আইএস সৃষ্টির শুরু থেকেই আমরা শুধু শত্রুর মুখ থেকেই আইএস সম্পর্কে শুনে এসেছি। আইএস’র নৃশংসতার কথা বলেছে তারাই যারা ইরাক এবং সিরিয়াতে নিজেরা সরাসরি যুদ্ধ করেছে, আইএস এর বর্বরতায় যাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে, যারা আইএস এর হিংস্রতা থেকে মুক্তি পেতে চায় এবং যারা আইএস’র মৌসুমি যোদ্ধা। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরতে শুরু করেছে। নিচের এই লেখাটি আইএস এর যোদ্ধা ‘আবু আহমেদ’ নামের এক সিরিয় যুবকের জবানবন্দী, যিনি আইএস’র বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি মাসের পর মাস আইএস’র স্বদেশী, বিদেশী ভয়ংকর যোদ্ধাদের সাথে একসাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কয়েকটি পর্বে বিভক্ত অনন্য এই লেখাটিতে আবু আহমেদ নিখুঁতভাবে এবং আন্তরিক দৃষ্টি দিয়ে বর্ণনা করেছেন, আল-কায়েদার ভিত্তি ব্যবহার করে কিভাবে আবু বকর আল-বাগদাদি সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের বিস্তার ঘটালেন, এবং কিভাবে খেলাফতকে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন। আবু আহমেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কিছু নাম এবং তাদের বিবরণ ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের লিংক-যেভাবে আইএস অস্ত্রভাণ্ডার দখলে নেয়, তৃতীয় পর্বের লিংক:আইসিস ও আল-কায়েদা জোটে ভাঙন ও সংঘর্ষ

সিরিয়াতে চলমান গৃহযুদ্ধের মত বিশৃঙ্খলায় অংশগ্রহণ করা নিয়ে আবু আহমেদকে কখনো বিচলিত মনে হয়নি। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের এক মফস্বল শহরের রক্ষণশীল এবং ধার্মিক আরবিয় সুন্নি মুসলিম পরিবারে আবু আহমেদের জন্ম। ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়াতে যখন প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় আবু আহমেদ তখন ছাত্র। সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই সে বিদ্রোহী গ্রুপে যোগ দেয়। আবু আহমেদ বলতে লাগল, “মিশরের আরব বসন্তের পরে লিবিয়াতে কি ঘটে দেখার জন্য আমাদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা এবং উৎকণ্ঠা ছিল। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের দেশে কোনদিন বইবে না পরিবর্তনের হাওয়া”।

২০১২ সালের মাঝামাঝি যখন জন-জোয়ার জনযুদ্ধে রূপ নিলো ততক্ষণে আবু আহমেদের হাতে উঠে এসেছে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। আবু আহমেদ নিজের অজান্তেই যুদ্ধে জড়িয়ে গেল, সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে দেখতে পেল যুদ্ধের ময়দানে মিশে গেছে জিহাদি মতাদর্শের একটি বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে। যোদ্ধাদের বেশিরভাগই সিরিয়ার নাগরিক, তবে পবিত্র জিহাদে অংশ নিতে ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়া থেকেও এসেছে কিছু যুবক। যোদ্ধাদের নিয়মিত এক যুদ্ধের ময়দান থেকে আরেক যুদ্ধের ময়দানে ঘুরে বেড়াতে হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই আবু আহমেদের যোদ্ধাদলকে নাম পরিবর্তন করতে হয় অথবা মিশে যেতে হয় অন্যকোন জিহাদি দলে। এভাবেই তারা ছড়িয়ে যেতে থাকে। ২০১৩ সালের বসন্ত জাগরণে আইসিল (ISIL- Islamic State of Iraq and Levant) আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিলে জিহাদি গ্রুপ এবং নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধাদের মাঝে উত্তেজনা শুরু হয়। ২০১৪ সালে ISIL গ্রুপ নিজেদের নাম IS-Islamic State পরিবর্তন করে বিশ্বে ইসলাম কায়েমের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী নিজেদেরকে খেলাফতের দাবিদার ঘোষণা করে। তখন থেকে আবু আহমেদ আই.এস. এর একজন যোদ্ধা হিসেবে কর্মরত আছে এবং সে এই জিহাদি গ্রুপের অভ্যন্তরীণ আদ্যোপান্ত ইতিহাস এবং যোদ্ধাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত।

