লিখেছেন: Neel Arindam

১. মানুষ: দূর্বল দৈহিক কাঠামো

প্রকৃতিতে এইসব জিকা, সার্স, এনথ্রাক্স, স্মল-পক্স, প্লেগ, কলেরা, ইবোলা, এইচআইভি অরো শত ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া কী করে এলো!

এখন অবধি বিজ্ঞানীদের কাছে যে সব তথ্য আর প্রমাণ আছে, তার কোনটাই সুনিশ্চিত নয়। যা আছে, তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হাইপোথিসিস,  যদিওবা হাইপোথিসিস যে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুনোর জন্য নিজেও একটা একটি পদ্ধতি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে হাইপোথিসিস শুধুই উপসংহারে পৌঁছুনোর পথ, প্রমাণ নয়। নির্দিষ্ট বিষয়ে নতুন কোন প্রমাণ যোগ হলে, যদি হাইপোথিসিস এর ব্যাবহার শতাংশের বেশি হয় তখন তা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অপর দিকে হাইপোথিসিসের ব্যাবহার প্রমাণ এবং উদাহরনের চেয়ে কম হলে নতুন প্রমাণ হাইপোথিসিসের পক্ষে থাকার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু হাইপোথিসিস আর প্রমাণে ভিন্নতা শুধু নামে, বস্তুত হাইপোথিসিস না থাকলে আমরা আমাদের সৃষ্টি, আদি অন্ত বের করতে পারতাম না কোনকালেই। কিন্তু প্রতিটি হাইপোথিসিসে যোগ হয় নতুন শব্দ আর নতুন প্রমাণ। হাইপোথিসিস আর প্রমাণ অনেকটা সিরিজ আর সিকুয়েন্সের মতো। একটা ছাড়া অন্যটা অচল।

বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ বায়োলোজিস্ট একমত যে প্রকৃতি-তে প্রথম বিকাশ হয় কোষের, তারপর ভাইরাসের [১] কেননা জিন একই সাথে RNA এবং DNA ধারণ করে। সেক্ষেত্রে ভাইরাস শুধুমাত্র RNA। RNA এবং DNA সম্পর্কিত ধারনা পাবেন এখানে।

ভাইরাস এবং প্রান প্রকৃতির-ই দুটি ভিন্ন রূপ। প্রতিনিয়ত মিউটেশনের পথ ধরে প্রকৃতি প্রান ও ভাইরাসকে ডেভেলপ করেছে বিচিত্রভাবে। বায়োলজি নিয়ে আমার নিম্নতম জ্ঞান নেই। বিশেষ জ্ঞান থাকলে হয়তো সঠিক করে বোঝাতে পারতাম যে কীরকম পথে কিংবা কীরকম কাঠামোতে পরিবর্তিত হয়েছে প্রান আর ভাইরাস!

তবে গোটা বস্তু বোঝার চাইতে বোঝা জরুরি যে, আমাদের জীবনের কিংবা প্রকৃতিতে জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই! শুধুমাত্র ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের এককোষী প্রাণী আমরা, যারা প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য তাদের জিনেটিক কোড আর দেহকে পরিবর্তিত করেছে সময়ের সাথে।

নেইল্ ডিগ্রেস টাইসন বলেন, ’আমাদের পৃথিবীতে যদি পানির বদলে তরল নাইট্রোজেনের নদী থাকতো, তবে আমাদের প্রানের প্রধান উৎস আর কাঠামো হতো লিকুইড নাইট্রোজেন নির্ভর। অথবা যদি নাইট্রিক এসিডের সাথে গঠন মিলিয়ে আমাদের মিউটেশন ঘটতো, তবে আমাদের খাবারের প্রধান অংশ নির্ভর করতো নাইট্রিক এসিডের ওপর। এমন-ই বিচিত্র মিউটেশন। নেই কোন সুবিন্যস্ত কাঠামো।’

