রক্তাক্ত অভিজিৎ রায়ের দেহের ওপাশের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন প্রথমেই যাকে দুঃসংবাদটা জানানো প্রয়োজন মনে করেছিলাম সে অনন্ত; মৌলবাদী জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে খুন হয়ে যাওয়া অনন্ত বিজয় দাশ। প্রথম ফোনে তাঁকে জানিয়েছিলাম আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ আর দ্বিতীয় ফোনে মৃত্যু সংবাদ। সংবাদ শোনে বিস্ময় আর করুণ কন্ঠের অনন্তের প্রতিক্রিয়া ছিলো- কী বলেন এসব?

এর দুই দিনের মাথায় বইমেলায় অনন্ত বিজয়কে দেখে আঁতকে ওঠে বলেছিলাম আপনি ঢাকায় কেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি যান। অনন্ত কথা রেখেছিলেন। উত্তরে বলেছিলেন- না এসে পারিনা, বছরে একবারই বইমেলা হয়, সেখানে না এসে থাকি কীভাবে? অনন্তের হাতে তখন কয়েকটা বই। বইয়ের প্যাকেট উঁচিয়ে বলেছিলেন কিছু জরুরি বই কেনার দরকার ছিল, কিনলাম। তারপর কয়েক মিনিটের আলাপচারিতা শেষে বইমেলা থেকে বিদায় জানিয়ে বলেছিলাম সিলেট ফিরে ফেসবুকে ইনবক্স কইরেন।

এরপর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে জিন্দাবাজার কয়েক মিনিটের জন্যে দেখা হয়েছিল, রাত তখন নয় কিংবা সাড়ে নয় হবে। আমি বলেছিলাম- এই আপনি এত রাতে বাইরে কেন, তাড়াতাড়ি বাসা যান। তিনি জানতেন কেন এ উৎকণ্ঠা, তাই বললেন হ্যাঁ যাচ্ছি এখনই। আপনিও যান- এমন প্রত্যুত্তর ছিল তাঁর; এটাই সরাসরি সর্বশেষ আলাপ। এরপর আর একদিন জিন্দাবাজার দূর থেকে দেখেছিলাম তাঁকে, জানতাম না এটাই হবে সচল দেহের অনন্তকে শেষ দেখা!

এর আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছিল ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’। বইটির মূল লেখক ছিলেন ইরানি লেখক আলি দস্তি। তাঁর ‘বিশতো সেহ সাল’ নামে বইটি ভাষান্তর করেছিলেন আবুল কাশেম ও সৈকত চৌধুরী। হেফাজতের ইসলামের হুমকির মুখে কানকথায় বইটি নিষিদ্ধ করার পর ফোনে সে বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করেছিলাম অনন্ত বিজয়ের সঙ্গে।

বইটি কীভাবে সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব আবারও, প্রয়োজনে রিপ্রিন্ট করা যায় কীনা এসব। আমরা বিভিন্ন জায়গায় আলাপ করেছিলাম, এগিয়েছিলামও কিছু দূর। অনন্ত বলেছিলেন বইমেলা তবে শেষ হোক, লেখকদের সঙ্গে আলাপ করে চুড়ান্ত করবেন তিনি আদৌ কী সে পথে যাওয়া হবে। আমিও অপেক্ষা করেছিলাম বইমেলা সমাপ্তির।

এরপর বইমেলার শেষ মুহুর্তে এসে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর আসলে আমরা মুষড়ে পড়েছিলাম, কী হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ভর করেছিল। দীর্ঘ ফোনালাপের যেখানে শেষ হয়েছিল সেখানেই আমরা থেমে যাই। কিছুই করা হলো না তাঁর কিংবা আমার! আসলে পুরো দেশ সে পরিবেশই হারিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। মানুষের জীবন, মানবিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জঙ্গি মৌলবাদীদের উদ্যত চাপাতি; তুলনামূলক শক্তি বিচারে চাপাতিই শক্তিশালি হয়ে ওঠে।

ফেসবুকে অবশ্য তারপরেও কথা হয়েছে। সর্বশেষ বলেছিলাম সিলেটটুডে‘তে লিখতে। অনন্ত বলেছিলেন- হ্যাঁ লিখব। সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে নিজের ব্যস্ততার কথা জানালেন। এও জানলাম- অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রি হয়ে তবেই পত্রিকায় লিখবেন। তাঁর আর লেখা হয়নি, এখন আমরা তাঁকে নিয়েই লিখছি কেবল। এর আগে বলেছিলাম অনুপ্রাণন সাহিত্য পত্রিকায় লেখা দিতে, অনন্ত আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন লিখবেন। তিনি নিজে লিখেননি তবে তাঁর এক বন্ধুর করা দ্বিজেন শর্মার একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং সেটা প্রকাশও হয়েছিল। এর আগে অবশ্য তাঁর সম্পাদিত বিজ্ঞানভিত্তিক ছোটকাগজ ‘যুক্তি’র একটা রিভিউ প্রকাশ হয়েছিল অনুপ্রাণনে।