আবু আহমেদের সাথে ১৫ মিনিট সময় কাটানোর পর খেলাফতের একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে আমরা তাকে জিহাদি গ্রুপ নিয়ে গভীরভাবে প্রশ্ন করেছিলাম। প্রায় দশমাস সময়ে আমরা প্রায় ১০০ ঘণ্টা আবু আহমেদের সাথে ছিলাম। সে অত্যন্ত ধৈর্য-সহকারে আমাদের প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল, কিভাবে সে আইএসের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ল, কিভাবে এই জিহাদি সংগঠনটি সুসংগঠিত হল এবং আইএস’র অভ্যন্তরে ইউরোপ থেকে আগত বিদেশি যোদ্ধাদের ভূমিকা কেমন ইত্যাদি। আবু আহমেদের সাথে আমাদের মাঝে মাঝে সপ্তাহব্যাপী একটানা ছয় ঘণ্টার মত সাক্ষাৎকার হয়েছে। আবু আহমেদ আমাদের সাথে কথা বলার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকির মুখে ছিল। সে এখনো আইএস’র যোদ্ধা, সেই কারণে আমাদেরকে আবু আহমেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য ঢালাওভাবে অনেক তথ্য গোপন করতে হয়েছে। আবু আহমেদ আমাদের সাথে কেন কথা বলেছিল তার উপযুক্ত কারণ সে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছিল। তার কারণ, আইএস’র সাথে থাকার পরেও সে এই জিহাদি সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রমের সাথে একাত্ম হতে পারেনি। সে আইএস’র সাথে মিলিত হয়েছিল কারণ তার কাছে মনে হয়েছিল এই অঞ্চলের মধ্যে আইএস সবথেকে শক্তিশালী সুন্নি গ্রুপ। যাইহোক, এই জিহাদি সংগঠনের অতিরিক্ত উগ্রতা এবং হিংস্রতার জন্য তার কিছুটা মোহভঙ্গ হয়েছে। প্রতিপক্ষকে জবাই করে, পুড়িয়ে, পানিতে ডুবিয়ে, শ্বাসরোধ করে হত্যার জন্য আবু আহমেদ আইএস কে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে আবু আহমেদ বলেন, সিরিয়ার আল-বাব শহরের কেন্দ্রে “ফ্রিডম স্কয়ার” বলে একটা জায়গা আছে, আইএস সেখানে একটা খাঁচা স্থাপন করেছে সিরিয়ার জনসাধারণকে সাজা দেয়ার উদ্দেশ্যে। সাধারণত ছোটখাটো অপরাধের সাজা দেয়ার জন্য এই খাঁচার আয়োজন। যেমন, সিগারেট বিক্রি করাও আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোন অপরাধী কী অপরাধ করেছে তার বিবরণ কাগজে লিখে সেটা তাদের গলায় ঝুলিয়ে একনাগাড়ে তিনদিন খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়। ফ্রিডম স্কয়ারের নাম এখন “পানিশমেন্ট স্কয়ার” হয়ে গেছে। আবু আহমেদ বলতে লাগলেন, “এই ধরণের জঘন্য শাস্তি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না, আইএস কে মানুষ এখন ঘৃণা করে। আমরা মনে করেছিলাম আইএস সব জিহাদি গ্রুপকে একটা কালো পতাকার তলে সমবেত করতে সক্ষম হবে, কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়নি। গ্রুপগুলোর মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বিবাদ লেগেই আছে।

আবু আহমেদ ইউরোপের বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস থেকে আসা বিদেশি যোদ্ধাদের খুব পছন্দ করেন। তারা সবাই ইউরোপের উন্নত দেশে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করত। তাদের সামাজিক নিরাপত্তার কোন অভাব নেই, কিন্তু তারা জিহাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জীবন নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে এসেছে। এই জিহাদিরা যখন স্বেচ্ছায় স্রোতের বিপরীতে চলে এসেছে, তখন সিরিয়ার লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে বিশাল অংকের টাকা ব্যয় করে চোরাপথে ইউরোপের শরণার্থী শিবিরে একটু ঠাই পাওয়ার জন্য লাইন দিচ্ছে। অথচ, এই বিদেশী যোদ্ধারা ইসলামের জন্য জিহাদ করতে তাদের পরিবার, বাড়িঘর, যথাসর্বস্ব জায়গাজমি, নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ সুখের জীবন ছেড়ে সিরিয়ার মানব সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্যোগে চলে এসেছেন। আমাদেরকে সাহায্য করতে এসেছেন। আমাদেরকে সাহায্য করতে গিয়ে এই মানুষগুলো সত্যি সত্যিই তাদের সর্বস্ব কোরবান করে দিয়েছেন।

