একাত্তরের শব্দসৈনিক রাশেদুল হাসান গতকাল ( ২২ ডিসেম্বর) সকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। পত্রপত্রিকায় রুটিন রিপোর্টের বাইরে তাকে নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখা হয়নি দেখলাম। খুবই অপরিহার্য যে তথ্যটিও ঠিকমত আসেনি সেটি হচ্ছে, উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলি ছিলেন। মুক্তমনাতেই আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা প্রধান কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকার পোস্ট করেছিলাম। (লিঙ্কঃ https://blog.mukto-mona.com/2013/09/13/37411/) । সেখানে কথোপকথনে রাশেদুল হাসানের এক অসামান্য কীর্তির কথা উঠে এসেছিল। গত দুইদিনে যেহেতু সেই বিশেষ ঘটনাটির কথা আলোচিত হতে দেখলাম না তেমন, তাই ভাবলাম ঘটনাটির কথা আলাদা করে পোস্ট করা উচিত।
আমি সরাসরি সাক্ষাৎকারের সেই অংশটুকু তুলে দিচ্ছিঃ
==
–এই প্রসঙ্গেই আসতে চাচ্ছি,এই যে বেলাল মোহাম্মদের কথা বললেন,অন্যান্যদের কথা বললেন যারা কিনা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পর্দার অন্তরালেন মানুস ছিলেন,আমাদের বর্তমান মিডিয়া কি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে আনতে পেরেছে?
কাঃলোহানীঃ…আমার মনে হয়…আদৌ পারেনি…এখনও আবদুল্লাহ আল ফারুক বেঁচে আছেন,শরফুজ্জামান বেঁচে আছেন,আমিনুর রহমান বেঁচে আছেন,মোস্তফা আনোয়ার বছর তিনেক আগে মারা গেছেন,প্রধান প্রকৌশলী সাকের সাহেব-ও আজ আমাদের মাঝে নেই…আমি আসল ছেলেটির নামই মনে করতে পারছিনা…যে ছেলেটি ট্রান্সমিটারটি উঠিয়ে নিয়ে পরে ইন্সটল করেছিল…
–রাশেদুল হোসেন কি?
কাঃলোহানীঃ হ্যাঁ হ্যাঁ…রাশেদ রাশেদ। young man, he was technical operator.ইঞ্জিনিয়ারও তখনও নয়…সে ট্রান্সমিটারটি খুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল যখন পাকিস্তানিরা বোমা বর্ষণ করে ওটাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল কালুরঘাটে,এটাকে তখন উঠিয়ে নিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তের নিকটবর্তি বগাফার জঙ্গল নিয়ে যাওয়া হয়।রাশেদ সেখানেই ট্রান্সমিটারটিকে স্থাপন করছিল,without looking at the copybook!!কারণ কপিবুক তো তখন তার কাছে নাই।সেগুলো কিছুই সে দেখেনি,কিন্তু তারপরও সে সেটিকে ইন্সটল করেছিল।সেটা দেখে ইন্ডিয়ার তথ্য ও বেতারের প্রতিমন্ত্রী মি.নন্দিনী অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।এবং তখনকার অল ইন্ডিয়া রেডিও-র প্রধান প্রকৌশলী অবাক হয়ে বলেছিলেন যে এই তরুণ কিভাবে এটা সম্ভব করল!আসলে দেশপ্রেম ও মাটির প্রতি আনুগত্য যদি থাকে তাহলে যেকোন মানুস যেকোন জিনিস জয় করতে পারে…এটা হল তারই একটি প্রমাণ।আর রাশেদ তাই একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে আছে আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাসে।
==
রাশেদুল হাসান যেদিন মারা গেলেন তার আগেরদিনই দেশের ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এতে বিএনপির পলিটিকাল গেইন কি হল জানি না কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বহুল প্রতিষ্ঠিত একটা ফ্যাক্টকে বিতর্কিত করে খালেদা জিয়া মূলত জামায়াতি বুদ্ধিজীবীদেরই পারপাস সার্ভ করলেন। তবে দুঃখজনক হল এমন বক্তব্যের পর আমাদের দেশের কোন সাংবাদপত্রে প্রতিবাদলিপি ছাপানো হল না, কোন টিভি চ্যানেল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কথার প্রতিবাদ জানানো হল না। নিরপেক্ষতার বিলাসিতায় মগ্ন আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো দিনে দিনে এতোটাই নির্লিপ্ত আর মেরুদন্ডহীন হয়ে যাচ্ছে যে মানে মধ্যে মনে হয় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তদানের এমন অপমান বুঝি আর কোন ভাবে হতে পারতো না। বাংলাদেশ মনে হয়ে বিরলতম দেশ যেখানে সংবাদপত্রের সুনির্দিষ্ট কোন সম্পাদকীয় নীতি নেই। পাকিস্তান ১৬ ডিসেম্বরে হারলেও ১৪ ডিসেম্বরে তারা জিতেছিল, আমরা হেরেছিলাম, যে হারের ক্ষত এখনও শুকায়নি। যেকারণে রাশেদুল হাসানদের মৃত্যু সংবাদ ছাড়া আর কিছুই পাইনা আমরা পত্রিকার পাতায়, আর মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করে যেকোন ধরণের বক্তব্য প্রদান করা যায় সংবাদ সম্মেলনে কোন ধরণের কোন প্রশ্ন/জবাবদিহিতা ছাড়াই।
রাশেদুল হাসান, যেখানেই থাকবেন ভাল থাকবেন। আমরা দুঃখিত যে আপনাদের আত্মত্যাগের যথাযথ প্রতিদান আমরা দিতে পারিনি।
পুনশ্চঃ তথ্যঃ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ এই নামটি দিয়েছিলেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, বেতারকেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক।
রাশেদুল হাসানের মত যোদ্ধাদের কাহিনী গুলো নিয়ে আরো বেশি বেশি লেখা আশা করছি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু ইতিহাস মাত্র নয় সংগ্রামী সাধারন মানুষের অসাধারন অবদান রাখার আলেখ্য। এই আলেখ্য গুলোই আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে প্রেরনা দেবে।
আমরা দুর্ভাগা দেশের অভাগা সন্তান।
শহীদের মহাত্মারা এই জাতি কে কখনো ক্ষমা করবে না! অজস্র অভিশাপ কখনো বড় হওয়া যায় না… 🙁
সময় কাউকে ক্ষমা করবে না।