প্রথম পর্ব।
একটা হিন্দুর দুই সন্তান। সে ছেলে সন্তানের বেলায় বাবা বা পিতা। কিন্তু মেয়ে সন্তানের বেলায় “কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা”। এটা খাচ্চর হিন্দু সমাজের একটা চিত্র। বাবার মাথায় দুই মন ওজনের একটা পাথরের চেয়েও বেশী ভারী কন্যাটি। ভারমুক্তি ঘটে যেকোন একটা ছেলে বা কোন ঘাটের মরা বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে পারলে।
খাচ্চর হিন্দু সমাজের দ্বিতীয় চিত্রটি শুরু হয় ঐ মেয়েটি যখন বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসে। স্বামী মারা গেলে শ্বশুড়-শাশুড়ী বলবে – তুই ভাতার খাকী ডাইনী। তোর জন্য আমাদের ছেলে মরেছে। তোকে এনে ঠাই দিয়েছিলাম বংশ রক্ষার জন্য। তা যখন হলো না, এখন তোকে রেখে কী করবো? তোর বাপকে খবর দে, এসে নিয়ে যাক। বাপের বাড়ি এসেও মেয়েটির ঠাই নাই। সারাদিন কাজের মেয়ের মত খাটবে। কিন্তু আহার জুটবে উচ্ছিন্ন। হিন্দু সমাজে বিধবাদের মনুষ্য প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার শেষ আঠার-উনিশ বছর বয়সেই। লেখাটি শুরুর আগে একটা কাহিনী বলি সংক্ষেপে।
নরেনের (ছদ্ম নাম) সাথে ছোটবেলায় খেলেছি বটগাছ তলার মাঠে।১৯৬৪ এর দেশব্যাপী দাঙ্গার পরে চলে যায় বহরমপুরের নলখোলায়। ২০০৮ সালে নলখোলা যেয়ে ওকে খুজেছি, পাইনি। দেখা হলো ২০১০ সালে। রিটায়ার করেছে। প্রাইমারি স্কুলে মাষ্টারী করতো আর নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের জন্য পূজা করে দিত। নরেন এখনও এদের স্বর্গে যাওয়ার সার্টিফিকেট দেয় আর এরা চাল-ডাল টাকাকড়ি দেয়। দশ টাকা পেলে বিশ টাকা জমায়। এই করেই নরেন বাড়িতে ইট দিয়ে “দলান” বানিয়েছে।
দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে নরেনের সাথে দেখা হওয়াটা বেশ একটা চমকপ্রদ ঘটনা। ওর বাড়িটা কোথায় তা আমার ভগ্নিপতি পরেশদা জানতেন। হেটে অর্ধেক পথ এসে রাস্তার পাশে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান। পরেশদা বললেন, যাও ডাক্তারবাবু বসে আছেন, জিজ্ঞেস করে এসো। ডাক্তারবাবু যে চেয়ারে বসেছিলেন সেই চেয়ার ঘেসেই নরেন তার চেয়ারটা টেনে আড্ডা মারছিলো। কিন্তু আমি ওকে চিনতে পারিনি। আমি দরজার বাইরে থেকে নরেনবাবুর বাড়িটা কতদুরে জানতে চাইলে ডাক্তারবাবু মজা পেলেন। ভিতরে আসার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করলেন। আমি বিরক্ত হলাম। ডাক্তাববাবু আমার বিরক্তি বুঝতে পারলেন। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আবার বললেন, দেখুন তো এনাকে চিনতে পারেন কিনা। আমি নরেনেরে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম এক মিনিট। ওর মুখায়ববটা স্লো-মোশনে পরিবর্তন হতে থাকলো – ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১০ সাল। মুখ থেকে বেরোলো – নরেন!