কিন্তু জিহাদি গ্রুপের বিভক্তি দেখে আবু আহমেদের খুব দ্রুত মোহভঙ্গ হয়। তার প্রথম কারণ, আইএস সব জিহাদি গ্রুপগুলোকে একত্রিত করতে পারে নি বরং গ্রুপগুলোর মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব তালগোল পাকানো বিশৃঙ্খলা বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে আশংকা। আবু আহমেদের কাছে মনে হয়, আইসিস শক্তিশালী নুসরা ফ্রন্টকে ভেঙে দিয়েছে আর সিরিয়ার জিহাদি গ্রুপগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আবু আহমেদ দেখতে পেলেন কিছু বিদেশী যোদ্ধা আসলে ধর্মোন্মাদ। বেশিরভাগই মরক্কো বংশোদ্ভূত বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডের উশৃঙ্খল যুবক। ইসলাম সম্পর্কে তাদের কাছে কোন ধারনাই নাই। না পারে ঠিকমত পড়তে কোরআন, না পারে নামাজ। এরা ইউরোপে বেশিরভাগই ছিল কর্মহীন, পারিবারিক বন্ধনহীন। ইউরোপের মূলধারার শিক্ষা এদের মাঝে নেই। বাস করত শহরের অনুন্নত বস্তি এলাকায়, হয়ত বেঁচে ছিল কোনক্রমে সোশ্যাল বেনিফিটের টাকায় আর এদের প্রায় সবাই ছোটখাটো ক্রাইমে আগে থেকেই যুক্ত ছিল। এইসব ধর্মোন্মাদদের মধ্যে কোন ধর্মেরই জ্ঞান নেই। জীবনে কোরআনের একটা আয়াত পড়েছে কিনা সন্দেহ। ইউরোপের সালাফি মসজিদে ওয়াহাবি ইমামের বয়ান শুনে হঠাৎ করে তাদের মনে জ্বলে উঠেছে দোজখের আগুন। ইউরোপের শুঁড়িখানায় আর ডিসকোতে কাটানো উচ্ছন্নে যাওয়া এইসব যুবকদের জন্য সিরিয়ার যুদ্ধ হল রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনী অথবা পাপে ডুবে যাওয়া জীবনে অনুশোচনা করার সহজ মাধ্যম। কিন্তু কিছু কিছু বিদেশী যোদ্ধা আছে যারা ইউরোপে প্রকৃত অর্থেই ধর্মীয় আদর্শে জীবনযাপন করত এবং তারা সত্যিকার জিহাদের ডাকে সাড়া দিতেই সিরিয়াতে পাড়ি জমিয়েছে।

বেলজিয়াম থেকে আগত জিহাদি আবু সায়াফ প্রায়ই জবাই করার কথা বলত। সে একদিন তার দলনেতা আবু আল-আথির আল আবসিকে জিজ্ঞেস করল, “সে কী কখনো একজনকে শিরশ্ছেদ করতে পারবে? তার বহু দিনের ইচ্ছা সে মানুষের মাথা হাতে করে নিয়ে আসবে”। বর্তমানে সিরিয়ার মানুষ তাকে ‘আল-থাবা’ বা জবাইকারী হিসেবে চেনে। যে কোন যুদ্ধে ‘সত্য’ প্রথম আক্রান্ত হয়। আবু আহমেদ আইএস সম্পর্কে আমাদেরকে যা কিছু বলেছে তা এত বেশি অবিশ্বাস্য যে আমাদেরকে তার কথার সত্যতা যাচাই করতে হয়েছে। সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে আমরা আবু আহমেদকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। ইউরোপ থেকে আগত অনেক আইএস জিহাদিকে আবু আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে চেনে। সিরিয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপ ছেড়ে যাওয়া মোটামুটি ৫০ জনের তালিকা এবং তাদের ছবি আবু আহমেদকে দিয়ে বললাম, দেখুন তো এই ছবির মানুষদেরকে চিনতে পারেন কিনা?

ইউরোপ থেকে আগত জিহাদি যোদ্ধাদের সব খুঁটিনাটি তথ্য আবু আহমেদের নখ দর্পণে। শুধু ছবি দেখে আমাদের সামনেই ইন্টারনেট বা পারিপার্শ্বিক কোন সাহায্য ছাড়াই আবু আহমেদ প্রায় ৩০ জন জিহাদির আদ্যোপান্ত বলে দিলো। সাথে সাথে সে জিহাদিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে যাচ্ছিল। অন্য ছবিগুলো সম্পর্কে আবু আহমেদ কিছুই জানে না বলে জানিয়েছিল। আবু আহমেদ তার ল্যাপটপ থেকে ডাচ, বেলজিয়াম এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে সিরিয়াতে আগত জিহাদিদের কিছু গোপন ছবি এবং ভিডিও আমাদেরকে দেখিয়েছিলেন যেগুলো অনলাইনে পোস্ট করা হয়নি। জিহাদি গ্রুপের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণেই এমন ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। আইএস’র চরম লোমহর্ষক, বীভৎস, হিংস্র কর্মকাণ্ডের ছবির অন্তরালে কাজ করার প্রমাণও আবু আহমেদের কাছে আছে। ২০১৫ সালে সিরিয়ার প্রাচীন নগরী পালমিরা দখল নেয়ার পর আবু আহমেদ মরুভূমির এই শহরে কিভাবে বিরোধী পক্ষকে জবাই করা হয় সেটা দেখতে বেরিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসের এক সুন্দর সকালে অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি থেকে আগত আইএস জিহাদি প্রাচীন পালমিরা শহরের এক ঐতিহ্যবাহী ভবনের সামনে দুইজন সিরিয়ান সৈন্যকে জবাই করে। পালমিরাতে এমন অনেক প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আইএস ৪ঠা জুলাই একটা ভিডিও প্রকাশ করে যেখানে দেখা যাচ্ছে পালমিরা নগরীর বিশাল এক মঞ্চে একজন কিশোর জিহাদি ২৫জন সিরিয়ান সৈন্যের গলা কাটছে।

