বিদেশ থেকে লেখালেখির কারণে প্রায়ই এক শ্রেণীর মানুষের দ্বারা আক্রমনের স্বীকার হতে হয়। এর কারণ হচ্ছে, তারা মনে করেন প্রবাসীরা দেশের জনগণের টাকায় লেখাপড়া করে, দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন না করে, উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে চলে গেছেন। অতএব তারা স্বার্থপর, দেশপ্রেমহীন ও অকৃতজ্ঞ। তাদের মুখে দেশ নিয়ে কথা মানায় না, অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়। তাদের সেই ভাবনা কতটা যৌক্তিক ও গ্রহনযোগ্য এই আলোচনার মাধ্যমে সেই বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করবো। এখানে কয়েকটা বিষয় আছে; () জনগণের অর্থে লেখাপড়া করা () দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন না করা (উন্নত জীবনের প্রশ্ন অভিবাসন। আপাতত এই তিন উপশিরোনামে লেখাটি সীমাবদ্ধ রেখেছি।

() জনগণের অর্থে লেখাপড়া করা 

শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের যে ব্যায় তাকে শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ বলে। শিক্ষায় বিনিয়োগেরও একটা হিসেবে আছে, যাকে রেট অব রিটার্ন বলে। কোন শিক্ষায়, কি ধরণের বিনিয়োগ করলে তা কতগুন হয়ে ফিরে আসে তার হিসেব শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষায় বিনিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র সেখান থেকে অধিক লাভ/সেবার কথা বিবেচনা করে। সে হিসেবেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে নেয়া সুবিধা নাগরিকরা তাদের কর্মজীবনে সেবা প্রদান/উৎপাদনের মাধ্যমে পরিশোধ করে থাকে। সে জন্য কাউকে আমৃত্যু রাষ্ট্রের দাস হয়ে থাকতে হয় না। কারণ রাষ্ট্র যে অর্থ বিনিয়োগ করে সেটা জনগণেরই অর্থ।

তারমানে শিক্ষা সুবিধার যে ঋণ বা দায় আছে তা শোধ করার বিষয়টি কিন্তু আমৃত্যু নয়। তা সারাজীবন ধরে টানার বিষয় নয়। সেটা কিভাবে পরিশোধ করা হয় তারও একটা হিসেব বা ক্যালকুলেশন আছে। যার মাধ্যমে নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে নেয়া সুবিধা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে পরিশোধ করে থাকে।

উন্নত দেশগুলোতে এ ধরণের হিসেব পাওয়া গেলেও  আমাদের দেশে এ ধরণের কোন হিসেবে করা হয়/হয়েছে বলে আমার জানা নেই। উন্নত বিশ্বে এক্ষেত্রে খরচের হিসেবটা কেমন তার একটা নমুনা এখানে তুলে ধরছি।

যেমন ধরুন, একজন ডাক্তার তৈরী করতে কি পরিমান খরচ হয়? এখানে এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের একটি হিসেব তুলে ধরছি। ইউরোপের অনেক দেশই কয়েকবছর পর পর এই হিসাবটা করে থাকে। যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, একজন ডাক্তার তৈরি করতে মোট খরচ ২ লাখ ১৩ হাজার পাউন্ড।

এর মধ্যে শিক্ষার্থী নিজে ব্যাংকঋণ নিয়ে খরচ করেন ৬৪ হাজার পাউন্ড, যার পুরোটাই তাকে বা তার পরিবারকে সূদসহ ব্যাংকে ফিরিয়ে দিতে হয়। আর রাষ্ট্র অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বাকিটা ব্যয় করে। অর্থাত্‍ রাষ্ট্র একজন ডাক্তার তৈরি করতে খরচ করে ১ লাখ ৪৯ হাজার বা দেড় লাখ পাউন্ড। এটা বলার অবকাশ রাখে না যে, এই খরচের প্রায় পুরোটাই প্রাতিষ্ঠানিক খরচ, ব্যক্তি ছাত্রের প্রতি সরাসরি খরচ নয়। ইংল্যান্ড এই হিসাবটি আপডেইট করে থাকে দুটি প্রধান কারণে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন ডাক্তার তৈরী করতে সরকার যে বিনিয়োগ করে তা তুলে আনতে কত বছর লাগে? পাঁচ বছর? দশ বছর? সারাজীবন? আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসবের তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু যুক্তরাজ্যে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট হিসেব বের করেছে যে অন্তত চার বছর এনএইচএস ইংল্যান্ডে (জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগে) কাজ করলে এই বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসে।

