লিখেছেনঃ শাহাব আহমেদ
রুশীতে একটি গান রয়েছে : “প্রকৃতির কোনো খারাপ আবহাওয়া নেই , প্রতিটি আবহাওয়া সুন্দর , বারিধারা বা তুষারপাত সে যাই হোক বছরের যে কোনো সময়কেই গ্রহণ করো খুশী মনে”
বছরের একটি দিন আর একটি দিনের থেকে ভিন্ন কি?
এক অতি প্রিয়জন আমার একটি লেখা পড়ে (যার লেখার তারিখটি ২২ শে মার্চ ) প্রশ্ন করলো : “লেখাটা কি ২২ শে মার্চের না ৩০শে মার্চের?”
কেন এই প্রশ্ন?
খরস্রোতা পদ্মায় শৈশবে তীর ভাঙতে দেখতাম আর দেখতাম ফানেলাকৃতির জলের ঘুর্ণি। বাবার হাত ধরে সেই ভাঙন, সেই ঘুর্ণির দিকে তাকিয়ে থাকতাম অপলক, কী একটা বিস্ময় তন্ময় করে রাখতো। ভাঙন, উর্মি ও ঘুর্ণি আমাদের জীবনের দৈনন্দিনতার অচ্ছেদ্য অংশ। নানা ধরনের প্রশ্নও আমাদের জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে, কিছুর উত্তর আমরা জানি, কিছুর জানি না, কিছু প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে যাই । কিন্তু আমার সংবেদনশীল মন এই আপাত ছন্নছাড়া প্রশ্নটি নিয়ে ছোট বেলার সেই পদ্মার ঘুর্ণির মত ঘুরতে লাগল । সহজ প্রশ্ন হয়ে গেল জটিল । ২২ আর ৩০ এর মধ্যে তফাত কী? আসলেই কেন এই প্রশ্ন ? অলস মস্তিস্কের কারবার, কাকে জিজ্ঞেস করি? প্রশ্ন কর্তাকে জিজ্ঞেস করি, “এ প্রশ্ন কেন করলে? “
সে বলে “এমনিতেই।”
এমনিতে পাখি বা মানুষ মারা যায় ,কিন্তু কেউ কোনো জটিল প্রশ্ন করে এমন শুনিনি। এই যেমন কন্যা বলে ” বাবা , তুমি কথায় কথায় প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গ পাল্টাও মনে হয় যেন তোমার মন ও বাস্তবতার মধ্যে কোনই সম্পর্ক নেই , তুমি কি দেকার্তের শিষ্য ? না তোমার ওপর তার evil genius এসে চড়াও হয়?”
আমি বলি “না তো! আমি ওকে চিনিই না”
তারপর মনে পড়ে, হ্যা, চিনি আবছা আবছা। আমি গিয়েছিলাম ডাক্তারি পড়তে সোভিয়েত ইউনিয়নে।আগে যেমন জোর করে হাত পা বেঁধে বিধবাদের আগুনে তুলে দেয়া হত সেভাবেই তো ওরা আমাদের দর্শনের জটিলতার লীথি জলে চুবিয়ে দেশপ্রেমিক সমাজতন্ত্রী বানাতে চেয়েছে। সেখানে দেকার্ত , হিউম ,কান্টদের দর্শন পড়ে এক মাথার মানুষ থেকে চৌমাথার ব্রহ্মায় পরিণত হওয়ার দশাই তো হয়েছিল। ব্রহ্মার মতই অপ্রয়োজনীয় তথ্যে তথ্যে একাকার মাথা। বাইরে জঞ্জাল পরিস্কার করা যায় কিন্তু মাথার জঞ্জাল পরিস্কার করা কিভাবে যদি মাথাটি ধড়ে শোভা পায় নারিকেলের মত?
দেকার্তের মাইন্ড বডি ডুয়ালিজমে, যতদূর মনে পড়ে ,বলে “এই যে জগতটা আমরা দেখছি তা আসলে বাস্তব নয় আমাদের মনজ, আমরা যেভাবে একে দেখতে চাই সেভাবেই দেখি । “( I think, therefore, I am).
কী সাংঘাতিক কথা! কি ভয়ানক ! এমন কথা ভাবতে গেলেই কেমন গা শির্ শির্ করে ওঠে । ২২ তারিখ বনাম ৩০ তারিখ দেকার্তের দর্শনের চুলায় ঢুকালে তা পুড়ে যে শিখা উঠবে তাকি একই হবে? না অন্য?
