ওয়াহাবিজমের প্রাথমিক পাঠ-পর্ব ১

ওয়াহাবিজমের প্রচার ও প্রসার-পর্ব ২

সৌদি আরব; বিশ্বের সন্ত্রাসবাদ রফতানির একমাত্র উৎস: নিশ্চিতভাবেই আইএস একটা ইসলামী আন্দোলন, এটা নতুন কোন মতবাদ নয়, নয় কিছু গতানুগতিক নতুন ভাবধারা বা আইএস’র উৎস খুঁজতে সুদূর কোন অতীতে যাওয়া লাগবে না। আইএস’র শিকড় প্রোথিত আছে ওয়াহাবিজমের মাটিতে যার শুরু হয়েছে ১৭ শতকে আর ব্যাপকতা পেয়েছে সৌদি আরবে তেলের খনি আবিষ্কারের পরে। তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গত শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানদের প্রতিষ্ঠিত জাতিরাষ্ট্রের ধারণা প্রায় ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আইএস ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে নৃশংসতা এবং হিংস্রতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে যা আসলে ইসলামের জন্ম এবং প্রচার ও প্রসারকালীন সময় থেকেই অন্তর্নিহিত ছিল। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকেই আরব উপদ্বীপাঞ্চলে নতুন করে রক্ষণশীলতার চর্চা শুরু হয়। ইরাকে মার্কিন সেনা বাহিনীর হামলা ও স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর মনে হয়েছিল ইরাকে বুঝি জাতি-ভিত্তিক একটা আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হতে যাচ্ছে কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতায় বিশ্বের প্রত্যাশানুযায়ী দেশটি পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, আধুনিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। পরিবর্তে সেখানে জন্ম নিলো আইএস’র মত উগ্রপন্থী ধর্মীয় জিহাদি সংগঠন যারা অদ্ভুত জাদুবলে আধুনিকতাকে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মুহূর্তে ইরাক-জুড়ে বর্বরতা প্রসারিত হয়ে গেল। আইএস একের পর এক প্রকাশ করতে লাগল হিংস্র, বর্বর, ঘৃণ্য সব ভিডিও যেখানে দেখা যায় জিম্মিদের জবাই করে শিরশ্ছেদের দৃশ্য। জিম্মিদের মধ্যে দেখতে পাই ইউরোপিয়ান, আমেরিকান রিলিফ কর্মী, সাংবাদিক, এমনকি আটককৃত সিরিয়ান সৈন্য। সারি সারি কাটা মাথা ঝুলিয়ে তারা হত্যার উৎসব উদযাপন করছে। কত কত অভিনব উপায়ে মানুষ খুন করা যায় তার যেন মঞ্চায়ন চলতে লাগল আইএস নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া, ইরাকের মঞ্চে। মাথার পিছনে একে-৪৭ ঠেকিয়ে গুলি, জবাই করে হত্যা খুবই নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো, মানুষকে খাঁচায় ভরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মত ভিডিও প্রকাশ পেতে লাগল। এসব ক্রমাগত বর্বরতা প্রমাণ করে ইসলাম আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে কত ব্যর্থ!

২০১৩ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ওয়াহাবিজমকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে। যদিও সৌদি আরবের প্রধান মুফতি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য আইএসকে অভিযুক্ত করে আসছেন। প্রধান মুফতি ক্রমাগত বয়ান করছেন ইসলাম কখনো উগ্রপন্থা, অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না। অন্যদিকে সৌদি আরবের শাসক গোষ্ঠী ইসলামের শিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে যোগ্য প্রতিরোধ এবং সালাফি ঘেঁষা ধর্মচর্চার কারণে আইএসকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। মুসলিমদের বহু-বিভক্ত ইসলাম-চর্চা রোধ করতেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে ওয়াহাবিজমের মত বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চা। তারই ফলশ্রুতিতে ওয়াহাবিজম হয়ে উঠল উগ্রপন্থী যেখানে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না।