তাহলে কি দাড়ালো, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট এর সময় টা হচ্ছে চার বছর, চল্লিশ বছর নয়। একজন ডাক্তারের কার্যকর আয়ু হচ্ছে প্রায় ৪৫ বছর। তাহলে বাকি ৪১ বছর এই ডাক্তার কি করে? বাকি ৪১ বছর এই ডাক্তার সার্ভিস উত্‍পাদন করে, সমাজের জন্যে মূল্য উত্‍পাদন করেন।

বাংলাদেশে থেকে যারা কথায় কথায় ‘একজন ডাক্তার বানাতে জাতির কতো টাকা খরচ হয়’ এই প্রশ্ন তোলেন, তাদের প্রতি অনুরোধ অনুগ্রহ করে তার সাথে আরেকটি প্রশ্ন তোলেন একজন ডাক্তারের উপরে ‘জাতির এই বিশাল অংকের টাকা’ উঠে আসতে ডাক্তারকে কতোদিন কাজ করতে হয়?

তাহলে ২টি প্রশ্নঃ 

১। একজন ডাক্তার তৈরি করতে সরকারের কি পরিমান অর্থ খরচ হয়? (যেমন যুক্তরাজ্যে দেড় লাখ পাউন্ড।)

২। একজন ডাক্তার তৈরী করতে যে পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করা হয় সেই টাকাটা উঠে আসতে কত বছর সময় লাগে? (যেমন যুক্তরাজ্যে ন্যূনতম চার বছর)

বাংলাদেশের জন্য এই হিসাব বের করা কি খুব কঠিন কোন কাজ? মোটেই নয়। যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসেব বিজ্ঞানে পড়া একজন  শিক্ষার্থীই এই কাজটি করতে পারবে। কিন্তু আমাদের দেশে এই রকম কোন হিসেবে নেই। কেন নেই, কেন সেই হিসাবটা করা হয় না, সেটা আমার জানা নেই।

এখন আমার নিজের হিসেবটা একটু বলি। আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। আমি কখনো চাকরিব্যবস্যা করিনি। তবে সার্বক্ষনিক রাজনীতি করেছি এবং তা করেছি প্রায় ২০ বছর। আমার লেখাপড়া করার বয়সের সমানই। একে যদি মানুষের প্রতি সেবা বলেন তাহলে তার একটি আর্থিক মূল্য আছে। সে মূল্য কি অন্য কোনপেশজীবী তৈরীরখরচের চেয়ে কম? যারা সেটাকে ব্যবহার করে আয়ইনকাম করেছে তাদের বিষয় ভিন্ন। আর রাজনীতি বা জনসেবা করতে যেয়ে যে, হামলামামলা, জুলুমনির্যাতন, বছরের পর বছর আত্মগোপন, কারাবরণ আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হয়েছি সেগুলো আমার পারিবারিক রাষ্ট্রীয় নয়, সে হিসেবের কথা না হয় এখানে নাই বলি। 