মানুষের কথাই ধরা যাক! আমাদের শারিরিক গঠন বিশ্লেষন করলে, আমাদের শরীর খুবই আনব্যালেন্সড কাঠামোতে তৈরি। আমারা একই সাথে নিশ্বাস নিতে এবং ঢোক গিলতে পারিনা, যেমনটা তিমিরা পারে। আমাদের চোখের রেটিনা ইনসাইড আউট, যা কিনা স্কুইটদের রেটিনাতে নেই। আমাদের দাঁতের পাটি, যেখানে আমাদের বেশিরভাগ দাঁত-ই সঠিকভাবে কাজের নয়, যেখানে আমাদের চাইতে হাঙ্গরেরা এগিয়ে। আমাদের স্পাইনাল কর্ড সোজা, যেখানে কুকুরেরা আমাদের চাইতে এগিয়ে। আমাদের পায়ে ২৬টির মতো হাড় আছে, যেখানে উটপাখি এগিয়ে। এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, আমাদের মস্তিস্ক শরীরের অনুপাতে এতটাই বড় যে, বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের কমপ্লিকেশন তৈরি হয়েছে। আমরা জানি না কেন আমাদের দেহে এপেনডিক্স থেকে যাচ্ছে। আমাদের স্টমাক এর চারপাশে কঠিন আবরন নেই, যা বেশিরভাগ প্রানীর থাকে। পুরুষদের শরীরে নিপল, সেল ডিভিশনে গন্ডগোল, আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রিজেনারেশন না করার ক্ষমতা; ইত্যাদি। তাই আমরা প্রকৃতির সেরা জীব না কোনভাবেই। আমাদের শুধুমাত্র মস্তিস্ক বড়! তাই প্রথমেই ভাবতে হবে, আমরা শুধুমাত্র প্রকৃতির অংশ এবং অন্যসকল জন্তু জানোয়ারের মতো আমরাও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক জীব। [২]

কিন্তু আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গিয়েছি নানা ভাবে। এর প্রধান কারন আমাদের মানব ইতিহাসের সবচাইতে বড় আবিষ্কার। আপনি চাকা কিংবা স্টিম ইঞ্জিনের কথা ভাবছেন কী! তাহলে ভুল ভাবছেন, চাকা কিংবা স্টিম ইঞ্জিন আমাদের যুগান্তকারী আবিষ্কার অবশ্যই। কিন্তু এইসব আবিষ্কারের মূলে রয়েছে আবিস্কার করার জন্য ভাবনা আর তথ্যের যোগান যা আমাদেরকে দিয়েছে চাষ পদ্ধতি আর সামাজিকীকরণ এর মতো ব্যাবস্থা।

তাই মানব জাতির সবচাইতে যুগান্তরকারী, বলা যেতে পারে পৃথিবী বদলানো আবিষ্কার; সেটা হচ্ছে চাষ পদ্ধতি আর সামাজিকীকরণ। আজকের দিনে কোন খামার, কোন একজন কৃষক আমাদের সবার গোটা মাসের খাবার চাষ করছেন বলেই আমরা ভাবতে পারছি মহাবিশ্ব নিয়ে। আমরা করতে পারছি নতুন নতুন আবিষ্কার! লিখতে পারছি, পড়তে পারছি কিংবা সকাল থেকে বিকেল অফিসের চেয়ার টেবিল নোংরা করতে পারছি। নয়তো আজকেও আমাদের চিন্তা করতে হতো কালকের খাবারের জন্য, আগামীকালের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। সকাল হলেই খাবার আর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হতে হতো। তখন জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকতো তাই। কাজেই কৃষকদের ধন্যবাদ। আবার ‍শুধুমাত্র এই চাষাবাদ আর বিশ্বায়নের মতো ব্যাপার মানব জাতির সাথে সূত্রপাত হয়েছে বলেই পৃথিবী বৈশ্বিক উষ্ণতা আর বৈশ্বিক দূষণের মতো ভয়ংকর পরিনতির সাথেও আমরা পরিচিত হতে পেরেছি।