১৮ শতকে আরব উপদ্বীপাঞ্চলে মুসলিম রাজন্যবর্গ ক্ষমতা হারাতে শুরু করলে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ইসলামকে নবজাগরণের কাজে ব্যবহার করে। পশ্চিমে যখন রাজ্য থেকে চার্চকে আলাদা করা হয়ে গেছে, ঠিক তখন আরব পেনিনসুলায় ধর্মীয় নিরপেক্ষতাকে ধূলিসাৎ করে ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে ধর্মগ্রস্ততা। যার ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বব্যাপী বিকাশ লাভ করেছে ধর্ম ভিত্তিক অর্থনীতি এবং বিভক্তি। কোন সংস্কৃতিই মনে করে না ধর্ম গোপন কোন আচরিত সংস্কার। ইসলাম পার্থিব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে অথচ কি সীমাহীন বৈপরীত্য! রাজনীতি চর্চা ইসলামের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। ইসলাম যতটা না ধর্ম, তার থেকে বেশি রাজনীতি এবং তার থেকেও বেশি সাম্রাজ্যবাদ। কারণ কোরআন মুসলিমদের উপর পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে মুসলিম উম্মাহর আর্থিক এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি মুসলিমের ইমানি দায়িত্ব। ওয়াহাবিজম মনে করে দরিদ্র মানুষ যদি শোষণের হাত থেকে বাঁচতে চায়, দুর্বল যদি বঞ্চনা থেকে রেহাই পেতে চায় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে একমাত্র বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চায় পারে মুসলিমদের সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে। সুতরাং ওয়াহাবিজমের তাত্ত্বিক গুরুরা মুসলিমদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে হারানো ক্ষমতা এবং সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হলে মুসলিমদের ইসলামের উৎস-মূলে ফিরে যেতে হবে। এই দুনিয়ার সাময়িক বস্তুবাদী চিন্তা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে সর্বত্র আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রত্যেক মুসলিমকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাদের জানমাল যা আছে সব ইসলামের জন্য ব্যয় করতে হবে। মুসলিমদের বোঝানো হল সমাজ পুনর্গঠনের জন্য ইসলামের তৃণমূলে ফিরে যাওয়া মৌলবাদী জিহাদ কোনক্রমেই জঙ্গিবাদ নয়।

১৭০৩ সালে সৌদি আরবের নাজদ শহরে জন্ম নেয়া ইসলামী চিন্তাবিদ মুহম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাবের চিন্তা ধারায় বিকশিত ওয়াহাবিজম এখন বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের প্রধান অনুপ্রেরণা। ওয়াহাবিজম তৎকালীন সময়ের ইসলামে জনপ্রিয় সুফিবাদ এবং মাজারকেন্দ্রিক ইসলাম চর্চার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, মাজারকেন্দ্রীকতা ইসলামে দেবত্ব আরোপ করে যা মারাত্মক কুফরি এবং আল্লাহর সাথে শিরক করার মত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তিনি প্রত্যেক মুসলিম নর নারীদেরকে একমাত্র কোরআন-হাদিস পঠন পাঠনে মনোনিবেশ করতে বলেন এবং নবী মুহম্মদ ও তার সাহাবীদের সুন্নাহ চর্চার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ওয়াহাব নবী মুহম্মদের সময়ে আচরিত ইসলামে ফিরে যেতে চাইলেন এবং ইসলাম প্রচারের মধ্যযুগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণকে খারিজ করে দিলেন। তার এক ফতোয়ায় সুফিজম, শিয়া মুসলিমদের ইসলাম চর্চা বিদআত হয়ে গেল এবং বাতিল হয়ে গেল শতাব্দীব্যাপ্ত লিখিত এইসব ইসলামী ওলামাদের ইসলামী কিতাব।

স্বাভাবিকভাবেই ওয়াহাবের ফতোয়ায় তৎকালীন ধর্মবেত্তা এবং স্থানীয় শাসকগণ বিরাট হুমকির মুখে পড়ে গেলেন। কারণ তারা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন ধর্মের এই নবজাগরণে বাধা দিলে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি হবে এবং জাগরণের ঢেউয়ে তারা ভেসে যাবেন। ওয়াহাবিজম প্রচারে, আবদ আল-ওয়াহাব সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেলেন সৌদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ ইবনে সৌদকে। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি ওয়াহাবের মতবাদকে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সিঁড়ি হিসেবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই তাদের মাঝে বিভেদ দেখা দিলো কারণ আবদ আল-ওয়াহাব ইবনে সৌদের ক্ষমতা দখল, দস্যুবৃত্তি এবং রাজ্যের পরিধি বাড়ানোর জন্য জিহাদে নামে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করাকে সমর্থন করলেন না। ওয়াহাব বললেন, ব্যক্তিগত লাভের জন্য জিহাদ পরিচালনা করা যাবে না। তবে মুসলিম উম্মাহ সামরিকভাবে আক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে তিনি জিহাদ অনুমোদন করবেন। তিনি আরবের সংস্কৃতি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের হত্যা নিষিদ্ধ করলেন। নির্বিচারে জনসম্পদ ধ্বংস এবং বেসামরিক জনগণ, নারী এবং শিশুদের হত্যা নিষিদ্ধ করলেন। জিহাদের ময়দানে মারা গেলে বেহেশতে উচ্চ আসনে আসীন হবে এমন নিশ্চয়তাও তিনি দেননি। কারণ এমন লোভী চিন্তার সাথে জিহাদ কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। এভাবেই দুইটা ওয়াহাবিজমের জন্ম শুরু। ওয়াহাবিজম দিয়ে ইবনে সৌদ তরবারির সাহায্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ইসলামকে ব্যবহার শুরু করলেন আর ওয়াহাবের শিক্ষা ও দর্শনকে এক আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য আইন এবং ধর্মদ্বারা জায়েজ করে নিলেন।

