দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সালে হিন্দু বিধবা বিবাহের উপর দুইখানা বই লেখেন। তাঁর যুক্তির ভিত্তিতে একই সালে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। এই আইন পাশের ১৫৫ বছর পরে ভারতের বহরমপুরের নলখোলাতে দেখে এলাম ঈশ্বর চন্দ্রের সমস্ত শ্রম পন্ডশ্রম হয়ে গেছে। হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা আগে যা ছিলো এখনও তাই আছে। নরেনের মেয়ে বিধবা হয়ে নরেনের কাছেই ফিরে এসেছে। নরেন আগে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা ছিলো। এখন আর নয়। নরেন ওকে ঠাই দিয়ে যেনো মহৎ কাজ করে ফেলেছে। বিধবা মেয়েটি ফ্রিতে
খায়, দায়, কাজ করে আর উপোসের সময় উপোস করে। খাওয়া-পরার অভাব নাই। নরেন তো মেয়েকে মহাসুখে রেখেছে। ওর বয়স মাত্র ২০-২২ হবে। বাকী জীবন চলবে এভাবেই যতদিন না “মৃত্যু” ঘটে। মৃত্যুই ওর জীবনের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সে পর্যন্ত তাকে পেত্নীর মত অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে হবে। নরেন যখন বাড়িতে না থাকে, মেয়েটি নিশ্চয় জানালার ফাঁক দিয়ে মানুষ দেখে। মানুষেরা এদিক-ওদিক-সেদিক স্বাধীন মত ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যায় তা সে জানে না। হয়তো একই মুখ প্রতিদিন দেখে। কিন্তু সে কাউকে চিনে না। ২০-২২ বছর বয়স। ভরা যৌবনকাল। মন চঞ্চল হওয়ার এটাই সময়। কিন্তু জানালায় হাত দেওয়া যাবে না। ভগবানের রাগ হবে। কে ভগবান? ভগবান ইজ ভগবান। কোন প্রশ্ন করতে নেই। মানসিক প্রতিবন্দীদের কোন প্রশ্ন করতে হয় না।
খুরশীদ আনোয়ার (ছদ্মনাম) বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলো। পাশ করে আমি প্রকৌশল অনুষদে শিক্ষক হিসেব যোগদান করি। খুরশীদ আনোয়ার যোগ দেয় সরকারী/আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানে। সেই ১৯৭৪-৭৫সালের পর দেখা হয়নি। অতি সম্প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। ওর দুই মেয়ে ইংল্যান্ডে ইলেক্ট্রিক্যাল/ইলেক্ট্রোনিক্স ইঞ্জিনীয়ারিংএ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তো তখন। মাঝে মাঝে বলতো – মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময় হচ্ছে। ভালো পাত্রের সন্ধান থাকলে জানাইও। ওদের দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়াতে অত্যন্ত সুন্দর সুখী জীবন-যাপন করছে।
খুরশীদ নিজে উচ্চ পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিল। বর্তমানে অবসর নিয়ে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি। বয়স্কদের কমন টপিক শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে একদিন কথা হচ্ছে। হঠাৎ বললো, – তোমার একটু সময় হবে? আমি বললাম, কেনো? তখন বললো, আমার তৃতীয় মেয়েটি নিয়ে তোমার সাথে আলাপ করতে চাই।
