তিনি ছিলেন জিশুর অস্বীকারকারী, ট্রিনিটিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ক্যাথোলিক চার্চের ট্রান্সসাবস্ট্যান্টিয়েশনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। মহাবিশ্ব সম্পর্কে তার ধারণাগুলোকে মনে করা হতো বাইবেল বিরোধী , সে সময় তার অসীম মহাবিশ্বের ধারণা ছিল বিপজ্জনক একটি মতবাদ! কিন্তু অসীম মহাবিশ্বের ধারণার সাথে হেরেসি বা ধর্মবিরোধীতার কী সম্পর্ক ছিল? কেন অসীম ইউনিভার্সে বিশ্বাস করার কারণে জিশুর অস্তিত্বে আঘাত এসেছিল? এর উত্তর হলো যদি মাল্টিভার্সে প্যারালাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থেকে থাকে তবে এক একটি ইউনিভার্সে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা, ভিন্ন ভিন্ন জিশু, ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর। অসংখ্য মহাবিশ্বের মানুষের জন্য অসংখ্য জিশু ও ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়! যা বাইবেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না!

          আমার এ বক্তব্য ঠিক হোক অথবা ভুল আপনি শুনলে হয়তো শিউরে উঠবেন, ম্যানিওয়ার্ল্ডের অস্তিত্বে বিশ্বাস ব্রুনোর ট্রায়ালের সময় গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। একদিকে তিনি জিশুর অস্তিত্বে অস্বীকার করেছেন আবার অন্যদিকে তিনি ম্যানিওয়ার্ল্ডসের ধারণা দিয়ে জিশুর অস্তিত্বকে অপমানিত করেছেন, অপমানিত করেছেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে! অব ইনফিনিটি ইউনিভার্স অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড নামক গ্রন্থে ব্রুনো সুস্পষ্টভাবে তার অসীম মহাবিশ্বে বিশ্বাসের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মহাকাশে অজস্র নক্ষত্র ও গ্রহ আছে। আমরা সূর্যকে দেখি কারণ সূর্যের আলো আছে। আমাদের পৃথিবীর মতো মহাকাশে এমন অনেক গ্রহ আছে যাদের কোনো আলো নেই, আর তাই আমরা সেগুলোকে ডিটেক্ট করতে পারি না। সে সকল আলোহীন অজানা গ্রহেও স্বাধীনভাবে জীবনের বিকাশ ঘটতে পারে, তৈরি হতে পারে বুদ্ধিমান জীবন।

          হাজার হাজার বছর মানুষ প্রশ্ন করেছিল, রাতের আকাশ কেন অন্ধকার? তারা জানত না এ প্রশ্নের উত্তর। যারা মিশরের পিরামিডের মতো জটিল মার্বেল তৈরি করেছিল তারা জানত না মস্তিষ্ক অস্তিত্বশীল। পিরামিডের নির্মাতারা এমনকি মন অথবা কনসাসনেস নামক শব্দটির সাথেও ভালোভাবে পরিচিত ছিল না। আজ আমাদের কাছে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুবই সহজ সে প্রশ্নগুলো ভাবিয়েছে আমাদের পূর্বসূরীদের ৭০ হাজার বছর। আপনি যদি কেবল এ প্রশ্নের উত্তর জানতে পারেন, রাতের আকাশ কেন অন্ধকার তবে আপনি জানতে পারবেন মহাবিশ্ব কত বিশাল আর আপনি এটাও জানতে পারবেন এর হয়তো একটি শুরু ছিল। রাতের আকাশ কেন অন্ধকার এ প্রশ্নের প্রথম উত্তর দিয়েছিল একজন কবি যার নাম পু। ধারণা করা হয় তিনিই ছিলেন পরোক্ষভাবে মহাবিস্ফোরণ ধারণার পূর্বপুরুষ। তিনি বলেছিলেন, রাতের আকাশ এ জন্যই অন্ধকার কারণ বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রগুলো থেকে এখনো এ পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছায়নি, আমাদের মহাবিশ্বের ঘটনা দিগন্তের (46.5 লাইট ইয়ার্স) বাহিরেও অসীম মহাবিশ্ব উপস্থিত, মহাবিশ্বের সে সকল এলাকা আমরা দেখতে পাই না কারণ সেখান থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর সময় চলে যায়, এর অর্থ হলো মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে, মহাবিশ্বের একটি অংশ অন্যটি থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে সরে যাচ্ছে, তারা একে অন্যকে ছেড়ে তের বিলিয়ন বছর ধরে সম্প্রসারিত হচ্ছে! এখান থেকেই আমরা বুঝতে পারি, নিশ্চয় অতীতে গ্যালাক্সিগুলো ক্লোজ ছিল, কোনো একটি ফোর্স তাদের আলাদা করে দিয়েছিল আর সেটাই ছিল বিগব্যাং! মহাবিশ্ব সাড়ে তের বিলিয়ন বছর পূর্বে একটি অসীম ক্ষুদ্র ঘণীভূত দশা থেকে বিস্ফোরিত হয়েছে, তের বিলিয়ন বছর ধরে মহাবিশ্বের একটি অংশ অন্য অংশ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