বাংলাদেশ থেকে যারা উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসি হয়েছেন তারা সাধারণত দক্ষ শ্রমশক্তি। দক্ষ শ্রমশক্তি হলে সাধারণ ভাবেই ধারণা করা যায় তাঁরা দেশে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সেটা হলে তাদের কর্ম বা পেশার কারণে যে সেবা প্রদান ও উৎপাদন করেছেন তার মাধ্যমে হয়তো তাদের সেই রাষ্ট্রীয় আর্থিক দায় শোধ করতে পেরেছেন। কিন্তু যেহেতু সে ধরণের কোন তথ্য ও গবেষণা নেই সে কারণে যুক্তরাজ্যের মত করে সহজেই পরিষ্কার করে সে কথা বলে দেয়া যাচ্ছে না। সেটাই যদি হয় তাহলে অযৌক্তিক আবেগ ও উত্তেজনার এমন মন্তব্য করে প্রবাসীদের আঘাত-অপ্রস্তত করা কি সমীচীন? প্রবাসীরা বিদেশে বসবাস করে আপনার শুধু সেটাই দেখেন তারা যে দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন ভাবে ভূমিকাও রাখে সেটাও তো বলতে হবে।

স্বজাতির কেউ বিদেশে থাকার কারনে তার কথা-চিন্তা যদি আপনাদের ভাল না লাগে পছন্দ না হয় তাহলে বিজাতীয়দের কথা-চিন্তা গ্রহন-অনুসরণ কি ঠিক? যেমন কার্ল মার্কসের জন্ম জার্মানে। নানা দেশে ঘুরে শেষে ইংল্যান্ডে থাকার সুযোগ পেয়েছেন এবং সেখানেই মারা গেছেন। সেখানে বসেই তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন, থিওরি-দর্শন দিয়েছেন। আর তার সেই দর্শন ও চিন্তাধারা সারা দুনিয়ার মানুষ জেনেছেন। যাঁরা তাঁর চিন্তাধারাকে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক মনে করেছেন তা গ্রহন করে নিজ নিজ দেশে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন ও করছেন। এমনি শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুণীজনরা মত-চিন্তা প্রকাশ করেছেন, অজ্ঞ-মূর্খ, ধর্মান্ধ, কূসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ছাড়া সবাই তাকে গ্রহন করে এগিয়ে গেছেন। চিন্তা সবসময়ই উন্মুক্ত ও সার্বজনীন তার কোন দেয়াল ও সীমারেখা নেই।

গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া দু’টি বড় রাজনৈতিক ঘটনার উল্লেখ করছি। যে দুই ঘটনার অভিঘাত এখনো প্রবাহমান।
১) লেনিন ছিলেন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে। সেখানে বসেই লিখছিলেন এপ্রিল থিসিস। আর এর  ছ’মাস পরে ঘটেছিল রুশ বিপ্লব।
২। আয়াতুল্লাহ খোমেনিকেও দেশ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। নির্বাসনে থেকেই তিনি তার দেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। নির্বাসন থেকে ১৫ বছর পরে উনি ফিরে আসার মধ্য দিয়ে ইরানের পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপটই পরিবর্তন হয়ে যায়।
এই দু’জন সম্পুর্ন বিপরীত চিন্তা/দর্শনের মানুষ দুনিয়ার কোন মানচিত্রে ছিলেন তার সাথে তাদের দেশের প্রতি টানের মাত্রাভেদ করা কী সম্ভব?

 

২। দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন না করা 

প্রবাসী হওয়া ও দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করার অর্থ আসলে কি? কিভাবে, বা কি করলে দায়িত্ব পালন করা বুঝায়? এই প্রশ্নটি তিন ভাগে আলোচনা করেছি।

() দেশে থেকে সরকারিবেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্ম করা, উদ্যেক্ত হওয়া, ব্যবস্যাবাণিজ্য করা বা আরো না না পেশাসখের সাথে যুক্ত হওয়া।

