লিখেছেন: সুমন বিশ্বাস
প্রশ্ন তোলা যায় যে বর্তমান করোনা ভাইরাস বিশ্বকে কেন স্থবির করে ফেলেছে, যদিও আগের মারাত্মক করোনা ভাইরাস SARS তা করেনি। অনেকে প্রশ্ন তোলেন যে সার্স’এর জন্য কোন ভ্যাকসিন যখন কখনই বিকাশ করা হয়নি তখন বর্তমান করোনা ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ করার জন্য কেন একটি ভ্যাকসিনের এত জরুরি প্রয়োজন? পূর্ববর্তী করোনা ভাইরাস তো এত বড় বিপর্যয় নিয়ে আসেনি। পূর্ববর্তী SARS এবং MERS এর কারণে মানব মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বর্তমান SARS-CoV-2 এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা থেকে অনেক কম। তাই বলতে গেলে পুরো বিশ্ব এখন আশায় আছে কবে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে।
ভ্যাকসিন একটি জৈবিক প্রস্তুতি যা কোন নির্দিষ্ট রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে। একটি ভ্যাকসিনে সাধারণত একটি এজেন্ট থাকে যা একটি রোগজনিত মাইক্রো অর্গানিজমের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত এবং এটি প্রায়শই জীবাণু বা এর টক্সিনের দুর্বল বা নিহত ফর্ম থেকে তৈরি হয়। এই এজেন্টই একে আমাদের শরীরের মধ্যে হুমকি হিসেবে চিনতে এবং একে ধংস করতে আমাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্বুদ্ধ করে।
করোনাভাইরাস এক ধরণের সাধারণ ভাইরাস যা আপনার নাক, সাইনাস বা উপরের গলায় সংক্রমণ ঘটায়। বেশিরভাগ করোনা ভাইরাস মানুষের জন্য বিপজ্জনক নয়। বিস্তারিত বলতে গেলে, Corona viruse হচ্ছে Coronaviridae পরিবারের Enveloped Positive-sense Single-stranded RNA virus আর এই ভাইরাসের জিনোমের আকার প্রায় ২৬ থেকে ৩২ কিলোব্যাসের মধ্যে থাকে। RNA ভাইরাসগুলির মধ্যে এটি অন্যতম বৃহত্তম। করোনা ভাইরাস প্রধানত ৪ টি বর্গে বিভক্ত, Alphacoronaviruses এবং Betacoronaviruses যা প্রথানত স্তন্যপায়ীকে আক্রমণ করে অন্যদিকে Gammacoronaviruses এবং Deltacoronaviruses যেগুলো প্রাথমিকভাবে পাখিকে আক্রমণ করে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ প্রজাতির করোনা ভাইরাস সম্বন্ধে ধারনা পাওয়া গেছে,আর এদের মধ্যে ৭’টি মানব করোনা ভাইরাস। চারটি মানব করোনা ভাইরাসগুলি এমন লক্ষণ তৈরি করে যা সাধারণত হালকা থাকে যেমন:
1. Human coronavirus OC43 (HCoV-OC43), β-CoV
2. Human coronavirus HKU1 (HCoV-HKU1), β-CoV
3. Human coronavirus 229E (HCoV-229E), α-CoV
4. Human coronavirus NL63 (HCoV-NL63), α-CoV
কিন্তু তিনটি মানব করোনা ভাইরাস এমন লক্ষণ তৈরী করে যেগুলি গুরুতর যেমন:
1. Middle East respiratory syndrome-related coronavirus (MERS-CoV), β-CoV
2. Severe acute respiratory syndrome coronavirus (SARS-CoV), β-CoV
3. Severe acute respiratory syndrome coronavirus 2 (SARS-CoV-2), β-CoV
SARS-CoV-1 এবং SARS-CoV-2 নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে দুটি ভাইরাসই বাদুড় থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল।যদিও এবারের করোনাভাইরাস চীনের ল্যাব থেকে ছড়িয়েছে কিনা সেটা নিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই দুটি ভাইরাসের আরএনএ জিনোমগুলি প্রায় ৮০% অভিন্ন।
SARS-CoV-1 চীনের গুয়াংডং প্রদেশে ২০০২ সালের নভেম্বরে লক্ষ করা গিয়েছিল, যখন সেখানে চিকিৎসকরা একটি অস্বাভাবিক নিউমোনিয়া দেখেছিলেন।এই SARS বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এশিয়াতেই ছিল। ভাইরাসটি SARS-CoV-2 থেকে বেশি আক্রমণাত্মক এবং মারাত্মক ছিল। রোগীদের মধ্যে সাধারণত দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে লক্ষণগুলি দেখা যেত। অন্যদিকে MERS-CoV ২০১২ সালে সৌদিআরবে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু কোভিড -১৯ এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণ এক্ষেত্রে রোগীর ভিতর তেমন কোনও লক্ষণ ছাড়াই সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।যা জটিলতার সৃষ্টি করছে।তাই এটা এখন বড় প্রশ্ন আমরা কি আদৌও পারব এর প্রতিষেধক বানাতে?
