সহস্র সাবান মাখিলেও বাঙালির গায়ের রঙ ইংরাজের মত বিশ্রী উৎকট ধবল বর্ণ হইতে পারে না ও সহস্র কোট পরিলেও বাঙালির স্নিগ্ধ মনুষ্য-মূর্তি বিকট নেকড়েবাঘ-মূর্তিতে পরিণত হইতে পারে না! – সোনায় সোহাগা, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

– কোনো মানবিক মানুষ কীকরে অন্য মানুষের গায়ের রঙকে বিশ্রী উৎকট বলতে পারে? যে মানুষ নিজের ও নিজেদের গায়ের রঙকে অতি আশ্চর্যজনকভাবে সুন্দর এবং চমৎকার মনে করে অন্যের ও অন্যদের গায়ের রঙকে মনে করে বিশ্রী উৎকট সে মানুষ কি মানবিক মানুষ? এরকম যে মনে করতে পারে কী রকম তার মানসিকতা? অন্য মানুষের গায়ের রঙ কিংবা চেহারাকে যে ঘৃণা করে সে কেমন মানুষ?
– বাঙালিরাই কি কেবল স্নিগ্ধ মনুষ্য-মূর্তি? পশ্চিমের কোট পরা লোকজনের মধ্যে স্নিগ্ধতা ও মনুষ্যত্ববোধ কি নেই আদৌ? পশ্চিমের লোকেরা সবাই কি নেকড়েবাঘ? অথবা কোট পরলেই কি মানুষ নেকড়েবাঘ হয়ে যায়? অন্যের পোষাক নিয়ে এহেন ঘৃণ্য মন্তব্য যে করতে পারে সে কেমন মানুষ? নিজেকে ও নিজেদেরকে অতি উন্নত মানুষ এবং অন্য ও অন্যদেরকে যে নিচু মানুষ মনে করে সে কেমন মানুষ, কতটুকু মানবিক মানুষ?

অন্য মানুষের গায়ের রঙ ও পোষাক নিয়ে এই হীন কথাগুলি কোনো সাধারণ বাঙালি বলেনি কিন্তু। বলেছেন, অতি উচ্চমার্গের শিল্প সাহিত্য সভ্যতা ভব্যতা রুচি আচার-আচরণ সংস্কৃতি ইত্যাদির তীর্থস্থানতুল্য সুবিখ্যাত জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ির এক বিখ্যাত সন্তান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই অভ্যাস অধিকাংশ সাধারণ বাঙালির মধ্যে আরো প্রকট।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেক ভাই জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর গায়ের রঙ নাকি শ্যামলা ছিল। এজন্য তাঁকে নানান খোঁচাপূর্ণ কথাবার্তা শুনতে হতো। সে বাড়ির বৌ ও ছেলেদের নিয়মিত হলুদ বাটা, দুধের সর, ময়দার লেয় ইত্যাদি সুস্বাদু খাবার গায়ে গতরে মাখতে হতো ফর্সা হয়ে সুন্দর হবার জন্য। কাদম্বরী দেবী রবিকে ঠাট্টা করে প্রায়ই বলতেন, রবিটা একটুও দেখতে সুন্দর না একদম কালো।