যদিও ওয়াহাবের মতবাদ ইসলামের ধর্মীয় ঐশী-বাণীকে ঘিরেই আবর্তিত এবং তিনি জোর-দাবী করতে লাগলেন তার প্রচারিত ইসলামই একমাত্র সঠিক এবং সত্যপথ। ঠিক তখনি ওয়াহাব কোরআনের অন্তর্নিহিত বার্তাকে অপব্যখ্যা করে ফেললেন। কোরআন (২;২৫৬) আয়াতে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছে, “মানুষের বিশ্বাসের উপর জোর করো না। মুসলিমদেরকে অবশ্যই সকল নবীর উপর নাজিল হওয়া ঐশী-বাণীকে বিশ্বাস করতে হবে (৩;৮৪) এবং বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চয়ই আল্লাহর ইচ্ছা (৫;৪৮)”। সুতরাং এখানে আমরা দেখতে পাই কোরআনের ভাষ্য মেনে নিলে বহু-বিভক্ত ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওয়াহাবিজমের তাকফির অনুযায়ী এক মুসলিম আর এক মুসলিমকে অনায়াসে কাফের বলে ফেলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সুফিবাদের মাধ্যমে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে। সুফিবাদ মুসলিমদের সামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করলেও ওয়াহাবিজমের খারিজী নিয়মের কারণে সুফিবাদ সমর্থনকারী মুসলিমগণ কাফের হয়ে যাচ্ছেন। সুফি দার্শনিক ইবনে আল-আরাবি বলেন, “তোমার নিজের ঈশ্বর বিশ্বাসকে এমনভাবে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করো না যাতে অন্য ধর্মবিশ্বাসের উপর তোমার বিদ্বেষ চলে আসে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তিনি কোন বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারেন না।” একজন মরমী মানুষ নিজেকে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম বা অন্য বিশেষ ধর্মের অনুসারী বলে স্বীকার করেন না, কারণ যিনি একবার মর্মের সন্ধান পেয়েছেন তিনি মানুষের বানানো বিভেদের দেয়াল অতিক্রম করে সর্বজনীন মানবতায় পৌঁছে যান।

ভিন্ন ধারার ইসলামকে অস্বীকার করলেও ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব কোন মুসলিমকে কাফের হিসেবে চিহ্নিত করতেন না, কারণ তিনি বলতেন, একমাত্র আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন একজন মানুষের রুহু’র সত্য দর্শন কী। ওয়াহাবের মৃত্যুর পর তার মতবাদ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। কোরআনের ভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানের মত উদার নীতির বিপক্ষে গড়ে উঠল ভয়ানক রাজনৈতিক পাশাখেলা। কোরআনের অপেক্ষাকৃত উগ্র আয়াতগুলো বেশি বেশি ব্যাখ্যা শুরু হল। সুফিবাদ, শিয়া, কাদিয়ানী, আহমাদিয়া ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে ওয়াহাবিজম হয়ে উঠল ইবনে সৌদের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূলমন্ত্র। ওয়াহাবিজম ব্যবহার করে ইবনে সৌদের ছেলে আবদ আল-আজিজ ইবনে মুহম্মদ বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চার জন্য রাজ্য গঠন করলেন। ইসলাম চর্চায় বাধাদানকারীর অভিযোগ তুলে, তাকফির আখ্যা দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে পাইকারি হারে শিরশ্ছেদ করতে লাগলেন। নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা দিয়ে আবদ আল-আজিজ ১৮০১ সালে ইরাকের কারবালা শহর দখল করে নেন, ধুলোয় মিশিয়ে দেন ইমাম হোসেনের মাজার, লুট করেন মাজারের সমুদয় সম্পত্তি, জবাই করে হত্যা করেন হাজার হাজার শিয়া মুসলিম। হত্যার বীভৎসতা থেকে বাদ গেল না নারী, শিশু এমনকি বয়োবৃদ্ধ। ১৮০৩ সালে ভয়ে এবং আতংকে মক্কা নগরী এই সৌদি নেতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৮১৫ সালে অটোমান সম্রাট মিশরের শাসক মুহম্মদ আলী পাশাকে বাদশাহ আবদ আল আজিজের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আলী পাশা ওয়াহাবি শক্তিকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করেন এবং তাদের রাজধানী দখল করে নেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়াহাবিরা ‘ইখওয়ান’ বেদুঈন যোদ্ধাদের সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল অঞ্চল দখল করে আবার রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেই সময় ওয়াহাবি আবদ আল-আজিজ ইখওয়ান যোদ্ধাদেরকে ‘মুসলিম ভ্রাতৃত্ব’ সম্মানে ভূষিত করেন।

