লিখেছেন: নাজমা আক্তার

অটিজম এমন একটা অসুখ যেখানে মানুষ সবরকম সামাজিক সংস্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। রোগটা এমনই যে সারা জীবন থেকে যায়। শুধু তাই নয়, পরবর্তী প্রজন্মও উত্তরাধিকার সূত্রে এই রোগটা পেতে পারে।। ২০১৪ সালের একটা গণনা অনুযায়ী১, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক ৬৮ জন শিশুর একজনের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ পাওয়া গেছে।

অটিজম শব্দটা এসেছে একটা গ্রিক শব্দ থেকে: “অটোস” অর্থাৎ অহং। শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন অয়গেন ব্লয়লার (Eugen Blueler) নামে একজন সুইস মনোবিজ্ঞানী। ১৯১১ নাগাদ উনি ‘অটিজম’ শব্দটা ব্যবহার করেন স্কিজোফ্রেনিয়ার কিছু বিশেষ উপসর্গকে বোঝাতে। তারপর, ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটেনের গবেষকরা কথাটা বাজারে আনলেন সামাজিক বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের বোঝাতে। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লিও ক্যানার বেশ কিছু শিশুর অসামাজিক আচরণের কারণ বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনিও এই শব্দটাই বেছে নিলেন। এদিকে একই সময়ে হান্স অ্যাস্পার্গার নামে এক জার্মান বিজ্ঞানী খুবই কাছাকাছি কিছু উপসর্গ লক্ষ্য করলেন। সেগুলোকে এখন অ্যাসপার্গার্স সিনড্রোম বলা হয়।

সংক্ষেপে বললে,

অটিজম-এর তিনটে প্রধান বিশেষত্ব রয়েছে:
১। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
২। ভাষা বা অন্য উপায়ে নিজেকে প্রকাশ করতে অক্ষমতা
৩। কিছু বিশেষ ক্রিয়াকলাপে এতটাই মশগুল থাকা যে দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে

অটিজম ধরা পড়ে যেভাবে

অটিজমের রোগনির্ণয় বা ডায়াগনোসিস করার কোনো ডাক্তারী পরীক্ষা এখনো অবদি বেরোয়নি। তার বদলে চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীরা অটিজম নির্ণয় করতে আচরণ-সংক্রান্ত কিছু সর্বস্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। রোগের উপসর্গের উপর ভিত্তি করে একটা নিয়মাবলী মেনে রোগীকে একটা স্কোর দেওয়া হয়। স্কোর একটা সীমা ছাড়িয়ে গেলে তখন রোগী সন্দেহের আওতায় পড়ে। তারপর পাকাপাকিভাবে অটিজম সাব্যস্ত করতে একটা পাঁচমেশালী বিশেষজ্ঞ দলের প্রয়োজন হয়। তাতে থাকে শিশুরোগের বিশেষজ্ঞ বা পিডিয়াট্রিসিয়ান, মনোবিজ্ঞানী, স্পিচ-ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট-এর মত হরেক বদ্যি।

বিজ্ঞানীদের কাছেও অটিজম একটা পুরনো ধাঁধা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও যার কোনো সুরাহা হয়নি। আর সব মস্তিষ্কের ব্যারামের থেকে অটিজম বেশ আলাদা। একে তো, উপসর্গের বৈচিত্র্য দেখে রোগটা কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ বোঝা যায় না। তায় আবার বিভিন্ন রোগীর মধ্যে অটিজমের প্রকাশ হয় বিভিন্ন মাত্রায়। তাদের বাহ্যিক চালচলন আলাদা, তাদের স্বাধীন ভাবনাচিন্তার ক্ষমতাও আলাদা। এই বিপুল বৈচিত্র্যকে বোঝাতে অটিজমকে একটা বড়সড় দলে ফেলা হয় — অটিজম স্পেকট্রাম কন্ডিশনস বা এ.এস.সি.।

লক্ষণ / উপসর্গ

প্রথমে উপসর্গের বৈচিত্র্যকেই ধরা যাক। অটিজমের সবচেয়ে স্পষ্ট ছাপ পড়ে সামাজিক আদানপ্রদানের মধ্যে। কিন্তু, সেখানেও নানারকম সম্ভাবনা দেখা যায়। কেউ কেউ লোকসমাজে কথাই বলতে পারেনা, কেউবা কথা বললেও নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেনা। আরেকটা লক্ষণ হলো, সামাজিক আদবকায়দায় চূড়ান্ত আনাড়িপনা। যেমন, লোকসমাজে কি বলতে আছে, কি নেই, বুঝি না। কার সাথে কিরকম ভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে জ্ঞান নেই। বন্ধু পাতানো, কি সামান্য বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা, স্বভাবের মধ্যেই নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।

