আপনি কয়জন বাঙালীকে চেনেন যে শর্ষে ইলিশ ভালবাসে না? কাচ্চি বিরিয়ানি অথবা গরুর রেজালা ছাড়া কোন বাংলাদেশী বিয়ে কল্পনা করতে পারেন? অনুমান করতে পারি আপনার উত্তর হবে খুব বেশি না অথবা একেবারেই না। যদিও বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত, আমি এটুকু জানি, বাঙালী মাংস ভালবাসে, মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে বেশি, আর সব বাঙালী মাছ ভালবাসে। সেজন্য মনে হতে পারে বাংলাদেশে প্রাণীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা বাতুলতা। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত।
আমি ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশ যাই আর সেই থেকে প্রতি বছর একবার বা দুবার সেখানে যাই। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সেরা সম্ভাবনা তার প্রাণোচ্ছল ছাত্র সম্প্রদায়। আমাকে আন্তরিকভাবে তারা নিজেদের মাঝে গ্রহণ করেছে এবং আমার কাজ আর দর্শন আমাকে ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছে; এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। শুরুতে আমার মনোযোগ ছিল জ্ঞানের বিজ্ঞান, মানবাধিকার, আর মূল্যবোধের দর্শন বিষয়ে। সাম্প্রতিক কালে আমি যে বিষয়ে আমার সব চেয়ে বেশি ভাবনা চিন্তা তা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি; বিষয়টি হল প্রাণীদের অধিকার ও নীতিমালা। আমি ভেবেছিলাম যে দেশে আমিষ সবার এত প্রিয় খাবার, সেখানে মানুষ আর প্রাণীদের সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার আগ্রহ থাকবে সীমিত। আমি ভুল ভেবেছিলাম। বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ই এই আলোচনায় আগ্রহী আর আমরা যেভাবে প্রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণ করি তার নৈতিক সমস্যা নিয়ে অবগত। জীবজগতের আর সব প্রাণীর মতই মানুষ এক বিশেষ সম্প্রদায়, যদিও এ কথাটি আমরা মনে রাখি না। আসলে তর্কের শুরুটা হয়ত এখান থেকেই।
আমরা যে সমস্ত প্রাণীদের খাবার হিসাবে বা অন্য যে কোন ভাবে ব্যবহার করি তারা যে শুধু আমাদের মত, তাই না বরং আমরাও তাদেরি মত এক বিশেষ শ্রেণীর প্রাণী। এটা প্রাণীবিদ্যার শ্রেণীকরণ এবং নীতিগত দিক থেকে অত্যন্ত জরুরি এক তথ্য। প্রাণীজগতের সব সদস্য কষ্ট আর আনন্দ অনুভব করে আর এই পৃথিবীতে এদের বিশেষ উপস্থিতি বিদ্যমান। তাদের সাথে কেমন আচরন করা হয়, সে সম্পর্কে তারা সজাগ। তাদের বিশ্বাস ও ইচ্ছা আছে, অনেক প্রাণীই আত্ম সচেতন আর ভাষার ব্যবহারে সক্ষম। অনেক প্রাণীর বোধশক্তি মানব শিশু আর অপরিণত বুদ্ধির মানুষ থেকে পরিপক্ক। মানবজাতি আর প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীর মাঝে স্বকীয় পার্থক্য আসলে খুবই কম, আমরা আমাদের নৈতিক অবস্থানের উচ্চতা জাহির করার সুবিধার্থে যে পার্থক্যকে বিশ্বাস করি। যদি সকল মানুষকে সমানভাবে সম্মান করা মানব ধর্ম হয় তবে সকল প্রাণীকেও শ্রদ্ধা করা উচিত। আমি বিশ্বাস করি প্রাণীকে খাবার ও বস্ত্রের প্রয়োজনে অথবা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহার করা অন্যায়। এই কারণে আঠারো বছর আগে আমি মাংস খাওয়া ছেড়ে দেই এবং নয় বছর আগে পরিপূর্ণ নিরামিষাশী হয়ে যাই সমস্ত প্রাণীজ খাদ্য- মাংস, মাছ, ডিম, দুধ- বর্জন করে। যেসব খামারে কারখানার মত পশুপ্রাণী প্রতিপালন হয়, সেই নিদারুণ দুঃখের জীবন আর ভয়াবহ মৃত্যু কারো কাম্য নয়, তবে আমাদের মত প্রাণীদের এরকম জীবনে ঠেলে দেবার প্রয়োজন কি? এক সময় আমিষ ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারত না, সেই অবস্থার আজ পরিবর্তন হয়েছে। বাঙালী রান্নায় আছে নিরামিষের অনেক রকম পদ- সব্জির তরকারি, ডাল, ভর্তার সমাহার।
