তালিবান কারা এবং কেনই বা তাদের নিয়ে এত ভীতি? কোথা থেকে এলো এই তালি*বান এবং তারা কী চায়? বিশ্ব সংবাদের নতুন শিরোনাম তালি*বান, তাই তাদের নিয়ে এই লেখাটি।
আপনারা সবাই জানেন তালি*বান শব্দের আক্ষরিক মানে হলো ছাত্র। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন তাতে কিছুই যায় আসে না কিন্তু পোশতু ভাষার তালি*বা#ন শব্দটি সারা বিশ্বে আতংকের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ইউনেস্কোর ভাষাশুমারির হিসেবে আফগানিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষ পোশতু ভাষায় কথা বলে। আফগানিস্তানের সাথে ইরান এবং পাকিস্তান সীমান্তের মানুষও এই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। ভাষাগত কারণেই তারা দুই দেশের সীমান্তে সহজে প্রবেশ করে তাদের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করে অনায়াসে ফিরে আসতে পারে। সীমান্ত এলাকা এতটাই দুর্গম যে সেখানে নিরাপত্তাবাহিনী পৌঁছাতেও পারে না, সুতরাং তা#লি@বান জঙ্গিরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ভয়ানক ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিত তালি%বা#ন ২০ বছর পরে সম্প্রতি পুনরায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে। তালি*বান রাজধানী কাবুলে প্রবেশের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জড়ো হয় দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য। অনেকে অবুঝের মত যেকোনভাবে বিমানে ঝুলতে থাকে ফলে বিমান টেকঅফ করার সাথে সাথে পাকা আমের মত টুপটাপ করে ঝরে পড়তে থাকে মানুষ। শূন্য থেকে পড়ে কয়েকজনের মৃত্যুও হয় এই মর্মান্তিক ঘটনায়। মৃতদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী একজন উদীয়মান আফগান ফুটবলারও ছিল। ছাত্র শব্দটি এত ভয়ানক হতে পারে কে তা জানত।
ইতিহাসের পাতায় আফগানিস্তান “সাম্রাজ্যের কবরস্তান” বলে সুপরিচিত। ইতিহাস বলছে খ্রিস্টীয় ১১ শতক থেকেই বিভিন্ন রাজা এবং তাদের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে আসছে। চারিদিকে স্থলবেষ্ঠিত হওয়ার পরেও কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক খেলা ও মতাদর্শের কারণে আফগানিস্তান সবার কাছেই আকর্ষনীয় রণাঙ্গন। ইতিহাসের ফিরে দেখা পৃষ্ঠায় পারস্য (বর্তমান ইরান) দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছিল আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আলেক্সান্ডার থেকে সিকান্দার কে চেষ্টা করেনি এই দুর্গম দেশ দখল করতে! যুদ্ধের পর যুদ্ধ জয় করেছে তারা আফগানিস্তান দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাদের কারোরই ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না।
মগধ বা বর্তমানের দক্ষিণ বিহারের শক্তিশালী মৌর্য সম্রাটও আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল এবং যথারীতি পরাজিত হয়েছিল। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা যা আজকের দিন পর্যন্ত বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মুঘল, ব্রিটিশ, সোভিয়েত এমনকি আমেরিকান সবাই চেষ্টার ত্রুটি করে নাই আফগানিস্তান দখলের জন্য কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাই। আফগানিস্তান হলো সেই পাগলা ঘোড়া যার পিঠে হয়ত ওঠা যায় কষ্ট করে কিন্তু বল্গা ধরে রাখা যায় না। তা#লি@বানের প্রত্যাবর্তন সেই অদম্য আফগানিস্তানের নতুন উদাহরণ যেখানে আমেরিকান সরকারের ২০ বছরের এত টাকা, প্রযুক্তি, জনবল, প্রাণহানি, প্রচেষ্টা সব ব্যর্থ হয়েছে।
কারা তা#লি@বান, কোথায় তাদের অবস্থানঃ কারা তা#লি@বান আর কী তাদের পরিচয় এবং সামরিক পদায়ন সেটা পরিষ্কার নয়। তা#লি@বা!ন আফগানিস্তানে যুদ্ধ করলেও কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তাদের নেতৃত্ব পরিচালিত হচ্ছে অন্যকোন অদৃশ্য স্থান থেকে। কঠোর গোপনীয়তা, নিয়মনীতির প্রয়োগ, আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে তা#লি@বান নেতৃত্ব তাদের অস্ত্র বহনকারীদের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তা#লি@বা!নি নেতৃত্ব সামরিকবাহিনীর মত অর্গানোগ্রাম মেনে চলে যার সর্বোচ্চ পদমর্যাদাকে বলে ‘রাহবারি শুরা’। কোয়েটা শুরা হিসেবেও নামটা অনেক প্রচলিত। তা#লি@বা!নের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের কোয়েটা নগরীতে মহম্মদ মোল্লা ওমরের হাত ধরে। ২০০১ সালে ইউএস আর্মি আফগানিস্তানে হামলার আগ পর্যন্ত মোল্লা ওমর তার সঙ্গীদের নিয়ে পাকিস্তানেই লুকিয়ে ছিল। ইউএস আর্মির হাতে মোল্লা ওমর নিহত হওয়ার পর তা#লি@বা!নের নিয়ন্ত্রণ যায় মোল্লা আখতার মহম্মদের কাছে। কিন্তু তার নেতৃত্ব বেশিদিন স্থায়ী ছিল না, ২০১৬ সালে ইউএস আর্মির বিমান হামলায় মোল্লা আখতার মহম্মদও নিহত হয় পাকিস্তানেই। বর্তমানে তা#লি@বা!নের নিয়ন্ত্রণ চলছে মৌলভি হবিতুল্লাহ আখুন্দজাদার নেতৃত্বে। সে এখন রাহবারি শুরার দায়িত্ব পালন করছে। রাহবারি শুরার রাজনৈতিক এবং সামরিক শাখা আফগানিস্তানের দখলকৃত অঞ্চলে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করছে।