এক সপ্তাহ আগে অনলাইনে প্রকাশিত জার্মান এবং অস্ট্রিয়ান জিহাদিরা যেসব বীভৎস হত্যাযজ্ঞ করেছে আমরা তার কিছু ছবি দেখলাম আবু আহমেদের কাছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে হত্যার কিছু পূর্বে পিছনে হাতবাঁধা দুই বন্দী, তাদের চোখে কাপড় বাঁধা। আর একটা ছবিতে দেখলাম আইএস’র মিডিয়া উইং জবাই দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করছে। আইএস হত্যাযজ্ঞের ছবির অন্তরালের এই ছবি অনলাইনে প্রকাশ করেনি। আবু আহমেদের কাছে আমরা যেসব ছবি দেখেছি তা আর কারো কাছে নেই।

ছবিতে যে দুজন ক্যামেরাম্যান দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যে একজন জার্মান নাগরিক হ্যারি সাফ্রো যে সিরিয়াতে পালিয়ে এসেছে আইএস’র সাথে যোগ দিয়ে জিহাদে অংশ নিতে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার মোহভঙ্গ হয় এবং পালিয়ে আবার জার্মানি ফিরে যায়। জার্মানি পৌঁছালে পুলিশ তাকে জঙ্গিবাদের অভিযোগে আটক করে। বর্তমানে হ্যারি সাফ্রো জেলে আছে। একবার আইএস’র প্রোপাগান্ডা ভিডিওর জন্য কালো পতাকা উড়িয়ে ক্যামেরার সামনে দিয়ে বার বার হেঁটে যাওয়া হ্যারি সাফ্রোর ছবিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের কভার ফটো করেছিল। আবু আহমেদ যে ছবি দেখিয়েছিল আর নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রচ্ছদের মধ্যে পার্থক্য আছে, মতভেদ আছে। কিন্তু সাফ্রো জার্মান পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে বলেন, আইএস’র প্রোপাগান্ডা ভিডিও তৈরিতে তার ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ। যদিও আইএস’র প্রোপাগান্ডা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সে কালো পতাকা বহন করছে, আর ছবিতে দেখা যাচ্ছে সে দুজন সিরিয় নাগরিকের হত্যাকারীর ভিডিও করতে ব্যস্ত। আবু আহমেদ শুধু সিরিয় জিহাদিদের ক্রমশ যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া দেখেন নি, আরও দেখেছেন আইএস’র উত্থান। নুসরা ফ্রন্ট এবং আইএস’র মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়া সিরিয় যুদ্ধের অন্যতম দিক। এর ফলে আসাদ বিরোধীদের মাঝে প্রবল বিরোধের ফাটল দেখা দেয় এবং তৃতীয় জিহাদি গ্রুপের উত্থানের সবুজ সংকেত দিয়ে যায়। সেই সাথে আল কায়েদাকে ছাপিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে আবু বকর আল বাগদাদি। আবু আহমদের চোখের সামনে ঘটে যায়, কিভাবে পৃথিবীর দুটি বৃহৎ জিহাদি গ্রুপের মাঝে বিচ্ছেদ তৈরি হয়।

খেলাফতের কাফেলা:

২০১৩ সালের মাঝামাঝি আবু আহমেদ একদিন দেখতে পেলেন মজলিশ সুরা আল-মুজাহিদিনের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়াল এক গাঢ় লাল-বাদামি রঙের গাড়ি। গাড়ি থেকে নামলেন উত্তর সিরিয়া অঞ্চলের কাফর শহরের জিহাদি গ্রুপের নেতা আবু আল-আথির। আবু আহমেদের এক জিহাদি কমান্ডার বন্ধু তার কাছে এগিয়ে এসে কানে কানে বলল, “ভালোভাবে গাড়িটি সার্চ করে দেখো”। গাড়িটির বিশেষত্ব বলে কিছুই নেই। মনোযোগ আকর্ষণ করার মত একেবারে ঝকঝকে নতুনও নয়, আবার লক্ষড়ঝক্কড় মুড়ির টিনও নয়। গাড়িটি অস্ত্র সজ্জিত নয় এমনকি গাড়ির লাইসেন্সের কোন নাম্বার প্লেটও নাই।

