ছায়েদ আলী পেশায় দিনমজুর শ্রেণীর হলেও তার একটা সমাজ আছে। সেই সমাজ হয়তো সম শ্রেণীর মানুষদের নিয়েই। তাদের আর্থিক দৈন্যতা যতই করুণ হোকনা কেন, দুবেলা পেঠের ভাত জোগাড় করতে  যতই গলদ্ঘর্ম হতে হয়না কেন তাদেরকেও কিছু সামাজিক আইন সংস্কার বিধি বিধান মেনে চলতে হয়। কেউ সেই নিয়ম ভঙ্গ করলে সালিশ বৈঠকে তার শাস্থির বিধান করা হয়। অন্যান্যের মতো ছায়েদ আলীদের সমাজেও নারীর চরিত্র তথা সতীত্ব একটি স্পর্শকাতর বিষয়। একজন দরীদ্র মানুষ একজন সম্পদশালীর যতই কিল-গুঁতা খাকনা কেন তাতে তাদের জাতিভ্রষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই।এমনকি কেউ যদি পেঠের কারণে চুরি-চামারিও করে তাও মেনে নেয়া যায় কিন্তু পরিবারের একটি মেয়ে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যদি পুরুষ-দংশিতা হয়ে যায় তবে আর রক্ষে নেই। উল্কার গতিতে চারদিকের বাতাস গরম হয়ে পড়ে। জাত গেল জাত গেল বলে চারদিকে শোর উঠে যায়। চরিত্রভ্রষ্ট সেই মেয়েটিকে কঠিন শাস্থি না দেয়া পর্যন্ত মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ছায়েদ আলীর মেয়ে বিউটিকে বাবুল নামের দুর্বৃত্তটি অপহরণ পূর্বক ধর্ষণ করে ফলে সে সমাজে কুলটা হয়ে পড়ে। তাকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের ছেলে তুলে নিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে অনৈতিক কাজ করেছে তাতে বাবুলের চরিত্রহানীর কোনো কারণ ঘটেনি। সে এজন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত হবে তারও কোনো কারণ নেই বরং সে বুক ফুলিয়ে হাঁটবে। মেয়েদের দেখলে  শিষ দেবে। অশ্লীল মন্তব্য করবে কারণ এসব করার মতো একটি কান্ড সে অতি কৃতিত্বের সাথে ঘটিয়ে ফেলেছে। তার এই অপকর্মের জন্য তার আত্নীয় স্বজনকে মুখ লুকাতে হবেনা। এজন্য তার ভাই বোনের বিয়েও আটকে থাকবেনা কিন্তু বিউটি ধর্ষিতা হওয়ায় তার নির্মম নিষ্টুর ফল ভোগ করবে তার বাবা ছায়েদ আলী। সে তার অন্যান্য মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেনা। সমাজ তাকে একঘরে করবে। একেতো দরীদ্র মানুষ এর উপর যদি সমাজ তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বাঁচবে কী করে? দিনমজুর মানুষ তাকে যদি কাজ না দেয়া হয় পেঠে পাথর বেঁধেতো সে বাঁচতে পারবেনা। এর চেয়েতো বরং সেই আপদটিকে বিদায় করে দেয়াই ভাল। এদিকে প্রতিহিংসাপরায়ন আরেক খলচরিত্র ময়নামিয়া ছায়েদ আলীকে ক্রমাগত প্ররোচিত করেছে মেয়েকে হত্যার জন্য। মেয়েতো এমনিতেই মরে গেছে। যাকে ধরে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে তারতো এমনিতেই মৃত্যু হয়ে গেছে। তার বেঁচে থাকা তার নিজের জন্য যেমন অভিশাপ তেমনি গোটা পরিবারের জন্যও। বরং পরিকল্পনামাফিক তাকে হত্যা করলে সে সামাজিক চাপ থেকে মুক্তিলাভ করবে সেসাথে যে লম্পট তার মেয়ের সর্বনাশ করেছে তাকে ফাঁসিয়ে হত্যা মামলার আসামী করা যাবে। দরীদ্রের মেয়েকে একজন ইউপি মেম্বারের ছেলে ধর্ষণ করেছে এটা আইনের চোখে তেমন বড় কোনো অপরাধ নয় সুতরাং এ কারণে তার শাস্থিও হবেনা কিন্তু যদি খুনের মামলায় জড়ানো যায় তবে তাকে শাস্থি পেতেই হবে।এইসব প্ররোচনা এক সময় ছায়েদ আলীর কাছে যৌক্তিক মনে হয়। যৌক্তিক মনে না হওয়ার কোনো কারণও নেই। কারণ ময়নামিয়ার প্রতিটি কথাই যুক্তিপূর্ণ। তারপর প্রথম দফা চারিত্রিক এবং সামাজিক মৃত্যুর পর যথারিতি একদিন বিউটির শারিরীক মৃত্যুও সম্পন্ন হয়।