তা#লি@বা!নের শাসনে মৌলভি হবিতুল্লাহ আখুন্দজাদার পদমর্যাদা হলো আমির আল-মুমিনিন যার সরালার্থ হলো বিশ্বাসীদের নেতা। তা#লি@বা!নের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ পদ। মোল্লা ওমর যখন তা#লি@বা!নের প্রধান ছিল তখন সে নিজের নামের সাথে এই পদবি ব্যবহার করত। মৌলভি হবিতুল্লাহ আখুন্দজাদা তিনজন সহকারীর মাধ্যমে রাহবারি শুরার দায়িত্ব পালন করে। তারা হলো মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা মুহম্মদ ইয়াকুব, তা#লি@বা!নের অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার এবং সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। সিরাজুদ্দিন হাক্কানি হলো হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা। হাক্কানি নেটওয়ার্কের গোয়েন্দা শাখা তা#লি@বা!ন এবং আল-কায়েদা আর পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার স্টেট ইন্টেলিজেন্সের সাথে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করে। তা#লি@বা!ন শাসনের বিরোধীতাকারীদের দমন করার দায়িত্ব সিরাজুদ্দিন হাক্কানির। মুহম্মদ ইয়াকুব তা#লি@বা!নের আদর্শগত এবং ধর্মীয় বিষয়ের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তা#লি@বা!ন আফগানিস্তান সরকারের ছায়া সরকার গঠন করে রাহবারি শুরার সদস্যরা সরকারের নিয়মিত মন্ত্রীসভার আদলে দায়িত্ব পালন করে। ছায়া সরকারের কাজ হলো তা#লি@বা!ন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সামরিক, শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং প্রচার ও প্রসার দেখভাল করা। সামরিক কমিশন তা#লি@বা!নের সবথেকে শক্তিশালী উইং। তারা দখলকৃত অঞ্চলের শাসনকর্তা এবং কমান্ডার নিয়োগ দেয় এবং সেখানে তা#লি@বা!নি শাসন কায়েম করে। তা#লি@বা!নের রাজনৈতিক কমিশনের দায়িত্ব পালন করছে আবদুল গনি বারাদার। গনি বারাদারই ২০২১ সালে কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তির ফলেই আমেরিকা ২০ বছর পরে আফগানিস্তানের ভূমি থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
তা#লি@বা!নের দুঃশাসন আর নৃশংসতা নিরসনে কবে জেগে উঠবে বিশ্বঃ
তা#লি@বা!ন বৈশ্বিক রাজনীতিতে সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ এখন, বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের ব্যানার হেডলাইন। ১৯৯০ সাল থেকে তা#লি@বা!নের উত্থান। আমরা আগেই জেনেছি আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে তা#লি@বা!ন মিলিশিয়াবাহিনী গঠিত হয় এবং সময়ের হাত ধরে সেই তালিবান আজ আফগানিস্তানের সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বিশ্বরাজনীতিতে অংশগহণের জন্য দরকষাকষি করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নান্দনিক আর খনিজ সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তান আসলেই বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চ আর এদেশের নিরীহ জনগণ সেই রঙ্গমঞ্চের উলুখাগড়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বরাজনীতি যখন পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের দুই মেরুতে বিভক্ত তখন আমেরিকা এবং রাশিয়া তাদের মতাদর্শের দিকে টানতে ব্যস্ত বিশ্বের অন্যসব দেশকে। আফগানিস্তান সেই রাজনীতির পাকদণ্ডী দেশগুলোর অন্যতম। অবিভক্ত রাশিয়ার সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় ছিল আর সেই কারণেই আমেরিকা আফগানিস্তানে রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করতে আফগানিস্তানের বিরোধীদল এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীদেরকে উসকে দিতে থাকে। ধর্মীয়ভাবে উগ্র তা#লি@বা!ন বাহিনী রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং কঠোর সামাজিক নিয়মনীতি আরোপ করে। তাদের দখলকৃত অঞ্চলে চালু হয় শরিয়া আইন। তা#লি@বা!নদের প্রথম রাজনৈতিক সফলতা আসে ১৯৯৪ সালে কান্দাহার দখলের মধ্য দিয়ে এবং যথারীতি তারা সেখানে প্রতিষ্ঠা করে শরিয়া আইন। সুপ্রাচীন কান্দাহার শহর আফগানিস্তানের দক্ষিণে অবস্থিত যেখান থেকে মধ্য এশিয়া পাকিস্তান এবং ভারতে প্রবেশের রাস্তা আছে ফলে কৌশলগত এবং ভৌগলিকভাবে কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং তার পৌত্র সম্রাট অশোক কান্দাহার শাসন করত, পরে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পারস্য এবং মঙ্গলীয়দের কাছে আর সর্বশেষ আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট দখলে নেয়।
অপরাজিত কান্দাহারের গল্পঃ
তালিবানের হাতে কান্দাহারের পতন আফগানিস্তানের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরেই বোঝা যাচ্ছিল গোটা আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করা তালিবানদের জন্য শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। পারস্যের শাসকদের বিরুদ্ধে মঙ্গোলীয় আক্রমণকারী চেঙ্গিস খানের আক্রমণে কান্দাহার নগরী ধংসপ্রাপ্ত হলেও পুনরায় বিকশিত হতে থাকে এবং ১৮ শতকে কান্দাহার আফগানিস্তানের রাজধানী হয়। এরপর ব্রিটিশ কান্দাহার তথা আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে আসে ১৯শতকে ততদিনে রাশিয়া এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে এদিকে তাদের ভারতীয় সাম্রাজ্য হুমকির মুখে পড়ে যায়। ব্রিটিশবাহিনীকে আফগানিস্তান ছাড়ার আগে ৯০ বছরে আফগানদের সাথে তিনটা যুদ্ধ সামাল দিতে হয়েছিল। ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ২০শতকে রাশিয়া আফগানিস্তানে তাদের মতবাদ কায়েম করার স্বপ্ন দেখে। মূলত আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করার অভিযান ব্যর্থ হলেই জেগে ওঠে তালিবান বিপ্লবের ঝাণ্ডা।