গাড়ির ভিতর চারজন মানুষ বসে আছে, আবু আহমেদ কেউকে চিনতে পারলেন না। ড্রাইভারের পিছনে বসে আছে পুরো মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা একজন ব্যক্তি। তার কাঁধে কাল রঙের শাল বুকের উপর ঝুলে আছে। তার বড় দাঁড়িতে তাকে ব্যক্তিত্ববান পুরুষ মনে হচ্ছে। ড্রাইভার ছাড়া সবার কোলের উপরেই স্বয়ংক্রিয় ছোট মেশিনগান। আবু আহমেদ দেখতে পেলেন সদর দপ্তরের সামনে কোন অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই। বরাবরের মতই শুধু দুজন অস্ত্রধারী সদর দপ্তরের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে গেল নিরাপত্তা দিতে। সদর দপ্তরের ইন্টারনেট কানেকশন ঠিকঠাক চলছে, আবু আহমেদের কাছে অন্য দিনের থেকে আজকে ভিন্ন কোন দিন মনে হল না। চারজন মানুষ গাড়ি থেকে নেমে সদর দপ্তরের মধ্যে গায়েব হয়ে গেলেন। সেই জিহাদি কমান্ডার আবার এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, একটু আগে কাকে দেখলে জানো? তিনিই আবু বকর আল-বাগদাদি।

২০১০ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাকে আল-কায়েদাকে সাথে নিয়ে আবু বকর আল-বাগদাদি ইসলামিক স্টেট অভ ইরাক (আইএসআই) গঠন করেন। বাগদাদির নিজের স্বীকারোক্তিতেই জানা যায় বাগদাদি, আবু মুহাম্মদ আল-জোলানিকে ২০১১ সালে জিহাদি তৎপরতা সংগঠিত করতে নুসরা ফ্রন্টে পাঠান। ২০১১ সালের শুরুতে আইএসআই এবং নুসরা ফ্রন্ট একসাথে জিহাদ করেছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বাগদাদি আর সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। তিনি ইরাক এবং সিরিয়ার আল-কায়েদার সব জঙ্গিকে একত্র করে দুইটা দেশ দখল করে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন এবং অবশ্যই তিনি হবেন নতুন খেলাফতের খলিফা।

তারপরের পাঁচদিন প্রতি সকালে একনাগাড়ে লালচে বাদামি রঙের গাড়ি বাগদাদি এবং তার ডেপুটি হাজি বকরকে আইএস’র কাফর হামরার সদরদপ্তরে নামিয়ে দিয়ে যেতে লাগল। সূর্যাস্তের আগে আগে ঠিক একই গাড়িতে একই ড্রাইভার বাগদাদিকে সদরদপ্তর থেকে অজানা কোন গোপন আস্তানায় নিয়ে যেত। পরেরদিন সকালে আবার সেই একই গাড়িতে বাগদাদি এবং সঙ্গীকে পৌঁছে দিয়ে যেত।

এই পাঁচদিনে আইএস’র সদরদপ্তরে সিরিয়ার সব জিহাদি গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাথে বাগদাদি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত ফেরারি আসামী, তারা সবাই মিলিত হয়েছে এক ছাদের নিচে। মেঝেতে ম্যাট্রেস এবং ছোট ছোট কুশন দিয়ে তাদের জন্য আসন পাতা। এখানে তারা বিলাসে ভুনা মাংস, গ্রিল মুরগী, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চা, কোমল পানীয় দিয়ে সকালের নাস্তা আর দুপুরের লাঞ্চ করতো। পৃথিবীর সব থেকে দুর্ধর্ষ ফেরারি আসামি বাগদাদি পেপসি, মিরিন্ডা অথবা অরেঞ্জ ফ্লেভারের সোডা পান করতেন। খেলাফত প্রতিষ্ঠার এই গোপন মিটিংয়ে উপস্থিত হয়েছেন মজলিশ সুরা আল-মুজাহিদিন গ্রুপের আমীর আবু আল-আথীর, মিশরের জিহাদি কমান্ডার মেশাব আল মাসরি, জর্জিয়া থেকে আগত শীর্ষস্থানীয় চেচেন জিহাদি ওমর আল-শিশানি, লিবিয়ার জিহাদি কমান্ডার ওয়ালীদ আল-লিবি, লিবিয়ার কাতিবাত আল-বাত্তার জিহাদি গ্রুপের আমীর আবেদ আল-লিবি, নুসরা ফ্রন্টের গোয়েন্দা সংস্থার দুজন শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তি এবং বাগদাদির ডানহাত হাজি বকর। আবু আহমেদ এত এত বিগশট জিহাদি কমান্ডার, আমীর, গোয়েন্দা প্রধান দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। মিটিংয়ের বিরতি হলে সে সদর দপ্তরেরকে পায়চারী করে বেড়ায় আর সহযোদ্ধাদের কাছে জানতে চায় মিটিংয়ে কারা এসেছে। আবু আহমেদের প্রশ্নই শেষ হয় না। বাগদাদি কেন ইরাক থেকে সিরিয়া এসেছে? কেন কমান্ডার, আমীর বাগদাদির সাথে বৈঠক করছে? কী এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার জন্য স্বয়ং বাগদাদিকেই উদয়াস্ত মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে?

