লিখেছেন: জীবন

প্রান্তিক পাঠকদের মুশকিল হলো তারা ইচ্ছে করলেই বই কিনতে পারেন দেদারসে কিন্তু পাঠকালে তাদের অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। করতে হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই। এইতো গত সপ্তাহে পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন মহোদয়ের “বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ” পাঠে গিয়ে বুঝতে পারলাম একজন পাঠক হিসেবে আমি কতটা পেছনের। খামটি মেরে তিনদিন চেষ্টা করেও রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হলাম। অবশ্য লেখক মহোদয় বইটির ভূমিকায় স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এই বইটি নিতান্তই উচ্চমার্গীয় পাঠকদের জন্য। আমি যে উচ্চমার্গীয় নই তা আবার স্বীকার করে কে? যাই হোক অনেক চিন্তা ভাবনা করে গবেষক-লেখক-শিক্ষক মিজ্ জয়া চ্যাটার্জী’র “দেশ ভাগের অর্জন” পাঠে মনোনিবেশ করলাম। একজন গৃহী মানুষ হিসেবে বেশ সময় নিয়ে আমাকে বইটি শেষ করতে হয়েছে। এই বিষয়ে বাংলা ভাষায় এতো বেশী লেখা হয়েছে যে, সে বিষয়ে নূন্যতম পড়াশুনা না করেই এই একটি মাত্র বই পাঠে নিজেকে বেশ জ্ঞানী ভাবতে ইচ্ছে করছে। এও জানি যে খালি কলসি বাজে বেশী। এতোকিছুর পরেও “নাই কাজ তো খই বাজ।” তাইতো দেশবিভাগ নিয়ে কিছুটা লেখার চেষ্টা। এই কাজটিও সহজ নয়। সাধু-চলিত, তৎসম-তদ্ভব নানান গোলযোগ আছে। তথাপিও অনেকটা একরোখা ভাবেই লিখতে বসা। এক্ষেত্রে গুগল মামাও আমাকে বেশ সাহায্য করছেন। উল্লেখ্য যে, এই লেখার পুরোটা জুড়েই উপরোক্ত বইখানার প্রভাব রয়েছে। তবে ঢংটা একান্তই আমার।

(বঙ্গভঙ্গ, প্রথম ধাক্কা)

দুইটি বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-সৃস্টি প্রায় একই রকম হওয়া সত্বেও কেন “সীমান্ত রেখা”? এই ভাবনাটি আমাকে প্রতিনিয়তই বেশ ভাবাতো। যদিও “দ্বিজাতি তত্ত্ব” বিষয়টি বেশ জ্বলজ্বলে। তারপরও। ১৭৬৫ সালে বিহার ও উড়িষ্যা সমন্বয়ে গড়ে উঠা বাংলা ব্রিটিশ ভারতের একক প্রদেশ হিসেবে গড়ে উঠে। উনবিংশ শতাব্দিতে বাংলা-বিহার-উড়িষা-আসাম নিয়ে ব্রিটিশগণ বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন ঠিকই কিন্তু কোন কিছুই চূড়ান্তরূপ পায়নি যা ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জন “বঙ্গভঙ্গ”-এর মাধ্যমে চূড়ান্তরূপ দান করেন। পূর্বে পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ ও মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করে ১,০৬,৫০৪ বর্গমাইলের “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” প্রদেশ। যার জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন। যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। অপরদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর ও মধ্য প্রদেশের পাঁচটি জেলা, ওড়িষা রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এতে পশ্চিম বাঙলার আয়তন হয় ১,৪১,৫৮০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা হয় ৫৪ মিলিয়ন যার মধ্যে ৪২ মিলিয়ন হিন্দু ও ০৯ মিলিয়ন মুসলিম। বঙ্গভঙ্গের স্বপক্ষে সরকারী প্রশাসনিক আয়তন অতিরিক্ত বড় হয়ে যাওয়া এবং তদপ্রেক্ষিতে শাষনকার্য পরিচালনা করা দুরুহ হয়ে পড়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসলেও বাঙালি শিক্ষিত হিন্দুগণ মনে করেন যে, এটা ছিল জাতীয় সচেতনতা ও সংহতির উপর কার্জনের কৌশলী আঘাত। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘুতা হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও তাদের চিন্তিত করে তুলে। তাইতো এই বিভক্তি-বিভাজনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-গোষ্ঠীসমুহ একতে জোটবদ্ধ হয়ে উঠে। বাংলার প্রচারযন্ত্র বিভক্তির বিরোধিতা করতে থাকে। এই সময়ে দাঁনাবেধে উঠে “স্বদেশী আন্দোলন”। এই আন্দোলনে ডি.এল রায়, রজনীকান্ত সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর দেশাত্মবোধক গাণ প্রেরণা হিসেবে কাজ করেন। এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি——”। মূলত দুই বাংলার কোন হিন্দু বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেননি। অপরদিকে বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আশীর্বাদস্বরূপ হবে এবং নতুন প্রশাসনের সাথে তাদের দরকষাকষির সুযোগ তৈরী হবে বিধায় অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলমান বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেয়। তারই ফলস্বরূপ ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন” প্রতিষ্ঠা করা হয়। জনাব খাজা সলিমুল্লাহকে সর্বসম্মতিক্রমে এই ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মনোনীত করা হয়। এরপরও একদল শিক্ষিত উদারবাদী মুসলমান বিভক্তি বিরোধী বিক্ষোভ ও স্বদেশী আন্দেলনে যোগদান করেন। তাদের সংখ্যা নগন্য হলেও এ বিষয়টি মুসলমানদের চিন্তাধারায় নতুন মাত্রা যোগ করে। সর্বজনাব খাজা আতিকুল্লাহ, খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইউসুফ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমূখ ব্যক্তিগন স্বদেশী ধ্যাণ ধারণার প্রচারক ছিলেন। জনাব আবুল কাশেম ফজলুল হক ও নিবারণ চন্দ্র দাশ তাঁদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বালক’ ও মাসিক পত্রিকা ‘সুহৃদ’ এর মাধ্যম অসাম্প্রদায়িক ধ্যাণ-ধারণা প্রচার করেন। তবে একথা স্বীকার্য যে, মুসলিম মানসে চিন্তা-ভাবনার সার্বজনীন প্রবণতা ছিল বিভক্তির পক্ষে। নওয়াব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় লিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ১৯১০ সালের ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সভায় বাংলার শামসুল হুদা ও বিহার হতে মাজহার-উল-হক বিভক্তির পক্ষে অবস্থান রাখেন। শুধু তাই নয়, মুসলিম পত্র-পত্রিকা স্বদেশী আন্দোলনকে হিন্দু আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করতে থাকেন এবং প্রান্তিক পর্যায়ে তারা বেশ সফলও হন। মীর মশাররফ হোসেন এর মতো প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকগণ স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল সমালোচক ছিলেন। তবে দুই বাংলার স্বদেশী আন্দোলন এতো বেশী প্রবলতর হয়ে উঠে যে, ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে এসে বঙ্গভঙ্গকে রদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার বলেন যে, নতুন প্রদেশটিতে বসবাসকারীদের মধ্যে মুসলমানগণ অত্যাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায় নতুন বিন্যাসের আওতায় ধারণাগত দিক থেকে তারা হিন্দুদের সমান অথবা সম্ভবত কিছুটা উচ্চতর অবস্থায় বিরাজ করবেন। মুসলমানদের স্বার্থসমূহ আইন পরিষদ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বিশেষ প্রতিনিধিত্বের দ্বারা রক্ষা করা হবে। অবশেষে ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল বিভক্তির আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ও বাংলার পুনঃ একত্রীকরণের দিন ধার্য করা হয়। এর মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুদের ক্রোধকে কিছুটা প্রশমিত করা গেলেও কলকাতাকে ভারতের রাজধানী হতে কেবল প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় নামিয়ে আনায় তারা আহতও হন। ব্রিটিশ সরকার বারংবার প্রশাসনিক পুনবিন্যাসের নামে বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছে উল্লেখ করলেও অন্তনির্হিত বিষয়টি ছিল পুরোপুরিই “সাম্প্রদায়িক” ।

