বহুদিন পরে একবার আমার সেই প্রিয় নদীর প্রিয় বালুচরের বায়ু সেবনের ইচ্ছা হলো। গেলাম সেখানে। পরনে রিপড জিন্স, পায়ে জর্ডন স্নিকার। এই বেশে এখানে কেন! নিজের চরিত্র দোষে হয়তোবা। সবাই কেমন দূরে দূরে। আমি কি সবার পর হয়ে গেছি এই দেশে, এই বেশে! হঠাত করে বালুচরের সেই পুরান নেড়ে বটগাছের তলায় কেনা গায়েনের সাক্ষাত। সেই শতছিন্ন কেনা বাউল। আমাকে দেখেই গান থামিয়ে পরম স্নেহে কাছে ডেকে বললো- সেখের পো, হাল কি? একখান সিগারেট দেও দিনি, তোমাগো সায়েবী সিগারেট।
গায়েনের বলার ঢং দেখে মন ভিজে গেল। বসে পড়লাম পাশে। পাঁচ’শ পঞ্চান্নর পুরা প্যকেটটা তাকে দিয়ে বললাম- নেও তুমারে দিলাম।
-আমি কি তুমার কাছে পুরো প্যাকেট চাইছি?
একটা নিলো, পুরাটা নিলো না। আমার প্রবাস-গর্ব একটুখানি খাটো হলো বা। মনে পড়ে গেলো, সেই শিশুকালে হাটবারে ঠিক এই অশীতিপর বটগাছের নীচে বসে তার গান শুনতাম থুতনীর নীচে হাত রেখে ছদ্ম-মনোযোগে। গান শেষ, শিশু আমি বসে আছি ঠিক সেই ভাবে। কাছে এসে কেনা গায়েন আমার অস্তিত্বটাকে চমকে দিয়ে বলতো- কিগো সেখের পো আরো গান শুনবা? একটা বড় বিচীকলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো- এইডে নিয়ে বাড়ী যাও, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
সেই বহুপুরানো আমার মন-স্বজন যুবক বাউল আজকে বৃদ্ধ, বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ। সংসার হয়নি, করে নি। কারো কাছে কিছু চায় না। দশটা দিলে নয়টা ফেরত দিয়ে দেয়। চাহিদা নেই, উচ্চাশা নেই- একবিংশ শতকের এক বিস্ময় মানব।
হঠাত করে চমকে তার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললাম- গায়েন তুমার সেই চুল-দাড়ি কই?
কোন উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে রইলো যেন মন-সাইজির ধ্যানে। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো তার। উত্তরের জন্যে আবার একটা তাগাদা দিলাম। হাত-শরীর কেঁপে উঠলো, রাগে না অভিমানে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
-আগের জম্মে পাপ ছেলো, তারই খ্যাশারত দিতি হলো সেখের পো, খ্যাশারত। নিজির শরীরডাই যেন অন্য কারুর হয়ে গেছে- ডরাই, বিস্তর ডরাই এহন। আমি যাই, বেলা গেল।
কেনা গায়েনের বেলা যায়। তার গমন পথে ধুসর পৃথিবীর ছায়া পড়ে। আমি বসে থাকি বৃদ্ধবটমূলে। মুখে হাত দিয়ে বসে ভাবি, শেষে এই নিঃস্ব কেনাকেও খেশারত দিতে হলো, ধর্মীয় বিচ্যুতির খেশারত? কী না পারে এই ধর্ম!!!