তালিবান শাসনের আগের আফগানিস্তানঃ
তালিবানের উত্থান শুরু হয় আফগানিস্তানের বাদশাহ মুহম্মদ জহির শাহ’র (১৯৩৩-১৯৭৩) আমলে। জহির শাহ ছিলেন তৃতীয় শাসক যারা চেষ্টা করেছিলেন কমিউনিস্ট রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে দেশ পরিচালনা করতে। প্রথম শাসক আমানুল্লাহ ১৯২৩ সালে আফগানিদের জন্য প্রণয়ন করলেন সংবিধান। ঘটনাচক্রে সেই বছরই মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুর্কিতে ইসলামি খেলাফতের পতন ঘটে। আমানুল্লাহ সংবিধানে নারী পুরুষের সমতা এবং সবধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেন কিন্তু এই উদার সংবিধানে ক্ষেপে যায় ইসলামপ্রিয় আফগান, তারা এক তাজিক নেতার নেতৃত্বে কাবুল দখল করে নেয়। ভিতু আমানুল্লাহ কাবুল উদ্ধারের চেষ্টা না করে রণে ক্ষান্ত দেয়। আমানুল্লাহ’র দুঃসম্পর্কের ভাই মুহাম্মদ নাদের শাহ অল্প প্রয়াসেই পুনরায় কাবুলের অধিকার নিতে সক্ষম হন। নাদের শাহ সোভিয়েত প্রভাবিত আমানুল্লাহর সংবিধান বলবত রাখেন কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ছেড়ে দেন মুফতি, মুহাদ্দিসদের উপর। কিন্তু মাত্র চার বছরের মাথায় তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। নাদের শাহ’র ছেলে জহির শাহ আফগানিস্তানকে দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং আমেরিকা-সোভিয়েত রাশিয়ার ঠাণ্ডাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই জহির শাহ আফগানিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে শাহ মাহমুদ খান এবং দাউদ খান দুইজন প্রধানমন্ত্রী জহির শাহ’র বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তালিবানের উত্থানে ভূমিকা রাখেন। অবাধ নির্বাচন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, উদারপন্থী সংসদ ইত্যাদি আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণেই জহির শাহ রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের কাছে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। ইসলামি মৌলবাদীদের সমর্থন নিয়ে দাউদ খান জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। দাউদ খান সোভিয়েত ইউনিয়নের কায়দায় আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং সেনাবাহিনী প্রচলন করলেন। তার শাসনামলে সোভিয়েত রাশিয়া মস্কো থেকেই আফগানিস্তানের নীতি নির্ধারণ করত। দাউদ খান আফগানিস্তানের নারীদের বোরখা এবং হিজাব ঐচ্ছিক এবং পর্দাপ্রথাকে নিষিদ্ধ করে দেন। সর্বক্ষেত্রে নারীদের অবাধ বিচরণে বিকশিত হতে থাকে আফগানিস্তান কিন্তু ধর্মীয় নেতা, রক্ষণশীল শ্রেণি দাউদ খানের উদার সমাজকে মেনে নিতে পারেনি।
গণতান্ত্রিক আফগানিস্তানঃ
জহির শাহ আফগানিস্তানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সুচনা করতে চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যে আফগান আইনসভা লয়া জিরগা থেকে অনুমোদন নিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। সেখানে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সুপারিশ করা হয়, নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ। নিম্নকক্ষের নাম ‘হাউজ অফ পিপল’ এবং উচ্চকক্ষের নাম ‘হাউজ অফ এল্ডার্স’। নিম্নকক্ষের সদস্যবৃন্দ সাধারণ নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত এবং রাজা তাদেরকে বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনসভার জন্য নিয়োগ দেন। এটাকে বলা যেতে পারে আফগানিস্তানের নিজস্ব কায়দার গণতন্ত্র। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালে আফগানিস্তানের আইনসভার দুইকক্ষেরই জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল।
এই গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া তৎকালীন আফগানিস্তানের মার্কসিস্ট থেকে শুরু করে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং মৌলবাদি সব রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ নিয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী মার্কসিস্ট গ্রুপ আর মাদ্রাসা এবং কাবুল ইউনিভার্সিটির ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামিক সোসাইটি, জামায়াতে ইসলামি ইত্যাদি রাজনৈতিক দল। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের সামাজিক সময়টা কেটেছে দুটি রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। সোভিয়েত ভাঙনের সেই উত্তাল সময়ে ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানে তালিবানের জন্ম।
পশতুনিস্তানের সংকটঃ
