“শ্রীমৎ শংকরাচার্য বলেছেন নারী নরকের দ্বার। সনৎ নরকের অনেকগুলি দ্বার খুলেছিল, তাই শেষ পর্যন্ত তার নরকবাস অনিবার্য হয়ে পড়ল।”
উদ্ধৃতিটি বাঙালি মাত্রেই অবিহিত হবেন আন্দাজ করা যায়। পাঁচ-দশ বছর আগেও কি হত বলা যায় না। তবে অধুনা বায়োস্কোপে প্রবল ব্যোমকেশ হাওয়ায় এরকম সব উদ্ধৃতি-ই উড়ো খৈ-এর মত আপনি-ই তাবৎ বাঙালির কানে ঢোকা উচিত। তবু এই প্রচন্ড ব্যোমকেশ ঝাপটায়-ও যাদের কানে এসব যায়নি তাদের জন্য বলে দিই, উপরোক্ত বাক্যটি ‘বেণী সংহার’ শীর্ষক ব্যোমকেশের রহস্য কাহিনী থেকে গৃহিত। বক্তা স্বয়ং ব্যোমকেশ।
ব্যোমকেশ ছাপার চরিত্র হিসেবে বাংলায় ফেলুদা’র থেকে অনেক কম জনপ্রিয়। কারণ বোধকরি তার কাহিনী ছোটদের পড়ার মত নয় বলে বাঙালি মনে করে; ফলে কিশোরদের ব্যোমকেশ পড়ায় উৎসাহিত করা হয় না। আর বড় এবং বুড়ো বাঙালি বাংলা গোয়েন্দা গপ্পো পড়ে না। অন্তত চারপাশের লোকজন দেখে তো তাই-ই মনে হয়। ফলতঃ গোয়েন্দা হওয়ার জন্য তিনি বড় হতে পারলেন না আর তাঁর গপ্পে কোন ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় না রেখে বাঙালি জাতির মধ্যে (প্রতিবেশী বিহারিদের মধ্যেও) কাম বিষয়টি যে বিদ্যমান এই মহাগোপন কথটা বলে ফেলে কিশোর জগতের ছাড়পত্র পেলেন না। প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়ষ্ক বাঙালির এই দুই অসেতুবন্ধ জগতের মাঝে ত্রিশঙ্কু হয়েই ঝুলে রইলেন। তবে পড়ুক বা না-ই পড়ুক বঙ্গসমাজ ব্যোমকেশ সম্বন্ধে খুব-ই উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকে। এবং তার প্রায় একমাত্র গুণ হিসেবে প্রচার করা হয়ে এসেছে যে তিনি খুবই বাঙালি। তাঁর বা তাঁর স্রষ্টার মেধা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যাথা নেই, কেবল ব্যোমকেশ বাঙালি এতেই আমারা দারুণ আহ্লাদিত।
ব্যোমকেশ নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান, মেধাবি বাঙালি তবে উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি পড়ার পরে এটাও নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে তিনি নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক বাঙালিও বটে। কারণ তিনি শঙ্করাচার্যের সাথে দ্বিমত ব্যক্ত করেননি।
কেবল একটি উদ্ধৃতি নয়। ঝুলিতে আমার এ রকম বচন প্রচুর। ঐ একই কাহিনীতে কয়েকটি বাক্য পরেই শ্রী বক্সী আরো বলেন, ‘মেদিনীর মতো মেয়েকে তুচ্ছজ্ঞান কোরো না। যুগে যুগে এই জাতের মেয়েরা জন্মগ্রহণ করেছে – কখনো ধনীর ঘরে কখনো দরিদ্রের ঘরে – পুরুষের সর্বনাশ করবার জন্য।’ সুধী পাঠক গল্পটি পড়লেই বুঝতে পারবেন যে শ্রী বক্সী কিন্তু উক্তিটি মোটেই মজা করে করেননি। গল্পের দ্বৈত খুনে মেদিনীর একটি বড় ভুমিকা আছে। সে বাড়ির প্রায় সমস্ত পুরুষকে সম্মোহিত করেছিল নিজের যৌন আবেদন দিয়ে। বিশেষ করে সনৎ নামের যুবককে, যে আসলে খুন দু’খানা করে। মেদিনী অপরাধী এবং তার প্রতি তিরষ্কার যৌক্তিক। কিন্তু সে তিরষ্কারের অভিমুখ, যেমন আমরা উদ্ধৃতি গুলিতে দেখতে পাচ্ছি, যদি অপরাধীর জেন্ডার কে উদ্দেশ্য করে হয় তবে তা সমস্যার। অপরাধী এক জন ব্যক্তি, সে তার অপরাধে তার নারী শরীর কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু তাতে নারীজাতি বা নারীত্ব ইত্যাদিকে দায়ী করা কম অপরাধ নয়। পুরুষ সনৎ-ও তার শরীর ও পৌরুষের গৌরবমন্ডিত পেশীশক্তি ব্যাবহার করেই খুন দু’টো করেছে। কই তখন কিন্তু শ্রী বক্সী এটা বলেননি যে পুরুষরা এমনই ঘৃণ্য হয়। তখন কিন্তু তার তীরের অভিমুখ একটি বিশেষ ব্যক্তি মানুষের দিকে। তার জেন্ডারের দিকে নয়।
আরো স্পষ্ট করে শ্রী বক্সী বলছেন, ‘মেদিনী-ই যত নষ্টের গোড়া। সে স্বামীকে ছেড়ে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল তারপর এখানে এসে আর একজন উচ্চতর বর্গের মানুষকে তার মোহময় কুহকজালে জড়িয়ে ফেলল…।’ দ্যাখা যাচ্ছে এই বাক্যে সনতের অপরাধ শ্রী বক্সী প্রায় নৈতিক ভাবে মাফ-ই করে দিয়েছেন। এখন সনত বা বাড়ির আর যারা এই ‘মোহময় কুহকজালে’ জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা তো কেউ সদ্য হস্তমৈথুন শেখা বয়ঃসন্ধি প্রাপ্ত খোকনটি নন যে কচি মাথা পেয়ে মেদিনী চিবিয়ে খেয়েছে। সবাই যথেষ্ট বয়োপ্রাপ্ত। তাঁরা সে জালে যখন জড়িয়েছেন তখন এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে জড়াতে তারা যথেষ্টই চেয়েছেন। ভীমনাগের দোকানে সন্দেশ দেখে কেউ যদি খাবে বলে দোকানি কে মারে তবে লোকে সন্দেশের দোষ দ্যায় না। পুলিশ ব্যাংক ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে, প্রলুব্ধ করার জন্য টাকার বান্ডিলকে হাজতে পাঠায় না।
অপর একটি দিকও খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি আর একবার দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি ফিরে দেখি তবে দেখব, যে ‘মেদিনীর মত মেয়েকে তুচ্ছ মনে কোরো না’ এই বাক্যবন্ধে যে মূল সুরটি ঝন্ ঝন্ করে সেটি হ’ল মেয়েদের তুচ্ছ করাটাই দস্তুর। অপর মেয়েদের তুচ্ছ করলে শ্রী বক্সী আপত্তির কোন কারণ দ্যাখেন না কেবল মেদিনীকে তুচ্ছ করা অনুচিত কারণ সে ‘নিরপরাধ’ পুরুষের সর্বনাশ করার শক্তি রাখে। এ বিষয়ে এর বেশী কিছু বলা নির্মোহ পাঠকের কাছে অত্যুক্তিই হবে বলে বোধকরি।
এইরকমই যদি ‘রক্তের দাগ’ শীর্ষক গল্পটি পড়ি তাতেও দেখব নারীর যে সনাতন দুর্বল লজ্জাশীলা রূপটি ভারতীয় সমাজে স্বীকৃত সেটি-ই ফুটে উঠছে বিভিন্ন কথায়। বিবেকানন্দ এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘In the West, the women did not very often seem to me to be women at all, they appeared to be quite the replicas of men! Driving vehicles, drudging in offices, attending schools, doing professional duties! In India alone the sight of feminine modesty and reserve soothes the eye!’