প্রথমত, বিশ্বে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার সর্বাধিক। শিক্ষিত মানুষের প্রায় ৩৭ শতাংশ বেকার। সেক্ষেত্রে একটা চাকরি বা কাজ পাওয়া সহজ নয়। এদেশে চাকরি পাওয়া খুব সৌভাগ্যের বিষয়। আর সরকারি চাকরি মানে তো একটা সোনার হরিন। তারপরে সেটা জোটাতে মামা-খালু, রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থকড়ি লাগে যা সাধারণ মানুষের নেই। তারপরে যারা কোনভাবে চাকরি একটা জোটাতে পারেন তাদের অধিকের জন্য সততার সাথে কাজকর্ম ও জীবন-যাপন কঠিন হয়ে ওঠে। সীমিত আয়, সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার কথা ভেবে একটা অংশ কোন এক সময় উদ্বিগ্ন ও হতাশা থেকে দেশান্তর হয়।

চাকরির বাজার কঠিন হওয়ায় তরুণদের একটি অংশ ছাত্রাবস্থাতেই ঠিক করে ফেলে লেখাপড়া শেষ করেই বছরের পর বছর চাকরি না খুঁজে বিদেশ চলে যাবে। কারণ তারা অনিশ্চিত জীবন কাটাতে চান না। আবার তাদের প্রতিষ্ঠার উপর তাদের পরিবার নির্ভরশীল। ফলে তরুণরা এক কঠিন পরীক্ষা ও বাস্তবতার সম্মুখীন হন। তাহলে শিক্ষার্থীদের এই সংকট ও সমস্যার দায়টা কার? তারা যখন নিজেদের জীবনের একটা গতি নিজেরাই করে নিতে বিদেশে চলে যায় তখন আপনারা তাদের দেশপ্রেমহীন, অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর বলে কথা শোনান। সেটা কি ঠিক? রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব নিতে পারলে- তাদের আর কি করার ছিল? আপনার কি চান, চাকরির বাজারে ঘুরে ঘুরে এই হাজার-হাজার, লাখ-লাখ তরুন  তাদের জীবনটা নষ্ট করুক? কেউ বলতে পারেন, চাকরিই কেন করতে হবে, চাকরিই কি জীবনের সব? ব্যবস্যা করতে পারে, কৃষিকাজ করতে পারে, না হয় রিক্সা চালতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু সবাই কি সব কাজ করতে পারে? অতপর সবার কি সেই সুযোগ ও সামর্থ আছে? কিন্তু সেক্ষেত্রে এ ভাবনা কি শিক্ষায় বিনিয়োগের অবমূল্যায়ন নয়? প্রবাসীদের বেলায় সে হিসেবে করলে এখানে নয় কেন? কেউ বলতে পারেন, চাকরিই কি জীবনের সব? অন্য কিছুও তো করা যায়, প্রয়োজনে হকার হবে, রিক্সা চালাবে ইত্যাদি। সেটা করা হলে কি একজন উচ্চশিক্ষিত নাগরিকের শিক্ষায় বিনিয়োগের অবমূল্যায়ন করা হলো না? বিনিয়োগের হিসেবেটা প্রবাসীদের বেলায় করছেন এখানে কেন করা হবে না?

() সংসার, বাবামা সেবা যত্ন করা, সমাজকর্ম রাজনীতি করা ইত্যাদি। 

জীবনের নিরাপত্তা তথা প্রয়োজনীয় আয়-উপার্জন না থাকলে দেশ-সমাজ তো দূরের কথা নিজের জীবনই হয়ে উঠবে হুমকি। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলে তখন সবাই সংসার করে, পরিবার-পরিজনের দায়িত্ব পালন করে। সেটা দেশে হোক আর বিদেশেই হোক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কারো দেশে না থাকাকে নিয়ে। তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, কারন সে দেশের অর্থে রেখাপড়া করে বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে আলাপেই আগে করে নিলাম কেন বা কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ এই সিদ্ধান্ত নেয়। সেটা কি আপনারা অন্যায় মনে করছেন? আপনি বলতে পারেন তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক যোগ্য আছেন/ছিলেন তারা ইচ্ছে করলেই এখানেই ভাল চাকরি করতে পারতো কিন্তু তারা আসলে উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে গেছে। কি হতে পারতো, কেন হয়নি, সে বিষয়ে কি কোন গবেষণা হয়েছে? সরকারই বা কেন তাদের যেতে বাধা দেয়নি? সেটা যদি তারা না করে তাহলে আপনি তাদের অপবাদ দেয়ার কে? সেটা কি তাহলে ঈর্ষা বা অনধিকার থেকে নয়?