 

মানব দেহের অনুমানিক সামঞ্জস্যকর কাঠামো

 

২. অপরিকল্পিত মানব সভ্যতা

২০১৯ আমাদের বৈশ্বিক উষ্ণতা ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অর্থাৎ আমরা প্রকৃতির প্রতি বিন্দুমাত্র যত্নশীল হইনি, উল্টো প্রহার করেছি চরম হারে।
এমন কোন রেকর্ড নেই যে কভিড-১৯ এই বৈশ্বিক উষ্ণতার ফসল।

কিন্তু এই উষ্ণতা বরফ গলার হারকে বাড়িয়ে দিয়েছে। গুণিতক হারে ৬ গুন। যা কিনা এই যাবৎকালে সর্বোচ্চ। এবং এতে করে সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়তে পারে ১৬ সেন্টিমিটিার অবধি এই শতাব্দীর শেষে। [৩] এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র ২০১৯ সাল অবধি গড় পরিসংখ্যানের হিসেবে।

২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গড়ে ৩.৫ মিলিমিটার হারে সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বেড়েছে, যা কিনা ১৯০১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের চাইতে ২.৫ গুণ হারে। [৪]

 

১৯৮০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গ্লোবাল ওয়ার্মিং রেকর্ড

এই উষ্ণতার একটা বিশাল অংশ সমৃদ্রের কোরাল-শ্রেণী কনজুম করে নিচ্ছে, যাতে করে বিষাক্ত শৈবাল-প্রবাল তাদের বংশ বৃদ্ধি করতে পারবে সর্বোচ্চ হারে।[৪]

 

আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পশ্চিম উপকূলে বিষাক্ত শৈবালের কারনে ১১ মাস স্টেট অব ইমার্জেন্সি ঘোষণার অনুরোধ করেন বিজ্ঞানীরা। [৫]

আমাদের; মানুষের করা প্লাস্টিক, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অলো, পারমানবিক চূল্লি, পানির অপব্যাবহার এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এইসব বর্জ্য যে কোন স্থানে ফেলে এত বছর ধরে আমরা যে প্রকৃতিকে নিয়মিত ঝুকিপূর্ন করে তুলেছি; আজকের এই পৃথিবী তারই উদাহরণ।

প্লাস্টিক, রাসায়নিক, পারমানবিক, দাহ্য পদার্থের ব্যাবহার কন্ট্রোল করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই! নয়তো সেই দিন খুব কাছে যে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মৃত্যু অবধারিত। পাশাপাশি বিকলাঙ্গ ও জরাগ্রস্থ সন্তান প্রসব, শারিরিক অসুখ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শেষ করে দিতে পারে খুব সহজেই।

আমাদের, মানবসভ্যতা সহ পৃথিবীর মোস্ট অপ স্পেসিসের ধ্বংসের আরেকটা সম্ভাবনা গাঢ় করে ব্যাকটেরিয়া। অবশ্যই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া। [৬]  ব্যাকটেরিয়া দিন দিন এন্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছে, নতুন কোন শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক বাজারে না আসলে, আগামী ২০০ বছরে পৃথিবীতে ‍শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়ারা বেঁচে থাকবে। ব্যাকটেরিয়ারা খুব সহজেই এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স হয়ে উঠতে পারে। এমনকি যে ব্যাকটেরিয়ারা এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স হয়েছে, তারা অন্য প্রজাতির ব্যাকটেরিয়াকেও সরাসরি তার রেসিস্টিভিটি দিতে পারে! [৭]