প্রাণী অধিকার বিষয়ে এটা নিতান্তই প্রাথমিক যুক্তি আর এর সমর্থনে আরও বহু কথা বলার অবকাশ আছে। কিন্তু আশা করি বিষয়টির গুরুত্ব অন্তত পরিষ্কার হয়েছে। আমাদের সাথে প্রাণীদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন ভাবনার প্রয়োজন আছে কিনা সেই তর্কের আজ সময় এসেছে আর এ ব্যাপারটি পণ্ডিতদের উপর ছেড়ে না দিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করাই ভাল। যে বিষয়টি সবচাইতে মনোযোগের দাবি রাখে তা হচ্ছে প্রাণীজ কৃষি, কেননা এতে অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণী জড়িত আর এই প্রাণীর ব্যবহারও অন্য যেভাবে আমরা সাধারনত করে থাকি তা থেকে ভিন্ন।
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুযায়ী মানুষ খাদ্যের জন্য প্রতি সেকেন্ডে দুই হাজার প্রাণী হত্যা করে, মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী বাদ দিয়ে। যদি প্রাণীর অধিকার থাকে, তাহলে প্রাণীজ কৃষি বিদ্যা নৈতিক বিপর্যয় এবং এর সমাপ্তি অতি জরুরি। এছাড়াও আমিষ বর্জনের আরও অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। আমি চারজন বাংলাদেশীর সাথে কথা বলেছি যারা আমিষ বর্জন করেছেন। এই বর্জনের কারণগুলো তাঁদের কথাতেই শুনে নেই।
তাপস (৫১) নিরামিষাশী হবার সিদ্ধান্ত নিলেন কারণ তিনি প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। তিনি একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখেছিলেন, “আর্থলিংস,” যা সবার দেখা জরুরী, আর এই প্রামাণ্য চিত্র উনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মাংস, মাছ, ডিম, দুধের উৎপাদনে কতখানি নিষ্ঠুরতা জড়িত। ঊনি আমাকে বললেন যে নিজের স্বাস্থ্য আর পৃথিবীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে উনি প্রাণীজ দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত আছেন। একটি সুষম উদ্ভিদজ খাদ্যতালিকা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কর্কট রোগ, ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। তাপস আর তার স্ত্রী তনুশ্রী (৪২), দুজনেই নিরামিষাশী, দাবি করেন যে তারা শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, আর আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ আছেন। মিল্টন (৪৫) একমত হলেন, “শারীরিকভাবে আমি অনেক ভাল আছি আর আমার শারীরিক অসুবিধাগুলো আমিষ ছেড়ে দেবার সাথে সাথে দূর হয়ে গেছে।” মিল্টন ছয় বছর নিরামিষাশী ছিলেন কিন্তু পরিবারের চাপে সম্প্রতি মাছ খাওয়া শুরু করেছেন। অনেকের মতই মিল্টনের পরিবারের সদস্যরা ভুলভাবে বিশ্বাস করেন যে নিরামিষ আহার হিন্দু আচার যদিও ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত সকল প্রাণীদের প্রতি সদয় হতে নির্দেশ দিয়েছে। বলিউডের নায়ক আমির খান, যিনি মুসলিম, সম্প্রতি তাঁর ভক্তদের অবাক করে নিরামিষাশী হয়েছেন। তাঁর প্রেরণা তাঁর স্ত্রী যিনি বহুদিন ধরেই নিরামিষাশী, তাকে উদ্ভিদজ খাবারের স্বাস্থ্য গত উপকারিতার উপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখান। “ প্রামাণ্য চিত্রটি আমাকে একটি সুস্থ জীবনের উপায় দেখিয়েছে। একমাত্র দহিবড়া ছাড়া আমি ভাল সময় পার করছি। ওজনের কথা চিন্তা না করে আমি সব কিছুই খেতে পারি।”