আর সমাজকল্যান, রাজনীতির কথা যদি বলেন তাহলে বলবো তাহলে সে কাজ যারা করছে, তাদের প্রতি আপনাদের ধারণা কি ইতিবাচক? বরং বলা হচ্ছে এটা পঁচে গেছে, নষ্টদের দখলে গেছে, এটা একটা ব্যবস্যা ইত্যাদি। অথবা এদের মধ্য বা এদের বাইরে যারা সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান তাদের পিছনে কয়জন মানুষ আছে? বলছেন, এখন নির্বোধ লোকেরা নীতি-আদর্শের কথা বলে, এই সব দল করে। মানুষ হতাশ হয়ে বলছে এদেশে কিচ্ছু হবে না। সব লুটেপুটে খাচ্ছে কিছু লোক। তার জন্য কোন প্রতিবাদ নেই। আপনাদের ভাষায় যারা দেশে আছে তারা দেশপ্রেমিক তারা বিদেশের উন্নত ও নিরাপদ জীবন গ্রহন করেনি। সেই মানুষগুলো কি কাজ করছে? দেশ ও সমাজের প্রতি কি দায়িত্ব পালন করছে? বিদেশে না যেয়ে শুধু দেশে থাকাই কি দেশাত্ববোধের কাজ? তাহলে যারা বিদেশে আছে তারাও তো সেই কাজই করছে। পার্থক্য শুধু স্থানের নয় কি?

() আর যারা আয়ইনকাম করেন, যাদের সম্পদ আছে তারা সরকারকে করখাজনা প্রদান করার মাধ্যমে দেশের প্রতি ভূমিকা পালন করেন।  

ট্যাক্স বা কর হল একটি বাধ্যতামূলক আর্থিক চার্জ যা দেশের উন্নয়নের জন্য সরকার কর্তৃক ব্যক্তি বা সংস্থার উপর আরোপ করা হয়। আর ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এই করের প্রতিদান স্বরূপ রাষ্ট্রের নিকট থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভ করেন। যেমন নাগরিকরা সরকারি পথ-ঘাট-স্টেশন-পার্ক-লাইট-ডাস্টবিন, শিক্ষা-চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ধরণের সেবা পেয়ে থাকেন। যারা দেশ বসবাস করেন তাদের প্রতিমুহূর্তে এ সুবিধাসমুহ গ্রহন-ব্যবহার করতে হয়। যারা বিদেশে বসবাস করেন তাদের বাংলাদেশ সরকারকে কোন কর দিতে হয় না। তারা দেশের কোন সুবিধা গ্রহনও করেন না। তারা যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশে পাঠান সেটা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কর দেয়াকে কি কনট্রিবিউট বলা যায়? কর হচ্ছে একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা। যে কারণে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে আয় কর দিতে হয়। আর কন্ট্রিবিউশন বলতে, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থার রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি জ্ঞানবিজ্ঞান, সভ্যতার উন্নয়নে কোন অর্থপূর্ণ কর্ম ভূমিকাকে বুঝায়। বাংলায় আমরা যাকে অবদান বলি।

যেমন যারা ভাষা, স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছে, তারা কোন আর্থিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে সেটা করেনি। নিশ্চিত বিপদ মৃত্যুর কথা জেনেও তারা এই সংগ্রাম যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে! আজ আমরা যে ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের অধিকার ভোগ করি এটা তাদের অবদান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন কারো দান বা করের অর্থে আসেনি! বরং শাসক ট্যাক্সের টাকা এই সংগ্রামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে করছে!