ইখওয়ান বেদুঈন গোত্রের ভিতরে পোতা আছে আইএস শিকড়ের প্রাণ ভোমরা। ইখওয়ান সম্প্রদায় ছিল চিরভবঘুরে এবং যাযাবর এবং ইসলামের গোঁড়া অনুসারী। ইখওয়ান সম্প্রদায়কে দুর্বল করতে ওয়াহাবি ধর্মগুরুগণ এই বেদুঈনদেরকে মরুভূমিতে স্থায়ী আবাস গড়ে দিলেন যাতে সেখানে তারা চাষাবাদ করতে পারে এবং পরিয়ে দিলেন ওয়াহাবি দাসত্ব শৃঙ্খল। ওয়াহাবি চিন্তাধারায় গড়ে উঠল তাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি। এই উগ্র ওয়াহাবিজমের সংস্পর্শে বেদুঈনরা দিনে দিনে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠল। মাঝে মাঝেই তারা প্রতিবেশী জনপদে জিহাদের নামে অতর্কিত হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষের জানমাল, গবাদিপশু লুটপাট করে নিয়ে যেত। নিরস্ত্র গ্রামবাসী, বা ইসলাম ত্যাগী অথবা ওয়াহাবি মতাদর্শ মানে না এমন হাজার নারী শিশুদের উপর নিয়মিত নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাত আর বন্দী পুরুষদেরকে জবাই করে হত্যা করত। ইউরোপিয়ান এবং অনারব কারো সাথে যুদ্ধ করার সময় তারা নিজেদের মুখ ঢেকে বর্শা এবং বল্লম ব্যবহার করত। যেহেতু নবী মুহম্মদ আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করতেন না তাই ইখওয়ান বেদুঈনরাও যুদ্ধে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত না।

১৯১৫ সালে আবদ আল-আজিজ সৌদি আরবের পশ্চিমে বর্তমানে মক্কা ও মদিনা অঞ্চলে অবস্থিত হিজাজ, ইরান সাগরের উপকূল থেকে নাজদ, এবং সিরিয়া এবং জর্ডানের উত্তরাংশ দখল করার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু ১৯২০ সালে তার দখল পরিকল্পনা থেকে কিছুটা সরে আসলেন। এই সময়ে আবদ আল-আজিজ ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে আরব পেনিনসুলায় জাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু এরমধ্যে ইখওয়ান গোত্র ইরাক, জর্ডান এবং কুয়েতে পর্যটনে আসা বিদেশীদের শয়তান আখ্যা দিয়ে হত্যা অব্যাহত রাখল এবং পচার করে দিলো জিহাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা চলবে না। আধুনিক যুগের সবকিছুই বিদাত কারণ যা কিছু নবী মুহম্মদ ব্যবহার করেন নাই মুসলিমদের সেগুলো ব্যবহার করা নাজায়েজ। ঠিক সেই কারণে সৌদি আরবে টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, গাড়ি, গান, ধূমপান ইত্যাদি অনুমোদন করার দায়ে ইখওয়ান গোত্র সৌদি বাদশাহর বাহিনীকেও আক্রমণ করে বসে। পাল্টা জবাবে আবদ আল-আজিজ ব্রিটিশ সৈনিকদের সাহায্য নিয়ে ১৯৩০ সালে ইখওয়ান গোত্রকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন।