খুরশীদ আনোয়ার যখন তার তৃতীয় মেয়ের গল্প শোনায়, আমি বিভ্রান্ত হয়েপড়ি, – আমি তো জানতাম তোমার দুটি মেয়ে এবং সবাই উচ্চশিক্ষিতা এবং ভালো ছেলেদের সাথে বিয়ে দিয়েছো। এই মেয়েটি কোথা থেকে এলো? তখনই খুরশীদ সিনেমার মত ঘটনাটা খুলে বলে, ‘আমি ওর ঔরসজাত পিতা নই, কিন্তু আমি অন্য দুই মেয়ের চেয়ে একবিন্দুও কম আপন মনে করতে পারিনা।’
মেয়েটার একটা সুন্দর স্বাভাবিক সুখময় জীবন ছিলো। সংসারে হঠাৎ নেমে আসে প্রচন্ড ঘূর্নিঝড়। বাবা এবং তার স্বামীর মৃত্যু হয় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। সব কিছু লন্ড-ভন্ড হয়ে যায় নিমিষে। একটা চাকুরী খুব দরকার। মেয়েটি মেধাবী এবং চাকুরীটার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার কোন কমতি নেই। খুরশীদ এইচ-আরকে নির্দেশ দেয় এই মেয়েটিকেই নিয়ে নিতে। একটা অতিরিক্ত প্রমোশনসহ পরদিনই মেয়েটা কাজে যোগ দেয়।
মেয়েটির বাবার একটি ভালো ব্যবসা এবং দুটো বাড়ি ছিলো। বাবার কিডনীতে সমস্যা দেখা দেয়। দুটো বাড়ীর বিক্রি করে চিকিৎসা শুরু হয়। কিডনী ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। তারপরেও বাবা বাঁচেন নি। কাকার ব্যবসা-বুদ্ধি কম। ব্যবসাটি আগের মত চলছে না। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিলো বিদেশী ব্যাংকে চাকুরীরত একজন ভালো পাত্রের সাথে। কিন্তু হার্ট এটাকে তারও মৃত্যু হয়। সে এখন নিজের ৪/৫ বছরের একটি মেয়ে এবং মাকে নিয়ে বিপদাপন্ন। খুরশীদ আনোয়ারের দেওয়া চাকুরীটাই তার একমাত্র উপার্জনের উৎস।
একটা দুস্থ মেয়েকে চাকুরী দিয়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করেছে খুরশীদ। এরকম সহায়তা আমি কাউকে দিতে পারিনি। আমি উচ্ছসিত হয়ে বারবার এই প্রশংসাই করছিলাম। সে বললো – আমার অন্য দুটো যেমন সুখে আছে, আমি চাই আমার এই শেষ মেয়েটিও সুখের সংসার করুক। কিন্তু আমার সীমাবদ্ধতার জন্য আমি কিছু করতে পারছি না। তুমি যদি কিছু করতে পারো! “সীমাবদ্ধতা”টা কী তা আমি খেয়াল করিনি। বললাম – ভালো চাকুরী করছে, মাস্টার ডিগ্রীর জন্য পড়াশুনাও করছে। একটা বিয়ের ব্যবস্থা করো।
এবারে খুরশীদ যা বললো তা এরকমঃ মেয়েটি হিন্দু, আর আমি মুসলমান। আমি বিয়ের খরচ দিতে পারি। কিন্তু হিন্দু পাত্র কী ভাবে খুজবো! আমার কথা কে শুনবে? সেজন্যই তোমাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছি।
খুরশীদের মহানুভবতা সীমাহীন। কিন্তু সে খুবই অসুস্থ। এক কথায় বলা যায়, হার্ট এট্যাকে বার কয়েক মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে – হার্টে অপারেশন করার আর কোন সুযোগ নেই। এই অবস্থায় যে কয়দিন বাঁচে এটাই বেশী। মৃত্যুর আগে সে দেখতে চায় তার তিনটি একই রকম সুখে সংসার করছে।
খুরশীদের সাথে আমার ভাবনাগত কিছু মিল আছে। বললো – ‘পৃথিবীর মানুষের জন্য কিছুই দিতে পারলাম না।’ এটা হুবহু আমার কথা। আমিও কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। নিয়মিত রক্তদান করি। তাতে কয়েকজন মানুষের উপকার হয় ভেবে আনন্দ পাই। বললাম, – মরণোত্তর দেহ দানের ব্যবস্থা করেছি। খুরশীদ বললো – আমিও চেষ্টা করছি। ফরম এনেছি। কিন্তু যারা আমাকে এই কাজে সহায়তা করবে সেই অফিসের লোকেরাই নানা রকম প্রশ্ন করে আমাকে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু আমি দমছি না। ফ্যামিলিকে বুঝাচ্ছি কেনো আমি এটা করতে যাচ্ছি।