কোন ব্যক্তি যদি চাকুরী ও ব্যবস্যা-বাণিজ্য থেকে অর্জিত আয়ের কর প্রদান করেন তাকে কন্ট্রিবিউশন বলা যেতে পারে। তবে এ দুয়ের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। কেননা করের বিনিময়ে নাগরিকরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা গ্রহন করেন। সুতরাং নাগরিকের কর প্রদান- প্রাপ্তির স্বার্থে ও বিনিময়ে।

কিন্তু বাংলাদেশে এক শ্রেনীর নাগরিক অহঙ্কার করে বলেন যে, আমরা সরকারকে ট্যাক্স দেয় বলেই দেশ চলে! দেশ-সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা কোন ব্যক্তি কখনো কোন প্রতিদান আশা করেন না। মনে রাখা দরকার বাংলাদেশে ট্যাক্স নিবন্ধিত নাগরিকের সংখ্যা মাত্র ১২/২০ লাখ! জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম। জিডিপিতে এর ভূমিকা ৮/৯ শতাংশ। আর জিডিপিতে বৈদেশিক মুদ্রার ভূমিকা ১১/১২ শতাংশ। প্রবাসীরা এদেশে থাকেন না বিধায় তারা কোন সরকারি/নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও গ্রহন করে না।

() উন্নত জীবনের প্রশ্ন অভিবাসন 

মানুষ বিদেশ যায়, তার অনেকগুলো কারণ আছে। মোটদাগে বলা যায়, কাজের সুযোগ, অধিক আয়, সামাজিক নিরাপত্তা, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রধানত। দেশে এই সুবিধা না থাকার কারণে তরুণরা বিদেশ মূখী হয়। তাদের বিদেশ মূখী হওয়ার পিছনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী। এক্ষেত্রে যারা চলে যাচ্ছে তাদের দায় এই অর্থে আছে যে, তারা দেশে থেকে এই অবস্থার পরিবর্তনে/উন্নয়নে ভূমিকা না রেখে চলে যাচ্ছে। এখানে তাদের সমালোচনা হতে পারে। আবার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন করতে যেয়ে বিপদ-বিড়ম্বনা আছে সেটা গ্রহন করার মানসিকতা, অবস্থা সবার নেই। সে জন্য এই আলোচনা খুব সরল নয়।

অভিবাসন নিয়ে একটু কথা বলা যাক। অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন হচ্ছে চলাচল, স্থানান্তর। এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়া। গ্রাম থেকে শহর, ছোট শহর থেকে বড় শহর বা রাজধানী, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া ইত্যাদি।

যে গ্রামে জন্মগ্রহন করে, সে/তারা জীবনের কোন এক সময় লেখাপড়া, চাকরি, ব্যবস্যা বা নানাবিধ কারণে উন্নত জীবন ও নিরাপত্তার আশায় জন্মস্থান/নাড়িপোতা মাটি ছেড়ে শহর/রাজধানীতে চলে যায়, সেখানেই স্থায়ীভাবে বাস করে। একেই অভিবাসি বলে এই অভিবাসী যেমন দেশের মধ্যে হতে পারে আবার এক দেশ থেকে আরেক দেশেও হতে পারে। কোন এক সময় তার জন্মস্থান শৈশব-কৈশর-স্বজন হয়ে ওঠে অতীত ও স্মৃতি। যে/যারা নিভৃত গ্রাম থেকে বড় শহর বা রাজধানীতে এসেছে সেটাও উন্নত জীবন, সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্যই এসেছে।

উন্নত জীবন-নিরাপত্তার আশায় যখন কোন ব্যক্তি/পরিবার এক দেশ থেকে অন্য দেশে যান আপনারা তখন তাদেরকে চিত্রিত করেন লোভী, স্বার্থপর, দেশপ্রেমহীন। কিন্তু কারন তো একটাই। নয় কি? কিন্তু একজনকে বলা হচ্ছে স্বার্থপর অন্যজন নিজেকে মনে করছে দেশপ্রেমিক। তা কি যৌক্তিক? যিনি উন্নত জীবনের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে আসলেন তিনি তো সুযোগ পেলে অবশ্যই বিদেশে যেতেন, তাই নয় কি?