শুধুমাত্র সামাজিক আচরণের মাধ্যমেই যে অটিজম প্রকাশিত হয়, তাও নয়। বন্ধ দরজার আড়ালেও তাকে দেখা যায়। যেমন, বিশেষ কয়েকটা বাঁধাধরা কাজে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা। অস্বাভাবিক মনোযোগ সহকারে ঘুরেফিরে একই জিনিস বারবার করে চলেছে, এরকমটা অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়।

কিন্তু অনেক সময় তাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি সজাগ হয়। আপনি-আমি যেসব ঘটনাকে লক্ষ্যই করব না, যেমন গাছের পাতা নড়া বা দেওয়ালে আলোর খেলা, সেগুলো তাদের কাছে চলচ্চিত্রের মত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর খারাপ দিকটা হলো, আপনি-আমি যেসব অসুবিধেকে পাত্তাই দেবো না, সেগুলোকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না। অনেক সময় তো সেসব তাদের কাছে বিভীষিকার আকার ধারণ করে। যেমন, কোনো বিশেষ ফ্যাব্রিকের ছোঁয়া, কিম্বা বিশেষ কম্পাঙ্কের শব্দ, বা হয়ত কোনো অপছন্দের রং বা খাবারে হালকা বিস্বাদ। লেখিকা ডোনা উইলিয়ামসে কথায়:

“তীব্র আলো, রঙের বাহার আর হাজারো নক্সা, এই সব মিলিয়ে ইন্দ্রিয়ের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। তাতে দেহ এমনভাবে সাড়া দেয় যেন ক্রমাগত আক্রমণ চলছে তার উপর। একে একে আসে মাথা ধরা, উৎকন্ঠা, থেকে থেকে দুশ্চিন্তা কিম্বা পাল্টা আক্রমণের প্রবৃত্তি।”

প্যাটার্ন বা নক্সা খুঁজে পাওয়ার দক্ষতায় সাধারণ লোকে অটিস্টিক লোকজনের ধারেকাছেও আসে না।

এবার দ্বিতীয় বিষয়টাতে আসা যাক। সব অটিস্টিক রোগী একরকম হয়না। একদিকে আছে আদি-অকৃত্রিম অটিজম, যেখানে কথা বলাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে রয়েছে অ্যাসপার্গার্স সিনড্রোম, যেখানে কথা বলতে কোনো সমস্যা নেই। আই. কিউ. স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের উপরে। কিন্তু দুই ধরনের অটিস্টিক রোগীর ক্ষেত্রেই অন্যান্য সামাজিক সমস্যাগুলো একই বা সাধারণ আগ্রহের জায়গাটা একইরকম সীমিত, যা সাধারণভাবে স্বাভাবিক মানুষের সাথে মেলে না। এদিকে, অ্যাসপার্গার্স-ওয়ালাদের চমকে দেওয়ার মত কিছু ক্ষমতা থাকে। কেউ হয়তো অসাধারণ শিল্পী, কেউ সংখ্যা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, কেউ আবার অঙ্ক বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মত খুঁটিনাটি বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন।

এখানেই বৈচিত্র্যের শেষ নয়। সাধারণ মানুষের, অর্থাৎ যারা অটিস্টিক প্রমাণিত হয়নি তাদের মধ্যেও এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটু আধটু দেখা যায়। প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট সাইমন ব্যারন-কোহেন দেখিয়েছিলেন, সমাজে গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ বা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে অটিজম-সম বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়।২,৩ সেই কারণেই, অটিজমকে একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটু আধটু দেখা যায়। প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট সাইমন ব্যারন-কোহেন দেখিয়েছিলেন সমাজে গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ বা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে অটিজম-সম বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়। সেই কারণেই, অটিজমকে একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের শ্রেণীর মধ্যেও ফেলা হয়। নামটা আগেই বলেছি, অটিজম স্পেকট্রাম কন্ডিশনস বা A.S.C।

অটিজম নিয়ে গবেষণা

মূলত, তিনটে দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গবেষণাটা চলে।

১। জেনেটিক গবেষণা – ক্রোমোসোমে খুঁত ধরা, সম্পূর্ণ জিনোমের সিকোএন্সিং করা বা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে জিনের উপর কারিকুরি করা — সব এই ধরণের গবেষণার আওতায় পড়ে।

২। স্নায়বিক গবেষণা – সাধারণত, এই গবেষণায় ম্যাগনেটিক রেসনান্স ইমেজিং (এম.আর.আই.) বা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফির (ই.ই.জি.) মাধ্যমে অটিস্টিক রোগীর মস্তিষ্কের ছবি তুলে তার সাথে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের ছবির তুলনা করা হয়।

