অনুবাদক: বিকাশ মজুমদার
মূল প্রবন্ধ:The secret lives of young IS fighters

টাইগ্রিস নদীর তীরে পড়ে আছে তিনজন সদ্য যুবক আইএস যোদ্ধার মৃতদেহ। মৃতদেহের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের ব্যক্তিগত ছবি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রামাণ্য দলিল যা থেকে প্রকাশিত হবে এইসব আইএস যোদ্ধাদের লোমহর্ষক ব্যক্তিগত জীবনযাপন।

সতর্কতা: সন্ত্রস্ততা-উদ্দীপক উপাদানের উপস্থিতি

মহম্মদ তিনজন আইএস যোদ্ধার ক্রিয়াকর্ম খুঁজে পেয়ে এবং তার মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে পেরে ভীষণ উত্তেজনায় টগবগ করছে। তাদের একজনের দিকে লক্ষ্য করে সে চিৎকার করে বলছে, “ওকে গুলি করো।”
সে একটু আতংকিত বলে তাকে জঙ্গীদলের রান্নার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সে নিরস্ত্র কিন্তু ইরাকি পুলিশের বিশেষ দল (ইমারজেন্সী রেসপন্স ডিভিশন) তার সঙ্গীদের কপালের দিকে ট্রিগার তাক করে আছে, যাদের গুলি কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয় না।

null

টাইগ্রীস নদীর তীরে একটা মৃত দেহ এবং পাশেই কাপড়ের স্তুপ। এখানে দুইজন আইএস জঙ্গীর লাশ ছড়ানো ছিটানো। একজন কৈশোর উত্তীর্ণ মৃত বালক, কংক্রিটের বালি সিমেন্ট ইটের আবর্জনার স্তুপে ডুবে আছে। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া তার কালশিটে পড়া হাতে একটা শুকনো লাঠি ধরা। কাছেই ঘাসের মধ্যে আর একটু বয়স্ক জঙ্গীর মৃতদেহ। এখনো তার চোখ খোলা, কিন্তু তার মাথার খুলির কিছু অংশবিশেষ গেছে খোয়া। বাংকারে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় বিমান হামলায় দুজনের একসাথে জীবনের যবনিকাপাত হয়েছে। কিন্তু টাইগ্রীস নদীর পাড় ধরে পায়ে চলার রাস্তায় তৃতীয়জন একটু আড়ালে গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে যার জন্য সৈন্যরা ঈষৎ চিন্তিত।
সাবধান! তার হাতের দিকে তাকাও। মনে হচ্ছে তার হাতে এখনো তাজা গ্রেনেড। আস্তে যাও, মুহম্মদ।

আইএস এখনো অদৃশ্য লক্ষ্যবস্তুতে দফায় দফায় গুলি বর্ষণ করছে।একজন সৈন্য বলছে, “কুত্তার বাচ্চাটা লুকিয়ে ছিল” সাবধানে, খুব সাবধানে। আর একজন সৈন্য বলছে, “ওহহ, আমি দেখিইনি তার গায়ে আত্মহত্যার পোশাক পরা।” একজন ইরাকি সৈন্য পুরো বিষয়টা তদারকি করছিল। সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে জলপাই বাগানের নিচে যেখানে ইমারজেন্সী রেসপন্স ডিভিশনের অস্থায়ী ক্যাম্প। এখান থেকেই ইমারজেন্সী রেসপন্স ডিভিশন ইরাকে আইএস’র শেষ শক্ত ঘাটি মসুলকে পশ্চিম দিকে কোনঠাসা করে রেখেছে। আমি উপর থেকে মৃতদেহগুলো দেখলাম। একজনের ডানপা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। হাড় থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে কোনক্রমে বাংকারের বাইরে এসেছে এবং নদীর ধারে একটা ছোট্ট পাহাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে। এমনকি মৃত্যুর পরেও একজনের চেহারা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে, সরু চোয়াল আর কিছুটা দুষ্টুমিপূর্ণ নাক আর গালে অল্পকিছু দাড়ি। সে সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে মাত্র, এখনো যুবক হয়ে ওঠেনি। যৌথবাহিনীর সৈন্যরা তার পাশেই অবহেলায় পড়ে থাকা একটা এম১৬ রাইফেল খুঁজে পেল, যার উপরে খোদাই করে লেখা “আমেরিকা সরকারের সম্পত্তি।” সৈন্যরা এম১৬ মেশিনগানটি গুটিয়ে রাখল। মনে হয় দুই বছর আগে সিরিয়া থেকে ইরাকি বাহিনী পিছু হটার সময় আইএস হাজার হাজার অস্ত্র এবং গাড়ি দখল করেছিল এই এম১৬ সেই অস্ত্রেরই একটা।

“আদেল, আদেল, কারো কাছে কি অস্ত্র গোলাবারুদ আছে? মৃতদেহ তল্লাশি করতে করতে একজন সৈন্য বলছিল আমার গুলির পুরো একটা ম্যগাজিন দরকার।” যে মানুষটি কেবলমাত্র এম১৬ খুঁজে পেল এই রাইফেল এখন থেকে তার।
একজন অফিসার আমাকে বললেন, এখানে আমরা আর নিরাপদ নই। সৈন্যরা কিছুটা ভীত হয়ে পড়ল এবং ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাইল। সে সতর্ক করে বলল, এখানে আরও আইএস জঙ্গী এখনো আছে।
ফেব্রুয়ারীর শেষ নাগাদ থেকে এই যৌথবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে তাদের জীবন কাটাচ্ছে। এই তিনদিনে তারা দক্ষিন মসুলের দিকে সন্তোষজনক অগ্রগতি করতে পেরেছে। এখন তাদের সামনে শুধু আল বুসেইফ গ্রাম, তারপরে ধংস হয়ে যাওয়া বিমানবন্দর, আর শহরে প্রবেশের আগে পশ্চিম দিকে কিছু প্রতিবেশি গ্রাম।