[SWAMI VIVEKANANDA COMPLETE WORKS (e- book edition) Volume 6. Conversation and dialogue: (From the Diary of a Disciple) No. VIII. Place: Calcutta. Year: 1897, March or April. The disciple was: Sharatchandra Chakravarty]
এই যে নারীর সাবডিউড, লজ্জাশীলা, অবনত, পুরুষের বাধ্য, প্রায় ঘরবন্দি ইমেজটি যুগে যুগে মহাপুরুষরা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে এসেছেন বাবু ব্যোমকেশও তার-ই উপর সযত্নে দাগা বুলিয়েছেন। যেমন তিনি গপ্পের শেষের দিকে বলছেন, ‘রমাকান্ত যে বলেছিলেন সুচিত্রা ভাল মেয়ে সে-কথা নেহাৎ মিথ্যে নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাঁধন ভাঙার একটা ঢেউ এসেছিল, উচ্চবিত্ত সমাজের অবাধ মেলামেশা সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুচিত্রা আলোর নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে একটু বেশী মাতামাতি করেছিলেন। অভিভাবিকার অভাবে গন্ডির বাইরে যে পা দিচ্ছেন তা বুঝতে পারেন নি। কিন্তু প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে হুঁশ হল। বিয়ের পর তিনি বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, শান্ত সংযতভাবে বাড়িতে রইলেন।’ সুচিত্রার কুমারী গর্ভে একটি সন্তান এসেছিল। সেই প্রসঙ্গে এই উক্তিটির অবতারণা। এখন আপাত দৃষ্টিতে উক্তিটি বিশেষ আপত্তিকর মনে হয় না। বিশেষ করে প্রসঙ্গটি মনে রাখলে। সত্যি বলতে কি যদি এটি কেবল একটি ঘটনার অব্জেক্টিভ বিবৃতি হোতো, তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে আপত্তির কিছুই থাকত না। কিন্তু সচেতন পাঠককে একবার ওই, ‘…সুচিত্রা ভাল মেয়ে সে-কথা নেহাৎ মিথ্যে নয়’ এই কথা কটি খেয়াল করতে অনুরোধ করি। এই বাক্যটির সংযোজনেই এটি আর কেবল বিবরণ থাকল না, শ্রী বক্সীর মতামত হয়ে উঠল। কি সেই মতামত? তার অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটি এই রকম যে সুচিত্রা ‘ভালো মেয়ে একথা মিথ্যা নয়’ এই জন্য যে তিনি অবাধে পুরুষ সংসর্গ ক’রে যখন ধাক্কা খেলেন তখন আজীবন এক কঠোর প্রায়শ্চিত্ত শুরু করলেন। যাকে বলে বিয়ের পর তিনি শুধরে গেলেন। এবং কী সেই সংশোধন? না, বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন, শান্ত সংযত হয়ে বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। অর্থাৎ বিবেকানন্দ বর্ণিত ভারতীয় নারীর প্রটোটাইপটা মেনে নিলেন। ভালো মেয়ে হতে গেলে ঘরের বাইরে পা না দেওয়াই ভালো। শান্ত সংযত হয়ে থাকাটাই দস্তুর। একেই হুঁশ হওয়া বলে। এর অন্যত্র যদি হ’তো, যদি সুচিত্রা বিয়ের পর (পরকীয়া না করে) মুক্ত ভাবে লোকের সাথে মিশতেন; যে মুক্তির কথা, আলোর কথা শ্রী বক্সী বলেছেন সে আলোতে যদি (গন্ডির বাইরে আর পা না দিয়ে) দাঁড়াতেন তবে কি আর ভালো মেয়ে থাকতেন না? কথার ইঙ্গিত বলে, না।