ইখওয়ান গোত্রকে দমন করে বাদশাহ আজিজ সৌদি থেকে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল করলেও পুষে রাখলেন ধর্মীয় উগ্রবাদ। তিনি ওয়াহাবিজমকে নবায়ন এবং ওয়াহাবিজমের মৌলবিশ্বাস তাকফির পুনঃ-প্রতিষ্ঠা করলেন। সৌদি সাম্রাজ্যের হাত ধরে বেড়ে উঠতে লাগল উগ্রতা এবং পরমতে অসহিষ্ণুতা। ওয়াহাবিজমের তাকফিরি নিয়মানুসারে ইসলামের মৌলিক প্রশ্নে কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই সে হয়ে গেল কাফের। কিন্তু ইখওয়ান গোত্রের আচরিত ইসলামী বিশ্বাস, চেতনা এবং ভৌগলিক সীমারেখা বৃদ্ধির স্বপ্ন মরেনি, বরং ৭০’র দশকে সৌদি রাজপরিবারে যখন আরও বেশি পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং আধুনিকতা কেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গৃহীত হল তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বিদ্রোহী গোত্র। তারা মনে করত পশ্চিমের সংস্কৃতি চর্চার ফলে ইসলাম রসাতলে চলে যাচ্ছে। এদিকে মিশরের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের এইসময়ে সোভিয়েত প্রভাবে আরবাঞ্চলে বিস্তার ঘটাচ্ছেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শ যেটা পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কপালে ফেলে দিয়েছে দুশ্চিন্তার বলি রেখা। আর সৌদির জনগণ মনে করে সমাজতন্ত্র হল আল্লাহর বিপরীতে শয়তানি কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে ইরানের বিপ্লবের পরে শিয়া মুসলিমের উত্থান সৌদি সুন্নি-ওয়াহাবি মুসলিমদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। ফলশ্রুতিতে সমাজতন্ত্র এবং শিয়া উত্থান ঠেকাতে সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে তৈরি হল মৈত্রী-বন্ধন। সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা রোধ করতে দরকার হয়ে গেল ধর্মের আফিম, সেটা উগ্রপন্থা হলে আরও ভালো হয়।

১৯৭৩ সালে আরবাঞ্চলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে সামরিক সাহায্য করার অভিযোগে সৌদি আরব তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়। তেল বেচা বাড়তি টাকা দিয়ে সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার কাজে ব্যয় করা শুরু করে। পুরনো শক্তি প্রয়োগে জিহাদের বদলে সামনে এলো ধর্মীয় বিশ্বাসের মোড়কে উগ্রপন্থী জিহাদি সাংস্কৃতিক চর্চা। সৌদি ভিত্তিক মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে তাদের শাখা অফিস স্থাপন করল। কোরআনের ওয়াহাবি ব্যাখ্যা ছাপিয়ে সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয় দেশে দেশে ছড়িয়ে দিতে লাগল ধর্মীয় উগ্রপন্থা। ওয়াহবি ভাবধারার কোরআনের তাফসীর ও তর্জমা করলেন পাকিস্তানের সৈয়দ আবদুল আ’লা মওদুদী এবং মাওলানা কুতুব। সারাবিশ্ব অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে গেল ওয়াহাবি কোরআন। এইসব দেশে সৌদি অর্থায়নে মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যের আদলে নির্মিত হতে লাগল মসজিদ, মসজিদে নিয়োগ পেল ওয়াহাবি ইমাম। তারা উগ্রপন্থী ওয়াহাবিজমের বয়ান প্রচার করতে লাগলেন প্রতি জুমাবারের খুৎবায়। কিভাবে বিধর্মীর সাথে কথা বলতে হবে, কিভাবে বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চা করতে হবে এমনকি কিভাবে ইসলাম কায়েম করতে হবে। দিকে দিকে স্থাপিত মাদ্রাসায় ওয়াহাবি কারিকুলামে গরিব শিশুরা বিনামূল্যে শিক্ষা পেতে লাগল। অন্যদিকে গরিব মুসলিমদেশের বেকার যুবকদের চাকরি হল মধ্যপ্রাচ্যে। এইসব যুবক চাকরি শেষে দেশে ফিরে এলেন সাথে নিয়ে ওয়াহাবিজমের ইসলাম। এখন তাদের বাড়ির পাশে সৌদি অর্থায়নের সুদৃশ্য মসজিদ, মাথার উপরে ফ্যান, সুন্দর ওজুখানা। ততদিনে মেয়েদের শরীর মুড়ে গেছে বোরখায় অথবা হিজাবে, মেয়েদের জন্য আলাদা হয়ে গেছে স্কুল থেকে শুরু করে শপিং-মল পর্যন্ত। এত বিনিয়োগ অথবা দানের বিনিময়ে সৌদি চায় শুধু বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চার নিশ্চয়তা। ওয়াহাবিজম অন্য সব ধর্মের সহাবস্থান নাকচ করে দিলো। এমনকি বাতিল হয়ে ইসলামের অন্যান্য শাখা। বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসের বিষ-বাষ্প বিষাক্ত নিশ্বাসের মত সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে জুড়ে বসল। ওয়াহাবিজমের হিংসার ঝর্ণাধারা সাপের মত কিলবিল করছে এখন ইউরোপে, যুক্তরাষ্ট্রে, পাকিস্তানে, জর্ডানে, সিরিয়াতে সর্বত্র। মূলধারার ইসলামকে হারিয়ে ইসলামী চালকের আসনে বসে আছে এখন ওয়াহাবিজম।