বললো – মরণোত্তর দেহদানটা হয়ে যাবে। এরপর আমার একটাই ইচ্ছাপূরণ বাকী থাকবে। সেটা আমার এই মেয়েটির জন্য সুখের একটা সংসার পেতে যাওয়া। কিন্তু অসুবিধা হলো, আমি তো মুসলমান। আমি চাইলেই হিন্দুদের সামাজিকতায় নাক গলাতে পারি না। তাই তোমাদের সাহায্য চাইছি। আমার আয়ুটাও দিন দিন সীমিত হয়ে আসছে।
খুরশীদ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অসহায়া এই হিন্দু মেয়েটাকে মনে-প্রাণে নিজের মেয়ে করে নিয়েছে। এর একটা ভালো সংসার হবে, এটাই তার শেষ স্বপ্ন। কিন্তু কোন হিন্দু এগিয়ে আসেনি। হিন্দুরা আসেনা। এরা এসবকে সমাজবিরোধী কাজ মনে করে। এরা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে মন্দির বানায়, মন্দির সাজায়। এরা সোনার গয়না দিয়ে অস্তিত্বহীন দেবদেবীর শরীর ঢেকে ফেলে। মানুষ এদের কাছে তুচ্ছ। বিধবা হলে তো কথাই নেই। হিন্দু সমাজে একজন মানুষের চেয়ে গরুর মূল্য অনেক অনেক বেশী।
খুরশীদের মাথায় এক চিন্তা, এক ধ্যান – তিনটা মেয়ে একই রকম সুখে থাকুক। শীল বাবু নামে তার প্রাক্তন বসের সাথে আলাপ করে। এই নরপিশাচটি খুরশীদকে বুঝতেই পারলো না। তিনি অনেকদিন বসগিরি করতে পারেন না। খুরশীদকে পেয়ে বসগিরি শুরু করলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সুরে কথা শুরু করলেন। মেয়েটি নিয়ে মজা করলেন। তার জানা ৭০/৭২ বছরের বিপত্নীক বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দেওয়ার মস্করা করলেন। নিজে বিপত্নীক থাকলে এই ঘাটের মরাটি হয়তো নিজেই বিয়ে করতে চাইতেন। হিন্দু খচ্চরগুলো এরকম মস্করা করতেই ওস্তাদ। এই শীলবাবু এবং নৌ-মন্ত্রী দুটোই খচ্চর এবং নরপিশাচ। এদেরকে শাহবাগের মোড়ে কান ধরে উঠবস করানো উচিৎ।
এরকম আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো। আমার জানা একটা ছেলে একটি মেয়ে সহ এক বিবাহিতা মহিলাকে বিয়ে করেছে। পুরণো ঢাকায় একটা গলিতে থাকে। ২০১০ সালে ছেলেটির বাসায় গিয়েছিলাম। ওদের এখন দুটো মেয়ে। ছেলেটি ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালায়। কিন্তু সোনার সংসার। মেয়ে দুটি ভারী লক্ষ্মী। স্ত্রীটিকেও আমার খুব ভালো লাগলো। এই ঘটনাটি নিয়েও সমাজে প্রচুর চুলকানি শুরু হয়ে গেছে তখন। তার শিক্ষিত মামার সাথে কথা বললাম। পাত্তা পেলাম না। তার কাছে ভাগ্নে অপকর্ম করেছে। তিনি নীতিবান, অপকর্মকে সমর্থন করেন না। আমার এক বিজ্ঞ বন্ধুর সাহায্য চাইলাম। ইনি শীল বাবুর এক ধাপ উপরে অবস্থান করেন। শুনেই বললেন, – আরে, বকনা বাছুর না, ও তো গাই গরু (গাভী) এনেছে বাছুর সহ (মেয়ে)। মানুষের শরীরের ভিতরে এমন কুৎসিৎ মন লুকিয়ে থাকতে পারে তা মানুষের চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই।