অনন্ত বিজয় দাশের ব্যক্তিগতভাবে পরিচয়ের হিসাব খুব বেশি দিনের না হলেও আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন লেখালেখিসূত্রে। মাঠে-রাজপথে পরিচয় আর এক সঙ্গে কাজ শুরু হয়েছিল মুক্তমনা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর মৌলবাদীদের হামলার পর সিলেটে মানববন্ধনের সিদ্ধান্তগ্রহণ সংক্রান্ত এক সভায়। সেখানে প্রথম সরাসরি আলাপ তাঁর সঙ্গে। সে দিন কেবল আলাপ হয়েছিল কর্মসূচি নিয়ে, পরের দিন আমরা একটা মানববন্ধন করেছিলাম সিলেটে।

এরপর বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। এই আলাপচারিতার থেকেছে কেবল ব্যক্তিপর্যায়ে, নিজেদের লেখালেখি খুব বেশি হয়নি। কারণ তাঁর আর আমার লেখালেখির বিষয় আলাদা- এসবে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ ছিল খুব সীমিত। তবে মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে পরষ্পর মত আর চিন্তার আদানপ্রদান করতাম সুযোগ হলেই, কারণ এই ইস্যুতে আমরা অভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে।

২০১৩ সালের গণজাগরণের সময়ে এক সঙ্গে অনেকদিন আমাদের বসা হয়েছে, স্লোগানে গলা মেলানো হয়েছে। এই সময়ে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ বিষয়ক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার তাঁর মতামত যখনই শুনতে চেয়েছি আমরা তখন খেয়াল করেছিলাম স্বল্পভাষী হলেও দুরদৃষ্ট, চিন্তার গভীরতা অনেক।

গণজাগরণ আন্দোলনকালিন সময়ে তাঁকে নিয়ে অনেক চিন্তা হতো, চিন্তা হতো আমাদের অনেক সহযোদ্ধাদের নিয়েও। আমাদের নামোল্লেখ করে হত্যার হুমকি দিয়ে যেদিন ‘উড়োচিঠি’ আসলো অনন্ত বিজয় আমাকে ফোন করে কেমন আছি, কোথায়-কীভাবে আছি জানতে চাইলেন। টের পেলাম তাঁর কন্ঠের মধ্যে কেমন আতঙ্ক আর উদ্বেগ। তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম ভালো আছি, টেনশন নিচ্ছেন কেন, আমাদের কিছুই হবে না। মজা করে বললাম- আর ওরা ত আমার নামের বানানই ভুল করেছে, ভুল বানানের তালিকা আমি প্রত্যাখ্যান করেছি বলে হেসে ওড়িয়ে দিতে চাইলাম সে আতঙ্ক। আমরা একসঙ্গে হেসে ওঠেছিলাম সেদিন। তারপর বললাম- আপনি ত জঙ্গিদের হিটলিস্টে; থেমে গেছেন? থামবেন না, এভাবেই ত আমাদের চলতে হবে। অনন্ত আমার সঙ্গে একমত হলেন, বললেন- তবু নিরাপদে ত থাকতে হবে। কারণ আমাদের সবার বেঁচে থেকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে!

দেখা হলে মাঝে মাঝে নিজেদের পেশাগত জীবন নিয়ে কথা হতো। আমিও ব্যাংকার ছিলাম, অনন্তও তাই। একটা জায়গায় আমরা একমত ছিলাম ব্যাংকার জীবন গোলামির জীবন বাদ দিয়ে দেবো। অনন্ত হত্যার তিন মাস আগে আমি সে জীবন ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু অনন্ত পারেননি। পেশাগত জীবনে ব্যাংকার থেকেই মৃত্যুমুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে, যদিও এই হত্যাকাণ্ডে পেশাগত জীবনের কোন সম্পর্ক নেই।

অনন্ত হত্যার দিন সকালে যখনই খবর পেলাম ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে সোজা পৌছালাম সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌঁছার পর দেখি আমাদের পরিচিতদের অনেককেই। টিভি চ্যানেলগুলোর ভিড়, কিছু উৎসুক জনতাও ওদিকে। আগে থেকে পৌঁছানো আমার পরিচিতদের কয়েকজন আমাকে অনন্তের লাশের কাছে নিয়ে গেলো। পরিচিত ফটো সাংবাদিকদের একজন এসে বলল- ভাই ওরা অনন্ত দা’র কিছুই রাখেনি, মগজ পর্যন্ত বেরিয়ে গেছে। আমাকে লাশের কাছে নিয়ে যেতে যেতে বলল লাশ দেখেন। আমি মুখে কিছু বলিনি, শুধু ইশারায় জানিয়ে দিলাম- না! কারণ ঐ লাশ আমার সহ্য হবে না।

ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম লাশঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। দেয়ালে এ পিঠ ঠেকানো আমার ইচ্ছাকৃত হলেও মনে হচ্ছিল আসলে আমাদের পিঠ এভাবেই দেয়ালে ঠেকে গেছে। একের পর এক লেখক খুন হবে আর আমরা তাদের লাশ দেখব আর আহাজারি করব, লিখব, প্রতিবাদ করব, মিছিল করব, সমাবেশ করব, মানববন্ধন করব- ব্যস এতটুকুই। এর বাইরে আসলে আমাদের আর কোন ক্ষমতা নেই!

ইত্যবসরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা কাছে এসে টিভিতে কিছু বলার অনুরোধ জানালেন। সাংবাদিকরা আমার পরিচিত বলে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছিল। আমি তাদেরকে বললাম আমি ক্যামেরার সামনে কিছু বলব না, বলতে পারব না। দুপুরে দুইটা টিভি চ্যানেল থেকে বলল তাদের বিকেলের সংবাদে লাইভ অংশ নিতে, রাতের জন্যেও- সবাইকে জানালাম আমি কথা বলতে পারব না। তারাও আমার অবস্থা বুঝে নিয়ে এরপর আর অনুরোধ করেনি।

দুপুরে নাম ভুলে যাওয়া এক পত্রিকার সাংবাদিক ফোন দিয়ে জানতে চায় অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী কয়েসের কোন সম্পর্ক আছে কীনা। আমি তাজ্জ্বব হয়ে গেলাম তার প্রশ্নে। তার যুক্তি হলো খুন হওয়ার আগে অনন্ত এমপি কয়েসের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাকে জানালাম অনন্তের স্ট্যাটাস জাফর ইকবাল স্যারের পক্ষে দেওয়া যেখানে স্বাভাবিকভাবেই এমপি কয়েসের বিরুদ্ধাচারণ করা হয়েছে যেমনটা আমরা অনেকেই করেছি।

সে সাংবাদিক আমাকে জ্ঞান দিতে শুরু করে আমরা নাকি আবেগে কথা বলছি সবাই জঙ্গি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে, এসব। তাকে জানালাম অনন্তের স্ট্যাটাস দেওয়ার মিনিট ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যেই তিনি খুন হয়েছেন আর এভাবে একটা সাদামাটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে যদি কেউ খুন হতো তাহলে দেশে প্রতিদিন অন্তত ৫০জন লোক খুন হতো সরকারবিরোধী ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে। লোকটার কথাবার্তার ধরণে মনে হচ্ছিল কিছু লোক সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

আমি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে অনন্ত বিজয়ের হত্যাকাণ্ডের দিন থেকে আগের ৭৬ দিনে তিন খুনের কাহিনী ও হত্যার ধরণের কথা তাকে মনে করিয়ে দিলাম। বললাম- সব হত্যার ধরণ একই। পেছন থেকে মাথা লক্ষ্য করে চাপাতির কোপ এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যু। তারপর অনেক কথা- আমার নিজের বর্তমান পরিচয় দেওয়ার পর বলল অনন্তের পরিবারের কারও সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। ওখানেই ওর সাথে আলোচনার সমাপ্তি।

একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, অনন্ত বিজয় দাশকে যেভাবে খুন করা হয় ঠিক একইভাবে হত্যা করা হয় রাজীব হায়দার থাবাবাবা, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবুকে। এর আগে অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস এবং অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ- ভিন্ন সময়ে ভিন্ন স্থানে শিকার হলেও তাদের সবার ওপর হামলার ধরণে দেখা যায় গলা থেকে দেহের ঊর্ধ্বভাগ অর্থাৎ মাথাই ছিল আক্রমণকারীদের লক্ষ্য। অধ্যাপক ইউনূস নিহত হয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু হুমায়ুন আজাদ আহত হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় জার্মানিতে মারা যান।

লালনভক্ত ও বাউল দর্শনে বিশ্বাসী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলনের (১৫ নভেম্বর, ২০১৪) ওপর হামলার ধরণও ছিল একই রকমের। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলার পর তিনি প্রাণে বেঁচে যান শীতের সময়ে ভারী পোষাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন বলে। ২০১৩ সালের পহেলা অক্টোবর সাভারে ব্লগার আশরাফুল আলমের ওপর তার বাসায় গিয়ে হামলা করে জঙ্গি মৌলবাদীরা, যাতে তিনি মারা যান সেখানেও তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