এরকম উদাহরণ চলতেই থাকবে। পরিসর স্বল্প তাই আমরা বরং শ্রী অজিতবাবুর দিকে চোখ ফেরাই। তিনি বুদ্ধিতে তাঁর বন্ধুবর শ্রী বক্সীর থেকে খানিক খাটো হলে কি হবে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে কিন্তু বন্ধুর অনুরূপ।
ধরা যাক ‘আদিম রিপু’ গল্পটি। প্রথমেই তিনি ননীবালা চরিত্রটিকে যেমন বর্ণনা করেছেন তা উদ্ধৃত করা যাকঃ
‘কিন্তু সেকি স্ত্রীলোক! পাঁচ হাত লম্বা, তদনুপাতে চওড়া, শালপ্রাংশু আকৃতি, পালিশ করা আবলুশ কাঠের মত গায়ের রঙ, ঘটোধ্নী, নিবিড়নিতম্বিনী, স্পষ্ট এক জোড়া গোঁফ আছে, বয়স পঞ্চাশের ওপারে। তিনি আমার দিকে চাহিয়া হাস্য করিলেন, মনে হইল হারমোনিয়ামের ঢাকা খুলিয়া গেল।’
বলাই বাহুল্য এই রকম নারী দেখে অজিতবাবু মোটেই খুশি হননি। প্রথম বাক্যেই তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বলা ভালো সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ‘সে কি স্ত্রীলোক!’ এ বিস্ময় সন্দেহের-ই নামান্তর। প্রশ্ন হ’লো কেন? উত্তরটা নারীবাদী লেখক হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ শীর্ষক বইটিতে খোঁজা যাক। তিনি সেখানে বলছেন, ‘পুরুষ এমন অসংখ্য সংজ্ঞা দেয় নারীর যার সবটাই নিন্দাসূচক। কোন কোন নারীকে দেখিয়ে তারা বলে, সে নারী নয় যদিও তার জরায়ু-স্তন-যোনি সবই রয়েছে। ওই নারীর মধ্যে তারা দেখতে পায় নারীত্বের অভাব, চিরন্তন নারীত্বের উনতা। তারা চায় নারী হবে নারী, থাকবে নারী, আর হয়ে উঠবে নারী। পুরুষ চায় শাশ্বতী নারী, যার কোন অস্তিত্ব নেই।’ [নারী, হুমায়ুন আজাদ। আগামী প্রকাশনী। পৃঃ ১৯-২০]।
যে নারী অজিতবাবুর কামনার সাথে মেলে না তার নারীত্ব নিয়েই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এতে আমাদের বিস্মিত হবার কিছু নেই কারণ পুরুষমাত্রেই প্রায় এরকমটা ভাবেন আর তার প্রমাণস্বরূপ অজিতবাবু বলেছেন, ‘আমি ভাবিতে লাগিলাম এরূপ আকৃতি লইয়া ইনি কখনই ঘরের ঘরণী হইতে পারেন না, স্বামীপুত্র ঘরকন্না ইহার জন্য নয়। বিশেষ নামের আগে মিস খেতাবটি দাম্পত্য সৌভাগ্যের বিপরীত সাক্ষ্য দিতেছে।’ দাম্পত্য বিষয়টা তাহলে পুরোটাই কেবল অজিতবাবুর মত পুরুষের কামনার, এই রকম ঘোষণা করতে তাঁর বা তাঁর স্রষ্টার বিন্দুমাত্র আটকায়নি। স্বভাবতই ওই মিস খেতাবটি তিনি দুর্ভাগ্য বলে চিহ্নিত করেছেন, সাবলম্বী নারীর দীপ্তি হিসেবে নয়। বলাই বাহুল্য গল্পের যে জায়গায় এই উক্তিগুলি আসে সে জায়গায় মিস ননীবালার সাথে অজিতবাবুর কোন আলাপচারিতাই হয় নি। ফলে সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য সব-ই অজিতবাবুর মত। মিস ননীবালার নয়।