নতুন প্রজন্মের মুসলিম বেড়ে উঠল ইসলামের ছদ্মবেশে উন্মাদ ওয়াহাবিজমের জিহাদি জোশে। তারা শিখল অন্য ধর্মকে হিংসা করতে, বিধর্মীরা কাফের, তাদের হত্যা করলে কোন গুনাহ হয় না এবং তাদের উপর অর্পিত হয়ে গেল সর্বত্র ইসলাম কায়েম করার মহান এবং পবিত্র দায়িত্ব। ওয়াহাবি ইসলাম খারিজ করে দিলো আগের ইসলামী পণ্ডিতদের ধর্মশিক্ষা। কোরআনের নতুন ব্যাখ্যা উগ্রবাদের শিক্ষা দিলো। শিক্ষা দিলো যেকোনভাবে ইসলাম কায়েম করতে হবে। নতুন নতুন সুদৃশ্য মসজিদে নামাজ পড়ে, মাদ্রাসায় ধর্ম শিক্ষা লাভ করলেও মুসলিম দেশগুলোতে দুর্নীতি কমার কোন লক্ষ্মণ নাই, মানুষের দারিদ্র কমে না, ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন জোটে না। বেশীরভাগ মুসলিম দেশেই চলে একনায়কতন্ত্র, ছদ্মবেশে স্বৈরতন্ত্র, কোথাও একচ্ছত্র রাজতন্ত্র। মানুষের বাক স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। অত্যাচারী শাসক আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মুসলিম মারা গেলে সৌদি বিশ্ব-দরবারে প্রচার করে বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার। সৌদি আরবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে তারা দেখতে লাগল ফিলিস্তিনি বা লেবাননের মুসলিমদের দুর্দশা। মাদ্রাসায় পড়ুয়া কিশোর যুবকদের সরকার থেকে উৎসাহিত করা হয় আফগান জিহাদিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। সেই সেদিনের আফগান যোদ্ধাদের মুসলিম উম্মাহ এবং ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই ইউরোপ থেকে উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক প্রযুক্তি-জ্ঞান সম্পন্ন যুবক সিরিয়া এবং ইরাকের জিহাদে অংশ নিচ্ছে।

একটা জরিপে দেখা যাচ্ছে যেসমস্ত সৌদি যুবক স্বেচ্ছাসেবী হয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল তারাই বসনিয়া, চেচনিয়াতে যুদ্ধে গেছে। এই স্বেচ্ছাসেবীরা পাকিস্তানের প্রাক্তন সামরিকদের অফিসারদের সাহায্যে আল-কায়েদা ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছে। জরিপে আরও দেখা যায়, শুধু পশ্চিমা এবং বিধর্মীদের প্রতি হিংসা থেকে নয়, অত্যাচারিত মুসলিম ভাই বোনদের সাহায্য করার জন্য তারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, একইভাবে ১৯৩৮ সালে পুরো ইউরোপের মানুষ জড়ো হয়েছিল স্পেনের ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে। আবার ১৯৬৭ সালে আরবের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের ৬ দিনের যুদ্ধে সারা পৃথিবী থেকে ইহুদিরা দলবেঁধে ছুটে গিয়েছিল ইজরায়েলকে সাহায্য করতে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। বিদায় হজ্বের ভাষণ অনুসারে সকল দেশের সকল মুসলিম ধর্মভাই। সুতরাং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো মুসলিম আক্রান্ত হলে সেটা ইসলামের ধর্মীয় অস্তিত্ব সংকট। কেউ কেউ বর্ণনা করেন, সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর দুর্দশা দেখেই নাকি বিন লাদেনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সাহসী যুবকগণ যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

