(৪)
কবি আবুল হাসানের কবিতা, “অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!”
যত দুর্দন্ড প্রতাপশালীই হোক না কেন, মানুষকে বেশীর ভাগ সময় নিজের সাথেই থাকতে হয়। নিজের সাথেই পরামর্শ করতে হয়। নিজের সাথেই কথা বলতে হয়। কখনো কখনো যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি দিতে হয়। খন্ডন করতে হয় প্রত্যেকটি যুক্তি ও প্রতিযুক্তিকে। এবং পৌঁছুতে হয় সিদ্ধান্তে। যতই সলা-পরামর্শ নিক না কেনো, মানুষকে শেষ বিচারে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় সে সিদ্ধান্তের অনুকূলে। এই এগিয়ে যাওয়া যে সব সময় অনুকূল থাকে সেটাও নয়।
অধিকাংশ সময়েই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয় চারিদিকের নানান বৈরিতার সাথে। সে জীবন যুদ্ধে অবসাদ আছে, আছে অসহায়ত্ব। সে অবসাদকে –সে অসহায়ত্বকে মোকাবেলা করার জন্যে প্রয়োজন হয় শক্তির। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবনযুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি কি সবসময় থাকে? পরিবার, সমাজ , রাস্ট্র কি সব সময় সব মানুষের সহায়ক হয় কিংবা হয়েছে কোনদিন?
আজ যে কোন ভাবে যদি এক বদ্ধমূল ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যায় কিংবা সব মানুষকে বোঝানো যায় যে, ঈশ্বর, আল্লাহ,ভগবান, যিশুসহ এতোদিন বিশ্বাস করে আসা সৃষ্টিকর্তার কোন অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে নেই। যদিও নানা বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী মানুষেরা নানাভাবে এ কথা বলে আসছেন যুগ যুগ ধরে। তাহ’লে একবার ভাবুন তো, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অসহায়ত্ব, যাঁরা এতোদিন নানা বিপদ-বিসম্বাদে সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে বেঁচেছিলেন,যাঁরা ভাবতেন এ পৃথিবীর কেউ সাথে না –থাকলেও উপরওয়ালা একজন সারাক্ষণ তাদের দেখছেন।
সেই উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই তাঁরা বেঁচে আছেন। সেই উপরওয়ালাই তাঁদের বিপদে ফেলছেন আবার তিনিই রক্ষা করছেন কিংবা মেরে ফেলছেন। সেই উপরওয়ালাই বৃষ্টি দিয়ে ভেজাচ্ছেন, রোদ দিয়ে শুকোচ্ছেন , আবার ছায়া দিয়ে জুড়াচ্ছেন।
“তিনি যেমনি নাচান তেমনি নাচে, মানুষের কী দোষ”। সেই নাচানেওয়ালা সৃষ্টিকর্তা কোথায় আছেন কিংবা আদৌ আছেন কিনা- সে যুক্তিবাদী প্রশ্ন অধিকাংশ মানুষের কাছে অবান্তর মাত্র। এক চরম অসহায়ত্ব – এক মহা অনিশ্চয়তা থেকে মানুষ আত্মসমর্পণ করছে এক ভয়াবহ অলৌকিকতার কাছে- এক মহামারী বিশ্বাসের কাছে।
প্রখ্যাত যুক্তিবাদী লেখক-কবি –অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ একবার নিজের অভিজ্ঞতা বলছিলেন এক আড্ডায়। ঢাকা থেকে নিজের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে যাওয়ার সময় একবার বাস দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ কিন্তু বাস ড্রাইভারের সাহসী ও দক্ষতার জন্যে সে যাত্রায় বাসের প্রত্যেকটি যাত্রী বেঁচে যান।
এ কথা বাড়ি পৌঁছে মা-কে বললে, হুমায়ুন আজাদের মা বলছিলেন, “আল্লাহর কাছে হাজার শুকর করো, তিনি তোমাদের বাঁচিয়েছেন “।
এ কথা শুনে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, “আম্মা একথা কেন বলছেন? আল্লাহ বাঁচাবেন কিভাবে, আল্লাহ তো মারতেই চেয়েছিলেন, বাঁচালো তো বাস ড্রাইভার”।