সম্মন্ধ করে বিয়ের ক্ষেত্রে বাঙালিরা সবসময় ফর্সা মেয়ে খোঁজে। গায়ের রঙ কালো হলে অন্য যত গুণাগুণইই থাকুক না কেন সে মেয়ে বিয়ের পাত্রী হিসেবে অনেক কম নাম্বার পায় পাত্র পক্ষের কাছ থেকে। অনেক ক্ষেত্রেই বাদ পড়ে যায়। বাংলাদেশের বাজারে কালো মেয়েদের গায়ের রঙ ফর্সা করার জন্য ক্রিম পাওয়া যায়। টিভি রেডিও এবং পত্রিকায় এসব ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে। দেখানো হয়, একটি মেয়ে আগে কালো ছিল এইসব ক্রিম ব্যবহারের পর ফর্সা হয়ে সুন্দর হয়ে গেছে। কালো রঙের কারণে আগে সুন্দর ছিল না। বিয়ের বাজারে বাদ পড়ে যেতো। এই ক্রিম ব্যবহার করে ফর্সা ও সুন্দর হবার পর বিয়ে হয়েছে। মানুষের গায়ের রঙ, চেহারা ও বাহ্যিকভাবে মানুষ দেখতে কেমন তা নিয়ে এমন ঘৃণ্য বাণিজ্য পৃথিবীর আরো অনেক জায়গায় এখনো বিদ্যমান। বাঙালির মধ্যে তা অত্যন্ত প্রবল।

কোন এক ননদ ও শ্বাশুড়িকে তাদের বধূকে বলতে শুনেছি, এই কালো ও বিশ্রী চেহারার অতি কুৎসিত মেয়েকে ছেলের বৌ করে খুব ভুল করে ফেলেছি। সেই শ্বাশুড়ি ও ননদের গায়ের রঙ কিন্তু বৌটির চেয়ে কালো।

শুধু গায়ের রঙ নয় অন্যান্য অনেককিছুতেই বাঙালি নিজেকে ও নিজেদেরকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে থাকে। এক আত্মীয়ের সাথে একদিন ফোনালাপ হচ্ছিল। আমাকে সে বলছিল, “আজকে এক স্পেনিশ কাজ করেছিল আমার বাসায়। তাকে ভাত খাইয়েছিলাম। থালাবাসন সবচেয়ে খারাপটা দিয়েছিলাম তাকে যাতে সে খাওয়ার পরে সব ফেলে দিতে পারি। করেছিও তাই। সে খাওয়ার পর ছুড়ে ফেলে দিয়েছি তার ব্যবহৃত বাসনকোসন।” আমি তাকে বললাম, কেন আপনার জানা মতো সে লোকের কি কোনো ছোঁয়াচে রোগ আছে, যক্ষা জাতীয় কিছু? সে বলল, না, তা তো নেই। বললাম, তাহলে একজন মানুষের ব্যবহৃত থালাবাসন আপনি প্রবল ঘৃণা ভরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কেন? সে বলল, ছিঃ একজন দরিদ্র স্পেনিশ যে থালায় খেয়েছে, যে থাকা স্পর্শ করেছে সে থালায় কি আমি আর খেতে পারি? আমার স্বামী সন্তান কিংবা কোনো আত্মীয়কে খেতে দিতে পারি? আমি বললাম, সেই স্পেনিশ হত্দরিদ্র বলেই কি আপনি তাকে ঘৃণা করে তার ব্যবহৃত থালা ফেলে দিলেন? সে যদি বিত্তবান হতো, হতো দেশের প্রেসিডেন্ট তাহলে কি আপনি তা করতেন? বরং গর্ব করে কি বলতেন না, আজ দেশের প্রেসিডেন্ট আমার বাসায় ভাত খেয়েছে? এবং সেই থালাটি পরম যত্নে তুলে রেখে কেউ আসলে তাদের গর্ব করে বলতেন না, এই সেই থালা যে থালায় প্রেসিডেন্ট ভাত খেয়েছে? তাকে কি তখন সবচেয়ে খারাপ থালায় খেতে দিতেন? একজন মানুষ শুধু দরিদ্র বলেই কি তাকে এমন অচ্ছুৎ মনে করছেন? দারিদ্র কি অপরাধ? আমার সে আত্মীয় আমার একটি প্রশ্নেরও উত্তর দেয়নি।