“আমি যে কোন প্রাণী বা পাখির প্রানহরন না করেও বেঁচে থাকতে পারি, এটা মানসিকভাবে অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক“ বললেন দীপেন (৫৫) যিনি মাছ ছাড়া আর কোন প্রাণী আহার করেন না। তাপসের মতই উনি পরিবেশজনিত উপকারের কথা উল্লেখ করলেন, “মাংস উৎপাদনের জন্য প্রাণীর খাদ্যের দাবি মেটাতে ভূমির ব্যবহার করতে হয়।“ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ চিন্তার বিষয় যেহেতু দেশের ভূমিসম্পদ সীমিত। দুধ, ডিম, মাংসের, বিশেষ করে গরুর মাংসের উৎপাদন ভূমি ব্যবহারের দিক থেকে ভীষণ অদক্ষ। সয়াবিন, চাল, ভুট্টা, বিভিন্ন রকমের ডাল, গম প্রতি একর ভূমিতে অনেক বেশি প্রোটিন উৎপন্ন করে।
প্রাণীর খাদ্যের জন্য কৃষিকাজ পানি দূষণের আর পানির অপচয়ের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এক বেলা খাবারের জন্য গরুর মাংস উৎপাদনে ৪,৬৬৪ লিটার পানির প্রয়োজন কিন্তু মাত্র ৩৭১ লিটার পানি ব্যবহার করে একবেলার নিরামিষ আহার উৎপাদন করা সম্ভব। প্রাণীর জন্য কৃষি যে পরিমাণ গ্রীনহাঊজ গ্যাস উৎপাদন করে পরিবেশ দূষণ করে তা পরিবহন ক্ষেত্রে উৎপন্ন গ্যাস থেকে বেশি আর বিশ্বে ক্ষুধার পরিমাণ বৃদ্ধি করে কেননা যে পরিমাণ ক্যালরি প্রাণীদের খাওয়ানো হয়, তার অতি অল্প পরিমাণ মাংস, ডিম, বা দুধ জাতীয় খাবার রূপে তা ফেরত আসে- এ পরিমাণ ক্যালরি সরাসরি পেলে মানুষ বহুগুণ উপকৃত হতো।
প্রাণীজ কৃষি, যা কিনা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে (যেহেতু আরও বেশি মানুষ এখন মাংস কেনার সামর্থ্য রাখেন), আমাদের স্বাস্হ্যের জন্য, পরিবেশের জন্য, প্রাণীদের জন্য চরম ক্ষতিকর। এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার সময় এসে গেছে।
আশা করি এই লেখা থেকে নিরামিষভোজী আর আমিষভোজী উভয় পক্ষই চিন্তার জন্য রসদ পেয়েছেন।
অনুবাদঃ মেহনাজ মোমেন
রাইনার ইবার্ট, রাইস ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের পিএইচডি পদপ্রার্থী এবং অক্সফোর্ড প্রাণী নীতিশাস্ত্র সেন্টারের সহযোগী ফেলো। উনার লেখা পড়তে হলে rainerebert.com অথবা টুঁইটারে @rainer_ebert অনুসরণ করুন।
Food chain –এ আপনি আপনার অবস্থানকে কোন জায়গায় রাখবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার! তবে আপনি সভ্যতার এমন একটা উৎকর্ষ পর্যায়ে আছেন যেখানে দাঁড়িয়ে আপনাকে ভাবতে হয় না আগামীকাল কি খাবেন! তাছাড়া সিংহের গর্ভে জন্ম নিলেও হয়তো বুঝতেন শিকার না ধরলে অস্থি কংকাল সার দেহ নিয়ে ধীরে ধীরে মরতে হবে! Food Selection এটা সভ্যতা শিখিয়েছে প্রতিটি প্রাণী প্রজাতিকে, বেঁচে থাকার সংগ্রাম শিখিয়েছে প্রতি প্রাণী প্রজাতিকে । অভাব, খাদ্য সামগ্রী প্রাপ্তির অপ্রতুলতা প্রাণী প্রজাতিকে শেখায় খাদ্য তালিকায় কোনটি Include করতে হবে আর কোনটি Exclude করতে হবে। যদিও এই অবস্থানে এসে মানুষ সহজেই তার খাদ্য তালিকাকে রি-অরগানাইজ করতে শিখেছে নিত্য নতুন আঙ্গিকে। কাজেই উদ্ভিদ কিংবা প্রাণি কোন ম্যাটার না বাট অভাব কিংবা খাদ্য সামগ্রী প্রাপ্তির অপ্রতুলতা !!!!!!