সহজ মানুষের খুব সরল বিশ্বাস। সব কিছুর পেছনেই সেই উপরওয়ালার ইশারা দেখতে পান। বিশেষ করে পরিস্থিতি যখন নিজের আয়ত্বের মধ্যে আর থাকে না।
ছোটবেলায় প্রতি সপ্তাহে বাড়ি থেকে কলেজ হোস্টেল যাওয়ার সময় আমার ঈশ্বরভক্ত বড়মা (জেঠিমা ) ঢাউস আকারের দু’টো তুলসির পাতা কানের গোড়ায় গুজে দিয়ে বলতেন, ‘ভগবান যেন নিরাপদে পৌঁছে দেন”।
আমি জানতাম, কোন বাধায় কাজ হবে না , তাই নিরবে মাথা নিচু করে সে তুলসির পাতা কানে নিয়ে বলতাম, “ ঠিক আছে দাও। ঢাকা যাবো বাসে। আর বাস তো আর আমি চালাবো না। চালাবে ড্রাইভার । তাই বিপদ হলে ড্রাইভারের জন্যেই হবে। তাই বাসে উঠেই বাস ড্রাইভারের কানে তুলসির পাতা গুজে দেবো।“
কোটি কোটি মানুষের কি সহজ সরল অথচ প্রবল বিশ্বাস ওই না-দেখা সৃষ্টিকর্তার উপর। অথচ পথের দুর্ঘটনার জন্যে বাস্তবের মানুষগুলোই দায়ী। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের মা কিংবা আমার বড়মার তো কোন আস্থা -ভরসা কিংবা কর্তৃত্ব নেই ওই বাস ড্রাইভার কিংবা বাস্তব জীবনের দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী সকল নিয়ামকের উপর। তাই শেষ ভরসা ওই উপরওয়ালার কাছে!
অন্য সকল বিশ্বাস যদি চিরস্থায়ী না হয়, তবে ধর্মীয় বিশ্বাসও চিরস্থায়ী হ’বার কথা নয়। যাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে চিরকালীন এবং অভ্রান্ত ও অপরিবর্তনীয় বিশ্বাস বলে বিশ্বাস করে থাকেন,তাঁদের যুক্তিতে কোথাও গড়মিল আছে।
ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছে শুনেছি গুটি বসন্ত বা কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেতো। সৎকার করার মতো মানুষও খুঁজে পাওয়া যেতো না। এসব রোগ থেকে বাঁচতে ঘরে ঘরে প্রচলন ছিল ওলনচন্ডীর মতো নানা পূজা –অর্চনার। এখন সে সব রোগ নেই, পূজা-অর্চনা বা বিশ্বাসও নেই।
আগে প্রচন্ড উৎপাত ছিল সাপের । জংগল ছিল বসত বাড়ির চারিদিকে। অনাবাদি ভিটে ছিল। ইঁদুর বা অন্যান্য পোকামাকড় ছিল। ছিল সাপের উপদ্রুপ। তাই ছোটবেলায় গ্রামে দেখেছি হিন্দু তো অবশ্যই মুসলমান বাড়ি থেকেও মনসা পূজার জন্যে টাকা দেয়া হতো।
এখন মানুষ বেড়েছে। জংগল ভিটেবাড়িতেও হয়েছে মানুষের ঘর-গেরস্থালি। ঘরবাড়িতেও এসেছে পরিবর্তন। মাটির ঘর থেকে উঠেছে পাকা দালান। সাপের আবাসন কমে গেছে। তাই এখন আর মনসা পূজার তেমন প্রচলন গ্রাম বাংলায় মুসলমান তো দুরের কথা হিন্দুদের মধ্যেও তেমন নেই।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার দিয়ে মানুষ যতো নিজের অসহায়ত্বকে বশ করতে পারবে, যতো আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারবে, যতো যুক্তিবাদী জ্ঞানের চর্চা করবে; মানুষের ততো নির্ভরতা কেটে যাবে ওই অদৃশ্য “নাচানেওয়ালে”র উপর থেকে, মানুষ ততোই বিশ্বাস হারাবে ওই অদেখা ঈশ্বরের প্রতি এবং নির্ভয়-নির্ভার হবে নিজেও।
ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্য
লেখাটি খুব জ্ঞানগর্ভ । “মানুষের ততো নির্ভরতা কেটে যাবে ওই অদৃশ্য “নাচানেওয়ালে”র উপর থেকে, মানুষ ততোই বিশ্বাস হারাবে ওই অদেখা ঈশ্বরের প্রতি এবং নির্ভয়-নির্ভার হবে নিজেও।” – বাস্তবে হবেও তাই । তবে তা হতে সময় নেবে অনেক । হাজার বছর ধরে মানুষ যে বিশ্বাস, অনুভুতি লালন করে এসেছে, তা নির্মুল হতে আরো কয়েকশো হাজার বছর তো লাগবেই ।
ঈশ্বর এবং ধর্ম খুব দ্রুতই ডিকশনারি থেকে হারিয়ে যাবে।