লিখেছেন: সরোজকুমার ঘোষ

‘জানি, বিপদ চারিদিকে ওঁত পেতে আছে! কিন্তু আমার কিছু হবে না!’ যেকোনো বিপদকালে সাহসী অন্য অর্থে অতি-আত্মবিশ্বাসী মানুষের মনের অবস্থা এমনই থাকে। যেমনটা ছিলো যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিশ জনসন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। মুদ্রার একপিঠ যদি সাহস বা অতি-আত্মবিশ্বাস হয়, অপর পিঠ হলো বোকামি। এই শ্রেণির মানুষ বিষয়টি বিপদ ঘাড়ে আসার পর টের পায় আসলে অতি-আত্মবিশ্বাস বোকামির সামিল। তখন আর কোনো কিছুই করার থাকে না, শুধু মুখ কাঁচুমাচু করে বলা ছাড়া- ‘হয়ে গেলো কী করবো, সবই কপাল। স্রষ্টার ইচ্ছে।’ এই কপালওয়ালা বা অদৃষ্টবাদীরা কোভিড-১৯ এর মতো বৈশ্বিক মহামারীর সময় নিজের এবং সমাজের জন্য আরো বেশি করে হুমকি হয়ে উঠছে। কেনো হুমকি তা গণমাধ্যম ও সরকারি সচেতনতাম‚লক প্রচার-প্রচারণার অভিযানের কল্যাণে আজ কারো অজানা থাকার কথা নয়। কোভিড-১৯ এর কোনো ঔষধ বা টিকা এখনো বিশ্ব তৈরি করতে পারেনি। আর এই বিশেষ ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাও ভয়ানক। তাই একে থামানোর একমাত্র উপায় সংক্রমণ রোধ। মানুষই কোভিড-১৯ এর মুখ্য বাহক, তাই সংক্রমণ রোধ করার জন্য প্রয়োজন মানুষে-মানুষে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা। যেনো করোনা সংক্রামিত ব্যক্তির দ্বারা কোনো সুস্থ মানুষ সংক্রামিত না হয়। সামাজিক দ‚রত্ব বজায় রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী চলছে এক অভূতপূর্ব লক-ডাউন। সারা বিশ্ব করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বর্তমানে লক-ডাউন নামের এই অস্ত্র নিয়েই যুদ্ধ করছে।

 