বলতে পারেন যারা দেশে আছে তারা তো অন্য দেশে যায়নি। তারা দেশে থেকে মানুষের সেবা করছে। কিন্তু এই মানুষদেরই যদি আপনি কোন গ্রামে বা থানায় গিয়ে কাজ করতে বলেন, করবে? কয়জনকে পাবেন তখন গ্রামে গিয়ে থাকার জন্য

গ্রামে জন্ম বেড়ে ওঠা মানুষেরাই কর্মজীবনে আর গ্রামে থাকতে চায় না, শহরেই থাকতে চায়। একজন ডাক্তারকে কোন থানায় পোস্টিং দিলে তিনি বাধ্য না হলে সেখানে যান না। আর গেলেও ধারাবাহিকতা রাখেন না। অধিক ক্ষেত্রে নামমাত্র হাজিরা দিয়ে তারা শহরেই থাকেন। কারণ শিক্ষা, পরিবেশ, আনন্দবিনোদন উন্নত জীবন। এটাই বাংলাদেশের স্বাভাবিক সাধারণ দৃশ্য তখন অন্যদের কিভাবে বলেন উন্নত জীবনের জন্য বিদেশ চলে যায়? আপনারা নিজেরাও তো উন্নত জীবন ছেড়ে গ্রামমফস্বলে যেতে চান না, তাই না? তাহলে দেশপ্রেম কোথায় গেলে? সে জন্যই বিষয়টা আপেক্ষিক সম্পর্কিত। দেশপ্রেমের বিষয়টিকে এভাবে সরলীকরণ করার সুযোগ নেই। 

আপনাদের কাছে গ্রাম অবহেলিত যারা বিদেশে থাকে তাদের কাছে হয়তো দেশ অবহেলিত কূটতর্কে বিষয়টা তো একই। যার বিদেশে বা উন্নত দেশে যাওয়ার সুযোগ আছে সে সেখানে যাচ্ছে, আর যার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তারা দেশেই থাকছে কিন্তু দেশের অবহেলিত গ্রামাঞ্চলে যেতে চাইছে না। তাই শুধু অবস্থানগত কারণে প্রবাসীদের ভুল অপবাদ নিজেদের মহিমান্বিত করা হচ্ছে অযৌক্তিক গ্রহনযোগ্য

আর যারা বিদেশে না আসতে পেরেছেন আপনাো চান আপনার সন্তান যেন কোন উন্নত দেশে যেয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। অনেকে তাদের সন্তান, পরিবারকে বিদেশে রেখে দেশে চাকরি, ব্যবস্যা করছেন। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে তাদের পরিবারকে পাঠাচ্ছেন। সেই অর্থে দেশে বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে। নয় কি? কিন্তু সেখানে আপনাদের বক্তব্য, প্রতিবাদ কোথায়?

তারেক রহমান, সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশ থেকে দল পরিচালনা করেন, নির্দেশণা দেন সেটা নিয়ে তেমন আলোচনাবিতর্ক কোথায়? তখন এই সব দলের প্রতি আনুগত্যে কোন সমস্যা হয় না। ভারতের নাগরিক আমর্ত্য সেনও বিদেশে থাকেন তার মানে কি তিনি অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর, দেশপ্রেমহীন? নাকি তাঁকে নিয়ে বাঙালিরা গর্ব করে? মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের কি বলা হবে, দেশপ্রেমহীন

সরকারী হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটির উপরে। বাংলাদেশে শিক্ষিত যুবকের অর্ধেকেই (৩৭%) বেকার। দেশে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। এই স্বার্থপর, দেশপ্রেমহীন মানুষেরা যদি দেশে ফিরে আসে, আছে তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান? যারা দেশে বেকার আছে তাদেরই কোন গতি নেই এদের তাহলে কি হবে? এই যুবক-তরুণরা নিজেরাই নিজেদের গতি করতে বিদেশে চলে গেছে। দেশের রেমিটেন্সে ভূমিকা রাখছে। সেটা কি আশির্বাদ নয়?