ছেলেটার মা তখন জীবিত। তিনি বলেছিলেন – ‘আমার ছেলে সুখে থাকলেই আমি খুশী। তোমরা ওদেরকে আমার কাছে এনে দাও।’ আমি চেষ্টা করেছিলাম ছেলেটিকে স্ত্রী ও মেয়ে সহ গ্রামে নিয়ে আসতে। কিন্তু পারিনি। একটা লোক যদি না খেয়ে মারা যায়, গ্রাম এবং হিন্দু সমাজের কিচ্ছু যায় আসে না। গ্রাম এবং সমাজের কলংক হয় যদি একটি ছেলে তার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে সুখে সংসার করে।
স্বামী এবং পিতৃহীন একটি মেয়েকে একটা নতুন সুখী সংসার গড়ে দেওয়ার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছে একজন মুসলমান। অথচ
দেখতে ভদ্র আসলে খচ্চর জাতীয় শীলবাবুদের লজ্জা হচ্ছে না। এদের মজা লাগছে।
শীলবাবুরা নতুন পৃথিবী গড়তে প্রতিবন্ধকতার খল নায়ক। এরা টানে পিছন দিকে। তরুণরাই পৃথিবীর প্রাণ শক্তি। ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে মেয়েটি পৃথিবীকে দেখেছে অনেক। সুখময় একটি সংসারের জন্য এই মেয়েটি একজন আদর্শ কারিগর হবে। আমি কোন আর কোনদিন শীলবাবুদের দ্বারস্থ হতে চাইনা। কামনা করি মেয়েটি এবং ওর বাচ্চাটি কোন হৃদয়বান তরুণের নজরে পড়বে। তখনই একটি সোনার সংসার গড়ে উঠবে। সেদিন আনন্দে আমার বন্ধু আত্মহারা হবে। টেলিফোনের এপাশ থেকে বন্ধুটির সাথে আমার চোখও অশ্রুসিক্ত হবে।
লেখকের প্রথম ভাগে আমি যে উক্তি করেছি, তাঁর রাশ ধরে দ্বিতীয় ভাগে ও বলতে চাই যে, লেখক যতই প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করুন না কেন যে একটি সত্য ঘটনার উপর ইহা লেখা হইয়াছে, কিন্তু তাহা সত্য নয় বলে মনে করি, কেন না, (১) বর্তমান সময়ে কোন অল্প বয়সের মেয়ে সাদা থান পড়ে থাকে না। (২) কোন বাবা-মা তাঁর মেয়েকে সাদা থান পড়িয়ে বাড়ীর মধ্যে স্মাজিক ভাবে বন্ধী করে রাখে না। (৩) এখন কার মেয়েরা সেই পুরোন আমলের মেয়েদের মত নয় যে, তারা পর্দা প্রথা মেনে চলে না। বিশেষতঃ কোন অপরিচিত ব্যাক্তির সামনে না আসে লুকিয়ে থাকাটা শরৎ” চন্দ্রের গ্লপে পাওয়া যায়, কিন্তু বর্তমান সময়ে বাবার সাথে আসা একজন বয়স্ক ব্যাক্তির সামনে লুকিয়ে থাকাটা মেনে নেওয়া যায় না। কেন না পরবর্তী সময়ে ও অন্ধকারে লুকিয়ে থাকাটা অদ্ভুত লাগে। (৪) মেয়েরা বাড়ীর কাজ করে, কিন্তু বর্তমানে বাব-মা অত নিষ্ঠুর নয় যে বিধবা মেয়েটিকে দিয়ে বাড়ীর সব কাজ ক্রাবে শুধু দু-বেলা দু-মুঠো খাবার দেওয়ার জন্য। বিজন বাবুর প্রতিবাদ করা কে সঠিক বলে মনে করি। আমার মনে হয় এই রকম একটি লেখা লেখে লেখক পাঠক সমাজের বাহ বা কুড়োতে চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে দেখা যায় যে, কিছু লোক এখনো হন্দু সমাজের ফাঁকফোকর খুজে মরছে এবং সমালোচনা করতে চায়। কেন না হিন্দুদের সহনশীলতা ও ধ্রয্য অনেক বেশী এবং প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ও কম, এই সুযোগে র সদ্ব্যবহার করতে তারা ছাড়ে না। তারা নিজ কে অনেক প্রগতিশীল মনে করে। অথচ তারাই সমাজের বেশী ক্ষতি করে বা করছে।
আইয়ুব খান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ নিশ্চয়ই anti-indian আর anti-hindu ছিলো?
ভাল লেখা
লেখক কে ধন্যবাদ এই লেখাতে উপহার দেওয়ার জন্য।
লেখক যে কাহিনী তুলে ধরেছেন সেটা ২০১০ সাল। জানি না পশ্চিমবঙ্গে এখনো এমন গ্রাম ও পরিবার আছে কিনা যেখানে একজন শিক্ষিত বাবা তার ২২ বছরের বিধবা মেয়েকে সাদা শাড়ী পরিয়ে সুখে থাকেন শুধু না সেই মেয়ে আপাদমস্তক শরির ঢেকে অন্য পুরুষ, হোক সে বাবার বয়েশি, তার সামনে আসতে লজ্জা পায়। হাঁ, এমন একটা সময় ছিল বটে যখন বিশেষ করে কুলীন ব্রাহ্মন কন্যার সাথে বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দেওয়া হত। সেই অল্প বয়েশি মেয়ে বিধবা হলে তাকে সারা জীবন সাদা থান পড়ে বৈধব্যের জীবন কাটাতে হত। কিন্তু সে তো বহু যুগ আগে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর তো সেই জঞ্জাল ঝেটিয়ে বিদায় করা শুরু করে দিয়ে গেছেন। তার পর বহু সমাজ সংস্কার হওয়ার পর ওই সব দুঃস্বপ্ন এখন শুধুই অতীত। আজকের দিনে ওই সব ঘটনা টেনে এনে লেখক ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন?
একটি বিধবা (সন্তান সহ) মেয়ের বিবাহ হিন্দু সমাজে ততটাই কঠিন যতটা মুসলমান সমাজে। এমন কি বিপত্নীক (সন্তান সহ) পুরুষও দ্বিতীয় শ্রেনীর পাত্র। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্যা। তার সাথে মধ্যবিত্ত সমাজের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এই সমস্যাকে আরও অসহনিয় করে তুলেছে। এর সাথে ধিন্দু ধর্মকে টেনে আনার কারন বুঝতে পারলাম না। এই ধরনের পাত্রির বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্মীও বাধা সত্যিই নেই। আর্থ সামাজিক কারনই মুখ্য।
বিশ্বাস করুন হিন্দু নারী, মুসলমান নারী এই সব কস্নিস্কালেও মাথাতে ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু অভিজ্ঞতা হওয়াতে এখন মনের মাঝে কিছু অবাঞ্ছিত প্রশ্ন উঠে আসছে। আপনাদের সাথে সেই মনকষ্ট ভাগ করে নিতেই কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি। আমার মনে এই ‘কু চিন্তা ‘ আসার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন নাটকে (telefilm) সাধারণ ভাবে হিন্দু বা মুসলমান চরিত্র সে ভাবে উল্লেখ থাকে না বা থাকলেও তার ধর্মীও পরিচয় কখনই সোচ্চার হয় না। কিন্তু লক্ষ্য করছি কোন নারী চরিত্র যদি, ‘চরিত্রহীন’, হয়, বিশেষ করে সে যদি ‘পরকীয়া’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সেই নারী চরিত্রটি কেন জানি না শুধু হিন্দু নারী হয়। এটা শুধুই কাকতালীয় ধরে নেওয়া যেত। কিন্তু