এবার উল্টো করে যদি ভাবি তাহলে অন্ধমুনির শাপের মত একটা ভালো দিকও আবিষ্কার করা সম্ভব। মিস ননীবালাকে যতই অজিতবাবুর খারাপ লাগুক, কিন্তু গপ্পের লেখক তাঁকে বেশ শক্ত সমর্থ করেই তৈরি করেছেন। সবল, সাবলম্বী। ওই অবদমিত ভারতীয় নারীর ছাঁচে ঢেলে তাঁকে তিনি তৈরী করেননি বলেই মনে হয়। একটা আশা জাগে। কিন্তু গপ্প আর একটু গড়ালেই দেখা যায় সে আশায় জল ঢেলে শ্রী বক্সী ও অজিতবাবুর মতই তাঁদের স্রষ্টাব্যাক্তিও দুর্দমনীয় নারীকে ভয় করেন। পছন্দ করেন না মোটেও। সে নারীর অবাধ্যতাকে যদি কলঙ্কের, অপরাধের মুগুরে তাঁরা গুঁড়িয়ে দিতে না পারেন তবে তাদের পৌরুষ নামক আস্ফালনের অবকাশ থাকে না। মিস ননীবালা কলঙ্কিনী নন। খুনে, বা ডাকাত-ও নন। তবে? তার জন্য নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি : ‘ননীবালার চেহারা দেখিয়া যদিও কেহই তাঁহাকে অবলা বলিয়া সন্দেহ করিবে না, তবু তাঁহার হৃদয়টি যে অসহয়া রমণীর হৃদয় তাহা স্বীকার করিতে হয়।’
এই রকম যখন-ই তিনি কোন নারীকে খানিকটা সবলা, অনমনীয়া করে তুলেছেন তখন-ই হয় তাকে কোথাও পুরুষ নির্ভর করে তুলেছেন অথবা তার গায়ে কলঙ্ক লাগিয়েছেন বা অপরাধের বোঝা চাপিয়েছেন। এই ধরুন ‘অদৃশ্য ত্রিকোণ’ গল্পে রেবা চরিত্রটি। রেবা নিজে তার ব্যবসা দ্যাখে, গাড়ি চালায়, লোকজনের সাথে মেশে। তার অকর্মণ্য স্বামীর উপর সে কোন প্রকারেই নির্ভর করে না। এ পর্যন্ত ভালোই ছিল। তার পরেই মনে হল বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই বলা হল, ‘তাহার হৃদয় এখন সম্পূর্ন স্বায়ত্ত ও স্বাধীন। কিন্তু মেয়েমানুষ যতই স্বাধীন হোক, পুরুষের বাহুবলের ভরসা তাহারা ছাড়িতে পারে না।’
যেমন বহ্নি ‘পতঙ্গ’ গল্পে শকুন্তলার যে বর্ননা তা এই রকম, ‘সুন্দরী এবং বিদুষী। কলানিপুণা, নাচতে গাইতে জানেন, ছবি আঁকতে জানেন, তার ওপর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তেজস্বিনী ছাত্রী, বি.এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।’ কিন্তু এখানেও শকুন্তলা কলঙ্কিনী এবং সে তার স্বামীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অবশেষে মরে। এক বিদুষীর চমৎকার পরিণতি।