প্রবাসীরা না থাকায় দেশের ক্ষতি হয়েছে সেটা বলছেন কিন্তু কি সুবিধা হয়েছে সেটা বলছেন না কেন

১। ‍উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একট বড় অংশ চাকরিরর বাজার ও প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাড়িয়ে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমিয়েছে।

২। তারা দেশের রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ী, পয়নিষ্কাসন, গাড়িঘোড়া, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ অন্যান্য সুবিধা ব্যবহার না করে নাগরিক জীবনের উপর চাপ কমিয়েছে।

৩। প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণে ভূমিকা রাখছে। নানা খাতে বিনিয়োগ করছে। আত্মীয়-স্বজনদের বিদেশে চাকরি-লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে।

৪। বাংলাদেশে একটি দক্ষ-অদক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানীকারক দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে।

৫। সংখ্যায় কম হলেও প্রবাসীরা উন্নত দেশের সরকার-প্রশাসনের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, দেশের জন্য গৌরব তৈরী করছে।

দেশে এখনো প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা ১৮ কোটি তাহলে দেশের এই দূরাবস্থা কেন? তারা তো দেশপ্রেমের কারণেই দেশে আছে তাই না? না কি বলবেন, আমরা খারাপ হলেও দেশে আছি আপনাদের মত দেশ ছেড়ে পালাইনি। কিন্তু এমন কথা কি গৌরবের?

ব্যতিক্রম বাদে দেশে কর্মরত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক, কর্মকর্তা, আমলা, তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কি উন্নত ইতিবাচক? সাধারণর ভাবনা, ডাক্তাররা ডাকাত, ইঞ্জিনিয়াররা চোর, আমলারা দুর্নীতিবাজ, ব্যাংকাররা লুটেরা, ব্যবসায়ীরা পাচারকারী ইত্যাদি। তাহলে তো এরা বিদেশে এসে দেশের জন্য ভালই করেছে, না হলে এরাও দেশে একই কাজ করতো, নয় কি? বা করতে বাধ্য হতো। এই সব চোরডাকাতদুর্নীতিবাজলুটেরাপাচারকারী দেশ থেকে চলে গিয়ে দেশের ভালই করেছ। এতে তো আপনাদের স্বস্তি বোধ করার কথা তাহলে ক্ষুব্ধ কেন?

আর দেশে-বিদেশের এই কূটতর্কগুলো আসে মানুষের স্বার্থ-সমীকরণ-রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে। এই আলোচনা অনেক বড় কোন পূর্ণাঙ্গ লেখায় তার বিস্তারিত নিয়ে আসবো। অতএব প্রবাস থেকে যারা দেশ নিয়ে কথা বলেন, লেখালেখি করেন তাদের প্রতি এমন মনোভাব শোভন ও যৌক্তিক নয়। বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান তাদের সেই অধিকারকে স্বীকার করে। তাহলে আপনার কোন অধিকার ও নৈতিকতায় এমন কথা বলেন?

দেশে ঘুষদুর্নীতি, অন্যায়, অনিয়ম, অনাচার, অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, সন্ত্রাস, অপরাজনীতি নিয়ে যদি কোন যৌক্তিক আলাপ থাকে তার জবাব আলোচনাতেই দিতে হবে। বিদেশ থেকে লেখালেখির কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেই অথবা চিন্তার সাথে না গেলেই ব্যক্তিগত আক্রমন করবেন তা অশোভন গ্রহনযোগ্য নয়। 

————————————————————————-

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক