হাক্সলি, আসা গ্রে, হুকার তার হয়ে লড়ে যেতে থাকেন। তবে ১৮৭০ সালের মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতা না পেলেও বিজ্ঞানীমহলে প্রজাতির বিবর্তনের ধারণাটা পাকাপোক্তভাবে জেকে বসে। কিন্তু যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় বিজ্ঞানীরা তখনও বিবর্তনের প্রক্রিয়া বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন ঘ্টার প্রক্রিয়াটাকে একরকম বর্জনই করে দেয়।

 

ওদিকে মানুষের বিবর্তন নিয়ে তো ডারউইন পড়লেন আরেক ফ্যসাদে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী যাওবা অন্যান্য প্রজাতির বিবর্তনের কথা মেনে নিতে পারলেন, মানুষেরটা কিন্তু কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। শুধু বাইরের বিজ্ঞানীরাই নয়, তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু লায়েলের মত অত্যন্ত প্রগতিশীল বিজ্ঞানীর পক্ষেও মানুষের বিবর্তন মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ডারউইনের সামনে। যে ওয়ালেস এর কারণেই তিনি তার তত্ত্বটিকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে ওয়ালেস নিজের থেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, তিনিই পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে এসে বলে বসলেন যে, মানুষের বিবর্তনের ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদ প্রযোজ্য হতে পারে না। মানুষের মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিমত্তার মত এত জটিল জিনিষ নাকি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে না। ডারউইন তার অরিজিন অফ স্পেসিজ বইতে মানুষের বিবর্তন নিয়ে কিছু না বললেও হাক্সলি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন আলোচনার এবং লেখায় মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করতে শুরু করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে ডারউইন ১৮৭১ সালে মানুষের বিবর্তন নিয়ে লেখা The Descent of Man বইটা প্রকাশ করেন।

 

ডারউইনের বিরর্তন তত্ত্বের সমস্যা ছিল অনেকগুলোই। শুরু করা যাক deep time বা অনন্ত সময়ের সমশ্যাটা দিয়েই। ডারউইন  বলেছেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করতে হাজার হাজার কোটি কোটি বছরের প্রয়োজন । কিন্তু এই হাজার কোটি বছর আসবে কোথা থেকে? ভূতত্ত্ববিদ জেমস হাটন এবং চার্লস লায়েল প্রকৃতি এবং ভুত্বকের আজকের এই অবস্থায় আসতে অসীম সময়ের প্রয়োজন হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও তারা কোন সুস্থির বৈজ্ঞানিক প্রমাণ তখনও হাজির করতে পারেন নি। বেশীরভাগ মানুষই সে সময়ে বাইবেল এর ব্যখ্যা অনুযায়ী পৃথিবীর বয়স ৬ হাজার বছর বলেই মনে করতো! বিখ্যাত পদার্থবিদ উইলিয়াম থমসন (যিনি পরে লর্ড কেলভিন উপাধিতে ভূষিত হন) ১৮৬৬ সালে এই আনুমানের বিরোধিতা করে বলেন যে পৃথিবীর বয়স আসলে ডারউইন যা বলেছেন তার থেকে অনেক কম। থমসন থার্মো-ডাইনামিকসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন, তিনিই প্রথম থার্মো-ডাইনামিকসের দ্বিতীয় সুত্র এবং চরম তাপমাত্রা স্কেল আবিষ্কার করেন। থমসন রাসায়নিক শক্তি এবং মাধ্যাকর্ষণ এই দুইটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আলাদা আলাদাভাবে সূর্যের বয়স নির্ধারণ করে দেখান, মাধ্যাকর্ষণ বল ব্যবহার করলে সূর্যের বয়স সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় এবং সেটাও কিনা হচ্ছে মাত্র কয়েক’শ লক্ষ বছর। থারমো-ডাইনামিকসের সুত্র ব্যবহার করে থমসন এটাও প্রমাণ করেন যে, এমনকি মাত্র কয়েক লক্ষ বছর আগেও পৃথিবীর তাপমাত্রা এতই বেশী ছিল যে সেখানে কোনরকম প্রাণের উৎপত্তি ঘটা ছিল একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। তার এই হিসেব মত ডারউইনের দেওয়া প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব তো দুরের কথা, লায়েলের তত্ত্বও ভুল বলে প্রমাণিত হয়ে যায়। থমসনের হিসেব ঠিক হলে বিবর্তনবাদকে ভুল বলে ধরে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকে না। পরবর্তীতে থমসন পৃথবীর বয়সকে কমিয়ে ১-৩ কোটি বছরে নামিয়ে নিয়ে আসেন। ডারউইনের সময়কালে বিজ্ঞানীরা পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে যা জানতেন তা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের সঠিকতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের জন্ম দেয়। ডারউইন ওয়ালেসকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই, পৃথিবীর বয়স সম্পর্কে থমসনের দৃষ্টিভংগী আমার সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।’ পৃথিবীর বয়স যে এর চেয়ে বেশী তা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বোঝা গেলেও আরও অর্দ্ধ শতক লেগে গিয়েছিল সঠিক বয়সটা বের করতে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি যে পৃথিবীর বয়স আসলে প্রায় সাড়ে চার শ’ কোটি বছর। এই আবিস্কারগুলোর ফলেই ধীর গতিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যমে বিবর্তন ঘটার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল কিনা সেই সমস্যাটার সমাধান হয়।