দৃশ্যপটটি কল্পনা করুন। একজন স্নেহময় পিতা যিনি তার জীবনের শেষ সামর্থ দিয়েও তার কন্যাটির মুখে হাসি ফুটাতে চেয়েছেন। একেবারে শৈশবকাল থেকেই কন্যাটি যখন যার বায়না ধরেছে সীমিত সামর্থের মাঝেও তিনি চেষ্টা করেছেন মেয়ের আব্দার রক্ষা করতে। অথচ  সেই স্নেহের কন্যাটিকেই তিনি বাড়ি যাবার নাম করে তার নানীর বাড়ি থেকে নিয়ে এসে ঘাতকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। নির্জন হাওরের খোলা প্রান্তরের সবুজ ঘাসে ফেলে তাকে ঘাতকরা হত্যা করছে আর সেই পিতা পাশে দাঁড়িয়ে সেই হত্যার দৃশ্য দেখছেন। সেই মেয়েটির কথা ভাবুন। একাধিক ঘাতক তাকে নির্মমভাবে হত্যা করছে আর তার জন্মদাতা পিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। কী তার অপরাধ? কেন তাকে হত্যা করা হচ্ছে? এইতো মাত্র কদিন আগে এক পশু তাকে অপহরণ করে দিনের পর দিন বলাৎকার করেছে। সেই পশুর হাত থেকে বাঁচতে তাকে দূরের আত্নীয় বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এর মাঝে তাকে মেরে ফেলার মতো অপরাধ সে কোথায় করল? অবশ্য মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে  একটি অপরাধের কথা তার মনে পড়ে থাকবে হয়তো। সে অপরাধটি হলো তার জন্মপাপ। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া্র পাপ। সে মেয়েটি চর্যাপদ পড়েনি পড়লে জানত হাজার বছর আগেই তার কথা বলে গেছেন এক চর্যাকবি ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরি’ এই রূপকের মাধ্যমে।হরিণের মাংসের সুখ্যাতি যেমন তার মৃত্যুর কারণ তেমনি নারীর শরীর হলো তার জন্মশত্রু। এই শরীরের কারণেই তাকে মরতে হচ্ছে। ভাবুন সেই বাবার কথা। প্রফেশনাল ছাড়া একটা পাগলা কুকুরকে হত্যা করতেও একজন বিবেকবান সুস্থ মানুষের হাত কাঁপে এমনকি কেউ হত্যা করলেও দাঁড়িয়ে দেখার মতো মানসিকতা থাকেনা কিন্তু আমাদের কথিত এই পিতা তাই করছেন। তিনি নিজ কন্যাকে ঘাতকের কাছে তুলে দিয়েছেন। কন্যার সেই হত্যাকান্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। এর কারণ হত্যাকান্ডের দর্শক সেই লোকটি তখন আর বাবা নন। বাবার খোলসের ভেতর জেগে ওঠা চিরকালের একজন পুরুষ যার কাছে নারী কোনো স্বত্তা নয় একটি জীবন্ত বস্তুমাত্র।

বিউটির এই হত্যাকান্ডের মূল মোটিভ হলো সামাজিক চাপ থেকে মুক্তি এবং তা থেকে ছায়েদ আলী ও তার পরিবারের সম্মান রক্ষা সুতরাং একে বলা যায় এক ধরণের অনার কিলিং। একটি দিনমজুর শ্রেণীভুক্ত মানুষের মাঝেও যদি এ রকম সামাজিক মান-সম্মানের প্রশ্ন তাকে হত্যার মতো অপরাধে উদবুদ্ধ করে তাহলে আমাদের তথাকথিত অভিজাত সমাজের অবস্থাটি কেমন? কারণ পারিবারিক মান-সম্মানের প্রশ্নতো সে সমাজে আরও উৎকট। হা সেইসব সমাজেও অনার কিলিং চরিত্রের হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়ে থাকে। যদিও পাকিস্তানের মতো তা স্বীকৃত নয় অনার কিলিং শব্দটাও এখানে প্রচলিত