আইএস জঙ্গীরা দ্রুত গতির স্রোতের মত ধেয়ে আসতে লাগল কিন্তু যতই মসুলের কাছাকাছি এসে পড়ল ততই তারা প্রতিরোধের মুখে পড়ল। আর অসংখ্য মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকল রাস্তায়, ফুটপাতে। মসুল শহরের পূর্ব প্রান্ত থেকে পাল্টা আক্রমণ প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল কারণ ইতিমধ্যে ১০০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং আইএস জঙ্গীরা এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। মসুল পরিণত হলো বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডারে। যেখানে সেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি আর প্রতিবেশি প্রত্যেক বাড়ি জঙ্গীদের আত্মগোপনের আস্তানা। যখন আমরা পাহাড়ের উপরে সেনা ঘাটিতে ফিরছিলাম, আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম জঙ্গীদের মৃতদেহ। একটা লাশের পাশে ঘাসের উপর দেখতে পেলাম আইএস’র স্ট্যাম্প সিল লাগানো ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো। এটা ছিল ছুটির অনুমতিপত্র। কাগজের উলটো পাশে রক্তের দাগ।

সৈনিকেরা মৃতদেহগুলো শেষবারের মত আবার চেক করে দেখল। ছায়ার আড়ালে একজন যুবকের পাশে পড়ে আছে ব্যবহারের প্রায় অযোগ্য সামান্য কিছু সিরিয়ান ডলার। কিন্তু তার অন্য পকেটে পাওয়া গেল ছোট্ট একটা বস্তু, মহামূল্যবান—একটা মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড। এই মেমোরি কার্ডের ছবির মাধ্যমেই আমরা দেখতে পারব মৃত আইএস জঙ্গীদের জীবিত জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র যেমন জঙ্গীদের মাঝে কেমন গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাদের নৃশংসতা এবং মসুলের দিকে তাদের যুদ্ধযাত্রা। এই ছবিই নিহত জঙ্গীদের অজানা জীবনের উপর আলোকপাত করবে। কে ছিল এই যুবক এবং মরার আগে জানল না ইসলামিক স্টেটের কী গোপনীয়তা সে ফেলে গেল।

মৃত এই আইএস জঙ্গীর আলোকচিত্র শুরু হচ্ছে পারিবারিক ছবি দিয়ে যা অতি দ্রুতই অন্ধকারে পর্যবসিত হবে। যুবকটি বসে আছে, তার মুখে হাসির আভাস। হরিণের মত দীর্ঘ আয়ত উজ্জ্বল দুটি চোখ তার। পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট একটা বালিকা। মনে হচ্ছে তার বোন। তাকে কাছে জড়িয়ে ধরা এবং ছোট্ট বালিকাটি তার তর্জনী উচিয়ে ধরে আছে যেটা হলো ইসলামিক স্টেটের এক আল্লাহ প্রকাশের প্রতিক হিসেবে চিহ্নিত। তার লম্বা কোকড়ানো চুলের মাঝখানে সিথি করা। সামনে যত ছবি দেখব সবই সম্পাদনা করা হয়েছে। তার গাল, চিবুকে, কিশোরী মেয়েদের মত গোলাপী আভা এসেছে। বাড়ানো হয়েছে তার চোখের উজ্জ্বলতা। বোঝা যায় কোথাও যেন একটা পরিবর্তন ঘটছে।
এরপরেই দেখতে পাবো তার গায়ে সামরিক পোশাক, কাঁধে ঝুলছে কালাশনিকভ, আর বুক পকেটে একটা ওয়াকি-টকি। অন্য একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সে ঘুমিয়ে আছে। নিশ্চিতভাবেই ছবি তোলার জন্য পোজ দেয়া হয়েছে কারণ যুদ্ধের মধ্যে যোদ্ধারা কিভাবে বিশ্রাম করে সেটা দেখানোর উদ্দেশ্যে।

এখন আর এটা পারিবারিক ছবির এলবাম নেই। শহীদ হতে যাচ্ছে একটা শিশুর মত নিষ্পাপ চেহারার আততায়ী যে আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত। তার পোশাকের অন্য পকেটে প্রাপ্ত মেমোরি কার্ডে আমরা আরো ছবি দেখতে পাবো। যুবক এবং কিশোরদের একটা দলীয় ছবি। এতক্ষণের আলোচিত জঙ্গী যোদ্ধা এই ছবিতে নেই, হতে পারে সে ক্যামেরার পিছনে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমরা আরো জানতে পারব এইসব যুবক এবং বালকদের প্রায় সবার বাড়ি মসুলে এবং তারা ‘নাইনভে ফায়ার সাপোর্ট গ্রুপ’ নামের পিছন থেকে সাহায্যকারী দলের সদস্য। আইএসের সাথে কাটানো সময় এবং যুদ্ধ তাদের মধ্যে একটি কৃত্রিম গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে। যোদ্ধাভাইদের হাতে একটা জিনিস বাধা দেখে বিস্ময়ে আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মাঝখানে সিঁথি করা লম্বা চুলের একজন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক যোদ্ধা খুব মনোযোগের সাথে ক্যামের দিকে তাকিয়ে আছে। সহসা আমার নজর গেল তার হাতের দিকে। তার হাত কোমরের উপর রাখা। আমি কৌতুহলি হয়ে আরো দেখতে লাগলাম, লোকটি কালো দস্তানা পরে আছে। তার জামার হাতের নিচে লুকানো আছে আত্মহত্যার বেল্ট এবং তার বৃদ্ধাঙ্গুলি আত্মহত্যার বেল্টের সুইচ স্পর্শ করে আছে। দস্তানা পরা হয়েছে যাতে হাতের নিচে সুইচ লুকিয়ে রাখা যায় এবং সময়মত বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। এটা আসলে জঙ্গীদের ছদ্মবেশ যাতে নিরাপত্তা চৌকি বুঝতে না পারে খাকি কাপড় পরা হাসিমুখের যুবকের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে এবং তল্লাশি চৌকি বিস্ফোরণের আঘাতে উড়ে যাবে।

null

এখানে দলীয় ছবিও আছে, সাথে একজন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষও আছেন। যুদ্ধে তাদের মুখে স্থায়ী কালসিটে পড়ে গেছে আর যেখানে সেখানে কাটাছেড়া দাগ। তাদের মুখ কখনো ভুলবার নয় এবং মসুলে তারা খুব পরিচিত। কিন্তু ফোনের মেমোরি কার্ড থেকে আরও গোপন কিছু প্রকাশ হবে যেটা এতদিন আমার চোখের সামনেই অবহেলায় পড়ে ছিল।