কাফর হামরার মিটিং শুরুর আগে বাগদাদির দেয়া ছোট্ট বক্তৃতায় হয়ত আবু আহমেদের সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল বাগদাদি ঘোষণা দেন, আইসিস সিরিয়াতে বিস্তার লাভ করেছে। নুসরা ফ্রন্টসহ এই অঞ্চলের সব জিহাদি গ্রুপকে আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদের কর্তৃত্ব বাগদাদির হাতে অর্পণ করতে হবে। সব জিহাদি গ্রুপকে তাদের পূর্বের নাম পরিবর্তন করে আইসিস নামে পরিচিত হতে হবে। এখানে উপস্থিত শেখ, আমীরদেরকে বলেন জাবাত আল নুসরা এবং জোলানি এসব নাম পরিহার করে সবাই আমার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করুন। আইসিস’র ছায়াতলে মিলিত হোন এবং আপনারা জানেন, খুব শীঘ্র আমরা একটা রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছি।

আল কায়েদার সাথে বানোয়াট জোট:

বাগদাদির পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য ইরাক এবং সিরিয়ার বিশাল অঞ্চলের সব জিহাদি গ্রুপের মাঝে সমন্বয় দরকার আর বাগদাদির জন্য এটাই সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। উপস্থিত সব আমির, জিহাদি গ্রুপের নেতা আইএস’র নেতা বাগদাদি বোঝালেন তারা ইতিমধ্যেই ওসামা বিন লাদেনের উত্তরসূরি আল কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। হঠাৎ করেই তারা কিভাবে জাওয়াহিরি এবং আল-কায়েদা ছেড়ে বাগদাদির আইএস এ যোগ দিবে?

আবু আহমেদ আমাদের কাছে বলেছেন, “মিটিংয়ে জিহাদি গ্রুপের আমীর ও শেখরা বাগদাদির কাছে জানতে চেয়েছিল, আপনি কি জাওয়াহিরির সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করছেন?” বাগদাদি তাদের বলেছিলেন, “অবশ্যই আমি জাওয়াহিরির সাথে একাত্ম হয়ে জিহাদ করছি, খেলাফতের আন্দোলনে আল্লাহর পথে নেমেছি। কিন্তু জাওয়াহিরির অনুরোধেই এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া যাবে না। বাগদাদি তাদেরকে নিশ্চিত করেন, তিনি আসলে আল-কায়েদা কমান্ডারের নির্দেশেই কাজ করছেন”।

অন্যদিকে এইসব জিহাদি নেতাদের পক্ষে বাগদাদির কথার সত্যতা যাচাই করার কোন সুযোগ ছিল না। কারণ জাওয়াহিরির সাথে যোগাযোগ করা তাদের জন্য অসম্ভব কাজ। জাওয়াহিরি একজন ফেরারি সন্ত্রাসী। জনসম্মুখে তাকে বিগত কয়েক বছরে দেখা যায় নি। সে হয়ত লুকিয়ে আছে আফগানিস্তানের কোন দুর্গম পাহাড়ের নির্জন গুহায়। হয়ত সে আত্মগোপন করে আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোন নিরাপদ আশ্রয়ে। যেহেতু জাওয়াহিরির সাথে বাগদাদির কথার সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, সেহেতু জিহাদি গ্রুপের নেতারা কিছুটা দ্বিধা সত্ত্বেও বাগদাদির সাথে কাজ করতে রাজি হয়ে গেলেন। যদি বাগদাদি জাওয়াহিরির নির্দেশ মেনেই কাজ করে তাহলে জিহাদি গ্রুপের নেতাদের আইসিসে যোগ দিতে কোন বাধা নেই। জিহাদি নেতারা তাই বাগদাদিকে বললেন, “যদি বাগদাদি নিজেই আইএস গঠন করে তাদেরকে তার দলে ভিড়িয়ে নুসরা ফ্রন্ট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, তাহলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হবে। আল-কায়েদার মাঝে বিভেদ দেখা দেবে এবং সব জিহাদি গ্রুপের যোদ্ধাদের মাঝে ফিতনা ফ্যাসাদ দেখা দেবে।” তাই সবদিক বিবেচনা করে জিহাদি নেতারা বাগদাদিকে শর্তসাপেক্ষে সমর্থন দিলেন। আবু আহমেদের বরাত দিয়ে আমরা জানতে পারি, জিহাদি নেতারা বাগদাদিকে বলছেন, “তোমার দাবি সত্যি হয় তাহলে আমরা তোমার সাথে আছি”।