এভাবে করে প্রতিটি ব্যাকটেরিয়া হতে পারে বহু এন্টিবায়োটিকের রেসিস্ট্যান্স। এটা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির বা বাহকের ক্ষেত্রে। এবার গ্লোবালি ভাবুন। আপনার শরীরে ধরে নিন ৩ টি এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া আছে, এবং আমার শরীরে আছে ২টি এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া। এখন পরস্পরের সাথে সেক্সের মাধ্যমে, শারিরিক কন্টাক্টের মাধ্যমে; ইভেন হাঁচি, কাশির মাধ্যমেও এক বাহক থেকে অন্য বাহকের শরীরে ব্যাকটেরিয়ার অদান প্রদান হয়। এভাবে করে দুইজন অথবা একাধিক মানুষই কিন্তু সবগুলো এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া প্রহন করলো এবং প্রদান করলো। তখন এই নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যাক্তিদের শরীরে সেইসব এন্টিবায়োটিক কাজ করবে না। এভাবে আমরা প্রতিদিন অসংখ্য ব্যাকটেরিয়াকে করে তুলছি এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স হবার প্রসেসটাও খুব বিচিত্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ঠিকমতো প্রয়োগ ও ব্যাবহার সময়সীমা হেরফের-এর কারনে। কিন্তু বাহকের শরীরে এক বা একাধিক এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া থাকার কারনে ও বংশবিস্তারের ফলে। পামাপাশি আমার আপনার আশেপাশের ব্যক্তিরদের দ্বারা। একটা মজার তথ্য দেই বিশ্বে ৪৭ মিলিয়ন এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইবড ককরে প্রয়োগ করা হয় গুরুতর কোন কারন ছাড়াই, শুধুমাত্র ঠান্ডা সর্দি ফ্লুতে। [৮]

৩. ক্লাইমেট চেঞ্জ- বৈশ্বিক উষ্ণতা, দূষণ, পুঁজিবাদগ্রস্থ সমাজ

২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গড়ে ৩.৫ মিলিমিটার হারে সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বেড়েছে, যা কিনা ১৯০১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের চাইতে ২.৫ গুণ হারে। ৪

এর মানে হচ্ছে, বিগত শতাব্দীর ৮৯ বছরে না যতটুকু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার চাইতে ১০ বছরে আমরা পৃথিবীর ২.৫ গুন ক্ষতি করেছি। শুধু মানবিক কারনে একবার ভেবে দেখুন, গত শতাব্দীতে দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ গিয়েছে পৃথিবীর ওপর, পাশাপাশি কত শত যুদ্ধে কত সহস্র কার্বন নিঃস্বত হয়েছে। কত সিলেনিয়াম, সিলিকন বায়ুতে মিশেছে! কিন্তু তার চাইতেও আমরা শুধুমাত্র ১০ বছরে বিশ্বায়ন, নগরিকায়ন আর কলকারখানা দিয়ে, তার চাইতে বেশি ক্ষতি করেছি পৃথিবীর। আলো, কার্বন, পানি, মাটি, আর বায়ু দূষণের মাধ্যমে।

এন্টার্টিকা! পৃথিবীর সমস্ত বরফের তিন ভাগের দুইভাগ ধারন করে আছে। শুধুমাত্র বরফ-ই না, এন্টারটিকা ধারন করে আছে, কোটি বছর অগের অনুমানিক ৪০ মিলিয়ন বছর আগের ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াও!

এন্টার্টিকায় বরফের লেয়ার: ২ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার অবধি পুরু [৯]

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারনে সাগরে কোরালে যেমন প্যারাসাই আর শৈবালের হার হমে যাচ্ছে, আর বাড়ছে বিষাক্ত শৈবালের সংখ্যা। যে কারনে মাছেরা এবং ডিপেন্ডেড প্রাণীকূল প্রতিকূলে পড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে অন্যসব প্রানী, এমনকি মানুষেরও টিকে থাকার অশঙ্কা। তেমনি এন্টার্টিকা তার বরফের নিচে দাফন করে রেখেছে হাজার রকমের ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস। যার বেশির ভাগ বিজ্ঞানীদের অপরিচিত।