বৈশ্বিক মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দিয়ে সারাদেশ লক-ডাউন করেছে। এই ঘোষণার পরপরই যেনো অদৃষ্টবাদীর সংখ্যা দেশে হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে । আমি এই অদৃষ্টবাদীদের একজনের সাক্ষাৎ পেলাম নিজ বাড়িতেই- আমাদের কাজের বুয়া। লক-ডাউনের প্রথমদিনে সকালে কাজ করতে আসলে একটি সার্জিক্যাল মাস্ক দিয়ে বললাম, ‘বুয়া আজ থেকে এটা ব্যবহার করতে হবে, আর কাজ শুরু করার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেন।’ সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘আল্লাহ যদি কাউকে রোগ-বালাই দিতে চায়, তাহলে তা দিবেই। হাত ধুলেই কী আর মুখে কাপড় বাঁধলেই কী!’ সেদিন আমাদের নির্দেশনা মেনেই কাজ করলো। কিন্ত পরেরদিন সকালে দেখি তার মাস্ক আর নেই। জিজ্ঞেস করলে তার সটান উত্তর, ‘দম বন্ধ হয়ে আসে, থ্যাকবার পারি না।’ আর অতো হাত-মুখ ধোবারও নাকি দরকার নাই। অমুকের আব্বা বলেছে। এই অমুকের বাবা একজন ডাক্তার, আমার পরিচিত। বুঝলাম কথাটা অমুকের আব্বার নয়, তিনি এতোটা অসচেতন মানুষ নন। যাইহোক সেদিন রাতে আমার স্ত্রী মোবাইলে বুয়াকে জানিয়ে দিলো- আগামীকাল থেকে আপাতত আর কাজে আসতে হবে না, মাসের শেষে বেতন নিয়ে যাবেন। সে বুয়াকে আরো আশ্বস্ত করলো যতোদিন অবস্থার উন্নতি না হয় ততদিন এভাবেই বেতন নিয়ে যাবেন। বাড়ির বাইরেও লক্ষ করলাম বুয়ার মতো অদৃষ্টবাদীরা সংখ্যা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-বর্গের মানুষের মধ্যে নেহাত কম নেই। লক-ডাউনে বাইরে অযথা ঘোরাঘুরি করা মানুষের সংখ্যাও বোধকরি বেড়েছে। কেমন একটা ছুটির আমেজ মানুষকে যেনো পেয়ে বসেছে। এটিই বোধহয় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি- নিষিদ্ধের স্বাদ আস্বাদন করা। আলব্যের কাম্যু (১৯১৩-১৯৬০)-এর দ্যা প্লেগ(১৯৪৭) উপন্যাসের ওরান শহরের মানুষের সাথে তুলনা করলে খুব আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের বর্তমান অবস্থার। আমরা হরহামেশাই বড়াই করি মানুষ-সমাজ-বিশ্ব-বিজ্ঞান অনেক অগ্রসর হয়েছে, মানবজাতি ও সভ্যতা তার উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে। দাবিটা হয়তো সর্বাংশে মিথ্যা নয়, তবে দ্যা প্লেগ পড়ে মনে হয় মানুষের সহজাত-প্রবৃত্তি আর অসহায়ত্বে কোনো পরিবর্তন আসেনি। উপন্যাসে আফ্রিকার ফ্রেঞ্চ কলোনী আলজেরিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী একটি শহর ওরান-এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নোংরা ও বৈচিত্র্যহীন এ-শহরে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ডাক্তার বার্নার্ড রেক্সের প্রচেষ্টায় নগর কর্তৃপক্ষ শহরটি লক-ডাউন করে দেয়। প্লেগের মহামারী হয়ে ওঠার খবরটি প্রথমদিকে নগরকর্তৃপক্ষ চাপতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত জরুরী অবস্থা জারির মাধ্যমে স্বীকার করে নেয়। বেশ কিছুদিন থেকেই প্লেগে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে জানার পরেও প্রথমদিকে নগরবাসী মনে করেছিলো- এটা সাময়িক। ফলে তাদের মধ্যে-আমাদের মতোই-এক ধরনের ছুটি ছুটি মনোভাব দেখা দেয়। তবে নগর কর্তৃপক্ষের আরোপিত বিধিনিষেধ এবং প্রতিদিন প্লেগ আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে মানুষের সে আমেজ কাটতে শুরু করে। ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকা লক-ডাউনে গৃহবন্দি নগরবাসীর মনে তিলে-তিলে দানা বাঁধতে শুরু করে হতাশা আর অবসাদ। এ-রকম একটা সময় ওরানের চার্চে একটি প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়। তাতে বক্তব্য রাখেন যাজক ফাদার প্যানেলক্স, তিনি বলেন- এই মহামারী ক্রমবর্ধমান পাপ আর ঈশ্বর-বিমুখতার পরিণতি। বিশেষত ওরান শহরের মানুষ ঈশ্বরের পথ থেকে বিচ্যুত, তাই তাদের শাস্তি দিতে ঈশ্বরের কোপদৃষ্টি প্লেগের রূপ ধরে শহরের উপর পড়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ ঈশ্বরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর দেখানো পথে চলা। ফাদারের এই বক্তব্য শহরবাসীর মনে সাময়িক একটা ভাবাবেশের সৃষ্টি করে। কিন্ত মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারে না। ডাক্তার, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাব প‚রণের জন্য এগিয়ে আসে জিন তারোর মতো শহরের বাইরে থেকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আসা মানুষ। বিশেষত তার প্রস্তাব ও উদ্যোগ এবং ডাক্তার রেক্সের সহযোগিতায় গঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। তাদের এই মানবিক ও বাস্তব প্রচেষ্টা দেখে অদৃষ্টবাদী এবং স্বভাব-ধর্মপ্রচারক ফাদার প্যানেলক্সও এক সময় যোগ দিতে চায় স্বেচ্ছাসেবী পরিচ্ছন্নতা কর্মীদলে। দ্যা প্লেগ উপন্যাসে অদৃষ্টবাদী ফাদারের মনে যেমন পরিবর্তন এসেছিলো আমাদের সমাজের অদৃষ্টবাদীদের মধ্যেও সেরূপ পরিবর্তন আসুক। কোভিড-১৯ সৃষ্ট এই বৈশ্বিক মহামারীতে নিজেকে একেবারে অদৃষ্টের হাতে তুলে না দিয়ে সংকট মোকাবিলায় নিজের করণীয়টুকু করলেই নিজ ও সমাজের জন্য মঙ্গল। রাষ্ট্র আমাদের কাছে বেশি কিছু চায়নি- চেয়েছে শুধু আমরা যেনো নিজ ঘরে থাকি এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখি। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ দেখে মনে হচ্ছে আমরা সেটুকুও করতে পারছি না। পারলে বিভিন্ন শহরের বাজার, রাস্তা-ঘাটে এতো ভিড় কেনো?