বেশীরভাগ জায়গায় সত্যবতীকে প্রায় একটা আদর্শ নারীর রাখা হয়েছে বিভিন্ন গল্পে। এখন খেয়াল করলে দ্যাখা যায় সত্যবতীকে তেমন বিদুষী বলা যায় না। তিনিযে দারুণ তেজস্বিনী তাও নয়। যেটুকু ঝগড়া তক্ক তিনি শ্রী বক্সীর সাথে করেন তা নেহাৎ-ই দাম্পত্য সম্পর্কে একটু স্বাদ ফেরানোর নিমিত্ত। তার গুণের মধ্যে তার লয়াল্টি যাকে বাঙালি চারিত্রিক দৃঢ়তা বলে। তার সময় মত চা দেওয়ার কথা মনে রাখা। ব্যোমকেশ বাবু মোজা পরেছেন কিনা তার খেয়াল রাখা। ভালো ভাবে খোকা কে মানুষ করা ইত্যাদি। অর্থাৎ ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে ঠিক যা যা বাঙালি পুরুষ চেয়ে থাকে সত্যবতী তার প্রতিমূর্তি।
এখন সৃষ্টির দায় দিনান্তে স্রষ্টাকেই নিতে হবে। তখন কেবল বাস্তব, কালের প্রতিচ্ছবি, চরিত্ররা আসলে স্বাধীন ইত্যাদি বলে দোষ, সৃষ্ট চরিত্রের ঘাড়ে ফেললে নিতান্ত অন্যায় হবে। তারা রাখাল নামক দুষ্ট বালকের মত স্রষ্টার কান কামড়াতে চাইলেও অন্যায় হবে না। আমি যদি বাঁশ কেটে বাঁশি বানিয়ে সুর তুলি তার কৃতিত্ব যেমন আমার, তেমন লোহার পিন্ড থেকে বন্দুক বানিয়ে লোক মারলে তার দায়ও আমার-ই। হত্যার দায় তখন বন্দুকের ওপর চাপালে লোকে শুনবে কেন!
:yahoo:
আমি লেখাটার সঙ্গে পুরোপুরি সহমত। আজ লেখিকা অ্যানালাইজ করলেন ঠিকই কিন্তু আমার ব্যোমকেশ বক্সীর বহু কাহিনী সম্পর্কে এইরকম ধারণাই হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। এবং শুধু ব্যোমকেশ বক্সী নয় শ্রদ্ধেয় শরদ্বীন্দু মহাশয়ের অনেক রচনাতেই আমরা এই হেন কিছু বক্তব্য এবং উক্তি দেখে থাকি। শুধু শরদ্বীন্দু নন এই দোষে দোষী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আরো অনেক চেনা পরিচিত লেখকও এবং বলা বাহুল্য কিছু লেখিকাও, আমি নাম বলছিনা। তবে ব্যোমকেশ যেহেতু কল্পনাপ্রসূত একপ্রকার গোয়েন্দা গল্প সেইহেতু সাবজেক্টের ক্রিয়াকলাপগুলি কতোটা বাস্তবেও হয় সেই নিয়ে দ্বন্দ থাকতেই পারে। ক্রাইম থ্রিলার নিয়ে রোন্যাল্ড চ্যান্ডলার বলেছিলেন যে গোয়েন্দা গল্প হলো মহৎ মানুষের মনের খোরাক, যাইহোক গোয়েন্দা গল্পের বিশ্লেষণ কিছুটা ” পাজেল ” বা ” ধাঁধার ” মতো এটা সত্যি মস্তিষ্কের খোরাক। তবে ক্রাইম প্যাট্রল এবং আমাদের চারপাশে যা ঘোটে চলেছে প্রতিনিয়ত প্রতি মুহূর্ত সেই হিসেবে যৌনতা এবং যৌন ইর্ষা সংক্রাান্ত যতো অপরাধ ঘটেছে কিংবা ঘটে চলেছে তার দ্বায় নারী পুরুষ দুজনেরই ( এইখানে ধর্ষণ শ্লীলতাহানী এইসব ক্রাইমকে বাদ রাখছি কারণ এই ক্ষেত্রে মেয়েদের কোনও দোষ নেই )। তবে প্রতারণা খুন জালিয়াতি ইত্যাদি এইসব ক্ষেত্রেও আজ নারী মোটামুটি পুরুষের সঙ্গে টেক্কা দিয়েই চলেছে সেইজন্য আজ ক্রাইমে কালপ্রিট হিসেবে দোষী উভয়েরই।