তালিবানের উত্তানের সাথে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জড়িত। সেটা হলো পশতুনিস্তানকে কেন্দ্র করে কিছু সংকট। পশতুনিস্তান বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, আফগানিস্তান আইনগতভাবে ভৌগলিক যে অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে পাকিস্তান সেখানের কিছু অংশ অধিকার করে বসে আছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমানা কিন্তু আগেই অ্যাংলো-আফগান ডুরান্ড লাইন চুক্তিতে মীমাংসিত ছিল। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের পশতু অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বিভাজন রেখার জন্য আফগানিস্তানের আমির আব্দুর রহমান খান ডুরান্ড লাইন সীমান্ত চুক্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান পাকিস্তানের কাছ থেকে পশতু দখল করার জন্য ১৯৬০ সালে সৈন্য প্রেরণ করেন কিন্তু আফগান সেনারা অচিরেই পরাজিত হয়। পশতুকে ফিরে পাওয়ার আশা এবং প্রতিশোধের আশায় দাউদ খান ক্রমশ সোভিয়েত বলয়ে ঢুকতে থাকেন। কিন্তু চারদিকে স্থলবেষ্ঠিত দেশটির জন্য এটা ছিল বিশাল সিদ্ধান্ত যার ফলাফল ভোগ করতে হয় দাউদ খানকেই চড়া মূল্য চুকিয়ে। একই দাউদ খান তিনি জহির শাহ’কে সিংহাসন চ্যুত করেন ১৯৭৩ সালে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে আসলেন। জহির শাহ’র সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ধারণা ইতিমধ্যেই ব্যর্থ প্রমাণিত। এদিকে আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট ঘরানার সেনা অফিসারদের সমর্থন ছিল দাউদ খানের উপর। জহির শাহ’র সংবিধানকে বিলুপ্ত করে আফগানিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী ঘোষণা দেয়া হয়। নতুন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দাউদ খান পশতুনিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর সাক্ষাত করেন।
চার বছর পরে ১৯৭৭ সালে আরেকটি নতুন সংবিধানের খসড়া উত্থাপিত হয় এবং লয়া জিরগা অনুমোদন দেয়। কিন্তু ততদিনে আফগানিস্তানে ক্ষমতার দখলকে কেন্দ্র করে বহুমুখী টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেছে। তখন আফগানিস্তান বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে দাউদ খান এবং তার পরিবার পরিবারকে হত্যা করার জন্য কয়েক দফায় হামলা চালানো হয়। আবারো মঞ্চে রাশিয়ার প্রবেশ, নতুন রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতা গ্রহণ করলেন কিন্তু ক্ষমতার কত্রিত্ব রয়ে গেল মস্কো। নতুন সরকার কিছু সংস্কার করলেন যেমন নারী পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা এবং সুদের কারবার নিষিদ্ধ করা। ভূমি এবং প্রশাসন কাঠামো সাজানো হলো রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির আদলে। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ে গেল। তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ইসলামিক দল। প্রথমে কাবুলে বিক্ষোভ দেখা যায়, তারপরে সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, আনাচে কানাচে সারাদেশে। সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের বিক্ষোভ দমন করে সেখানে পুনরায় নিজের পছন্দমত সরকার ন্যস্ত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের মধ্য দিয়ে রক্ষণশীল ইসলামিক দলের উত্থান। বিশ্ব রাজনীতির পরিক্রমা বড়ই বিচিত্র। আমেরিকা, পাকিস্তান এবং চীন ইসলামিক দলকে সর্বাত্মক সাহায্য করে সোভিয়েত রাশিয়াকে প্রতিহত করতে।
জিহাদের জন্য প্রতীক্ষাঃ
সোভিয়েত আক্রমণ বিভিন্ন আফগান রাজনৈতিক দলের জন্য বিরাট ধাক্কা এবং বৃহৎ শক্তি দেশগুলোর জন্য আলুপোড়া খাওয়ার মত সুখ অর্থাৎ দেশটির কৌশলগত অবস্থান নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা। রাশিয়ার আক্রমণের পরেই দেখা গেল প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে মুজাহিদিন। মুজাহিদিন একটা আরবি শব্দ যার মানে হলো যে সব মানুষ পবিত্র ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুজাহিদিনরা আফগানিস্তানের বিভিন্ন ইসলামি দলকে একত্রিত করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের সমর্থিত সরকারের উপর কয়েকবার হামলা চালায়। যখন মুজাহিদিন যোদ্ধারা আফগানিস্তানে একত্রিত হয় সোভিয়েত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে তখন মুজাহিদিনদেরকে সামরিক যোগান দেয়ার জন্য আমেরিকা পাকিস্তানের মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। চীনও জিহাদিদেরকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।
অর্থ আর সালাফি ইসলামের কঠোর ধর্মীয় মতবাদ আমদানি হলো সৌদি আরব থেকে। ইসলামিক আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে শক্ত জোটবদ্ধ যুদ্ধ। যারা অর্থ এবং সালাফি ইসলামের উগ্র মতাদর্শের শিক্ষা নিয়ে আফগানিস্তানকে সাহায্য করেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ওসামা বিন লাদেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে আমেরিকা, পাকিস্তান এবং সৌদি একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় পাকিস্তান আর্মির গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদেরকে সামরিক এবং প্রশিক্ষণ সহায়তা যোগান দেবে।
এখন সময় তালিবানেরঃ