 

ডারউইনের তত্ত্বের আরেকটা মারাত্মক সমস্যা ছিলো – ডারউইনের সময় পর্যন্ত বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক কিভাবে কাজ করে তা সম্পের্ক বিজ্ঞানীদের কোন স্পষ্ট ধারণাই ছিলো না। সে সময়ের জীববিজ্ঞানীরা ভাবতেন যে, পরবর্তী প্রজন্মে বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে এক ধরণের মিশ্রণ ঘটে; যেমন ধরুন, বাবার গায়ের রং কালো আর মার গায়ের রং ফর্সা হলে ছেলেমেয়ের গায়ের রং মিশ্রিত হয়ে শ্যমলা হয়ে যেতে পারে! ডারউইন বেশ বিপাকে পড়লেন, আসলেই কি বাবা মার বৈশিষ্ট্যগুলো সন্তানের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে যায়? কিন্তু আসলেই যদি এভাবে বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটে তাহলে কি তার প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বই ভুল প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে না? আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের অন্যতম প্রধাণ শর্তই হচ্ছে যে, প্রজাতির জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রকারণ থাকতে হবে, যার ফলশ্রুতিতেই জীবের মধ্যে বেঁচে থাকার যোগ্যতায় ভিন্নতা দেখা দেয়। কিন্তু এভাবে যদি কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো মিশ্রিত হয়ে যেতে থাকে তাহলে তো হাজার প্রজন্ম পরে সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে, প্রকারণ থাকবে কি করে? তখনও জেনেটিক্সের আবিষ্কার না হওয়ায় ডারউইন এরও সদুত্তর দিতে পারেননি, এমনকি তিনি এই মিশ্রণ তত্ত্বকেই সঠিক বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্বের সমালোচক বিজ্ঞানীদের চোখ এড়িয়ে যায়নি এই গোঁজামিলটা। ফ্লিমিং জেনকিন নামক একজন অধ্যাপক সঠিকভাবেই দেখিয়ে দিলেন যে বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো যদি এভাবে মিশ্রিত হয়ে যায় তাহলে এক সময়ে জনপুঞ্জে আর কোন প্রকারণই থাবে না, এবং এটাই ডারউইনের দেওয়া প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। ডারউইন তার জীবদ্দশায় এর তেমন কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। অথচ তার সমস্যার সমাধান দিতে পারতেন গ্রেগর মেন্ডেল, যিনি ১৮৬৫ সালেই তার জিনতত্ত্বটি প্রস্তাব করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ, ডারউইন মেন্ডেলের লেখাটা পড়ারই সুযোগ পেলেন না; আসলে সে সময় কেউই মেন্ডেলের আবিষ্কারের প্রতি ভ্রক্ষেপ না করায় তার এই গুরুত্বপুর্ণ কাজটা সকলের অগোচরেই থেকে যায়।