নরেন উচ্ছ্বসিত। আমিও। তখন রাত হয়ে গেছে। ফিরবো। কিন্তু নরেন ছাড়লো না। ওর বাড়ি যেতেই হবে। কারণ ওর “দলান” না দেখাতে পারলে শান্তি হবে না। গেলাম। বাড়ির ভেতরে অন্ধকার। গেট খুলতেই মনে হলো একটা সাদা বস্তু অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। একটা কক্ষে ঢুকতেই নরেন হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিলো। ছোটবেলার গল্প শুরু হলো। এক সময় নরেন বললো – বাবা যা করেছিলেন, তার চেয়ে বেশীই করেছি, কী বলিস? আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
আমার টয়লেটে যাওয়ার তাগিদ পেলাম। নরেন একটা গামছা আমার হাতে দিয়ে বললো – কাপড় খুলে গামছাটা পড়ে নে। আর একটা হারিকেন জ্বালিয়ে বললো – এদিকে যা, তারপর ডাইনে চাপা জায়গা দিয়ে একটু যেয়ে বায়ে ঘুরলেই পায়খানাটা পাবি। তার আগে টিউব ওয়েলের কাছে বদনা আছে। ওখান থেকে জল নিয়ে নিবি। হারিকেনটা দেওয়ালে পেরেকের সাথে ঝুলিয়ে নিবি।
আমি চাপা জায়গা দিয়ে যাচ্ছি। হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় একটু দুরে দেখলাম, একটা সাদা বস্তু। সেই সাদা জিনিষটা। দুটো খালি পা দেখা যাচ্ছে হাটুর নীচ থেকে। দেখলাম গ্রীবা পর্যন্ত খোলা হাত পরণের একমাত্র সাদা কাপড়টা দিয়ে ঢেকে নিলো। বুঝলাম এটি একটি মনুষ্য জীব। কিন্তু ঘটনা চক্রে এখন এই বাড়ির একজন পেত্নী। অন্ধকারেই এর বাস। আমি এবাড়িতে ঢোকার পর থেকেই এই জায়গাটায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেট খুলতেই এই পেত্নীটিি দৌড়ে পালিয়েছিলো। এবং অন্ধকার জায়গায় লুকিয়েছে। অন্ধকারই ভুত-পেত্নীদের জায়গা।
নরেনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে পরেদা বললেন, সাদা বস্তুটি নরেনেরই মেয়ে। বিয়ে দিয়ে “কন্যাদায়মুক্ত” হয়েছিলো। বছর না পেরোতেই ওর স্বামী মরেছে। শ্বশুর বাড়ি ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বাপের বাড়ির সমস্ত কাজ এক হাতে করে। বাড়িতে একটা ঘর ভর্তি ঠাকুর আছে। সকালে ঠাকুরদেরকে ঘুম থেকে জাগান দেয়, ব্রেকফাস্ট খাওয়ায়। এগারটার দিকে জল ছিটিয়ে স্নান করায়। তারপর ঘন্টা বাজায়। তখন ঠাকুরদের লাঞ্চ খাওয়ার সময়। লাঞ্চ শেষে ঠাকুরদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়। বাবা খায় এবং নিজে কিছু মুখে দিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরদের আবার ডেকে উঠাতে হয়। ধুপ-ধূনা দেয়। ডিনার হয়। গান গেয়ে ঠাকুরদের ঘুমিয়ে দেয়। নিজের বাপ ডিনার করে। যা থাকে তাই নিজে খায়। এসব প্রাত্যহিক কাজ। এর ফাকে যে সময়টা পায় তখন সারাদিন গীতা -ভাগবত পাঠ করে। এটাই নরেনের মেয়ের পৃথিবী। এটাই হিন্দু গৃহে বিধবাদের চিরায়ত পৃথিবীর নমূনা। পৃথিবী পাল্টেছে। কিন্তু নরেনের গৃহে বিদ্যাসাগর এবং শরৎ চন্দ্রের দিনকাল টিকে আছে। নরেন জানে তার মেয়ে খেয়ে-পড়ে দারূণ শান্তিতে আছে। কিন্তু জানেনা ২২/২৩ বছরের মেয়েটির সারাটি জীবন সামনে পড়ে আছে। জানেনা নরেন বাড়িতে না থাকলে মেয়েটি জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে মানুষ দেখে। দেখে মানুষেরা হাটাহাটি করে। হেটে এদিক-সেদিক যেদিকে মন চায় চলে যায়। দেখে মন চঞ্চল হয়। কিন্তু দরজা খোলার অধিকার তার নেই।