মসুলের যুদ্ধক্ষেত্রে জঙ্গীরা দুইধরণের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে জোটের কড়া নজরদারি এবং অবসাদগ্রস্থ ক্লান্তি তাদের গিলে ফেলছে। রাত্রে মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর সুযোগ পায় তারা। সাংবাদিক হিসেবে জঙ্গীদের অনুসরণ করার সময়ে আমাকেও একই দৈনন্দিন জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সূর্যাস্তের আগে আগে ঘুম থেকে উঠতাম, যুদ্ধের সম্মুখভাগে যেতাম, দেখতাম তারা কিভাবে মর্টারের গোলা, রকেট পাশ কাটিয়ে, রাস্তার ধারে পুতে রাখা বোমা এবং ড্রোনের আঘাত এড়িয়ে যুদ্ধে যায়। নিচু হয়ে নিজের মাথা বাঁচিয়ে দেখতাম আইএস স্নাইপার এবং যোদ্ধাদের মাঝে বন্দুকযুদ্ধ। রাতে আমাদের ক্যামেরার সহযোগী দল খুব কম সময়ই পেতো ছবি সম্পাদনা করার, আমাদের ক্যামেরার যন্ত্রপাতি চার্জ দেয়ার। পরেরদিন কাজে বেরোনোর আগে খুব কম সময় পেতাম ঘুমানোর জন্য।

null
আকাশ থেকে তোলা খামার বাড়ির ছবি

আমরা কখনো আমাদের ঘুমানোর ঘরগুলোতে বেশি নজর দিতাম না। সংক্ষেপে বলতে গেলে এগুলো ছিল অন্ধকার, সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত থাকতাম এবং অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকত। আমরা সবাই জানতাম জোটের সৈন্যরা বুনোফাঁদে আইএস জঙ্গী খুঁজে বেড়ায় সুতরাং এখানে আমরা মোটামুটি নিরাপদ। প্রায় দুই সপ্তাহ খামারবাড়িতে কাটানোর পর তিনটে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। কুকুর আর পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে তাদের শরীরের পচাগলা মাংস খাচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের শরীর, চেহারা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। যখন আমি মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ডের ছবি দেখছিলাম তখন কোথা থেকে যেন একটা ধাতব মুদ্রা পড়ল। এই খামারবাড়িতে যোদ্ধারা শুধু যুদ্ধই করত না, এখানে তাদের বাসস্থানও ছিল। খামারবাড়ির দেয়ালে সুন্দর কিছু শৈল্পিক ছবি ঝোলানো এবং আসবাবপত্র দেখতে পেলাম।

যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের শেষ দিন। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে কয়েকঘন্টার সময় আছে ইরবিলের নিরাপদ স্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য। চলে যাওয়ার আগে আমি ভাবলাম খামারবাড়ি একটু খুঁজে দেখি। আমি যেখানে ঘুমাই, ঠিক তার উপরে একটা জানালা। আমি ধুলায় ধূসরিত পর্দা সরালাম। ঠিক এখানেই লুকানো আছে আইএস খেলাফতের সরকারি প্রজ্ঞাপন এবং নির্দেশাবলি। প্রজ্ঞাপনে লেখা আছে আইএস যুদ্ধের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছে, বিশেষ করে জনবলের মারাত্মক ঘাটতি এবং খেলাফতের উর্ধতন নেতার সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। নভেম্বরের ১১ তারিখে একটা প্রজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে আইএস’র যুদ্ধমন্ত্রী বিশেষ বাহিনী নিয়োগের জন্য তাগাদা দিয়েছেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নতুন এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়েছে যুদ্ধ থেকে পালানো ঠেকাতে হবে। যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে আসার কোন উপায় নেই। কেউ পালানোর চেষ্টা করলে বল প্রয়োগ করা এবং তার প্রতি নৃশংস আচরণ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

ঘরের পিছনের দেয়ালটা কম্বল দিয়ে ঢাকা। আমি একটা রহস্যের সন্ধান পাচ্ছিলাম, তাই হ্যাচকা একটা টান দিলাম চাদর ধরে। ধুলোর মেঘ ছড়িয়ে পড়ল, দেখা গেল আর একটা ছোট্ট কিন্তু আলোকিত ঘর। দেয়ালের গায়ে একটা জানালা এবং বিছানাপাতা আর বাইরে একটা সবজির বাগান। যারা মরে গেছে জীবিত থাকতে তারা এখানে ঘুমাতো। তাদের কাপড় চোপড়, ব্যবহৃত জিনিসপত্র ঘরের মেঝে ভর্তি যত্রতত্র ছড়ানো ছিটানো। আইএস’র দেয়াল পোস্টারের পাশেই চেলসি ফুটবল ক্লাবের লোগো লাগানো বালিশের কভার পড়ে আছে। পোস্টারে আইএস খেলাফতে অপরাধ করলে তার শাস্তির তালিকা লেখা।

সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ফ্ল্যাশলাইটের যন্ত্রাংশ সকেট থেকে তার খোলা অবস্থায় দেখা গেল। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা জিনিসের উপর আমার চোখ আটকে গেল। দেখতে পেলাম সোনালী চুলের শিশুর ছবিওয়ালা ছত্রাক সংক্রমণরোধী একটা ওষুধের বাক্স। কিন্তু খুব সতর্কভাবে ছবির শিশুটির চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। ইসলামে মানুষের প্রতিকৃতি অংকনে নিষেধাজ্ঞার কারনেই সম্ভবত ছবির মুখাকৃতি বিকৃত করা হয়েছে।
ঘরটি খুবই নোংরা। পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের স্তুপের নিচে লুকানো একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আইএস জঙ্গীরা ফেলে গেছে। কয়েকটা পাতায় হাতে লেখা বিস্তারিত দিকনির্দেশনা এবং তথ্যচিত্র খুব সতর্কভাবে ভাজ করে রাখা হয়েছে। এই লেখা থেকেই আমরা লেখক সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারব। কাগজের এক কোনায় আইএস’এ তার সদস্যপদের ক্রমিক নম্বর এবং তার নাম ইংরেজি বর্ণে বড় করে লেখা; তার নাম ছিলঃ আবু আলি আল মোসলিউ। এই নামের লোকটিই কি ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেই যুবক?

লেখার শুরুতে হাতের লেখা খুব সুন্দর গোছানো এবং পরিষ্কার এবং নির্দেশনাগুলো খুব সুনির্দিষ্ট। সেখানে লেখা আছে, প্রকৃতপক্ষে আবু আলি জীবন আর মৃত্যুর মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। আবু আলি শিখেছে কিভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে হয়। লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে আবু আলি খুব মেধাবী এবং পরিশ্রমী শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু যেটা হয় আরকি, প্রশিক্ষণ যখন বাড়তে লাগল তখন স্কুলের অন্যান্য ছাত্রের মত সেও উদাসী এবং অনিয়মিত হয়ে গেল। কিন্তু সে তার নিজের কাজের জন্য গর্বিত। গুগল ম্যাপ থেকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে অব্যর্থভাবে সে লক্ষ্যভেদ অনুশীলন করতে লাগল। সে কাগজের উপর কম্পাস দিয়ে ডিগ্রি (উন্নতি কোণ) এঁকে মর্টারের গোলা বর্ষণ করে। অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তার লেখা নোটবইতে সে অস্ত্রের তালিকায় রাসায়নিক অস্ত্রের নাম উল্লেখ করেছে। মসুলে আইএস রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল কিনা সেটা নিয়ে বিপুল বিতর্ক প্রচলিত আছে। আবু আলির নোটখাতায় নিজের লেখা থেকে জানতে পারলাম অন্তত আইএস রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছিল এবং তাদের রাসায়নিক অস্ত্রের প্রস্তুতিও ছিল। সে নোটখাতায় তার নির্দেশ চিহ্নিত করে রেখেছে, তার অধীনস্ত যোদ্ধাদের জন্য পেন্সিলে আঁকা একটা লোগোতে আইএস’র সীল লাগিয়েছে। তার দলের নাম দিয়েছে “সাধারণ সাহায্যকারীদল”। সেখানে একটা মূলমন্ত্র লেখা, “ইসলামিক স্টেটঃ নবীর মতাদর্শ মেনে চলে” এবং বিরোধীদের মুখে ছাই দিয়ে ইসলামিক স্টেট বহাল তবিয়তে টিকে আছে। শিক্ষাবিভাগের একটা পরীক্ষার খাতাকে সে নোটখাতা হিসেবে ব্যবহার করেছে। সবথেকে মজার বিষয় হলো, পরীক্ষার খাতার উপর লিখে রেখেছে শিক্ষা বছর ২০১৬-১৭, বিষয়ঃ মর্টার। আবু আলি নিজেই নিজের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করেছে। ফাইনাল মার্কসঃ কংগ্রাচুলেশনস, তুমি পাশ করেছে। পূর্ণমাণঃ ১০০

এই গোপন আস্তানার আরো অনেক গোপনীয়তা প্রকাশ পেতে তখনো বাকি। যখন আমি ঘরের আবর্জনা ঘাঁটতেই চোখে পড়ল। প্রথমে এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হলো। নোটখাতাটা ছিঁড়ে গেছে এবং একটা সুতা দিয়ে ঝোলানো। কেউ নোটখাতার কয়েকটা পাতায় একই ইসলামিক কবিতা এবং নামাজের সুরা এবং আয়াত হিজিবিজি করে বারবার লিখে রেখেছে। মনে হচ্ছে মুখস্ত করার জন্যই খোদাই করে লেখা হয়েছে। লেখায় প্রচুর ভুলে ভরা, এ পর্যায়ে হাতের লেখা বিশ্রি হয়ে গেছে এবং অক্ষরের গঠন এলোপাতাড়ি। মনে হচ্ছে এই লেখা নিশ্চয় আবু আলির নয়।

নোটখাতায় এরপরের পাতায় আইএস যোদ্ধাদের সংখ্যা, নামের তালিকা, ক্রমিক দেখা গেল। যে নাম এবং ক্রমিক সংখ্যা ঘষামাজা করেছে তার নিশ্চয় যোদ্ধাদেরকে টহলে পাঠানোর ক্ষমতা ছিল। সে যোদ্ধাদের নাম এবং তাদের দ্বায়িত্ব পালনের সময়, কে কয় রাউন্ড গুলি করেছে এবং পরবর্তী টহলের জন্য কতজন যোদ্ধা লাগবে তার হিসেব লিখে রাখত। নিশ্চিতভাবেই এই খামারবাড়িতে একজন উর্ধতন আইএস যোদ্ধা থাকতো, সম্ভবতই সে এই যোদ্ধাদলের নেতা। পরে আমি জেনেছিলাম তার নাম ছিল আবু হাশেম।