৩। রোগীর হাবভাবের উপর নজর রাখা। বেশ কিছু পরীক্ষা হয় যার দ্বারা চটজলদি সাধারণের থেকে অটিস্টিক লোকজনকে আলাদা করা যায়। একটা পরীক্ষার কথা আগেই বলেছি — লুকোনো আকৃতি খুঁজে বার করা। একে বলে, এমবেডেড ফিগারস টেস্ট।

অটিজম নিয়ে ভিন্ন ভাবে চিন্তা

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিভিন্ন উপসর্গগুলোকে আলাদা আলাদা করে দেখতে হবে। যেমন, রোগীর অবস্থা কতটা খারাপ, তার একটাই রেটিং দেওয়ার মানে হয়না। তার থেকে সামাজিক উপসর্গের উপর একটা রেটিং, কাজকর্মের উপসর্গে আরেকটা রেটিং, ইন্দ্রিয়ের প্রখরতায় একটা তৃতীয় রেটিং — এরকম দেওয়া গেলে ছবিটা অনেক স্পষ্ট হয়। আর মলিকুলার জেনেটিক্সের ক্ষেত্রেও একটাই ‘অটিজম জিন’ খোঁজার চেষ্টা ছাড়া উচিত। তার থেকে বিভিন্ন উপসর্গের পেছনে কি জেনেটিক প্যাটার্নের অবদান রয়েছে, সেই খোঁজেই জোর দেওয়া উচিত। কারণ, এটা তো মোটামুটি স্পষ্ট যে বেশিরভাগ জিনই একা অনেকগুলো উপসর্গের জন্যে দায়ী নয়।

কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়। একটা যদি ব্যাখ্যা না পাওয়া গেল তো এই বিভিন্ন উপসর্গগুলো একসাথে হানা দেয় কেন? কাকতালীয় তো হতে পারেনা। জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। যদিও বেশিরভাগ জিন একটাই উপসর্গের সাথে জড়িত, কিছু জিন আছে যারা একাধিক উপসর্গের জন্ম দেয়। সেখানেই কি তবে রহস্যের চাবিকাঠি? অথবা, আচরণ-সংক্রান্ত গবেষণার দিক থেকে দেখলে, এটা কি হতে পারে যে এক ধরণের অক্ষমতার সাথে আরেকটার সম্পর্ক রয়েছে? হয়তো, একটা অক্ষমতা এলে আরেকটা আসবেই আসবে?

একমেবাদ্বিতীয়ম ব্যাখ্যার সন্ধান ছাড়লে অটিজমের ‘একটিই’ চিকিৎসার সন্ধানও ছাড়তে হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেসব পরিবার তাদের শিশুদের কি হয়েছে বোঝবার চেষ্টা করছে, যে মনোরোগ-বিশেষজ্ঞগণ রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ বাতলাচ্ছে, যেসব অটিস্টিক ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে নিজেদের ক্ষমতা ও অক্ষমতার সাথে পরিচিত হচ্ছে, কিংবা যেসব গবেষক নতুন ওষুধ-বিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজছে, তাদের কাছে এটা একটা নতুন ভাবনার খোরাক। তবে যদ্দিন না রহস্যের সমাধান হচ্ছে, উপসর্গগুলোকে বোঝা এবং কাবু করা ছাড়া উপায় নেই।

লেখার উৎস:

[১] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা শহরের সেন্টার ফর ডিসিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর অটিজম এন্ড ডেভেলপমেন্টাল ডিসেবিলিটিস মনিটরিং নেটওয়ার্ক বিভাগটি, ২০১৪-তে এই গণনাটা করেছিল।

[২] Baron-Cohen, Simon, et al. “Autism occurs more often in families of physicists, engineers, and mathematicians.” Autism 2.3 (1998): 296-301

[৩] Baron-Cohen, Simon, et al. “The autism-spectrum quotient (AQ): Evidence from asperger syndrome/high-functioning autism, males and females, scientists and mathematicians.” Journal of autism and developmental disorders 31.1 (2001): 5-17

[৪] Amaral, David G., Cynthia Mills Schumann, and Christine Wu Nordahl. “Neuroanatomy of autism.” Trends in neurosciences 31.3 (2008): 137-145

[৫] Brambilla, Paolo, et al. “Brain anatomy and development in autism: review of structural MRI studies.” Brain research bulletin 61.6 (2003): 557-569

[৬] Jemel, Boutheina, Laurent Mottron, and Michelle Dawson. “Impaired face processing in autism: fact or artifact?.” Journal of autism and developmental disorders 36.1 (2006): 91-106