তখন বাগদাদি প্রকাশ করলেন তার নীল নকশা। তিনি সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেট করার পরিকল্পনা ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, “মুসলিমদের জন্য আলাদা একটা রাষ্ট্র দরকার। শুধু মুসলিমদের জন্য একখণ্ড অখণ্ড ভূখণ্ড দরকার যেখান থেকে মুসলিমরা তাদের জিহাদ পরিচালনা করতে পারবে এবং একপর্যায়ে সারা বিশ্বে ইসলাম কায়েম করবে, প্রতিষ্ঠিত হবে শরিয়া আইন ও মুসলিম শাসন”। উপস্থিত সবাই বাগদাদির প্রস্তাবনার বিরোধিতা করলেন। আল-কায়েদা শুরু থেকেই রাষ্ট্র চিন্তা না করেই জিহাদ করে আসছে। আল-কায়েদা প্রকাশ্যে কোন ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে না। কোন অজানা জায়গায় লুকিয়ে থেকে হঠাৎ জনাকীর্ণ স্থানে হামলা করে আবার আত্মগোপনের শীত নিদ্রায় চলে যায়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের অনেক সুবিধা আছে। কোন দেশে সন্ত্রাসী হামলা করে লুকিয়ে থাকা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের টিকিটির দেখাও পায় না, তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে না, ফলে তাদেরকে নির্মূল করাও সম্ভব হয় না। মিটিংয়ে জিহাদি গ্রুপের নেতারা বললেন, রাষ্ট্র গঠন করা তো আত্মহত্যার সামিল। শত্রুরা আমাদেরকে সহজেই ধরে ফেলবে, আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবো। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হবে আমাদের মরণফাঁদ। মজলিস সুরা আল-মুহাহিদিনের আমীর আবু আল আথীর বাগদাদি আসার আগের তার জিহাদি যোদ্ধাদের বলে দিলেন, আমরা কোন ভূখণ্ড ভিত্তিক রাষ্ট্রের ঘোষণা দিতে চাই না। আমরা এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছি। কেউ কেউ বলতে লাগলেন, রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হবে খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। আথীর তার দলের লোকদের বললেন, “ মানুষ কেমন পাগল হলে এই যুদ্ধাবস্থায় রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দিতে পারে!” আবু আহমেদ নিশ্চিত করেন, চেচেন জিহাদি নেতা ওমর আল শিশানিও রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে একই রকম দ্বিধান্বিত ছিলেন। ওসামা বিন লাদেন ঠিক যে কারণে আমেরিকানদের হাত থেকে বাঁচতে বছরের পর বছর লুকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে একটা রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া মানে হল খুন হয়ে যাওয়ার জন্য শত্রুদেরকে আহ্বান করা।

অনেকে দ্বিধা, বিরোধিতা সত্ত্বেও বাগদাদি তাদেরকে চাপ দিতে লাগলেন। মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনই বাগদাদির একমাত্র লক্ষ্য। বিতর্কের এক পর্যায়ে বাগদাদি বললেন, এখন পর্যন্ত জিহাদিরা কোন নিজস্ব ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে না। আমাদের দরকার নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখার একটি দেশ, দেশের নাগরিক, সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী সম্পাদন করার জন্য আমলাতান্ত্রিক অবকাঠামো। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে প্রাথমিক ঝড়ের আঘাত সহ্য করতে পারলেই সেটা স্থায়ীভাবে টিকে যাবে। বাগদাদির পরের যুক্তিটা ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং যুক্তিযুক্ত। ইসলামিক স্টেট হবে সারাবিশ্বের সব মুসলিমের নিজের দেশ। আল কায়েদার মত শক্তিশালী জিহাদি সংগঠনের নেতাদেরকেও সব সময় ছদ্মবেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। একজন সাধারণ মুসলিমের পক্ষে এই জিহাদে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। বাগদাদি যুক্তি দেখালেন, কিন্তু ইসলামিক স্টেট ঘোষণা করলে সারাবিশ্ব থেকে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সমমনা জিহাদিকে আকর্ষণ করা সম্ভব। ইসলামিক স্টেট হয়ে উঠতে পারে চুম্বক ক্ষেত্র। আবু বকর আল বাগদাদি মুসলিম যুবকদের ইসলামিক স্টেটে আগমনকে হিজরতের সাথে তুলনা করলেন। যেমন-ভাবে নবি মুহম্মদ প্রাণ বাঁচাতে মক্কা থেকে মদিনাতে চলে এসেছিলেন।

সমবেত জিহাদি নেতারা গভীরভাবে আলোচনা করতে লাগলেন, নব গঠিত ইসলামিক স্টেট কিভাবে পরিচালিত হবে, নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কী হবে, এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইস্যুতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে ইত্যাদি নানা জটিল পৌরনীতি। দিনের পর দিন ক্রমাগত আলোচনার পর এতদিনের দ্বিধান্বিত আথীর, শিশানি, নুসরা ফ্রন্টের দুজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সবাই বাগদাদির পরিকল্পনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। নব গঠিত ইসলামিক স্টেট যেন পরিচালিত হয় নুসরা ফ্রন্ট এবং আহরার আল শাম নামের বিদ্রোহী জিহাদি-গ্রুপের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নেতারা এখন বাগদাদির কাছে শুধু এই নিশ্চয়তাটুকু চায়। এই সহজ শর্ত মানতে বাগদাদির কোন আপত্তিই রইল না।