 

অরিজিন অফ স্পেসিজ বের হওয়ার প্রায় ৬০ বছর পর্যন্তও প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি বিজ্ঞানী মহলে গ্রহ্নযোগ্যতা পায়নি। নিও-ল্যামার্কিজম, অরথজেনেসিস, সল্টেশিনজম, মিউটেশনিজম সহ অনেক তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এদিকে ১৯০০ সালের দিকে আবার নতুন করে আবিষ্কৃত হল মেন্ডেলের কাজ। আমরা অবাক হয়ে জানতে পারলাম, ডারউইন যে সমস্যাগুলো নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তার সমাধান ছিলো এক্কেবারেই তার হাতের ডগায়। মেন্ডেল দেখালেন যে, ছেলে মেয়ের প্রত্যেকটা বংশগত বৈশিষ্ট্য মা বাবার কোন না কোন ‘ইউনিট ক্যারেক্টর’ দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে। বাবা মার কোষের ভিতরের এই ফ্যাকটর বা জিনগুলো একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হয়। কিন্তু মেন্ডেলের তত্ত্ব আবার নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল, মিউটেশনিষ্টরা মত দিল যে, ধীর প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নয় বরং আকস্মিক মিউটেশনের মাধ্যমেই বিবর্তন ঘটছে। এই মতবাদ পরবর্তীতে আরও কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে।

 

১৮৮২ সালে ডারউইন যখন মারা যান তখন বংশগতিবিদ্যা আর আনবিক জীববিদ্যার সেরকমভাবে বুৎপত্তি ঘটেনি। জ্ঞানের অসপূর্ণতার কারনে ডারুইনের তত্ত্বের যে অসপূর্ণতা ছিলো, তা পরবর্তীতে বহু দশক ধরে বহু বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রমে পূরণ করা হয়েছে। ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশকে ফসিলবিদ্যা এবং জেনেটিক্স এর সাথে ডারউইনের তত্ত্বের সমন্বয় করে থিওডোসিয়াস ডাবঝানস্কি, জুলিয়ান হাক্সলি, আর্নেস্ট মায়ার, জি জি সিম্পসন, বার্ণার্ড রেনেশ প্রমুখ বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন বিবর্তনবাদের আধুনিক ব্যাখ্যা – বিবর্তনের এই  সংশ্লেষনী তত্ত্ব বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিবর্তনবাদকে।

 

বিবর্তনের এই আধুনিক সংশ্নেষণী তত্ত্ব অনুযায়ী আজকের দিনের বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা প্রজাতির উৎপত্তির পেছনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি বিবর্তনের জন্য অন্য বেশ কিছু ফ্যাক্টরকেও গন্য করে থাকেন, ফ্যাক্টরগুলো হল এই হল :

* জিন মিউটেশন

* ক্রোমজম মিউটেশন

* জেনেটিক রিকম্বিনেশন

* জিনের পুনরাগমন বা জিন প্রবাহ

* জেনেটিক ড্রিফট

*এবং অন্তরণ

 

এই আধুনিক তত্ত্ব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, জনপুঞ্জে জিনের প্রকারণ রয়েছে এবং এই প্রকারণগুলো তৈরি হচ্ছে আকস্মিক মিউটেশন এবং জেনেটিক রিকম্বিনেশন থেকে, এদের পিছনে কোন নিয়ম, উদ্দেশ্য বা অভিযোজন কাজ করছে না। কোন জনপুঞ্জে এই মিউটেশন এবং জেনেটিক রিকম্বিনেশনের হারের উপর জিনের ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তন নির্ভর করবে। কোন জনপুঞ্জে যদি মিউটেশনের হার বিরল হয় তবে জিনের ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তনে এর ভুমিকাও হবে অত্যন্ত নগন্য। এখন কোন জনপুঞ্জে এই জিনের ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তন ঘটার পিছনে প্রধাণ কারণগুলো হচ্ছে: জিন প্রবাহ, জেনেটিক ড্রিফট, অন্তরণ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন।