নোটখাতা যেন গোপনীয়তার অজানা খনির নতুন মনি। নোটখাতা থেকে প্রকাশিত হলো আল-বুসেইফ এয়ার ব্রিগেড ইউনিটের সৈন্যদলের নামের তালিকা। অগ্রগামী সৈনিক দলের সাহায্য করার জন্য তারা একটা ছোট দলে বিভক্ত। সর্বেসর্বা আবু হাশেম আটজন যোদ্ধা এবং দুইটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা আল বুসেইফ’র আকাশসীমা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ভ্রাম্যমান দল গঠন করলেন। একটা হুন্দাই পিকআপ ট্রাকে বিমান বিধ্বংসী দোনলা কামান এবং অন্য ট্রাকে ভারী মেশিনগান নিয়ে টহল দিয়ে বেড়াতো। দুটি গাড়িই সাদা কারন ইসলামিক স্টেট যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় সাদা গাড়ি ব্যবহার করে যাতে ধুলোবালিতে সহজেই আত্মগোপন করে নিজেদের লুকিয়ে ফেলতে পারে।

আবু হাশেম কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। সে প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে। কী ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হলো, তার ট্রাকের চ্যাসিস নাম্বার, কয় রাউন্ড গুলি তাদের মজুদ আছে, কত খরচ হয়েছে, কী ধরণের গুলি খরচ হয়েছে তার বিশদ বিবরণ নোটখাতায় লেখা আছে, এমনকি ত্রুটিপূর্ণ গুলির কথাও উল্লেখ আছে।

সে শুধুমাত্র একজন ভালো সরবরাহকারীই নয় বরং সে খুব ভালোভাবে জানে কিভাবে ছোট ছোট দল কার্যকরভাবে কাজ করে। নোটখাতার নথি দেখে বোঝা যাচ্ছে তার প্রচেষ্টায় কিভাবে তার দলের যোদ্ধাদের মনোবল এবং শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবু হাশেম যোদ্ধাদের কাজের সময় এমনভাবে বিন্যস্ত করেছিল যাতে গাড়ির উপরেই কয়েকজন যোদ্ধাকে একসাথে খাবার খেতে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সে নিজে দুইটা গাড়ির চালক আবু রিয়াদ, আবু হাফস এবং বন্দুকযোদ্ধা আবু আল-শামের সাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। নোটখাতায় কমান্ডার আবু হাশেমের নিজের চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। নামের তালিকা থেকে নিয়মিত যোদ্ধাদের নাম পরিবর্তন করে আবু হাশেম দৈবচয়ন পদ্ধতিতে টহলের জন্য যোদ্ধাদের নতুন দল নির্বাচন করত। নেতৃত্বের ভারে ন্যুব্জ হয়ে দল পরিচালনা করতে গিয়ে তার মনের উপর ভীষণ চাপ গিয়েছে কিন্তু কাজের চাপ কখনো তাকে দমন করতে পারেনি। পোড় খাওয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডারের মতই আবু হাশেম তার দলে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলত। একবার একজন অধীনস্ত যোদ্ধাকে নিয়ে সে টহলে বের হয়। সেখানে একটা লিখিত নির্দেশনায় সে আদেশ দেয়, যদি কারো দ্বায়িত্ব পালনে ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে সে অবশ্যই শাস্তির সম্মুখীন হবে। এবং সবাইকে আল্লাহর নামে দোয়া করে বলেন, “আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন।”

ছবি, নথি, নোটখাতা নিয়ে আমি খামারবাড়ি ত্যাগ করলাম এবং শেষ পর্যন্ত ইরাক ছেড়ে চলে গেলাম। কিন্তু মাসের পর মাস সেই মৃত মানুশগুলো আমার মাথায় রয়ে গেল। ছবি, নোটখাতার সাহায্যে আমি ইতিমধ্যেই জঙ্গীদের সম্পর্কে অনেককিছু জানি। কিন্তু আমি কি আরও চমকপ্রদ কিছু খুঁজে পাবো? মৃতদের কি পরিবার ছিল? কেমন ছিল তাদের জীবনযাপন? মসুল থেকে শুরু করলাম মৃত জঙ্গীদের অতীত জীবনের খনন কাজ। এপ্রিলের প্রথমদিকে ইরাকের ইমারজেন্সি রেসপন্স ডিভিশন গোটা একটা সৈন্যদল নিয়ে মসুল শহরের পশ্চিমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খামারবাড়ি মনে হচ্ছে জন্মান্তরের আগের ঘটনা। সেখানে এখন সৈন্যদলের নতুন ঘাঁটি, আর কিছুটা দূরেই প্রতিবেশি আবাসস্থল।
নিরবিচ্ছিন্ন গোলাবর্ষণ খামারবাড়ির জানালার বাইরে অবশিষ্ট যা কিছু ছিল সব তছনছ করে দিলো। সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গীদের বন্দী করে আনা হলো খামারবাড়িতে। সৈনিকেরা পিকআপ ট্রাক থেকে একজনকে টেনে তুলল। আঘাতে আঘাতে সে মৃতপ্রায়। তার টিশার্ট রক্তে ভেজা। কে যে তাকে এমন মেরেছে সেটা অবশ্য পরিষ্কার না। হতে পারে সৈন্যরা তাকে মেরেছে অথবা স্থানীয় জনতা প্রতিশোধ নিতেই এমন মেরেছে যারা এতবছর ধরে আইএস জঙ্গীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং অত্যাচারিত হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন মেজর আমাকে পিছনের একটা ঘরে ডাকলেন। তিনি বললেন, “আসুন আপনার সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দিই যার কথা ইতিপূর্বে আমরা কেউকে জানাইনি।”
দেখতেই অনেকটা অসৎ, সাধারণ পোশাকে দেখতে অনেকটা দ্বায়িত্ব থেকে বিরত সৈনিকের মত দেখতে এক তরুণ যুবক ঘরে প্রবেশ করল। ধরে নিই তার নাম ইব্রাহিম। সে দুইবছর ধরে আইএস’র পক্ষে যুদ্ধ করছে, তবুও সে কিন্তু বন্দী নয়। কারণ সে একজন ডাবল এজেন্ট। একই সাথে আইএস এবং ইরাকি বাহিনীর জন্য কাজ করছে। খামারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত একটা ছবি আমি ইব্রাহিমকে দেখালাম।