খেয়াল করলে দেখা যায়, হুমায়ুন আজাদ (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪), অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস (২৪ ডিসেম্বর, ২০০৪), রাজীব হায়দার ( ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩), আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায় (২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫), ওয়াশিকুর বাবু (৩০ মার্চ, ২০১৫) ও অনন্ত বিজয় দাশের (১২ মে, ২০১৫) সবাইকে আক্রমণ করা হয় রাস্তায়। যাদের মধ্যে শেষোক্ত দুইজনের ক্ষেত্রে হামলা হয় প্রকাশ্যে দিনের বেলায় এবং আগে যা হতো রাতের অন্ধকারে। ফলে এটা প্রমাণ হয় খুনিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে বিশেষত বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে।

অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডের পর খুব তাড়াতাড়ি তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। হত্যাকাণ্ডের দিন প্রথমে ভূমিকম্প এবং পরে নিখোঁজ থাকা বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের সন্ধান সংবাদে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের নিয়ে। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর দুই সপ্তাহ সরগরম ছিল মিডিয়া, ওয়াশিকুর বাবুর হত্যার পর তিন দিন আর অনন্ত বিজয়ের পর তিন ঘন্টা। অথচ অভিজিৎ-অনন্ত এই দেশ, সমাজকে কতখানি দিতে পারতেন সে ধারণাই করতে পারছে না কেউ।

অনন্ত বিজয় বিজ্ঞানমনস্কতার ছোট কাগজ ‘যুক্তির’ সম্পাদনাসহ: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’, ‘পার্থিব’, ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’সহ কিছু বইয়ের লেখক ও সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল ‘একুশ শতকের বিজ্ঞান’ নামের আরেকটি গ্রন্থের যেখানে কী কী বিষয় থাকবে সে সম্পর্কে পরিকল্পনাও ছিল কিন্তু সে আর হলো না, যা তিনি তাঁর কাছের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন।

২০০৬-এর মে মাসে ‘মুক্তমনা রেশোনালিষ্ট’ এওয়ার্ড প্রাপ্ত অনন্ত বিজয়। সিলেটে বিজ্ঞানচর্চাকে ছড়িয়ে দিতে গঠন করেছিলেন ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদি কাউন্সিল’। তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এ সংগঠনের জন্যে যে বিরাট এক আঘাত সে বলার অপেক্ষা রাখে না।

অনন্ত আর জীবিত না এটা আমাদের জন্যে বিশাল এক কষ্টের নাম। ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে খুব বেশি অনুভব করি সে কষ্ট আর বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনে তাঁর চিন্তার কথা সামনে আনলে ব্যক্তিগত সে কষ্ট সার্বজনীন এক হাহাকারে রূপ নেয়।

ব্যক্তিগত পরিচয় আর এক সঙ্গে কিছু কাজ করার সুবাদে অনন্তের মৃত্যু গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। তবু কষ্ট করে নিজেকে প্রবোধ দিই সবাইকে মরে যেতে হয় একদিন যদিও এমন মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। মাঝে মাঝে মনে হয় অনন্ত বিজয়কে আর একবার লেখার জন্যে তাগাদা দিয়ে বলি- অনন্ত আপনি না বলেছিলেন লেখা দেবেন; কই দিলেন না যে? কিন্তু আর সম্ভব কোথায়? জানি তাগাদা দিয়েও লাভ নাই, সব কিছুর উর্ধ্বে ওঠে যাওয়া মানুষ হয়ে গেছেন তিনি। ফেসবুকে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার ঘুরে আসা হয়েছে তাঁর টাইমলাইন, তাঁকে ‘রিমেম্বারিঙ’ করে রেখেছে ফেসবুক। ইনবক্সে কিছু লিখতে যাব কিন্তু সবার ইনবক্স উন্মুক্ত থাকে না যে! এ যেন সত্যিকার অর্থে আকাশের চাঁদ; দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না!

অনন্ত বিজয় দাশের ফেসবুক টাইমলাইন উন্মুক্ত, সেখানে চাইলেই কিছু লিখে আসা যায় কিন্তু আমি লিখব না, আমি লিখছি না; তাঁকে উদ্দেশ করে কিছু লিখে আসার মতো শব্দ-বাক্য আমার ব্যক্তিগত অভিধানে নাই। আমার শব্দভাণ্ডারকে বড় দীন মনে হয় এক্ষেত্রে!

অনন্ত কত দূর আপনি? মনে হয় কাছে আছেন কিন্তু দূর থেকে এভাবে কাছে থাকা যেন এক মৃত্যুযন্ত্রণা। জানি, জানেন না আপনি তা অথচ আমি জানি, আমরা জানি!

অনন্ত বিজয়ের পথে এভাবে যেতে হয় না অনন্ত বিজয়! অনেক কিছু দেওয়ার বাকি ছিল, অনেক কিছু দিতে পারতেন আপনি।

11244714_324787294363115_3238042862285775939_n

ananta