সব নাটকেই দেখছি একই অভিজ্ঞতা। কেন বলুন তো? হিন্দু মেয়েদের চরিত্র নিয়ে যে ভাবে খুশি কাটা ছেঁড়া করা যায় বুঝি! ওই নারী মুসলমান নারী হলে কি সমাজে প্রতিবাদ আসবে বলে পরিচালক ভয় পান? পাঠক কয়েকটি নাটক দেখতে পারেন । ১) “সারাদিন বৃষ্টি, জানালা বারান্দা ছাদ”, ২) বয়সন্ধি ৩) পুতুলের সংসার । তিনটি ক্ষেত্রেই নারী চরিত্র গুলি হিন্দু বা মুসলমান না হলেও নাটকটির কোন ক্ষতি হত না। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারনে ওই নারীগুলি শুধুই হিন্দু।
এ ছাড়া আর একটি দিক উল্লেখ করছি। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি বিবাহের ক্ষেত্রে আন্তধর্ম বিবাহ সমাজে ভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখ যোগ্য ভুমিকা নিতে পারে। নর নারী পরস্পর প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হবে, সব সামাজিক বাধা ছিন্ন করে বিবাহ করবে এবং সমাজ আরও উদার ও প্রগতিশিল হবে। কিন্তু নাটকে সব ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি শুধু মাত্র হিন্দু মেয়েই মুসলমান ছেলেদের প্রেমে পড়ে। উদাহরণ ১) কাঁটা তারের বেড়া ২) পেনসিলে আঁকা ভালবাসা । মুসলমান নারীদের হিন্দু পুরুষদের প্রেমে পড়ার নাটক কি সমাজ মেনে নেবে না। জানি বাস্তবে হিন্দু নারীদের মুসলমান ছেলেদের বিয়ে করার মত কিছু মুসলমান নারীও হিন্দু পুরুষদের বিয়ে করে। কিন্তু আমার প্রশ্ন নাটকে কেন সেটা দেখান যাবে না? ভয়টা কোথায়?
তাই বুঝি এখানেও লেখক হিন্দু মেয়েকেই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন?
অনুগ্রহ করে আমার ভুলটা ধরিয়ে দিলে খুশি হব।
বিজন ঘোষ
কলকাতা
৪/৮/২০১৮
বিজনবাবু,
আপনাকে নমস্কার লেখাটি পড়ার জন্য এবং বেশ কিছু সংবেদনশীল বিষয় সামনে আনার জন্য। আমি একে একে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করবো।
১। আমার লেখার কোন চরিত্র কাল্পনিক নয়। নামগুলো কাল্পনিক। ২০১০ সালেও বিদ্যাসাগর আমলের ঘটনা ঘটে। তবে সংখ্যায় কম একটু ইতিহাসে চলে যাই। আমার গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটা খাল। আমরা উত্তর পাড়ের বাসিন্দাদের ওপারের অমুক বলতাম। ব্যঙ্গ করে অনেকেই “বিধবা” পাড়া বলতো। আমি যখন স্কুলে পড়তাম (পূর্ব পাকিস্তান), তখন ঐ পাড়ার প্রতি দুই বাড়ীর একটিতে খুব অল্প বয়েসী বিধবা দেখা যেতো। কারণ ছিলো – তখন প্রতি বছরই কলেরা-বসন্তের মহামারী হতো এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষরা মারা যেতো। আমি কোন বিধবার বিয়ে হতে বা এ নিয়ে কোন আলাপ করতে শুনিনি।