সেই মান্ধাতার আমলে ( ক্লাস ৮?) যখন মানুষ অন্য কিছু মুখস্ত করে , আমি খৈয়ামের শ দুয়েক রুবাই মুখস্ত করেছিলাম বিশেষ ইচড়ে পাকামীর তাড়নায়। তখনই যতদূর মনে পড়ে হ্যারল্ড ল্যাম্বের “ওমর খৈয়াম” উপন্যাসটি হাতে পড়েছিল। কী মুগ্ধই না হয়েছিলাম ওমর খৈয়ামের পাণ্ডিত্বে , কষ্ট পেয়েছিলাম যখন অন্ধ কূপমণ্ডুক গোষ্ঠী তার মানমন্দির পুড়িয়ে দিল আর তিনি সারাজীবনের সাধনালব্ধ জ্ঞানের সঞ্চয় ধ্বংস হয়ে যেতে দেখলেন। একবার তিনি মানমন্দিরের ছাদে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলেন মুক্ত আকাশের দিকে আর বিড় বিড় করে ভৃত্যকে বলছিলেন তার বোধের কথা, যে আসলে এই পৃথিবী স্থির নয় , ঘুরছে , সুতরাং এইযে দালানের ছাদে তারা দাঁড়িয়ে আছে তাও ঘুরছে। এই সাংঘাতিক কথা শুনে তার ভৃত্য কি ভয়টাই না পেয়েছিল , তার মনে হয়েছিল যে এক্ষুনি সে বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে পড়ে যাবে, সে চিৎকার করে বলেছিল :”হুজুর থামুন , আর বলবেন না, আমি ভয় পাচ্ছি, পড়ে যাবো” এই জাতীয় কিছু।
খৈয়ামের ভৃত্যের সেই ভয়ের চেয়ে দেকার্তের “বাস্তবে কিছু নেই , সব মায়া, আমাদের কল্পনা মাত্র “এই কথার ভয় আমাকে আরো বেশী কাবু করে। কেননা তাহলে তো খুব সহজেই বলা যায় : “কেউ কাকেও চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে না, এটা দেখার ভুল , অবাস্তব , মায়া “এবং আরও একটু বোকা হলে, “উন্নতি , মধ্য আয়ের দেশ, ডিজিটাল মিরাকল ,পদ্মাসেতু এগুলো ও কিছু নয় , সব মায়া।”
আরে ধ্যাত, কী মায়া, মায়া করছো ? এ মায়া সে মায়া নয়, এ দেকার্তের মায়া। হ্যাঁ, তুমি যদি মায়া সম্রাজ্ঞী Six Sky এর প্রশ্ন তোলো, আমরা তাকে নিয়ে আলোচনা করতে পারি , যত চাও, বাস্তবতার নিরিখে তিনি কখনই অপ্রাসঙ্গিক হন না। আমার জিভেও কোনহাড় নেই, টায়ার্ড হবে না। হ্যাঁ, অত্যন্ত প্রতাপশালী সম্রাজ্ঞী ছিলেন তিনি, তার আমলে মায়া সাম্রাজ্য সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছিল, কিন্তু তারপরে? সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল তার পরে। এই যে এত উন্নতি, জিডিপির সাঁই সাঁই উর্ধ্বগতি, মসজিদ, মাদ্রাসা, হিজাব, আমাদের দেশ টিকে থাকবে তো এত উন্নতির পরে?
প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ২২ তারিখ ( এক দিন) এবং ৩০ তারিখের (অন্য দিন) মধ্যে তফাত নিশ্চই কিছু আছে। আমার শুধু জানা নেই। মানুষের মনোজঙলে কখন কোন্ প্রানি হাটে তা সেই জঙলও কি সব সময় জানে? তাই প্রশ্নকর্তার কোনো একটি প্রশ্ন যে পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম হয় পরবর্তীতে সেই প্রেক্ষিত বদলে গেলে প্রশ্নটির গুরুত্বও বদলে যেতে পারে। অথবা প্রশ্নকর্তা কারণটি ভুলে যেতে পারে অথবা জাস্ট চেপে যেতে পারে।
প্রাচীন মিশরে ফেরাউন আর পুরোহিতদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দন্দ্ব দীর্ঘদিন। দু পক্ষেরই সম্পদ ছিল অফুরন্ত আর ক্ষমতা ছিল অসীম। সেই দ্বন্দের চুড়ান্ত পর্যায়ে কোনো এক ফেরাউন (রামসিস-১১?) ভাবলেন পুরোহিতদের শায়েস্তা করা দরকার। সিদ্ধান্ত নিলেন মন্দির আক্রমণ করে চিফ পুরোহিতকে (হেরিহর? ) ক্ষমতাচ্যুত করার। কিন্তু হেরিহরের হাজার চোখ, হাজার কান, তিনি খবরটা জানতে পারলেন এবং এমনভাবে কল কাঠি নেড়ে ব্যাপারটি সাজালেন যেন আক্রমণটি হয় একটি নির্দিষ্ট দিনে, কারণ তিনি জানতেন ঐদিন সূর্যগ্রহণ হবে। তার প্ল্যানমত তার পছন্দের দিনটিতে আক্রমণ শুরু হল। হেরিহর মন্দিরের চুড়ায় দাঁড়িয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন “আমি ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তোমরা আমার গায়ে হাত দিলে ঈশ্বর ( রা- সূর্যদেব) পৃথিবী থেকে সূর্য কেড়ে নেবেন। “