ইব্রাহিমের সাথে কুয়েনটিনের আলাপ:
ইব্রাহিম বলল, “আমি তাদেরকে ভালো করেই চিনি” তারা আইএস জঙ্গী। তারা খালেদ ইবনে আল-ওয়ালিদ’র দলের সদস্য। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক একজন লোকের ছবির দিকে আঙুল তাক করে সে বলল, “এই লোকটা একজন সেকশন কমান্ডার।” তারা সম্মুখভাগের যোদ্ধাদলের সাহায্যকারী দল হিসেবে কাজ করত। প্রয়োজনে তারা মুহুর্তের মধ্যে আক্রমণে চলে যেতে পারে। মেজরের সাথে ইব্রাহিমও নিশ্চিত করল, জঙ্গীদের বেশিরভাগই মসুলের। ইব্রাহিম বলল, আইএস’র সদস্য হওয়ার কারনে তার সাথে কী কী ঘটেছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এমন সব বালক এবং বয়স্ক মানুষদের ভাগ্যে একই ঘটনা ঘটেছিল।

“আমি শিখেছিলাম কিভাবে হিংস্র হতে হয়। কিভাবে দয়ামায়া হীনভাবে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়। বন্দীদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হবে সেটা বিশেষভাবে শিখেছিলাম”। সে উল্লেখ করেছিল সহযোগী দলের সদস্যরা স্পার্টা যোদ্ধাদের মত জীবনযাপন করতো। এখানে শিক্ষা দেয়া হয়, তোমার নবীর মত সাদামাটা জীবনযাপন করতে। সে বলল, “একজন যোদ্ধার বেঁচে থাকার জন্য খুব জিনিসপত্রের দরকার নেই”। ইব্রাহিম এবং অন্যান্যদের সাথে পরিচয় হয়ে জানলাম, ছবিতে দেখা মৃত মানুষদের প্রায় সবার সাথেই আমি দেখা করেছি। ছবিতে দেখা সব মানুষদের চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া আইএস জঙ্গীরা যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করতো কিন্তু আসল খেলা তো আসলে অন্যত্র। মসুলের স্পেশাল ফোর্সের একজন সদস্য আমাকে বুঝিয়ে বললেন, “যখন আইএস এখানে আসে তখন জঙ্গীরা ছিল প্রায় সবাই শিশু এবং আমরা তাদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে গণ্য করিনি”।

মসুলের পুরনো শহরাঞ্চলে আসতে আইএস’র দেরীর কারনে আইএস’র চিন্তার থেকেও দ্রুত গতিতে ইরাকি বাহিনী মসুলের পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। আইএস’র সাহায্যকারী ক্ষুদ্র দলটি ধারনাও করতে পারেনি এত দ্রুত কাজটি ঘটতে পারে। আবু আলি এবং তার যোদ্ধাদল গোপন আস্তানায় লুকানো প্রমাণ ধ্বংস করার সময়ও পায়নি। তাদের কার্যক্রমের নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে গেল। খামারবাড়ির ঘরের মেঝেতে এক টুকরো লিখিত কাগজ পেলাম যেখানে লেখা আছে মসুলের কোথায় কোথায় আইএস’র কার্যক্রম পরিচালিত এবং সমন্বিত হবে।

গুগল ম্যাপের সাহায্যে আমি স্থানগুলোকে চিহ্নিত করলাম। একটা স্থানকে চিনতেও পারলাম—জায়গাটা ছিল আইএস’র গোলাবারুদের কারখানা এবং ২০১৬ সালের নভেম্বরে সেখানে আমি গিয়েছিলাম। ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীর ধারণা সমন্বয়ের অন্যান্য স্থানগুলো হলো গোলাবারুদের গুদামঘর এবং উৎপাদনকেন্দ্র।

প্রায় কয়েক ডজন মানুষ অস্ত্র কারখানায় নিখুঁতভাবে উৎপাদন করে মর্টার শেল। যৌথবাহিনীর যুদ্ধবিমানের দৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে তারা কারখানার ছাদে ফুটো করে তেল পুড়িয়ে আগুন জ্বালায়। এপ্রিলে আমরা গোলাবারুদের কারখানায় আবার গিয়েছিলাম। এতদিনে নিশ্চিত সেই কারখানায় উৎপাদিত গোলাবারুদ বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য খোলা বাজারে চলে এসেছে। কারখানার ছাদে যেখানে ফুটো করা হয়েছিল সেখানে পানির ট্যাংক বসানো হয়েছে এবং যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ছাদ সংস্কার করা হয়েছে।

নভেম্বরে মসুলের স্থানীয় মানুষ আইএস জঙ্গীরা অস্ত্র গোলাবারুদ বানিয়েছিল সেই কথা বলতে খুব উৎসুক ছিল। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এপ্রিলে এসেই সেই মানুষেরাই মুখে কুলুপ আটকে ছিল। কি একটা ভয় যেন মসুলের মানুষকে গ্রাস করেছিল। স্থানীয়রা আইএস থেকে মুক্তি পেলেও তারা বোধহয় ভেবে আইএস জঙ্গীরা তো খুব বেশি দূরে নয়। মসুলের আকাশে বাতাসে তখন প্রতিশোধের গন্ধ ভাসছে। তখন আমার জন্য বুঝতে সহজ হয়ে গেল আইএস’র সাহায্যকারী দলের অবস্থান খুঁজে পেতে কেন এবং কখন আমাকে শেষ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে। খামারবাড়িতে অনেক কাগজপত্র এবং প্রামাণ্য দলিলের মাঝে কিছু ধর্মীয় বইও খুঁজে পেলাম। ধর্মের বইগুলোতে পূর্ব মসুলের কোন এক মসজিদের স্ট্যাম্প দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। একটা বইতে একজন ইমামের নাম দেখতে পেলাম যিনি বইটি একজন তরুণকে উপহার দিয়েছেন।