খুব চমৎকার একটা লেখা পড়লাম। ঝরঝরে অনুবাদ। বাংলাদেশে যদি সত্যিই এ পরিবর্তন এসে থাকে তাহলেতো আশার কথা
আমার মনে হয় সবপ্রাণী খাওয়া যায়,তবে জীবিত অবস্থায় নয়,মৃতাবস্থায়।এমন কি মৃত মানুষও খেয়ে নেওয়া যায় নির্দ্বিধায়, তাতে করে প্রাণীকুলও কষ্ট পেলনা,আবার মরনের পর অবশিষ্টাংশেরও অপচয় হলনা।অনেকে মনে করবেন নিজের মায়ের মাংস কি করে খাবেন!আমি বলব নিজের মায়ের মুখে আগুন দিয়ে যদি পোড়ানো যায়,তবে তার মাংসও খাওয়া যায়,শুধু তা অভ্যস্ততার বিষয় মাত্র।
উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এটা আসলে খাদ্যচক্র। আমরা উদ্ভিদ বা প্রাণি যা-ই খাই না কেন এদের সবারই প্রাণ আছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে পুরো খাদ্যচক্রটাই খুবই বর্বর। কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই।
আমরা উদ্ভিদকে হত্যা না করে…. উদ্ভিদ যে ফল দান করে শুধু সেগুলো গ্রহন করেও বেঁচে থাকতে পারি।
এরকম বিশ্বাস বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল ভিত্তির জন্য প্রচন্ড রকমের ক্ষতিকারক।
এটা সম্ভবত উন্নতবিশ্বে যেখানে মাংশ উৎপাদনকে রীতিমত অমানবিক ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন করা হয়েছে তাদের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের দেশে বেশিরভাগ গরুই-ছাগলই তার মালিক কৃষকের সংসারে আরেকজন সদস্যের মত করেই বড় হয়।
তবে মানবীয় দৃষ্টিতে দেখলে অন্য চেতন প্রাণির জীবন নাশ করে খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস মানবজাতিকে কাটিয়ে ওঠা উচিত মনে করি। নিজে অবশ্য বেশ কয়েকবার নিরামিষাশী হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। মাসখানেক পর প্রবল পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমরা যারা আমিষভোজী, তারা নিরামিশাষীতে পরিণত হতে গেলে খাওয়া দাওয়া কীভবে পরিবর্তন করতে হবে, এই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করে একটা লেখা দিতে পারেন। শুধু ‘ডাল থেকে প্রটিন পাবেন আর পালংশাক থেকে ক্যালশিয়াম’। এভাবে বললে হবে না। একটা নিয়মমাফিক তরিকা বাৎলাতে হবে। যেমন সেটা অনুসরণ করে সুস্থ জীবন ধারণ করা যায়। অন্য ভাষায় সম্ভবত এ ধরনের লেখা আছে। কিন্তু বাংলায়, বাঙালীর খাদ্যাভাসের কথা মাথায় রেখে তেমন লেখা লেখার অনুরোধ রইলো।