ইসলামিক স্টেট গঠনের পরের স্তরে চলে এলো পারস্পারিক মৈত্রী স্থাপন। নেতারা সব একের পর এক উঠে দাঁড়িয়ে বাগদাদির হাতে হাত মিলিয়ে শপথ বাক্য পাঠ করলেন, “আমি এই-মর্মে একাত্মতা ঘোষণা করছি যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে চাপের মুখে, কারো শক্তি প্রয়োগে বিশ্বাসের আমীর আবু বকর আল-বাগদাদি আল কোরায়শীকে ছেড়ে যাবো না। যতদিন নিজের চোখে দেখব তার ঈমান আছে ততদিন তার উপস্থিতি অথবা অনুপস্থিতিতে তার আদেশ মেনে চলবো। তখন বাগদাদি সব কমান্ডারদেরকে তাদের অধীনস্থ কিছু জিহাদি যোদ্ধা দেখাতে বললেন। মজলিস সুরা আল-মুজাহিদিন নেতা আবু আল-আথীর তার দলের বেলজিয়াম, ডাচ এবং ফ্রেঞ্চ যোদ্ধাদেরকে ডাক দিলেন। আবু বকর আল-বাগদাদির কাছে ব্যক্তিগতভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেছে এমন বিদেশী যোদ্ধাদের মধ্যে আছে আবু সায়াফ। স্থানীয় মানুষ তাকে “জবাইকারী” হিসেবে পরিচিত, বেলজিয়াম জিহাদি আবু জুবায়ের, ফ্রান্সের জিহাদি আবু তামিমা আল-ফ্রান্সি, চেচেন বংশোদ্ভূত বেলজিয়াম সুদর্শন সোনালী চুলের যুবক আবু শিশান আল-বেলজিকি। শিরশ্ছেদের অভিযোগে আবু শিশান ইতিমধ্যেই বেলজিয়ামে তালিকাভুক্ত ফেরারি আসামি। আমস্টারডাম, ব্রাসেলস বা প্যারিসে ছোটখাটো অপরাধে যুক্ত এইসব ইউরোপিয়ান সবার কাছে অত্যন্ত গর্বের সাথে মহা উৎসাহে কিভাবে বাগদাদির কাছে কিভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেছে প্রকাশ করতে লাগল। দুইদিন পরে আবু আহমেদ আনুগত্য প্রকাশ করলেন আবু আল-আথীরের কাছে।

আইসিসে যোগ দেয়া মানে হল, প্রত্যেক জিহাদি-গ্রুপ, ছোট ছোট দলের জিহাদিরা আর আগের নামে পরিচিত হতে পারবে না। এখন থেকে তারা সবাই আইসিস। এর ফলে সবথেকে বড় ক্ষতিটা হয়ে গেল বোধহয় নুসরা ফ্রন্টের নেতা আবু মুহম্মদ আল-জোলানির। বর্তমান পৃথিবীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ তার হাত থেকে হাতছাড়া হয়ে গেল। আইসিসে যোগ দেয়ার জন্য জাওয়াহিরির লিখিত কোন দিকনির্দেশনার জন্য আল-জোলানি অপেক্ষা করছিলেন। এবং নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধাদেরকে আইসিসে যোগ দিতে আপাতত নিষেধ করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ততদিনে নুসরা ফন্টের কমান্ডার এবং যোদ্ধারা আইসিসের পক্ষে শুরু করে দিয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আবু আহমেদ আলেপ্পো শহরে গিয়ে দেখতে পেলেন নুসরা ফ্রন্টের ৯০ শতাংশ যোদ্ধা ইতিমধ্যেই আইসিসের নিয়মিত যোদ্ধা। আইসিসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানো নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধাদের প্রধান কেন্দ্র তখন হাসপাতাল ভবন। বাগদাদির নতুন সৈন্যরা তাদেরকে হাসপাতাল ছেড়ে দেয়ার আদেশ দিলো। তারা ঘোষণা দিলো, আমরা এখন ইসলামিক স্টেটের প্রতিনিধি। সুতরাং এই ভবন আমাদের, তোমরা এখান থেকে চলে যাও। আইসিস উত্তর সিরিয়ার নুসরা ফ্রন্টের সদরদপ্তর, তাদের অস্ত্রাগারের গোলা, বারুদ সব দখল করে নিলো। কী অবাক কাণ্ড! আল-কায়েদা অধিকৃত সিরিয়ার যোদ্ধারা হঠাৎ করেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আইসিসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেল!! একটি নতুন অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে গেল; অন্ধকার যুগের নাম – ইসলামিক স্টেট।

[লেখাটি Foreign Policy তে প্রকাশিত “Present at the Creation” এর অনুবাদ]