প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব।

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সালে হিন্দু বিধবা বিবাহের উপর দুইখানা বই লেখেন। তাঁর যুক্তির ভিত্তিতে একই সালে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। এই আইন পাশের ১৫৫ বছর পরে ভারতের বহরমপুরের নলখোলাতে দেখে এলাম ঈশ্বর চন্দ্রের সমস্ত শ্রম পন্ডশ্রম হয়ে গেছে। হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা আগে যা ছিলো এখনও তাই আছে। নরেনের মেয়ে বিধবা হয়ে নরেনের কাছেই ফিরে এসেছে। নরেন আগে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা ছিলো। এখন আর নয়। নরেন ওকে ঠাই দিয়ে যেনো মহৎ কাজ করে ফেলেছে। বিধবা মেয়েটি ফ্রিতে
খায়, দায়, কাজ করে আর উপোসের সময় উপোস করে। খাওয়া-পরার অভাব নাই। নরেন তো মেয়েকে মহাসুখে রেখেছে। ওর বয়স মাত্র ২০-২২ হবে। বাকী জীবন চলবে এভাবেই যতদিন না “মৃত্যু” ঘটে। মৃত্যুই ওর জীবনের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সে পর্যন্ত তাকে পেত্নীর মত অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে হবে। নরেন যখন বাড়িতে না থাকে, মেয়েটি নিশ্চয় জানালার ফাঁক দিয়ে মানুষ দেখে। মানুষেরা এদিক-ওদিক-সেদিক স্বাধীন মত ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যায় তা সে জানে না। হয়তো একই মুখ প্রতিদিন দেখে। কিন্তু সে কাউকে চিনে না। ২০-২২ বছর বয়স। ভরা যৌবনকাল। মন চঞ্চল হওয়ার এটাই সময়। কিন্তু জানালায় হাত দেওয়া যাবে না। ভগবানের রাগ হবে। কে ভগবান? ভগবান ইজ ভগবান। কোন প্রশ্ন করতে নেই। মানসিক প্রতিবন্দীদের কোন প্রশ্ন করতে হয় না।

খুরশীদ আনোয়ার (ছদ্মনাম) বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলো। পাশ করে আমি প্রকৌশল অনুষদে শিক্ষক হিসেব যোগদান করি। খুরশীদ আনোয়ার যোগ দেয় সরকারী/আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানে। সেই ১৯৭৪-৭৫সালের পর দেখা হয়নি। অতি সম্প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। ওর দুই মেয়ে ইংল্যান্ডে ইলেক্ট্রিক্যাল/ইলেক্ট্রোনিক্স ইঞ্জিনীয়ারিংএ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তো তখন। মাঝে মাঝে বলতো – মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময় হচ্ছে। ভালো পাত্রের সন্ধান থাকলে জানাইও। ওদের দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়াতে অত্যন্ত সুন্দর সুখী জীবন-যাপন করছে।

খুরশীদ নিজে উচ্চ পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিল। বর্তমানে অবসর নিয়ে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি। বয়স্কদের কমন টপিক শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে একদিন কথা হচ্ছে। হঠাৎ বললো, – তোমার একটু সময় হবে? আমি বললাম, কেনো? তখন বললো, আমার তৃতীয় মেয়েটি নিয়ে তোমার সাথে আলাপ করতে চাই।

খুরশীদ আনোয়ার যখন তার তৃতীয় মেয়ের গল্প শোনায়, আমি বিভ্রান্ত হয়েপড়ি, – আমি তো জানতাম তোমার দুটি মেয়ে এবং সবাই উচ্চশিক্ষিতা এবং ভালো ছেলেদের সাথে বিয়ে দিয়েছো। এই মেয়েটি কোথা থেকে এলো? তখনই খুরশীদ সিনেমার মত ঘটনাটা খুলে বলে, ‘আমি ওর ঔরসজাত পিতা নই, কিন্তু আমি অন্য দুই মেয়ের চেয়ে একবিন্দুও কম আপন মনে করতে পারিনা।’

মেয়েটার একটা সুন্দর স্বাভাবিক সুখময় জীবন ছিলো। সংসারে হঠাৎ নেমে আসে প্রচন্ড ঘূর্নিঝড়। বাবা এবং তার স্বামীর মৃত্যু হয় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। সব কিছু লন্ড-ভন্ড হয়ে যায় নিমিষে। একটা চাকুরী খুব দরকার। মেয়েটি মেধাবী এবং চাকুরীটার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার কোন কমতি নেই। খুরশীদ এইচ-আরকে নির্দেশ দেয় এই মেয়েটিকেই নিয়ে নিতে। একটা অতিরিক্ত প্রমোশনসহ পরদিনই মেয়েটা কাজে যোগ দেয়।