ইখওয়ান নতুন রূপে ফিরে এসেছে বর্তমানের আইএস রূপে। আইএসের ধারালো তলোয়ার, কালো পতাকা, ঢাকা মুখ আর জবাই করে হত্যা মনে করিয়ে দেয় ইখওয়ানের প্রাক্তন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ চেহারা। কিন্তু বর্তমানের আইএস জিহাদিরা অনেক বেশি মরিয়া। তারা মরতে প্রস্তুত, নিশ্চিত মৃত্যু তারা জানে এবং তারা হাসি খুশি। অবাক ব্যাপার! অবাক বিশ্বাস!! মৃত্যুর আগেও বলছে আমরা বেহেশতে যাচ্ছি। ঠিক এই কারণেই নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আইএস’র যুদ্ধে অনেক সাফল্য। ওয়াহাবিজম বলছে জিহাদের ময়দানে যোদ্ধাদের ধর্মের সব আচরণ পালন করার দরকার নেই। বাস্তবেও দেখতে পাই, ইসলামের জন্য যুদ্ধরত বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা তাদের ধর্ম পালন করে না। অনেকের ধর্ম সম্পর্ক পর্যাপ্ত শিক্ষা পর্যন্ত নেই। ওয়াহাবি ইসলামে ধর্মান্তরিত নওমুসলিম আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ওয়াহাবি কোরআনের ব্যাখ্যা পড়ে কেউ দেখতে পারে ধর্মের বইতে লেখা আছে বিধর্মীদের হত্যা করতে হবে, তখন তার মনে উচিৎ অনুচিত বোধ লুপ্ত হয়ে যায়। সে অন্ধ পতঙ্গের মত জ্বলন্ত আগুনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, অথবা বিধর্মী খুন করতে চায়। কারণ এই মানুষ খুনে কোন অপরাধ হয় না, এখানে পাপের কোন বালাই নাই। কারণ আল্লাহ স্বয়ং ইসলাম কায়েমের জন্য খুন অনুমোদন করেছেন। তখন বিধর্মী খুনেই তার সুখ। কানাডিয়ান পার্লামেন্টে হামলাকারী ছিল একজন ধর্মান্তরিত নওমুসলিম। তার কাছে ওয়াহাবিজমের বই পাওয়া গিয়েছিল। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের বারমিংহামের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে সিরিয়াতে জিহাদের উদ্দেশ্যে আইএস এ যোগ দিতে রওনা হওয়া দুজন যুবক অ্যামাজন ডট কমে ওয়াহাবি বইয়ের অর্ডার করেছিল।