আর একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে অ্যান্থ্রাক্স,পোলিও,বসন্ত,যক্ষ্মা, হাম,হুপিং-কাশি,ম্যামস্, ডিপথেরিয়া, কলেরা,হেপাটাইসিস এ,হেপাটাইসিস বি,টিটেনাস,রুবেলা,ফ্লু(ইনফ্লুয়েঞ্জা) ইত্যাদি রোগের প্রতিষেধক যেখানে বানানো হয়েছে সেখানে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, হেপাটাইসিস সি,ম্যালেরিয়া, এইডস,জিকা ভাইরাস ইত্যাদি রোগের প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ১৮৮৯ সালের রাশিয়ান ফ্লু(H2N2) ইতিহাসের ভয়ানক ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু (H1N1 ভাইরাস), ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লু (H2N2 ভাইরাস),১৯৬৮ সালের হংকং ফ্লু(N3N2 ভাইরাস),২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লু(H1N1 ভাইরাস) মানব সভ্যতাকে আঘাত করে নিজেরাই গুটিয়ে পড়ে।স্প্যানিশ ফ্লু প্রাদুর্ভাবের ১০০ বছর পরে,এই চারটি ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী হয়েছে। কিন্তু ১৯১৮-এর প্রাদুর্ভাবের মতো মারাত্মক কোনওটিই ছিল না প্রায় ৫ কোটি মানুষ এতে মারা যায়। এছাড়া যত অতীতের দিক যাওয়া যাবে তত একই চিত্র দেখা যাবে,এক একটা মহামারী এসেছে আবার হঠাৎ করে চলেও গেছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ২৯০,০০০ থেকে ৬৫০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার (Seasonal Flu) প্রাদুর্ভাব এর কারণে। যদিও এর তুলনামূলক মৃত্যুর হার অনেক কম কারণ কিছু Anti-flu drug আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ভ্যাকসিনগুলি মোটামুটি সহজলভ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্যবিধি এক শতাব্দী পূর্বে অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এবং মৌসুমি ফ্লু সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলি কম বিপজ্জনক। কিন্তু ফ্লু ভাইরাস গুলো দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে,যেটা একটা বড় উদ্বেগ এর কারণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে ১৯১৮ সালে যে ধরণের ধ্বংস দেখা গিয়েছিল সে রকম বিপর্যয় আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে।
Covid-19 এর আগে যে দুটি Corona virus মানুষকে আক্রমণ করেছে, SARS এবং MERS এদের ক্ষেত্রে তেমন কোন কার্যকরী প্রতিষেধক বানানোর আগে এ দুটি ভাইরাস রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায় ফলে এদের উপর গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। এরূপ ঘটনা এবারও ঘটতে পারে। প্রকৃতি আমাদের উপর সদয় হতে পারে।যেমনটা পূর্বের Pandemic গুলোর সময় হয়েছে। সেজন্য তো আমাদের গবেষকরা বসে থাকতে পারেন না, তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য,কারণ একটি ভ্যাকসিন ই পারে এই মুহূর্তে এই মহামারী সমাপ্ত করবার এবং দেশগুলিকে পুনরায় খোলায় সহায়তা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ টি দল বিভিন্ন পরীক্ষাগারে এই কভিড-১৯ রোগের প্রতিষেধক বানানোর জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ফাইজার এবং এর জার্মান অংশীদার বায়োএনটেক এবং চীনা সংস্থা ক্যানসিনো সহ বেশ কয়েকটি প্রস্তুতকারকের জন্য ইতিমধ্যে মানব পরীক্ষা শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব সেবা অধিদফতর জানিয়েছে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষাগার থেকে একটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে ওষুধ সংস্থা আস্ট্রাজেনেকাকে ১.২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সরবরাহ করা হবে।
তাছাড়া ওষুধ সংস্থা মডারনা ঘোষণা করেছে যে এটির আরএনএ ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং কার্যকর বলে মনে হয়েছে, যদিও এটি পরীক্ষার মাত্র আট জনের ফলাফলের ভিত্তিতে ছিল।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সেই সাথে আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে শরীরের Immune system কে উন্নত করবার সময় এখনই। কারণ পরবর্তী Pandemic আসন্ন।
অসাধারণ ইনফরমেশন। ধন্যবাদ আপনাকে লেখক সুমন বিশ্বাস।
আমাদের দেশের প্লাজমা থেরাপি নাকি ভাল ফল দিচ্ছে।
চীনা কোম্পানি ক্যানসিনো এটার ভ্যাকসিন আবিস্কার এর দৌড়ে এগিয়ে আছে।
অসাধারণ
ব্যাপারটি সত্যই উদ্বেগজনক।