পাকিস্তানি আইএসআই ৪০জন মুজাহিদিনকে এবং অন্যান্য উগ্রপন্থীদেরকে ছোট দলে ভাগ করে একইসাথে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার সমন্বয় করে যাতে সোভিয়েত এবং আফগান সরকারের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময় জিহাদি যোদ্ধার কোন ঘাটতি দেখা না দেয়, যাতে তারা যুদ্ধের মনোবল ফিরে পায়। প্রশিক্ষণে আইএসআই তাদেরকে ইসলামিক রক্ষণশীল এবং ইসলামিক উগ্রবাদী দুইটা দলে ভাগ করে যাতে ভবিষ্যতে কোন উদারপন্থীর স্থান না হয়।
১৯৮০ সালের দিকেই বহির্বিশ্বের কাছে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র এবং আফগানিস্তান থেকে তারা পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করার সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেন। পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। সোভিয়েত পক্ষ থেকে আফগান সেনাবাহিনীর জন্য সাহায্যও বন্ধ হয়ে যায়।
আফগান সরকারের তখন আইএসআই’র নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হওয়ার উপায় নাই, জিহাদিদেরকে প্রতিপালন ও অস্ত্র কেনার মত যথেষ্ট অর্থ নাই। উদারপন্থী আফগানিস্তানের এখানেই ইতি। আফগানিস্তানের সত্যিকার নিয়ন্ত্রণ সোভিয়েতের কেজিবি’র কাছ থেকে পাকিস্তানের আইএসআই’র কাছে চলে যায় আর পর্দার অন্তরালে কলকাঠি নাড়তে লাগল আমেরিকা এবং সৌদি আরব এবং এই দুই দেশই আইএসআইকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, কী এক অদ্ভুত খেলা!
সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবার পর ক্ষমতার রুটি ভাগাভাগিতে আফগানিস্তানে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, ফলে ধ্বসে পড়ে নজিবুল্লাহ’র সরকার। আইএসআই’র মদদ ও সমর্থনপুষ্ট কয়েকজন মুজাহিদিন দলের উর্ধতন কয়েকজন নেতা যৌথভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। কিন্তু তার ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ যেন নতুন মাত্রা পায়। মুজাহিদিন, মিলিশিয়া, জিহাদি প্রতিটা গ্রুপ নিজেদের মাঝে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় দেশজুড়ো নৈরাজ্য। আইন শৃঙ্খলা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে অপহরণ, লুট, ডাকাতি, খুন এবং দুর্নীতি সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে মাত্রাছাড়া।
এই নৈরাজ্য থেকে আফগানিস্তানকে বাঁচাতে ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানের স্থানীয় এবং পাকিস্তান থেকে আগত মাদ্রাসা ছাত্রদের সমন্বয়ে জন্ম নেয় তালিবান। তাদের নেতার নাম মুল্লা মহম্মদ ওমর যিনি ধার্মিক হিসেবে সুপরিচিত এবং সোভিয়েত হটানোর যুদ্ধে তার বীরত্ব খ্যাতি সবার জানা। তদুপরি ওসামা বিন লাদেনের সমর্থন ছিল তার উপর।
তালিবানি শাসনঃ
তালিবান প্রথমবারের মত বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয় কান্দাহার দখলের মধ্য দিয়ে। তারা স্থানীয় সরকারের পতন ঘটিয়ে কান্দাহারে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। ডাকাত নির্মূল করে শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং সেখানে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে সামরিক এবং সৌদি আরবের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেল বিপুল পরিমাণ। আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থান পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক সুবাতাস। যেহেতু তারা পাক-আফগান সীমান্তের পশতু সংকটের মীমাংসা করতে চায় না সেহেতু তালিবান উস্কে দেয়াই কূটকৌশলের কূটনীতি।
১৯৯৪ সালের দিকে আফগানিস্তান একটা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল দেশ যেখানে রাজনৈতিক স্থিরতা নেই। এমতাবস্থায় তালিবান কান্দাহারে প্রবেশ করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে। তারা আফগান শহর থেকে অপরাধ নির্মুল করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইসলামের শরিয়া আইন এতটাই প্রভাবশালী যে খুব দ্রুত গতিতে তালিবান বিস্তৃত হতে থাকে আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। দুই বছরের মাথায় তালিবান সেনাবাহিনীর কাছে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে নেয় এবং প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রাব্বানি’র সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে।
কাবুলসহ আফগানিস্তানের ৯০শতাংশ ভূমি দখলের পর বুরহানুদ্দিন নাম সর্বস্ব প্রেসিডেন্ট থাকলেন তাও আবার নির্বাসনে। ১৯৯৬ সাল থেকে তালিবান আফগানিস্তানের সরকার পরিচালনা করলেও পুরো কর্তৃত্ব স্থাপনের সংগ্রাম তখনও চলমান ছিল। আফগানিস্তানকে শাসন করা তালিবানের জন্য সহজ ছিল না, তারা কঠোর শরিয়া চালু করে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছ থেকে কোন স্বীকৃতি পায়নি। তাদের সামাজিক এবং শাসন রীতি বহির্বিশ্বের কাছে আফগানিস্তানের ভাবমূর্তি খুন্ন করেছে বিশেষত যেখানে নারীদেরকে সবকিছু থেকে বাদ দেয়ার ফলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে। বন্ধ হয়ে যায় নারীদের শিক্ষালাভের অনুমতি ও চাকরির সুযোগ। যথাযথ বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই জনসম্মুখে অপরাধীকে হত্যা, অনৈসলানিক