          ইনফ্ল্যাশন থিওরি অনুসারে, স্পেস প্রসারিত হয়েছিল আলোর গতিতে।। মহাবিশ্বের একটি অংশ অন্যটি থেকে আলোর গতিতে দূরে সরে যায়। ৬৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ বা তারও দূরের ইউনিভার্সগুলো থেকে ১৩ বিলিয়ন বছর হয়ে গেল এখনো আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছায়নি! আর এজন্যই রাতের আকাশ অন্ধকার! রাতের আকাশ এজন্যই অন্ধকার কারণ মহাবিশ্বের বয়স সসীম, রাতের আকাশ এজন্যই অন্ধকার কারণ তের বিলিয়ন বছরে আমাদের কাছে মহাবিশ্বের অজানা অংশগুলো থেকে আলো এসে পৌঁছায়নি , আমরা যখন রাতের আকাশের দিকে তাকাই আমরা স্বয়ং তাকিয়ে থাকি সাড়ে তের বিলিয়ন বছর অতীতের সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টের দিকে , যার আর গভীরে আমাদের মস্তিষ্ক প্রবেশ করতে পারে না!

রাতের আকাশ এজন্যই অন্ধকার কারণ আমাদের ইউনিভার্সের একটি সীমা আছে ! রাতের আকাশ এজন্যই অন্ধকার কারণ আমাদের এ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাহিরেও অনন্ত কোটি মহাবিশ্ব আছে। একজন অতি সাধারণ কবি উত্তর দিয়ে গিয়েছিলেন ব্রুনোর অসীম মহাবিশ্বের সত্যতার!

          আজ ইনফ্লেশনারী থিওরি, স্ট্রিং থিওরি ও এম থিওরি আমাদের বলছে, শুধু মাল্টিইউনিভার্স অস্তিত্বশীল হতে পারে তা নয়, প্রতিটি মহাবিশ্বের ফিজিক্স ও স্পেসের গঠন পদ্ধতিও পৃথক হতে পারে। আপনার এক মাইক্রোমিটার দূরত্বেই আর একটি মহাবিশ্ব থাকতে পারে কিন্তু আপনি সে ইউনিভার্সগুলো দেখতে পান না কারণ এ মাইক্রোমিটার আপনার ফোর্থ ডায়মেনশনাল জগতের এক মাইক্রোমিটার নয়, এ মাইক্রোমিটার হায়ার ডায়মেনশনের মাইক্রোমিটার।

          মৃত্যুর আগে ব্রুনোকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছিল, তার মতামত অস্বীকার করার জন্য কিন্তু তিনি অস্বীকার করেননি। আজকের এ স্বার্থপর পৃথিবীতে ব্রুনোর মতো উন্মাদ আর কে হতে পারে? কে আছে এই পৃথিবীতে যে অ্যান্ড্রোমিডার জন্য জীবন দেবে, যে পদার্থবিদ্যার আইনের জন্য জীবন দেবে, যে মাল্টিভার্সের জন্য জীবন দেবে? মাল্টিভার্স কী আমাকে চেনে আমি কে, ফিজিক্সের আইন কী আমাকে জানে আমি কে, তবে কেন আমাকে, ম্যানিওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিসের জন্য জীবন দিতে হবে? হ্যাঁ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারীর ২৬ তারিখ এক বড্ড উন্মাদকে ব্রুনোর মৃত্যুর ৪২২ বছর পর ঠিক একই নির্মতায় জীবন দিতে হয়েছিল। আর সে পাগল ছেলেটি ছিল, আমাদেরই ছেলে, আমাদের অভিজিৎ রায়। পাবলিক প্লেসে আমরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি। একজন সহজ সরল মহাজাগতিক মনকে আমরা সবাই মিলে অকালে খুন করেছি। অভিজিৎ রায়ের খুনের পেছনে কোনো ব্যক্তি মানুষ দায়ী নয়, সমগ্র বাংলাদেশ দায়ী। কারণ এটি একটি খুনি রাষ্ট্র। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীরা জেল থেকে পালিয়ে যে দেশে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারে, যে ঘটনাকে প্রোটেস্ট করে এদেশের মাটিতে একটি শব্দও উচ্চারণ করার সাহস কারও নেই, সে এক খুনি রাষ্ট্র। ওয়েয়ারের মতে ব্রুনোর লাস্ট ওয়ার্ড ছিল, I have a greater fear of being judged by the perverted judgment of you who sit there, than of the sentence you will pass on me। আবার ফ্র্যান্স লেখক ও দার্শনিক পিয়েরে বেইলের মতে ব্রুনোর লাস্ট ওয়ার্ড ছিল, Perhaps you pronounce this sentence against me with greater fear than I receive it। কিন্তু আমি জানি না, অভিজিৎ রায়ের লাস্ট ওয়ার্ড কি ছিল অথবা নীরবতা আর বিস্ময় ছাড়া সেদিন তার কোনো ভাষা ছিল কি না। আমি বিশ্বাস করি একদিন ফেব্রুয়ারীর ২৬ তারিখ এদেশে অভিজিৎ রায় দিবস পালিত হবে।
Reference:
1. “The Role of Magic in the Work of Giordano Bruno” by Hilary Gatti (2004)
2. “Giordano Bruno and the Hermetic Tradition” by Frances A. Yates (1964)
3. “Bruno’s Radical Cosmology and the Return of the Infinite” by Robert Fludd (2002)
4. “Giordano Bruno’s Cosmic Deification: The Role of the Poet and Philosopher” by Julia Conaway Bondanella (2014)
5. “Giordano Bruno’s Hermetic Infinities” by John Michael Greer (2005)