২। আমি প্রচুর নাটক দেখি। অন্তত একটা নাটক না দেখে ঘুমাবো এরকম রাত আমাদের জীবনে খুব বেশী নাই। বাংলাদেশের নাটকের উৎকর্ষতা নিয়ে একটা লেখা ছিলো মুক্তমনায়। খুজে পেলাম না। আপনার উল্লেখিত নাটক গুলো কী ভাবে মিস করলাম বুঝতে পারলাম না। অবশ্যই খুজে দেখবো। হ্যা, আপনার অবজারবেশনের সাথে আমি একমত। আ) বাংলাদেশের নাটকের চরিত্রগুলোর নাম এবং ঘটনাগুলো ধর্মীয় কলুষতা মুক্ত। আন্তরিক অভিনন্দন। আ) তবে ইদানীং পরিবর্তন লক্ষ্য করছিঃ ক) ইসলামী বাংলাদেশ হিজাব আর গিজাবের গ্যাঞ্জামে আচ্ছন্ন, নিমগ্ন। নাটকে হিজাবের পদধ্বনি দেখতে পাচ্ছি। ক) দুঃচরিত্রা নারীর জন্য হিন্দু নারী চরিত্র ব্যবহার হচ্ছে। নীচে উল্লেখ করছি।
৩। আমার ফেসবুকে https://www.facebook.com/nripendra.sarker
“Nripendra N Sarker
July 27 at 2:23 PM ·
“জলসাঘর”
শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবদাস” অবলম্বনে জাকারিয়া সৌখিনের টেলিফিল্ম “জলসাঘর”। নতুন আঙ্গিকে, সমসাময়িক কালের পটভূমিতে একটা নতুন ধরণের কাজ।
চোতামারা কাজ। কিন্তু মূল কাহিনীর রেফারেঞ্চ দেওয়া হয়েছে।
দেবদাস নিয়ে প্রচুর সিনেমা হয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম চরিত্রগুলোর নাম পাল্টানো হয়েছে। বোধ করি কাহিনীকে আধুনিকীকরণ এবং Demographic চাহিদার জন্যই এটা করা হয়েছে। কিন্তু দেবদাসের চরিত্রে পবন সাহেবকে মদ্যপ হতে হয়েছে। বাংলাদেশে কোন চরিত্রকে খারাপ দেখাতে চিরাচরিত মদ্যপ করা ছাড়া দ্বিতীয় পথ নাই। মদ্য কি ইয়াবাজাতীয় কোন ড্রাগের চাইতেও খারাপ?
সর্বোপরি টেলিফিল্মটি উপভোগ্য হয়েছে।”
ফেসবুকে গেলে উপরের স্ট্যাটাসটা দেখতে পাবেন। এই নাটকে দেবদাসের নাম “পবন”, পার্বতীর নাম “অবনী”। মূলতঃ ধর্মীয় আবরণমুক্ত। ব্যাপারটা প্রশংসনীয়। কিন্তু চন্দ্রমুখীর চরিত্রের নাম “চারুবালা” জাতীয় হিন্দু নাম। কারণ চন্দ্রমুখী একটা বেশ্যার চরিত্র। মুসলমান নারীকে বেশ্যা হিসেবে দেখাতে জাকারিয়া সৌখিনের বড্ড বেশী কষ্ট হয়েছে। নিতে পারেন নি। এখানেই তার মুসলিম মানসিকতাটা ফুটে এসেছে।
৪। স্ট্যাটাসটা কপি পেষ্ট করলাম। হিন্দু গ্রাম ধংসের ছবিটা কপি হয়নি।
“Nripendra N Sarker
July 20 at 12:27 PM ·
ন্যাক্কারজনক নাটক। নামঃ “ঢাকা মেট্রো ভ-১৯৭৯”
আমার এতকালের প্রিয় পরিচালক গোলাম সারওয়ার ফারুকী নিবেদিত।
এদের বুঝা মুশকিল! সত্যই মুশকিল!
মানবিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্ববোধ থেকে দেশের সংখ্যাপ্রভু এবং সরকার দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি মমত্ববোধ থাকার কথা। সেই মমত্ববোধ থেকে সংখ্যালঘুদের দুর্বল দিক বাদ দিয়ে ভালো দিকটা আলোচনায় নিয়ে আসাটাই স্বাভাবিক। সংখ্যালঘুদের প্রতি অন্যায়-অবিচার নিয়ে গনমাধ্যমে নাটক প্রচার হতে পারে। লেখালেখির মাধ্যমে এবং সভা-সমিতিতে আলোচনা হতে পারে। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলামিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
নাটকের পটভূমি এরকমঃ
কোন একটা হিন্দু গ্রাম। অধিকাংশ লোক দরিদ্রসীমার নীচে। গরীবদের মেয়েদের বিয়ের বয়স হলেই এক ধনবান হিন্দু ঢাকা থেকে গাড়িতে আসেন। এবং কিছু টাকা দিয়ে একে একে ঢাকা চলে আসেন। গ্রাম আগের মতই স্বাভাবিক চলতে থাকে। এটুকুই মাত্র গল্প। কেনো এটুকু গল্প নিয়ে নাটকটি বানানো হলো, কী এর মূখ্য উদ্দেশ্য তা একেবারে অনুপস্থিত।
গাড়ি আসে ইট বিছানো ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে। মনে হয় ১৯৭০-৮০ সময়কালের গল্প। কিন্তু ছয়-সাত বছরের ছেলেপিলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমলের হাটু অবধি ধূতি পড়ানো বাংলাদেশে কোথাও আছে এখনও?
আমি গ্রামে বড় হয়েছি। পঞ্চাশের দশকে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। ৩০ মাইল ব্যাপী প্রচুর হিন্দু গ্রাম চিনতাম। কোত্থাও ছোটদের ধূতি পড়তে দেখিনি। ফারুকী এই আজব হিন্দু জীব কোথায় পেলেন? ধনী হিন্দুরা গরীরদেরকে কিছু টাকা দিয়ে মেয়েগুলো একের পর এক ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে। এসব চিত্র কোথাকার? কোথায় সে কল্পজগৎ জনাব ফারুকী? সব কল্পকাহিনী তৈরী করে সংখ্যালঘুদের গালে শেষ চড়টি বসিয়ে দিয়েছেন।
জনাব ফারুকীর জন্য বলছি। নীচের চিত্রটাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বাভাবিক চিত্র। এটা চোখে পড়েনি আপনার?
২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে সময়এখন.কম এ হেডলাইন ছিলোঃ “যুবলীগ নেতা কর্তৃক বড়গুনার ১৪ হিন্দু পরিবার সমূলে উৎখাত!”
লিঙ্কঃ https://somoyekhon.com/news/23424
ফারুকী না হয় এই ঘটনাটা মিস করেছেন। করতেই পারেন। কিন্তু ঘটনা তো একটি-দুটি নয়। হাজারে হাজার। বাংলাদেশে এমন কি কোন হিন্দু গ্রাম আছে যেখানে খুন, ধর্ষন, জমি দখল নিত্যকার ঘটনা নয়?
ফারুকীরা এসব দেখেন না। এরা কল্পকাহিনী বানায়। সংখ্যালঘুদের দূর্দশা নিয়ে মস্করা করে মজা পায়। মনে পড়ে হাই স্কুলে একটা বাংলা প্যাসেজ ইংরেজীতে ট্র্যানস্লেট করতে হতো। গল্পটা এরকমঃ এক পচা ডোবায় অল্প জলে আটকে আছে কিছু ব্যাঙ। একদল ছেলে পাড় থেকে ঢিল ছুড়ে ব্যাঙদের মারছে। এক লোক জিজ্ঞেস করছে – কী করছো তোমরা? ছেলেরা বলছে – ব্যাঙ মারা খেলছি।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জীবন আর পচা ডোবার ব্যাঙদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ফারুকী এবং যুবলীগ নেতাদের জন্য বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা খেলার ভালো উপকরণ। আপনার উপভোগ করুণ। ব্যাঙেদের পালাবার পথ নেই।”
১৯৭৪-১৯৭৫ সালে এই বঙ্গে (বাংলাদেশে) হিন্দুদের অবস্থা কেমন ছিলো জানতে চাই?