এমনই এক ঘটনা ঘটে রাশিয়ার সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চলে। ১৬ বছরের এক বালক হঠাৎ করে মারা যায়, এবং সেই বালকের সংস্পর্শে থাকা ২০ জন ব্যক্তি হসপিটালাইসড হয় অসুস্থতা নিয়ে। পরবর্তীতে জানা যায়, অনুমানিক ৭৫ বছর আগের জমে থাকা ভূপৃষ্ঠে এনথ্রাক্সের সংক্রমণে বালকের মৃত্যু হয়েছিল্।[১০] তার মানে সেই ৭৫ বছর আগের এনথ্রাক্স তখনো জীবিত ছিল, বরফের নীচে! কোল্ড ওয়ার-এর সময় কালে ১৯৪০ থেকে শুরু করে ১৯৭৯ সাল অবধি রাশিয়াতে ৭০০০ এর বেশি এনথ্রাক্স ভিক্টিমের কবর রয়েছে, মানুষ পশু নির্বিশেষে। ২০১৬ সালের বালকের মৃত্যু বরফ গলে যাওয়া এবং সেই দাফন হওয়া এনথ্রাক্সের ফসল।

এরকম আরেকটা ঘটনা এই বিবিসির জ্যাসমিন ফক্স-শেলীর আর্টিকেলটায় উল্লেখ আছে ২০১৭ সালের মে-তে প্রকাশিত। 1890 সালে সাইবেরিয়ার কলেইমা নদীর উপকূলে স্মলপক্সে ৪০% মানুষ মৃত্যুবরন করে। ১২০ বছর পরে ২০১১ সালে কলেইমা নদী থেকে RNA সংগ্রহ করার পর এবং সেই স্মলপক্সের সাথে ম্যাচ করে নাসা বিবৃতি দেয় যে ভাইরাসটি ৩২০০০ বছরের পুরনো।[১০]  এমন সহস্র ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া ভূগর্ভে দাফন হয়ে আছে এবং আচ্ছ্বাদিত হয়ে আছে বরফে। ইতিহাসে যখন যখন কোন এপিডেমিক এসেছিল, তখনকার অক্রান্ত মানুষ এবং প্রানীদের কবরে নিশ্চিন্তে আছে সেইসব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসেরা। এমনকি বিজ্ঞানীরা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর ভাইরাসও শনাক্ত করেছে সেইসব গনকবরের মাঝে থেকে। যা এখনো জীবিত এবং শুপ্ত অবস্থায় আছে। এখনো প্রায় সকল শ্রেনীর ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সুপ্ত আছে মৃতদের দেহে, সেইসব কবরে।

সাইবেরিয়ান ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চল, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া হিসেবে ব্যাবহারের জন্য বরফ গলে যাচ্ছে, অথবা ভেঙে ফেলা হচ্ছে; সেখান থেকে আরও অনেক প্রাননাশক ভাইরাসের দেখা মেলে। ২০১৭ সালে জিন-মিশেল ক্লেভারি এবং চ্যান্টাল আবিগাল, এমন অনেক ডেডলি বাইরাস নিয়ে কথা বলেন। তারা ৩০০০০ বছরের পুরনে এমন একটি ভাইরাসের সন্ধান পান সেখানে, যা কিনা এচআইভির চাইতেও [১০] গুন বেশি বড়।১১ পাশাপাশি তারা বলেন, ত্রিশ হাজার বছরের পুরনো ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার চাইতে গত শতাব্দীর সেইসব মহামারী প্রানঘাতী ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই বেশি। [১১]  ইতিমধ্যে স্প্যানিশ ফ্লুর ভাইরাস বিজ্ঞানীরা পুনঃজীবিত করতে সফল হয়েছে।