শেষ অনুচ্ছেদ বাদে প্রায় সমস্ত আলেখ্যর সঙ্গে একমত। লেখার কাঁটাছেঁড়া চলতেই পারে। লেখাগুলির ভাষ্য আজকের দিনে অচল হতেই পারে। তার জন্য প্রাচীন লেখক-কে দোষ দেওয়া যায় না। বাংলায় প্রাপ্তমনস্ক গোয়ন্দাগল্পের পাঠক সংখ্যা যখন সীমিত তখন লেখককে বেচুবাবু হতে হবে বইকি। মন্টু ময়রা যদি বিক্রি বাড়ানোর জন্য (বাঙালীর পেটে নিষিদ্ধ) গব্যঘৃতে জিলিপি ভাজে তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। অন্ততঃ যদি খদ্দের প্রাপ্তবয়স্ক হন।
তাই শেষ অনুচ্ছেদটি কিছুটা হলেও ‘ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্ববাদে’ (Historical Chauvinism) দুষ্ট। আমরা একবিংশ শতকের ‘মুক্তমনা’ পাঠক। কিন্তু আমাদের বাবা কাকারা ছিলেন আগের শতাব্দীর, আর তারো আগের প্রজন্ম ছিল ঊনবিংশ শতকের। তাই আজকের মূল্যবোধের নিরিখে তাঁদের ‘অ-প্রগতিশীলতা’ পরিমাপ করা নেহাত-ই অনুচিৎ। তাঁদের কে তৎকালীন সমাজের গড়পড়তা মননশীলতার মানকে বিচার করে – উদার এবং গোঁড়া এই দুই শ্রেণীতে ফেলা যেতে পারে মাত্র। সমসাময়িক সময়ের বিচারে তাঁরা অপাংক্তেয় হবেন বলাই বাহুল্য কিন্তু সেই বিচার অপ্রয়োজনীয় এবং অহেতুকী
সহমত আপনার সঙ্গে।
ধন্যবাদ প্রসূনজিৎ। আপনার সঙ্গে একমত। তবে এ দোষে কেবল শরদিন্দুই দুষ্ট নন। আরো অনেকেই একি সমস্যায় আক্রান্ত। ভাবছি একটি সিরিজ লিখব। দ্যাখা যাক।
আসলে লেখকের সৃষ্টির দায় লেখকের উপরই বর্তায়। এক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায় লেখক তার সৃষ্ট চরিত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সমস্ত দায় সেই চরিত্রের ওপর চাপিয়ে দেন।
কিন্তু যখন দেখা যায় সেই লেখকের প্রায় সব সৃষ্টির মূল সুরই এক তখন আর লেখকের দায় এড়ানোর উপায় থাকে না। শরদিন্দু ব্যানার্জীর বেলাতেও একই কথা। যদিও এ ব্যাপারে উনি কি ভাবছেন তা আর কখনোই জানা যাবে না।
শরদিন্দুর বিভিন্ন লেখা পড়ে তাকে আমার কাছে সবসময়ই হিন্দু পুনর্জ্জীবনবাদী ও তথাকথিত প্রাচীন হিন্দু আদর্শবাদে বিশ্বাসী লেখক বলেই মনে হয়েছে। যার উপজাত হিসেবে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রচ্ছন্ন সমর্থনও তার লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। একই সাথে তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রতি সহমর্মিতাও লক্ষ্য করা যায়। যা আসলে একই আদর্শ জারিত।
তবে উনি অত্যন্ত দক্ষ, কুশলী ও প্রতিভাবান লেখক বিধায় পুরো বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষভাবে তার লেখায় এসেছে। অনেকটা যেন মেঘলা দিনে রোদের উঁকি দেবার মত। দেখা যায় কিন্তু অনুভব করা যায় না।
যাক আপনাকে ধন্যবাদ শরদিন্দুর রচনার এই আপাত অদৃশ্য কিন্তু প্রকটভাবে উপস্থিত বিষয়টি তুলে ধরার জন্য।