 

গত ৫০-৬০ বছরে জেনেটিক্স, অনু-জীববিদ্যা, জিনমিক্সের মত শাখাগুলো এগিয়ে গেছে অকল্পনীয় গতিতে, ক্রোমোসোম, ডিএনএ এবং মিউটেশন থেকে শুরু করে মানুষের জিনোমের পর্যন্ত হিসাব বের করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। এখন তো জীববিজ্ঞানীরা রীতিমত দাবী করছেন যে, যদি একটা ফসিলের চিহ¡ও পৃথিবীর বুকে কোনদিন না পাওয়া যেতো তাহলেও আজকের জেনেটিক্সের জ্ঞান এবং আমাদের ডিএনএ-এর মধ্যে লেখা পুর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর হাজার বছরের ইতিহাস থেকেই বিবর্তনের তত্ত্ব প্রমাণ করে ফেলা যেতো। তবে মজার কথা হচ্ছে যে এখন পর্যন্ত যে এত কোটি কোটি ফসিল পাওয়া গেছে ভূত্বকের বিভিন্ন স্তরে তার মধ্যে কোন ‘ভুল’ স্তরে কোন ‘বেমানান’ ফসিল পাওয়া যায়নি যা দিয়ে বিবর্তনবাদকে খন্ডন করা যেতে পারে। এখনও বিবর্তন এবং তার সাথে সম্পর্কিত শাখাগুলোতে পুনোর্দ্যমে গবেষনা চলছে প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে। ইদানীং বিজ্ঞানীরা বলছেন, যতই কাজ এগুচ্ছে ততই নাকি দেখা যাচ্ছে বিবর্তনে প্রাকৃতিক নির্বাচন এর ভুমিকা আগে যতটুকু বলে ভাবা হয়ছিল তার চেয়েও তার ব্যাপকতা আসলে অনেক বেশী।

 

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিবর্তনবাদকে সঠিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। যে কোন বড় তত্ত্বের মতই তাকে দশকের পর দশক ধরে বৈজ্ঞানিক অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, প্রত্যেকটি খুটিনাটি তথ্যকে বারবার ঝালিয়ে নেওয়া হয়েছে।আর এই পরীক্ষা আজও চলছে, বিজ্ঞানীরা প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য এবং জ্ঞানের আলোকে একে পরীক্ষা করে দেখছেন। কিন্তু তার ফলে কি বিবর্তনবাদের সম্পর্কে মিথ্যা রটনা কিংবা অহেতুক আক্রমনগুলো কমে এসেছে? মোটেও নয়, আসলে দিন দিন যেন তা বেড়েই চলেছে। আমেরিকার মত দেশে আজ স্কুলের পাঠ্য্সূচী থেকে বিবর্তন পড়ানো বাদ দেওয়ার দাবী জানাচ্ছে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তা রক্ষনশীল একটি অংশ। আর আমাদের দেশে তো উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে বিবর্তন পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নামেমাত্র পড়ানো হলেও চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মীয় মৌলবাদী অংশের চাপে পড়ে বিবর্তনবাদ পড়ানো একেবারে বাদই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুপরিচিত অধ্যাপক এবং লেখক দ্বিজেন শর্মা তার এক লেখায় বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলেও ডারউইনের তত্ত্বের এতটা বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়নি, এখন স্বাধীন বাংলাদেশে যা ঘটছে।

 

একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় বিবর্তনবাদ এর বিরুদ্ধে এত প্রবল বাঁধার কারণটা কি! এটা তো আসলে শুধই একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, এটা আসলে এক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী। এ আমাদের চিরায়ত চিন্তাভাবনা, দর্শন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। ঘুণ ধরা পুরনো সব মুল্যবোধে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছে সে, পুরনো ধ্যানধারণাকে ভেংগে চুরমার করে দিয়েছে! পৃথিবীতে যে গুটিকয়েক তত্ত্ব মানব সভ্যতার ভিত ধরে নাড়া দিয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। কোপার্নিকাসের সৌরকন্দ্রিক তত্ত্বের পরে একেই সবচেয়ে বড় প্যরাডাইম শিফট বলে চিহ্নিত করা হয়। মানুষ শুধু তথাকথিত ‘মহাসৃষ্টি’র কেন্দ্র থেকেই বিচ্যুত হয়ে পড়েনি, দুই হাজারেরও বেশী বছর ধরে লালন করা অপরিবর্তনশীল মহাবিশ্ব ও প্রজাতির ধারণা সমৃদ্ধ স্থবির জাগতিক দর্শন থেকেও তাকে বের হয়ে আসতে বাধ্য করেছে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব। গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টটল এবং প্লেটো যে স্থির, অপরিবর্তনশীল এক বিশ্বের ছবি একেছিলেন আমরা তার বোঝা বহন করে চলেছি প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে। তাদের ভাগ্যবাদী, স্থবির এই মতবাদের প্রতফলনই দেখা যায় ধর্মীয় বইগুলোতে। বার্ট্রন্ড রাসেল এই প্রসঙ্গেই বলেছিলেন যে এর পরে পৃথিবীতে যত বড় বড় বৌদ্ধিক অথবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটেছে তাদের প্রায় সবাইকেই কোন না কোনভাবে এরিষ্টটলের মতবাদকে উৎখাত করে এগুতে হয়েছে। আসলেই তো, আমাদের চিন্তা চেতনার সর্বত্র জুড়েই তো ভর করে রয়েছে সেই অপরিবর্তনশীল ভাগ্যবাদী দর্শন – প্রত্যেকটি প্রজাতিই এ অবস্থাতেই ‘সৃষ্টি’ হয়ে টূপ করে পৃথিবীতে এসে পড়েছে, আমাদের সবার ভাগ্য পূর্ব-নির্ধারিত, নিয়তিকে ঘিরেই আবর্তিত হয় আমাদের চিন্তা ভাবনা। তাই বিবর্তবাদ যখন আমাদের বলে, এই বিশ্ব সদা পরিবর্তনশীল, কয়েকশো কোটি বছরের যাত্রাপথে আরও কোটি কোটি প্রজাতি জন্ম হয়েছে, আবার তাদের মধ্যে বেশীরভাগই বিলুপ্তও হয়ে গেছে, আমাদের প্রজাতিও হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে তখন আমরা তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। বিখ্যাত বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স যখন বলেন, ‘আমাদের চারপাশের বিশ্বজগতে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো দেখলেই বোঝা যায় এর মধ্যে কোন পরিকল্পনা নেই, উদ্দেশ্য নেই, নেই কোন অশুভ কিংবা শুভের অস্তিত্ব; আসলে অন্ধ, করুনাহীন উদাসীনতা ছাড়া এখানে আর কিছুই চোখে পড়ে না’ – তখন আমাদের স্থবির ভাগ্যবাদী অচলায়তনের মোড়কে পোড়া দর্শন এবং বৌদ্ধিক স্বত্তা প্রবলভাবে নাড়া খায়। যে সব রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ, ধর্ম ব্যাবসায়ীরা এতদিন সাধারন মানুষকে এগুলো বুঝিয়ে এসেছেন তারা তীব্রভাবে এর বিরধিতা করেন, বিভিন্নরকমের কুৎসা রটাতে দ্বিধা করেন না।

 

চারপাশের পরিবেশ বদলায়, আমরা বদলাই তার সাথে সাথে বদলে যায় পরিবেশের সাথে আমাদের নিত্যদিনের সম্পর্কগুলোও। আমরা মানুষেরা সেই বিশ্ব-প্রকৃতিরই একটা ছোট্ট অংশ। প্রকৃতির আর সবার সাথেই আমাদের যাত্রাপথ ভাগ করে নিতে হবে। স্টিফেন জে গুল্‌ড বোধ সেটা ভেবেই বলেছিলেন We are the offspring of history, and must establish our own paths in this most diverse and interesting of conceivable universes–one indifferent to our suffering, and therefore offering us maximal freedom to thrive, or to fail, in our own chosen way.

   

 

ডারউইন দিবস ২০০৯