স্থাপত্য, নিদর্শন ধ্বংস তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাহাড় কেটে বানানো বামিয়ানের বিশাল বুদ্ধমূর্তি বোমা, রকেটের আঘাতে ভেঙে ফেলার সময় বিভিন্ন দেশ নিন্দা জানায়, কোন কোন দেশ শিল্প নিদর্শন হিসেবে কিনে নিতে চায়। তালিবান আফগানিস্তানে গানবাজনা নিষিদ্ধ করে, দাড়ি শেভ করাকে ইসলাম বিরোধী ঘোষণা দেয় এবং দাড়ি ছোট রাখলে তাদেরকে কারাগারে পাঠায়। তাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থা পশতুন এবং শরিয়া আইনের সমন্বয়ে তৈরি যা খুব কঠোরতার সাথে মেনে চলা হয় এবং ভীষণভাবে ওয়াহাবিজম দ্বারা প্রভাবিত। সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মাদ্রাসার ছাত্ররাই মূলত আফগান তালিবানের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
তালিবান রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে ফুলেফেঁপে ওঠে ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা এবং পাকিস্তানের ভারত বিরোধী জঙ্গি প্রত্যক্ষ মদদে। তাদেরই একটা চক্র ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনের কাঠমুন্ডু থেকে দিল্লিগামী ১৭৬জন যাত্রীসহ একটা বিমান ছিনতাই করে। তালিবান প্রশিক্ষিত ছিনতাইকারীরা বিমানটিকে আফগানিস্তানের কান্দাহার নিয়ে যায় এবং ভারতের জেলে আটক মুশতাক আহমেদ জারগার, ওমর সাইদ শেখ এবং মাসুদ আজহার এই তিন মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গির মুক্তির দাবি জানায়।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত ছাড়া কোন দেশ তখন আফগানিস্তানের সরকারের ক্ষমতায় তালিবানকে সমর্থন দেয় নি। তালিবানি শাসনের চূড়ান্ত সময়ে তালিবান প্রায় পুরো আফগানিস্তান দখলে নিতে সক্ষম হয় কিন্তু তারপরেই তো ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তনকারী আমেরিকায় আল-কায়েদার টুইন টাওয়ারে হামলা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় প্রায় ৩০০০ হাজার মানুষ নিহত হয়। হামলার তাৎক্ষণিক জবাবেই আমেরিকা এবং ন্যাটো যৌথবাহিনী আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। আল-কায়েদাকে উচ্ছেদ করতে এলেও তালিবানদের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ে, অনেকে নিহত হয়, কৌশলগতভাবে তারা প্রায় ২০ বছর পিছিয়ে যায়।
তালিবানের পতনঃ
আফগানিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনায় তালিবানকে পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য দেনদরবার করলেও জাতিসংঘ তাদের আবেদন নাকচ করে দেয়। বরং জঙ্গিবাদকে আশ্রয় এবং প্রসারের জন্য তালিবান শাসনের উপর অবরোধ আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে আসছিল টুইন টাওয়ারে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ওসামা বিন লাদেন তালিবান আশ্রয়ে আফগানিস্তানে নিরাপদে আছে।
কিন্তু তালিবান নেতারা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত হয় না। জাতিসংঘ ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সালে জঙ্গিবাদের লালনপালন ও প্রশিক্ষণের অভিযোগে অবরোধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ওয়াহাবি প্রভাবের কারণে তালিবানরা শিয়াদেরকে মুসলিম থেকে বিচ্যুত মনে করে ফলে তাদের ইরানের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ইরান আল-কায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দেয় না। তালিবান টিকে ছিল মূলত মাদক উৎপাদন, চোরাকারবারি এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের উপর ভিত্তি করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোবাহিনী আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাটিতে অবস্থান নিয়ে আবারও তালিবানের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে বলে কিন্তু এবারেও তারা সম্মত হয় না। ফলে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু হয়, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আসতেই তালিবান তাদের শক্তঘাটি কান্দাহার ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তালিবান বিরোধী একটা রাজনৈতিক দল জার্মানিতে মিলিত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে।
হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০১ সালে থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন। ২০০৪ সালের নির্বাচনে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, সেই ভোটে নারীরাও ভোট দেয়ার সুযোগ পায় এবং তাঁর শাসন মেয়াদের শুরুতে লয়া জিরগার অধিবেশনে নতুন সংবিধান অনুমোদন করেন। হামিদ কারজাইয়ের পিতা এবং পিতামহ দুজনেই জহির শাহ’র সরকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হামিদ কারজাই দেখেছেন আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। উত্তাল সময়ে তাদের পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে। ভারতে শিক্ষা শেষ করে কারজাই মুজাহিদিনদের সাথে মিশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গঠিত মুজাহিদিন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তালিবানের উত্থান সময় কারজাই এবং তাদের