একটা স্বীকারোক্তি দিয়ে রাখি- আমি নিজেও কোভিড-১৯ এর কারণে কলেজ বন্ধ হবার পর থেকে সেই ছুটির আমেজে ভাসছিলাম। আর ভাবছিলাম এই অবসরে দীর্ঘদিনের বকেয়া পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কাজগুলো সমাধা করবো। এমনিতেই ভবঘুরে স্বভাব আমার, বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। কিন্তু সেই আমি আমার সহজাত ভবঘুরে প্রবৃত্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। এক্ষেত্রে আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে আমার স্ত্রী, টিভি, ঘরে থাকা বই-পত্র আর ইন্টারনেট সংযোগ। এমন দীর্ঘ গৃহবন্দিদশা মনে অবসাদের জন্ম যে দেয় না তা নয়, তবে তা কাটিয়ে উঠতে নিজের কাজে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। মনে পড়ছে দ্যা প্লেগ উপন্যাসের প্যারিস কেন্দ্রিক পত্রিকার সাংবাদিক রেমন্ড র‌্যামবার্টের কথা। যে লক-ডাউনের কদিন আগেই ওরান এসেছিলো শহরে বসবাসরত আরব সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন-যাত্রার মান সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করতে। দীর্ঘ ও অনির্দিষ্ট লক-ডাউন তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিলো। তার হতাশার অবশ্য অনেক কারণ ছিলো ত্রিশ বছরের স্ত্রী অল্পদিনের মধ্যেই একত্রিশে পড়বে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে। কবে শেষ হবে লক-ডাউন, কবে হবে স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ- তার অনেক চিন্তা। আমাদের কারো-কারো হয়তো এজাতীয় চিন্তা ও অনুভ‚তি থাকতে পারে, এমনকি অনুরূপ পরিস্থতি থাকাও অসম্ভব নয়। তবে সাংবাদিক রেমন্ড র‌্যামবার্টের সময়টা ছিলো ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ- আজ থেকে আট দশক পূর্বে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাংবাদিক র‌্যামবার্টের অসুবিধাগুলো বর্তমানে দুর করেছে। ফলে আমরা অন্তত ততোটা মানসিক আবসাদে থাকবো না, যতোটা সেই ফরাসি সাংবাদিক ছিলো। কেউ কেউ হতাশা, ভীতি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার শিকার হতে পারেন- যেমনটা হয়েছে আমার স্ত্রী। সে প্রতিদিনই প্রায় খোঁজ করে টিকা কবে আবিষ্কার হবে? কবে সবকিছু ঠিক হবে? কোনো ঔষধ যদি আবিষ্কার করা সম্ভব না হয়? অবসাদ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রভৃতি মানসিক চাপ কাটাতে পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করে যাচ্ছি।

আশার কথা শুরুর সেই ছুটি ছুটি আমেজ তিন সপ্তাহের মধ্যে খুবই ধীর গতিতে হলেও থিতিয়ে এসেছে। কোভিড-১৯ এর শুরুর দিনগুলোতে যারা মাস্ক,  গ্লাভস পরে বাইরে চলাফেরাকে একটু বাঁকা চোখে দেখছিলো তারা এখন অনেকেই এগুলো ব্যবহার করছে। দোকানে হ্যান্ডওয়াশ, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, সাবান, ডেটল-স্যাভলনের মতো জীবাণুনাশকের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিলো লক-ডাউনের প্রথম ধাপেই। এই একুশ দিনে হাত ধোবার অভ্যাসও গড়ে উঠেছে নিশ্চয়। ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতিও আমরা সচেতন হয়ে উঠেছি- এমনটা আশা করা যেতেই পারে। নিজের তাগিদে নাহোক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় বাইরে অযথা ঘোরাঘুরি করা মানুষের সংখ্যা কমছে- বগুড়া শহরের মধ্যে- এগুলো সত্যিই আশার কথা। আরো একটি আশার কথা হলো কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক তিনটি টিকা হিউম্যান ট্রায়ালে গিয়েছে।

ড. সরোজকুমার ঘোষ
সহকারী অধ্যাপক
বাঙলা বিভাগ
বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