তেমনি এন্টার্টিকা তার বরফের নিচে ঢেকে আছে ৪০ মিলিয়ন বছর আগের ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া। যা কিনা প্রতিনিয়ত আমাদের তৈরি করা উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে, পুনঃজীবিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ের হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লেও ২০৪০ সালে, অটলান্টিকের সুমেরু সাগরে গ্রীস্মের সময় কোন বরফ থাকবে না। [১২]  অর্থাৎ কত বড় বিপর্যয়ের মুকোমুখি আমরা হতে যাচ্ছি সেটা সহজেই বোধগম্য। সেখানে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার হচ্ছে নতুন সব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস। যেসব ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস গোটা পৃথিবীর বেশিরভাগ স্পেসিসকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। Phocine distemper virus (PDV), ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো আইডেন্টিফাই করা হয়। তখন PDV সংক্রমণে প্রায় ১৮৩০০ সামুদ্রিক সিলের(হারবর সিল এবং গ্রে সিল) মৃত্যু নোট করা হয়েছিল। এবং এই সংক্রমণ থেমে নেই ।যা কিনা ক্লাইম্যাট চেঞ্জের সাথে বাড়ছে সমানতালে। [১৩]  শুধুমাত্র ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৩০ ভাগ সামুদ্রিক প্রাণী PDV সংক্রমিত হয়েছে। এবং মানুষের খাবারের একটা বড় অংশ সামুদ্রিক প্রাণী রিলেটেট।[১৪]  পাশাপাশি সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাস বিপর্যয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর উপর প্রভাব ফেলবে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
এইসবের একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে পৃথিবীর প্রতি, প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হওয়া। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ এবং বনায়নে সহায়তা করা। কিন্তু কে শোনে ভাই কার কথা! আমার সোনার হরিন চাই!

পুঁজিবাদগ্রস্থ সমাজ! এই কথা শুনে কার্ল মার্ক্স, মাওসেতুং এর সাথে সম্পর্ক জুড়বেন না যেন! কেন জুড়বেন না, তার বিশেষ কারন আছে। কিন্তু আজকের বিষয় সম্পূর্ন আলাদা। আমারা বিশ্বায়ন, নগরিকায়ন আর কলকারখানার বৃদ্ধির জন্য এতটাই মোহগ্রস্থ হয়ে উঠে পড়ে লেগেছি যে আমাদের বন-জঙ্গল ধ্বংস হয় হোক, হোক না হয় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি! অবশ্যই এর পেছনে ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত সবার-ই হাত আছে। যত বেশি কনজুমার, তত বেশি কারখানা তত বেশী চাষ।

সুমাত্রার রেইন ফরেস্ট অন্যতম প্রাচীন রেইনফরেস্ট। প্রানবৈচিত্রের এক বিশেষ অংশ এই জঙ্গল। পৃথিবীর প্রাচীন অনেক প্রাণীর বাস। অথচ আমাদের চাহিদা পাম ওয়েলে, চাহিদা খাদ্যে। পাম ওয়েলের জন্য পাম ট্রি চাষ করা বাধ্যতামূলক। আর পম ট্রি চাষ করতে গিয়ে হচ্ছে বন নিধন। বনের ভেতর গড়ে উঠছে সভ্যতা।

১৯৮৫ সাল থেকে ২০০০ সাল অবধি ৭০ ভাগ বন উজাড় করা হয়েছে

সমহারেও যদি সুমাত্রার বন নিধন হতে থাকে, তবে আগামী ১৫ বছরের ভেতর এই বন পুরোপুরি ধংস হয়ে যাবে। [১৫]  এবং কার্বন দূষণের হার কমানোর জন্য বন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চই আর নতুন করে আমাদের জানতে হবে না।

একই অবস্থা গোটা পৃথিবীর বনাঞ্চলে। প্রতিবছর মানুষের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ফসল চাষ, গবাদি পশুর চাষ, কাঠের চোরাচালান, বিশ্বায়ন ইত্যাদি কারনে ধ্বংস হচ্ছে বন। আমাজনের রেইনফরেস্ট ২০ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে ১৮৮৫ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত হিসেবে।১৬ ২০১৯ সালে সিএনএন এক রিপোর্ট অনুযায়ী আমাজন তার ২৪,০০০ স্কয়ার মাইল বন হারিয়েছে শুধুমাত্র মানুষের বন ধ্বংসের ফল হিসেবে। যা কিনা ১০.৩ মিলিয়ন ফুটবল মাঠের সমান জায়গা। সোজা বাংলায় বললে ১ কোটি ৩০ লক্ষ ফুটবল মাঠ। [১৭]