আল মুমিনীন মসজিদটি গোলাবারুদের কারখানা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। খামারবাড়ির আইএস’র জঙ্গীরা এই মসজিদেই নামাজ পড়তো এবং স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনে চাপিয়ে দিয়েছিল সাক্ষাৎ নরক। মসজিদটি খুবই সাদামাটা, কোন চাকচিক্যের ছোঁয়া সেখানে নেই। বসন্তের খুব উজ্জ্বল একদিনে শিশুরা স্কুল থেকে তাদের বাড়িতে ফিরছে। কিন্তু মসজিদের ধাতব দরজায় কড়া নাড়ার সময় আমার মনে একটা ভয় কাজ করছে। এখানে কি জঙ্গীকে বই উপহার দেয়া সেই ইমাম এখনো আছে? মসজিদের প্রহরী আমাকে উত্তর দিলো এবং আমাকে মসজিদের ভিতরে নিয়ে গেল। প্রহরী একটা বালককে পাঠালো ইমামের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি জুতা খুলে অপেক্ষা করতে লাগলাম। উজ্জ্বল রোদে বসে আমি অপেক্ষা করছি। সেখানে চা খেলাম এবং মসজিদের বাইরে শিশুদের খেলাধুলার শব্দ শুনতে পেলাম। উপহার দেয়া বইতে স্বাক্ষর করা সেই ইমাম অনেক আগেই আইএস’র সাথে পালিয়ে গেছে। আইএস মসুল দখলের আগে যে লোক মসজিদে ইমামতি করতো প্রহরী তাকে ডাকলো। নতুন ইমাম সাহেব আসলো। তার নাম ফারেস ফাদেল ইব্রাহিম। চওড়া কাঁধ আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর লোকটি আমার অনুমানের থেকেও তরুণ। আমি তাকে জঙ্গীদের ছবি দেখালাম এবং সে প্রায় সবাইকেই চিনতে পারল।

ইমামকে এখন বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে এবং দ্রুতই আমি বুঝতে পারলাম তার বিচলনের কারন। ছবির দিকে তাকিয়ে সে বলল, দয়া করে আমার ছবি তুলবেন না। সে কেন আইএস জঙ্গীদের ভয় পায়? সে বলল, “জঙ্গীরা তার পুরো পরিবারকে এই বসতভিটা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে।” জঙ্গীদের প্রায় সবাই ইরাকের কিন্তু কিছু বিদেশি জঙ্গীও ছিল। সিরিয়া, মরক্কো বা অন্য কোন দেশের। এক বছরেরও অধিক সময় ধরে তারা এখানেই থাকতো কিন্তু ২০১৬ সালের নভেম্বরে যখন ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী মসুলের দিকে ধাবিত হয় তখন আইএস জঙ্গীরা পালিয়ে যায়। আগের ইমাম আইএস’র সাথে পালিয়ে যায়। সে ছিল একজন অস্থায়ী ইমাম। ধর্ম মন্ত্রণালয় হয়ত কিছুদিন পরেই তাকে স্থায়ী নিয়োগ দিতো। এটা নিশ্চিত যে এটাই পালিয়ে যাওয়া ইমাম। মসজিদটি ১৯৮০ সালে স্থাপিত হওয়ার পর তার বালক বয়স থেকে সে এই মসজিদে নামাজ কায়েম করেছে। আইএস আসার আগে সে স্থায়ী ইমামের সাথে মসজিদে আগত মুসল্লিদেরকে বয়ান করতো।

আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “স্থায়ী ইমামের কী হয়েছিল?” সে বলল, আইএস এসে ইমামকে হত্যা করে এবং তাকে তাদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই লোকটিই আইএস জঙ্গীদেরকে ধর্মীয় বই উপহার দিয়েছিল এবং সে আইএস জঙ্গীদেরকে প্রিয়পাত্র বলে সম্বোধন করত। মসজিদের নামাজপড়ার বড়ঘরের মেঝেতে কার্পেটের উপর বসে আমরা কথা বলছিলাম। ফারেস বলতে লাগল, মসুলে আইএস আগমনের পর স্থানীয় অধিবাসীদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল। তারা পুরো শহর তছনছ করে দিলো এবং সবচেয়ে খারাপ হলো, তারা বিশ্বের কাছে ইসলামকে হিংস্রভাবে উপস্থাপন করল। প্রথমদিকে আইএস স্থানীয়দের মানুষদের সাথে ভালো ব্যবহার করতো। স্থানীয়দের সম্মান এবং আস্থা অর্জন করার পরেই বেরিয়ে এলো তাদের আসল চেহারা ও উদ্দেশ্য। মসজিদ হয়ে গেল আইএস’র নিয়ন্ত্রণ এবং জঙ্গী নিয়োগ কেন্দ্র।

মোল্লা ফারেসকে দুটি সুযোগ দেয়া হয়। হয় আইএস এ যোগ দিতে হবে অথবা বাড়িতে থাকতে হবে এবং শুধু মাত্র তার এই প্রিয় মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য বাড়ির বাইরে আসতে পারবে। ফারেস বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আইএস মসুলে আসে বিশ্বাসের ভেক ধরে। মসুলের অধিবাসীরা সবাই ধর্মবিশ্বাসী। সুতরাং যে কেউ যদি ধর্মবিশ্বাসের কথা বলে যদি কেউ তাদের কাছে আসে তাহলে তাদের জন্য উদার আমন্ত্রণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো এক জিনিস আর সত্য হলো আলাদা।