(দেশ বিভাগ, চূড়ান্ত ধাক্কা)

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছে ছিলো ভারতবর্ষকে নিজের অধীনে রাখা। তবে “ভারত ছাড়” আন্দোলনের মাধ্যমে সে ইচ্ছা নস্যাৎ হয়ে যায়। কাজেই এটলির অধীন সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারত থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মূলত এই সিদ্ধান্তের কারণে অখন্ড ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক চিত্র রাতারাতি পাল্টে যায়। এটা ঠিক যে, দেশভাগের মূল ভিত্তি লন্ডন ও দিল্লি ঠিক করে দেয়, আর এসব ভিত্তি ঠিক করার সময় প্রাদেশিক চিন্তা-ভাবনার চেয়ে রাজধানী ও সর্ব-ভারতীয় উদ্দেশ্যেগুলি প্রাধান্য পায়। লন্ডন ঘোষনা করে যে, বেঙ্গল বিধানসভাকে দুইভাগে ভাগ করতে হবে। একভাগে থাকবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলির নির্বাচিত সদস্য এবং অন্য ভাগে থাকবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা গুলির সদস্য। যেকোন ভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যদি প্রদেশ ভাগের পক্ষে ভোট দেয় , তাহলে বাঙলাকে ভাগ করা হবে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বেঙ্গল আইন সভাকে দুইভাগে ভাগ করা হয় এবং তারা প্রদেশ ভাগের ওপর ভোট দেয়। ঐতিহাসিক এই ভাগে ‘হিন্দু’ ভাগের অধিকাংশ সদস্য প্রদেশ ভাগের পক্ষে ভোট দেয়। আর যা আশা করা হয়েছিল ঠিক সেইভাবে অধিকাংশ মুসলিম বাঙলাকে অবিভক্ত রাখার পক্ষে ভোট দেয়। অবশ্য এর পূর্ব হতেই বাংলা প্রদেশ ভাগের বিষয়ে উচ্চবংশীয় হিন্দুরা আন্দোলন করে আসছিলেন। এছাড়াও ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলীম লীগ সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ এর দাবী জানিয়ে রাখেন। উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করায় বাঙলাকে লীগ নিশ্চিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী এলাকা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। এ কথা ঠিক যে, ৩ জুন, ১৯৪৭ এ এটলির বিবৃতির মাধ্যমে বাঙলার হিন্দু নেতাদের কোয়ালিশনের সাফল্যমন্ডিত হয়। লন্ডন ও দিল্লিতে নেয়া সিদ্ধান্তে তারা ভারতের মধ্যে নিজেদের জন্য একটা হিন্দু রাজ্য লাভ করে যা বর্ষাকাল শেষ হওয়ার আগেই কার্যকর হবে। ৩ জুন হতে ১৭ আগস্ট মোট দশ সপ্তাহের মধ্যে যখন স্যার রাডক্লিফের সীমান্ত রেখা ঘোষণা করা হয় তখন ব্যাপক বিষয়ের মধ্যে সামান্য বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়। এই ভদ্রলোকের অনেক বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান প্রকাশের সুযোগ থাকলেও সীমান্ত রেখা নির্ধারণে তার কোন প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতার বিষয়টি জানা যায়নি। তিনি মূলত (১) আর্য রাষ্ট্র সংঘ (২) হিন্দু মহাসভা (৩) কংগ্রেস অভিপ্রায় (স্কিম) (৪) কংগ্রেস পরিকল্পনা (৫) কংগ্রেস পরিকল্পনা খুলনা ইত্যাদি ব্যতীত এবং (৬) জাতীয় বংগ সংগঠন সমিতি কর্তৃক প্রদত্ত সীমান্ত রেখা সমূহকে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে অনুমোদন করেছেন মাত্র। উপরোক্ত ৬টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত না থাকলেও নির্ভেজাল হিন্দু রাজ্য প্রাপ্তির বিষয়ে এক বিন্দুতে স্থির ছিলেন। সবথেকে