নয় কিন্তু প্রথাটি ট্যাগবিহীন ভাবে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। একটি মেয়ে পরিবারের ঐতিহ্য ভঙ্গ করে নীচু সমাজ বা ভিন্নধর্মের একটি ছেলের সাথে জড়িয়ে পড়েছে সেই মেয়েটিকে কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছেনা তখন পরিবারের সম্মান বা ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে তাকে হত্যা করে রোগভোগে মৃত্যু বা আত্নহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু পরিবারের লোকজনই হত্যার সাথে জড়িত থাকে সুতরাং এসব হত্যাকান্ড সাধারণ মৃত্যু বা আত্নহত্যার মামলা হিসেবেই চিরকালের জন্য চাপা পড়ে যায়। পর্দার অন্তরালের এই শিরোনামবিহীন হত্যাকান্ড মুসলমানদের মতো হিন্দুদের মাঝেও আছে। উভয় সমাজেরই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক বৈষম্য বর্ণ গোত্র সামাজিক ষ্ট্যাটাস ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে সামঞ্জস্য রয়েছে। হিন্দুদের একটি বাড়তি সুবিধা হলো প্রেমেপড়া বা প্রেমেধরা অবাধ্য মেয়েটিকে হত্যা করে কোনো একটি রোগে মৃত্যু হয়েছে এ রকম ঘন্টাখানেকের ঘোষণায় ‘রামনাম সত্য হে’ বলে লাশটিকে খাটিয়ায় তুলে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করে দিলেই বায়োলজিকেল সকল ইভিডেন্স নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশে যতগুলি নারী-আত্নহত্যার ঘটনা ঘটে তার বড় একটি অংশই পর্দার অন্তরালের অনার কিলিং। এমনকি যেগুলি প্রমানিত আত্নহত্যা তার পেছনেও থাকে প্ররোচনা। ভিকটিমের চারপাশে এমন ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করা হয় যখন মৃত্যুর মাঝেই সে একমাত্র মুক্তির পথ খুঁজে পায়। এ ক্ষেত্রে পরিবার সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করেনা কিন্তু ভিক্টিমকে মরতে বাধ্য করা হয়। এটাও হত্যা। বিউটির মতো কত হাজারো হতভাগিনী যে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিষ্টুরতার বলি হয়ে পৃথিবী থেকে অকালে ঝরে গেছে এবং যাচ্ছে তার খবর আমরা জেনেও না জানার ভান করে যাচ্ছি। কারণ ভেতরে ভেতরে আমরা প্রায় সবাই একাধারে ধর্ষক ও অনার কিলারদের শ্রেণীভুক্ত। বিউটিও অন্যান্যদের মতো নিরব নিঃশব্দেই চলে যেত কিন্তু তার হত্যা দিয়ে অন্যকে ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছে বলে খেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। যদি গলা টিপে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো কেউ তার খবরও জানতনা।

বিউটি হত্যাকান্ডের আসামী হিসেবে বাবা ছায়েদ আলীর হয়তো সর্বোচ্চ শাস্থিই হবে। হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের জন্য কি শুধু ছায়েদ আলীই দায়ী ? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, এর মূল্যবোধ, নারীর প্রতি তার বর্বর দৃষ্টিভঙ্গি কি সমান দায়ী নয়?  ছায়েদ আলীতো একজন স্রেফ রোবটিক চরিত্রমাত্র  তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এই সমাজ। কিন্তু সমাজেরতো বিচার হবেনা। যতদিন না এই সমাজের পুরুষদের বোধোদয় হবে ততদিন নারীদের এই অভিশাপ বয়ে বেড়াতেই হবে।