মেয়েটির বাবার একটি ভালো ব্যবসা এবং দুটো বাড়ি ছিলো। বাবার কিডনীতে সমস্যা দেখা দেয়। দুটো বাড়ীর বিক্রি করে চিকিৎসা শুরু হয়। কিডনী ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। তারপরেও বাবা বাঁচেন নি। কাকার ব্যবসা-বুদ্ধি কম। ব্যবসাটি আগের মত চলছে না। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিলো বিদেশী ব্যাংকে চাকুরীরত একজন ভালো পাত্রের সাথে। কিন্তু হার্ট এটাকে তারও মৃত্যু হয়। সে এখন নিজের ৪/৫ বছরের একটি মেয়ে এবং মাকে নিয়ে বিপদাপন্ন। খুরশীদ আনোয়ারের দেওয়া চাকুরীটাই তার একমাত্র উপার্জনের উৎস।

একটা দুস্থ মেয়েকে চাকুরী দিয়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করেছে খুরশীদ। এরকম সহায়তা আমি কাউকে দিতে পারিনি। আমি উচ্ছসিত হয়ে বারবার এই প্রশংসাই করছিলাম। সে বললো – আমার অন্য দুটো যেমন সুখে আছে, আমি চাই আমার এই শেষ মেয়েটিও সুখের সংসার করুক। কিন্তু আমার সীমাবদ্ধতার জন্য আমি কিছু করতে পারছি না। তুমি যদি কিছু করতে পারো! “সীমাবদ্ধতা”টা কী তা আমি খেয়াল করিনি। বললাম – ভালো চাকুরী করছে, মাস্টার ডিগ্রীর জন্য পড়াশুনাও করছে। একটা বিয়ের ব্যবস্থা করো।

এবারে খুরশীদ যা বললো তা এরকমঃ মেয়েটি হিন্দু, আর আমি মুসলমান। আমি বিয়ের খরচ দিতে পারি। কিন্তু হিন্দু পাত্র কী ভাবে খুজবো! আমার কথা কে শুনবে? সেজন্যই তোমাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছি।

খুরশীদের মহানুভবতা সীমাহীন। কিন্তু সে খুবই অসুস্থ। এক কথায় বলা যায়, হার্ট এট্যাকে বার কয়েক মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে – হার্টে অপারেশন করার আর কোন সুযোগ নেই। এই অবস্থায় যে কয়দিন বাঁচে এটাই বেশী। মৃত্যুর আগে সে দেখতে চায় তার তিনটি একই রকম সুখে সংসার করছে।

খুরশীদের সাথে আমার ভাবনাগত কিছু মিল আছে। বললো – ‘পৃথিবীর মানুষের জন্য কিছুই দিতে পারলাম না।’ এটা হুবহু আমার কথা। আমিও কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। নিয়মিত রক্তদান করি। তাতে কয়েকজন মানুষের উপকার হয় ভেবে আনন্দ পাই। বললাম, – মরণোত্তর দেহ দানের ব্যবস্থা করেছি। খুরশীদ বললো – আমিও চেষ্টা করছি। ফরম এনেছি। কিন্তু যারা আমাকে এই কাজে সহায়তা করবে সেই অফিসের লোকেরাই নানা রকম প্রশ্ন করে আমাকে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু আমি দমছি না। ফ্যামিলিকে বুঝাচ্ছি কেনো আমি এটা করতে যাচ্ছি।

বললো – মরণোত্তর দেহদানটা হয়ে যাবে। এরপর আমার একটাই ইচ্ছাপূরণ বাকী থাকবে। সেটা আমার এই মেয়েটির জন্য সুখের একটা সংসার পেতে যাওয়া। কিন্তু অসুবিধা হলো, আমি তো মুসলমান। আমি চাইলেই হিন্দুদের সামাজিকতায় নাক গলাতে পারি না। তাই তোমাদের সাহায্য চাইছি। আমার আয়ুটাও দিন দিন সীমিত হয়ে আসছে।

খুরশীদ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অসহায়া এই হিন্দু মেয়েটাকে মনে-প্রাণে নিজের মেয়ে করে নিয়েছে। এর একটা ভালো সংসার হবে, এটাই তার শেষ স্বপ্ন। কিন্তু কোন হিন্দু এগিয়ে আসেনি। হিন্দুরা আসেনা। এরা এসবকে সমাজবিরোধী কাজ মনে করে। এরা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে মন্দির বানায়, মন্দির সাজায়। এরা সোনার গয়না দিয়ে অস্তিত্বহীন দেবদেবীর শরীর ঢেকে ফেলে। মানুষ এদের কাছে তুচ্ছ। বিধবা হলে তো কথাই নেই। হিন্দু সমাজে একজন মানুষের চেয়ে গরুর মূল্য অনেক অনেক বেশী।