আইএস তল্পিতল্পা প্রায় গুটিয়ে নিয়েছে। এমন সময় অন্যান্য ইমামদেরকে সালাফিজম অবজ্ঞা করার অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয়া হয়। যখন তাদের মুক্তি দেয়া হয় তখন মুচলেকা দেয় আর কখনো ইমামতি করবে না। আর আল-মুমিনীন মসজিদের ইমামকে হত্যা করা হয়। পিছন থেকে আইএস’র সাহায্যকারী দলের তরুণযুবাদের ছবি দেখে মোল্লা ফারেস কিছুক্ষণ দম নিলো যেন। তারপরে বলল, “যার হাতে বন্দুক, তার কাছে ক্ষমতা। এমনকি সে যদি ছোট বাচ্চা শিশু হয় তবুও। যেমন আইএস’র কিশোর জঙ্গীও এখানকার বয়স্ক এবং শক্তিশালী মানুষদের হত্যা করেছিল। আমাদের মসজিদের ইমামকে হত্যা করেছিল নিতান্ত একটা শিশু”।

একটু পরেই আসরের নামাজের সময় হবে এবং আমাদেরকে সাক্ষাৎকারপর্ব শেষ করতে হবে। অনেকগুলো উৎসুক শিশু কিশোর মসজিদের চারপাশে ভীড় করে আছে, তারা হুড়োহুড়ি করে মসজিদে ঢুকতে চায়। মোল্লা ফারেস সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করার আগে মসুলের দখলদার আইএস সম্পর্কে বলল, “তারা ইসলামের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেছে এবং এই কলঙ্কের দাগ ভবিষ্যতেও থেকে যাবে।” ফারেস ফাদেল ইব্রাহিম আবার বললেন, “ভাই, আমরা প্রকৃতিগতভাবেই ধর্মবিশ্বাসী, যুব বৃদ্ধ আমরা সবাই ইসলাম এবং মুসলিমদের ভালবাসি”। এমনকি আমাদের নবী মুহম্মদ যখন কোথাও যুদ্ধে যেতেন তখনও তিনি সাহবীদেরকে আদেশ দিতেন যেন কোন শিশু, নারী এবং বৃদ্ধদের হত্যা না করা হয়, কোন গাছ যেন না কাটা হয়। কিন্তু আইএস’র মাঝে কোথায় ইসলামের সেই আদর্শ আর মূল্যবোধ?”

এটা বলেই সে উঠে দাঁড়ালো এবং আযান দেয়া শুরু করল। বাইরে চকচকে রোদ। অপেক্ষায় থাকা শিশুরা হুড়মুড় করে মসজিদে ঢুকল এবং তাদের পড়ালেখা শুরু করল। টাইগ্রিস নদীর তীরে মরে পড়ে থাকা তিনজন জঙ্গী এই শিশুদের থেকেও ছোট। সত্যি বলতে এদের একজন তো রীতিমত বাচ্চা। ধ্বংসযজ্ঞ এবং ত্রাসের মাধ্যমে আতংক ছড়ানোর কাজে আইএস’কে সাহায্য করার জন্য ছোট দলের উৎসাহ উদ্দীপনা বিপুল। তারা নিজেরাই নিজেদের শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে এবং নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।

তারা কি একটু শান্তিমত মরতে পেরেছিল? আমি অবাক হয়ে গেলাম, তারা শুধু তাই করেছে যা তাদেরকে করতে বলা হয়েছে। তারা যোদ্ধা হিসেবে মরেছে কিন্তু বোকার মত মরেছে। তথাকথিত খেলাফতের প্রতি করুণা, যারা এই শিশু কিশোরদের সাথে একসাথে বসবাস করত, অথচ তাদেরকে হত্যা করেছে, তাদেরকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে এবং খেলাফতের নামে কোরবানি করে দিছে। আইএস মোল্লা ফারেসকে ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় মানুষদের কাছে গেল। তারা অধিবাসীদের বলল, “যেহেতু খেলাফতে তোমাদের কিছু যায় আসে না, সুতরাং মৃত্যুই তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।” কিন্তু সত্য উন্মোচিত হলো যখন আইএস স্থানীয় আধিবাসীদের বাড়ি গেল। তারা পরিবারের সবাইকে হত্যা করে বাড়িঘর ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। আইএস এবং সাহায্যকারী দলের কাছে মসুল বা মসুলের মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র দয়া মায়া ছিল না। অনেক যুবক আইএস এ যোগ দিতে চায় কিন্তু তাদের সাথেও আইএস ভয়ানক খারাপ আচরণ করে।

কুয়েন্টিনের পর্যবেক্ষণ:
আমি যখন মসুলে আইএস’র পদচারণা অনুসন্ধান করছি, তখন একটা বিষয় আমার মনে খুব দাগ কেটে যাচ্ছে, সেটা হলো আইএস এ যোগ দেয়া প্রায় সব জঙ্গীই মুলত বয়সে সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক। আশ্চর্য! আমরা প্রায় সবার সাথেই কথা বলতে পেরেছিলাম। ১৫ বছরের উপর যে কেউ আইএস এ যোগ দিতে পারে কিন্তু তাদের কিছু যোদ্ধার বয়স আরো কম। মসুলে আইএস’র সমর্থক ছিল। শিশু, কিশোর, তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলে আইএস’র জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শ করে। আইএস’র ঘৃণ্য ক্ষমতাকেন্দ্রিক খেলাফতের বলি অস্ত্র হাতে এইসব কোমলমতি নিষ্পাপ শিশু-কিশোর। মসুলে যখন আইএস হেরে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে তখন আইএস জঙ্গীদের মৃতদেহ সেখানে সেখানে পড়ে থাকত। টাইগ্রিস নদীর ধারের সেই লাশগুলো আর নেই। কুকুর ও অন্যান্য মৃতভোজী প্রাণীরা তাদের টেনে নিয়ে গেছে। সেইসব যুবকদের কোন হদিস আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তাদের বিশৃঙ্খলা আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখনো মসুলজুড়ে বিদ্যমান। তার ফলাফল মসুল ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেছে এবং পেরিয়ে গেছে টাইগ্রিস নদীর প্রবাহ।