পরিবার পাকিস্তানে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই ১৯৯৯ সালে আততায়ীরা তাঁর পিতাকে হত্যা করে। হামিদ কারজাইকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার কারণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাকে মনে হয়েছে তালিবানের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে। তার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দেখে মনে হয়েছিল আফগানিস্তানে বুঝি তালিবানের ভয়াবহতার সমাপ্তি হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয় ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তারা আফগানিস্তানে থাকবে এবং এখানে প্রতিষ্ঠিত করে যাবে ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক পাশা খেলার ছক।
আফগানিস্তানে অভিযান শুরুর ১০ বছর পর ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পায় পাকিস্তানে, রাতের আঁধারে বিশেষ কমান্ডো অপারেশনে সেনানিয়ন্ত্রিত শহর অ্যাবোটাবাদের একবাড়িতে।
তালিবানের পুনরুত্থানঃ
২০১৮ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে তালিবান আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার আফগানিস্তানে আবার তালিবান পুনরুত্থানের হুমকিতে পড়ে যায়।
২০১৯ সালে আফগানিস্তান সরকার স্বীকার করে যে আশরাফ গনির ৫ বছর শাসনামলে তারা ৪৫,০০০ নিরাপত্তাকর্মী হারিয়েছে কারণ চারিদিকে তালিবানের হামলা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারে তালিবান এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের মধ্যে কয়েকদফা আলোচনা হয়েছিল, অবশেষে একটা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৈন্য প্রত্যাহার তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
যুক্তরাস্ত্র-তালিবান যুদ্ধে আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কিন্তু এই যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশেও তালিবানের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য জিহাদি যোদ্ধা এবং অর্থের অভাব হয়নি। পাকিস্তানের মাদ্রাসা এবং আফগানিস্তানের ধর্মীয় বয়ানের কারণে জিহাদি যোদ্ধার যোগান অফুরন্ত। আফগানিস্তানে আমেরিকান উপস্থিতি হটানোর যুদ্ধে দেশের মধ্য থেকেই তারা সাহায্য পেয়েছে প্রচুর। যদিও পাকিস্তান, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার ইত্যাদি সবদেশের সরকার তালিবানকে অর্থ সাহায্য দেয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে তবুও বিভিন্ন মাধ্যম ঘুরে সাহায্যের যোগান কখনো থেমে থাকেনি। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালে তালিবান মাদক বিক্রি থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে দেশটির মোট আয় ছিল ১.৫ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং যখনই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় তখনই সরকারি কর্মকর্তা, নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা করতে তালিবানের প্রস্তুতি গ্রহণ শেষ। সরকারি কর্মকর্তা, সেনাদের মাঝে আতংক, ভয় ঢুকানোর জন্য নৃশংসভাবে হত্যা করতে তারা ঐতিহাসিকভাবে সিদ্ধহস্ত।
কীভাবে তালিবানের পুনরুত্থান ঘটলঃ
আমেরিকা-ন্যাটো যৌথজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তালিবান কখনোই অস্ত্র ত্যাগ করে নাই। মুখোমুখি যুদ্ধে তারা আমেরিকান সেনাবাহিনীর কাছে সাময়িক পরাজিত হলেও মুহুর্তেই গেরিলা যুদ্ধে চলে গেছে। তালিবান জিহাদিরা ২০০১ সাল থেকে খুব ধীরে, সুপরিকল্পিতভাবে সরকারি স্থাপনা, সেনাঘাটি, সামরিক অস্ত্র এবং গাড়ির উপর চোরাগোপ্তা হামলা করছে। তালিবান তাদের কৌশলে অত্যন্ত সফল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোবাহিনীর শক্তিশালী সেনা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাথে ২০ বছর যুদ্ধ করে টিকে থেকে শান্তিচুক্তি করা প্রকান্তরে তালিবানের বিজয়।
তালিবানের যা ক্ষতি হয়েছিল সেটা তারা দ্রুত পুষিয়ে নেয়, সংগঠিত হয়ে পুনরায় জিহাদি যোদ্ধা বাড়িয়ে নবোদ্যমে তারা আমেরিকান সেনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। ন্যাটোবাহিনীর উপর অতর্তিক হামলা করে তারা পাহাড়ের কোন গুহায়, উপত্যকার গ্রামে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল, এখন তালিবান পুনরায় তাদের আফগানিস্তান দখলের পরিকল্পনা সাজায়।
শান্তিচুক্তি সম্পাদনের সময় আফগানিস্তানের ৪০০ জেলার মধ্যে ২০ শতাংশ জেলা নিয়ন্ত্রণ করত তালিবান। ৩৩ শতাংশ জেলা সররকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাকি জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ দখল নিয়ে সরকার এবং তালিবানের মাঝে টানাপোড়েন আছে। সম্প্রতি তালিবান ঘোষণা দিয়েছে আফগানিস্তানের ৮৫শতাংশ অঞ্চল এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণের সময় তালিবানের যে ক্ষমতা ছিল এখন তারা সেই অবস্থায় ফিরে গেছে। তারা ৫৫ হাজার যোদ্ধা নিয়ে আফগানিস্তান দখল করেছে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার তালিবান আফগানিস্তান দখলের সময় থেকে বর্তমানে তাদের যোদ্ধা অনেক বেশি।
তালিবান কি জনপ্রিয়?