আরেক স্বঘোষিত উচ্চশিক্ষিত মহিলাকে খুব দুঃখ করে বলতে শুনেছিলাম, দেখুন তো, আমার পায়ের গোড়ালি কেমন ফেটে গেছে কাজের বুয়াদের মতো। আরেক মহিলা একবার একজনের নাম ‘আকলিমা’ শুনে বলেছিল, আকলিমা কোনো শিক্ষিত ও ভদ্র পরিবারের মেয়ের নাম হতে পারে না। এটা তো কাজের মেয়েদের নাম। খারাপ বা অপছন্দের কিছু হলেই সেটা দারিদ্র ও দরিদ্রদের মতো ঘৃণ্য!
আরেক ভদ্রলোককে অট্টহাসি হেসে বলতে শুনেছিলাম, আমার বাসায় কোনোদিন কোনো কালাইয়া বা কালুনী আসতে পারবে না।

বাঙালির গায়ের রঙ সাধারণত বাদামি। কারো কারো রঙ একটু ফর্সার দিকে। তবু বাঙালির গায়ের রঙ যতই ফর্সাই হোক সাদাদের তুলনায় বাদামি। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালিদের দেখি, এই পশ্চিমেও কোথাও আফ্রিকান বা অন্য কোনো দেশের গায়ের রঙ কালো মানুষ দেখলে নাক সিঁটকে বলে, “কালাইয়া, কাউল্লা, কালুনী, কালী! এদেরকে লাগে কেমন, কেমন বিশ্রী? দেখতে যেমন বিশ্রী তেমনি চালচলনও বিশ্রী।’ এরকম আরো কত কি! একজন মানুষের গায়ের রঙ কেমন বা সে দেখতে কেমন তা কোনো ব্যাপার নয়। মানুষের বাহ্যিক রূপ-রঙে মানুষের বিচার হয় না, হয় গুণে। এই অতি সহজ ব্যাপারটা বেশির ভাগ বাঙালি আজো বুঝতে পারে না।

অন্য দেশী মানুষদের সম্পর্কে বাঙালিদের মন্তব্য করতে শুনি, “এদের কোনো বাছবিচার আছে নাকি? এরা যা পায় তা খায়, যা ইচ্ছা তা করে বেড়ায়, যা ইচ্ছা পরে কিংবা পরে না। এদের কোনো জাত পাত আছে নাকি? এমনটা শুধু বাঙালি বিদেশে গিয়ে করে না। বাংলাদেশে আরো বেশি মাত্রায় করে। নিজের অঞ্চলের সবকিছু ভালো আর অন্য অঞ্চলের সবকিছু খারাপ,নিজের পরিবারের সবাই অতি উত্তম আর বাইরের সবাই অতি অধম এরকম বাঙালিরা সবসময় বলে থাকে।

বিদেশে দেখতে পাই, কোনো অবাঙালি মেয়ে যদি কখনো শাড়ি সেলোয়ার-কামিজ পরে বা মাছ ভাত খায় বাঙালির বাসায় এসে তবে বাঙালি মহলে তার ধন্য ধন্য রব পড়ে যায়। কী চমৎকার মেয়ে দেখেছ? অবাঙালি হয়েও শাড়ি পরেছে! ভাত খেয়েছে! আর কোনো বাঙালি মেয়ে যদি শর্ট পরে বা বীচে গিয়ে বিকিনি পরে, বিয়ার খায় তবে তার ছি ছি পড়ে যায়। কেন? বাঙালির সংস্কৃতি কেউ গ্রহণ করলে সে মহান আর কোনো বাঙালি অন্যের সংস্কৃতি গ্রহণ করলে সে খারাপ? বাঙালিরা শুধু নিজেরাই অতি উত্তম, তাদের চেহারা মোবারক অতি উত্তম, তাদের কৃষ্টি-কালসার সবই অতি উত্তম। আর অন্যের চেহারা খারাপ, রঙ খারাপ, খাওয়াপরা খারাপ, রীতিনীত খারাপ। কেন আমাদের অধিকাংশের মানসিকতা এমন ‘আমিই ভালো আমিই ভালো, আমিই সুন্দর, আমিই চমৎকার’ টাইপ?