 

Natural Brazilian Amazon (Amazonia) by year [১৬]

এইসব বন-ই না শুধু! আমরা ভূগর্ভস্থ খনিজ মাত্রারিক্ত ব্যাবহার এবং অধিক মাত্রায় উত্তোলনের ফলে এই শতাব্দীর শেষে বেশিরভাগ খনিজ শেষ হয়ে গেলে অবাক হবেন না যেন। [১৮] এমন কি খাবার পানিও!

চায়না(চীন) যে হারে ডিসপ্রোসিয়াম (dysprosium), নিওডিমিয়াম (neodymium) এবং ল্যানথেনাম (lanthanum) এবং ম্যাগনেটিক পন্য ব্যাবহার করছে উঠতি কম্পিউটার, মোবাইল আর হাইব্রিড যানবাহন তৈরি করার জন্য, তাতে করে তাদের এই বিরল ধাতু ২০৩৭ সাল নাগাদ প্রায় শেষ হয়ে যাবে। [১৮]

আরও হাজারো দিক থেকে পৃথিবী ঝুকির মুখে। যার জন্য আমি আপনি আমরা সবাই, আমাদের অপরিকল্পিত জীবনযাপন এবং পুঁজিবাদী মনোভাব দায়ী।

তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে, এই কভিড-১৯ মোকাবেলা করতে পারলেও আপনি আমি আমরা পরবর্তী মহামারী মোকাবেলা করতে পারবো না। হয়তো!

 

তথ্যসূত্র:
১- https://www.nature.com/scitable/topicpage/the-origins-of-viruses-14398218/
২- https://brightside.me/wonder-people/10-mistakes-in-the-human-bodys-structure-that-pose-problems-for-us-494610/
৩- https://blogs.scientificamerican.com/eye-of-the-storm/earth-had-its-second-warmest-year-in-recorded-history-in-2019/
৪- https://www.sciencenews.org/article/ipcc-how-climate-change-already-altering-oceans-ice-future
৫- https://www.sciencenews.org/article/ipcc-how-climate-change-already-altering-oceans-ice-future
৬- https://www.cdc.gov/drugresistance/about/how-resistance-happens.html
৭- https://science.howstuffworks.com/environmental/life/cellular-microscopic/question561.htm
৮- https://www.cdc.gov/antibiotic-use/community/about/antibiotic-resistance-faqs.html
৯- http://www.antarcticglaciers.org/question/lake-vostok-exist-prior-antarctic-glaciation-formed-result-formation-ice-age/
১০- http://www.bbc.com/earth/story/20170504-there-are-diseases-hidden-in-ice-and-they-are-waking-up
১১- https://www.salon.com/2017/11/11/5-diseases-climate-change-may-awaken-from-melted-permafrost_partner/
১২- https://www.theguardian.com/environment/2007/mar/16/climatechange.climatechange
১৩- https://en.wikipedia.org/wiki/Phocine_morbillivirus
১৪- https://www.cbsnews.com/news/melting-arctic-ice-may-be-spreading-a-deadly-virus-to-spread-in-marine-mammals/
১৫- https://www.theguardian.com/world/2013/may/26/sumatra-borneo-deforestation-tigers-palm-oil
১৬- https://rainforests.mongabay.com/amazon/deforestation_calculations.html
১৭- https://edition.cnn.com/2019/12/30/world/amazon-deforestation-decade-soccer-fields-trnd/index.html
১৮- https://www.mining-technology.com/features/featuremined-into-extinction-is-the-world-running-out-of-critical-minerals-5776166/