ব্রিটিশ দার্শনিক জন গ্রে বলছেন, আইএসকে শুধু সালাফি বললে হয়ত কিছু ভুল হয়ে যাবে। কারণ বর্তমানের আইএস অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, তারা দুনিয়ার লাভ ক্ষতির বিষয়ে সচেতন। প্রযুক্তি দক্ষতা সম্পন্ন, নিজস্ব অর্থায়নে ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ মিলিয়ে আইএসের সম্পদের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার। মনে করা হয় আইএস সবথেকে ধনী সন্ত্রাসী সংগঠন। ইখওয়ান গোত্রের সাথে আইএসের হুবহু মিলে যায়। দখলকৃত অঞ্চল লুটকরে, ব্যাংক ডাকাতি করে, ব্যাংকের স্ট্রংরুমের ভল্ট ভাঙা স্বর্ণ সংগ্রহ করে, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে, খনির তেল বেচে আইএস ইতিমধ্যে পৃথিবীর সেরা ধনী জিহাদি গ্রুপে পরিণত হয়েছে। আইএস’র হিংস্রতা, নৃশংসতার কোন তুলনা নেই। জবাই করার ভিডিও খুব কৌশলে এবং পেশাদারিভাবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয় যাতে মানুষের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের মাঝে বীভৎসতার বীজ বুনে দেয়া যায়। পরিকল্পিত গণহত্যা মানুষের মনে ভয় সৃষ্টির ধারণা খুব পুরনো কৌশল। আধুনিক যুগেও গণহত্যার খবর বিরল নয়। ইউরোপের প্রথম বস্তবাদি দেশ ফ্রান্স প্রতিষ্ঠার সময়ে ফ্রেঞ্চ বিপ্লবে ১৭০০০ হাজার নর, নারী, শিশুকে প্রকাশ্যে গিলোটিনে গলা কেটে হত্যা করা হয়। আইএস ঠিক একইভাবে জনমনে আতংক সৃষ্টির লক্ষ্যে নৃশংসাবে মানুষ হত্যা করছে। তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এমন ভয়ানক জবাই করে ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নাই। ১৯২২ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাশা ক্ষমতায় এসেই তুরস্কের জাতিগত শুদ্ধতার জন্য তুরস্ক থেকে গ্রীক-ভাষী খ্রিস্টানদেরকে বিতাড়িত করেন। ১৯২৫ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাশা খেলাফতকে অকার্যকর ঘোষণা করেন। আর আইএস সেই বাতি্লকৃত খেলাফতকে পুনঃ-প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। খেলাফত বহুকাল ধরেই রাজনীতিতে একটা বাতিল ইস্যু। কিন্তু যেহেতু খেলাফত মুসলিম উম্মাহর ঐক্যতার প্রতীক এবং নবী মুহম্মদের সময়ের রাজনৈতিক চর্চা তাই আইএস আবার খেলাফত ফিরিয়ে আনতে চায়। সুন্নি মুসলিমদেরকে প্রায়ই তাদের হারানো ঐতিহ্যর জন্য হাহাকার করতে দেখা যায়। যদিও আইএসের দাবীকৃত খেলাফতে বিশ্বব্যাপী মুসলিম ধর্ম পণ্ডিতদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। অনেকেই এখন আর খেলাফতকে সমর্থন করেন না বরং ধর্মীয় বিভ্রান্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের উপজাত হিসেবে জন্ম নেয় উদার এবং গণতান্ত্রিক জাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। শিল্পোন্নয়নের সাথে গড়ে ওঠে আলোকিত সময় যেটা কোন মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হয়নি, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ হয়েছে ইতিবাচকভাবে। সভ্যতার দুর্বলতম দিক হল, বৃহত্তম জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সহ্য করতে পারে না, ঠিক যেমন বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে। বিংশ শতাব্দীর সব বড় বড় গণহত্যার জন্য সভ্যতার সংঘর্ষ দায়ী। ইউরোপ আমেরিকায় আধুনিকতা, সভ্যতা প্রচার ও প্রসার হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাত ধরে আর পৃথিবীর অন্য-প্রান্তে সভ্যতা এসেছে হয়ত ভিন্ন-ধারায়, ইউরোপের কাছ থেকে ধার করে। আধুনিকতার জাদুর কাঠির স্পর্শে উদার দেশের জন্ম হয়ে যাবে এমনটা চিন্তা করা মারাত্মক ভুল। আগ্রাসন, দমন এবং দখলদারিত্ব বজায় রেখে উপনিবেশিক কায়দায় ইরাকে গণতন্ত্রের চর্চা করতে গিয়ে সেখানে জন্ম হয়েছে পুতুল সরকার। এই বিশৃঙ্খলার ফাঁক দিয়েই বেড়ে উঠেছে আইএস। এমনকি সাদ্দামের নিয়মিত সেনাবাহিনীর অধিকাংশ এখন আইএস বাহিনীর নিয়মিত জিহাদি যোদ্ধা।

আইএস হয়ত ক্ষমতায় নিজেকে ছাড়িয়ে যাবে, তারপরেও আইএসের উদ্দেশ্য এবং নীতিমালা সফল হবে না কারণ এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে শিয়া সুন্নি দুইদিক থেকেই গড়ে উঠবে প্রতিরোধ। ধর্মের উগ্রতা ফ্রাংকেনস্টাইনের মত। শুরু করা যায় কিন্তু শেষ করা সহজ নয়। সৌদি আরব এবং পশ্চিমামিত্র নিজেরাই এখন আইএস’র হামলার হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও হামলা হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে নিরীহ মানুষ। এই অঞ্চলে সৌদি আরবেরই একমাত্র আরবের আইএস দমন করার মত সামরিক ক্ষমতা আছে। আমাদের বুঝতে হবে বর্তমানের আইএস সংঘর্ষে ওয়াহাবিজম ইসলামকে ব্যবহার করছে, আর ওয়াহাবিজমের জন্ম এবং বিকাশ সেই সৌদি আরবে। এখানে খেলা করে সৌদি আরবের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সুতরাং আমাদের বুঝতে হবে ওয়াহবিজম শুধু সালাফ বা পূর্ব প্রজন্মের ইসলামে ফিরে যাওয়া নয় বরং ক্ষমতার লড়াইয়ে ইসলাম ধর্মের বাইপ্রডাক্ট।

(প্রবন্ধটি কারেন আর্মস্ট্রংয়ের ইংরেজি প্রবন্ধ Wahhabism to ISIS: how Saudi Arabia exported the main source of global terrorism এর অনুলিখন।)