আশ্বর্যের বিষয় পূর্ববাংলার সীমান্তবর্তী কোন জেলার কোন থানা বা ইউনিয়নও যদি হিন্দু অধ্যুষিত হয় তবে সীমান্ত রেখাকে এদিক-ওদিক করে নেয়ার জন্য তারা একাট্টা হয়ে কাজ করেছেন। অভিবক্ত নদীয়া (যার অংশ বিশেষ এখন কুষ্টিয়া) এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার মোহে তারা দার্জিলিং ও শিলিগুড়িকে পর্যন্ত পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়ে দিতেও আগ্রহী ছিলেন। যদিও তখন এই দুটি জেলাতে শতকরা হিসেবে হিন্দু আধিক্য ছিল। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় তৎকালীন মুসলিমলীগ নেতৃবৃন্দ ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দাবী-আন্দোলন-জমায়েত করে আসলেও বাঙলার সীমানা নির্ধারণে তাদের তেমন কোন ভূমিকাই ছিলনা। এতোকিছুর মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিল বাঙলা প্রদেশের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এবং নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসের বড় ভাই জনাব শরৎ চন্দ্র বোস এবং তৎকালীন মুসলিমলীগ নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারা শেষ দিন পর্যন্ত দুইবাংলাকে একত্রে রেখে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার বিষয়ে দরকষাকষি করে গেছেন। প্রথম দিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর প্রস্তাবে পরোক্ত সমর্থন দিলেও পরবর্তীতে সে সমর্থন থেকে সরে দাঁড়ান। অপরদিকে জওহরলাল নেহেরু এবং ভাল্লাবাই পাতিল সহ বেশিরভাগ কংগ্রেস নেতা তাদের প্রস্তাব বাতিল করেন। এছাড়া শ্যাম প্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলও তীব্রভাবে বিরোধিতা করেন। ফলশ্রুতিতে হিন্দু নেতাদের চাহিদা মোতাবেক স্যার র্াডক্লিফ সীমান্ত রেখা চূড়ান্ত করেন।

(উদ্বাস্তু)

একজন ঐতিহাসিকের মতে-নতুন রাষ্ট্র গঠন হলো ‘উদ্বাস্তু সৃজনের প্রক্রিয়া’। সমজাতীয় জাতি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টার ফলে কিছু লোক সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হয় যারা ‘ভুল’ জাতিগোষ্ঠি ভাষা বা ধর্মের বিষয়ে নিজেদেরকে নতুন সীমান্তের ‘ভুল’ পাশে অথবা ‘ভুল’ রাষ্ট্রে দেখতে পায়। সংখ্যালঘিষ্ঠরা বুঝতে পারে যে তারা অন্য কোন স্থানের লোক, তারা তাদের মতো লোকদের নিয়ে গঠিত অন্য নতুন রাষ্ট্রের অধিবাসী। নতুন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ বা ৫৩ লাখ ছিল মুসলিম। অপরদিকে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ হিন্দু। রাতারাতি এসব হিন্দু নতুন ও স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার অধীন হয়ে পড়ে। প্রত্যেক মানুষের মনে একটা ভীতিকর হত্যাযজ্ঞের দৃশ্যের স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর তা হলো নোয়াখালী ও ত্রিপুরায় হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা এবং কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গায় মুসলিম নিধন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হত্যার এই কুৎসিত প্রেক্ষাপটের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেউ সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে শান্তিপূর্ন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে পারেনি। নতুন প্রভুদের অধীন অরক্ষিত ও প্রভেদমূলক অবস্থায় থেকে যাওয়া অথবা সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে অন্য একটা দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে নতুন করে শুরু করার জন্য তাদেরকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা ঠিক যে পূর্ববঙ্গীয় একশ্রেণির ধনীক গোষ্ঠির পূর্ব হতেই ব্যবসায়িক-পেশা বা অন্য কোন কারণে পশ্চিমবাঙ্গালায় তথা কলকাতায় যাতায়াত ছিল। যে কারণে এই শ্রেণির বঙ্গবঙ্গ হতেই পশ্চিম বাঙলায় বসতি স্থাপন শুরু করেছিল। যা ১৯৪৭ সালে এসে চূড়ান্ত রূপ পায়। এদের পরিবারের একটি অংশ পূর্ব হতেই পশ্চিম বাঙ্গায় বসবাস করে আসছিলেন। মুসকিল হলো পূর্ববঙ্গে হিন্দুরা সমজাতীয় সম্প্রদায় ছিলনা, তাদের জনসংখ্যাও সমানভাবে বিভাজিত ছিল না। তাদের অধিকাংশই বসবাস করত পূর্ববঙ্গের দক্ষিন অঞ্চলে। হিন্দু হিসেবে তারা শ্রেণিভূক্ত হলেও তাদের সামাজিক বিভক্তি ছিল অসংখ্য। তাই এই বিশাল ও ভিন্নমুখী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানে থাকা বা ভারতে চলে যাওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। কাজেই অধিকাংশ হিন্দুদের জন্য পশ্চিম বঙ্গে পাড়ি দেয়ার বিষয়টি সুখকর ছিল না। তাই নিম্নশ্রেণিভূক্ত হিন্দুরা খুব সহজে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে যেতে চায়নি। কিন্তু ১৯৫০ সালে খুলনার দাঙ্গার পর ব্যাপকহারে অর্থাৎ প্রায় ২০ লাখ হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। কাশ্মীরে হযরতবাল পবিত্র স্থান থেকে মুসলিমদের পবিত্র স্মারক চুরি ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং যে কোন কারণে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পূর্ববঙ্গ হতে লক্ষ লক্ষ লোক পশ্চিম বঙ্গে পালিয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মুসলিম ছিলেন ধনীক ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক। তারা ১৯৪৭ সাল এবং অব্যবহিত পরেই কলকাতায় অসহায় পড়ে পড়েন। তাদের মধ্যে একটা অংশ পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুদের সাথে সরকারী পর্যায়ে জমির অদল-বদল করে নিয়ে পূর্ববঙ্গে স্থিত হয়েছেন। কিছু মুসলিম পরিবার সীমান্তবর্তী জেলা মালদা, মুর্শিদাবাদ গিয়ে সাময়িক বসতি স্থাপন করেন। কিছু পরিবার আসামেও যায়। পূর্ববঙ্গ হতে দিনমজুর-শ্রমিক-কামার-জেলে-কুম্ভকার সম্প্রদায়ের পরিবার গুলো একপ্রকার প্রায় নিস্ব: হয়ে পশ্চিম বাংলায় গমন করে। তাদের কিছু পরিবারকে কলোনী বসতি স্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু কলোনীগুলোর অবস্থা এতোটাই অমানবিক ছিল যে সেখানে সাপ-বিচ্ছু থাকতেও কষ্ট পেত। সবচেয়ে ভয়াবহ বসতি স্থাপন করা হয় উড়িষ্যা ও বিহার রাজ্যের কোরাপুট ও কালাহান্দি জেলা এবং মধ্য প্রদেশের বাস্তার জেলার বিস্তৃত ‘দণ্ডকারণ্য’ নামক জায়গায়। এ অঞ্চলের নিচু মালভূমিতে কোন ফসল ফলানোর সুযোগ ছিলনা। কিন্তু এখানেই ২৫ হাজারের বেশী পরিবারকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হয়। এভাবে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে কোন অস্থিতিশীলতা তৈরী হলেই পূর্ববঙ্গ হতে সহায়-সম্বলহীন পরিবার পশ্চিম বাংলায় গমন করেছে। সর্বশেষ বাবড়ি মসজিদ নিয়ে গোলযোগের সময়েও এ বাংলা হতে অনেক হিন্দু পরিবার পশ্চিম বাংলায় গিয়ে বসতি গেড়েছেন। সবথেকে দুঃখের বিষয় নিজ ভিটা-বাড়ি ছেড়ে গিয়ে সেখানে অধিকাংশ পরিবারকে যুগের পর যুগ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। যে ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য সে ধর্ম এক সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠা মানুষকে এক গন্থিতে বেঁধে রাখতে পারেনি। বরংঞ্চ তা কোটি মানুষের চোখের জলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বারংবার। (সংক্ষেপিত)