উত্তর নির্ভর করছে কার কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে তার উপর। আফগান জনগণ সবসময় আতংকগ্রস্থ পরিবেশে বসবাস করে। সরকারের নিরাপত্তাবাহিনী আফগান নাগরিকদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে নিজেরাই ভয়ে পালিয়ে গেছে পাশের দেশে। পুনরায় আফগান দখলের সময় একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তালিবান জিহাদিরা ২০জন আফগান সৈন্য আত্মসমর্পনের পরেও সারিবদ্ধ গুলি করে হত্যা করছে। সাধারণ জনগণের মাঝে ভয় ঢুকানোর জন্য তারা এতটা নৃশংসতা প্রকাশ করে এবং তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়া ২০ বছর আগে তালিবান কীভাবে আফগানিস্তান শাসন করত।
আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান জরিপ করেছে আফগান নাগরিকদের মধ্যে তালিবানের সমর্থন এবং জনপ্রিয়তা আছে কী না। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এশিয়া ফাউন্ডেশন পরিচালিত ২০০৯ সালের একটা জরিপে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ তালিবানকে সমর্থন করে এবং তারা সরকারের দমনপীড়ন ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় প্রতিবাদ মুখর।
২০১৯ সালে আরেকটা জরিপে দেখা যাচ্ছে ১৫ শতাংশেরও কম আফগান নাগরিক তালিবানকে সমর্থন করে কিন্তু ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র-তালিবান শান্তি চুক্তির আভাস পাওয়ার সাথে সাথেই তালিবানের জনপ্রিয়তা, সমর্থন বাড়তে থাকে। তখন দেখা যায়, ৫৫ শতাংশ আফগান মনে করেন যে তালিবান ক্ষমতায় গেলেই আফগানিস্তানে পুনরায় আইন ও বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শান্তির সুবাতাস বইবে।
এই জরিপ থেকে বোঝা যায় আফগানিস্তানের মানুষ জানে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় এবং কেউ ক্ষমতার ভুল প্রান্তে থাকতে চায় না। জরিপ থেকে আরো বোঝা যায় তালিবানের ক্ষমতায় আসতে বেশি দেরি নেই। যুক্তরাষ্ট্র এদিকে আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে সৈন্য প্রত্যাহার করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোবাহিনী সৈন্য প্রত্যাহারের আগে তালিবানের সাথে শান্তিচুক্তিতে কিছু শর্ত আরোপ করে। যেমন জঙ্গিদের সাথে কোন আঁতাত করা যাবে না, নারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে হবে ইত্যাদি। তালিবান নারীদেরকে শরিয়তের বিধান এবং আফগানিস্তানের প্রচলিত আইন অনুযায়ী নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। একজন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে তৎকালীন সরকার সর্বজনীন নির্বাচনের মাধ্যমে আইনি বৈধতা দাবী করেছিল। কিন্তু তালিবান একজন ইমামের নেতৃত্বে আফগানিস্তানকে বানাতে চায় ইসলামিক রাষ্ট্র। আফগানিস্তান এখন সাংবিধানিকভাবে “ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান” নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার সাথে সাথে তালিবানের আফগানিস্তান দখলের পর একটা প্রশ্ন থেকে যায়ঃ যুক্তরাষ্ট্র যা অর্জনের জন্য আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল ২০ বছরে তাদের সেই উদ্দেশ্য কি পূরণ হয়েছে?
টুইন টাওয়ারে হামলার প্রধান অভিযুক্ত ওসামা বিন লাদেন নিহত, মোল্লা ওমরও আর বেঁচে নেই। তবে আল-কায়েদার কার্যক্রম এখনো সক্রিয়ভাবে চলছে। কয়েকবার মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পরেও আফগানিস্তানে বেঁচে আছে আয়মান আল-জাওয়াহিরি। তালিবান আবারও শক্তিশালী হচ্ছে। পাকিস্তান, আরব আমিরাত, সৌদি আরবের অব্যাহত সমর্থনে আফগানিস্তানে তালিবান আল-কায়েদার অনেক বড় আশ্রয়। খোরাসানের ইসলামিক স্টেটের পরে তালিবানের সমকক্ষ জিহাদি সংগঠন আর কেউ নেই।
কিন্তু সারা বিশ্বের জন্য চিন্তার জন্য রয়ে গেল তালিবান, কারণ তারা এখন ফিরে এসেছে এবং আফগানিস্তানের ক্ষমতায়।
সত্যের ✌ অনিবার্য!