এক ফেব্রুয়ারি মাসেই চলে গেলেন ডঃ আহমদ শরীফ। বড়ই অকস্মাৎ সে যাওয়া। দু’দিন আগেও সারা বিকেল-সন্ধ্যা সে কী তুমুল আড্ডা। ফেরার সময় লাঠি উঁচিয়ে সে চিরাচরিত বিদায়-সম্ভাষণ। একুশে বইমেলার জন্য টিএসসি চত্বর তখন লোকারণ্য। বরাবরের মতো আমি ও কবিবন্ধু ফরিদুজ্জামান দু’হাত ধরে রাস্তা পার করে রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম স্যারকে। সেই যে শেষযাত্রা তখন কি জানতাম? জানলাম ভোরে এক কবি বন্ধুর টেলিফোনে। তখন ডঃ আহমদ শরীফ বারডেমের হিমঘর।
দু’দশকের চেনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তখন শোক আর স্মৃতি রোমন্থনের বিরাণ ভূমি আমাদের কাছে। কী করে বাঁচিয়ে রাখা যায় সে আড্ডা! অন্তত একজন মধ্যমনি দরকার। কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে আনলে হয়। কিন্ত তিনি তো আড্ডাবাজ নন। কোথায় পাওয়া যাবে সে সক্রেটিস, যিনি সামলাবেন সব পথ সব মতের অসম বয়সের কিছু মানুষের আড্ডা? সুভাষ ভট্টাচার্য প্রগতিপন্থি, রফিক খান সাহেব পারিবারিকভাবে আওয়ামীপন্থি কিন্ত মতাদর্শে ও আত্মীয়তায় বামপন্থি, তপন দে ইস্কুলের ছাত্রাবস্থায়ই টাংগাইলের জাসদের স্বীকৃত নেতা, আজাদ শুধু বিএনপির ভালো কাজ দেখতে পায়, জাহাংগীর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, প্রাক্তন আমলারা প্রসংগে-অপ্রসংগে শুধু আমলাতন্ত্রের গুনগান করেন। এমন যে আড্ডার চরিত্র সেখানে একমাত্র ডঃ আহমদ শরীফেই মানাতো।
একদিন হঠাৎ আগমন হুমায়ুন আজাদের। স্যারকে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। অসুবিধে একটাই স্যারের আসতে একটু দেরি হবে। কারণ, শাহবাগে তরুণ ডাক্তারদের একটা আড্ডা সেরে সন্ধ্যার একটু আগেই পৌঁছে যাবেন প্রতিদিন।
বাবুল ইলেট্রনিক্সের পাশ থেকে জাতীয় জাদুঘর হয়ে ফুটপাতের পুরানো বইয়ের দোকানের ধার ঘেঁষে হাতের মুঠোয় বেনসন সিগারেট নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতেন ডঃ হুমায়ুন আজাদ, বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, সমালোচক ও ভাষাবিজ্ঞানী- এ তিনটিই তাঁর প্রিয় বিশেষণ।
হঠাৎ আড্ডার চরিত্র বদলে গেল। রাজনীতির প্রতি প্রচন্ড বিমুখ হুমায়ুন আজাদ পেয়ে গেলেন কবিতার আসর। ক্রমশ সন্ধ্যা পেরিয়ে নেমে আসতো রাত। হাইকোর্টের দিক থেকে কখনো উঠে আসতো চাঁদ। গাছের ফাঁক-গলে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ত সবুজ ঘাসে। একটু দূরের কোনো নাম না-জানা ঘাস ফুলের গন্ধ আলো-আঁধারের মুহুর্তকে আরও কাব্যময় করে তুলতো।
জ্যোৎস্না আর আঁধারের সে মোহনীয় পরিবেশে বেড়ে চলতো আমাদের আড্ডা। কবিতার সে মুহুর্তগুলোকে হুমায়ুন আজাদ উপভোগ্য করে তুলতেন তাঁর অতুলনীয় কবিতাবোধ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে। আধুনিক কবিতা যে এমন উৎকৃষ্ট উপলব্ধি ও শৈল্পিকতায় হুমায়ুন আজাদ তা বুঝেছিলেন।
আর তাই আধুনিক কবিতায় কিভাবে মানবিকতা ছাড়িয়ে শিল্পকলাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, কিভাবে ভাঙা-গড়ার নামে রীতিমতো কবিতাকে কোলাহলের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে হুমায়ুন আজাদ বর্ণনা করতেন অসংখ্য কবিতা উদ্ধৃত করে। তাঁর প্রিয় কবিতার অন্যতম দু’টি কবিতা বুদ্ধদেব বসুর “ বেশ্যার মৃত্যু” ও সুধীন দত্তের “যযাতি” থেকে আবৃত্তি করতেন হুমায়ুন আজাদ।
“ উত্তীর্ণ পঞ্চাশ, বনবাস প্রাচ্য প্রাজ্ঞদের মতে
অতঃপর অনিবারণীয়; এবং বিজ্ঞান বলে
পশ্চিম যদিও আয়ুর সামান্য সীমা বাড়িয়েছে
ইদানিং, তবু সেখানেই মৃত্যুভয় যৌবনের …” ( যযাতি, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত )
অবাক বিষ্ময়ে দেখতাম “ যযাতি” থেকে অনর্গল আবৃত্তি করে যাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের উত্তীর্ণ পঞ্চাশ এক অধ্যাপক, কবি ও মুক্তমনা লেখক, হুমায়ুন আজাদ, যাঁর মৃত্যু পশ্চিমেই, কিন্ত আয়ুর সীমা সামান্যও বাড়েনি মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ ঘাতকের আঘাতে।
২৮ এপ্রিল হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন। প্রথাবিরোধী লেখক ও কবি হুমায়ুন আজাদের প্রতি জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
কি সুন্দর করে লিখেছেন। ধন্যবাদ। আহমদ শরীফ হুমায়ুন আজাদের মত মানুষেরা যে এমন করে মাঠে ঘাসে বসে আড্ডা জমাতেন এমনি করে না লিখলে হয়ত ঠিকমত বুঝতে পারা যেত না। এত কাছে থেকেও কখনো যাওয়া হয়নি, আর আপনারা একসাথে বসেছেন। ঈর্ষণীয়।
হুমায়ূন আজাদ একজন যুগ পুরুষ। তাঁর জীবন সংরক্ষিত হলেও কর্মপরিসর সংক্ষিপ্ত নয়। তাঁর জন্মদিনে রইল হার্দিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।