লেখাটির সময় সম্বন্ধ উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। যখন লেখা হয়েছে,তখন হিন্দু সমাজ অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তবে ত্রিশ,চল্লিশ শ্তকে এইরূপ ঘটনা বর্তমান ছিল। তবে সেটা বিশেষঃত হিন্দু সমাজের উচ্চ বর্ণের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
হাঁ, সত্যি ভালো লেগেছে তবেঁ অন্তরে ক্ষরণ ঘটেছে।
নরেনের সাথে দেখা না হলেই বুঝি ভাল হতো। দীর্ঘশ্বাস! 🤐
১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়ানো আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। “দাঙ্গা” বা “রায়ট” বলতে যা বুঝায় তা হলো দুইপক্ষের মধ্যে মারামারি, খুনাখুনি। যখন দুর্বল গোষ্টি নীরবে মার খাওয়া হজম করে তাকে দাঙ্গা বা রায়ট বলে না।
১৯৬৩ র শেষ ভাগে ও ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে হিন্দুদের উপর যে রকম অত্যাচার ও জুলুম হয়েছিল, যারা স্বচক্ষে দেখেছে তারা বুঝেছে যে, মুসলমানদের একাংশ কতখানি নির্মম ও অত্যাচারী ছিল। আমি তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি, কয়েকদিন ক্লাস করেছি, কিন্তু চারদিকে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের খবরের জন্য ইস্কুলের ছাত্রদের উপর ও সেই প্রভাব পড়ে। মুসলমান ছাত্ররা নানান রকমের মন্তব্য করত কখনো কখনো শারীরিক ভাবে লাঞ্ছনা ও করতে চেষ্টা করতো। হিন্দু মেয়েদের উপর অনেক অত্যাচার করেছে, ধর্মীয় ব্যপারে ও অত্যাচার করেছে ও এখনো করছে, জোর পূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেছে, এমত অবস্তায় অভিবাবক রা আমাকে দেশে না রেখে কলকাতায় কাকদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু মন সব সময় জন্ম ভূমির আনাচে-কানাচে ঘুরত, যা এখনো করে। এখনো মাতৃভূমির কথা ভুলতে পারি না। কিন্তু সেই সময়ের কথা মনে পড়লে আর যেতে ইচ্ছে করে না। আমি সব মুস্লমাদের কথা বলছি না। একটা অংশ এইসব করেছে, এরা যে সংখ্যায় খূ বেশী ছিল তা নয়, কিন্তু ভালো ও সেকুলার মুসলমানেরা তাদের কে কিছু বলার সাহস পেত না, কিছু টা ভয় করে চলতো। সেইজন্য হিন্দুদের এই রকম দুর্গতি হয়ে ছিল। এখনো প্রায় সেই রকম হচ্ছে। তবে হিন্দুদের ও তখন দোষ ছিল। তারা ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। বর্তমানে হিন্দুরা কিছুটা রুখে দাঁড়িয়েছে। তখন যদি তারা প্রতিবাদ ও রুখে দাঁড়াতো তবে মুসলমানেরা কিছুটা ভয় পেত। আর একটা কথা হল হিন্দুরা দেশ ভাগের পর থেকে দলে দলে ভারতে চলে আসা। হিন্দুরা ভারতে না আসলে আজ তারা রাজনৈতিক ভাবে অনেক ভালো স্থানে থাকতো। তারজন্য এখন নিজেকে খুব খারপ লাগে। ছোট ছিলাম বলে নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল না। তবে যারা এখনো আছে তাদের ধন্যবাদ দেই, কেন না তারা প্রতিকূলে লড়ে টিকে আছে।
ভাল লেগেছে
১৯৬৪ এর দেশব্যাপী দাঙ্গার পরে চলে যায় বহরমপুরের নলখোলায়।
এ ব্যাপারে কি বোঝানো হলো? ১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা না? যেটার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বহু হিন্দু ভারতে গিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলো। https://en.wikipedia.org/wiki/1950_East_Pakistan_riots এটা কোন ঘটনা তাহলে? ইস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মটাই ছিলো একটা বেয়াদব উদ্দেশ্যে।