ফেরাউন বললেন “ও মিছে কথা বলছে , আমি ফেরাউনই হচ্ছি ঈশ্বরের প্রতিনিধি , তোমরা আক্রমণ চালাও”।
আক্রমণ শুরু হল, কিন্তু সাথে সাথে শুরু হল সুর্যগ্রহণ, সূর্য ঢেকে গেল, পৃথিবী নিমজ্জিত হল অন্ধকারে , সৈন্যরা ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ঈশ্বরের রাগ দেখে। ফেরাউন নিহত হলেন, হেরিহর ক্ষমতা দখল করে হলেন নতুন ফেরাউন।
এই গল্পের মাধ্যমে জানা গেল যে একটি দিন অন্য দিনের চেয়ে ছিল হেরিহরের জন্য লাভজনক এবং ফেরাউনের জন্য সর্বনাশা। সুতরাং ২২ তারিখ এবং ৩০ তারিখের মধ্য কখনও কখনও হতে পারে যুগান্তকারী পার্থক্য । আরও জানা গেল যে ক্ষমতায় বসে ফেরাউন ভেবেছিলেন তার শত্রু তার চেয়ে কম শক্তিশালী, কম প্রস্তুত বা কম বুদ্ধিমান। তিনি সম্ভবত জানতেন না যে শত্রু মিথ্যে কথা বলে অবিকল সত্য কথার মত করে। শত্রু যখন কথা বলে তার সত্য কথা এবং মিথ্যা কথার মধ্যেকার তফাত পুলসেরাতের পুলের মতই চিকন। আর সাধারণ মানুষ , রাজনীতিবিদদের সব চাইতে কাছের প্রানি- প্রজাতি ,ধাপ্পার জাউ গিলে খুব সহজে।
এত কিছু জানার পরেও যে প্রশ্নটি রইল অজানা : “কেন সে এই প্রশ্নটি করল ? “
কী জানি হয়ত আগামী ৫ হাজার বছরে তার উত্তরও বেরিয়ে আসবে ।
আমি রাতে যখন শুয়ে শুয়ে ভেড়া গুনি, অন্ধকার আমাকে প্রশ্ন করে কেন এই সব গাল গল্প ফেঁদে সময় নষ্ট করি? সফিস্টরা তো সুন্দর সুন্দর কথা বলতো, চার্বাকরা ও (চারুবাক থেকে চার্বাক) । সমাজে তারা কী অবদান রাখতে পেরেছে? আর যারা বেশি বেশি আদর্শ , দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের কথা বলে তারাই কি সামান্য পটকার আওয়াজে সবার আগে দৌড়ে ঝোপে পালায় না ? আমি উত্তর দিতে পারি না। আমার রোমের বদ সন্তান নীরোর কথা মনে পড়ে , সে তার গুরু সফিস্ট সেনেকাকে বলেছিল : “খুব তো সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, বলেন মৃত্যুকে ভয় পান না এবং নিজের ন্যায়মতকে প্রতিষ্ঠা করতে জীবন পর্যন্ত দিতে পারেন। এই তো বিষের পাত্র সামনে, প্রমাণ করুন যে মৃত্যুকে আসলেই ভয় পান না।”
নীরো এবারও ভুল করেছিল , তার গুরু বিষের পাত্র পান করে শিষ্যের ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু তাতেই কী এসে যায় ?
নীরো নীরোই থাকে এবং যুগে যুগে সেনেকারা এসে বিষ পান করে যায়।
================================================
================================================
================================================
পাদটিকা : যে বিষয় গুলো এখানে আলোচনা করা হয়েছে:
*ব্রহ্মা : ৪ মুখ বিশিষ্ট- আমি চৌমাথা বলেছি
*সতীদাহ প্রথা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী ও ভলতেয়ারের “জাদিগ”.জাদিগে জানতে পাই সতীদাহ প্রথার আবিষ্কারক আমরা নই, সাইথিয়ানরা।
*লীথি নদী: গ্রীক মিথ, পূনর্জন্ম লাভের আগে মানুষকে এই নদীতে স্নান করানো হতো যাতে তার পূর্বজন্মের কোন স্মৃতি মনে না থাকে।
*দেকার্ত – আমি যা উল্লেখ করলাম দেকার্তের দর্শন হিসাবে তা কানাকে বক দেখানোর মতই , তার দর্শন এত সহজ নয়। পডুন : Mind body dualism, Evil genius or demon
*ওমর খৈয়াম উপন্যাস যতদূর মনে পড়ে হ্যারল্ড ল্যাম্ব, ক্লাস এইটে পড়া,পেলে পন্চান্নতে আবার পড়তাম ।
*Wikipedia এবং বুরতোমেয়েভ বিশ্ব ইতিহাস (রুশ)
*পোলিশ লেখক বলিস্লাভ প্রুসের অনবদ্য ঐতিহাসিক উপন্যাস “ফেরাউন” পড়েছিলাম ৮০ দশকে রুশ ভাষায়*সফিস্ট দার্শনিক সেনেকা ও নীরো
(শাহাব/মে ১-২,২০১৬)
প্রতিটা লাইনে কি সুন্দর করে জ্ঞান সাজানো রয়েছে এই ধরনের লেখা পড়লে যেন শুধু পড়তেই ইচ্ছা করে। সব মর্ম বোঝার বোধগম্যতা নেই আমার তবে আমি মুগ্ধ হই এমন লেখা পড়ে।