খুরশীদের মাথায় এক চিন্তা, এক ধ্যান – তিনটা মেয়ে একই রকম সুখে থাকুক। শীল বাবু নামে তার প্রাক্তন বসের সাথে আলাপ করে। এই নরপিশাচটি খুরশীদকে বুঝতেই পারলো না। তিনি অনেকদিন বসগিরি করতে পারেন না। খুরশীদকে পেয়ে বসগিরি শুরু করলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সুরে কথা শুরু করলেন। মেয়েটি নিয়ে মজা করলেন। তার জানা ৭০/৭২ বছরের বিপত্নীক বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দেওয়ার মস্করা করলেন। নিজে বিপত্নীক থাকলে এই ঘাটের মরাটি হয়তো নিজেই বিয়ে করতে চাইতেন। হিন্দু খচ্চরগুলো এরকম মস্করা করতেই ওস্তাদ। এই শীলবাবু এবং নৌ-মন্ত্রী দুটোই খচ্চর এবং নরপিশাচ। এদেরকে শাহবাগের মোড়ে কান ধরে উঠবস করানো উচিৎ।

এরকম আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো। আমার জানা একটা ছেলে একটি মেয়ে সহ এক বিবাহিতা মহিলাকে বিয়ে করেছে। পুরণো ঢাকায় একটা গলিতে থাকে। ২০১০ সালে ছেলেটির বাসায় গিয়েছিলাম। ওদের এখন দুটো মেয়ে। ছেলেটি ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালায়। কিন্তু সোনার সংসার। মেয়ে দুটি ভারী লক্ষ্মী। স্ত্রীটিকেও আমার খুব ভালো লাগলো। এই ঘটনাটি নিয়েও সমাজে প্রচুর চুলকানি শুরু হয়ে গেছে তখন। তার শিক্ষিত মামার সাথে কথা বললাম। পাত্তা পেলাম না। তার কাছে ভাগ্নে অপকর্ম করেছে। তিনি নীতিবান, অপকর্মকে সমর্থন করেন না। আমার এক বিজ্ঞ বন্ধুর সাহায্য চাইলাম। ইনি শীল বাবুর এক ধাপ উপরে অবস্থান করেন। শুনেই বললেন, – আরে, বকনা বাছুর না, ও তো গাই গরু (গাভী) এনেছে বাছুর সহ (মেয়ে)। মানুষের শরীরের ভিতরে এমন কুৎসিৎ মন লুকিয়ে থাকতে পারে তা মানুষের চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই।

ছেলেটার মা তখন জীবিত। তিনি বলেছিলেন – ‘আমার ছেলে সুখে থাকলেই আমি খুশী। তোমরা ওদেরকে আমার কাছে এনে দাও।’ আমি চেষ্টা করেছিলাম ছেলেটিকে স্ত্রী ও মেয়ে সহ গ্রামে নিয়ে আসতে। কিন্তু পারিনি। একটা লোক যদি না খেয়ে মারা যায়, গ্রাম এবং হিন্দু সমাজের কিচ্ছু যায় আসে না। গ্রাম এবং সমাজের কলংক হয় যদি একটি ছেলে তার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে সুখে সংসার করে।

স্বামী এবং পিতৃহীন একটি মেয়েকে একটা নতুন সুখী সংসার গড়ে দেওয়ার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছে একজন মুসলমান। অথচ
দেখতে ভদ্র আসলে খচ্চর জাতীয় শীলবাবুদের লজ্জা হচ্ছে না। এদের মজা লাগছে।

শীলবাবুরা নতুন পৃথিবী গড়তে প্রতিবন্ধকতার খল নায়ক। এরা টানে পিছন দিকে। তরুণরাই পৃথিবীর প্রাণ শক্তি। ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে মেয়েটি পৃথিবীকে দেখেছে অনেক। সুখময় একটি সংসারের জন্য এই মেয়েটি একজন আদর্শ কারিগর হবে। আমি কোন আর কোনদিন শীলবাবুদের দ্বারস্থ হতে চাইনা। কামনা করি মেয়েটি এবং ওর বাচ্চাটি কোন হৃদয়বান তরুণের নজরে পড়বে। তখনই একটি সোনার সংসার গড়ে উঠবে। সেদিন আনন্দে আমার বন্ধু আত্মহারা হবে। টেলিফোনের এপাশ থেকে বন্ধুটির সাথে আমার চোখও অশ্রুসিক্ত হবে।